প্রশ্নোত্তর:
শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিকঅবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?
মারুফ রায়হান: লেখক হতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে লেখকই হতে চেয়েছি চিরকাল; লেখা ভালোবেসেছি; লেখাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছি। কারণ এটি কোনো শখের বিষয় নয়। কিংবা নয় এমন কিছু যা খন্ডকালীন মনোযোগের। ধরুন গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করলাম, স্টার্ট নিলাম, তারপর সাবধানে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যস্থলে; কাজ সেরে আবার একইভাবে গাড়ি চালিয়ে এসে গ্যারাজে ঢুকিয়ে তৃপ্ত মনে হাতে চাবি নিয়ে লিভিংরুমে ফিরলাম। লেখা এমন নয়। লেখা হচ্ছে চিরজীবনের যাত্রা, তাতে সুনির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে না। নেই গন্তব্যের সীমারেখা। নেই পরম স্বস্তিভরে ফিরে আসা। প্রতিটি লেখাই একেকটি যাত্রা ও সংগ্রাম, তাতে থাকে কিছুটা দ্বিধা ও মিশ্রছন্দ। থাকে লেখার মান নিয়ে সংশয়, প্রকাশসফলতা নিয়ে দোদুল্যমানতা। লেখা নিয়ে লেখক চূড়ান্ত তৃপ্ত ও সুখী হলে বুঝতে হবে তাঁর লেখক হওয়ার ঢের বাকী। যাহোক, আমার শৈশবই কি নির্ধারণ করেছিল আমি লেখক-জীবন বেছে নেব? লেখার ভুবন আমাকে কীভাবে টেনেছিল? প্রথমেই মনে পড়ে বইয়ের কথা। বাসায় নিবিষ্ট মনে বই পড়তে দেখেছি আম্মাকে। বলা যায় কিশোরী বয়সই তো ছিল তাঁর, খুলনার এক গহন পল্লী থেকে আব্বার চাকরিসূত্রে তাঁর বড় শহর করাচিতে আসা। জানি না কী করে তিনি বইকেই আত্মীয় করে নিয়েছিলেন। বইয়ের জন্ম দেয় কারা এমনটা ভাবতাম ছেলেবেলায়। তাঁরাও কি একেকজন ঈশ্বর, মানে স্রষ্টা! এভাবে ছেলেবেলাতে লেখকই আমার কাছে নায়ক।
কিন্তু আমার লেখার শুরু কবে, কীভাবে? এক জায়গায় লিখেছি: ‘সম্ভবত সহপাঠিনীর প্রেমে পড়ার পর নিজের ভেতর কবিতার কলকল টের পাই, কবিকে নয়। সদ্য কলেজপড়–য়া তখন আমি। একতরফা ছিল সে প্রেম। প্রেমনিবেদনের মাধ্যম হিসেবে কবিতা বেছে নেয়া। পরে অবশ্য প্রেমিকার বদল হয়। মানবী থেকে কবিতা। সেই প্রেম টুটেনি, যদিও সেটাও একতরফা।’
ওই বক্তব্যে আংশিক সত্যতা রয়েছে। আমার তারুণ্যের শহর যশোরে শিল্পী এস এম সুলতানের কাছে ছবি আঁকা শিখতে যেতাম। আঠারোয় যখন ঢাকা চলে এলাম, অল্প ক’বছরের মধ্যে অভিনয় এবং সংগীতশিক্ষা-দুটোই হয়ে উঠেছিল ধ্যানজ্ঞান। অথচ শিল্পের ওই তিন শাখার কোনোটিতেই আমি সক্রিয় থাকিনি। চিনে নিয়েছি নিজের প্রকৃত প্রেমকে, ফিরে এসেছি শব্দের গ্রহে। সতেরোর তোরণে দাঁড়িয়ে যে-কিশোর লিখতে শুরু করেছে তার কিনা প্রথম গ্রন্থটি বেরুলো বহু বিলম্বে, ত্রিশ বছর বয়সে! নিজের লেখা মলাটবন্দি করায় কি ছিল উদাসীনতা? নাকি সংশয় সংকোচ!
আমার তখন মোটে ঊনিশ। আমাদের নাটকের দল আরণ্যক মে দিবস উপলক্ষে কবিতা-গান ও পথনাটক প্রদর্শনীর সূচনা করল। সেখানে কবিতা পড়লাম। মোহাম্মদ রফিক পিঠ চাপড়ে দিলেন। বেতার মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাফা আনোয়ার তৎক্ষণাৎ আমন্ত্রণ জানালেন পরদিন কবিতাটি রেডিও সেন্টারে গিয়ে রেকর্ড করার। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানও পছন্দ করতেন সেই তরুণের কবিতা; একের পর এক প্রকাশ করেছেন তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকা বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’ সম্পাদনা করতেন আবু হেনা মোস্তাফা কামাল। অখ্যাত অপরিচিত এক তরুণকে তিনিও দারুণ অনুপ্রাণিত করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার কবিতা নিয়ে বক্তৃতা দিলেন হুমায়ুন আজাদ। তুখোড় সমালোচক হিসেবে তখনই বিখ্যাত তিনি। আশ্চর্য এক কথা বললেন দেশের কবিদের সম্পর্কে। জানতাম জীবনানন্দ বলেছেনÑ সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। তিনি বললেন শত শত ব্যক্তির কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে প্রকৃত কবি হলেন মাত্র পনেরজন। উপস্থিত কবিরা তাঁকে অনুরোধ করলেন এই পনেরজনের নাম প্রকাশ করতে। আর কী অবাক কা-, তিনি একে একে নামও বলতে শুরু করে দিলেন। গ্রন্থহীন এই আনাড়ি নবীনের কয়টা কবিতাই বা বেরিয়েছে সেসময়। হুমায়ুন আজাদ তাঁর অতিসংক্ষিপ্ত কবিতালিকায় নামটিকে স্থান দিলেন।
অথচ আমার ব্যক্তিজীবন তখন টালমাটাল, নিজেকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারব কিনা নিজেই জানি না। ‘আত্মহনন’ নামের শয়তান আমার ছায়ার সঙ্গে হাঁটে নিত্যদিন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হয়তো বুঝেছিলেন। তিনিই জোরাজুরি করলেন কবিতার বই বের করার জন্য। দূরদৃষ্টি ছিল তাঁর। নিশ্চয়ই তিনি জানতেন বই বেরুনোর পর তাতে বাঁধা পড়ে যান লেখক, তাঁকে নতুন নতুন সৃষ্টির দিকে এগিয়ে যেতে হয়। তাঁর আর অন্য কোথাও যাওয়া হয় না। জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখলেন আমার প্রথম বই প্রকাশে। তিনিই তখন বইয়ের বাজার বাংলাবাজারের রাজকুমার। সদ্যভূমিষ্ঠ কন্যাসন্তানটিকে উৎসর্গ করলাম আমার প্রথম কাব্য ‘স্বপ্নভস্মের চারুকর্ম’। কিন্তু বই বেরুনো মানেই কি লেখক হিসেবে সনদপ্রাপ্তি? না, তা নয়। প্রথম বইটি বেরুনোর পরই শুরু হয় আসল লেখক-জীবনে প্রবেশের সংগ্রাম। ২০১০ সালের কথা। আমার ত্রয়োদশ কাব্য ‘ধুলোয় লুটোনো দিন’ রচিত হয়েছিল যখন দিনগুলো ধুলোয় লুটোচ্ছিলো। আর রাতগুলো সাঁতার কাটছিলো জোছনার দিঘিতে। ধুলোর ভেতরও থাকে সোনা, আমার তখনও জানা ছিল না। দিনগুলো টাকা কামানোর চাকরগিরিতে লুটোপুটি খেতে খেতে অকস্মাৎ বলে উঠেছিলো- তুমি না মানুষ! দাসত্বের সঙ্গে কেন বাঁধবে গাটছড়া।
আমার নিজের অভিজ্ঞতাই তো একজন নবীনের লেখক হওয়ার সংগ্রাম। তাই এজীবনের দিকে তাকিয়ে কোনো ইশারা হয়তো পাওয়া যাবে। শুরুতে বইয়ের কথা বলেছি। লেখার জন্য বই পড়ার যে কোনো বিকল্প নেই- সেকথা এখন নিশ্চয়ই সবাই মানেন। শুধু কি নিজের ভাষার লেখা পড়লেই চলে? চলে না। ছাত্রজীবনে ইউসিস লাইব্রেরি ও বিটিশ কাউন্সিলের কার্ড করেছিলাম। একসঙ্গে চারখানা করে বই আনা যেত। কবিতার বই তো নিতামই, বেশি করে নিতাম প্রবন্ধগ্রন্থ আর উপন্যাস। পরে কর্মজীবনে সাহিত্য সম্পাদনার কারণে আমার সুবিধে ছিল দেশের তাবৎ লেখকের লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। সুযোগটা আমি শিক্ষার্থীর মতোই কাজে লাগিয়েছি। বলতে চাইছি, সমকালীন কোনো লেখককেই হেলাফেলা করতে নেই। শামসুর রাহমানকেই দেখেছি তিনি নবীনদের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। আর বানান ও ছন্দ সম্পর্কে খুঁতখুঁতে ভাবও তাঁর কাছ থেকেই আমার পাওয়া। আজকাল অনেকেই ভাবেন ছন্দ ছাড়াই বুঝি কবিতা লেখা সম্ভব। আচ্ছা সারগাম ছাড়া কি কণ্ঠে সঠিক সুর তোলা সম্ভব? আর উঁচু দরের কণ্ঠশিল্পী হতে হলে উচ্চাঙ্গ সংগীত কি না জানলে চলে! শব্দের মাত্রা ও ওজন যিনি না বুঝবেন, বাংলা কবিতার ছন্দ যাঁকে ভালো না বাসবে তিনি যত নাম করুন না কেন ফেসবুকে,আমার বিবেচনায় তিনি কবি নন। শিল্পের প্রতিটি শাখারই নিজস্ব ‘ভাষা’ রয়েছে, রয়েছে তার রঙ ও আদল, সুধা ও সৌন্দর্য, শক্তি ও সুষমা। এটা অস্বীকার করে বেশিদূর যাওয়া যায় না। আর কবিতার মতো শুদ্ধতম শিল্পের বেলা এসব যে কত জরুরী তা কাব্যসাগরে একবার ডুবুরীর পোশাকে (অর্থাৎ পাঠক হিশেবে) ডুব দিয়েই অনুধাবন সম্ভব। কবিতা লেখার জন্য এখনও যখন চুপটি করে নিজের মুখোমুখি এসে বসি, মনে হয় এর আগে কখনো কোনো কবিতা লিখিনি; জীবনে বুঝি এই প্রথম লিখতে বসেছি। আর লেখা হয়ে যাওয়ার পর এত অতৃপ্তি আর অসহায়ত্ব কাজ করে যে, তরতাজা নতুন কোনো বইয়ের ভেতর আশ্রয় খুঁজতে হয়; তখন পুনরায় নিমজ্জিত হতে চাই জীবনের বহিরঙ্গ ছাপিয়ে গভীর গহীন কল্পনা, ভাবনা এবং অনুভূতিরাজ্যে।
এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচের ক্লাসের শিশুরও পাঠ্য তাঁর কবিতা। সুতরাং জানা যায় নাম। আমার সময় ছিল ভিন্ন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের একচিলতে শহর যশোরের তারুণ্যের ছটফটানো প্রাঙ্গণটি ছিল সেখানকার উজ্জ্বল মহাবিদ্যালয়ে। সেটির নামও এক উচ্চাভিলাষী কবির নামে- মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়, সংক্ষেপে লোকে বলতো এম এম কলেজ। সেখানকার বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকও ছিলেন একজন কবি, আজীজুল হক। বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নান্নু (মাহবুব) আর আমি আবৃত্তিতে নাম লেখালাম। ও পড়ল সুকান্তের ছাড়পত্র, আমি স্যারের ‘বিনষ্টের চিৎকার’, কী সূচনা! ‘অবশ্যই আমি সেই ব্যবহৃত রমণীর সজ্ঞান প্রেমিক’। শামসুর রাহমানের কবিতা সেখানেই কি প্রথম শোনা? হতে পারে। ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে ওঠা, শামসুর রাহমান নামে আছেন একজন। আর আমার সময় তখন অপার্থিব বিষাদে পরিকীর্ণ। রাজহংসীর মতো এক সহপাঠিনীর প্রতি প্রথম দেখায় জেগে উঠেছিল প্রেম। তারপর ক্রমাগত অতলে তলিয়ে যাওয়া। এখন ভাবতে অবাক লাগে, প্রেম নিবেদনের কোনো পথই কেন মাড়াল না ছেলেটি! মেয়েটি বুঝুক বিষাদ বিশদ, নিজেও মজুক একই ঘোরে,এমনটা চাওয়ার পেছনে কী যুক্তি ছিল অন্ধ প্রেমিকের? পঞ্চাশোর্ধ জীবনে এসে সতেরোয় সন্তরণশীল সেই কিশোরকে দেখি (বালকই বলব? তরুণ তখনও নয়!): পরিবারে থেকেও যে নেই পরিবারে; কলেজ-ক্যাম্পাসে উপস্থিত থাকলেও সে নয় নিবিড় ছাত্র; আস্ত বর্ষাকাল এসে তাকে বিদীর্ণ করে যায়; বসন্ত এসে করে যায় সমাহিত। ওই অগাধ নৈঃসঙ্গের মনোটোনাস দিনরাত্রিতে কবিতাই এসে হাত ধরে। নিঃশব্দতার ভেতর কবিতা কথা বলে, অন্ধকারের গুমোটে কবিতাই আলো জ্বালে। শামসুর রাহমানের কবিতা হয়ে ওঠে পরম সান্ত¡না ও গহন আশ্রয়। আর সে নিজেও কি তখন নয় শামসুর রাহমান?
সেই অল্প বয়সে আমার একান্ত বিবেচনা থেকে, বলা ভালো, আমার হৃদয়ের গভীর তন্ত্রী থেকে এটাই সত্য বলে মেনেছিলাম, শামসুর রাহমান আমার কবি, আর একইসঙ্গে তিনি সমকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি। শামসুর রাহমানের নিজের শহরে এসে একদিকে রক্তমাংসের মানুষটার সান্নিধ্যে আমি এসেছি; অন্যদিকে অপরপক্ষের কবি-কবিতাপাঠক এবং সমালোচকদের মন্তব্য-বিশ্লেষণ-মূল্যায়ণ সম্পর্কে ধারণালাভ করেছি। ফলে নিজের কাছেই অবাক মেনেছি যে কোন সে মানসিক অবস্থা যা আমাকে এমন করে সত্য জানিয়ে দিয়েছিল সেই মফস্বলে। ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হলো বাংলা কবিতার সে সময়কার প্রভাববিস্তারকারী সমালোচক হুমায়ুন আজাদের গ্রন্থ ‘শামসুর রাহমান/ নিঃসঙ্গ শেরপা। ভূমিকায় তাঁর মন্তব্য, ‘শামসুর রাহমান তিরিশি আধুনিকদের পর বাংলা ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি।’ একথার সরল অর্থ করতে পারি, শামসুর রাহমান এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
আজ নিজের মুখে বলতেই পারি যে, কয়েক বছরের মধ্যে আমার স্বপ্নের কবির সঙ্গে এক আত্মিক বন্ধনে বাঁধা পড়ি। খুব ঘনঘন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটতে থাকে। এমনও দিন গেছে সকালে তাঁর কার্যালয়ে গেছি আড্ডা দিতে, দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় তিনি আমাকে তাঁর অফিসের গাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেছেন ঢাকা কলেজের প্রধান ফটকে। বিকেল গড়াতেই আবার চলে গেছি তাঁর তল্লাবাগের বাসায়। আমার পিতা আর তাঁর জন্ম একই বছরে। পিতৃতুল্যই বটে তিনি, কিন্তু কোনোদিন কারো ওপর মুরুব্বিয়ানা ফলানো তাঁর স্বভাবে ছিল না। কলেজপড়–য়া কিশোরদেরও তিনি সম্বোধন করতেন আপনি করে। আর কবিতা চেয়ে কেউ খালি হাতে ফিরে গেছে এমনটা আমার জানা নেই। আড্ডা মুলতবী রেখে রাতে লেখা খসড়া কবিতা ফাইনাল করে অপেক্ষমান লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের হাতে তুলে দিয়ে তবেই ফিরে এসেছেন ফের আড্ডায়। দৈনিক বাংলা কার্যালয়ে তাঁর কক্ষটি ছিল সত্যিকারার্থেই আধুনিক বাংলা কবিতার সাগরে জলযান ছোটানো, সন্তরণশীল ও হাবুডুবু খাওয়া এবং নিমজ্জমান কবিপ্রাণসকলের মিলনস্থল। বিচিত্রার কবিতা প্রেসে যেত তাঁর হাত ঘুরে। দপ্তরে পৌঁছুনো কোনো কবিতারই কপি তাঁর নজর এড়িয়ে বা উপেক্ষায় বাতিল কাগজের ঝুড়িতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং নতুনদের লেখার প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ পক্ষপাত। দৈনিক বাংলা-বিচিত্রা পর্ব শেষ হলো; শুরু করলেন সাপ্তাহিক মূলধারা। এবার তাঁর সহকর্মী হওয়ার সুবাদে আরও ভালো করে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেলাম অপরের কবিতাকে গ্রহণ/ বর্জন করার পরিক্রমা। একটি লেখায় বলেছি কবিতার ছন্দ এবং বানানের শুদ্ধতা বিষয়ে তাঁর খুঁতখুঁতে স্বভাবের কথা। বাংলাদেশের কবিতার রাজাধিরাজ হওয়ার জন্য কোনো কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়ার মতো মানুষ তিনি ছিলেন না। তাঁর প্রয়াণের পর প্রধান কবির ‘আসন দখলের’ জন্য কারো কারো তৎপরতা দেখে গূঢ় শিক্ষালাভ করি: স্বপ্নের কবিকে বাস্তবের সীমানায় পেলেও তিনি থাকতে পারেন স্বপ্নবান, স্বপনজাগানিয়া। আর জাগতিক ‘সফল’ কবিরা ধারাবাহিক সুফল প্রাপ্তিযোগের দৌড়ে থেকেও আমার মতো নগণ্য কবিতাবান্ধবের কাছে স্বপ্নময় হয়ে ওঠায় থেকে যান অক্ষম অপারগ।
শুদ্ধস্বর:. আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষা শৈলির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিতভাবে শুনতে আগ্রহী।
মারুফ রায়হান: আমাদের বসবাস সমকালেই, অতীত কিংবা ভবিষ্যতে নয়। তাই কবিতা যিনি লেখেন তিনি সমকালেরই ব্যক্তি, তার লেখায় সমসাময়িক উপাদান বড় অংশ জুড়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে আমি কেবল সমসাময়িকতার কথা বলি না, স্বাদেশিকতার কথাও বলি।
প্রসঙ্গত যোগ করব, কবির বড় অবলম্বন কল্পনাশক্তি এবং পৃথিবীতে সৃষ্ট সব সাহিত্যসৃষ্টি ও সৃষ্ট শিল্পকলা আত্মস্যাতের ক্ষমতা। ফলে সমসাময়িকতা থেকে কবি ঊর্ধে উত্তোলিত হন। আমার কবিতায় ‘সমসময়’ সব সময়েই জায়গা করে নিয়েছে। এখানকার সাতটি প্রেমের কবিতাও তার উদাহরণ বটে। আমার ভালোবাসার শেষতম বোধ ও ব্যঞ্জনা এই কবিতাগুচ্ছে বিলক্ষণ রয়েছে। আর দেখুন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনও তাতে বাদ থাকেনি; এমনকি সর্বসাম্প্রতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি এবং তা থেকে বিশ্বমানবের পরিত্রাণের বিষয়টিও দেখছি চলে এসেছে।
আশির দশকে স্বৈরশাসকের আমলে চাপানো সাম্প্রদায়িকতায় মতিঝিলে ভারতীয় পাঠাগারে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ‘যখন অক্ষর পোড়ে মতিঝিলে’ নামে একটি কবিতা লিখি তখন। এটি সময়কে ধরে রাখার একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু এ কবিতা যেন সময়কেও অতিক্রম করে যায় তার বক্তব্যে ও ব্যঞ্জনায় এমন একটি আকাক্সক্ষাও ছিল আমার মনে। তাই আমি চেয়েছি এমনভাবে লিখতে যা কালের সীমানা পেরিয়ে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী কবিতা হয়ে উঠতে পারে।
আর রাজনৈতিক বোধের প্রসঙ্গে বলতে গেলে আমার প্রথমেই বলতে হবে মানুষের কল্যাণ লক্ষে সংগঠিত মানুষের তৎপরতার কথা, একইসঙ্গে বিপরীতভাবে মানুষের অকল্যাণ হবে এমন অপতৎপরতার কথাটিও। এটিই আমার দৃষ্টিতে রাজনৈতিক বোধ। বিশ্বব্যাপীই একদিকে রয়েছে বঞ্চিত নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষ, অন্যদিকে রয়েছে বঞ্চনাকারী নিপীড়ক, শোষক ও অধিকার বা প্রাপ্য কেড়ে নেয়ার দল। এ দুইয়ের সংঘাত স্বাভাবিক। আপনি যখন দেখবেন আপনার মাতৃভূমিতে অল্প কয়েক হাজার মানুষের হাতে সিংহভাগ সম্পদ ও অর্থ এবং তার বিপরীতে কোটি মানুষর বেঁচে থাকা মানে সার্বক্ষণিক অন্নচিন্তা তখন আপনি যদি নীরব থাকেন তাহলে আপনি তো কবি থাকেন না, মানুষও থাকেন না। আপনার রাজনৈতিক কবিতাগ্রন্থ বলে প্রকাশনা থাকবে, আবার আপনি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে অন্যায্য সুবিধা নেবেন, তাহলে কী করে বলবো যে আপনি প্রকৃতই রাজনৈতিক বোধের অধিকারী?
আমার কবিতায় রাজনৈতিক বোধের পরিচয় পেতে হলে আমার যে কোনো একটি (১৮টি গ্রন্থের) বইয়ের প্রথম থেকে শেষ কবিতাটি পর্যন্ত পরিভ্রমণ করাই যথেষ্ট হবে। আপনি যদি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা লেখেন তাহলে যেমন আপনার রাজনৈতিক বোধ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে, তেমনি আপনি যদি কখনোই এ দেশের এ মানবসমাজের সবচেয়ে বৃহৎ বাস্তবতা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা না লেখেন, তাহলেও স্পষ্ট হয়ে উঠবে আপনার রাজনৈতিক বোধ। এটি সত্য যে কবিতা বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে পারে না, কিংবা তার ক্ষমতা নেই রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণে কিংবা অপসারণে শতভাগ কার্যকর ভূমিকা রাখার। কিন্তু কবিতার শক্তি রয়েছে মানুষের মনোজগতে প্রভাব বিস্তারের। মানুষই ইতিহাস রচনা করে, তাই সেই অর্থে কবিতার শক্তি ব্যাপক। অপশাসন দুঃশাসন হটানো এবং সুন্দর সময়কে আহবান করায় কবিতার ভূমিকা তাই একেবারে উপেক্ষিত নয়। কবিতার ভেতর এই বোধের জাগরণও আমার দৃষ্টিতে রাজনৈতিক বোধ।
আর ভাষাশৈলী বিষয়ে নিজের মুখেই বলতে হবে? এটি সম্ভবত আমার কাজ নয়। তবু জানতে চাইছেন, তাই না এড়িয়ে অল্পকথায় বলি। কবি হিসেবে স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত হতে গেলে ভাষাশৈলী বা ভাষাভঙ্গি একটি অন্যতম সূচক। কবিকে তার সুর বা স্বর দিয়ে যেমন শনাক্ত করা সম্ভব, তেমনি তার রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও শব্দপ্রয়োগ দিয়েও তা সম্ভব। ভাষা ব্যবহার করেই তো লিখতে হয়, তাই সেটি ব্যবহার করতে গিয়ে কবিতায় ছন্দের বিষয়টিও সমান্তরাল প্রভাবক হিসেবে চলে আসে। ১৯৯২ সালে যখন আমার প্রথম কবিতার বইটি আলোর মুখ দেখে, সেসময়ে সেটির বেশ কিছু কবিতায় আমার দিনেরাতে যে কবির সান্নিধ্যে থেকেছি, এবং যাকে আমি সে কালপর্বে দেশের প্রধান কবি হিসেবে বিবেচনা করতাম, সেই শামসুর রাহমানের কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছিল। তার মানে, আমি বলতে চাইছি, ওই কবিতাগুলো আমি না লিখে তিনি লিখলেই মানানসই হতো। তবু আমি আমার সেসব কবিতা থেকে সেইসব চিহ্ন ঘসে ঘসে তুলে ফেলিনি, রেখে দিয়েছি। ভাষাসচেতনতা আমার ভেতর শুরু থেকে ছিল বলে ওই ছায়াপাত নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। আপনি নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যে কাজী নজরুলের কবিতার প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। তাতে কিছুই এসে যায়নি। যাহোক, পরবর্তীকালে কবিতা লেখার বিষয় হিসেবে আমি বহু অকাব্যিক বিষয়, এমনকি চেয়ার- টেবিলের মতো বস্তুও বেছে নিয়েছে, আর বলবার কথায় নিভৃত বোধের জগৎ ছাপিয়ে এই কূপমন্ডুক সমাজ তো বটেই, বহির্বিশ্বের বিষয়আশয়ও আসতে চেয়েছে। তখন আমার সামনে প্রশ্ন এসে দাঁড়ালো এসব কবিতার ভাষাভঙ্গি কী হবে, কেমন হবে? এই বোঝাপড়া আমি করেছি আমার মন ও মননের সঙ্গে, তাই তৎকালীন আমার কবিতায় নানা স্বর আসতে শুরু করে। মারুফ রায়হান ভেঙে কয়েকজন হয়ে যান।
যাহোক, ভাষাভঙ্গিতে ইংরেজি কবিতা বা অন্য ভাষার কবিতার ছায়াপাত যদি কোনো কবির ক্ষত্রে ঘটে থাকে, তবে তাকে আমরা দোষ দেব কেন? আমার বেলায় বাংলা কবিতা, আরও স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশের কবিদের কবিতার ভাষাপ্রবাহ থেকেই স্বরভঙ্গি উঠে উঠেছে। এতে আমার অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণে ঘটেনি।
শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
মারুফ রায়হান: শ্লীল-অশ্লীল? সমাজে বহুল ব্যবহৃত শব্দ হলো শ্লীলতাহানি। শুধু নারীর বেলাতেই এই শব্দ প্রয়োগ করা হয়। যৌন নিপীড়ন বিষয়টিও সামনে চলে আসে। দেখা যাচ্ছে শ্লীল-অশ্লীল শব্দের সঙ্গে যৌনতার একটি সম্মন্ধ রয়েছে। হা হা। কবিতার বেলায় অরুচিকর, অগ্রহণযোগ্য, অমার্জিত বক্তব্য প্রকাশই হলো অশ্লীলতা। শব্দ নিজে অশ্লীল হতে পারে না। স্ল্যাং বা গালিগালাজও ব্যবহারগুণেই হয় শ্লীল বা অশ্লীল। কবিতার ক্ষেত্রে কবির উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় হয়ে ওঠে রুচিকর বা অরুচিকর; বলতে পারি শ্লীল বা অশ্লীল।
ধরুন বন্যবরাহ শব্দ। এটির মানে জংলি শুয়োর। নিষ্ঠীবন শুনতে কী ভালো, আসলে এর মানে থুতু। আমাদের এক প্রধান কবি আরেক প্রধান কবিকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখলেন এবং তাকে গাল দিলেন বন্যবরাহ। এই এপ্রোচটিই অশ্লীল। যদি লেখক বুঝেন এটি আত্মঘাতী হয়ে উঠবে তার জন্যে, তাহলে কি তিনি তথাকথিত সুশীল শব্দ ব্যবহার করে বলতেন বন্যবরাহ? কিংবা ধরুন আমাদের আরেক কবি, ষাটের শক্তিমান তিনি। সদ্যস্বাধীন দেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও ব্যবস্থাপনা সঙ্কটে নিমজ্জিত একটা পরিস্থিতিতে লিখে ফেললেনÑ ভাত দে, হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব। এটা একটা এক্সপ্রেশন। নাথিং রং। দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে, খাবার না পেলে এমন রাগী কথা বলাই যায়। তবু এখানে কিন্তু রয়েছে। যিনি কবিতাটি লিখলেন, তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। যোদ্ধা দেশ স্বাধীন করায় অবদান রেখেছেন, দেশ গড়ায়ও তার থাকতে হবে অবদান। কারু কাছে নয়, তিনি নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন কেন তিনি মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার যজ্ঞে যুক্ত হতে পারছেন না। আর মানচিত্র খাওয়ার কথাই বা তিনি কিভাবে বলেন। তবু আমি বলেছি এটি পোয়েটিক এক্সপ্রেশন। এখানে হারামজাদা স্ল্যাং আমার বিবেচনায় অশ্লীল নয়। কিন্তু মোটে একখানা ভাবাবেগময় বই লিখে মহাখ্যাতিমান আরেক কবি যখন লেখেন, আমি তো গাঁয়ের পোলা, চুতমারানি গাইল দিবার পারি ( লাইনটি হুবহু এমন নাও হতে পারে)। এখানে চুতমারানি আমার দৃষ্টিতে মহাঅশ্লীল।
সেক্সুয়াল প্লেজার কে কিভাবে পাবেন সেটি নিয়ে বিচারে বসা চলে না, এটি দুই ব্যক্তির একান্ত বিষয়, অবশই সম্মতিসাপেক্ষে। তা না হলে সমকামিতা দেশে দেশে বৈধতা পেত না। ব্যক্তিগতভাবে আমি সমকামিতাকে অগ্রহণযোগ্য ভাবতে পারি, শতভাগ মানুষ ওই চর্চা করলে ধরীত্রির বুকে আর নতুন মানবশিশু আসবে না, সব অন্তিমে পৌঁছে যাবে। যাহোক সমকামী ব্যক্তিকে নিশ্চয়ই আমি ঘৃণা করব না। কথা হচ্ছে, একজন জনপ্রিয় কবি যদি ‘পায়ুপথে পুষ্পগন্ধ’ পান সেটি আমার কাছে অরুচিকরই মনে হবে। এ নিয়ে আমরা প্রকাশ্যে কথা না বললেও কবিদের আড্ডায়-আলোচনায় এসব উঠে আসে এবং সেই কবি জানেন আমার আপত্তির কথা।
নারী বা পুরুষদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গর উল্লেখ কখনোই অশ্লীল হতে পারে না। সূক্ষ্ম রুচির সীমানা অতিক্রম করে গেলেই সেটি অশ্লীল হয়ে উঠতে পারে। তবে বিষয়টি বেশ তর্কসাপেক্ষ। এই শ্লীল অশ্লীলের ধারণা। একই কবিতা কারু কাছে হয়ে উঠতে পারে মহা অশ্লীল, অন্যের কাছে শ্লীল। আমি ক্লিভেজ নামে একটি কবিতা লিখে বিপাকে পড়েছিলাম। কবিতাটি এখানে তুলে দিয়ে অন্য উত্তরে যাচ্ছি। নারী-পাঠকদের বড় অংশই কবিতাটিকে পছন্দ করেছিলেন, কিন্তু বেশ ক’জন আমাকে শাপশাপান্ত করতে ছাড়েননি।
ক্লিভেজ
অদৃশ্য হওয়ার জাদু জানে ওই
জলজ্যান্ত রেখা, গিরিখাদ
নিমগ্ন শিল্পীর আঁকা আশ্চর্য অগাধ
শার্প লাইন, রহস্য আর ভ্রান্তি অথৈ
টলটলায়মান টিলা তার পথ-রচয়িতা
এ রেখা বিমূর্ত ফণা তুলতো না যদি
বিব্রত বর্তুল দুটি না হতো জয়িতা
সহিষ্ণু অনুসরণ করো তার গতি, বোধি,
এবং লম্ফন তার গন্তব্য কোথায়
কোন সুগভীর শিল্পের কোঠায়
একখন্ড ওড়না বা আচ্ছন্ন আঁচল
মেঘবস্ত্র শুধু, শুধু ছল
কেবল উছিলা
পূর্ণিমার দুটি চাঁদ-অভিমুখী টানটান ছিলা
জোছনা-লুকনো ওই অন্ধকার অন্ধ করে দিলো
কতো চক্ষুষ্মান
তার টানে কতো না পাপীর হলো শির খানখান
ক্লিভেজ কী ভাঁজ!
আহ্ বিনা মেঘে সূক্ষ্ম বাজ
সূর্যরশ্মিও এইখানে এসে ভাজা-ভাজা
লাগ ভেল্কি, বাহাত্তরে মড়া অকস্মাৎ তরতাজা!
শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আাপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/ বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যেকোনো সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।
মারুফ রায়হান: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে মূল্যায়ণের জন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা চাই। প্রথমত আমি গবেষক হলে এবং যথোচিত অবগত ও আপডেট থাকলে এটি আমার জন্য আনন্দপূর্ণ একটি কাজ হতো। দ্বিতীয়ত, এ প্রসঙ্গ নিয়ে যথোপযুক্ত আলোচনা করতে গেলে তার আকার এতটাই বৃহৎ হয়ে উঠবে যে সেটি রীতিমতো গ্রন্থ হবে। অনলাইনে সেটি কি পড়ে ফেলা সহজ!
অভিন্ন ভাষায় লিখলেই দুটি পৃথক ভূখন্ডের উত্তাপ ও স্নিগ্ধতায় বসবাসকারী কবিদের ভেতর সমদর্শিতা থাকবে, এমন কোনো কথা নেই। তাহলে ব্রিটিশ ও মার্কিন কবিদের কবিতা এক স্বাদের/ এক পদের হতো। আবার একই মহানগরীতে বসবাসকারী দুজন কবির ভাবজগৎ ও প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন হওয়াই সঙ্গত ও সমীচীন। তাই তুলনা করা সহজ কাজ নয়। মূল্যায়ণও। স্রেফ ধারণার কথা কিছু হতে পারে।
তবে বলতে পারি, কবির কি কোনো নির্দিষ্ট দেশ থাকে? যে-ভাষায় তিনি লেখেন সে-ভাষাভাষি মানুষের প্রতি আলাদাভাবে তাঁর কি কোনো দায়িত্ব থাকে? মাতৃভূমির জন্যে তাঁর কী কর্তব্য থাকে? এখানে উৎকীর্ণ তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের বহুমুখী জবাব মনে আসে, নতুন জিজ্ঞাসাও তৈরি হয়। সেই পর্যায়ক্রমিক প্রশ্নের আগমন, আর ক্রমাগত জবাব অন্বেষণের জটিলতা আমরা এড়াতে পারি না। কবির নিজস্ব দেশ অবশ্যই থাকে, যদিও তিনি হতে পারেন বিশ্বনাগরিক, সেটাই কাম্য। একজন বড় মাপের কবি নিশ্চিতভাবেই হন সকল দেশের, অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের কণ্ঠস্বর। যদিও একান্ত স্বদেশের আকাশমাটির স্বাদ ও অভিজ্ঞতা প্রচ্ছন্ন থাকে তাঁর রচনায়; দেশকে পাওয়া যায় তাঁর উপমা, চিত্রকল্পের প্রয়োগ-সংকেতে, আবেগের আঙ্গিকে, উচ্চারণ-ভঙ্গিতে। শুধু দৈশিক পরিচয় নয়, একজন প্রধান কবির লেখায় স্পন্দমান থাকে নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্যও। স্বদেশের সীমানার বাইরের কোনো ক্রিয়ায় শৈল্পিক সাড়া দিতে গিয়ে তিনি যখন সেই অঞ্চলের মানুষের অনুভূতির অংশীদার হয়ে ওঠেন তখনও শব্দে-ছবিতে তিনি ইশারা রেখে চলেন আপন বংশের, আপন ভূমির। কবি তুলে ধরেন সত্যের স্বরূপ, শেকড়ের বিবৃতি, নীলিমার বেদনা। অনুভূতির বৈচিত্র্যে ভরিয়ে তোলেন পঙক্তির পর পঙক্তি। সত্য অন্বেষণ এবং অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার শিল্পিত প্রকাশ’ প্রধানতঃ এ দুটি তাঁর আরাধ্য। প্রকৃত প্রতিভা তাই পরিণত হন দ্রষ্টায়, কল্যাণময় স্বাপ্নিকে এবং দ্রোহীর প্রতীকে। অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপিত করেন স্বগোত্রের মানুষকে। আর সজ্ঞানে বা অসচেতনভাবে সমৃদ্ধ করে চলেন মাতৃভাষাকে। সমাজ প্রায়শই কবির মর্ম বুঝে উঠতে ব্যর্থ হয়, উপেক্ষা করে তাঁর অনিবার্য প্রয়োজন। যদিও কবি নিবেদিত থাকেন স্বকাল ও সমাজেরই কাজে। বাংলার কবির রচনায় যদি বাংলাদেশই না থাকে, বাঙালির স্বপ্ন ও সংকট না বিম্বিত হয়, তাহলে বাংলায় লেখা বলেই কি ওই কবিতাকে বাংলা কবিতা বলে মেনে নেয়া যায়? কবিকে বুকে টেনে বলা যেতে পারে আমাদের কবি, বাঙালি কবি!
মাতৃভূমির জন্যে কবির নিশ্চয়ই কর্তব্য থাকে। মাতৃভূমি বিপর্যস্ত নিষ্পিষ্ট বিদীর্ণ হতে থাকলে, এবসার্ড নাটকের উপাদানে উপহাসিত হতে থাকলে কবি নীরবতা পালন করতে পারেন না। কবি নিজে সংবেদনশীল শিল্পী, সংবেদনশীলতা জাগানোও তাঁর একটি প্রধান কর্তব্য।
শাহবাগের গণজাগরণ প্রত্যক্ষ করেছিল বাংলাদেশ এবং শাহবাগকে বিতর্কিত করে তোলার বা শাহবাগ বিতর্কিত হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত এমন একটি স্বপ্ন-প্রতিজ্ঞায় আন্দোলিত হয়েছিল দেশের সব শ্রেণির সব পেশার মানুষ যা স্বাধীনতার পর আর দেখা যায়নি। একাত্তরের বাংলাদেশের হৃদয়ের আলোকশিখার সঙ্গে কিছুটা তুলনা দেয়া যায় ২০১৩ সালের শাহবাগের নবজাগরণকে। গজদন্তমিনারবাসী কবিও আন্দোলিত হয়েছিলেন শাহবাগ-শিহরণে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে জরুরি হলো যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায্য শাস্তি দেয়া। সেখানে সামান্যতম আপোষ কাম্য হতে পারে না। শাহবাগ, স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশ জ্বলে উঠেছিল রাজাকারদের ছাড় দেয়ার আশঙ্কায়। আবার ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে প্রতিক্রিয়াশীলেরা পাঠাতে চেয়েছিল বার্ন ইউনিটে।
বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা একাত্তর। একইভাবে বায়ান্নোও। সীমান্তের ওপারের বাঙালি কবিদের এই অমূল্য অভিজ্ঞতা নেই। তাই বাংলাদেশের কবিতার বীজতলা অসামান্য বৈশিষ্ট্যে প্রোজ্জ্বল। অন্যদিকে অবিসংবাদিত নেতাকে হত্যা, দশকের পর দশক সত্যিকারের গণতন্ত্র অনুপস্থিত থাকাÑ এ দুটি নেতিবাচকতা এখানকার কবিদের জন্যেও নেতিবাচক হয়েছে। জ্ঞানের চর্চা, সুস্থ সাধনা ও আলোচনা, কল্পনার জন্যে সুস্থিতি এসবের অনেকটাই অভাব ঘটেছে দেশে। পশ্চিমবঙ্গের কবিরা এসব থেকে মুক্ত। সেখানে ছোটকাগজের সংস্কৃতিও বেগবান। তাই অস্বীকার করা যাবে না দু স্থানের কবিতা ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে, কবিদের মনোজগতেও তার প্রভাব রয়েছে। তবে একটা বিষয়ে তো বেশ মিল রয়েছে দুটি ভূখন্ডের; অসংখ্য ‘কবি’র (বা কবিতালেখকের) জন্মগ্রহণ চলছে, কবিতা প্রসবেও রয়েছে অঢেল-অজস্রতা।
শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।
মারুফ রায়হান: একটি বই নিয়ে বলতে হলে আমি অবশ্যই কবি ও কথাসাহিত্যিক (গুণী অনুবাদকও) মাসরুর আরেফিনের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস আড়িয়াল খাঁ নিয়েই বলব। এটি তাঁর চতুর্থ উপন্যাস। পর-পর চার বছরে একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হলো তাঁর চারটি উপন্যাস। এ ধারাবাহিকতা পাঠকের জন্য বিশেষ প্রাপ্তি, লেখকের জন্য অত্যাশ্চর্য শক্তিমত্তার পরিচায়ক। সাম্প্রতিক সময়ে আমার পঠিত বইগুলোর মধ্যে আড়িয়াল খাঁ’কেই আমি উল্লেখযোগ্য বিবেচনায় এগিয়ে রাখবো।
কবিতা:
মাতাল স্থপতি
শূন্যতায় গড়ছি প্রাসাদ
একপেশে ভালোবাসার ভবন
নিসর্গসমেত
দেয়াল নাচবে সবুজ ঝর্নায়
জানালার কাচে ধাক্কা খাবে
মুন ও মারকিউরি
স্বর্গোদ্যানে সোজা উঠে যাবে সিঁড়ি
সৈকতসম লিভিংরুমে
নক্ষত্রেরা খেলুক লুকোচুরি
খাক লুটোপুটি আস্ত হিমছড়ি
আছড়ে পড়–ক আটলান্টিক
আমি কোথাও নেই ঠিক
আমি থাকবো না
শুধু কবিযুগলের জন্যে এই বসতি-স্বাপ্নিক
আমার গড়েই তৃপ্তি
একপেশে ওই ভালোবাসার দীপ্তি
জোনাকসমেত পুষ্পঝাড়
শূন্যতায়, শূন্যের মাঝার
দূরবর্তিনীর প্রতি
আমাদের দেখা হোক এ গ্রহের তপ্ত নগরীতে
দেখা হোক মিহি মাইনাসে, ঈষাণ-নৈঋতে,
নর্থ-এন্ডে, হাজিময় কাজী আলাউদ্দিন রোডে
দেখা হোক চাঁদনি-চকে, ম্যানহাটনের রোদে
আমাদের দেখা হোক বনে-উপবনে ধ্বস্ত ইউক্রেনে
দেখা হোক ফুটপাথে চা-বাগানে আন্তঃনগর ট্রেনে
মহাকাশে, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে, নভোনীলে
দেখা হোক ব্যস্ত মতিঝিলে, শাপলার বিলে
আমাদের দেখা হোক বরষার দিনে, কবিতা-উড্ডীনে
দেখা হোক কোকিলের স্বরে গানের আসরে
রবীন্দ্র সরোবরে, টেট মডার্নে, মেঘনার ঘাটে
দেখা হোক প্রভাত ফেরিতে, প্রাচীন গ্রামীণ হাটে
দুজনার অজ্ঞাত অতীতে একবার হোক না দেখা
পরিচয়ের আগে পৃথক পৃথক ভুলে ভরা রাতে
পীড়নপিষ্ট বিনষ্ট প্রভাতে, দেখা হোক শুকোনো কান্নায়
সময়ের উচ্ছ্রিত পান্নায়, সাগর-ফেনিলে, ভূস্বর্গে ভূতলে
উষর পর্বতে ফুল ফোটানোর মন নিয়ে ঢের
দেখা হোক আমাদের ॥
প্রণয়-পিয়ানো
সুদক্ষ বাদক নই কিংবা বাদ্য-কারিগর
যদিও মজেছি আজ পিয়ানোর প্রেমে
অপার্থিব পিয়ানো তা, মগ্ন এক সুরমাতাল
এখনও জন্মেনি বটে, তবু তালে উন্মাতাল
এতে অপ্রেমের কোনো সুর বাজবে না
অনুরাগ ভিন্ন কিছু কখনোই ভাঁজবে না
প্রেম মানে কী?
রীডে রীডে হৃৎস্পন্দন, বাঁকের বদল
এইসব বাঁক-দক্ষ হলেন বিটোফেন-বাখ
আর, শরতের মেঘদল
আমি অজুহাত মাত্র
আর কারো জন্য নয়
অলৌকিক পিয়ানোটি শুধু
তার দশ আঙুল ছোঁবে বলে
নিভৃতে-যতনে সৃজন-শিহরিত
উড্ডয়ন-মুহূর্তে
সিটবেল্ট বাঁধার পর আমিও কতোবার ইচ্ছেকে বেঁধেছি
শেষ ফোনটার রেশ যখন বিলীয়মান, বিষাদ অশেষ
ডিপার্চার একদম যথাযথ, সে এখন আকাশে সুনিশ্চিত
ফোনের শব্দে তাই দংশন করলো অবাক বৃশ্চিক
রানওয়ের শেষ দৌড়ে বিমান, তার লিস্টে থাকা নামে
সৌজন্যসূচক ফোন; আমি কেন তবে অনভিপ্রেত প্রেমে!
চাইছি যতক্ষণ না সংযোগ হয় ছিন্ন, শুনি তাকে
জানি নি কি নৈঃশব্দ্যেও শ্রুতিসুখকর ধ্বনি থাকে?
কথারা কি সর্বদা অর্থবোধক? অর্থময় হয় অর্থহীনও
তাতে থাকে পরমার্থ-প্রণয়সিক্ত হয় বিশুষ্ক গহীনও
সংযোগ বিছিন্ন না হওয়া অবধি চাই থাকুক সে যুক্ত
বিদায় সম্ভাষণ-তালিকার কারো বুকে ছলকে উঠুক রক্ত ॥
কবিতাকাহিনী
জলশূন্য সাগর-মহাসাগর, জলের বদলে এসিড, মাছ নেই, নেই বিমূর্ত মৎস্যকন্যাও, সৈকতগুলো চোরাবালি-গ্রাম, তীরবর্তী লোকালয় জনশূন্য হাজার বছর; শ্বাসরুদ্ধ বাতাসে রোজ সূর্যের অনল-ছোবল, আর রাতে রূপোলি চাবুক রাক্ষুসে জোছনার; পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে ছিপি আঁটা অতল বোতল কীভাবে এলো এ-বদ্বীপে! থকথকে এসিডে ভেসে! বোতলের ভেতরে কবিতা; বাইনারি কোডে নয়, বাংলা বর্ণমালায় লেখা, সেলাই দিলে বই হবে।
হা ঈশ্বর, এলো অবশেষে নির্জনতম মানুষেরই হাতে…
প্রায়-প্রাণহীন পৃথিবীতে অনেকটা উল্কাপি-ের মতো আছড়ে পড়েছে এই অপার্থিব বস্তু, কবিতাগ্রন্থ; ছায়াপথে ছায়াবিন্দু হয়ে তা ছিল অনাদিকাল; সাতটি স্বর্গে ভিজেছে, পুড়েছে সাতটি নরকে; নক্ষত্রের প্রতারণা সয়ে মেঘের আঘাত সামলে কত আলোকবর্ষ পরে নেমে এসেছে আজ নিষ্ঠুর বৈরী মর্ত্য;ে বিশুদ্ধ কবিতার চরণে বোনা তার অবয়ব; ইলেকট্রন প্রোটনে অনাঘ্রাত রূপক ও চিত্রকল্প।
হা ঈশ্বর, এসে থিতু হলো নির্মোহ কবিরই করতলে…
বাতাসে সাঁতার কবিতার, কখনো বা বাতাসহীনতায়ও; বাতাসে বপন, কিংবা বাতাসেই রচিত; বাতাসে কখনো শ্বাসের বাতাস নিভে আসে, বাতাসেই থাকে অদৃশ্য দানব, থাকে ঘূর্ণি, বিকট দংশন, আর অভিশপ্ত নরনারীর দীর্ঘশ্বাস; উড়ে উড়ে ভেসে ভেসে কবিতারা অবতরণ করলো বৃক্ষহীন নির্বোধ উদ্যানে, অকবিদের আখড়ায়!
হা ঈশ্বর, বিদ্ধ হলো শেষমেশ প্রেমিকেরই বিদীর্ণ পাঁজরে!
সম্ভাব্য মৃত্যুর আগে
কুড়িল উড়াল সড়ক মাঝরাতে
আমাকে মৃত্যুর স্বাদ দিল
সাথে কিছু পার্পল পরাগ
এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে
জীবন ও মৃত্যুর দেবতা হতবাক
আমি দুজনের দিকে তাকিয়েই সুফীর ধরনে হাসি
রেলিং ও গাড়ির চাকার মল্লযুদ্ধ কে থামাবে
উড়াল সড়ক থেকে আছড়ে পড়ছিই তাহলে
এই তবে যবনিকা, এড়ানো-অসম্ভব বিধিলিপি!
মৃত্যু হলে হবে, কোনো খেদ নেই
সাক্ষাৎ পেয়েছি তার, আর বিলোড়ন নেই
মন ভরে গেছে, মন গন্তব্যে থেমেছে
অধুনা আমার সুখ হিমালয় ছুঁয়েছে
প্রাপ্তির ভাবনা ভুলে শুধু ভালোবেসে-বেসে
এমন পরম সুখ পাইনি তো আগে! তাই
এখন বিদায় নিতে হাহা-রব উঠবে না
সম্ভাব্য মৃত্যুর আগে
চোখ বুঁজে দেখা যাক প্রিয়মুখ আরও একবার…
রাশিয়া-ইউক্রেন
ছদ্মবেশী জীবাণু যুদ্ধের পরে কি
প্রকাশ্য পরমাণু যুদ্ধ শুরু হবে!
রুদ্ধ দুটি মন দুই দেশে উৎকণ্ঠিত উৎক্ষিপ্ত
আলিঙ্গনের জন্যে বাড়ানো দুটি যুগল হাতের
মাঝখানে রক্তগঙ্গা, ধসে পড়া হাইরাইজ, সুপ্ত ক্রোধ
আর শিশুদের থ্যাতলানো মগজ
তোমার ভাবনা জুড়ে মানবের কল্যাণ-স্থাপত্য
অরণ্যের অভ্যন্তরে প্রকৃতিসম্মত আবাসন
প্রাণিকুলের সঙ্গে দারুণ হবে সহাবস্থান
যদি সব বরফ গলে স্থলভাগ ডুবে যায়
তবু এ নতুন বসতি থাকবে চিরভাসমান
আর আমি ভাবি, উন্মাদদের আত্মঘাতী আয়োজনে
বসবাসযোগ্যতা হারানোর আগেই
অন্য গ্রহে মানুষের কিভাবে হবে অভিবাসন
দানবের হাত থেকে মানবের পরিত্রাণ অসম্ভব
তাই আর কোনো বিকল্প ভাবছি না
এরই মাঝে কেন ফের নতুন উদ্বেগ?
আজ আমার কেন মনে হচ্ছে
আমি আছি ইউক্রেনে, তুমি রাশিয়ায়?
আর, আমাদের মিলন-নিয়তি নির্ভরশীল
নব্য লুসিফারদের হাতে!