জন স্টুয়ার্ট মিলের সত্যতার দাবী

Share this:

অনুবাদকের ভূমিকা: যেকোনো একটি বিষয়ে মত প্রকাশ করতে গিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ ভাগ হয়ে বিশাল কলহ বাঁধিয়ে তোলার ব্যাপারে আমরা বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছি। বিষয়গুলোর কোনটা কেমন গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার সে প্রসঙ্গেও আমরা নিশ্চিতভাবে বিবদমান দুটি পক্ষকে মাঠে পেয়ে যাব। উভয়পক্ষ তাদের মতামতকে ‘একমাত্র’ সত্য ও ন্যায্য বলে দাবি করে থাকে। যুক্তির পথ অনুসরণ করে যদি আমরা এই মতামতগুলোর মধ্যে সত্যতা অনুসন্ধান করতে যাই, তাহলে কী দেখতে পাব? ব্রিটিশ প্রয়োগবাদী দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ অন লিবার্টিতে (১৮৫৯) সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে স্বকীয় নৈতিক মত প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সত্যতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ইউরোপীয় সভ্যতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে খ্রিষ্টীয় নৈতিকতাকে আমলে নিয়ে তিনি উদারনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন। বিরুদ্ধ কোনো মত যদি সমাজ ও রাষ্ট্রে কোনঠাসা হতে হতে হারিয়ে যায় তাতে মানবজাতির কী ক্ষতি হয় তা তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর খ্রিষ্টীয় নৈতিকতার সমালোচনার বিষয়টি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। বহুত্ববাদী ও ইহজাগতিক একটি সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরির লড়াইয়ে প্রভাবশালী কোনো ধর্মীয় নৈতিক ব্যবস্থার সাথে বোঝাপড়া আমাদের কেমন হওয়া উচিত তার কিছু আভাস আমরা পাব এই লেখায়। মূল রচনাটি অন লিবার্টি গ্রন্থের অব দ্য লিবার্টি অব থট অ্যান্ড ডিসকাশন প্রবন্ধের একাংশ।

অনুবাদক: জাকির হোসেন

বাস্তব জীবনে পরষ্পর সাংঘর্ষিক মতবাদগুলো যেমন গণতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্র, সম্পত্তি এবং সমতা, সহযোগিতা এবং প্রতিযোগিতা, বিলাস এবং মিতাচার, সামাজিকতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা এবং শৃঙ্খলা ইত্যাদি নিজ নিজ পক্ষের কন্ঠস্বরগুলোকে যদি স্বাধীনভাবে বলতে না দেওয়া হয়, যদি বিবদমান দু’পক্ষের নিজস্ব মতামতগুলোকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করার এবং সুরক্ষিত করার জন্য সমান মেধা এবং কর্মশক্তি বিনিয়োগ করতে না দেওয়া হয়, তাহলে উভয়পক্ষই সমানভাবে তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝে পাবে না। যে-কোনো একটি পক্ষ নিশ্চিতভাবেই প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং বিপরীত পক্ষ মুখ থুবড়ে পড়বে। সত্য সম্পর্কে জীবনের একটি বৃহৎ শিক্ষা হলো, সত্য মূলত একাধিক বিপরীতধর্মী চিন্তাকে সংযুক্ত করা এবং তাদের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করার প্রশ্নের সাথে জড়িত। তবে খুব কম ব্যক্তিরই এই কাজের উপযোগী যথেষ্ট প্রশস্ত এবং নিরপেক্ষ মন আছে যা দিয়ে তারা বিভিন্ন বিপরীতর্মী চিন্তার দ্বান্দ্বিক দিকগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে ফেলতে পারবে। এই কাজ করতে চাইলে পরষ্পর শত্রুভাবাপন্ন দুটি পতাকার নীচে যুদ্ধরত দুটি পক্ষকে সামলানোর মতো কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। পূর্বোক্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের ক্ষেত্রে যদি দুটি বিপরীত মতামতের মধ্যে একটির দাবি জোরালো হয়, তবে তাকে শুধু নিষ্ক্রিয়ভাবে সহ্য করে গেলেই হবে না, তাকে উৎসাহিত করতে হবে এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। সাধারণত কোনো একটি নির্দিষ্ট সময় এবং স্থানে উক্ত মতাবলম্বীরা সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগণিত হয়। যুগ যুগ ধরে সেই মত ‍উপেক্ষিত স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং মানব কল্যাণের একটি দিকের উপস্থাপন করে যা তার নিজ প্রাপ্য বুঝে না পাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে আমি এই বিষয়ে সচেতন আছি যে, আলোচ্য বিষয়গুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই দেশে ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার কোনো অভাব নাই। একাধিক দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সত্যতা সম্পর্কে এই বিশ্বজনীন ধারণাটি পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মানব বুদ্ধিমত্তার অসম্পূর্ণ অবস্থার ক্ষেত্রে, বিদ্যমান চিন্তা এবং মতামতের বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাবেশের মধ্যে দিয়েই কেবল কোনো একটি বিশেষ সত্যের বিভিন্ন দিকের সাথে সুবিচার করার সুযোগ তৈরি হয়। জাগতিক কোনো একটি বিষয়ে যদি আপাতদৃষ্টিতে সকলের ঐক্যমত ‍প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বলে মনে হয় এবং তারপরেও যদি কতিপয় মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় যারা সে ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করে থাকে, এমনকি পুরো জগৎবাসী যদি সেক্ষেত্রে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েও থাকে, তবুও সে ভিন্নমতাবলম্বীদের কাছে থেকে জগতের শোনার মতো কিছু অবশিষ্ট থাকে; তাদের নীরবতার সাথে সাথে সত্যতার কিছু অংশ হারিয়ে যেতে পারে।

শুনে আপত্তিকর বলে মনে হতে পারে, কিন্তু কতিপয় মানুষ বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করে থাকে বিশেষতঃ সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে, যেগুলো আসলে অর্ধসত্যের চেয়ে কিছু বেশি। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিষ্টীয় নৈতিকতা এই দিক দিয়ে একটি সর্বৈব সত্য বিষয়। কেউ যদি এর চেয়ে আলাদা কোনো কিছুর শিক্ষা দেয় তাহলে সে পুরোপুরি ভ্রান্ত। বাকি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অনুশীলনের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে অন্য কেউই এ জাতীয় বেদবাক্য পরীক্ষা করার মতো উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে না। খ্রিষ্টীয় নৈতিকতা কী এবং কী নয় তা উচ্চারণ করার আগে খ্রিষ্টীয় নৈতিকতা বলতে কী বোঝায় তা নির্ধারণ করাটাই কাম্য হতে পারে। এটি দ্বারা যদি বাইবেলের নতুন নিয়মের নৈতিকতা বোঝায়, তাহলে বলতে হয় যে-কেউ এই বইটি থেকে জ্ঞান অর্জন করবেন, তিনি হয়তো ভাববেন সেখানে নৈতিকতা সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ মতবাদের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বা তেমন কিছুরই ‍পরিকল্পনা করা হয়েছে। গসপেল সবসময় একটি পূর্বে থেকেই বিরাজমান নৈতিকতাকে নির্দেশ করে থাকে এবং তার অনুশাসনগুলোকে একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আটকে রাখে যেখানে সেই নৈতিকতা ‍কোনো বৃহৎ এবং ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সংশোধিত কিংবা বাতিল হয়ে যায়। এই ধর্মগ্রন্থটি খুব সাধারণ পরিভাষায় নিজেকে প্রকাশ করে থাকে যাকে প্রায়শই আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গসপেল আইনশাস্ত্রের সুষ্পষ্টতার পরিবর্তে বরং কাব্য বা অলঙ্কারশাস্ত্রের হৃদয়গ্রাহীতাকে ধারণ করে। বাইবেলের পুরাতন নিয়মকে সংযুক্ত করা ছাড়া তা থেকে নৈতিক মতবাদের একটি কাঠামো বের করে আনা সম্ভব নয়। তাতে একটি বিশাল ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হওয়া গেলেও তা অনেক দিক থেকেই বর্বর এবং তা বর্বর লোকেদের উদ্দেশ্যেই নির্মাণ করা হয়েছে বলা যায়। উক্ত মতবাদকে ব্যাখ্যা করার ইহুদী রীতি এবং ব্যাখ্যাকারকের পরিকল্পনা চরিতার্থ করার মতলবের একজন প্রকাশ্য শত্রু সেইন্ট পল নিজেও একইভাবে একটি পূর্বে থেকেই বিরাজমান নৈতিকতার অস্তিত্ব অনুমান করে নিয়েছেন। তার সে বিশেষ নৈতিকতা ছিল প্রাচীন গ্রিস এবং রোম প্রভাবিত। তিনি খ্রিষ্টানদেরকে অনেকাংশেই সে নৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি এমনকি দৃশ্যত দাসপ্রথাকেও অনুমোদন দিয়েছিলেন। যাকে ‘খ্রিষ্টীয়’ (বরং বলা উচিত ছিল ‘ধর্মতাত্ত্বিক’) নৈতিকতা বলে সাব্যস্ত করা হয়, তা আসলে যীশু খ্রিষ্ট কিংবা তার ধর্মপ্রচারকদের কার্যপ্রণালি নয় বরং তারও অনেক পরে তার উৎপত্তি হয়। খ্রিষ্টীয় প্রথম পাঁচ শতকে ক্যাথলিক চার্চে সে নৈতিকতা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। অবশ্য আধুনিকতাবাদী এবং প্রোটেস্ট্যান্টরা মন থেকে তা গ্রহণ করে নি এবং তারা তাকে প্রত্যাশিত মাত্রায় পরিবর্তনও করে নি। ইতিহাসের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে তারা সে নৈতিকতার মধ্যযুগে প্রণীত বিভিন্ন সংস্করণকে বিনষ্ট করেই তৃপ্ত থেকেছে যেখানে অন্যান্য প্রত্যেকটি দল-উপদল তাদের নিজ নিজ চরিত্র এবং প্রবণতা অনুযায়ী নতুন নতুন সংস্করণ যুক্ত করে সে শূন্যস্থান পূরণ করেছে। মানবজাতি এই নৈতিকতা এবং তার প্রচারকদের কাছে গভীরভাবে ঋণী-তা আমি কোনোভাবেই অস্বীকার করব না। তবে আমি এও বলতে দ্বিধা করব না যে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে এটি অসম্পূর্ণ এবং একপাক্ষিক। এছাড়াও আরো বলা যায়, যেসব ধ্যান-ধারণা এবং অনুভূতিগুলো ইউরোপীয় জীবন এবং চরিত্র গঠনে অবদান রেখেছে এবং একইসাথে সেগুলো খিষ্টীয় নৈতিকতার দ্বারা অনুমোদিত নয়, সেগুলোর সাহায্য ছাড়া মানবিক বিষয়গুলো বর্তমান সময়ের চেয়ে আরো বেশি নিকৃষ্টতর পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করতে পারত। তথাকথিত খ্রিষ্টীয় নৈতিকতার মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলতার সবগুলো বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এটির বেশিরভাগ অংশ মূলত পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদনামা। এর আদর্শ ইতিবাচকের চেয়ে বরং নেতিবাচক; সক্রিয়ের চেয়ে বরং নিষ্ক্রিয়; মহত্ত্বের চেয়ে বরং নিরীহ; ঈশ্বরের প্রবল সাধনার চেয়ে বরং শয়তান থেকে বেঁচে থাকা। এর অনুশাসনে ‘তোমার ইহা করা অনুচিত’ অন্যায্যভাবে ‘তোমার ইহা করা উচিত’ এর উপর ‍প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। ইন্দ্রিয়পরায়ণতার বিরুদ্ধে প্রবল ভীতি থেকে এটি কৃচ্ছ্রতাসাধনকে প্রতিমা বানিয়ে পূজা করে এসেছে। এর ফলে তা একসময় আইনগত বৈধতায় রূপ নিয়েছে। স্বর্গপ্রাপ্তির প্রত্যাশা এবং নরকগমনের হুমকিকে এটি একটি আদর্শ জীবন পরিচালনার জন্য পূর্বনির্ধারিত এবং যথার্থ অভিপ্রায় হিসেবে গণ্য করেছে। অন্যান্য জীবের স্বার্থের ব্যাপারে প্রত্যেক মানুষের কর্তব্যের অনুভূতিকে বিনষ্ট করে দিয়ে এটি মানুষের নৈতিকতাকে চূড়ান্তভাবে একটি স্বার্থপরায়ণ চরিত্র দিয়েছে। এটি মূলত একটি নিষ্ক্রিয় আনুগত্যের মতবাদ। এটি সবরকম প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের নিকট নিজেকে সমর্পণ করার সংস্কার শিখিয়েছে; সে সব কর্তৃপক্ষ যাদেরকে আসলে খুব বেশি পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন নেই যখন তারা বলে ধর্ম আসলে কী নিষেধ করেছে, এবং সে সব কর্তৃপক্ষ যাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তো দূরের কথা, তাদেরকে বাধা দেওয়ারও প্রশ্ন আসে না। যেখানে সেরা পৌত্তলিক জাতিগুলোর নৈতিকতায় রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, ব্যক্তির ন্যায্য স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করেও, সেখানে বিশুদ্ধ খ্রিষ্টীয় নৈতিকতায় কিভাবে কর্তব্যের এই বিশাল ক্ষেত্রটি অলক্ষিত এবং স্বীকৃতিহীন থেকে গেল? বাইবেলের নতুন নিয়মে নয় বরং কোরানের একটি আয়াতে আমরা পাই ‘কোনো শাসক যদি কোনো দপ্তরে কোনো একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয় যেখানে তার রাজ্যগুলোতে তার চেয়েও শ্রেয়তর কেউ বর্তমান ছিল, সে যেন রাষ্ট্র এবং সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে পাপকর্ম সাধন করে।’ আধুনিক নৈতিকতায় জনগণের প্রতি কর্তব্যের ধারণাটির যে সামান্য স্বীকৃতিটুকু রয়েছে, তাও কোনো খ্রিষ্টীয় উৎস থেকে নয় বরং গ্রিক ও রোমান উৎস থেকে এসেছে। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের নৈতিকতায় মহানুভবতা, উদারতা, ব্যক্তিগত মাহাত্ম্য এবং সম্মানের বোধটুকুও কোনো ধর্মীয় উৎস থেকে নয় বরং এর উৎপত্তি হয়েছে মানব উৎস থেকে। সেসব অবশ্য এমন কোনো নৈতিক আদর্শ থেকেও জন্ম নিতে পারত না যার একমাত্র প্রকাশ্য স্বীকৃত বিষয় হলো আনুগত্য।

আমার উদ্দেশ্য এমনটা বলা নয় যে, খ্রিষ্টীয় নৈতিকতার মধ্যে সহজাতভাবেই উক্ত সমস্যাগুলো বিরাজ করছে কিংবা একটি পূর্ণাঙ্গ নৈতিক মতবাদের মধ্যে যা কিছু থাকা আবশ্যক তা তার মধ্যে নেই। তাছাড়া আমি মোটেও স্বয়ং খ্রিষ্টের দেওয়া মতবাদ এবং অনুশাসনকে কটাক্ষ করছি না। আমি বিশ্বাস করি খ্রিষ্টের মুখনিঃসৃত বাণীগুলোর সাথে একটি সর্বাঙ্গীন নৈতিকতার কোনো বিরোধ নেই। নৈতিক দিক দিয়ে অসাধারণ সবগুলো বিষয়ই এর মধ্যে মজুদ রয়েছে। যারা এর মধ্যে থেকে বাস্তব জীবনের জন্য আচরণের নির্দেশিকা খুঁজে বের করতে গিয়ে এর ভাষাবিকৃতি ঘটিয়েছিল, তাদের সে পথ না মাড়িয়েই আমি উপরের বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পেয়েছি। তবে খুব সঙ্গতভাবে এটি বিশ্বাস করা যায় যে তারা কেবলমাত্র সত্যের একটি অংশই ধারণ করে এবং ঠিক তেমনটাই হওয়ার কথা ছিল। তাছাড়া উচ্চতর নৈতিকতার বেশ কিছু অপরিহার্য উপাদান রয়েছে সেগুলোতে যেগুলো আমরা খ্রিষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতার প্রামাণ্য বক্তব্যগুলোর মধ্যে পাই না এবং তা পাওয়ারও কথা নয়। খ্রিষ্টীয় চার্চের বক্তব্যগুলোর উপর প্রতিষ্ঠিত নৈতিক ব্যবস্থায় সেগুলোকে আলাদাভাবে একপাশে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। ঠিক এই কারণে আমার মনে হয় খ্রিষ্টীয় মতবাদের মধ্যে থেকে আমাদের জীবনের জন্য পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা খুঁজে বের করার একগুঁয়ে প্রচেষ্টা একটি বিশাল ভ্রান্তিতে পর্যবসিত হয়। ধর্মগ্রন্থের রচয়িতা তার পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন বিষয়ের অনুমোদন দিয়েছেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে ভক্তকে প্ররোচনা দিয়েছেন যদিও তা শেষ পর্যন্ত অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে। আমি এও বিশ্বাস করি যে এই সংকীর্ণ তত্ত্বটি নৈতিক নির্দেশনা এবং প্রশিক্ষণের মূল্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে আমাদের বাস্তব জীবনের জন্য একটি ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমার ভয় হয়, পুরোপুরি ধর্মীয় গড়নের মন এবং অনুভূতি গঠন করতে গিয়ে ‍যদি খ্রিষ্টীয় নৈতিকতার সাথে ইতোঃপূর্বে পরিপূরক হিসেবে সহাবস্থান করে আসা এবং একে তার মর্মভাব দিয়ে প্রভাবিত করা ও বিপরীতক্রমে প্রভাবিত হওয়া ধর্মনিরপেক্ষ বা ইহজাগতিক আদর্শগুলোকে বাতিল করা হয়, তাহলে এর ফলস্বরূপ একটি হীন, নতজানু এবং ক্রীতদাসসুলভ চরিত্র তৈরি হবে, এমনকি ইতোঃমধ্যেই তা হতে শুরু করেছে, যা কিনা নিজেকে একটি মহত্তম ইচ্ছার নিকট সমর্পণ করে বলে ধারণা করে, যেটি আবার একটি পরম কল্যাণের ধারণার মধ্যে নিজেকে জাগিয়ে তুলতে বা তার সাথে সহমর্মী হতে অক্ষম। আমি বিশ্বাস করি মানবজাতির নৈতিক পুনর্জাগরণের জন্য পুরোপুরি খ্রিষ্টীয় ‍উৎস হতে উদ্ভূত হতে পারে এমন যে-কোনো নৈতিকতার সাথে আলাদা কোনো উৎস থেকে আগত নৈতিকতাকে অবশ্যই পাশাপাশি সহাবস্থান করতে হবে। আমি আরোও বিশ্বাস করি, মানুষের একটি অসম্পূর্ণ মানসিক অবস্থার ক্ষেত্রে সত্যতার স্বার্থে চিন্তা ও মতের বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাবেশের প্রয়োজন; এমনকি খ্রিষ্টীয় ব্যবস্থাও এই নিয়মের বাইরে নয়। খ্রিষ্টধর্মের বাইরের কোনো উৎস থেকে প্রাপ্ত নৈতিক সত্যকে উপেক্ষা করা বাদ দিলেও এর মধ্যে যে নৈতিক সত্য রয়েছে সেগুলোকে উপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। এমন পক্ষপাতিত্ব বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের ঘটনা পুরোপুরি বর্জনীয়। তবে এটি এমন একটি ভুল যা থেকে আমরা সবসময় নিষ্কৃতির আশা করতে পারি না এবং একইসাথে একে একটি অমূল্য কল্যাণের বিনিময় মূল্য হিসেবে কবুল করে নেওয়া উচিত। কোনো একটি আংশিক সত্য যদি নিজে একটি পূর্ণাঙ্গ সত্য হওয়ার ভান করে, তবে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ জানানো উচিত। কোনো আবেগতাড়িত গোষ্ঠী যদি তাদের দিক থেকে পূর্বোক্ত প্রতিবাদকারীদের সাথে অন্যায় করে, তবে উভয় পক্ষের একদেশদর্শীতা দেখে বিলাপ করলেও তা অবশ্যই সহ্য করে নিতে হবে। যদি খ্রিষ্টানরা বিধর্মীদেরকে খ্রিষ্টধর্মের প্রতি ন্যায্য আচরণ করতে শেখায়, তাহলে তাদেরও উচিত হবে বিধর্মীদের প্রতি ন্যায্য আচরণ করা । সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে খুব অল্প জ্ঞান রাখা মানুষেরাও জানে যে নৈতিক শিক্ষার সবচেয়ে মহত্তম এবং সবচেয়ে মূল্যবান অংশটির রচয়িতা এমনকি শুধুমাত্র তারাই নয় যারা খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে নি বরং এর মধ্যে তারাও আছে যারা এর সম্পর্কে জেনেছিল এবং একে পরিত্যাগ করেছিল। আমি এমনটা দাবি করব না যে সব ধরণের মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা ব্যবহার করেই কেবল যাবতীয় দার্শনিক বা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কুফলকে রুখে দেওয়া যাবে। সংকীর্ণমনা ব্যক্তিরা কেবল যেসব সত্যতার ব্যাপারে আন্তরিক, সেগুলোই নিশ্চিতভাবে বিবৃত হবে, মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হবে এমনকি বিভিন্ন উপায়ে সেগুলোরই চর্চা করা হবে এমনভাবে যেন পৃথিবীতে আর কোনো সত্যের অস্তিত্ব নাই এবং কোনো ঘটনাই আর সেগুলোর সত্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না। আমি স্বীকার করি যে প্রত্যেকটি মত এবং চিন্তাধারার সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠার যে প্রবণতা, তা শুধুমাত্র মুক্ত আলোচনার মাধ্যমেই প্রশমিত করা যায় না বরং এর ফলে তা প্রায়শই তীব্রতর হয় এবং আরো বেশি খারাপ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যায়। এমনতর পরিস্থিতির মধ্যে কোনো একটি বিশেষ সত্যতা অধিকতর সহিংসতার মাধ্যমে নাকচ করে দেওয়ার কথা থাকলেও তার বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত লোকেদের প্রচারণার ফলে তেমন কিছু ঘটতে দেখা যায় নি। তবে চিন্তার এই সংঘর্ষের সুফল কোনো আবেগী দলান্ধ ব্যক্তি ভোগ করে না বরং তুলনামূলক শান্ত এবং অনাগ্রহী দর্শকের উপর এর মঙ্গলজনক প্রভাব বিরাজ করে। সত্যতার দুটি অংশের মধ্যে সহিংস সংঘাত নয় বরং কোনো একটি অংশকে দমন করাই হলো ভীষণ সমস্যাজনক। জনগণ যতক্ষণ পর্যন্ত দুটি পক্ষের মতামত শুনতে বাধ্য হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আশাবাদী হওয়ার অনেকগুলো কারণ থাকে। কিন্তু তারা যখন কোনো একটি পক্ষে অবস্থান নেয়, তখন ভ্রান্তি আরো গুরুতর হয়ে অন্ধবিশ্বাসে পরিণত হয় এবং সত্যতা অতিরঞ্জিত হয়ে মিথ্যাত্বে পরিণত হওয়ার ফলে তার নিজস্ব চরিত্রগুণ হারিয়ে ফেলে। মানুষের বিচারক্ষমতার চেয়ে বিরল কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা নেই যখন সে কোনো একটি প্রশ্নের দুটি দিকের বুদ্ধিদীপ্ত বিচার করতে বসে যার শুধুমাত্র একটি দিকের পক্ষে ওকালতি করার মানুষ আছে। দুটি পক্ষের চিন্তার মধ্যেই বিভিন্ন অনুপাতে মিশে থাকা ছাড়া সত্যতার আর কোনো উপায় থাকে না। সত্যতার সামান্য অংশকে ধারণ করা প্রত্যেকটি মতবাদ এবং চিন্তাধারার পক্ষে শুধু ওকালতি করাই নয় বরং তা যেন সবাই শুনতে পায় তার জন্য তৎপর হওয়া প্রয়োজন।

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!