উপন্যাস ২য় পর্ব
চার:
ছোটচাচার ওপর এ্যাটাকের পর, টানা কয়েক দিন ছোটচাচার আবহে থাকার দরুণ অঞ্জলীর ভাবনার জগতে আমূল একটা পরিবর্তন এলো, যেন; ঘুমিয়ে পরা ভাবনার জগৎ সশব্দ কড়ানাড়ায় দড়ফড়িয়ে জেগে ওঠলো। কয়েক মাস আগেও ও ভাবতে পারেনি এমন কোনো পরিবর্তনের কথা বা প্রয়োজনীয়তা। ঠিক এই সময়টাতে দাঁড়িয়ে ওর মনে হয়, যদিও পরিবর্তনের কথা ও ভাবতে পারেনি কিন্তু মনে মনে এরকম একটি পরিবর্তনের অপেক্ষায় ছিল সে। জায়েদের সঙ্গে সংসার ধর্ম পালন করতে করতে বৈষয়িক সুখ-শান্তির অভাব অনুভব না করলেও অন্তঃসার শূণ্য জীবন যাপন ওর ভেতরে ফাঁকা আওয়াজ তুলতো। ভেতরে ভেতরে ও মরে যাচ্ছিল, নিজের অগোচরে।
জায়েদ বাংলাদেশের মতো দেশে নির্ভেজাল এবং স্বচ্চল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পেরেছে নিজের একক প্রচেষ্টায়। অনেক কর্মী ওর প্রতিষ্ঠানের, সবাই নিয়মিত বেতন-ভাতা পায়। জায়েদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোনো দুর্নাম নেই। এমন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকের স্ত্রী হয়ে অঞ্জলীর রুটিন মেনে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরীর করার প্রয়োজন পড়ে না। তারচেয়ে বরং স্বামীর প্রতিষ্ঠানে সুসজ্জিত কেবিনে বাহারি নামের পদবীওয়ালা একটি পদ নিয়ে আরামসে করা যায় এমন কাজ করতে পারতো। জায়েদও তাই চেয়েছিল, প্রথম প্রথম অঞ্জলীকে বলেছিল; তোমার মাস্টারী ছেড়ে নিজেদের ব্যবসা দেখাশুনা করো। আমি একা সব দিক সামলাতে পারিনা।
অঞ্জলী হেসে বলেছিল, একা যা সামলাচ্ছ তাই অনেক। এরচে’ বেশি সামলাতে গেলে সব গুবলেট হয়ে যাবে।
কী দরকার তোমার অন্যের অধীনে ওই মাস্টারীর চাকরী করার? কত কষ্ট। তারচে’ নিজেদের ব্যবসা, নিজেদের অফিস তুমি রাণীর মতো হুকুম চালাবে। সবাই তোমার কথা মানবে।
অঞ্জলী জায়েদের কথায় হাসে, ও কিছু বলতে গিয়েও বলেনা; ওর মুখের কথা আবার বুকে ফিরে যায়, কী লাভ বলে; জায়েদ বুঝবেনা; এখনও বছর বছর অসংখ্য ছেলেমেয়ে ওর মুখের কথা নির্দ্বিধায় মানে, সে ওদের কাছে আইডল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছেলেমেয়েরা নিজেদের স্বপ্ন বুনার পথে অঞ্জলীকে সঙ্গে চায় আবার পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হওয়ার পর ছেলেমেয়েরা হাসি মুখে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, ওদের ভবিষৎ স্বপ্নের কথা শুনিয়ে যায়, নবাগতদের স্বপ্নের কথা শুনতে ওর ভালো লাগে। মাস্টারনী হয়ে এই আনন্দটুকু অঞ্জলী পায় তা ও জায়েদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রাণী হতে গিয়ে খোয়াতে চায়না।
অঞ্জলীর চাকুরী ছাড়ানো নিয়ে জায়েদ আগে খুব বেশি বাড়াবাড়ি না করলেও গত বছর দুয়েক ধরে সে অসম্ভব বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিদিনই এই নিয়ে বাসায় একবার করে হলেও তুলকালাম কাণ্ড করছে। বাবা’র পাল্টে যাওয়া মেজাজে টিনটিন কেমন ঘাবড়ে গেছে আর অঞ্জলী শাশুড়ীর নির্বিকার মুখ দেখে বুঝে নেয় ছেলের রাগের আগুনে মা’ই হাওয়া দিচ্ছেন। টিনটিনের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে অঞ্জলীর মাঝে মাঝে মনে হয়, চাকুরীটা ছেড়ে দেবে, পর মুহূর্তে মনে হয়; এখন পর্যন্ত চাকুরীটা একমাত্র ওর স্বাধীন ইচ্ছা। ক্রমাগত মানিয়ে নেওয়া জীবন যাপনে চাকুরীটি এখন পর্যন্ত ওর একক সিদ্ধান্তের জায়গা। শীতল হয়ে পড়া মেরুদণ্ডে উষ্ণতার পরশ। ওর এতটুকু স্বাধীনতার সজীব হাওয়া। নিজেকে কিউর করে নেয় এই ভেন্টিলেশন থেকে, চাকুরীটা ছাড়লে ওকে জায়েদ পুরোই পেয়ে বসবে।
অঞ্জলীর জীবনে পরিবর্তন ছোটচাচার এ্যাটাকের পর হুট করে হয়েছে তা কিন্তু নয়, বরং পরিবর্তনটি তখন হঠাৎ আকার নিয়ে ও’র চোখে ধরা দিয়েছে বলা চলে। ছোটচাচার প্রতি জায়েদ বা ওর পরিবারের দিনের পর দিন দেখানো অসম্মান আর এ্যাটাকের পর অবহেলা, অঞ্জলীর ভেতরে অনেকদিন পুষে রাখা ক্ষোভ ফেঁপে ওঠেছিল। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ না অন্য কোনো কারণে জানা নেই অঞ্জলীর, প্রথম দিন হাসপাতাল থেকে ফিরে আজিজ মার্কেটে গিয়ে কিনে এনেছিল ছোটচাচার লেখা বা সম্পাদিত সবক’টি বই। বই কিনে বাসায় ফিরে দেখেছিল, জায়েদ তখনও ডাইনিং টেবিলে গম্ভীর মুখে বসে রয়েছে। অঞ্জলীকে ফিরতে দেখে পেছন পেছন গম্ভীর মুখে জায়েদ বেডরুমে এসেছিল, ওর চোখের দৃষ্টি ছিল পুড়তে থাকা কয়লার মতো গনগনে। অঞ্জলী বই’র ভারী ব্যাগটা হাত থেকে নামিয়ে মেঝেতে রাখতে না রাখতে জায়েদ ছুটে এসে ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে ব্যাগটি হাতে তুলে নেয়, ধীর-স্থির জায়েদের এই উগ্র রূপ দেখে ও ঘাবড়ায় না, ওর জানা হয়ে গেছে; জায়েদ বহুরূপী।
কী এগুলো! এগুলো কি?
ব্যাগ ছিঁড়ে বইগুলো টেনে বের করতে করতে জায়েদ উন্মাদের মতো চিৎকার করতে থাকে। অঞ্জলী তখন জায়েদের হাতের ধাক্কায় বিছানার ওপর অর্ধেক বসা আর অর্ধেক শোয়া অবস্থায়। জায়েদ হাতের ধরা বইক’টি অঞ্জলীর গায়ের ওপর ছুঁড়ে মারে, এগুলো কি?
অঞ্জলী কোনো কথা বলেনা, একটি মোটা বই উড়ে এসে ওর বাঁ চোখের কোণায় লাগে, কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন অঞ্জলী অন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে আরও কয়েকটি ঢাউস সাইজের বই ওর গায়ের ওপর এলোপাতাড়ি আছড়ে পড়ে, রেহানা….রেহানা….তোমার এত সাহস বাড়ল কী করে! কী বুঝাতে চাও তুমি আমাকে? আমার ঘরে আবার এই বেজন্মার বই কিনে আনলে?
অঞ্জলী চোখের কোণ থেকে হাত সরিয়ে এনে হাতটি দেখার চেষ্টা করে, দৃষ্টির অন্ধকার কাটলে দেখা যায় আঠালো রক্ত ওর হাতে আর চোখের কোণ বেয়ে টপটপিয়ে পড়ছে রক্তের বিন্দু, সে অবস্থায় ও দৃঢ় কণ্ঠে বলে, খবরদার…চাচ্চুকে নিয়ে আর একটি বাজে শব্দ বলবে না…
জায়েদ লাফিয়ে চলে আসে অঞ্জলীর গায়ের ওপর, হিজাবসহ অঞ্জলীর চুলের গোছা ও দুই মুঠোতে খামচে ধরে; এইসব করে কী বোঝাতে চাস? তুই আমাকে দু’পয়সার দাম দিস না তাই বুঝাতে চাস? নাকি তোর ওই নাস্তিক চাচা মহাপুরুষ, পয়গম্বর হয়ে গেছে তা বুঝাতে চাস? কোন সাহসে ওই কুলঙ্গারের বই তুই আমার বাড়িতে ঢুকিয়েছিস? জায়েদ সমানে গালিগালাজ করতে করতে অঞ্জলীর মাথা ধরে খাটের সঙ্গে কয়েকবার ঠুকে দেয়।
অঞ্জলী জানে, জায়েদ অনেক পুরুষের মতো বহুরূপী। তবে এতো বছরে কখনও জায়েদের এত পাশবিক রূপ দেখেনি। শারীরিক মানুষিক কষ্টে নিমজ্জিত হতে হতে বিগত এক যুগ একসঙ্গে কাটিয়ে দেওয়া মানুষটির মুখের দিকে তাকাতে চেয়েও কিছু দেখতে পায় না,চোখের দৃষ্টি রক্ত আর জলের স্রোতে বন্ধ হয়ে আসে।
জায়েদ অঞ্জলীর চুলের মুঠি থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়, দ্রুত হাতে তুলে নেয় অঞ্জলীর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইগুলো, মেঝের ফাঁকা জায়গাটায় সব বই একত্রিত করে চিৎকার করে বলে, দেখ, দেখ তোর নবীর কিতাব আমি কী করি। দেখ…
অঞ্জলীর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, নিথর হয়ে বিছানায় ঢলে পরার আগে ওর মনে হয়, ও আর কিছু দেখতে চায়না। জায়েদ ওকে দেখিয়ে একটি একটি করে সব ক’টি বইয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘরের মাঝে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে আর কালো ধোঁয়ায় ঘর ভরে যায়। জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে অঞ্জলীর মনে হয়, আগুনের চারধারে ঘুরে ঘুরে জায়েদ উল্লাসে নাচছে।
পাঁচ:
অঞ্জলীর যখন জ্ঞান ফিরে আসে ও রুমে একা, তখনও বিছানায় শোয়া;ওর বোধ কাজ করছিল না; ও কি কোনো দু:স্বপ্ন দেখেছে নাকি ঘটনাটি কিছু আগে সত্যি সত্যি ঘটিয়েছে জায়েদ ও ঠিক বুঝতে পারছিলনা। ঘরে আগুন নেই,তবে তখনও আগুনের উত্তাপ আর ধোঁয়ার কটু গন্ধ ফ্যানের বাতাসে ওড়াউড়ি করছিল। জায়েদও নেই ঘরে। ও বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে বিছানায় ঝড়ে লণ্ডভণ্ড খড়কুটোর স্তুপের মতো পড়ে রয়েছে, ওর পাশে রান্নার খালা ভয়ার্ত চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে পানি হাতে। ধোঁয়ার গন্ধে ওর কাশি আসে, কাশির গমক শেষ হলে অঞ্জলী দেখে ছোট টিনটিন অসহায় চোখে ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে। ও হাত ইশারায় ছেলেকে কাছে ডাকলে টিনটিন ছুটে এসে মা’কে জড়িয়ে ধরে। অঞ্জলী মায়ায় ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলে বুঝে, টিনটিন বাসা থেকে ছিটকে পড়া পাখীর বাচ্চার মতো তিরতিরিয়ে কাঁপছে। ছেলের কপালে চুমু দেবার সময় অঞ্জলী ছেলের গায়ে-চুলে জন্ম মুহূর্তের সোঁদা গন্ধটুকু পায়। ছেলেকে আদর করতে গিয়ে ওর ভেতর কান্না এসে সব ভিজিয়ে দিতে চাইলেও ছেলের সামনে না কেঁদে স্বাভাবিক কণ্ঠে জানতে চায়, রাতের খাবার খেয়েছো আমার টিনটিন ছানাটা?
সে রাতে ঘরে ফেরে না জায়েদ, অঞ্জলীকে আক্রমন করে নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অঞ্জলী কী এক ভয়াবহ ক্ষোভ আর ঘৃনায় একবারের জন্যও স্বামীর খোঁজ করেনা, বরং নিজের কাজে অসম্ভব রকম মনোযোগী হয়ে ওঠে ও। নিয়ম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, হাসপাতালে যায় ছোটচাচাকে দেখতে; গিয়ে দেখে লাইট, ক্যামেরা অসংখ্য সাংবাদিক আর চেনা-অচেনা মানুষের ভিড় কেবিনের সামনে, পুলিশের কড়া পাহারা আর ভিড় দেখে অঞ্জলী ইতস্তত করে। কোনো কোনো দিন পুলিশের পাহারা টপকে ও কেবিনে ঢুকে যেতো। তখন হয়ত ছোটচাচী থাকতো না; ছোটচাচা ঘুম আর চেতনার মাঝামাঝি বেহুঁশ অবস্থানে। ছোটচাচার কিছু বন্ধু-বান্ধব তাঁকে ঘিরে থাকতো সব সময়, যাদের ও একদম চেনেনা। একদিন, অঞ্জলী অনেক সংকোচ নিয়ে রুমের একপাশে দাঁড়িয়ে ছোটচাচার ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছিল তখন একজন পুলিশ জানতে চায়, আপনি কে? উনি আপনার কে হন? অযথা ভিড় বাড়াবেন না আপা, অঞ্জলী বুঝতে পারেনা কী উত্তর দেবে। তখন জনৈক মন্ত্রী তার বিশাল শরীর আর ততোধিক বিশাল বাহিনী নিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে পটপট করে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে। ঘুমন্ত ছোটচাচাকে একজন ডাক্তার ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলেন, দেখুন কে এসেছেন আপনাকে দেখতে! আঘাতে নিস্তেজ হয়ে পড়া বোধ আর কড়া ওষুধের ঘোর কাটিয়ে ছোটচাচা চোখ মেলে ফ্যালফেলে তাকিয়ে থাকে, তাঁর স্বপ্নহিন চোখজোড়া অসহায় আর হতব্হিবল দেখায়। সেই ডাক্তার আবার বলেন, মাননীয় মন্ত্রী এসেছেন! ডাক্তারের কণ্ঠ খুশীতে গদগদ। ছোটচাচা কয়েক মুহূর্ত শূণ্য দৃষ্টিতে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। রোগীর এই ঘুমিয়ে পড়া সম্ভবত মাননীয় মন্ত্রীর ভাল লাগেনা, তিনি চারধারে তাকিয়ে গলা তুলে বলেন, এত ভিড় কেনো? রোগীর তো ইনফ্কেশন হয়ে যাবে। ভিড় কমান। ভিড় কমান। ভিড় করেছিল মন্ত্রীর সঙ্গে আগত সাংবাদিক, ফটো-জার্নালিস্ট হাসপাতালের ডাক্তার নার্স আর মন্ত্রীর একান্ত অনুচররা,তারপরও অঞ্জলী লজ্জায় কুঁকড়ে যায়, ও কেবিন থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে সকলের অগোচরে।
অঞ্জলী বাসায় ফিরে রাতে মায়ের শরীর এবং সুগারের কী অবস্থায় খোঁজ নিতো। ঘুমানোর আগে হারিয়ে যাওয়া পুরনো অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি করে প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত লো ভলিউমে ছেড়ে রাখে। অঞ্জলীর নিস্পৃহতা শাশুড়ীর কাছে অসহ্য লাগে, তাই তিনি ছেলের বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে কাঁদেন। ইনিয়ে বিনিয়ে ফোনে একে ওকে ছেলের নিরুদ্দেশের কথা বলে আর ছেলের মন্দ ভাগ্যের জন্য অঞ্জলিকে দায়ী করে জায়নামাজে বসে খোদার দরবারে আহাজারি করেন। তবুও অঞ্জলী ঠিক করে নেয়, সে কোনো ভাবেই জায়েদের খোঁজ করবেনা, ও গিয়েছে নিজের ইচ্ছাতে ফিরবেও নিজের ইচ্ছাতে। ফিরে আসলে পরে, জায়েদের সঙ্গে ওর কিছু বোঝাপড়া হবে।
আবার ছোটচাচার সবগুলো বই’র একটি সেট ও জোগাড় করেছে। তবে এবার বইগুলো ও আর বাসায় আনেনি, ইউনিভার্সিটির নিজের চেম্বারে টেবিলের ড্রয়ারে বইগুলো রেখেছে। প্রতিদিন বাসায় ফেরার পথে একটি বই ও ব্যাগে করে নিয়ে আসে আবার কখনো ইউনিভার্সিটিতেই অবসর সময়ে বইগুলো পড়ে আর এতদিন না পড়ার জন্য নিজেকে ধিক্কার দেয়। ও লক্ষ্য করেছে, ছোটচাচার বই পড়া শুরু করার পর দু’একজন শিক্ষক ওর দিকে শ্লেষের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সেদিন এক সহশিক্ষক তো বলেই ফেললো, এইসব বই পড়ছেন?
অঞ্জলী কৌতুহলের দৃষ্টিতে শিক্ষকের দিকে তাকালে তিনি বলেন, হুম বুঝেছি। এই লোককে তো কুপিয়েছে। কোপ খাওয়ার পর অনেকে ওর লেখার প্রতি ইন্টারেস্টেড হয়েছে। এখন বাজারে ভালো বিক্রি হচ্ছে এইসব বই। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য আজকাল লোকে কিনা করে। বলেই সহশিক্ষকটি এমন ভাবে হাসতে লাগলো যেন দারুণ এক কৌতুক শুনিয়েছে। অঞ্জলী ধৈর্য্য ধরে শিক্ষকের হাসি শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে, তারপর বলে; সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য লোকে নিজের জীবন চাপাতির নিচে ফেলে?
আরে খোঁজ নিয়ে দেখুন ওর নিজের লোকদের দিয়ে এমন নাটক সাজিয়েছে।
ছিঃ! মানুষ এতো নিচু কী করে ভাবতে পারে! ইনি আমার চাচ্চু।
অঞ্জলী নিজে শিক্ষক হয়েও এতদিন ধরে সে নিজের সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বাইরে অন্যসব পাঠ ছেড়ে দিয়েছিল। এবার ছোটচাচার বই, ব্লগের বিভিন্ন লেখার সঙ্গে সম-সাময়িক ভাবনার নানান রকম বইপত্র জার্নাল পড়তে গিয়ে অঞ্জলী নতুন করে আবার নিজেকে আবিষ্কার করে এক নতুন মানুষে পরিণত হতে থাকে। নিজেকে উপলব্ধি করতে থাকে। ওর মনে হয়, দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকা ওর সুপ্ত বোধেটি ধীরে ধীরে জেগে ওঠছে।
দিন দুই বাদে ছোটচাচার সঙ্গে দেখা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোজা ঢাকা মেডিক্যালে চলে যায় অঞ্জলী। সেদিনের দুর্ঘটনার এখন পর্যন্ত একবারও ছোটচাচার সঙ্গে ওর কথা হয়নি। বেশ কিছু দিন ছোটচাচা অচেতন ছিলেন আর সেদিন মন্ত্রীর কারণে বেরিয়ে আসতে হলো। আজও ছোটচাচার কেবিনের সামনে বেশ কয়েকজন পুলিশ পাহারায় আর কিছু মানুষের জটলা। ছোটচাচী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, চাচীর কথা শেষ হলে ওরা দু’জন এক সঙ্গে কেবিনে ঢুকে।
ছোট চাচা জেগে আছেন তবে এখনও পুরোপুরি বিছানায় শোয়া। বিছানা ঘিরে নানা রকম ডাক্তারী যন্ত্রপাতি তাঁকে পাহারা দিচ্ছে। প্রানবন্ত মানুষটা ব্যাণ্ডেজ মুড়ে কেমন বিছানার সঙ্গে লেগে রয়েছেন। পাশে খোলা পরে রয়েছে একটি ল্যাপটপ, ছোটচাচী কিছু একটা লিখছিলেন ছোটচাচার কথা মতো। অঞ্জলীকে দেখে ছোটচাচার চোখ খুশীতে হেসে ওঠে, দীর্ঘদিন পর তিনি অঞ্জলীকে দেখলেন। ছোটচাচা মৃদু কণ্ঠে অঞ্জলীকে কাছে ডাকলে ও পাশে বসে ছোটচাচার বুকে মাথা রাখে। ছোটচাচার বাণ্ডেজে মোড়ানো হাত জড়িয়ে ধরে অঞ্জলী নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, দীর্ঘদিনের জমিয়ে রাখা কষ্ট দু’চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পরে।
এর মাঝে একজন পুলিশ এসে জানায় মন্ত্রীস্যার রোগীকে দেখতে আসছেন ম্যাডাম। ভিড় কমান…
ছোটচাচা হেসে ফেলেন, যেন পুলিশের কথায় মজা পেয়েছেন। সব আমাদের মানুষ, কোনো ভিড় নেই। মন্ত্রী সাহেব যদি এর মধ্যে আসতে পারেন তো আসতে বলেন। ছোটচাচী বিরক্তির কণ্ঠে বলেন।
উনি কি আর আমার কথা শুনে আসবেন ম্যাডাম? পুলিশ নিজে এবার কৌতুক করে হাসে। এর মধ্যে মন্ত্রী সাহেব তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কেবিনে চলে আসেন আর সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরার ফ্ল্যাস জ্বলে ওঠে, মানুষজন চাপাস্বরে ফিসফাস করে কথা বলে; আটপৌরে হাসপাতাল কেবিন হঠাৎ আলোময় হতে চেয়েও পর মুহূর্তে আবার বিবর্ণ হয়ে থমকে যায়।
এই মন্ত্রীটি বেশ বন্ধু সুলভ, রোগী মাথার কাছে চেয়ারে বসেন, রোগীর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ছোটচাচার শরীরিক অবস্থার খোঁজ নেন, সঙ্গে আসা ডাক্তার বিস্তারিত সব ইনফরমেশন জানান। মন্ত্রী দুঃখী মুখ করে বলেন, বুঝলেন তো, আসলে আমরা কেউ নিরাপদ নই। এই যে আপনারা ভাবছেন, পুলিশ পাহারায় আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমি নিরাপদ। আসলে এইসব অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা যে কোনো সময় যে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আপনাকে কুপিয়েছে আর আমাকে হয়ত গুলি করবে নয়তবা বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে।
আপনি কাদের অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত বলছেন? আমার এ্যাটাকের দায় তো একটা গোষ্ঠি স্বীকার করে ওদের ওয়েভ পেজে জানিয়েছে। সোস্যাল মিডিয়ায় বারবার দায় স্বীকার করা গোষ্ঠিকে আপনারা কী করে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্ত, দুঃস্কৃতকারী বলছেন? ছোটচাচা নিচু অথচ দৃঢ় কণ্ঠে কথাটুকু বলে।
ওহো, তাই নাকি…টুইট করেছে? …হবে হয়ত…
আপনি জানেন না? নাকি বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছেন?
না রে ভাই এড়াবো কেনো? মন্ত্রী অনেক বেশি অমায়িক কণ্ঠে বলেন, আসলে বুঝেন তো, সারাদিন এত ব্যস্ততায় কাটে সব খবর তো আর রাখা যায়না। আমরাও তো মানুষ।
হুম। এতো বড় দেশ, এত মানুষ, কয়েকজন মানুষ কোপ খেয়ে কী গুলি খেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকলে উৎকণ্ঠার কী আছে! আমরা সাধারণ মানুষ ভুলে যাই আপনাদের দেশ উন্নয়নের জন্য প্রচুর কাজ করতে হয়। এসব ছোটখাট ব্যাপার আপনাদের মাথা না ঘামানোই উচিত। তারপরও দয়া করে অনেক কাজের ভিড়ে আমাকে দেখতে এসেছেন তার জন্য ধন্যবাদ।
ছোটচাচা কথাগুলো বলতে বলতে হাঁপিয়ে যান, ক্লান্তিতে চোখ বুঁঝেন। মন্ত্রী সাহেবকে তেমন বিব্রত দেখায় না, তিনি গলা খাকরি দিয়ে হাসপাতালের ডিরেক্টরকে বলেন, রোগীর আরো উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করবেন। দুর্বল হয়ে গিয়েছেন রোগী, পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন।
মন্ত্রী বেরিয়ে যেতে যেতে ছোটচাচীকে বলেন, নিরাপত্তার জন্য আমি আরো পুলিশ বাড়িয়ে দিতে বলেছি। আপনারা একদম ভয় পাবেন না।
ছোটচাচাকে আক্রমন করার পর কিংবা এমনও বলা চলে আক্রান্ত ছোটচাচাকে দেখতে আসার পর থেকে অঞ্জলীর নির্জীব হয়ে পড়া জীবনে অন্য এক হাওয়ার অনুপ্রবেশ ওর অগোচরে হচ্ছিল। সেদিন ছোটচাচার কেবিনে একজনকে দেখে অঞ্জলী প্রথমে বিব্রত পরে আনন্দিত হয়, সুমন। জায়েদের বন্ধু, অঞ্জলীর বন্ধুও ছিল সে; আরও পরে ওদের কারো সঙ্গে সুমনের বন্ধুত্ব টিকে থাকেনা। সুমন এখন কানাডায় থাকে, একটি সফটওয়্যার কম্পানিতে চাকুরী করে, ছোটচাচার জুনিয়র বন্ধু। ছোটচাচার এ্যাটাকের খবর শুনে শুধু তাঁকে দেখতে এসেছে, সুমনের এই আন্তরিকতাটুকু অঞ্জলীকে মুগ্ধ করে। এসময়ে সুমনের দেশে ফেরা নিয়ে ছোটচাচা বিরক্ত হলেন, সুমন ছোটচাচার কথায় কোনো প্রতিবাদের ধারে কাছে না গিয়ে উল্টা বললো, শুনেছেন কনকভাই, সরকার কী বলেছে?
কোন ব্যাপারে?
নাস্তিকদের জন্য গভর্মেন্টের জিরো টলারেন্স। সরকার ধর্ম নিয়ে সমালোচনামূলক কথাবার্তা সহ্য করবে না।
কোনো সময় কী কোনো সরকার ধর্মের বিপক্ষে গিয়ে যুক্তির পক্ষে ছিল! দেখেছো? সব সময়, সব যুগে সরকার আর ধর্ম একে অপরের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ঠিক বজায় রেখেছে।
সে তো অবশ্যই। সেজন্য তো মুক্তচিন্তার মানুষরা যা লিখে বা বলে তাতেই মৌলবাদীদের অনুভূতিতে আঘাত লাগার নাম করে সরকার জাত গেল জাত গেল রব তুলে ক্ষেপা হয়ে নাচতে থাকে। আর সারা রাত ওয়াজের নামে অশ্লীল বক্তব্য প্রশাসন শুনেও ওভারহিয়ার করে। হুজুরদের ওসব নিম্নরুচির ওয়াজ সমাজের মানুষদের মধ্যে কতটা অজ্ঞতা,কতটা মূর্খতা,অমানবিকতার আর অন্ধকার ছড়িয়ে দিচ্ছে তা কোনো সরকার দেখছে না শুধু নিজেদের ভোটের ডিপোজিটের দিকে তাকিয়ে।
ছোটচাচী বলে,অন্য দিকে দেখো চাপাতিওয়ালারা ধুমায়া মানুষ মারছে আর সরকার সন্ত্রাসী খুঁজতে গিয়ে সুন্দরবন উজাড় করে সার্চ লাইট বসাচ্ছে,এই হলো আমাদের সরকারের নীতি।
ছোটচাচা হাসেন, ভালো বলেছ। চাপাতিওয়ালার খোঁজে সুন্দরবন উজাড়…।
তিনজন মানুষের মধ্যে সরকার, রাজনীতি, ধর্ম, ব্লগারদের নাস্তিক উপাধী দিয়ে মৌলবাদীদের উদ্দেশ্য আর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্ক বির্তক জমে ওঠে। ছোটচাচা এখনও টানা কথা বলতে পারেন না, তারপরও যে ক’টি ছোট ছোট কোটেশন তিনি বলছিলেন অঞ্জলী সবগুল নিজের মনের ভেতরে গেঁথে নিচ্ছিল, ওর বারবার মনে হচ্ছিল; ভাবনাগুলো তো ওরও; তবে ও কেনো এমন করে ভাবতে পারেনা!
ছোটচাচার সঙ্গে দীর্ঘ সময় পার করে অঞ্জলী আর সুমন একসঙ্গে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো। করিডোর, লিফ্ট আবার লম্বা করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওদের মধ্যে অল্প কিছু কথা হলেও একবারের জন্যও জায়েদের সম্পর্কে সুমন জানতে চায়না। পার্কিং প্যালেসে এসে আলাদা হওয়ার সময় সুমন অঞ্জলীর দিকে ওর হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যান্ডশেকের জন্য, পারিপার্শ্বিক দ্বিধা নিয়ে, বন্ধুত্বের উষ্ণতায় সে হাত ধরে অঞ্জলী।
কোথায় যাবে তুমি? আমার সাথে গাড়ি আছে,তোমাকে পৌঁছে দেই? অঞ্জলী জানতে চায়।
আজ না। অন্য একদিন দিও।বাই…
অঞ্জলীর হাত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত মানুষের ভীড়ে মিশে যায় সুমন।
অঞ্জলী বাসায় ফিরে দেখে অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন পরিবেশ। বাসা ভর্তি মানুষ, জায়েদের বড় ভাই-ভাবী-তাদের বাচ্চা, ছোট দুই বোন আর তাদের স্বামী এবং বাচ্চারা মিলে পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে বেশ হৈচৈ চলছে। জায়েদের বড়ভাই এবং দুইবোন প্রায় তাদের মা’কে দেখার জন্য এই বাসায় আসে, তা নিয়ে অঞ্জলীর কোনো অনাগ্রহ বা আপত্তি নেই। কিন্তু আজকে সবাইকে দেখে ও ঝড়ের পূর্বাভাস পায়, কেননা; সারা বাড়ি আতর -আগরবাতির গন্ধে ভরপুর! ড্রইংরোমের মেঝেতে বিছানো সাদা চাদর আর উচ্ছিষ্ট খাবার বলে দিচ্ছিল এখানে কিছু আগে মিলাদ মাহফিল ছিলো। ও’কে ফিরতে দেখে পাজামা-পাঞ্জাবী আর টুপি মাথায় টিনটিন দৌঁড়ে এসে মা’র কোলে ঝাঁপিয়ে পরে বলে, জানো মা, বাবা না হারিয়ে গেছে!
তাই? কে বললো তোমাকে?
দাদী বলেছে। বাবা হারিয়ে গেছে।
না টিনটিন বাবা হারায়নি। কাজে বাইরে গিয়েছে, দু’এক দিন পর ফিরে আসবে।
বাবা ফিরে আসবে তো। বাবার ফেরার জন্য হুজুররা তো দোয়া করল, তাই বাবা ফিরে আসবে।
টিনটিন, হুজুরদের দোয়ায় কেউ ফিরে আসেনা। বাবা এমনিতে ফিরে আসবে।
কেনো রেহানা বাচ্চাটার ধর্ম বিশ্বাস নষ্ট করছ? ওকে বিশ্বাস করতে দাও না ওর বাবা আল্লাহর দয়ায় ফিরে আসবে।
ড্রইংরুমের সোফায় বসে তসবি টিপতে টিপতে অঞ্জলীর ভাসুর বলে। অঞ্জলী দেখে ওর শাশুড়ী, জা’ ননদ আর তাদের স্বামীরা ও বাচ্চারা সবাই সাদা কাপড়-চোপড় পরে গা মাথা ঢেকে সুর্মা চোখে তসবিহ জপার নাম করে একত্রিত হয়ে বসে আছে, বুঝাই যায়; সবাই ওর ফেরার অপেক্ষায় ছিল।
আমি ওর ধর্ম বিশ্বাস নষ্ট করছিনা ভাইয়া। ওর বাবা তো ফিরে আসবেই। ওকে বলছিলাম, হুজুরের দোয়ায় ওর বাবা ফিরে আসবে না, নিজের ইচ্ছাতে ফিরে আসবে। আমি চাই না ছোটবেলা থেকে ও একটি ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠুক, বাস্তবতা ভাবতে শিখুক টিনটিন।
বাপ চাচার দেখাইন্না পথ ধরে ওর মাথায়ও বেদ্বীন ভাবানা ভর করছে। শাশুড়ী গরগর করে ওঠে।
জায়েদ আজ এতটা দিন বাসায় ফিরছে না, তুমি তো আমাদের একবার জানানোর প্রয়োজনও বোধ করলে না রেহানা। তুমিও কোনো খোঁজ খবর করছো না। আম্মা বুড়ো মানুষ, জায়েদের চিন্তায় অস্থির হয়ে আমাদের জানালো বলেই জানতে পারলাম। তোমাকে এতটা দায়িত্ব জ্ঞানহীন ভাবিনি।
ভাইয়া জায়েদ কোনো ছোট বাচ্চা বা পাগল মানুষ না যে ও বাড়ির বাইরে গেলে সবাইকে জানাতে হবে বা খোঁজ করতে হবে। ও নিজের ইচ্ছায় গিয়েছে। এরকম ও আগেও গিয়েছে, তখনও আপনাদের জানাইনি, আবার ফিরেও আসছে। এবারও সময় হলে নিজেই ফিরে আসবে, আপনারা অযথাই ভাবছেন।
অঞ্জলী কখনো শ্বশুড়বাড়ির মানুষের সামনে জায়েদের নাম ধরে ডাকে না, স্বামীকে নাম ধরে সম্বোধন করা আমাদের সমাজে বেয়াদপী গন্য করা হয়, আর জায়েদের পরিবারে এটি কবীরা গোনাহর সামিল; আজ শ্বশুড়বাড়ির লোকের সামনে ও সে গোনাহ্ করলো।
রেহানা আমাদের সংসারেও ঝগড়া-ঝাটি হয়। তাই বলে, তোমার ভাইয়া এভাবে সংসার ছেড়ে যায়না, আমি তা হতে দেইনা। পুরুষদের রাগ একটু বেশি হয়, মেয়েমানুষকে তা মানিয়ে চলতে হয়। প্রয়োজনে হাত-পা ধরে হলেও পুরুষ মানুষদের সংসারে আটকে রাখার দায়িত্ব মেয়েমানুষদের নিতে হয়।
ভাবী, কে আপনাদের বললো জায়েদ সংসার ছেড়ে গেছে? ও সেদিন আমার গায়ে হাত তুলে নিজেই বাড়ির বাইরে চলে গেলো। ওকে আমি বের করে দেইনি। আর জায়েদ কোথায় আছে মা তো জানেই। মা’র সাথে ওর কালরাতেও ফোনে কথা হয়েছে।
অঞ্জলীর এই কথাতে সোফার গদিতে ঠেসে থাকা মানুষগুলো কেমন হকচকিয়ে নড়েচড়ে ওঠে, এমন বেফাঁস কথায় সবাই অসন্তুষ্ট হয়েছে।
হ্যাঁ আমার সঙ্গে জায়েদের কথা হইছে। তাতে কী? আমার ছেলে তো আর বাসায় ফিরে আসেনি। না জানি কোথায় আছে?
অযথা আপনারা লোক দেখানোর জন্য এইসব মিলাদ করছেন কেনো?
লোক দেখানোর লাইগা রেহানা! তুমি তো মা না, মা যদি হইতা নিজের সন্তানকে বুয়ার কাছে রাইখা সারাদিন বাইরে কাটায়া আসতে পারতা না। আমি মা, আমি জানি আমার ছেলে ঘরে না ফেরার কষ্ট। আমি আমার ছেলেরে যেকোনো মূল্যে ঘরে ফেরত চাই।
সবাই’র রুষ্টমূর্তি দেখে অঞ্জলী বুঝে নেয় একটা পরিকল্পিত নাটকের মাঝে ও দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওকে দিয়ে এরা সবাই কিছু একটা করাতে বা বলাতে চায়। অঞ্জলীর ভেতরে রাগের বাষ্প ফোঁসফোসিয়ে ওঠে, জায়েদ সেদিন ওর গায়ে হাত তুলেছে আবার নাটক সাজিয়ে পরিবারের সবাই’কে দিয়ে ওকে হেনস্থা করার ব্যবস্থাও নিয়েছে! অঞ্জলীর আর কথা চালাতে ইচ্ছে করে না, ও নিজের রুমে চলে যায়।
বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বেরুলে জায়েদের ভাই-ভাবী আসে ওর ঘরে। তাদের দু’জনের মুখে নির্মল স্নেহ সুলভ হাসি এবং ও বুঝে নেয় পরিকল্পিত নাটকের এটি দ্বিতীয় অংক!
রেহানা। জায়েদ যদি তোমার গায়ে হাত তোলার মতো কিছু করে থাকে তবে আমি লজ্জিত। জায়েদের কাছে এমন আশা করিনি, ও এমন কিছু করতে পারে আমরা ভাবতে পারিনা। আমরা ভেবেছিলাম, সাধারণ দাম্পত্য কলহ, রাগের মাথায় ও বাড়ি ছেড়েছে। মাও তাই বলছিল।
অঞ্জলীর একবার মনে হয়, ওর ভাসুর হয়ত সত্যি সত্যি ভাই’র কারণে অনুতপ্ত। তিনি একটি বেসরকারী ব্যাংকের জাঁদরেল এমডি হয়েও ভাইয়ের কৃতকর্মের অনুশোচনায় লজ্জিত আর ম্রিয়মাণ। পর আবার মনে হয়, সাধারণ দাম্পত্য কলহের জন্য সবাই মিলে মিলাদ পড়াতে আসছে…চমৎকার!
রেহানা, তারপরও…। জা বোঝানোর সুরে বলে, জায়েদ বাসা থেকে আজ কয়েকদিন বাইরে আছে। হয়ত তোমার কাছে লজ্জিত বলে বাসায় ফিরছে না। তুমি যদি একটা ফোন করো, দেখো ও ফিরে আসবে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে এরকম তো হতেই পারে, এটাকে বড় করে দেখা ঠিক না। আর মা বুড়ো মানুষ, জায়েদ তার আদরের ছোট ছেলে, পুত্রশোকে তিনি কেমন কাতর হয়ে পরেছেন। জেদ করো না আর….
অঞ্জলী কোনো কথা না বলে ভাসুর জা’র কথা শুনে যায়।
জায়েদ ফিরলে তুমি ওকে বকে দিও…। জা’র কথা শুনে অঞ্জলীর হাসি পায়, জায়েদ যেন ছোট খোকা!
ভাসুর মাথা নেড়ে জা’র কথায় সম্মতি জানিয়ে বলে, আর একটা কথা রেহানা, তোমার চাচার সাথে যা হয়েছে তা নিয়ে আমরা সবাই দুঃখিত। আমরা উনার জন্য আল্লার দরবারে দোয়া-দরুদ করেছি, তার দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য খতমে ইউনুস পাঠ করানো হয়েছে। আল্লাহ্তালা উনাকে হেদায়েত করুণ, উনাকে ঈমানের পথে নেকের পথে আসার তৌফিক দান করুণ। কিন্তু এটাও তো সত্যি; তোমার শুনতে খারাপ লাগতে পারে, উনার মতো মানুষের সাথে সম্পর্ক রাখা আমাদের জন্য সামাজিকভাবে যেমন বিব্রতকর তেমনি ধর্মীয়ভাবে গুনাহেরও। উনার মতো একজন স্বীকৃত নাস্তিক মানুষ আমাদের রিলেটিভ হন, এটা সমাজে দেওয়ার মতো পরিচয় না। আমরা বুঝি তোমার খারাপ লাগবে, তারপরও ধর্মের কারণে, সমাজের দিকে তাকিয়ে, সংসার আর পরিবারের সম্মানের দিকে তাকিয়ে তুমি তোমার চাচার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দাও।
ভাসুরের কথা শোনার পর অঞ্জলীর মুখে কথা যোগায় না, কিছু বলতে চেয়েও পারেনা; চোয়াল দু’টি শক্ত হয়ে পরস্পর লেগে আসে। ভাসুর তার কথা শেষ করে ওঠে পড়লে জা ওর পিঠে হাত রেখে আবারও নরম কণ্ঠে বলে, জায়েদ কি আর তোমাকে মন থেকে মেরেছে? পুরুষ মানুষ, রাগের মাথায় হয়ত হাতটা ওঠে গেছে। দেখছো না তোমার গায়ে হাত তুলে নিজেই কেমন শরমিন্দা হয়ে তোমার কাছ থেকে পালিয়ে আছে।… রাতেই ফোনটা করো রেহানা। জায়েদ তোমার ফোনের অপেক্ষায় আছে।
ছয়:
ভাসুর আর জা’র অনুরোধ রাখতে পারেনা অঞ্জলী, নিজের ভেতর কোনো স্পৃহা বোধ করে না ও জায়েদকে ফোন করার। অঞ্জলী ফোন করে অভিমান ভাঙানোর কোনো চেষ্টা না করলেও পরের দিন সন্ধ্যায় নিজে ফিরে এসেছিল জায়েদ। আরো শান্ত-শিষ্ট-ভদ্রতা সৌম্যতার মোড়কে নিজেকে মুড়িয়ে বাসায় ঢুকে সোজা চলে গিয়েছিল মা’র ঘরে, আম্মা আমাকে মাফ করে দাও। তোমাকে আর কষ্ট দেবো না। মা’র পা জড়িয়ে বিলাপ করে কান্না জুড়ে দিয়েছিল সে। বেডরুমে বসে জায়েদের হেঁড়ে গলার কান্না শুনতে পায় অঞ্জলী, বিস্মিত হয়ে ভেবে পায়না কেন ওরা মা-ছেলে মিলে এমন নাটক তৈরী করছে! জায়েদ দশ দিন পর বাসায় ফিরেছে, কিন্তু বাসা ছাড়ার পরের দিন থেকে ও নিয়মিত মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। অঞ্জলী জানে, কাজটি ও ঠিক করেনি; গোপনে শাশুড়ীর মোবাইলের ইনকামিং আর আউট গোয়িং লিস্ট একবার দেখে নিয়েছিল। ছেলে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাতে জায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখাটা ওর জন্য সহজ হয়েছে। তা না হলে, শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে হলেও হয়ত ও জায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। এখন জায়েদের ফিরে আসাতে অঞ্জলীর মধ্যে আলাদা কোনো ভাবনা আসেনা, ও জানত; ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে। ওর সঙ্গে ঝগড়া ছাড়াও জায়েদ মাঝে মাঝে বিভিন্ন রকম ইসলামি দাওয়াতে দেশে বা দেশের বাইরে যায়। যখন ফিরে আসে তখন দেখা যায় চেহারায় একটি নূরানী ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য সে আতর আর সুর্মা ব্যবহার করেছে। আতরের গন্ধে অঞ্জলীর বমিভাব হয় বলে জায়েদ আর পরে আতর কন্টিনিউ করেনা। সুর্মাও ওর চোখে বেশি দিন থাকে না। জায়েদের অনুপস্থিতি নিয়ে সবাই অযথা হাউকাউ করলেও বরং এই ক’টা দিন অঞ্জলী ভাবার অবকাশ পেয়েছে, নিজেকে নিয়ে; নিজের অস্তিত্ব আর স্বাধীনতা নিয়ে।
রাতে খাবার টেবিলে রেহানার সঙ্গে জায়েদ মুখোমুখি হয়। সেদিন রেহানার গায়ে হাত তোলা ও নিজের বর্বরোচিত পাশবিক রূপের তীব্রতা এমন নগ্ন ভাবে প্রকাশ হয়ে যাওয়াতে জায়েদ নিজে কুণ্ঠিত ও বিব্রত, ওর দৃষ্টি নত। কিন্তু ওর মতে এটিও সত্যি ও কোনো অন্যায় করেনি, অবাধ্য স্ত্রীকে শাসন করার অধিকার ওর রয়েছে। খাবার টেবিলে রেহানার ব্যবহারের স্বাভাবিকতা ওর দৃষ্টি এড়ায় না। এত নিরুত্তাপ ব্যবহার যেন জায়েদ মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট টেনে এসে খেতে বসেছে! রেহানার মাঝে ওর জন্য অপেক্ষা বা উপেক্ষা কোনোটি ও খুজেঁ পায়না, বরং নির্লিপ্ততা দেখতে পেয়ে ওর বুকের ভেতর খচখচ করে। কী এমন কামাল হয়ে গেল, ওর হাতে গড়া কাঁদার মূর্তিটি এমন বদলে যাচ্ছে দিনকে দিন!
ছেলে ফিরে আসা উপলক্ষ্যে মা রাতের খাবারের জন্য অনেক পদ রান্না করেছেন, ছেলের পাশে বসে এটা সেটা বেড়ে দিচ্ছে কিন্তু জায়েদ মা’র স্নেহের উত্তাপ উপভোগ করতে পারেনা। সে কিছুটা দ্রুতই খাবার শেষ করে ওঠে যায়।
জায়েদের চোখ সরিয়ে নেওয়া অঞ্জলীর দৃষ্টি এড়ায় না, এটা ওর স্বভাব; ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার পর কিছু দিন এমনি মাথা নিচু করে থাকে, তারপর আবার যে কে সে। দ্রুত খাওয়া শেষ করে জায়েদ ওর রিডিং রুমে গিয়ে ঢুকে। আসলে ওই রুমটি যত না জায়েদের রিডিং রুম তারচে’ বেশি ওর অফিস কাম পারসোনাল রুম। এই রুমে জায়েদ ওর বন্ধুদের সঙ্গে গল্প গুজব করে, ব্যবসায়িক পার্টনারদের সঙ্গে মিটিং করে, মাঝে মধ্যে হালাকার বিশেষ সভাও এখানে বসে। রাত বেশি হলে রিডিংরুমের ডিভানে শুয়ে ঘুমিয়েও যায়। টিনটিন হওয়ার পর থেকে প্রায় রাতই জায়েদ ওঘরে ঘুমায়, মাঝে মাঝে শারীরিক চাহিদার জন্য বেডরুমে এসে অঞ্জলীর পাশে শোয়। আজও জায়েদ তেমনি রিডিংরুমে হয়ত রাত কাটিয়ে দেবে।
নারী যখন গভীর ঘুমে ডুবে গেছে, ওর শরীরের সব ক’টি পেশী-শিরা-উপশিরা-তন্ত্রীতে ঘুমের রেশ শীতলতা ছড়িয়ে দিয়েছে, বস্তু জগতের কোনো কিছুর সঙ্গে ওর কোনো সংস্পর্শ নেই তখন পুরুষের হাত ওর শরীর কামের স্পর্শে নাড়াতে লাগলো। দোলাতে লাগলো। পুরুষ হাতের অবাধ্য পেষণে নারীর শরীর দলিত হতে হতে, পুরুষের বলিষ্ঠ দু’হাতের পেষণে নারীর শরীর অন্ধকার শেষে ভোরের আলোর মতো অপার্থিব শিহরণে নিমজ্জিত হতে হতে, আবার অনাকাঙ্খিত স্পর্শে নারীর শরীর নিজের বিষের থলি বিস্মৃত হয়ে সাপের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে নিজেকে রক্ষা করার কৌশল যেমন ভাবে তেমনি মুহূর্তে কুণ্ডলি ছাড়িয়ে ফনা তুলে ছোবলও হানে। এই তো নারী! তেমনি আজও নারীটি শিহরিত হতে হতে, বিকশিত হতে হতে পূর্ণমাত্রায় জেগে ওঠে। নারী প্রতিরোধ করতে চেয়ে প্রথমে সে নিজেকে গুটিয়ে কুণ্ডলি তৈরী করতে চায়।
অঞ্জলীর ঘুম ভাঙলে ও বুঝতে পারলো ওর দুই ঠোঁট অন্য দুই ঠোঁটের মাঝে আটকা পড়ে গেছে। ওর ওপর উপুড় হয়ে থাকা জায়েদের তপ্ত নিঃশ্বাস থেকে সিগারেটের কটু গন্ধ আর শরীরের আতরের বিকট গন্ধে বমি আসার আগে ও সজোরে জায়েদকে ধাক্কা দিল। জায়েদ কিছুটা অঞ্জলীর শরীর থেকে আলগা হলেও পুরুপুরি সরে যায়না। সজোরে দু’হাতে অঞ্জলীকে ঝাপড়ে ধরে ঘাড়ে গলায় ঠোঁট বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করে, আমি। আমি। রেহানা তোমার আমি।
নিজের নামটি অঞ্জলীর সারা শরীরে বিচ্ছুটির ছোঁয়ার মতো লাগে। ও আবারও সজোরে জায়েদকে ধাক্কা দিয়ে নিজের শরীরটিকে মাছের মতো ঘাই দিয়ে জায়েদর নিচ থেকে সরিয়ে আনে বিছানার অপর পাশে গিয়ে ওঠে বসে, তুমি এখানে কেনো?
আমি রেহানা! কী হলো? জায়েদ অঞ্জলীর দিকে হাত বাড়ায়।
খবরদার!
অঞ্জলী সাপের মতো হিসহিসিয়ে ওঠে। জায়েদের বাড়ানো হাত গুটিয়ে নেয়।
আমি চিৎকার করবো। এক্ষুনি বেরিয়ে যাও এ রুম থেকে।
চিৎকার করবে! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে রেহানা?
তুমি না বের হলে আমি চিৎকার করবো। তুমি আমাকে রেপ করতে চাও?
রেপ! আমি তোমার স্বামী হয়ে তোমার সাথে শুতে চাচ্ছি আর তুমি বলছো আমি তোমাকে রেপ করতে চাই!
আমি তোমার সাথে শুতে চাচ্ছি না।
তোমার সাথে শোয়া আমার হক।
ছি:
ছি:! তোমার এত জেদ ভালো না…
এখন যাও। সকালে আমার ভার্সিটি যেতে হবে।
তোর ওই বালের চাকরী যদি আমি না ছাড়াই…
এখন যাও।
অন্ধকারে কয়েক সেকেণ্ড নীরবে বসে থাকে জায়েদ। তারপর হঠাৎ দুদ্দাড় শব্দ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বিশাল বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা টিনটিনের কাছে নিজেকে টেনে নিয়ে অন্ধাকার গহ্বরে তাকিয়ে থাকে অঞ্জলী। ও নিজেও বুঝতে পারেনা হঠাৎ কী হয়ে গেল! ও যদিও মনে মনে জায়েদের অনুপস্থিতির দিনগুলোতে নিজেকে নিয়ে, নিজের পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভেবেছে কিন্তু মধ্যরাতে জায়েদের সঙ্গে এভাবে ধস্তাধস্তি করতে হবে ভাবেনি। ভাবেনি জায়েদকে এভাবে প্রতিরোধ করে প্রতিবাদ করবে। নিজের এই সাহস ওর ভেতর অনুপ্রেরণার বোধ জাগিয়ে তোলে, নিজের ভেতরে এখনও তাহলে এক টুকরো লুকনো আগুন আছে!