ডানপন্থার বৈশ্বিক উত্থান : অর্জুন আপ্পাদুরাই এর তত্ত্বতালাশ ও পর্যালোচনা

Share this:

এরদোয়ান তো সার্বভৌমত্বের রঙ্গমঞ্চে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রীতিমতো অনিবার্য টুল বানিয়ে ছেড়েছেন। একদিকে নব্য অটোমানবাদী কায়দায় ‘নয়া তুরস্ক’ নির্মাণ,  মুসলিম দুনিয়ার ত্রাতা হওয়ার সাম্রাজ্যবাদী বাসনা ; অন্যদিকে ইউরোপের দিকেও এক পা দিয়ে রাখা এরদোয়ানের রাজনৈতিক প্রকৃতি। ভিন্নমত এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার ক্ষেত্রে এরদোয়ান বরাবরই চরম নির্মম।

 

অর্জুন আপ্পাদুরাই ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী। বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক গতিপ্রবাহ নিয়ে কাজে বিশ্বব্যাপী সুখ্যাতি কুড়িয়েছেন। জন সংস্কৃতি নামের একাডেমিক জার্নালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। বিশ্বায়নের যুগে জাতিরাষ্ট্রের ভূমিকার পরিবর্তন ও সংকট , বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট দুনিয়াব্যাপী সহিংসতার সাংস্কৃতিক তাৎপর্য, ‘সংখ্যালঘু’র নির্মাণ এবং  তাদের ওপর ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ সম্প্রদায়ের নিপীড়নসহ বৈশ্বিক, জাতীয় ও স্থানিক সহিংসতার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছেন দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক যাবৎ। তিনিই সম্ভবত বিশ্বায়নের গতিপ্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলা শুরুর দিককার তাত্ত্বিকদের অন্যতম, যখন এমনকি ‘বিশ্বায়ন’ তার খোলস সম্পূর্ণ উন্মোচনও করেনি।

 

 

অর্জুন আপ্পাদুরাই

 

 

Modernity At Large (1996) এর পর অর্জুন আপ্পাদুরাই সেই ২০০৬ সালেই বিশ্বায়ন, জাতিরাষ্ট্র সহিংসতার পারস্পরিক যোগাযোগ নিয়ে লিখেছেন তাঁর দ্বিতীয় বই Fear Of Small Numbers : On the Geography Of Anger; যেখানে তিনি অত্যন্ত প্রফেটিক কায়দায় আজকের দুনিয়াব্যাপী ব্যাপক মাত্রার রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয়(non-state) সংঘবদ্ধ সহিংসতার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করেছেন। “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ” পরবর্তী বৈশ্বিক বাস্তবতায় সামাজিক অনিশ্চয়তা, অপূর্ণতা, ঘৃণা, ক্রোধ কীভাবে সহিংসতা উৎপাদনের নিয়ামক ভূমিকা পালন করে এবং বৈচিত্র‍্যকে মুছে ফেলতে চায় সে বিষয়ে বিশদ চুলচেরা ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। এই বইয়ে কেন ও কীভাবে ‘সংখ্যালঘু’ নির্মাণ করা হয় এবং সহিংসতার সম্মুখে তাদের উন্মোচন করা হয় সে সম্পর্কেও অত্যন্ত গভীর পর্যবেক্ষণ হাজির আছে।

 

ডানপন্থার বৈশ্বিক উত্থান এবং গণতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা

সম্প্রতি অর্জুন আপ্পাদুরাই বিশ্বব্যাপী ডানপন্থার উত্থান সম্পর্কে দুর্দান্ত কিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। বর্তমান প্রবন্ধে মূলত অর্জুন আপ্পাদুরাই কথিত বিশ্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতির ডানপন্থী মোড় এবং ‘নয়া এলিট’দের (New Elite) উত্থান সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে। এক্ষেত্রে আমরা অর্জুন আপ্পাদুরাই এর দুটি লেখার শরণাপন্ন হবো। প্রথম লেখাটির ইংরেজি শিরোনাম Democracy Fatigue যেটি ২০১৭ সালে Heinrich Geiselberger সম্পাদিত The Great Regression বই থেকে নেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় লেখাটি We are witnessing the revolt of the elites শিরোনামে The Wire নামের ইন্ডিয়ান অনলাইন পোর্টালে গত ২২ এপ্রিল, ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এই দুটি লেখা বেছে নেয়ার কারণ দুটি লেখাতেই বিষয়বস্তুই বৈশ্বিক ডানপন্থার উত্থান, গণতন্ত্রের ব্যাপক অবনতি, ‘সুপারলিডার’ ও তাদের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য ও মনস্তত্ত্ব, গণতন্ত্রের ব্যাপক ক্ষয়ের ক্ষেত্রে নির্বাচনের (election) এর ভূমিকা আলোচিত হয়েছে। মূলত দ্বিতীয় লেখাটিকে প্রথম লেখাটিরই সম্প্রসারণ ও সংযুক্তি বলা যেতে পারে। উল্লেখ্য, বর্তমান প্রবন্ধের লেখক কর্তৃক দ্বিতীয় লেখাটির একটি বাংলা অনুবাদ ইতোমধ্যেই অন্তর্জালে প্রকাশিত অবস্থায় আছে, আমরা অকাতরে সেই লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক অংশ এই লেখাতে ব্যবহার করব। তবে মূলত প্রথম লেখাটিতেই-অর্থাৎ Democracy Fatigue তথা গণতন্ত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা/বিদ্বেষ/ক্লান্তি -আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত থাকবে।

Democracy Fatigue প্রবন্ধে অর্জুন আপ্পাদুরাই বৈশ্বিক ডানপন্থার উত্থানের সাথে নেতা ও অনুসারীর আন্তঃসম্পর্কের প্রকৃতিগত পরিবর্তন এবং পশ্চিম বিশেষত ইউরোপের ভবিষ্যত গতিমুখ চিহ্নিত করেছেন।

আপ্পাদুরাই এই প্রবন্ধের শুরুতেই বর্তমান সময়ের কেন্দ্রীয় প্রবণতা পরিস্কার করেছেন : বিশ্বব্যাপী উদার গণতন্ত্রের প্রত্যাখ্যান/হ্রাস এবং এর স্থলে লোকরঞ্জনবাদী (populist) কর্তৃত্ববাদের আবির্ভাব। সদ্য বিদায় নেয়া ট্রাম্প (যিনি এখনো দাবি করে চলেছেন তাঁর বিরুদ্ধে ভোট কারচুপি হয়েছে এবং তিনিই বিপুল ভোটে জয়ী প্রেসিডেন্ট!) এর আমেরিকা, পুতিনের রাশিয়া, মোদীর ভারত এবং এরদোয়ান এর তুরস্কে এই প্রবণতার দৃষ্টান্ত খেয়াল করা যাবে। এছাড়াও, হাঙ্গেরিতে ভিক্টর ওর্বান, পোল্যান্ডে দুদা, ব্রাজিলে বলসোনারোও একই প্রবণতায় আক্রান্ত। ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য দেশেও ইতিমধ্যে বিদ্যমান স্বৈরশাসকদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী ডানপন্থী শাসনের সমস্ত প্রবণতা স্পষ্ট। এই দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি। বিশ্বব্যাপী এই ডান দিকে মোচড় সম্পর্কে উদ্বেগ ক্রমবর্ধমান ফলে আপ্পাদুরাই মনে করেন এই ডানপন্থার বৈশিষ্ট্য যুতসইভাবে সনাক্ত করা খুবই জরুরি।

উল্লেখ্য, অর্জুন আপ্পাদুরাই এর এই দুই প্রবন্ধে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত এক যুগের কর্তৃত্ববাদী শাসন সম্পর্কে কোন মন্তব্য নেই, তবে তিনি ডানপন্থার যেসকল ফিচার তুলে ধরেছেন তাতে শেখ হাসিনার শাসনামলকে ডানপন্থী তকমা না দেয়ার কোন কারণ নেই। আমরা এই প্রবন্ধের শেষ অংশে বৈশ্বিক ডানপন্থার সাথে বাংলাদেশের বর্তমান ডানপন্থী শাসনের মিল-অমিল তুলে ধরার চেষ্টা করব।

 

নেতা ও অনুসারী

নেতা ও নেতার অনুসারী বলতে যে চিরায়ত ধারণার সাথে আমরা পরিচিত, অর্জুন আপ্পাদুরাই মনে করেন সেই ধারণা দিয়ে আজকের ‘নেতা ও অনুসারী’র সম্পর্কের মিল ও দ্বন্দ্ব বোঝা সম্ভব না, এই ধারণায় পরিবর্তন আনতেই হবে। চিরাচরিতভাবে ধারণা করা হয় নেতা ও অনুসারীর যোগাযোগ বা মিলন ঘটে কিংবা বলা যায় পরস্পর পরস্পরের কাছে মূর্ত হয়ে ওঠে নেতার কারিশমা, সাহস, প্রপাগাণ্ডা এবং অনুসারীর নীতিগত আদর্শিক আনুগত্য থেকে। কিন্তু বর্তমানের এই ডানপন্থী দুনিয়ায় নেতা ও অনুসারীর সংযোগ ঘটে ঠিকই , কিন্তু সেটা সবক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরতার ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং নেতা-অনুসারীর উত্থান ও বিকাশ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বকীয়ভাবে ঘটে। অর্থাৎ নেতার আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, প্রতিশ্রুতি ও কৌশলের প্রতি উদাসীন-অনাগ্রহী থেকে সম্পূর্ণ নিজের বাসনা লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কৌশলের বশীভূত থাকতে পারে নেতার অনুসারীরা। এমনকি নেতা ও অনুসারীর সংযোগ সম্পূর্ণ দৈবাৎ ঘটনাও হতে পারে। আজকের দুনিয়ার ডানপন্থী নেতার মোটাদাগে বৈশ্বিষ্ট্যগুলো হচ্ছে : ভিন্নতার প্রতি চরম বিদ্বিষ্ট, পিতৃতান্ত্রিক (এমনকি ‘নেতা’ যদি নারীও হন), কর্তৃত্ববাদী। নেতার অনুসারীদের মধ্যে এসব বৈশ্বিষ্ট্য যে থাকে না তা নয়, আসলে থাকেই। কিন্ত অনুসারীদের নিজস্ব বৈশ্বিষ্ট্যগুলোই বরং অধিক গুরুত্বপূর্ণ: স্বীয় সমাজ তাদের জন্য এবং তাদের প্রতি যা করেছে এবং যা করেনি সেজন্য চরম ক্রোধ, ক্ষোভ, অসহায়ত্ব, হাহাকার ও প্রতিশোধনপরায়নতা।

তাহলে ‘নেতা’ ও ‘অনুসারী’র স্ব স্ব স্বার্থের মিলন ঘটে কোথায় বা কিসের মাধ্যমে? নির্বাচন! হ্যাঁ, নির্বাচন হচ্ছে সেই বিন্দু যেখানে নেতা ও অনুসারীর ইচ্ছা ও অভিলাষের মিলন ঘটে কিংবা নির্বাচন হচ্ছে সেই ঘটনা যার মাধ্যমে নেতা ও অনুসারী পরস্পরকে আশ্রয় করে স্ব স্ব এজেন্ডা (এজেন্ডাসমূহে সাদৃশ্য, বৈসাদৃশ্য ও ওভারল্যাপিং থাকতে পারে) চরিতার্থ করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায় বিজেপি কেন ও কীভাবে ভারতের বহু দলিত ও মুসলমানের ভোট পায়? কিংবা ট্রাম্প কেন কিছু সংখ্যক হলেও ব্ল্যাক, ল্যাটিনো, অভিবাসীর ভোট পায়? পশ্চিমবাংলার বামদের ভোট কেন বিজেপিতে শিফট হয়? এই জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে নেতা ও অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য ও মোটিভেশন সম্পর্কে স্বতন্ত্র বোঝাপড়া দরকার।

 

 

 

 

‘সুপারলিডার’ কে?

বৈশ্বিকভাবে যে ডানপন্থী শাসকদের উত্থান দেখা যাচ্ছে আপ্পাদুরাই তাদের কিছু (মোটাদাগে) সাধারণ ফিচার চিহ্নিত করেছেন। এই সুপারলিডারেরা (কখনো কখনো আমরা শ্লেষাত্মক অর্থে ‘ধর্মাবতার’ শব্দটিও ব্যবহার করব) খুব ভাল করেই অবগত আছেন  এমন এক সময়ে (বিশ্বায়নের যুগে) ধর্মাবতার হিশেবে তাদের আবির্ভাব ঘটেছে যে, যখন জাতীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা সংকটে পতিত। এর সবচেয়ে উদ্বেগজনক লক্ষণ হচ্ছে আজকের কোন জাতিরাষ্ট্রই জাতীয় সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন জাতীয় অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক নয়। এটা যেমন ধনী রাষ্ট্রসমূহের জন্য সত্য, গরীব রাষ্ট্রগুলোর জন্য তো কঠিন সত্য! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ; চীন আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার ওপর নির্ভরশীল কাঁচামালের জন্য, বিশ্বের প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রই মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল তেলের জন্য, বাংলাদেশের মতো ঋণনির্ভর উন্নয়নের ফুটানি করা আর রেমিটেন্স নির্ভর ‘উন্নয়নশীল’ রাষ্ট্রসমূহ ধনী ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। ফলে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের ধারণা প্রায় অপ্রাসঙ্গিকতায় বিলীন হয়ে গেছে।

তাহলে “জাতীয় সার্বভৌমত্ব” কথাটার মানেটাই বা কী হবে?

নিজস্ব অর্থনীতির ওপর কোন অর্থবহ লাগাম বা নিয়ন্ত্রণ না থাকার দরুণ বর্তমানের প্রায় সকল জাতীয় ‘সার্বভৌমত্ব’ এক ধরনের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ববাদের হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত। অর্থাৎ ঐতিহ্য, জাতিগত বিশুদ্ধতা, জাতিগত গৌরব নির্মাণ (কোন কোন ক্ষেত্রে জাতিগত কিংবা চেতনাগত সংকটের জুজু দেখিয়ে, যেমন ইন্ডিয়ায় বিজেপির প্রচারণা ‘হিন্দধর্ম হুমকিতে আছে’, বাংলাদেশে আওয়ামী প্রপাগাণ্ডা চ্যানেলের চেতনা ব্যবসায়, পাকিস্তানি ও মৌলবাদের জুজু )। এই সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ (majoritariaism) ‘অপর’, ‘শত্রু’ নির্মাণ ছাড়া রীতিমতো অসম্ভব। ফলে অবধারিতভাবেই জাতিগত-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিবিধ ‘সংখ্যালঘু’র নির্মাণ ঘটে। (বিস্তারিত বোঝার জন্য অর্জুন আপ্পাদুরাই এর  Fear Of Small Numbers বইটি দেখা যেতে পারে)। এই বাস্তবতাতেই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নমত ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকে। অর্জুন আপ্পাদুরাই একেই বলছেন “সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব”: In other words, the loss of economic sovereignty everywhere produces a shift towards emphasizing cultural sovereignty. This turn towards culture as the site of national sovereignty appears in many forms. (From : Democracy Fatigue)

যেমন রাশিয়ার পুতিন ২০১৪ সালে এক ডিক্রি জারি করে বলেছিলেন, রাশিয়া ‘ইউরোপ’ নয়। পুতিনের মতে ইউরোপের সাংস্কৃতিক বহুত্ব ‘নপুংসক ও বন্ধ্যা’ ( দুটোই যৌনবাদী শব্দ) এবং পুতিন রাশিয়াকে এক স্বতন্ত্র ‘ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক স্থান’ হিশেবে নির্মাণ করতে চান। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে এই ‘রাশিয়া’ কতটা যৌনবাদী ও পিতৃতান্ত্রিক হবে! এই ডিক্রির জারির পরপরই ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরু হয়, পুতিনবিরোধী শিল্পীকে কনসার্ট কর‍তে বাধা দেয়া হয় আর রাশিয়ার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ‘দুর্ঘটনা’ কিংবা অপঘাতে মৃত্যু তো রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে! মোদ্দাকথা, পুতিনের নেতৃত্বে ‘ঐক্যবদ্ধ’ রাশিয়া দেশের অভ্যন্তরে সমস্ত ভিন্নমতকে দমন ও দেশের বাইরে রাজনৈতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে তৎপর থেকে ‘সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব’ বজায় রাখবে।

এরদোয়ান তো সার্বভৌমত্বের রঙ্গমঞ্চে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রীতিমতো অনিবার্য টুল বানিয়ে ছেড়েছেন। একদিকে নব্য অটোমানবাদী কায়দায় ‘নয়া তুরস্ক’ নির্মাণ,  মুসলিম দুনিয়ার ত্রাতা হওয়ার সাম্রাজ্যবাদী বাসনা ; অন্যদিকে ইউরোপের দিকেও এক পা দিয়ে রাখা এরদোয়ানের রাজনৈতিক প্রকৃতি। ভিন্নমত এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার ক্ষেত্রে এরদোয়ান বরাবরই চরম নির্মম।

অর্জুন আপ্পাদুরাই এর ডানপন্থী ‘সুপারলিডার’ এর টেক্সট বুক এক্সাম্পল সম্ভবত ইন্ডিয়ার নরেন্দ্র মোদী। আরএসএস এর তৃণমূল কর্মী হিশেবে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন, এরপর গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ২০০১-২০১৪ সাল পর্যন্ত। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাটে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ গণহত্যা চালানো হয় যা ‘গুজরাট মডেল’ নামে পরিচিত। ‘পুরস্কার’ হিশেবে এরপর গোটা ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন টানা দুইবার। তিনি বর্তমান ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রধান ভ্যানগার্ড। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি ও নব্য উদারতাবাদী বাজার অর্থনীতির সমন্বয়ে এক নয়া ইন্ডিয়ার আবির্ভাব ঘটিয়েছেন।

মোদীর নেতৃতাধীন ভারতের বর্তমান রেজিম কেবলমাত্র নির্বাচন ছাড়া বাদবাকি সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারেই চরম ঘৃণা পোষণ করে। এটি অর্ধশিক্ষিত অর্থনীতিবিদ, ক্যারিয়ার জোচ্চোর, একচেটিয়া কায়-কারবার, তদবির ও খুল্লামখুল্লা দুর্নীতির মাধ্যমে স্বার্থ হাসিল করা লুন্ঠনজীবী ব্যবসায়িক সম্প্রদায় এবং নির্লজ্জ অপরাধী রাজনীতিবিদ ও আইনপ্রণেতাদের সমন্বয়ে গঠিত। এদের প্রতি-অভ্যুত্থান বহুত্ববাদী ইন্ডিয়ার ধারণার বিরুদ্ধে।

এই রেজিম নব্য এলিটদের এমন এক সংঘ যারা মনে করে ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদীরাই ভারতীয় ইতিহাসের একমাত্র ত্রাতা এবং এই তথাকথিত ‘ত্রাতা’রা মোঘল, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল এবং কংগ্রেসের দীর্ঘশাসনের পর নিদ্রা ভেঙ্গে জেগে উঠেছে। এই জোট ভয়াবহভাবে মুসলিম, খ্রিস্টান, দলিত ও লিবারেলবিদ্বেষী মতাদর্শ, নীতিনির্ধারণ ও গণহত্যা সংঘটনের ক্ষেত্রে নিজেদের অত্যন্ত কার্যকর শক্তি মনে করে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দায়মুক্তি ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে এই নব উত্থিত এলিটদের মধ্যে কোন শ্রেণীগত ঐক্য নেই।

জো বাইডেন আর কামালা হ্যারিসের প্রবল ব্যক্তিত্ব এবং মিডিয়ার ফুলানো ফাঁপা ‘hope’, ‘progress’ এর গল্পের মধ্যেও লুকানো যাচ্ছে না যে ট্রাম্প এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এবং খুব সহজে ক্ষমতা ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে না! আগামী জানুয়ারিতে ট্রাম্পকে ক্ষমতা থেকে সরাতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ‘পূণ্যভূমি’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোন কোন কেলেংকারির জন্ম দিতে হয় কে জানে! ভাগ্যিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ করার জন্য কেউ humanitarian intervention এর কথা ভাবে না!

যাই হোক, বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড় থেকে রাতারাতি সমস্ত ডানপন্থী ‘ভূত’ ছাড়াবেন এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। ‘ট্রাম্পবাদ’ (Trumpism) কোন ব্যক্তি নয়! ট্রাম্প যে এলিটদের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং নিজে যে ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন, তারা কেউই খুব বেশি শিক্ষিত নয়। তারা সেলফোন উদ্যোক্তা কিংবা রাজনীতিবিদ, রিপাবলিকান সিনেটের শাসক, হাউজের রিপাবলিকান অংশ, চায়ের পার্টি কিংবা রাজিনীতির প্রত্যেক স্তরেই উটকো, অনাহুত লোকজন। এছাড়াও, এই তালিকায় আরো রয়েছে ক্ষমতার বিমারে বিকারগ্রস্ত সিইও(CEO, যেমন পিটার থিয়েলের মতো সিলিকন ভ্যালি আইকন) , টেলিভিশন ও রেডিও মিডিয়ার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এবং বর্ণবাদী ও লোভী ধর্মপ্রচারক যাজক, গীর্জা এবং দাতাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। এর সাথে যোগ করুন ডানপন্থী থিংক ট্যাঙ্কের ক্যারিয়ারবাদী ভাড়াটে লেখকদেরও। কোনও সুস্পষ্ট সাংস্কৃতিক শিকড় ছাড়াই এলিটদের এই নেটওয়ার্কের একেবারে গভীরে কাজ করছে ফেডারেল সোসাইটির ওপাস দেই’য়ের(Opus Dei) মতো ট্রান্সন্যাশনাল গ্রুপগুলোর গোপন নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কগুলো হলো সুবিধাবাদ, লোভ এবং মুনাফাগন্ধীর নেটওয়ার্ক, যাদের কোন ঐতিহ্যগত বন্ধন কিংবা মূল্যবোধের বালাই নেই। এই নেটওয়ার্কের প্রধান ধর্মাবতার ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই খুবই চটকদার রেটরিক ব্যবহার করেছিলেন, “Make America great again..” যার প্রকাশ্য অর্থ ছিল আমেরিকার ‘হৃতপ্রায়’ শক্তি উদ্ধারের লক্ষ্যে নানা প্রকারের মিলিটারি চুক্তির নবায়ন, অর্থনীতিকে ওলটপালট করা এবং অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল ‘great America’ মানে সাদাদের আমেরিকা ; যেখানে মুসলিম, অভিবাসী, ব্ল্যাকদের স্থান ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসবে:

The implicit message is racist and racial, and speaks to those white Americans who feel they have lost their imagined dominance in American politics and economy to blacks, Latinos and migrants of every type. Trump’s biggest rhetorical success is to put the Greeks of ‘whiteness’ into the Trojan horse of every one of his messages about ‘American’ greatness, so that ‘making America great again’ becomes the public way of promising that whites in America will be great again. For the first time, a message about America’s power in the world has become a dog-whistle for making whites the ruling class of and in the US again. The message about the salvation of the American economy has been transformed into a message about saving the white race. (From Democracy Fatigue)

ইউরোপের অবস্থাও একই রকম : This worldwide package is also visible in Europe, in Theresa May’s UK, Victor Orbán’s Hungary, Andrzej Duda’s Poland, and in a host of increasingly vocal and ‘mainstream’ right- wing parties in virtually every other country. In Europe, the flashpoints for this trend are the fear of the latest wave of migrants, the anger about the various terrorist attacks in some of its major cities, and, of course, the shock of the Brexit vote. Thus populist authoritarian leaders and demagogues are to be found everywhere across the old continent, and they too operate with the same mix of neoliberalism, cultural chauvinism, anti-immigrant anger and majoritarian rage as the major models discussed in this essay. (From Democracy Fatigue)

 

 

২.

নয়া এলিটদের (New elites) উত্থান :

অর্জুন আপ্পাদুরাই মনে করেন, আমরা ‘নব্য এলিটদের উত্থান’-এর এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। এই উদীয়মান এলিটরাই নরেন্দ্র মোদী, ডোনাল্ড ট্রাম্প, এরদোগান, জেইর বলসোনারো, বরিস জনসন, ভিক্টর ওর্বান এবং এমন আরো বহু নব্য স্বৈরাচারদের আবরণ হিসেবে কাজ করে। তাঁদের সমর্থন আর তোষামোদ করে। তাঁদের পক্ষে প্রচারণা চালায়। নরেন্দ্র মোদী’সহ যেসব নব্য স্বৈরাচারদের নাম উল্লেখ করলাম, এরা এইসব নব্য এলিটদের উপর ভর করে এমন এক ব্যবস্থা কায়েম করেছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘উপর থেকে আরোপিত লোকরঞ্জনবাদ (populism)’। এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আমজনতা কেবল গণতন্ত্র থেকে ব্যাপকমাত্রায় নিষ্ক্রমণের (exit) উপকরণ মাত্র।

এইসব নতুন স্বৈরাচারী এলিটদের আচরণকে লুন্ঠনজীবী পুঁজিবাদ, পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কপ্রণালীর নয়া উদারতাবাদী পুঁজিবাদের নতুন ছদ্মবেশ, দুর্যোগ পুঁজিবাদ না বলে ‘অভ্যুত্থান’ বলার কারণ কী? এই নব্য এলিটরা কারা? তাদের অভ্যুত্থানটাই বা কিসের বিরুদ্ধে?

প্রথমত, তাদের এই উত্থান অন্য সমস্ত এলিটদের বিরুদ্ধে, যাদের তাঁরা হেয়, ঘৃণা ও ভয় করেঃ উদারনীতিবাদী এলিট, মিডিয়া এলিট, সেক্যুলার এলিট, কসমোপলিটান এলিট, “হার্ভার্ড” এলিট, ঝানু অর্থনৈতিক এলিট, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং শিক্ষাবিদ। সুতরাং, ‘অ্যান্টি-এলিট’ ডিসকোর্সের ছদ্মবেশে এটা আসলে নতুন এক এলিটিজম।

দ্বিতীয়ত, এই উত্থান তাঁদের বিরুদ্ধে যারা মনে করে প্রকৃত এলিটদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা হয়েছেঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গরা, ভারতে মুসলিম আর সেক্যুলারপন্থীরা, ব্রাজিলে বামপন্থী ও এলজিবিটি সম্প্রদায়, রাশিয়ায় ভিন্নমতাবলম্বী, এনজিও এবং সাংবাদিক, তুরস্কে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংখ্যালঘু, যুক্তরাজ্যে অভিবাসী, শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নবাদীরা সেই ‘বিশ্বাসঘাতক’। এই প্রতি-অভ্যুত্থান তাঁদের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে যারা মনে করে ‘দখলদার’ কিংবা ‘ভুয়া’ এলিটদের বিপরীতে তাঁরাই ‘প্রকৃত’ এলিট।

তৃতীয়ত, নব্য এলিটদের এই প্রতি-উত্থান লিবারেল গণতন্ত্রের যুগে নির্ণীত মূল্যবোধের বিরুদ্ধেও। কেবলমাত্র নিজেদের জন্য ব্যতীত তাঁরা স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বকে স্রেফ ঘৃণা করে। কোন রকম বাধা ছাড়াই যা খুশি করার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্যকে(চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স) তাঁরা ‘অবৈধ’ জ্ঞান করে। তাঁরা যে কোনও ধরনের নিয়ন্ত্রণকে ঘৃণা করে, বিশেষত কর্পোরেট সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে; কারণ তাঁরা একে মনে করে তাঁদের নিজস্ব এখতিয়ারের ক্ষেত্র পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে গভীর ‘ষড়যন্ত্র’। সর্বোপরি, তাঁরা বিবেচনা এবং পদ্ধতিগত যুক্তিবোধকে ঘৃণা করে। কারণ এগুলো অন্যের বক্তব্য শোনা, ধৈর্য এবং সম্মিলিত যুক্তিবোধের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি। কেবলমাত্র তাঁদের বন্ধুবান্ধব ও সমমনাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে, এমনকি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণেও তাঁদের আস্থা নাই।

তার মানে, একেবারে সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে, নব্য এলিটদের এই প্রতি-অভ্যুত্থান আসলে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই, কিন্তু এক্ষেত্রে মোচড় বা টুইস্ট হলো এই প্রতি-অভ্যুত্থান সংঘটিত হচ্ছে জনতার নামে। অন্যভাবে বলতে গেলে, অতি পরিণত (late) আধুনিককালের ‘জনতা’র ধারণা ‘গণ’ (demos) এবং গণতন্ত্র ধারণা থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে গেছে। এটি একটি অভ্যুত্থান—এই অর্থে যে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে উত্থান বরাবরই অভ্যুত্থান—আবশ্যিকভাবে বিপ্লব নয়। বিপ্লবের অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হওয়া। অন্যদিকে, এই অভ্যুত্থান কেবল এক এলিটের জায়গায় আরেক এলিটকে প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা।

উল্লেখিত সব কথাই মারাত্মকভাবে সরলীকরণের দোষে দুষ্ট এবং ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত মনে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যদি আমরা ওপরে বর্ণিত সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্নের পর্যালোচনা আমলে না নেই। এই নতুন এলিটদের প্রকৃতি, তাদের আবির্ভাবের শর্তসমূহ, এদের সামাজিক শেকড় আমাদের সামনে আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইন্ডিয়া, তুরস্ক, রাশিয়া, বাংলাদেশের মতো সমাজ ও রাষ্ট্রকে হাজির করে।

This, then, is what the leaders of the new authoritarian populisms have in common: the recognition that none of them can truly control their national economies, which are hostages to foreign investors, global agreements, transnational finance, mobile labour and capital in general. All of them promise national cultural purification as a route to global political power. All of them are friendly to neoliberal capitalism, with their own versions of how to make it work for India, Turkey, the United States or Russia. All of them seek to translate soft power into hard power. And none of them has any reservations about repressing minorities and dissidents, stifling free speech or using the law to throttle their opponents. (From : Democracy Fatigue)

 

অনুসারীর পাল

অর্জুন আপ্পাদুরাই এর যুক্তি অনুযায়ী এই ডানপন্থী শাসকদের অনুসারীদের স্বতন্ত্রভাবেই বুঝতে হবে কারণ তারা ব্যাপক এজেন্সিসম্পন্ন। এমন মনে করার কোন কারণ নেই যে এই অনুসারীরা যেসব নেতাদের উপর আস্থা রাখেন তাদের কেবল অনুকরণ কিংবা অন্ধ বিশ্বাস করেন। অবশ্যই নেতাদের প্রতিশ্রুতি এবং অনুসারীর বাসনা ও বিশ্বাসে কিছু সংমিশ্রণ তো আছেই। কিন্তু সেটা পুরো ঘটনার আংশিক দিক। কিন্তু বিশ্বাস, বাসনা ও লক্ষ্যের দিক থেকে অনুসারীদের নিজস্ব বিশ্ববীক্ষা রয়েছে। রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক আলবার্ট হার্শম্যান (Albert O. Hirschman) এর বরাতে আপ্পাদুরাই জানাচ্ছেন:

In his brilliant book ‘Exit, Voice, Loyalty’ Hirschman provides a powerful understanding of how human beings respond to a decline in products, organizations and states by either remaining loyal to them, leaving them or staying with them to protest the decline by ‘voicing’ opposition, resistance or complaints in the hope of repair or reform. The great originality of Hirschman’s analysis was its linking of consumer behaviour to organizational and political behaviour, and his approach was a vital move in comprehending how long and in what circumstances ordinary people could tolerate disappointment with goods and services before they switched brands, membership of organizations, or countries. Published in 1970, Hirschman’s book offered a deep insight into modern capitalist democracies before globalization began to undo the logic of national economies, local communities and place- based identities. It was also written before the rise of the internet and social media and thus could not have anticipated the nature of disappointment and protest in the world of the twenty-first century.

হার্শম্যানের, exit, voice, loyalty ধারণাগুলো আজকের দিনেও কার্যকর কিন্তু ভিন্নভাবে। হার্শম্যান যখন তাঁর বই লিখছেন, তখনো পর্যন্ত নির্বাচন সেই অর্থে জনগণের voicing এবং loyaly ছিল যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর জনগণ তাদের শাসকদের প্রতি সন্তোষ কিংবা অসন্তোষ প্রকাশ করত। অর্থাৎ নির্বাচন ছিল রাজনৈতিক দেনদরবারের ক্ষেত্রে একটা exit বা নিষ্ক্রমণ। আপ্পাদুরাই বলছেন, হার্শম্যানের সময়ের সাথে আজকের দুনিয়ার পার্থক্য হলো নির্বাচন আজকের দিনেও একটা exit, কিন্তু সেটা গণতন্ত্রকে বিদায় জানানো অর্থে নিষ্ক্রমণ

তার মানে দেখা যাচ্ছে, ডানপন্থী শাসক ও তাদের ভোটারু (electoral) অনুসারী উভয়েরই অবলম্বন ‘নির্বাচন’। আজকের দুনিয়ার শাসকেরা নির্বাচনের উপর নির্ভরশীল কারণ এটাই তাদের কাছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অস্বীকার করার সহজতম পথ। অন্যদিকে এইসব শাসকদের অনুসারীদের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইত্যাদির কোন আবেদন নেই ; তাদের কেবল নিজেদের ক্ষোভ, ক্রোধ ও হতাশা নির্গমনের জন্য নির্বাচন নামক এক ব্যবস্থা দরকার যার মাধ্যমে তারা তাদের স্বপ্নের ‘সুপারলিডার’ পাবে।

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, বিশ শতকের স্ট্যালিন, হিটলার, মুসোলিনীর মতো স্বৈরশাসকেরাও তো গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের গভীর হতাশা থেকেই ফায়দা লুটেছিল, তাহলে আজকের দিনের স্বৈরশাসক সুপারলিডারদের নতুনত্ব বা অভিনত্বটাই বা কী? আপ্পাদুরাই বলছেন অন্তত তিনটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আজকের যুগের সাথে আগেকার যেকোন যুগের পার্থক্য তৈরি করে দেয়:

The first is that the extension of the internet and social media to growing sectors of the population and the availability of web-based mobilization, propaganda, identity-building and peer-seeking have created the dangerous illusion that we can all find peers, allies, friends, collaborators, converts and colleagues, whoever we are and whatever we want.

The second is the fact that every single nation-state has lost ground in its efforts to maintain any semblance of economic sovereignty.

The third factor is that the worldwide spread of the ideology of human rights has given some minimal purchase to strangers, foreigners and migrants in virtually every country in the world, even if they face a harsh welcome and severe conditions wherever they go. Together, these three factors have deepened the global intolerance for due process, deliberative rationality and political patience that democratic systems always require.

এর সাথে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক সুরক্ষার সংকোচন, এমন সব অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব যেগুলোর কাজই হচ্ছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় তৈরি করা এবং মোদীর মতো গণতন্ত্রের প্রতি চরম আস্থাহীন শাসক হলে তো কথাই নেই! পদ্ধতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনবে! (Demonetisation এর নামে ৫০০ ও ১০০০ রূপির নোট বাতিলের কথা স্মরণ করুন! যার ফলে ইন্ডিয়ার কোটি কোটি দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা স্রেফ সর্বস্বান্ত হয়েছে।)

অর্থাৎ দুনিয়াজুড়েই আমরা এমন এক নব্য এলিটতন্ত্রের মুখোমুখি যার দুই পক্ষের (নেতা ও অনুসারী) স্পষ্ট সব বিরোধ ও স্বার্থের জেনুইন সংঘাত (This common cultural ground inevitably hides the deep contradictions between the neoliberal economic policies and well-documented crony capitalism of most of these authoritarian leaders and the genuine economic suffering and anxiety of the bulk of their mass followings.) আড়াল হয়ে যাচ্ছে আপাত স্বার্থের ‘মিলন’ এর ফলে।

সমস্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নব্য এলিট শাসকদের দরকার ‘নির্বাচন’, অন্যদিকে তাদের অনুসারীরা ঐতিহাসিক বঞ্চনার বোধ থেকে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার শম্বুক গতির প্রতি মারাত্মক বিতৃষ্ণ, বিদ্বিষ্ট, অনীহপ্রবণ। তাদের ক্ষেত্রে নির্বাচন হচ্ছে democracy fatigue কাটাবার একমাত্র উপায়। ফলে নব্য এলিটদের সুবিধাবাদ ও চতুরতা এবং তাদের অনুসারীদের ঘৃণা ও ক্লান্তির কমন গ্রাউন্ডেই তৈরি হয় সাংস্কৃতিক ও/অথবা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদ-সংখ্যাগরিষ্ঠতা সমেত “সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব”: This hatred and this exhaustion find their natural common ground in the space of cultural sovereignty, enacted in scripts of racial victory for resentful majorities, national ethnic purity and global resurgence through the promises of soft power.

এই বাস্তবতাতেই জাতিগত-ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘প্রান্তিক’ জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয় এবং তারা নজিরবিহীন সহিংসতার সম্মুখে উন্মোচিত থাকে। তারা এই ‘বলিরপাঁঠা’ ততক্ষণ পর্যন্ত হতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক সুরক্ষা, রুটি রুজি মর্যাদার নতুন রাজনীতি না গড়ে উঠবে।

 

নব্য এলিটদের অভ্যুত্থানের সাক্ষী হচ্ছি আমরা প্রবন্ধ থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি:

অন্ধ সমর্থক এবং সহযোগীদের নেটওয়ার্কের এক সুবিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে যারা মনে করে ‘সুপ্রিম লিডার’-এর তালে তাল মিলিয়ে চলার মধ্যেই তাদের নিজেদের এবং জাতির সমৃদ্ধি নিহিত। তাহলে, পূর্ববর্তী এলিটদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানরত এই নব্য এলিটবৃন্দ, যারা বর্তমান দুনিয়ার লোকরঞ্জনবাদী স্বৈরতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ দোসর, যাদের এই ক্যু লিবারেল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে; অনুসারীগোষ্ঠী, বুনিয়াদি শক্তি, ভোটার, এমনকি যে ‘জনগণ’-এর নাম ও দোহাই দিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটা অনন্ত ‘যুদ্ধ’ চালানো হচ্ছে, এই সমস্ত কিছু সমেত এই নব্য এলিট এবং তাদের বিশাল সংখ্যক সমর্থক অনুসারীদের আমরা কীভাবে ‘পাঠ’ করব? কীভাবে ব্যাখ্যা করব?

এই অত্যন্ত উদ্বেগজনক প্রশ্নের কিছু গড়পড়তা উত্তর আছে। একটি হলো এই স্বৈরশাসকেরা আবেগ-অনুভূতির (প্রেম, ক্ষত, ত্যাগ, ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ) গুরুত্ব বোঝে এবং এগুলোকে হাতিয়ার হিশেবে ব্যবহার করে। অন্যদিকে তাঁদের প্রতিপক্ষরা এমন সব তত্ত্ব, মূল্যবোধ, যুক্তি বিষয়ক আধা-বিদ্যায়তনিক তর্ক-বিতর্কে ডুবে থাকে, যেগুলোর আজকাল গণ আবেদন হারিয়ে ফেলেছে। দ্বিতীয়টি হলো আকাঙ্ক্ষার প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী উত্থান (বিজ্ঞাপন, ভোক্তা পণ্য, সেলেব্রিটি কাল্ট, কর্পোরেট সংস্কৃতি), যেটি কিনা উদারনৈতিক পদ্ধতিগত প্রক্রিয়াগুলোর ধীরগতির প্রতি দরিদ্র ও নিম্নবর্গ শ্রেণী ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। তাঁরা এখন সমৃদ্ধি ও মর্যাদা চায় এবং এই লোকরঞ্জনবাদী নেতারা তাঁদেরকে সেগুলো নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। আরও একটি যুক্তি হলো ক্রমাগত বাদ পড়া, দরিদ্র থাকা এবং অপমানের শিকার হওয়া নিম্ন শ্রেণীগুলোকে এতটাই বিদ্বিষ্ট করেছে যে তাঁরা এখন এইসব লুটেরা নেতাদের মধ্যেই নিজেদের পরিচয়কে জুড়ে দিতে চায় (যেসব নেতারা যা চায়, ঠিক তাই হাতিয়ে নিতে সক্ষম)। ফলে তারা মুসলিম, শরণার্থী, চৈনিক, জিপসি, ইহুদি, অভিবাসী এবং এমন আরও অনেক ‘অপর’-এর প্রতি আতঙ্কের দিকে আমজনতার মনোযোগ সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় বাস্তবতায় এই যুক্তিগুলো কিছুটা হলেও বোধগম্য।

তবে আমি মনে করি, ওর্তেগা গ্যাসেটের অন্তর্দৃষ্টি আমাদের এটা বুঝতে সহায়তা করে যে আমরা এমন এক যুগে প্রবেশ করেছি যেখানে আম-জনতার অভ্যুত্থান এলিটদের প্রতি-অভ্যুত্থান দ্বারা বেদখল হয়ে গেছে। এই বেদখল হওয়ার ঘটনায় সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বৈরাচারদের দ্বারা ঘনঘন ব্যবহার হতে থাকা এটাই উন্মোচন করে যে, এই ‘জনতা’ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে এইসব নব্য এলিটদের উত্থান মূলত তাঁদেরই উত্থান এবং তাঁদের সর্বোচ্চ করণীয় হচ্ছে, এইসব বীভৎস দানবীয় নেতাদের উত্থানের উদযাপন করা (সম্ভব হলে অনুকরণ করা)। সামাজিক পরিস্থিতি ও বিন্যাসের অর্থবহ বৈপ্লবিক কিংবা গণমুখী পরিবর্তনের চেয়ে এইসব নেতাদের মুহুর্তের মধ্যে সব ঠিকঠাক করে ফেলার ফাঁপা কারিশমার প্রতি তাঁদের অধিক আস্থা।

 কথা বলার ধরনে মনে হয় যেন এই নব্য ভোটারু (electoral) জনতা মনে করে বসে আছে তাঁদের নেতাদের সীমাহীন লুন্ঠনের সুফল তাঁদের দিকেও চুইয়ে পড়বে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি দরিদ্র ও নিম্নবর্গ শ্রেণীর আম-জনতার কাছে কেবল তাঁদেরই অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলির পাঁঠা অংশকে খুন করা, অঙ্গহানি করা এবং লাঞ্ছিত করার নিরঙ্কুশ দায়মুক্তি ছাড়া আর কিছু চুইয়ে পড়েনি। কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, উচ্চতর আয় এবং নিরাপদ শহরের মতো প্রাত্যহিক প্রয়োজনগুলো চুইয়ে পড়ার জন্য পিরামিডের একেবারে তলানিতে পড়ে থাকাদের সীমাহীন ধৈর্য ও অপেক্ষায় থাকতে হবে। কিন্তু তাঁরা এই আশায় বাঁচে যে, যদি তাঁদের কাছে ঘৃণা চুইয়ে পড়তে পারে, তাহলে হয়তো সমৃদ্ধিও চুইয়ে পড়বে।

 

বাংলাদেশ পরিস্থিতি:

বর্তমান প্রবন্ধে বিশ্বায়নের বাস্তবতায় যে নব উত্থানরত ডানপন্থার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে, তার সমস্ত কিছুই শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে মিলে যায়। ভিন্নমত দলন, সকল শ্রেণী পেশার নাগরিককে এক ভয়াবহ সার্বভৌম সহিংসতার সম্মুখে উন্মোচিত রাখা, একক বয়ান তৈরি করে সমস্ত বৈচিত্র্যকে গিলে ফেলা। বাঙালি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বয়ানের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল যে শাসনের নৈতিক খবরদারি, সেই শাসন আজকে অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি রাজনৈতিক মুসলমান পরিচয়বাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক। এই শ্রেষ্ঠত্ববাদী পরিচয়বাদী রাজনীতি শুরু হয়েছিল সেক্যুলারিজম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামক “সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব” নির্মাণের মাধ্যমে, বর্তমানে সেই একই শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতি রাজনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ইসলামের দ্বারস্থ হচ্ছে শাসনের ন্যায্যতা আদায়ের লক্ষ্যে।

এই দিক বিবেচনায় আপ্পাদুরাই কথিত কোন একক সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন নব্য-এলিটদের নেই, বরং তারা পরস্পরবিরোধী দুই শ্রেষ্ঠত্ববাদী সাংস্কৃতিক অভিঘাতের আপোষ, ঠোকাঠুকি ও মিশেলে টিকে আছে। আবার আরেকটা বড় পার্থক্য হলো বাংলাদেশের (অন্তত শাসনক্ষমতায় থাকা) নব্য এলিটদের কোন জনসম্মতি ও অনুসারীগোষ্ঠী নেই যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তারা ক্ষমতায় আসবে। ফলে দুই দুইবার বিনা ভোটে তারা ক্ষমতায় আছে। এদিক থেকে বাংলাদেশে নব্য এলিট ডানপন্থী শাসক এবং ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ মব সত্যিই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হচ্ছে অর্থাৎ এই মব বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা শাসকের অনুকূল না। কিন্তু বর্তমান জমানার ক্রোধান্বিত মবের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই ধারণ করে।

আপ্পাদুরাই যেমন দেখিয়েছেন, নির্বাচন হচ্ছে সেই বিন্দু যার উপর ভর করে ডানপন্থী শাসক ও তাদের অনুসারীরা পরস্পরের স্বার্থ চরিতার্থ করে এবং  সত্যিকারের গণতন্ত্র থেকে একপ্রকারের ‘নির্বাণ’ লাভ করে, বাংলাদেশে কিন্তু সেই বাস্তবতা ভিন্ন। কারণ এখানে গত এক দশক ধরে কোন নির্বাচন হচ্ছে না যে নির্বাচনে ভোট দেয়ার মাধ্যমে ক্রুদ্ধ মবের ‘গণতান্ত্রিক ভীতি’ থেকে নিষ্ক্রমণ ঘটবে এবং যে নির্বাচনকে ব্যবহার করে শাসক গণতন্ত্র নিশ্চিত করার হাত থেকে রেহাই পাবে। কিন্তু আপ্পাদুরাই এটাও বলেছেন, যেনতেন কায়দায় নির্বাচন ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমেও ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এই ধরনের শাসকের বৈশিষ্ট্য। যেমন রাশিয়ার পুতিন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকারের অনুগামী কোন ভোটারু( electoral) সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। কিন্তু democracy fatigue এ জর্জরিত ধর্মীয় ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববাদী মেজরিটি বাংলাদেশে অস্তিত্বশীল আছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, দুনিয়াজুড়ে যারা সব হারিয়ে কেবলমাত্র ভোটের অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে নিজেদেরকে নব্য এলিট ডানপন্থী শাসকের অনুগামী সহিংস সংখ্যাগরিষ্ঠ হিশেবে আবিষ্কার করছে, তাদেরই একটা অংশ (বাংলাদেশের সহিংস সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ‘জনতা’) যদি ভোটের অধিকারটুকুও সংরক্ষণ করতে না পারে, তাহলে তাদের সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, ক্রোধের রাজনীতিতে ভোটহীনতার হতাশা যুক্ত হয়ে যে সহিংসতার শর্ত তৈরি করছে ; তার সক্ষমতার সীমা কি কল্পনা করা সম্ভব?

তারা একদিকে যেমন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার সহিংসতার সম্মুখে নজিরবিহীনভাবে উন্মোচিত ন-মানুষ (হত্যাযোগ্য হোমো স্যাকের ; পারভেজ আলম ২০২০), ঠিক একইভাবে নিজেরাই একে অপরের জীবনের ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছে নজিরবিহীনভাবে। বাংলাদেশের এই ন-মানুষদের তাই বলা যেতে পারে “সার্বভৌম ন-মানুষ” ; যারা সার্বভৌম ক্ষমতার কাছে একেকজন সম্ভাব্য হত্যাযোগ্য ‘ন-মানুষ’, আবার প্রত্যকে প্রত্যকের ওপর সহিংস ক্ষমতা প্রয়োগে সক্ষম (গণপিটুনির কথা স্মরণ করুন) ‘সার্বভৌম’। এখানে প্রত্যেকে প্রত্যকের ‘অপর’। আবার সবাই সার্বভৌম ক্ষমতার ‘অপর’।

 

পর্যালোচনা

এই দুই নিবন্ধে অর্জুন আপ্পাদুরাই বিশ্বজুড়ে বিরাজমান ফ্যাসিবাদী, ডানপন্থী রাষ্ট্রপ্রণালী সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন। আমরা মনে করছি অপেক্ষাকৃত ন্যায্য, গণমুখী, গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা যারা বলেন, সমাজ-সম্পর্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে যারা চিন্তা করেন, সক্রিয় থাকেন; অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের এই পর্যবেক্ষণ তাঁদের আমলে নিতে হবে। কারণ বর্তমানে আমরা এমন এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমাজ বিন্যাসে আছি, যা প্রতি মুহুর্তে নিজেকে হালনাগাদ করছে, কৌশল বদলাচ্ছে। অত্যন্ত ক্ষীপ্র এই ব্যবস্থাকে যারা মোকাবেলা করছেন, তাঁরা তদ্রুপ ক্ষীপ্রতা অর্জন করতে না পারলে, আধিপত্যশীল ব্যবস্থা সম্পর্কে শত শত বছরের স্থবির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকলে, কখনোই সমাজ-সম্পর্কের পরিবর্তন আশা করা সম্ভব না।

আপ্পাদুরাই বলছেন, বর্তমান দুনিয়ার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে তার একটা অন্যতম প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিটদের মধ্যেই এক নতুন এলিট সম্প্রদায় এর উত্থান ঘটেছে। যারা বদলে দিয়েছে পুরোনো হিশাব নিকাশ। একে আমরা বলতে পারি, এলিটদের বিরুদ্ধে নব্য এলিটদের পাল্টা-অভ্যুত্থান।

দেখা যাচ্ছে যে, এই নব্য এলিট সম্প্রদায় কোন কোন ক্ষেত্রে, যারা জনগণ কেন্দ্রীক রাজনীতির কথা বলে তাঁদের চেয়ে বেশি জনসংশ্লিষ্ট। নব্য এলিটদের এই রাজনীতি-ধর্ম ব্যবসা-সংস্কৃতি কারখানার পেছনে আছে ব্যাপক জনসমর্থন। অন্তত আপাতদৃষ্টে তাই মনে হবে। প্রথাগত এলিটরা যেসব উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী মূল্যবোধকে স্বীকার করত অন্তত নিজেদের শ্রেণীর মধ্যে, এরা এমনকি সেইসব মূল্যবোধের প্রতিও বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাশীল না। এদের কোন ছদ্মবেশ নেই। মহৎ মহৎ কথার কোন ফুলঝুরি নেই, তারা যা করতে চায়, তা অত্যন্ত খুল্লামখুল্লাই করে।

বুর্জোয়া মানবতাবাদ, গণতন্ত্র, উদারনীতির সমন্বয়ে যে রাষ্ট্রপ্রণালী প্রচলিত ছিল, যেগুলো অন্তত কিছুটা হলেও প্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় কাজ করত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন ছিল, ক্ষমতার অন্তত লোকদেখানো বিভাজন ছিল; তার কিছুই আজকে আর অবশিষ্ট নেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, এমনকি বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলোতে। যেন এক সর্বত্র এক সর্বব্যাপ্ত মাফিয়াতন্ত্র কায়েম হয়েছে।

যারা প্রচলিত এলিট সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, উদারনৈতিকতার বিরুদ্ধে এক অনন্ত ‘ক্যু’ সংঘটিত করে চলেছে। অর্জুন আপ্পাদুরাই বলছেন, এক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্মম পরিহাস হলো, আগেকার যে কোন স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদের সাথে আজকের দুনিয়ার এই নব্য এলিট সম্প্রদায়ের নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদের পার্থক্য হলো, বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে, তার সবকিছুর পেছনেই এক আপাত বিপুল জনসমর্থন আছে।

কী করে সম্ভব হলো এই পরিস্থিতি? বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট-শিল্পী-নারীবাদী-সমাজতন্ত্রী-পরিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে এত বিপুল ক্ষোভ ও ঘৃণা উৎপাদনের কারণ কী? কী করে জনগণকে তাদের আসল বাস্তব প্রাত্যহিক সমস্যা-সংকট থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে নানা রকম ফাঁপা প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শিক চর্চায়? কী করে জনগণকে পরিণত করা যাচ্ছে ‘উন্মত্ত মব’-এ?

এই প্রবন্ধের প্রাথমিক পাঠে মনে হতে পারে যেন, অর্জুন আপ্পাদুরাই জনগণের উপরেই সমস্ত দায় চাপাচ্ছেন। কিন্তু আরেকটু গভীরভাবে পাঠ করলেই এটা পরিস্কার হবে যে, তিনি মূলত বলছেন, বর্তমান কালের নব্য এলিটরা ‘জনতা’র ধারণাতেও ক্যু সংঘটিত করে চলেছে। ‘জনতা’র নামে তারা মূলত এমন এক কাল্ট[গোষ্ঠীতন্ত্র] , এমন এক ক্রোধান্মত্ত মব তৈরিতে সক্ষম হয়েছে, যারা যুগ যুগ ধরে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হতে হতে, নানা ধরনের আদর্শিক প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে, শেষমেষ নিজেদের বাস্তব পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন না দেখতে পেয়ে বিশ্বায়নের যুগে এসে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, কোন এক ‘অতি-মানব’ সুপারলিডারে আস্থা রাখা ছাড়া, জিহাদি জোশ সম্বলিত কোন মতাদর্শের খরিদ্দার হওয়া ছাড়া তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না। নব্য উদারনৈতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ক্রমাগত প্রান্তিক হতে থাকা এই জনগোষ্ঠী গণতন্ত্রের প্রতি এক বিপুল ঘৃণা পোষণ করে এবং গণতন্ত্র থেকে ‘মুক্তি’ পেতে নির্বাচনের ওপর ভর করে।

ফলে এইসব ‘অতি-মানব’ স্বৈর-শাসকদের নির্মিত ‘কল্পিত শত্রু’র বিরুদ্ধেই তাঁরা তাঁদের সমস্ত ক্ষোভ ঢেলে দিতে উদ্যত। স্বৈর-শাসকদের সৃষ্ট বাস্তব সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে ঘৃণা, বিভাজন উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে যখন আমরা করোনাভাইরাস মহামারীতে সরকার-রাষ্ট্রপ্রণালীর নিদারুণ ব্যর্থতা, উন্নয়নের রোলমডেল রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাতের অকল্পনীয় অব্যবস্থাপনা (যার শিকার হচ্ছে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণ মানুষ), মাসখানেকের লকডাউনে সমস্ত কিছুতে ধস, তীব্র খাদ্যাভাব প্রত্যক্ষ করছি; ঠিক তখন ‘ধর্ম বনাম বিজ্ঞান’ এর মত অন্তঃসারশূন্য বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার মতো চরম অসংবেদনশীলতাও দেখতে পাচ্ছিলাম।

অর্জুন আপ্পাদুরাই’য়ের বক্তব্যের সার কথাটুকু যদি আমরা বুঝতে পারি, তাহলে আমরা হয়তো উপলব্ধি করব যে, জনগণকে নানা মতাদর্শে, চিন্তার বৈচিত্র‍্যকে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষে পরিণত করা, স্বীয় নলেজ সিস্টেমকে অন্য নলেজ সিস্টেমের উপর চাপিয়ে দেয়ার এই প্রবণতা বর্তমান কালের নব্য এলিটদের প্রধানতম সার্থকতা।

আরেকটা ব্যাপারও খেয়াল রাখা দরকার, এমনকি শতাব্দী পুরোনো ‘শ্রেণী’ বিশ্লেষণ দিয়েও আজকের পরিস্থিতি পুরোটা বোঝা অসম্ভব। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিট কমপ্লেক্সে পূর্ব অনুমিত অবধারিত কোন শ্রেণীগত ঐক্য নেই। একই শ্রেণীতে অবস্থিত সমস্ত পক্ষই একই মূল্যবোধে দীক্ষিত নয়।

যদি তাই হতো, তাহলে লিবারেল গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের বিরুদ্ধে একই শ্রেণীগত অ্যান্টি-লিবারেল, অ্যান্টি-হিউম্যানিস্ট, অ্যান্টি-ডেমোক্রেটিক ফ্যাসিস্ট এলিটদের উত্থান দেখতে হতোনা আজকের পৃথিবীকে। শ্রেণীবাদী রাজনীতি-অর্থনীতির বিরুদ্ধে অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে, কিন্তু চিরাচরিত যুক্তি-বিশ্লেষণ দিয়ে নয়। সেক্ষেত্রে আমরা পরিস্থিতির গুণগত নেতিবাচক পরিবর্তন বুঝতে ব্যর্থ হব। এলিটদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান রত নব্য এলিটদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হবো।

সেই সাথে চরম প্রতিক্রিয়াশীল-প্রলয়ঙ্করী নয়া উদারনৈতিক রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষকে স্রেফ ভোক্তা-ভোটারে পরিণত করার মাধ্যমে বাদবাকি সমস্ত সক্রিয়তা, কর্তাসত্তাকে ‘নাই’ করে দিতে পারে, (যার ফলে স্রেফ ভোটিং এজেন্সি চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ইনস্যানিটিতে পরিণত হয়েছে) সেটা অনুধাবন করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কৌশল নির্ধারণ করতে হবে, সেই আলাপটাও জরুরি।

 

 

ছবি কৃতজ্ঞতা

প্রচ্ছদ: Open democracy

ছবি ১: অরাজ

ছবি ২: Financial Times

ছবি ৩: Adnan Bbidi, Reuters

ছবি ৪: ইন্টারনেট

 

রেফারেন্স:

*Democracy Fatigue by Arjun Appadurai, The Great Regression (2017) ; Polity, 1st edition (2017), edited by Heinrich Geiselberger

*We are witnessing the revolt of the elites, Arjun Appadurai, The Wire, 2020

m.thewire.in/article/politics/populism-elite-narendra-modi-donald-trump/amp

*পারভেজ আলম (২০২০) মদিনা; আদর্শ প্রকাশনি, ২০২০, ঢাকা।

*অর্জুন আপ্পাদুরাই এর Democracy Fatigue প্রবন্ধটি এই লেকচার  থেকে শোনা যাবে।

 

Sarwar Tusher is an author and activist; interested in studying the state, power, authority, sovereignty, violence, and social relations.

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!