জিয়াউদ্দিন সরদারের ইসলামের পুনর্বিবেচনা

Share this:

অনুবাদকের ভূমিকা: সত্যের উপর জনসাধারণের যে অধিকার রয়েছে তাকে নিয়ন্ত্রিত ও কেন্দ্রিভূত করার প্রবণতা হচ্ছে সব ধরনের সামাজিক সম্পর্কের অন্যতম অন্যায্যতা। জিয়াউদ্দিন সরদার মুসলিম সমাজের মধ্যে এ প্রবণতা খুঁজে পান, যা তিনি তার Rethinking Islam প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধটি মূলত ৯/১১ পরবর্তী লেখা হলেও প্রবন্ধটিকে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করা হয়েছে। অনুবাদকৃত প্রবন্ধটি Sohail Inayatullah and Gail Boxwell সম্পাদিত জিয়াউদ্দিন সরদারের প্রবন্ধ সংকলনগ্রন্থ Islam, Postmodernism and Other Futures: A Ziauddin Sardar Reader (1lib.sk/book/693859/9f3f3f?id=693859&secret=9f3f3f) থেকে নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ বিশ বছর পূর্বের লেখা হলেও প্রবন্ধটি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে  আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। কেননা  মুসলিম সমাজে কোনোকিছু সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ পদ্ধতি বর্তমান সময়েও অতীতের মতো অপরিবর্তনীয় ও অনমনীয়; এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ইসলামের সমস্ত ব্যবস্থাপনাকে ঐশ্বরিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যার মাধ্যমে এগুলোকে অলঙ্ঘনীয় বিবেচনাপ্রসূত সমালোচনার উর্ধ্বে রাখা হয়। জিয়াউদ্দিন সরদারের মতে মুসলিম সমাজের মধ্যে বিরাজমান চিন্তা ও কার্যাবলির মধ্যে তিনটি প্রধান অধিবিদ্যক সংকট রয়েছে। এগুলো হচ্ছে “শরিয়াহ-এর তাৎপর্যকে  ঐশ্বরিক পর্যায়ে স্থান দেওয়া, বিশ্বাসীকে তার কর্তাসত্তার অনুসারী হওয়া থেকে অপসারণ করা এবং ইসলাম ও রাষ্ট্রকে একই সমীকরণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা।” মুসলিম সমাজের এই সংকটগুলোই মূলত এ প্রবন্ধে নির্মোহভাবে  উৎপত্তিসন্ধান করা হয়েছে।

অনুবাদক: জাহিদুল ইসলাম

 

ইসলামের অভ্যন্তরে গভীর পুনর্বিবেচনার বিষয় দীর্ঘসময় ধরে অতীত হয়ে রয়েছে। মুসলমানরা সনাতনী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে দিব্যি আস্থা রেখে যাচ্ছে, যার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে পিছিয়ে রয়েছে। এজন্য  আমরা স্বভাবতই সমসাময়িক বিশ্বে কষ্টদায়ক অনুভূতিতে ভোগী, আধুনিকতার সাথে অস্বচ্ছন্দতায় ভোগী। পন্ডিত এবং চিন্তকরা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইসলামের সংস্কারের যৌক্তিক সংগ্রাম এবং পুনর্বিবেচনার জন্য আমাদেরকে ইজতিহাদের বিষয়ে গুরুতর প্রচেষ্টা নির্মাণের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে জামালুদ্দিন আফগানি এবং মুহাম্মদ আবদুহ নতুন ইজতিহাদের আহবানের নেতৃত্ব দেন। এই পথে মোহাম্মদ ইকবাল, মালিক বিন নাবি, আব্দুল কাদির আওদাহ সহ অনেক উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ এবং প্রাজ্ঞজনরা  এই আবেদনকে সংযুক্ত করেছেন। এখন পর্যন্ত মুসলিম সমাজ ইজতিহাদ বিষয়টিকে ধারণ করতে বিশেষভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কেন?

এই ‘কেন’ ১১ সেপ্টেম্বরের পরে একটি অতিরিক্ত প্রয়োজনীয়তা অর্জন করেছে। সেদিনের ভয়াবহ ঘটনা অন্যকিছুর চেয়ে  সবচেয়ে বেশি যা প্রকাশ করে তা হচ্ছে, ইসলামের নিহিতার্থ এবং স্পৃহা থেকে দূরত্ব রেখে আমরা বিচরণ করি। একটি মুক্তিকামী শক্তি হয়ে ওঠা, একটি গতিশীল সমাজ, সমতা, ন্যায়বিচার এবং মানবিক মূল্যবোধের জন্য সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক গতিশীলতা থেকে দূরবর্তী হয়ে সম্ভবত ইসলাম একটি আবেগপূর্ণ সম্পর্কের চেহারা অর্জন করছে। প্রকৃতপক্ষে, এটি আমার কাছে মনে হয় যে, ইসলাম এবং মুসলিমদের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের যেসব উপস্থাপন দীর্ঘ শতাব্দী  ধরে প্রদর্শিত হচ্ছে আমরা সেসব ঐতিহাসিক ও সমসাময়িকতাকে অন্তরীণ করে রেখেছি। আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, পশ্চিম আমাদের সম্মিলিত ব্যক্তিত্বের উপর যে দানবিক প্রদর্শনী আরোপ করছে আমরা এখন মূলত তার পোশাকী রূপ ধারণ করে আছি।

কিন্তু পাশ্চাত্যকে শুধুমাত্র দোষারোপ করা, অথবা যান্ত্রিক আধুনিকতায় বিশ্বাস করা এগুলো নিছক আমাদের ভুলক্রটি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে। এটি আমাদের জন্য খুবই আরামদায়ক সুযোগ। এটি সত্যি যে পাশ্চাত্য, সুনির্দিষ্টভাবে আমেরিকাকে দায়বদ্ধ করার বিশাল সুযোগ রয়েছে। এবং আমেরিকান ও ইউরোপীয় বৈদেশিক নীতি ও আধিপত্যশীল প্রবণতার অন্যায্যতার দিকে মুসলমানরা খুব সহজেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। যাইহোক, এটি শুধুমাত্র একটি দিক, আমার বিশ্লেষণ এই অনতিক্রম্য সংকটের  অংশভুক্ত নয়। আধিপত্যের বিষয়টিকে সবসময় আরোপিত নয়; মাঝেমধ্যে একে আমন্ত্রণ করা হয়। ইসলামের সাথে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সম্পর্ক একে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমন্ত্রণ জানায়।

খুব বেশি গুরুতর কারণে আমরা ইজতিহাদের আহবানে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের পবিত্র গ্রন্থ প্রসঙ্গ, দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তনীয় থাকা কোরআন এবং নবী মোহাম্মদের উদাহরণকে আমরা চূড়ান্ত সূত্র হিসেবে ব্যবহার করি। একজন শুধুমাত্র একটি গ্রন্থের সাথে ব্যাখ্যামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, অথবা তারচেয়েও বেশি, যখন সে এই গ্রন্থের সাথে শাশ্বত সম্পর্ক গড়ে তুলে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যামূলক প্রসঙ্গ যদি কখনো আমাদের প্রসঙ্গ না হয়, আমাদের সময়ের না হয়, তখন সেই ব্যাখ্যামূলক বিশ্লেষণ, আমরা যেভাবে আছি তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথবা অর্থবহ হয়ে ওঠে না।  ঐতিহাসিক বিচার বিশ্লেষণ আমাদেরকে অতীতে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়; দীর্ঘ সময় পূর্বের প্রাসঙ্গিকতাকে জমিয়ে রাখে ও শক্তিশালী করে; খুবই বাজেভাবে প্রাসঙ্গিকতাকে কল্পনাকাতর ও হৃদয়ঙ্গম করা হয় যা কখনো ইতিহাসের মধ্যে অস্তিত্বশীল ছিল না। যার ফলে, মুসলমানরা যখন ইসলামের সাথে খুবই শক্তিশালী আবেগতাড়িত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, ইসলাম তখন অপরিহার্যভাবে আধ্যাত্মিক উদ্বেগ এবং উপাসনা ব্যতীত বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতার পদ্ধতি হিসেবে তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সরাসরি প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক রাখেনা। তখন ইজতিহাদ এবং নতুন ধরনের চিন্তাভাবনা সম্ভব হয়ে ওঠেনা, কেননা একে স্থান দেওয়ার মতো কোন প্রাসঙ্গিকতাই তাদের কাছে নেই।

অপরিবর্তনীয় বিচার বিশ্লেষণ হচ্ছে ‘ইজতিহাদের প্রবেশ পথের’ বাধা যা মুসলমানদের চিন্তা ও কার্যাবলির বিধ্বংসী ফলাফল বয়ে নিয়ে আসছে। এটি যা উৎপাদন করে তাকে আমি তিনটি অধিবিদ্যক বিপর্যয়ের মাধ্যমে বর্ণনা করি। শরিয়াহ-এর তাৎপর্যকে  ঐশ্বরিক পর্যায়ে স্থান দেওয়া; বিশ্বাসীকে তার কর্তাসত্তার অনুসারী হওয়া থেকে অপসারণ করা; ইসলাম ও রাষ্ট্রকে একই সমীকরণের অন্তর্ভুক্ত করা। বিস্তারিত ভাবে বললে, শরিয়াহ আইন যাকে সাধারণত ইসলামি আইন হিসেবে অনুবাদ করা হয়, অধিকাংশ মুসলিম একে ঐশ্বরিক হিসেবে বিবেচনা করে। যদিও শরিয়াহ-এর মধ্যে ঐশ্বরিক বলতে কিছু নেই। ইসলামের মধ্যে একমাত্র বিষয় যাকে ন্যায়সঙ্গতভাবে ঐশ্বরিক হিসেবে বর্ণনা করা যায় তা হচ্ছে কোরআন। শরীয়াহ হচ্ছে মানুষের নির্মাণ; ঐশ্বরিক ইচ্ছাকে একটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে বোঝাপড়ার প্রচেষ্টা। এজন্যই শরিয়াহ-এর পরিসর প্রধানত  ফিকহ অর্থাৎ আইনশাস্ত্র দ্বারা গঠিত যা মূলত ধ্রুপদী ফকিহগনের আইনগত মতামত ছাড়া অন্য কিছু নয়। আব্বাসিয় খেলাফতের পূর্বে যখন একে সুসংহত ও সূত্রবদ্ধ করা হয় তখন ফিকহ শব্দটির খুব প্রচলন ছিলোনা। যখন ফিকহ তার পদ্ধতিগত আইনের রূপ ধারণ করে তখন এটি আব্বাসিয় যুগের মুসলিম সমাজের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্তর্ভুক্ত করে। প্রথমত, তখনকার সন্ধিক্ষণে, মুসলমানদের ইতিহাস তার সম্প্রসারণবাদী পর্বে ছিলো এবং ফিকহ তখনকার সময়ের মুসলিম সাম্রাজ্যবাদের যৌক্তিকতার সাথে একীভূত হয়। এজন্য ধর্মত্যাগীদের উপর ফিকহের শাসন কুরআন থেকে নয় বরং এই যুক্তি থেকে উদ্ভূত। দ্বিতীয়ত, তখনকার জগতকে খুব সহজেই সাদা এবং কালোয় বিভাজন করা যেতো; যেমন জগতকে দারুল ইসলাম (ইসলামিক রাজ্য) এবং দারুল হরবে (বিধর্মীদের রাজ্য) বিভাজন করা হয়েছিলো। তৃতীয়ত, এসব আইনের স্রষ্টারা সমাজিক পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তা ছিলেন না। যার ফলে আইন নিছক তত্ত্বে পরিণত হয়, যাকে কখনো পরিবর্তন করা যেত না। আইনের স্রষ্টারা এর ভূলক্রটিগত অবস্থান এবং নতুন চিন্তাভাবনা ও রূপান্তরের ক্ষেত্রে আইনের কীরকম দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন এগুলো চিহ্নিত করতে  অক্ষম ছিলেন। তথাপি যে ফিকহ বর্তমানে আমাদের নিকট পরিচিত তা একটি বিভাজনের উপর ভিত্তি করে আবর্তিত হতো। একদিকে হচ্ছে শাসকগোষ্ঠী যারা নিজেদেরকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখত অন্যদিকে হচ্ছে তারা যারা আইনকে কাঠামোবদ্ধ করে। মুসলিম ইতিহাসের ‘সোনালী’ পর্যায়ের জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারণা তখনকার সময় থেকেই সক্রিয় হয়। যখন আমরা শরিয়াহকে ঐশ্বরিক হিসেবে বর্ণনা করি তখন আমরা অতীতের প্রাধান্যযুক্ত ফিকহ-এর মধ্যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা আরোপ করি।

বাস্তবিক এর অর্থ হচ্ছে যখন মুসলিম দেশসমূহ শরিয়াহ প্রয়োগ অথবা আরোপ করে তখন ফিকহ বাস্তবায়ন ও ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে এর যেসব জন্মগত অসঙ্গতি রয়েছে তা সম্মুখে ফিরে আসে। যেগুলো ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে  নাইজেরিয়ার মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা। এজন্য যখনই শরিয়াহ আরোপ করা হয় তখনই ফিকহ আইন ব্যবস্থাকে প্রয়োগ করা হয়। যখন থেকে এটিকে বাস্তবায়ন করা হয় তখনকার সময় থেকেই এটি প্রসঙ্গের বাইরে ছিলো এবং আমাদের  সময়েও এটি প্রসঙ্গের বাইরে। এর মাধ্যমে মুসলিম সমাজ মধ্যযুগীয় অনুভূতি অর্জন করে। আমরা এটি সৌদি আরব,সুদান এবং তালেবান আফগানিস্তানের মধ্যে দেখতে পাই। যখন (শরিয়াহ) এর আদেশদাতা অথবা এর চিন্তাগোষ্ঠী, এটি বাস্তবিক জগতের সাথে প্রাসঙ্গিক কি না তা বিবেচনা না করে আদর্শ এবং মূল্যবোধ হিসেবে স্থাপন করে তখন এটি ফিকহ-এর সাথে সঙ্কীর্ণ সংযোগ স্থাপন করে। ‘শরিয়াহ আমাদের সব সমস্যার সমাধান করবে’ এটি একটি সাধারণ অনুভূতিতে পরিণত হয়েছে। এটি সেইসব গোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে যারা শরিয়াহ এর ধারণাকে তাদের অবস্থানকে সংরক্ষণের  কায়েমী স্বার্থে ব্যবহার করে। ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির উৎসকে যেকোন মূল্যেই সংরক্ষণ করাই এর লক্ষ্য। এভাবেই শরিয়াহ একটি সেকেল আইনের পরিধির প্রতিরূপ লাভ করে এবং ঐশ্বরিক প্রকৃতি হিসেবে দাবি জানিয়ে এর সমালোচনাকে পরিত্যক্ত ও বেআইনী ঘোষণা করা হয়।

শরিয়াহকে ঐশ্বরিক পর্যায়ে প্রতিস্থাপনের অর্থ হচ্ছে বিশ্বাসীদের নিজস্ব কোন কর্তাসত্তা নেই। যেহেতু এই আইন অভিজ্ঞতাপূর্ব(a priori) প্রদত্ত তাই মানুষের এগুলোকে অনুসরণ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আর এভাবেই বিশ্বাসীরা সত্যের ব্যাপারে সক্রিয় অনুসন্ধানী হওয়ার চেয়ে বরং নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা হিসেবে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে শরিয়াহ কতগুলো নীতিমালার অনুষঙ্গ, মূল্যবোধসমূহের গঠনকাঠামো ছাড়া বিশেষ কিছু নয় যা মুসলিম সমাজের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এসব নীতিমালার অনুষঙ্গ, মূল্যবোধসমূহের গঠনকাঠামো স্থির প্রদত্ত নয় বরং এগুলো পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটের সাথে গতিশীলভাবে উদ্ভূত। এজন্যই শরিয়াহ হচ্ছে আইন অপেক্ষা সমস্যা সমাধানের প্রণালী বিদ্যা। এটি বিশ্বাসীদের স্ব-উদ্যোগী হওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করে এবং অনবরত কোরআনের পুনর্ব্যাখ্যা এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নবী মোহাম্মদের জীবনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অবশ্যই, যুগ যুগ ধরে কোরআনের পুনর্ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। যার অর্থ হচ্ছে শরিয়াহ ও ইসলামের নিজস্ব সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে  পুনর্নির্মিত হয়ে আসছে।  ইসলামের মধ্যে যে বিষয়টি অপরিবর্তনীয় হিসেবে রয়েছে তা হচ্ছে কোরআন এবং এর প্রত্যয়সমূহ নিয়ত পরিবর্তনশীল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের গতিশীল যোগানদাতা হিসেবে কাজ করে।

সুসংহত বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ইসলাম অতিমাত্রার ধর্মচারণ নয়। এজন্য বলা যায় এটি মানবীয় প্রচেষ্টার সকল দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিবেচনা প্রদানের মাধ্যমে বাস্তবতার সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গিকেই সুসংহত করে। ইসলাম সমস্ত মানবীয় সমস্যার পূর্ব-প্রস্তুতকৃত সমাধান প্রদান করেনা। এটি শুধুমাত্র নৈতিক এবং ন্যায্য প্রেক্ষাপট প্রদান করে যার মাধ্যমে মুসলমানরা সকল মানবীয় সমস্যার সমাধান খোঁজার ব্যাপারে উদ্যমী হয়ে ওঠে। সবকিছুই যদি ঐশ্বরিক শরিয়াহ আকারে অভিজ্ঞতাপূর্ব প্রণীত হয়, তাহলে ইসলাম তখন একটি সর্বাত্মকবাদী আদর্শে পরিণত হয়। ইসলামিক আন্দোলনসমূহ ইসলামকে এই পর্যায়েই নিয়ে আসে; বিশেষত জামাত-ই-ইসলাম (ভিন্নভাবে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশে) এবং মুসলিম ব্রাদারহুড। যেটি আমাকে তৃতীয় অধিবিদ্যক বিপর্যয়ের নিকট নিয়ে যায়। ঐশ্বরিক গুণাবলীসম্পন্ন শরিয়াহকে কেন্দ্রে নিয়ে এই আদর্শকে একটি জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা হয়। আর এভাবেই একটি ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইরান থেকে শুরু করে সৌদি আরব, সুদান ও উচ্চাভিলাষী পাকিস্তান সহ সকল সমসাময়িক ‘ইসলামিক রাষ্ট্রসমূহ’ এই উপহাসযোগ্য ধারণার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। ইসলাম যখন আদর্শ হিসেবে কোন কায়েমী গোষ্ঠীর কর্মতৎপরতা হয়ে ওঠে, এটি তখন তার মানবিকতাকে হারিয়ে রণক্ষেত্রে  পরিণত হয়। আবেগের বিকল্প হিসেবে এখানে নৈতিকতা, যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতা নির্দ্ধিধায় তার অবস্থানকে বিসর্জন দেয়। এটি হচ্ছে সর্বাত্মকবাদী আদর্শ থেকে সর্বাত্মকবাদী শৃঙ্খলার দিকে গমনের পদক্ষেপ, যেখানে রাষ্ট্রিয় স্বেচ্ছাচারিতার নিকট মানবীয় পরিস্থিতি উন্মুক্ত থাকা একটি তুচ্ছ বিষয়। ইসলামকে একটি রাষ্ট্র-ভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে রূপান্তর ঘটানোর মাধ্যমে শুধুমাত্র এর নৈতিকতা ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়না বরং এর মাধ্যমে অধিকাংশ ইসলামিক ইতিহাসকে অনৈসলামিক হিসেবে প্রতিপন্ন করা হয়। একইভাবে, যখন ইসলামিস্টরা একটি স্বর্ণযুগের অতীতকে পুনরায় আবিষ্কার করে তখন তারা বর্তমানকে অবজ্ঞা ও ভবিষ্যতকে উপহাস করার লক্ষ্যেই এটি করে। আমরা সবকিছুতেই মিসিয়ানিক বিশৃঙ্খলার  মধ্যে রয়ে গেছি, যেটি আমরা তালেবান শাসনামলে খুবই প্রাণবন্তভাবে দেখেছি। যেখানে সমস্ত রাজনীতি তার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকে এবং অর্থহীন ধর্মানুরাগ রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তিতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের মাধ্যমে ইসলামের সর্বাত্মকবাদী হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা মুসলমানদের রাজনীতিকে একটি অধিবিদ্যার মধ্যে রূপান্তর ঘটায়। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে প্রত্যেকটি কাজকেই রাজনৈতিক নির্দেশনার যৌক্তিকতার জন্য ‘ইসলামিক’ হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয় যা বৈপ্লবিক ইরানের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।

এই তিন ধরনের অধিবিদ্যক বিপর্যয় সামগ্রিকভাবে লঘুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে ঝোঁকে রয়েছে এবং এটি মুসলিম সমাজের আদর্শে পরিণত হয়েছে। লঘুকরণের এ প্রক্রিয়া যদিও নতুন কিছু নয়; কিন্তু বর্তমানে এটি একটি অদ্ভুত অবস্থানে পৌঁছেছে যে, যেসব যথার্থ চিন্তাভাবনা মুসলিম সমাজকে মানবিক মূল্যবোধসমূহের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করা হয় এগুলো এখন বিপরীত অভিমুখে পরিচালিত হচ্ছে। সূক্ষ্ম বর্ষজীবী হওয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, সহানুভূতি ও ক্ষমাশীলতার মাধ্যমে ন্যায্যতাকে নির্মাণের বদলে  আমরা যান্ত্রিক সূত্রসমূহকে চিরস্থায়ীভাবে চূড়ান্ত পুনরাবৃত্তিমূলক হিসেবে লাভ করেছি। এজন্য জনসাধারণ নিশ্চিন্ত যে তাদের নিজেদের জন্য চিন্তাভাবনার কোন দায় নেই কেননা তাদের সব সমস্যার সমাধান ধ্রুপদী উলামাদের (নবীদের উত্তরসূরি) মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে; যারা দীর্ঘ সময় পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছেন। যেহেতু সমস্ত কার্যাবলিকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেওয়া হয় তাই প্রশ্ন করা অথবা এগুলোর বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক করা পাপের সাদৃশ্য হিসেবে মত প্রদান করা হয়।

লঘুকরণের প্রক্রিয়া অতিরঞ্জিত আলেমের (প্রজ্ঞাবান) নিজস্ব ধারণার মাধ্যমে সূচনা ঘটে। একজন আলেম কাকে বলা হয়? কিসের মাধ্যমে তিনি কতৃপক্ষে পরিণত হন? ইসলামের সূচনার দিকে যিনি ইলম অথবা জ্ঞান অর্জন করতেন তিনিই আলেম হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ জ্ঞান বিস্তৃত দিক থেকে বর্ণিত ছিলো। আমরা এটি জ্ঞানের শ্রেণীকরণের সূচনার দিকে আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইবনে সিনা, আল-গাজ্জালি এবং ইবনের খালদুনের মতো চিন্তকদের মধ্যে দেখতে পাই। নিশ্চিতভাবে, জ্ঞানের সংজ্ঞায়ন এবং জ্ঞানের শ্রেণীকরণ উভয় বিষয়ই ধ্রুপদী ইসলামের প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যাবলিতে পরিণত হয়। কাজেই বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক, শিক্ষক এবং ধর্মতাত্ত্বিক সমস্ত প্রজ্ঞানবান লোকদের নিয়েই উলামারা গঠিত। কিন্তু আব্বাসিয় শাসনামলে যখন ‘ইজতিহাদের প্রবেশ পথ’ বন্ধ হয়ে গেলো, ইলম (জ্ঞান) তখন শুধুমাত্র ধর্মীয় জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো এবং ধর্মীয় পন্ডিতদের মধ্য থেকেই উলামাদের গঠন শুরু হয়।

একইভাবে, ইসলামের সম্প্রদায়গত জীবনের কেন্দ্রে যে ইজমা-এর ধারণা রয়েছে তাকে নির্বাচিত কিছু সম্মতির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। ইজমার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে জনসাধারণের সম্মতি। এই ধারণাটি দীর্ঘ অতীতে নবী মোহাম্মদ একজন মুসলিম শাসনব্যবস্থার প্রধান হিসেবে স্বয়ং চর্চা করতেন। যখন নবী মোহাম্মদ কোন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করতেন তখন তিনি সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়কে আহবান করতেন। তারপর, নি:সন্দেহে তারা খুব বেশি না হলেও মসজিদে একপ্রকার জনসমাবেশ হতো। যেখানে কোনকিছুর পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তিতর্ক প্রদর্শনের মাধ্যমে সীদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। চূড়ান্তপর্যায়ে জনসাধারণ একটি সম্মতিতে পৌঁছাত। এইভাবে ইসলামের সূচনার দিকে সম্প্রদায়গত এবং রাজনৈতিক জীবনে একটি গণতান্ত্রিক স্পৃহা কেন্দ্রিভূত ছিলো। সময়ের পরিক্রমায় ধর্মীয় পন্ডিতরা জনসাধারণকে তাদের এ অবস্থান থেকে সরিয়ে ইজমাকে ‘ধর্মীয় পন্ডিতদের সম্মতির’ মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। তাই এটি আশ্চর্যজনক নয় যে, কতৃত্ববাদ, ধর্মতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র মুসলিম বিশ্বে এখন প্রধান্য বিস্তার করছে। রাজনৈতিক পরিচর্চা তার কার্যক্ষেত্রে এমন এক আদর্শকে খুঁজে পেয়েছে যেখানে ধর্মীয় পন্ডিতরা কতৃত্বের সাথে তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে পরিচর্চা করেন; যারা নিজেদের এককভাবে ইসলামের পথপ্রদর্শক হিসেবে দাবি করেন। উলামার ছদ্ম আবরণে ভেকধারী পন্ডিত মুসলিম সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং অদ্ভুতভাবে যুক্তিতর্ককে লঘুকরণের মাধ্যমে জনসাধারণকে অন্ধবিশ্বাসের মধ্যে আবদ্ধ রাখেন।

এইভাবে বিভিন্ন প্রত্যয়সমূহ লঘুকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উম্মাহ (সম্প্রদায়) প্রত্যয়ের মধ্যে যে বৈশ্বিক মুসলিম সম্প্রদায়ের বোঝাপড়া ছিলো তাকে একটি জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ‘আমার দেশ সঠিক অথবা ভুল’ এই বিষয়টি ‘আমার উম্মাহ ভুল অথবা সঠিক’-এর মধ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। কাজেই সাদ্দাম হুসেনের মতো বর্তমানে অনেক স্বৈরশাসক নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ‘উম্মাহ চেতনা’ এবং ‘উম্মাহ-এর অখণ্ডতাকে’ ব্যবহার করছে। জিহাদকে এককভাবে পবিত্র যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এর ভাষান্তর এজন্য বিকৃত নয় যে এর ধারণাকে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক উপাদান থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে বরং এটি এজন্য যে, একে যেকোন প্রকারের যুদ্ধের নামে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে; এমনকি জঙ্গিবাদের নামেও। কাজেই কোন ধরনের নৈতিক এবং ন্যায্য কারণ ছাড়া  এখন যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে পারে। অন্য কোনকিছু এতোটা বিকারগ্রস্তভাবে বিচ্যুতি ও বিকৃত হয়নি যেভাবে জিহাদ তার প্রারম্ভিক অর্থ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত সংগ্রাম, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা এবং সামাজিক বিনির্মাণের অন্যান্য যেসব নিহিতার্থ রয়েছে এসবকিছুকেই বিলুপ্ত করা হয়েছে। ইসতিসলাহ, যাকে সাধারণত ‘জনসাধারণের সার্থ’ হিসেবে চর্চা করা হয়; এটি ইসলামিক আইনের অন্যতম একটি উৎস হলেও বর্তমানে এটি মুসলমানদের চৈতন্য থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। ইজতিহাদ, যা সম্পর্কে আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি এটি এখন ধর্মচারী আকাঙ্ক্ষায় আবদ্ধ ছাড়া অন্যকিছু নয়।

সহিংসতাকে যেভাবে চর্চা করা হয় সে সম্পর্কে কোরআন এবং নবী মোহাম্মদের কথাও কাজের তুলনায় বর্তমান ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধারণা খুবই উদ্বেগজনক। প্রয়াত মুসলিম চিন্তক ফজলুর রহমান কোরআনের যে ‘পরমাণুগত’ প্রতিষেধকের কথা বলেছেন এটি প্রায় মূল্যবোধে পরিণত হয়েছে। প্রায় কোনকিছুতে অথবা সবকিছুতেই কোরআনের আয়াত থেকে অংশত অপ্রাসঙ্গিকভাবে উদ্ধৃতকরণের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ৯/১১ ঘটনা পরবর্তী সময়ে অসংখ্য তালেবান সমর্থক, এমনকি যাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক ব্রিটেনের বাসিন্দা, তাদের কার্যাবলিকে এই আয়াতের মাধ্যমে বৈধতা প্রদান করে : ‘যারা অবিশ্বাস করেছে, আমি শিগগিরই তাদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি করব। যেহেতু তারা আল্লাহর কাছ থেকে কোন প্রমাণ পাওয়া ছাড়াই আল্লাহর শরীক বা অংশীদার দাঁড় করিয়েছে। দোযখই তাদের বাসস্থান এবং তা জালেমদের জন্য নিকৃষ্ট বাসস্থান।’ (৩:১৫১) যদিও এই আয়াতের আপাত গুণ বর্তমান সময়ের কোরআনের সত্যিকারের স্পৃহার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। এই বিশেষ আয়াতটি কোরআনে শুধুমাত্র নবী মোহাম্মদকে নির্দেশ করে রচিত। এটি উহুদের যুদ্ধের সময় প্রকাশিত হয় যে সময় ক্ষুদ্র ও দুর্বলভাবে সজ্জিত নবীর সামরিক বাহিনী অতি বৃহত্তর এবং প্রবলভাবে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর সাথে মোকাবিলা করে। তিনি যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কোরআন তাকে নিশ্চয়তা প্রদান করে এবং নবীর অ-পেশাদারী বাহিনীর মাধ্যমে শক্রকে ভীতি প্রদর্শন করা হবে বলে অঙ্গীকার প্রদান করা হয়। এর প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে এটি সকল মুসলমানদের জন্য কোন সাধারণ নির্দেশনা নয়। এটি তখনকার সময় কী ঘটেছিলো তার একটি ভাষ্য। একইভাবে চরমপন্থী আচরণকে বৈধতা দেওয়ার জন্য হাদিসকে ব্যবহার করা হয়। দাড়ি এবং পোশাকের মাধ্যমে নবীকে যেভাবে হাজির করা হয় তা একটি দেবমূর্তিতে পরিণত হয়েছে। কাজেই দাড়ি থাকা একজন ‘ভালো মুসলিমের’ জন্য শুধুমাত্র বাধ্যতামূলক নয় বরং এর আকার আকৃতিতে অনুরূপ হওয়া আবশ্যক। নবীকে শুধুমাত্র চিহ্ন এবং প্রতীকের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তার চারিত্রিক স্পৃহা,  তার কার্যাবলীর নৈতিক এবং নায্য মাত্রা, তার নম্রতা এবং সহানুভূতি, যেসব সাধারণ নীতিগুলোকে তিনি সমর্থন করতেন সবকিছুকেই লঘুকরণের অদ্ভুত যুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অধিবিদ্যক বিপর্যয়ের সমষ্টিগত প্রভাব এবং অসীম লঘুকরণ ইসলামের লালিত প্রেষণাকে যুদ্ধাংদেহী উপযোগিতা এবং ন্যায্যতার দেউলিয়াপনা যন্ত্রে রূপান্তর ঘটিয়েছে। গত দুই দশক ধরে আমি  যুক্তিতর্ক প্রদর্শন করে আসছি যে মুসলিম সভ্যতা বর্তমানে একটি খন্ডিত এবং ভঙ্গুর সভ্যতা যাকে আমাদের ‘স্তরে স্তরে’ পুননির্মাণ করতে হবে। এটি এখন সুস্পষ্ট যে আদর্শক্রমে ইসলামের নিজেই নিজেকে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।

আমাদেরকে সাধারণ একটি বাস্তবতা থেকে সূচনা ঘটাতে হবে যে কোনটি সঠিক, কোনটি ভালো, কোনটি ন্যায্য এধরনের সত্যের উপর মুসলমানদের একক কোন কতৃত্ব নেই। এমনকি এগুলো সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক প্রতিক্রিয়া বিকশিত করার প্রয়োজনীয়তা নেই। অন্যান্য মনুষ্যপ্রকৃতির মতো আমরা এগুলো অর্জন করার প্রচেষ্টা করব আমাদের নিজেদের বিশুদ্ধ ধারণা ও প্রত্যয়সমূহকে ব্যবহার করার মাধ্যমে। যেগুলো আমাদের সমসাময়িক বাস্তবতার সাথে বোঝাপড়া ও পুননির্মাণের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

অধিবিদ্যক বিপর্যয়সমূহকে মোকাবিলা করার ও কৃত্রিম লঘুকরণ থেকে দূরে থাকার জন্য একটি প্রাণবন্ত পথ খোঁজার সমসাময়িক ইসলামের ক্ষেত্রে পর্যালোচনামূলক কার্যাবলির দাবী রাখে। এটি মুসলমানদের প্রধানতম প্রয়োজন যে ইসলামের মূল ভিত্তিসমূহকে ব্যাখ্যা এবং পুনঃব্যাখ্যার মাধ্যমে ব্যক্তিগত এবং সম্প্রদায়গতভাবে নিজস্ব কর্তাসত্তাকে পুনরূদ্ধার করা। শরিয়াহ-এর সাধারণ ধর্মবিধির আওতায় কী ঘটে যাচ্ছে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। অধিকাংশ ফিকহ বা আইন যে বর্তমান সময়ে ভয়ানক অপ্রচলিত তা ঘোষণা করা। অদ্ভুত ধারণার মাধ্যমে ইসলামকে যেভাবে শুধুমাত্র ভৌগোলিকভাবে আবদ্ধ রাষ্ট্রের মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছে তাকে প্রতিহত করা এখন সময়ের দাবী। যদি আমরা আমাদের নিজেদের বিশ্বাসকে সত্যিকার অর্থে মূল্যায়ন করতে জানি তাহলে আমরা কখনো এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকে তাদের হাতে সমর্পণ করতে পারিনা যারা অশিক্ষিত অভিজাত শ্রেণী ও ধর্মীয় পন্ডিত। তাদের সমসাময়িক বিশ্ব সম্পর্কে উপলব্ধির অভাব রয়েছে, যা সাধারণত আধুনিকতা সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণা ও সাংস্কৃতিক উৎপাদন সম্পর্কে  তাদের অবজ্ঞা ও ঘৃণার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সতের শতকের বিশ্বের চেয়ে বর্তমানে আমরা যে বিশ শতকে বসবাস করছি তাতে খুবই অভ্যস্তভাবে জনসাধারণের পেশাদারি সীমানায় ইসলাম অনুমোদিতভাবে ম্লান হয়ে আসছে। আমরা এইসব শ্রেণীকে দূরবর্তী ইতিহাসের মধ্যে জমিয়ে রেখে ইজতিহাদের ধারণাকে সমাহিত করার কখনো অনুমোদন প্রদান করতে পারিনা।

সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সাধারণ মুসলমান যারা সমসাময়িক রাষ্ট্রের সাথে ইসলামের ন্যায্যতার জটিলতা নিয়ে উদ্বেগ, প্রশ্ন এবং বিবেচনাবোধ  রয়েছে তাদের আবশ্যিকভাবে ইসলামের মূল প্রত্যয়সমূহকে পুনরুদ্ধার করা এবং বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে সংশোধন করা প্রয়োজন। ইজমাহ হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক ও দায়িত্বশীল সরকারব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সমস্ত নাগরিকদের আবশ্যক সম্মতি। জিহাদকে বুঝতে হবে এর সার্বিক ব্যাখ্যার মধ্য থেকে যা হচ্ছে সব মানুষের জন্য জীবন্ত বাস্তবতা হিসেবে শান্তি ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম। এবং উম্মাহ-এর ধারণাকে পুনরায় সংজ্ঞায়ন আবশ্য,  যেনো এটি তার সীমাবদ্ধ বিমূর্তরূপ থেকে বের হয়ে আসতে পারে। আনোয়ার ইব্রাহিম যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে উম্মাহ বলতে ‘যে সম্প্রদায়  কেবলমাত্র নিজেদের মুসলিম বলে স্বীকার করে’ তারা নয়, বরং উম্মাহ হচ্ছে ‘কিভাবে মুসলমানরা অন্যান্য সম্প্রদায়,  প্রকৃতির রাজ্যের এবং নিজেদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হবে তার নৈতিক ধারণশক্তি।’ অর্থাৎ উম্মাহ বিষয়টি শুধুমাত্র মুসলমিদের সাথে সম্পর্কিত নয় অধিকন্তু এটি ন্যায্যতার অনুসন্ধানকারী ও নিপীড়িতদের সাথে সম্পর্কিত। এই দৃষ্টিকোন থেকে সমন্বয়ের অগ্রগতির যে আন্দোলন, তা হচ্ছে ইসলামের নৈতিক এবং ন্যায্যতা যেসব তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রাথমিক বার্তা রয়েছে তার মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থাকে নতুন এক মাত্রা প্রদান করা। যার মাধ্যমে এটি শান্তিপূর্ণ নাগরিক সংস্কৃতির একটি ক্ষেত্র হিসেবে; অংশগ্রহণমূলক প্রচেষ্টাও সার্বিকভাবে জানার পদ্ধতি হিসেবে জনসাধারণের অস্তিত্বশীলতা ও ক্রিয়াশীলতার সাথে সম্পর্কযুক্ত হবে।

যদিও ৯/১১ এর ঘটনা এসব মহৎ উদ্দেশ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তবুও ইসলামের সত্যিকারের মূল্যবোধের ফিনিক্স প্রকৃতপক্ষে টুইন টাওয়ারের ছাই থেকে উদ্ভূত হবে।

 

অনুবাদের উৎস

Ziauddin Sardar, Rethinking Islam in “Islam, Postmodernism and Other Futures: A Ziauddin Sardar Reader” Edited by Sohail Inayatullah and Gail Boxwell, Pluto Press, 2003, p.27-35

 

More Posts From this Author:

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!