সাক্ষাৎকার
শুদ্ধস্বর: আপনি কবিতার মাধ্যমে কী আবিষ্কার করার এবং বোঝানোর চেষ্টা করে থাকেন?
ফেরদৌস নাহার: মূলত মানুষ তার শিল্পসৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করে চলে। কবিতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই। কবিতা ভীষণ প্রতীকী, তাই বুঝে নেবার আগে অনুভবের সঙ্গে মিতালী করে নিতে হয়৷ গদ্যে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেওয়ার থাকে। কবিতায় সেই দায় থাকে না। তাই কবিতার যোগাযোগটা সম্পূর্ণই প্রতীকী এবং ইঙ্গিতময়। এর মাঝে রকমফের যেমন আছে, পাঠকের ক্ষেত্রেও তাই। সকল কবিতা সব পাঠকের জন্যে যেমন না, তেমনি সকল পাঠকও সব কবিতার জন্য প্রস্তুতও না। আমার কবিতায় আমি জোর করে কিছু বোঝাতে চাই না। আমার যাপন ও চর্চার ছাপ কবিতায় থাকলে পাঠক যার যার প্রস্তুতি অনুসারে তা বুঝে নেন। যেমন আমার কবিতায় ভ্রমণের অনুষঙ্গ থাকে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমানুভূতির গল্প থাকে। কোনো পাঠক যদি এগুলোর মধ্য থেকে আমার কবিতাকে, যাপনকে বোঝার চেষ্টা করেন সেটা তার কৃতিত্ব। আসলে কবিরা লেখকেরা নিজেদের আবিষ্কার যেমন করেন, তেমনি তারা পাঠকের কাছেও আবিষ্কৃত হতে থাকেন।
শুদ্ধস্বর: আপনি বর্তমান বিশ্বকে কিভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং বর্তমান ঘটনাগুলো আপনাকে লেখার ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে?
ফেরদৌস নাহার: এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বর্তমান বিশ্ব পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিশ্ব। ভোগবাদীতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখে যাচ্ছি আমরা। যুদ্ধ ও ভোগ। এর প্রভাব অর্থনীতি-সমাজনীতি-রাজনীতিতে সুস্পষ্ট। যে-দেশ নৈতিক ও মানবিক শিক্ষায় যত বেশি শক্তিশালী তারা এর প্রভাবকে হয়তো দক্ষতার সঙ্গে আড়াল করছে ঠিকই, কিন্তু অস্বীকার করতে পারছে না। আর দুর্বল দেশ হলে খাবি খেতে হচ্ছে তাদের। আমি ব্যক্তিগতভাবে নানাদিক থেকে সমতার সুবিধা-পাওয়া একটি রাষ্ট্রে বসবাস করছি ঠিকই, কিন্তু আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে এসব দিক থেকে তার দুর্বল অবস্থানের জন্য বারবার রক্তাক্ত হতে দেখে আমিও ক্ষত বিক্ষত হই। যখন ধর্ষণ আর হাজারও রকমের অন্যায় ও হত্যার মচ্ছব চলে তখন বিচার ব্যবস্থার প্রতি বারবার অনাস্থা ভর করে, চারপাশটা অন্ধকারে-ভরা মনে হয়। বাংলাদেশে অবস্থান করাকালীন সময়ে এবং এখন না থেকেও এসব বিষয়ে স্পষ্ট প্রতিবাদ করেছি লেখায় ও পথে নেমে, আর এখনও তা করে যাচ্ছি। তবে এর মাঝে হঠাৎ আলোর দিশাও দেখতে পাই। তখন ইচ্ছে করে তাকে সাধ্যমত যত্ন দিয়ে বাঁচিয়ে তুলি। এইসব ঘটনা ও পরিপার্শ্ব দ্বারা আমার কবিতা নানাভাবে প্রভাবিত। আমি শিল্পের পথে হাঁটি। সমসাময়িক বিষয় আমাকে আক্রান্ত করে। আমার কাজে তার প্রকাশ ঘটে বইকি। ক্ষমতার নগ্ন আগ্রাসনে দগ্ধ এই পৃথিবীকে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হতে দেখে তো চোখ বন্ধকরে রাখতে পারি না। কলম চলেছে, চলবে।
শুদ্ধস্বর: কোন সাহিত্য-ফিকশন বা নন-ফিকশন-বা কোন লেখক/লেখকরা আপনার নিজের লেখাকে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেছেন? কারা এবং কীভাবে?
ফেরদৌস নাহার: দেখুন, কোনো লেখক বা কোনো বই আমার লেখাকে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেছে কিনা এটা জানতে চাইলে, সবার আগে আমি নিজে প্রভাবিত হওয়ার কথাটাকে গুরুত্ব দেই। ছেলেবেলার বেড়ে-ওঠার দিনগুলোই পরবর্তী জীবনে সৃজনের পথকে অনেকাংশেই তৈরি করে দেয়। অন্তত আমার বেলায় তাই হয়েছে।
বইপড়ার একটা চরম নেশা ছিল সেই ছোটোকাল থেকেই। সে বয়সের উপযোগি দেশি-বিদেশি ফিকশন, নন-ফিকশন, ছড়া, কবিতা কিচ্ছু বাদ যায়নি তালিকা থেকে। এমনকি আমাদের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে একটু বেশি আগেভাগে এমন কিছু বই পড়ে ফেলি, যা ওই বয়সে পড়ার না। কলকাতা থেকে অনুদিত বইগুলো খুব টানতো। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি এবং অ্যা ফেয়ারল টু আর্মস, এমিলি ব্রনটি’র ওয়াদারিং হাইটস, এরিখ মারিয়া রেমার্কের থ্রি কমরেডস এবং অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট-এর মতো বই।
বেড়ে-ওঠার সময় আরও পেয়েছি সোভিয়েত ইউনিয়ানের প্রগতি আর রাদুগা প্রকাশনীর বাংলা বইগুলো। যেমন সুলভ ছিল, তেমনি তার কনটেন্ট, ছাপা, বাঁধাই কী যে সুন্দর, শোভন ও মজবুত, ভাবা যায় না। সেই থেকে একটা রুচিও তৈরি হয়ে যেতে থাকে। চিনলাম পুশকিন, ম্যাক্সিম গোর্কি, ভ্লাদিমির মায়াকোভ্স্কি, ল্যেভ তল্স্তোয়, ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কি, আন্তন চেখভ, ইভান তুর্গেনেভ থেকে আলেক্সান্দার বেলায়েভ পর্যন্ত। বেলায়েভ’র উভচর মানুষ ইকথিয়ান্ডর টেনে ধরে রাখে, ছাড়ে না। ব্যক্তিগত মানবিক-মানস গঠনে রুশ সাহিত্যের অবদান কোনোদিন অস্বীকার করতে পারব না।
গোগ্রাসে গিলেছি মার্ক টোয়েনের অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন, রবার্ট লুই স্টিভেনসনের ক্লাসিক বই ট্রেজার আইল্যান্ড, হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র আঙ্কেল টমস কেবিন, ড্যানিয়েল ডিফোর ক্লাসিক অ্যাডভেঞ্চার রবিনসন ক্রুসো, ভিক্টোর হুগোর হ্যাঞ্চব্যাক অবনটরদ্যাম, লরা ইঙ্গেলসের লিটল হাউস অন দ্য প্রেয়ারি, চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড ও অলিভার টুইস্ট-এর মতো বইগুলো। পাশাপাশি সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা’র এক একটি বুদ্ধিদীপ্ত পর্ব, এখলাস উদ্দীন আহমেদের ছড়ায় ছড়ায় ছন্দ, লীলা মজুমদারের হলদে পাখির পালক তো ছিলই। সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশের অমরচরিত্র আবদুর রহমান তো ইনহাস্ত ওয়াতানাম (এই তো আমার জন্মভূমি) বলে আজন্মের মতো দেশপ্রেমের অনুভব রোপন করে দিয়ে গেল।
তারপর একে একে বিশ্বের অসংখ্য ভাষার অসংখ্য কবি ও লেখকের চিনলাম, জানলাম। বিশ্ব সাহিত্যের নিত্য নতুন ভাণ্ডার নাগালের ভেতরে এসে গেল। সেসব লেখা প্রভাবের চাইতে প্রেরণাই দিয়েছে বেশি। পড়েছি, পড়ছি, ক্রমশ ঋদ্ধতায় ঋণী হচ্ছি। মনে করি, মানসিক গঠন তৈরিতে ছেলেবেলার প্রভাব ও রুচিটাই সবচেয়ে বেশি স্থায়ী হয়ে থাকে, এসবই হয়তো অনুপ্রেরণা, যা এখনও বয়ে নিয়ে যাচ্ছি-কবিতা থেকে গদ্যে, গদ্য থেকে গানে, গান থেকে ছবি আঁকায়, ছবি আঁকা থেকে হয়তো ভ্রমণে। এভাবেই।
পৃথিবীর নানা ভাষার অসংখ্য বই আমার প্রিয়, নাম লিখে শেষ করতে পারবো না। আজকে বাংলা ভাষায় লেখা ও অনুদিত কয়েকটি প্রিয় বইয়ের উল্লেখ করছি-আমার ছেলেবেলা : ম্যাক্সিম গোর্কি , জীবনানন্দ কাব্য সম্ভার, দেশে বিদেশে : সৈয়দ মুজতবা আলী, শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা : বুদ্ধদেব বসু, অনুস্মৃতি : পাবলো নেরুদা, ইকারুসের আকাশ : শামসুর রাহমান, একাত্তরের দিনগুলি : জাহানারা ইমাম, রাজা যায় রাজা আসে : আবুল হাসান, ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল : হুমায়ুন আজাদ, কাফকার জামা : সিকদার আমিনুল হক, কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই : শহীদ কাদরী, পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ : রফিক আজাদ ইত্যাদি।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার কবিতাকে আকার দেয়?
ফেরদৌস নাহার: শিল্পীর জীবনে যোগাযোগ পরে আসে। আগে আসে কাজ। আমার কাজই আমার যোগাযোগের মাধ্যম। কবিতা, সাহিত্য, গান, পেইন্টিং, ভ্রমণ ভালোবাসি বলে এসব মাধ্যমে কাজ করতে করতে যোগাযোগ হয়েছে অসাধারণ কিছু মানুষের সঙ্গে, শিল্পীর সঙ্গে। এখানে বলে রাখি, আমি সেই সব শিল্পীর সান্নিধ্যে গেছি যারা অনেকখানিই অনমনীয় ও আপসহীন ব্যক্তিত্বের। সত্যি বলতে তাদের স্নেহ ও ভালোবাসায় আজকের ফেরদৌস নাহার অনেকখানি তৈরি হয়ে এসেছে। আমার প্রলোভনের আকাঙ্ক্ষা নেই। সততার একটা দারুণ মূল্য আছে আমার কাছে। কাজেই নিজেকে বিকিয়ে দেবার জন্যে নানা রকমের জাগতিক যোগাযোগ আমাকে আকর্ষণ করে না। হয়তো এইসব মূল্যবোধগুলো এখনো আমাকে তাড়িত করে, বলতে পারেন, সেক্ষেত্রে আমি এখনো তথাকথিত ‘ওল্ডফ্যাশন’ই রয়ে গেছি। নিজেকে আগ-বাড়িয়ে কেনা-বেচা করার প্রবণতাকে ঘৃণা করি বলে যোগাযোগের দলবাজ প্রবণ সুবিধাবাদী বা ভোগী কোনোটাই হতে পারিনি। লেখালেখির জন্য স্নেহ যেমন পেয়েছি, আঘাতও পেয়েছি। এই কবিতার পথে চলতে গিয়ে হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ঈর্ষারও শিকার হয়েছি। সেসব হয়তো কখনো খানিকটা নাড়াও দিয়েছে, কিছু কবিতায় তার প্রভাবও রয়েছে নিশ্চয়ই। তারপরও ঋজু ও অবিচল কাব্য পরিভ্রমণের একটা শক্তি বহন করছি বলে লিখে যাচ্ছি। বিশ্বাস করি, সততা ছাড়া প্রকৃত কবি হওয়া যায় না।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার বক্তব্য উচ্চারণ করতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
ফেরদৌস নাহার: দেখুন, আমি কোনো কাঠামোয় আটকে থাকতে পছন্দ করি না। শুধু যে কবিতার ক্ষেত্রে এটা তা নয়। যেহেতু বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী এবং কবিতাকর্মী তাই ছন্দের ব্যাপারটা নিয়ে আমার কিছুটা জানাশেনা আছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমি প্রচলিত প্রধান ছন্দগুলো পরিহার করেই কবিতা লিখেছি। মুক্তছন্দে আমার কবিতাগুলো উড়াল দিয়েছে। আমাকে কাঠামোর চাপ প্রভাবিত করে না, করে প্রকাশের অন্তহীন মুক্তির যোগাযোগটা। আমার বোহেমিয়াম ভ্রামণিক মন তাতে স্বস্তি পায়। তবে ছন্দবদ্ধ কবিতা যে একেবারেই লিখিনি তা নয়। আর কেউ ছন্দে লিখলে তার কবিতাকে আমি অপছন্দ করব তাও কিন্তু নয়। তবে আমি ঠিক ওই একই রকম ছন্দাবদ্ধ তালে কবিতা লেখাকে অপছন্দ করি। কারণ, কবিতা আমার নিশ্বাস ফেলা ও নেয়ার প্রান্তর। সেখানে কেবল প্রথাগত ব্যাকরণ বা ছন্দের কাঠামোতে চলতে চাই না, চাই-বলার চলনে ঘোর ও উন্মুক্ত ভাবের আত্ম-উন্মেষ। সীমাবদ্ধ সুতোয় একে না-বেঁধে,আমার নিজের কবিতার ক্ষেত্রটি আকারে-প্রকারে, বিষয়ে, বিষয়ের উপস্থাপনে গড়তে ও ভাঙতে চেষ্টা করি। নিশ্চয়ই করি।
শুদ্ধস্বর: রাজনৈতিক কবিতা এবং সাধারণ কবিতার মধ্যে সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব এবং সংহতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
উত্তর : কবিতায় সাধারণ কবিতা বলে কিছু হয় কি? কবিতাকে প্রথমে কবিতা হয়ে উঠতে হয়। তারপর তার বর্গ বিভাজন। যেটা করেন তাত্ত্বিকেরা। বিশ্লেষকরা। নারীবাদী কবিতা, মানবতাবাদী কবিতা, কালোদের কবিতা, প্রান্তিক স্বরের কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা-আরও নানা রকম। পার্থক্য তো একটা থাকেই। প্রথমত বিষয়ে। তারপর আঙ্গিকে। উপস্থাপনে। তবে যতক্ষণ না এটা কবিতা ততক্ষণ তা হয় একটা স্টেটমেন্ট অথবা স্লোগান। কবিতা এর চেয়ে আরো অধিক কিছু। মায়াকোভস্কি, পাবলো নেরুদা, লোরকা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ এমন আরো দুর্দান্ত কবিদের রাজনৈতিক কবিতা আছে যা মূলত কবিতা। তারপর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার ভিন্নমাত্রা এনেছে। জনগণকে প্রভাবিত করেছে। আর এগুলো একেকটা উত্তাল সময়কে, ঐতিহাসিক বাস্তবতা বা চরিত্রকে ধারণ করেছে। এদিক থেকেও অন্যান্য কবিতার সাথে এর পার্থক্য তো রয়েছেই। তবে কবিতা মূলত কবিতাই। আমি বিশ্বাস করি, যখন সে কবিতা, তখন তার শৈল্পিক মূল্যবোধের কোনো দ্বন্দ্ব থাকে না, বরং তা হয়ে ওঠে প্রতিনিধিত্বমূলক নিবিড় কণ্ঠস্বর।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতা কি জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে বলে আপনার ধারণা? এটি অন্যান্য জাতীয়তা বা ভাষাগোষ্ঠীর কাছে আবেদন রাখতে পারে বলে কি আপনার মনে হয়? তাহলে কীভাবে?
ফেরদৌস নাহার: দেখুন, সেটা ভাবাটা আমার জন্যে খুব প্রয়োজনীয় কিছু নয়। নিজের কাজের প্রতি আস্থা থাকলে কাজ করার আনন্দটা উপভোগ করা যায়, যা আমি করে থাকি। তবে, কবিতার সীমানা পেরুনোর কথা বললে অবধারিত ভাবে অনুবাদ বা ভাষান্তরের প্রশ্ন আসে। আমি কাজ করি আমার মাতৃভাষায়। কাজেই এখানে অনুবাদ প্রক্রিয়ার একটা ভূমিকা আছে। আমি ইংরেজি বা ফরাসি কিংবা অন্য কোনো ভাষায় লিখলে সেটার পাঠকের পরিসর ভিন্ন এবং বিস্তৃত হতো নিশ্চিতভাবে। তাই অন্য ভাষাগোষ্ঠীর কাছে আবেদন তৈরি বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য করাটা ঠিক বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হচ্ছে না। তবে কন্টেন্টের কথা বললে বলা যায়, আমি নানা রকম বিষয়ে লিখি, লিখছি। লেখার উপমা উপকরণ ভাষাভঙ্গী বদলে যায়, যাচ্ছে। তাছাড়া বর্তমানে ভিন্ন একটি ভৌগলিক সীমানায় বসবাস করার কারণে বদলেছে তার প্রকাশ, বেড়েছে প্রেক্ষাপটের বিস্তৃতি। বিশ্বায়নের এই যুগে গ্লোবাল ভিলেজে বসে লেখালেখির অস্তিত্বকে ছড়িয়ে দেয়ার বিপুল সম্ভবনা রয়েছে। তাই বাংলাভাষার সৃষ্টিশীলতার পরিধিকে অন্তত ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফরাসি অনুবাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়াটা এখন খুবই জরুরি। সেজন্য মূলভূমি অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে অনুবাদ কর্মের টিমওয়ার্ক শুরু করতে পারলে ভালো হবে এবং তা প্রফেশনালি। আর সেভাবে করতে পারলে আমার কবিতা ভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ ও আবেদন তৈরি করতে পারবে নিশ্চয়ই।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন কবিতার সংক্রাম দিয়ে মানুষের ইতিহাস পালটানো সম্ভব? আপনার জবাবের পক্ষে বলুন।
ফেরদৌস নাহার: যদি বলেন, তাহলে বলব, শুধু কবিতা নয় সামগ্রিক শিল্প, যেমন-কবিতা, গান, ছবি আঁকা সবকিছু মানুষের আত্মার খোরাক। মানুষের দেহে প্রাণসঞ্চারী, সুকুমার বৃত্তির প্রকাশ ও বিকাশ। এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে ইতিহাস পালটে ফেলা একটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। তার অংশ হিসেবে শিল্পের ভূমিকা অবশ্যই আছে। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস মূলত হননের ইতিহাস। এর বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার হয়েছে নানাভাবে, তারই একটি মাধ্যম কবিতা। কাজেই প্রভাব যা আছে বা থাকবে তা একটা ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়েই যাবে। চট করে কোনো ফল পাওয়ার মত বিষয় এটি নয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্মরণ করলে আমরা এর সুস্পষ্ট উত্তর পেয়ে যাই। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা, পরবর্তীতে ১৯৯০-এ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। এই দীর্ঘ ইতিহাস যাত্রাকে অনুসরণ করলে এই উত্তর সহজেই পেয়ে যাব। আমাদের ভাষা অন্দোলন, স্বাধীনতা, স্বৈরাচার বিরোধীতা নিয়ে অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে, যা কিনা আজও আমাদের প্রতিবাদী গণমানুষের দীপ্ত চেতনার সম্পদ হিসাবে গন্য। কবিতার বহুমুখী শব্দ প্রক্রিয়া জনমনে ক্রমশ ছাপ ফেলে যায়, এর ফলাফল ও তার দীর্ঘমেয়াদি বিকাশ-প্রকাশ ও প্রভাব মানুষের চেতনায় ধীরে ধীরে স্থায়ী ও অমর হয়ে ওঠে। কাজেই মানুষের ইতিহাস পালটানোর ক্ষেত্রে কবিতার ভূমিকা মোটাও অস্বীকার করার নয়। বরং তা সত্য ও শক্তিশালী।
____________________________________
কবিতা
সিদ্ধান্ত
যে-আলোর নাম ছিল ঊষাবতী
যে-প্রেমের নাম ছিল অমরাবতী
তার দুচোখে এখন মৃত্যুর খেলা
কেউ তাকে চেনে না
শুধু আমি চিনি, আমি জানি
কেন ফুল ফোটে না এখন
কেন জল বিষাক্ত নীল হয়ে যায়!
আমার দেশ ছিল পূর্বদিকে
এখন আমি সমস্ত পৃথিবীর
আমার নাম ছিল নির্ধারিত কিছু
এখন আমি অনির্দিষ্ট মানুষ
আমার জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই-কারণ
জন্মের আগেও আমি মানুষ ছিলাম
মৃত্যুর পরও আমি মানুষ রয়ে যাব
এখন যে আমাকে-আমাদের ভয় দেখাচ্ছে
তাকে কি আমরা ছেড়ে দেবো?
রক্তের অবশিষ্ট রোগ
এই যুদ্ধ পরমায়ুর মতো
আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা!
গোলকধাঁধার মতো জীবন
ফুলহীন নির্লজ্জ অভিশপ্ত
কতটা জীবন বয়ে যাবে জানা নেই
তবু যুদ্ধ-খরার যন্ত্রণা
তামাটে শিকলে বাঁধাদিন
মানুষের অনিঃশেষ শক্তি
অস্ত্র খেলায় নিঃশেষিত
এত ক্ষয় এত গ্লানি
তবু দু’হাত হয় না নত
অবিরাম মন্ত্র বলে
উদ্ধত অস্ত্র হাতে
মানুষই দেখ মানুষের পিছে লেগে আছে
একটি ফুলের পরিবর্তে
একটি বুলেট
একটি চুম্বনের পরিবর্তে
একটি ছোবল
একটি প্রণয়ের পরিবর্তে
একটি হিংস্রতা
কেবলই পরিণাম, কেবলই নিয়তি
এই যুদ্ধ নিয়ে যাবে শ্মশানঘাটের দিকে
গোরস্তান কিংবা বধ্যভূমিতে
অরক্ষিত এই দেহ
নিরাপদ আশ্রয়ে অপূর্ণ
লোকমুখে প্রচলিত চিরগল্পের মতো
যুদ্ধ আজ হাটে-মাঠে বাজারে বন্দরে
বড়ো বেশি লোকপ্রিয়
রক্তের অবশিষ্ট রোগ!
মানুষের পাঁচটি মুখ
আমার জানা মতে মানুষের পাঁচটি মুখ
একটি খাদ্য গ্রহণের জন্যে
একটি মিথ্যে বলবার জন্যে
একটি চুম্বনের জন্যে
একটি হাসবার জন্যে-আর
একটি মুখ সত্যের জন্যে
আমি খুব সহজেই পাঁচটি মুখের
চারটিকে পেয়ে গেলাম
প্রথমে কিছু খাবার এনে রাখতেই
খাদ্য গ্রহণের মুখটি আপনাতেই খুলে গেল
আমি মানুষের ভাগ্য নিয়ে বিশ্ব-পরিক্রমা করলাম
আর অমনি মিথ্যে মুখটি মানুষের দুর্ভাগ্য
পরিণাম, আশা-হতাশা, বর্ণবাদ
ইত্যাদি বিষয় নিয়ে অবিরাম মিথ্যে বলে গেল
রাজনীতিবিদেরা যে-ভাবে বলে থাকেন
আমি একটি শিশু এবং একজন নারীকে উপস্থাপন করলাম
একটি মুখ পরম আহ্লাদে মুখ চুম্বন করল
শিশুকে প্রকাশ্যে এবং নারীকে অবশ্যই লুকিয়ে
আমি জগতখ্যাত কৌতুকাভিনেতা
চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে এলাম
আর কী আশ্চর্য ওকে দেখা মাত্রই একটি মুখ
প্রচণ্ড হাসতে শুরু করল, মহা-হাসির কিছু ঘটে গেছে
চার্লি চ্যাপলিন যেন লাফিং গ্যাস
এতকিছু করবার পরও আমি সত্যের মুখটি পেলাম না!
অবশেষে ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই
কে যেন পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখল
এবং ফিস ফিস স্বরে বলে উঠল-
গণিকালয়টি কোনদিকে একটু দেখিয়ে দেবেন কি?
আমি সত্যের মুখটি পেয়ে গেলাম
পূতিগন্ধমাখা সত্যের মুখটি এখন গণিকালয়ের দিকে ফেরানো!
কারফিউর রাত
আমার চারপাশে নিস্তব্ধ রাতের দাঁতভাঙা অন্ধকার
একটা করুণ কান্নার মতো বাতাস জানায় তার উপস্থিতি
এতটাই নিশ্চুপ যে মনে হয় প্রাচীন মিশরে আছি কিংবা
এই এখুনি কথা হবে হোমারের সাথে
আমার এই উপলব্ধি খান খান ভেঙ্গে যায়
রাজপথে ছুটন্ত ট্রাকের গতি
পৌর-আলোর ক্ষীণ আভাস বাদে
আর সব অস্বচ্ছ ক্লান্ত লাগে… … …
সারাটা শহরে কারফিউ!
অবরুদ্ধ রাজধানী, মানুষের উচ্চকিত কণ্ঠস্বর
বাতাসে মিলিয়ে গিয়েও প্রতিধ্বনি তোলে
আর সে চিৎকারকে চাপা দেবার জন্য
সেনা-ছাউনির পোষা প্রাণীগুলো
রাতভর দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ায় ঘোঁত ঘোঁত শব্দে
আমি এতকিছু কোনদিনই বুঝতে চাইনি
কোনোদিন এতসব বুঝবার প্রয়োজনও হতো না
যদি না এমন করে রাতগুলো গম্ভীর হতো
যদি না দিনগুলো এরকম ভয়ানক হতো
আমি খণ্ড খণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ি
কখনো মিছিলে, কখনো প্রতিবাদ, কখনো সভায়
কখনো সংগীত, কখনো নাটকে, কখনো কবিতায়
আমার চারপাশে নিস্তব্ধ গভীর অন্ধকার
কী জবাব দেবে এইসব রাতগুলো ইতিহাসের কাছে!
মানুষের দেখা না পেয়ে চাঁদও গুটিয়ে নেয় জ্যোৎস্নার ফালি
উত্তেজিত টহল-গাড়ি এইমাত্র ছুটে গেল শূন্যতার দিকে
আর আমি এইমাত্রই আরো একবার দৃঢ় হয়ে উঠি!
বিপ্লব চিনি না আমি
বিপ্লব চিনি না আমি
সেকি ওই চৌমাথা রাস্তায় ডাবল-ডেকারের চিৎকার?
সারাদিন সোরগোলে মত্ত থেকে
চা-খানায় আড্ডা জমায় কিছু ভূতে-পাওয়া শ্রেণিহীন মানুষ
ওদের ঠোঁটে উড়ে সাম্প্রতিক বিশ্ব আর
যুদ্ধবাজ বন্দি ভবিষ্যৎ
ল্যাংচানো যুক্তিতে তুড়ি মেরে
ওরাই মুহূর্তে বিপ্লবী নেতা বা কেউকেটা অন্যকিছু
সারাজীবন যেতে যেতে দেখেছি
এমনই ঘামে ভেজা সংসদ
বাতাসে মিশে যাওয়া সংগ্রাম
নিরর্থক যুক্তির সংবিধান
শ্লোগানে উঁচু করা হাতের দুর্বল মুঠি খুলে
ঝরে পড়েছে বিশ্বাসের আহত গোলাপ
বিপ্লব চিনি না আমি
সেকি ওই গাঁও-গেরামের কলিমুদ্দি চাষির
শূন্য গোয়ালের হাহাকার
ফেনানো দুধের নিখোঁজ ওলান
ফসলের নির্বাসিত ঘ্রাণ, নবান্নের হারানো শীৎকার
প্রথম বিয়ানো বাছুরের মৃত লাশ!
বিপ্লব চিনি না আমি
রোজ তাই লাথি খাওয়া দেহে
জেগে জেগে ইতিহাস লিখি-
এদেশে চিরকাল গর্বিত শাসকের বেহায়া সিংহাসন
নাভিশ্বাস ভাঁওতা দিয়ে কেড়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা বিশ্বাস
ক্লিন্ন হাতে কষে গেছে চাবুকের ঘৃণ্য পেচ্ছাব!
আমার সব ছিল, আমার কিছুই নেই
বিপ্লব চিনি না আমি
কাদাজলে মাখামাখি দুরন্ত বঞ্চনা সাথে
জরুরি আইন ভেঙ্গে জন্মান্তর সাক্ষী করে
আরো কিছু প্রতারণা দেখবার শক্তি আছে বলে
এখনো জ্বলছি পথে
আমি এদেশেরই সন্তান!
ভুঁইফোঁড় বলছ কে, বলো!
ফোঁড়ন কাটছ নাতো ভুঁইফোঁড় ভুঁইফোঁড় বলে!
আমি খুব শক্তমাটির শিশু
দুধ মায়ায় বেড়ে উঠা শাবক!
যেখানে জন্ম আমার সেখান থেকে
মক্কা, জেরুজালেম, হরিদ্বার
খুব দূর নয়
ওখানকার বাতাস-আলো
এখনেই পেয়ে গেছি আমি!
আমার দুইটি হাতে আজন্মের অন্তিমলীলা
বার বার খেলা করেও মৃত্যুকে এড়িয়ে গেছে
আমার শক্তির কাছে মহাদেশ নতজানু দেখ
আমাকে কে ভুঁইফোঁড় বলছ, বলো?
তামাটে রোদের দেশে কঠিন মানুষ থাকে
কেউ তাকে পারে না ঠেকাতে
আমার জন্ম সেই রোদের ঝাঁজে
আমাকে যে ছুঁয়ে দেখে
সে কেমন পুড়ে যায় ত্রাসে!
ভুঁইফোঁড় বলছ যে- তাকে
এইবেলা শুষে নেই প্রচণ্ড রৌদ্রের দাহে!
এসো, আগামীদিনের গল্প বলি এসো
শূন্যতার মাঝে বেড়ে-উঠার একধরনের
শক্তি আছে জেনো
এখন পৃথিবী সেই অপরিমেয় শক্তিতে
শূন্যতা অতিক্রম করছে
স্বাধীন সত্তার পাশাপাশি
দ্বিধাবিভক্ত একদল স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলে
এখনো তর্কে মাতোয়ারা
এ-কেমন পৃথিবী বলো
অবাঞ্ছিত জন্মরোধ আছে
শুধু অবাঞ্ছিত মৃত্যুরোধ নাই!
যারা যেখানে মানায় ভালো
সে কেবল বেমানান আসনে গিয়ে বসে
যার যেখানে থাকার কথা
তাকে কেবল ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া
কাঙ্ক্ষিত মানুষেরা অপরিচিত হয়ে হয়ে যায়
এ-কেমন পৃথিবী বলো
স্বাধীনতার শত্রুরা অবলীলায়
সময়ের টুটি চেপে
কী ভীষণ চাতুর্যে নিজেদের পঙ্কিলতা
ধুয়েমুছে সাফ করে নেয়
ধর্ম আর রাজনীতির বিষাক্ত রঙ্গলীলায়
আফিম আর বিষ ঢেলে দেয়
বেজন্মার কারুকাজে শিল্পের মোহন ছাঁচে
পরোক্ষ ব্যবসা করে যায়
তাদের বেহায়া বুকে ছুরি মারার পরিবর্তে
নিজেই নিজের বুকে ছুরি মারি আজ
এ-কেমন জন্ম বলো
স্বদেশে আত্মা জুড়ে শয়তানের হোলিখেলা
এই জন্মে দেখে যেতে হলো!
এ-কেমন পৃথিবী বলো
ভোর হবার আগেই দেখি
নতুন অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নিল
এসো, আগামীদিনের গল্প বলি এসো
দুধেভাতে বেড়ে-উঠার গল্প বলি এসো।
সাক্ষাৎকার পড়ে একটু পোক্ত হলাম পোক্ত হবার পথে।
সিদ্ধান্ত থেকে-
” জন্মের আগেও আমি মানুষ ছিলাম
মৃত্যুর পরও আমি মানুষ রয়ে যাব ”
সকল কবিতায় মুগ্ধতা অশেষ তবুও এই পঙক্তি দুটি গেঁথে গেলো মস্তিষ্কের ভিতরে।
শুভকামনা নিরন্তর।