অনুবাদকের ভূমিকা: নীলাঞ্জনা সুদেশনা লাহিড়ী, যিনি বিশ্বব্যাপী স্যাহিত্যপ্রেমীদের নিকট ঝুম্পা লাহিড়ী নামে পরিচিত, ১৯৬৭ সালের ১১রই জুলাইয়ে জন্ম নেওয়া ইতালি প্রবাসী এই বাঙালি বংশোদ্ভূত লেখিকা বিদেশ বিভুঁয়ে তার নাম নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন ছোটবেলায়। তার বিখ্যাত উপন্যাস দ্য নেইমসেক (২০০৩) এ সে অভিজ্ঞতার ছাপ পাওয়া যায়। বাঙালি পিতা-মাতার সন্তান ঝুম্পা লাহিড়ী জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডে। পরবর্তী সময়ে তারা পরিবারসহ আমেরিকায় স্থায়ী হন এবং সর্বশেষ দশ বছর আগে তিনি তার পরিবারকে নিয়ে ইতালিতে থিতু হন। ইংরেজভাষী লেখক হিসেবে তার সাহিত্য জীবন শুরু হয়। তার প্রথম গল্পসংকলন ইন্টারপ্রিটার অব ম্যালাডিজ (১৯৯৯) কল্পসাহিত্য বিভাগে পুলিৎজার পুরষ্কার পায় এবং দ্বিতীয় গল্পসংকলন আনঅ্যাকাস্টমড আর্থ (২০০৮) নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার জরিপে বহুল বিক্রিত বইয়ের তালিকায় এক নম্বরে অবস্থান করে। নিজের খ্যাতির চূড়ায় থাকাকালীন সময়ে তিনি অভূতপূর্ব এক নিরীক্ষায় নামেন। দুই দশক ধরে ইতালীয় ভাষা শিখে তিনি শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে ইতালিতে পাড়ি জমান এবং ইতালীয় ভাষায় সাহিত্য রচনা করবেন বলে মনস্থ করেন। ইতালীয় ভাষায় রচিত তার প্রথম উপন্যাস দোভ মি ত্রোভো’র (২০১৮) ইংরেজি রূপান্তর হোয়্যারঅ্যাবাউটস নিয়ে কথা হয় দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার লিজা অ্যালারডাইসের সাথে। সাক্ষাৎকারভাষ্যটি দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ১লা মে, ২০২১ তারিখে প্রকাশিত হয়।
মূল : লিজা অ্যালারডাইস
অনুবাদক: জাকির হোসেন
ঝুম্পা লাহিড়ীর তৃতীয় উপন্যাসটি হলো ইতালীয় ভাষার সাথে তার দুই দশকের প্রেমের সম্পর্কের এক চূড়ান্ত ও সফল পরিণতি। এই ঘোরে আক্রান্ত হয়ে তিনি প্রায় দশ বছর আগে পুরো পরিবারসহ রোমে স্থানান্তরিত হন। তিনি ইংরেজির সমস্ত পঠন-পাঠন বর্জন করে শুধুমাত্র ইতালীয় ভাষায় লিখতে শুরু করেন। ইতালীয় ভাষায় লিখিত তার প্রথম উপন্যাস দোভ মি ত্রোভো অর্থাৎ “যেখানে আমি নিজেকে খুঁজি ফিরি” কিংবা “আমি কোথায় আছি?” প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে, ইতালিতে। সম্প্রতি তিনি সেটিকে হোয়্যারঅ্যাবাউটস শিরোনামে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করেছেন।
বেনামি এক নারীকে নিয়ে বেনামি একটি শহরকে কেন্দ্র করে এক বছর সময়ের ব্যাপ্তিতে গল্পটির বেড়ে ওঠা। গল্পের প্রত্যেকটি অধ্যায়ে ইতালীয় এসপ্রেসো কফির এক পেয়ালা সমপরিমাণ অনুতাপ ও নিঃসঙ্গতা জমা হয়ে আছে। “অন দ্য স্ট্রিট” শিরোনামের দ্বিতীয় অধ্যায়ে গল্পকথক তার কোনো এক বন্ধুর স্বামীর সাথে ঘটনাক্রমে ধাক্কা খান, যার সাথে তিনি হয়তো “জড়িত হতে পারতেন, জীবন ভাগাভাগি করতে পারতেন”: তারা দুজন মিলে নারীদের অন্তর্বাসের একটি দোকানে গিয়ে পৌঁছান, কারণ তার এক জোড়া আঁটোসাটো অন্তর্বাস কেনার প্রয়োজন হয়। এতটুকু পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে আমরা একটি নির্দিষ্ট ধরনের গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। তবে এমনতর বেশিরভাগ রাস্তার কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে না। অধ্যায়গুলোতে আমরা বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক ও সংযোগের দেখা পাই: গল্পকথকের মাকে দেখতে যাওয়া; একজন বারিস্তার (কফির দোকানের পরিবেশক: অনুবাদক) সাথে প্রাত্যহিক বাতচিৎ; একটি ক্ষণস্থায়ী সাক্ষাৎ। লেখিকার মতে, উপন্যাসটি “কিভাবে একটি শহর নিজেই প্রধান নারী চরিত্রটির সাথে একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং নিজেই একটি সম্পর্কের সমার্থক হয়ে ওঠে” তার অনুসন্ধান করে। বইটি একইসাথে একাত্মতা ও বিচ্ছিন্নতা, স্থান ও স্থানচ্যুতি নিয়ে রচিত এবং আত্মপরিচয় সংক্রান্ত নানামুখী জিজ্ঞাসায় জর্জরিত, যেগুলোর উত্তর খুঁজেছেন লাহিড়ী তার নিউ ইংল্যান্ড, কলকাতা কিংবা অধুনা (আমাদের অনুমান) রোমের পটভূমিতে রচিত কল্পসাহিত্যগুলোতে। বহু মানুষের ক্ষেত্রে, বিশেষত ইতালিতে প্রযোজ্য এক বছরব্যাপী বাধ্যতামূলক সামাজিক বিচ্ছিন্নতার পর লেখিকার ভাষ্যানুযায়ী উপন্যাসটি”একধরনের শহুরে নিঃসঙ্গতার প্রেক্ষাপটে একজন নারীর চিত্রায়ণ” অপ্রত্যাশিতভাবে সময়ের স্পন্দন বলে মনে করা হচ্ছে।
আজ লাহিড়ী আছেন নিউ জার্সিতে তার নিজ বাসায়, তার ভাষায় “মি ত্রোভো প্রিন্সটন”। ২০১৫ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য তিনি ফিরে এসেছিলেন, একই সময়ে রোমের সাথেও দূরবর্তী সম্পর্ক রক্ষা করে চলছিলেন। “আমার দুই গোছা চাবি আছে। আমার এই অন্য একটি জায়গায় এই ভিন্ন একটি জীবন আছে।” তিনি যে সময়ের কথা ব্যাখ্যা করছিলেন তখনও করোনাভাইরাস আমাদের জীবনে হানা দেয় নি। সে সময় অবধি তার ছেলে রোমের একটি ইস্কুলে অবস্থান করছিল। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তার পেছনে উঁকি দেওয়া বইয়ের তাকগুলো থেকে বড় বড় ইংরেজি হরফে “ইতালিয়ান” লেখা একটি মাত্র বইয়ের নাম দেখা যাচ্ছিল। তার বিগত বই ইন আদার ওয়ার্ডস ছিল ইতালীয় ভাষায় লেখা তার প্রথম বই (অ্যান গোল্ডস্টেইন ও এলেনা ফেরান্ট যার ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন) যেটি কিনা তিনি “একপ্রকার ভাষাতাত্ত্বিক আত্মজীবনী” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বইটিতে তিনি তার কিবলা রোমের দিকে “তীর্থযাত্রা” এবং ইতালীয় ভাষাকে জয় করার তীব্র ইচ্ছার আবেগীয় বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। শেষের দিকে তিনি “প্রেম ও ভোগান্তিবিষয়ক” এমন একটি ব্যক্তিগত গ্রন্থ রচনার জন্য কিছুটা বিব্রতভাব স্বীকার করেন। এছাড়াও আমার সন্দেহ হয়, সাক্ষাৎকার দেওয়ার ব্যাপারেও তার একইরকম অনুভূতি কাজ করে (তার দেওয়া সাক্ষাৎকার ও তার লেখা বইয়ের উপর পাঠ-পর্যালোচনাও তিনি কখনও পড়ে দেখেন না)। তার কল্পসাহিত্য পড়ার সময় লেখিকার ব্যাপারে আপনার যেমন ধারণা জন্মাবে, তিনি ঠিক তেমনটাই চিন্তাশীল ও শান্ত সমাহিত, খুব সহজেই চোখ এড়িয়ে যেতে পারে এমন অনুচ্চ কৌতুকবোধের অধিকারী।
২০০৮ সালে প্রকাশিত তার ছোটগল্পের দ্বিতীয় সংকলন আনঅ্যাকাস্টমড্ আর্থ আমেরিকার বহুল বিক্রিত বইয়ের তালিকায় সোজা এক নম্বর স্থান দখল করলে টাইম ম্যাগাজিন আমেরিকার সাহিত্যের পাহারাদার পরিবর্তনের ঘোষণা দেয়। সে সময় তিনি টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি সবচেয়ে কম নিরীক্ষাপ্রবণ লেখক। শুধুমাত্র প্রচলিত ঘেরাটোপ ডিঙানোর খাতিরেই নতুন নতুন জিনিস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়টি কখনও আমাকে আকৃষ্ট করে নি।” এবং এটা সত্য যে ২০০০ সালে তেত্রিশ বছর বয়সকালে পুলিৎজার পুরষ্কারজয়ী তার প্রথম গল্পসংকলন ইন্টারপ্রিটার অব ম্যালাডিজ এর চোস্ত বিষণ্নতার গল্পগুলো সেই বাস্তববাদী ঐতিহ্যের অংশীদার। তার আমেরিকাবাসী সহকর্মীদের চটকদার বিদ্রুপ কিংবা তৎকালীন ইন্দো-ভারতীয় কল্পসাহিত্যের বৈশিষ্ট্যসূচক সরস গদ্য ও মহাকাব্যিক গতিকে পাশ কাটিয়ে তিনি (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির) এশীয়-আমেরিকান অভিবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনকে চিত্রায়িত করেছিলেন। এই কাজটি করেছিলেন তিনি একই ধরনের দরদি সুবিবেচনা ও নৈতিক জটিলতার সাথে, যেগুলো কিনা তার সাহিত্য জগতের দুজন বীর উইলিয়াম ট্রেভর ও এলিস মুনরোর রচনাকেও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছিল।
তার প্রথম উপন্যাস দ্য নেইমসেক এর গল্প বাঙালি অভিবাসী পিতামাতার সন্তান “গোগোলের” ভাগ্যকে অনুসরণ করতে করতে আমেরিকায় পৌঁছে যায়। এটিকে পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন খ্যাতিমান নির্মাতা মীরা নায়ার। ১৯৫০ এর দশকের কলকাতা থেকে শুরু করে কয়েক দশক পরের নিউ ইংল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে রচিত তার দ্বিতীয় উপন্যাস দ্য লো ল্যান্ড ২০১৩ সালে বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা করে নেয়। তার সম্প্রতি প্রকাশিত বই হোয়্যারঅ্যাবাউটস একটি উপন্যাস হওয়া সত্ত্বেও একে অনেকটা পরস্পর-সংযুক্ত বেশ কিছু গল্পের একটি সংকলন হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। সেভাবে কাঠামোগত দিক থেকে দেখলে বলা যায় লাহিড়ী তার নিজের ঘরের মাঠেই খেলতে নেমেছেন। তিনি প্রাচীনপন্থী হতে পারেন। তবে একজন লেখকের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাষা আয়ত্ত করার চেয়ে বড় কোনও পরীক্ষায় নামা সম্ভব নয়! হেনরি জেমসের একুশ শতকীয় নায়িকার মতো তিনি আমেরিকাকে (ব্রুকলিন ব্রাউনস্টোনের ধরাবাঁধা সাহিত্যিক ধাঁচ, যার মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বড় ভোজগুলোর একটি) পরিত্যাগ করেছিলেন রোমের পুরানো আকর্ষণের খাতিরে, যাকে তিনি “সাহিত্যিক উদ্বর্তনের” চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “জীবনের যে শক্তিগুলো আপনাকে মানুষের কাছে, বিভিন্ন স্থানের কাছে, বিভিন্ন ভাষার কাছে যেতে প্ররোচিত করে, সেগুলোকে ব্যাখ্যা করা সত্যিকার অর্থেই খুব কঠিন কাজ। আমার জন্যে বিষয়টা এমন যে প্রথমে একটি নতুন ভাষা, তারপর একটি স্থান এবং তারপর একটি নতুন জীবন, নতুন একটি চিন্তাপদ্ধতি, একটি নতুন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। এগুলো খুব বড় জিনিস।”
তিনি সবসময় অনুভব করতেন “একধরনের ভাষাতাত্ত্বিক নির্বাসনের” মধ্যে তার অবস্থান, সেটিও রোমে স্থানান্তরিত হওয়ার বহু আগে থেকেই। ভারতীয় অভিবাসী পিতামাতার কন্যা ঝুম্পা লাহিড়ী জন্মগ্রহণ করেন লন্ডনে। তার দুই বছর বয়সকালে পুরো পরিবার আমেরিকায় পাড়ি জমায়। তার বেড়ে বেড়ে ওঠা রোড আইল্যান্ডে হলেও (তার পিতা তার উপন্যাসগুলোর বহু চরিত্রের মতো কাজ করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে) ঘনঘন কলকাতা ভ্রমণ তার গল্পকে তার ইস্কুলের অন্য বন্ধুদের তুলনায় “অনেক বেশি জটিল” করে তুলেছিল। ”সবসময় সেখানে ছিল ’অন্য একটি জায়গা’ এবং ‘অন্য আরেকটি ভাষা’ এবং ‘অন্য আরেকটি পৃথিবী’।” নিজের চার বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলে যাওয়া বাংলা ভাষাটি একইসাথে তার মাতৃভাষা এবং “একটি বিদেশী ভাষা”, কারণ তিনি এই ভাষায় পড়তে ও লিখতে পারতেন না: এটি হলো তার বাবা-মায়ের ভাষা, “তাদের জগতের ভাষা”। লাহিড়ী ও তার বোনকে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল, যাকে তিনি অত্যাচারী “সৎ মা” বলে মনে করেছিলেন। “আমি কেন পালাচ্ছি? কে আমার পিছু নিয়েছে? কে আমাকে দমিয়ে রাখতে চায়?” তিনি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন ইন আদার ওয়ার্ডস উপন্যাসে। “জলের মতো পরিষ্কার উত্তর হলো ইংরেজি ভাষা”।
তারপরো তিনি ইংরেজিকে ভালোবেসেছিলেন, বিশেষত এটি তার সামনে বইয়ের একটি বিশাল জগৎ খুলে দিয়েছিল বলে। তিনি বলেন, “আমি এখনও একে ভালোবাসি। কিন্তু একই সাথে এটি আবেগের দিক থেকে এই ধরনের অসম্ভব একটি চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করেছিল। ইংরেজির সাথে আমার সম্পর্ক সবসময় এই জগতের একটি অংশ হওয়ায় ছোটবেলার একটি বাসনার দ্বারা প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রিত।” আপাতদৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক মনে হলেও একটি ব্যাপার সত্য যে ইতালিতে “সত্যিকার অর্থে একাত্মতার কোনো প্রশ্নই না থাকাটা” তাকে দুটি ভাষার মাঝামাঝিতে আটকে পড়া, “বলতে গেলে, হয়ে ওঠার এবং চিন্তা করার দুটি প্রক্রিয়ার মধ্যে একটিকে বাছাই করার” দোলাচল থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তি দিয়েছিল বলে তিনি মনে করেন। “পোসে পারোলে অর্থাৎ সংক্ষেপে এটি আমাকে সত্যিকারের একটি একাত্মতার অনুভূতি দিয়েছে, এটি যে ‘একটি অনুভূতি’ তা পুরোপুরি স্বীকৃত হয়েছে।”
প্রত্যেকবার রোমে ফেরার সাথে সাথেই তার লেখালেখির বিস্ফোরণ ঘটত। হোয়্যারঅ্যাবাউটস ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে তার “শহরের দৈনন্দিনের জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে, যার বেশিরভাগ অংশই মূলত শহরব্যাপী হেঁটে বেড়ানো।” সঙ্গত কারণেই উপন্যাসটির অনুপ্রেরণা ও তার ইংরেজি শিরোনাম নিজে থেকেই ধরা দিয়েছিল লেখিকার ভ্রমণকালীন সময়ে। ইতালির একটি রেলগাড়িতে বসে থাকা একাকী একজন মধ্যবয়েসি মহিলাকে কৌতুহলভরে দেখতে থাকার সময় উক্ত উপন্যাসের ধারণাটির “জন্ম” হয়। তিনি নিজের দেখা সে দৃশ্যের বর্ণনা দেন এভাবে, “কেউ একজন জানালার দিকে তাকাল এবং হয়তো নিজেকেই দেখতে পেল।” উপন্যাসের ইংরেজি শিরোনাম তিনি পেয়েছিলেন কয়েকমাস ধরে ব্যাপক চিন্তাভাবনার পর হঠাৎ একদিন রোমে ফেরার উড়োজাহাজে চড়ে বসে থাকার সময়। ”আশ্চর্যজনকভাবেই ‘হোয়্যারঅ্যাবাউটস’ একটি পুরোপুরি ইংরেজি শব্দ। এর কোনো লাতিন শেকড়ও নেই।” এবং এটিও কোনো দৈব ঘটনা নয় যে তার উপন্যাসের প্রত্যেকটি অধ্যায়ের খেয়ালি নামকরণ- “অ্যাট দ্য ত্রাত্তোরিয়া”, “ইন স্প্রিং”, “অন দ্য কাউচ”, “বাই দ্য সি”- শুরু হয়েছে একটি করে প্রিপজিশন বা পদান্বয়ী অব্যয় দিয়ে (তিনি আলবার্তো মোরাভিয়ার লেখা ”একটি বিস্ময়কর বাক্য” অধ্যয়ন করেছিলেন ইতালীয় প্রিপজিশনগুলোকে ”প্রথমবার ও সারাজীবনের মতো” আয়ত্ত করার উদ্দেশ্যে)। তিনি বলেন, “এটি হলো দোদুল্যমানতা, অস্থিরতা এবং প্রতিবিম্বের উপন্যাস। আমি জীবন যাপনের ধারণাটির ঠিক কী অর্থ হতে পারে তা নিয়ে ভাবছিলাম, ভাবছিলাম প্রতিনিয়ত জীবন কিভাবে চলমান থাকে।” তারপরো নিজেকে “একজন যাযাবর” বলে বর্ণনা করা লাহিড়ীর চেয়ে তার উপন্যাসের গল্পকথক লক্ষ্যণীয়ভাবে আলাদা, তিনি তার জন্মস্থল শহরটির বাইরে যাননি কখনও। লেখিকা ব্যাখ্যা করে বলেন, “তিনি তার জগতের মধ্যে সবসময় চলমান থাকেন এবং তারপরও সেখানে কোনওভাবে আটকা পড়ে যান, সীমান্তের ওইপাশের যাবতীয় বিষয়ে স্নায়ুচাপে ভোগেন।” “আজকের দিনে সীমান্তের অর্থ কী দাঁড়ায়?”
তার কল্পসাহিত্যের অন্যান্য চরিত্র যারা নিজেরা প্রায়ই ”দেশান্তরী হয়, শারীরিকভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে, নিজেদেরকে আবিষ্কার করে তল্লাশী চৌকিগুলোতে”, তাদের সাথে লাহিড়ীর “গ্রিন কার্ড, নাগরিকত্ব অর্জন, পাসপোর্ট ও সার্টিফিকেটের মতো জিনিসগুলোর সাথে গাঁটছাড়া বন্ধনের” নিজস্ব অভিজ্ঞতার মিল রয়েছে। হোয়্যারঅ্যাবাউটসে তিনি ভাবতে চেয়েছেন এমন কারও কথা যাকে এইসবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নি কখনও, তারপরও যিনি হয়তো অস্থিরতা অনুভব করেন, যার মাধ্যমে তিনি দেখাতে চেয়েছেন “থিতু হওয়া ও ছিন্নমূল হওয়ার” দ্বান্দ্বিক অনুভূতি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
উপন্যাসটির গল্পকথক অন্য আরেকটি দিক দিয়েও স্ববিরোধে জড়িয়ে পড়ে। চল্লিশের কোঠায় থাকা একজন অধ্যাপক, যিনি বহু বন্ধুবান্ধব ও প্রেমিক পরিবেষ্টিত হয়েও একাকী; কখনও তিনি নিঃসঙ্গ, কখনও সন্তুষ্ট; তিনি অন্যের অন্তরঙ্গতায় ঈর্ষান্বিত হন এবং অন্যেরা তার স্বাধীনতাকে ঈর্ষা করে। “তিনি এমন একটি চৌরাস্তার মাঝে অবস্থান করেন। তিনি এমন একজন নারী যিনি হয়তো কখনও মাতৃত্ব গ্রহণ করবেন না বলে ঠিক করেন; অন্য যে-কোনো সম্পর্কে তিনি জড়াতে পারেন, তবে সেটি তার জীবনের হিস্যা হবে না। কিভাবে তিনি এর সাথে বোঝাপড়ায় নামবেন?” বিকল্প একটি জীবন ও ভিন্ন একটি পথের কল্পনা থেকে বহু লেখা উৎসারিত হয় বলে লেখিকার বিশ্বাস। “কি হতো যদি এই জীবনটা আমার না হতো? যে ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয়েছে, তা যদি না হতো কিংবা তখন যদি না হতো? যদি এটা হতো, ওটা হতো, যদি একটি সন্তান হতো এবং তারপর আরও একটি সন্তান?” তিনি অবশ্য তার উপন্যাসের গল্পকথক নন বলে ভাবার মতো চাপ নিতে উৎসুক এবং তার ইতালি অভিযাত্রার বেশিরভাগটাই “একটি পারিবারিক অভিজ্ঞতা”। “ভ্রমণ আপনাকে আরও গভীরভাবে নিঃসঙ্গতার অনুভূতি দেবে। এটি আপনার অতল স্পর্শ করবে। আপনি আসলে কে তা জিজ্ঞেস করতে নিজেকে বাধ্য করবে।”
উপন্যাসটির মূলে প্রোথিত জরুরত বা উৎকন্ঠার অনুভূতি এসেছে এই বাস্তবতা থেকে যে সেটি লেখা হয়েছে তারা একদিন চলে যাবে এমন একটি সজ্ঞানের মধ্যে। লেখিকা দুঃখের সাথে স্মরণ করেন, “আমার কাছে সবসময় ফিরে যাওয়ার টিকেট কাটা থাকত। তিনি বলেন, “সেই নতুন জায়গাটিতে নিমগ্ন হয়ে যাওয়ার পর সবসময় সেখানে আবারও আমাকে পিছু ফিরে ডাকার মতো কিছু না কিছু অবশিষ্ট থাকত।”
তার দুই স্বদেশ ইতালি ও আমেরিকায় করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়তে দেখার কারণে গত বছরটি ছিল “এক অবিশ্বাস্য সংকটের সময়”। তবে এই সময়টা বেশ ফলপ্রসূও ছিল। তিনি আবারও ইতালীয় ভাষায় রোম্যান স্টোরিজ নামক ছোটগল্পের একটি সংকলন রচনার কাজ কেবলই শেষ করলেন, যার মধ্যে বেশ কিছু গল্প আছে যেগুলো কিনা রোমে তার সাথে দেখা হওয়া বেশ কিছু বাঙালি অভিবাসীদের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। তিনি অনুবাদের উপর একটি প্রবন্ধের বই রচনার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন (তিনি সম্প্রতি তার বন্ধু ও ইতালির “সেরা জীবিত লেখক” দমিনিকো স্তারনোনে’র বেশ কিছু উপন্যাস ইতালি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন)। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো ইতালীয় ভাষায় তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সামনে জুন মাসে। পূর্বে তিনি ইংরেজি ভাষায় কোন কবিতা লিখেননি এবং “কখনও হয়তো লিখবেনও না” বলে জানালেন। ঠিক যে কারণে ইংরেজি ভাষায় কখনও হয়তো হোয়্যারঅ্যাবাউটস তিনি লিখতেন না। তার ধারণা ইতালীয় ভাষায় লেখালেখি তার জন্য কবিতা রচনাকে সম্ভব করে তুলেছিল। “আমি যখন প্রথম ইংরেজিতে লিখতে শুরু করলাম, তখন নিজেকে অনধিকার প্রবেশকারী বলে মনে হয়েছিল। প্রথম যখন ইতালীয় ভাষায় লিখতে শুরু করলাম, তখনও নিজেকে অনধিকার প্রবেশকারী বলে মনে হয়েছিল। কবিতাগুলো যখন লিখছিলাম, তখনও একই অনুভূতি কাজ করছিল। তবে হয়তো সেটা মন্দ কোন বিষয় নয়।”
সামনের সেপ্টেম্বরে তার মেয়ে হাই ইস্কুলে যাওয়া শুরু করবে তাই লাহিড়ী এই গ্রীষ্মকালে রোমে ফিরে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন। প্রত্যেকবার সেখানে যাওয়ার পর পিয়াৎসায় (ইতালির শহরগুলোর খোলা চত্বর ও গণসমাগমের স্থান: অনুবাদক) গিয়ে ”প্রথমবারের কফিটি পান করতে ও সেই মানুষগুলো যারা আমাদের ফিরে আসায় সত্যিই আনন্দিত, তাদের সাথে দেখা করতে” তর সয় না বলে আবেগের সাথে উল্লেখ করেন তিনি। “সেখানে ঠিক আপনার দোরগোড়ায় এক বিশেষ ধরনের জীবন যাপনের ঘটনা ঘটে চলেছে যেটি কিনা সবসময় একধরনের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং সবসময় একধরনের স্থিতাবস্থায় বিরাজ করছে। আমি সেটির অভাব বোধ করছি।” তিনি বাংলাদেশ থেকে আসা বহু রোমপ্রবাসী বন্ধুবান্ধবের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন। “পৃথিবীর মধ্যে এটিই একমাত্র জায়গা যেখানে আমি নিয়মিত ইংরেজি, ইতালিয়ান ও বাংলায় সমানে গালগল্প চালিয়ে যাই।” লেখিকার কাছে ভাষার এই “ছোট্ট ত্রিবেণীসঙ্গমটি” এই শহরের জাদুময়তারই একটি অংশ। “এবং এটি পিয়াৎসায় আমার জন্যেই ঠিক অপেক্ষা করে বসে আছে।”