জন্মালাম,দাগ রেখে গেলাম

Share this:

শুদ্ধস্বর-এর তিন দশক হচ্ছে, ভাবতে অবাক লাগছে। আবার অবাকও হইনা কারণ মেঘে মেঘে হলো তো অনেক বেলা। শুদ্ধস্বর-ও তো পেরিয়ে এলো অন্তবিহীন পথ, স্বপ্ন তবু অনন্ত।

মনে আছে, বইমেলায় শুদ্ধস্বর-এর ছোটখাটো স্টলে ভিড় দেখে ভাবতাম-কী আছে তার পেটিকায়! পরে তো দেখলাম, আছে আছে -স্বপ্নের গুচ্ছ আছে শুদ্ধস্বর-এ। এমন অনেক বই যা অন্য কোনো প্রকাশনী দ্বিতীয় বা তৃতীয় গুরুত্বে বের করে, শুদ্ধস্বর সেটাইকে করল প্রথম ও প্রধান প্রকাশের বিষয়। তাই নতুনতাকামী পাঠকেরা ভিড় করতো শুদ্ধস্বর-এর সামনে কারণ শুদ্ধস্বর সামনে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় ধারণ করে ছিল, শুরু থেকেই।

শুদ্ধস্বর- তো সেই জায়গা যেখানে কমলকুমার মজুমদার থেকে মোস্তাক আহমাদ দীনের বই পাওয়া যেতো সমগুরুত্বে। সেই শুদ্ধস্বর-এর স্বপ্নমানুষ টুটুল ভাই যখন ২০১০ সালের এক সকালে যুক্ত হতে বললেন ‘শুদ্ধস্বর’-এর সঙ্গে, তখন মনে হয়েছিল আমি তো এমন একটি ডাকের জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। শুদ্ধস্বর-এর আজিজ মার্কেটের অফিস আসলে আমার শিক্ষাস্থল, বিশাল বিশ্বের   সঙ্গে সংযোগস্থল। টুটুল ভাই মানুষটা দেখতে আপাত গম্ভীর কিন্তু ভেতরে হৃদয়বত্তার উদার প্রস্রবণ প্রবাহিত সবসময়। তাই তাঁর প্রণোদনায় শুদ্ধস্বর একসঙ্গে জড়ো করতে পেরেছিল বাংলাদেশের সাহিত্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্ভার। সৈয়দ শামসুল হকের মতো বিশিষ্টজনের জন্মদিনে কবিতার বই প্রকাশের রীতি চালু করে শুদ্ধস্বর যেমন তাঁকে বিস্মিত করতে পেরেছিল তেমনি অভিজিৎ রায়ের ‘সমকামিতা’-র মতো ট্যাবু-ভাঙা বই প্রকাশ করো শুদ্ধস্বর অর্গল ভাঙার গান  গেয়েছিল। ‘শুদ্ধস্বর’ এতটাই বিশ্বস্ত স্বর হতে পেরেছিল যে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান নিজ থেকে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন এখান থেকে তাঁর বই প্রকাশ করতে,  আবদুশ শাকুরের মতো লেখক অসুস্থ শরীরে নিজে চলে এসেছেন শুদ্ধস্বর অফিসে, তাঁর বইয়ের কাজে। এইতো সেদিন চলে গেলেন আবুল হাসনাত। সবাই তাঁকে নিয়ে শোক করছে কিন্তু এটা কাউকে বলতে দেখলাম না যে, সম্পাদক পরিচয়কে ছাপিয়ে তাঁর লেখক-পরিচয়কে বড়ো করে দেখে শুদ্ধস্বর প্রকাশ করেছে তাঁর কবিতা, শিশুসাহিত্য ও প্রবন্ধের ৬টি বই।

বইমেলায় ‘জনপ্রিয়’ লেখকদের বিজ্ঞাপন-বোর্ডের ঐতিহ্য ভেঙে শুদ্ধস্বর-ই তো সেই প্রকাশক, যে কনিষ্ঠতম লেখকটির সচিত্র পরিচয়কে তুলে ধরেছে। অনেক লেখক আমাকে বলেছেন, ‘জীবনে কোনো প্রকাশক প্রথম আমাকে এমন সম্মান দিল।’

শুদ্ধস্বর-এ বাংলা ব্লগকে সম্মান করে কয়েকটি  ব্লগের গল্প সংকলন প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্য ও চিন্তাচর্চার অধুনান্তন ব্যাপ্তিকে ধারণ করেছে।

ব্যক্তিগতভাবে এসব কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে যেমন বাংলা প্রকাশনা সম্পর্কে আমার ছিটেফোঁটা ধারণা লাভ হয়েছে তেমনি আমার নিজের কবি বা প্রাবন্ধিক হিসেবে শুদ্ধস্বর-এর কাছ থেকে বা শুদ্ধস্বর-এর সূত্রে পাওয়া স্বীকৃতি ও সম্মান কখনও ভুলবনা।

২০১৩ সালে আমার ‘গোধূলিগুচ্ছ’ আর আল মাহমুদের ‘সনেটসমগ্র’ বই দুটো বের করলেন টুটুল ভাই। মেলা শেষে সানন্দে বললেন, আপনার বই আল মাহমুদের চেয়ে ২টা বেশি বিক্রি হয়েছে। এই তথ্যটা টুটুল ভাই না বললেও পারতেন কিন্তু তিনিই তো তা জোর গলায় বলবেন কারণ তাঁর হাত ধরে শুদ্ধস্বর হয়ে ওঠেছিল তারুণ্যের জয়তরণী। ২০১২ সালে শুদ্ধস্বর প্রকাশিত আমার প্রবন্ধের বই ‘করুণ মাল্যবান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’-এর জন্য জীবনের প্রথম পুরস্কার ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার’ অর্জনের আনন্দ তো সারাজীবন ঘিরে থাকবে আমাকে।

শুদ্ধস্বর আজিজ মার্কেট থেকে লালমাটিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে, বইমেলায় তার পরিসর বেড়েছে, শুদ্ধস্বর প্রকাশিত একের পর এক বই দেশের সেরা সব পুরস্কার লাভ করেছে, বইমেলা কর্তৃপক্ষ শুদ্ধস্বরকে সম্মানিত করেছে, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে শুদ্ধস্বর-এর পরিচিতি। শুদ্ধস্বর ‘বিকল্প ধারার প্রকাশনী’-গুলোকে প্রধান হয়ে ওঠার সাহস ও স্বপ্ন জুগিয়েছে। তরুণদের গুরুত্বের কেন্দ্রে রেখেই যে নতুন চিন্তাধারার বিকাশ ঘটাতে হবে; সেটা শুদ্ধস্বর রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে।

শুদ্ধস্বর-এর লেখক অভিজিৎ রায় একুশে বইমেলায় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলেন, প্রাণ দিলেন। শুদ্ধস্বর তবু পিছু হটেনি। শুদ্ধস্বর নতুন চিন্তার সারথি হয়ে ধারণ করে গেল অভিজিৎ-এর মতো নব চিন্তার নায়কদের। এর ফল ভোগ করতে হল। কীভাবে হলো, তা তো সবারই জানা। শুদ্ধস্বর-এর প্রকাশক টুটুল ভাই ও সুহৃদ লেখক রণদীপম বসু,  তারেক রহিম আহত হলেন ;সেই মৌলবাদী টার্গেটে। শুদ্ধস্বর-এর অফিসে রক্ত ঝরল, যেমন রক্ত এই ঢাকাতেই দূর অতীতে ঝরেছিল সোমেন চন্দ বা নিকট অতীতে হুমায়ুন আজাদের গা বেয়ে। রক্তের ধারায় শুদ্ধস্বর তাট মহিমা প্রকাশ করল।

আমার আজও মনে পড়ে, টিভিতে খবরটা শুনে ব্যগ্র হয়ে আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও সেলিনা হোসেনের ফোন। একজন প্রকাশককে কতটা আস্থার ভাবলে তাঁরা বিচলিত হয়ে ক্রন্দনসিক্ত-উদ্বেগাকুল কণ্ঠে খোঁজ নিতে পারেন, সেটা ভাবছিলাম।

‘শুদ্ধস্বর’ আর আগের অবস্থায় নেই তবে ‘শুদ্ধস্বর’ মরেও নাই। কারণ অল্প সময়েই ‘শুদ্ধস্বর’ প্রকৃতই  হয়ে ওঠতে পেরেছিল সময়ের ‘শুদ্ধস্বর’।  আর আমরা তো জানি, মাধ্যম পরিবর্তিত হলেও মহিমায় কোনো শুদ্ধস্বরেরই মৃত্যুনিয়তি নেই কখনও।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের ‘জন্মেছিস, দাগ রেখে যা’ কথাটাকেই তো যেন শুদ্ধস্বর আমাদের সমকালে যেন প্রতিপন্ন  করে গেল এই রক্তদায়ী আত্মঘোষণায় ‘জন্মালাম, দাগ রেখে গেলাম’।

 

 

Pias Majid is Assistant Editor at the Bangla Academy, Dhaka. He has written and published 20 books, including poetry, short stories, and articles both on Bengali and world literature. He is editor of 30 books, including a volume on William Shakespeare’s 400th Death Anniversary. He has received several awards for his writing.

 

 

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!