রণজিৎ গুহ একটা সাক্ষাৎকারে প্রজার সাথে নাগরিকের তফাত নিয়া বলছিলেন: ‘প্রজার সঙ্গে নাগরিকের মৌলিক তফাত এই যে, নাগরিকের অধিকার আছে, প্রজার নেই। প্রজার ভালো মন্দ, মরা-বাচা সবই প্রভুশক্তির অনুগ্রহ-নির্ভর। প্রভুর কাছে প্রজা প্রার্থনা করতে পারে, আবেদন করতে পারে, অবস্থাবিশেষে নালিশ জানাতে পারে; এক কথায়, সে চাইতে পারে। কিন্তু সে দাবি করতে পারে না। কারণ তার কোনো অধিকার নাই।’ আপনি যদি প্রজা হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি প্রধানমন্ত্রীর [প্রধানরাজার] কাছে অনুনয়-বিনয় জানাবেন। কাতরকণ্ঠে একটু নজর দেয়ার জন্য রাজাকে ডাকবেন। আবদার করবেন। মায়ার ডাক দিবেন রাজাকে। আর যদি আপনি নাগরিক হয়ে থাকেন, বা হয়ে উঠতে চান, তাহলে আপনি দাবি জানাবেন। এইটা আপনার হক। মিছিল করা আপনার অধিকার। মিটিং আপনার অধিকার। এখানে কোনো অনুনয়-বিনয়ের জায়গায় নেই।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ‘গুম’ নামক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসকে আইনি বরাত দিয়ে জায়েজ করেছে। একদিকে ‘পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার’ এর কথা স্পষ্টত উল্লেখ আছে, অন্যদিকে আইনের মধ্যে ‘করিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে’, ‘করিতেছেন বলিয়া সন্দেহ হইলে’, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট প্রতীয়মান হয়’ ইত্যকার বাক্য বা বাক্যাংশ বাংলাদেশের প্রায় তাবৎ জনগণকে ‘সম্ভাব্য অপরাধী’ হিসাবে হাজির করছে। এই আইনের প্রণয়নের পরপরই এই আশঙ্কা অনেকে অনুমান করলেও এটা এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে; এবং অতি অবশ্যই, বাস্তবতা অনুমানের চাইতে ঢের কঠিন। সম্প্রতি প্রায় নয় মাস কার্টুন আঁকার দায়ে জেলে বন্দী থাকা কার্টুনিস্ট কিশোর মুক্তির পর সাংবাদিকদের সামনে তার সাথে ঘটা ভয়ঙ্কর নির্যাতন এবং কিছুদিন পূর্বে জেলে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের শিকার মুশতাকের সাথে জেলে ঘটা ভয়ঙ্কর নির্যাতনের স্বরূপ তুলে ধরেন। এর বাইরে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কিশোরকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ২ তারিখ। কিন্তু আমরা তার গ্রেফতার বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক থাকার ঘটনা জানতে পারি ৬ তারিখ। তার মানে, এই তিন চার দিনের জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে তিনি ‘গুম’ থাকেন এবং সেই গুমকে বিদ্যমান আইনে হাজির থাকা বিভিন্ন অস্পষ্ট শব্দাবলী দিয়ে জায়েজ করাও সম্ভব। সাংবাদিক কাজলের ক্ষেত্রেও, চুয়ান্নদিন গুম থাকার পরই কেবল তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে জনসম্মুখে হাজির করা হয়। অর্থাৎ, ‘বেআইনি’ গুমের মাধ্যমে শুরু করা হচ্ছে ‘আইনি’ ডিজিটাল নিরাপত্তা অ্যাক্ট।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই দিক, বা বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে শর্তাধীন করে রাখার বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে ইতোমধ্যে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ কয়েকটি ধারা ধরে ধরে বিশদভাবে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে এই আইন সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে। কিন্তু একজন এক্টিভিস্ট হিসাবে আমি আইনের আরেকটা বিশেষ দিকে আলোকপাত করতে চাই। সম্প্রতি শ্রমিক নেতা রুহুল আমিনের গ্রেফতার আমাদের সামনে এই দিকটা প্রকটভাবে উন্মোচন করেছে।
উল্লেখ্য, ‘কতিপয় তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার’ যে ক্ষমতা কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়েছে তাতে দুটো বিষয় লক্ষণীয়। এক, যদি কোনো তথ্য-উপাত্ত ‘দেশের বা উহার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করে, বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে’ তাহলে সেই তথ্য-উপাত্ত সত্য নাকি মিথ্যা সেটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়, খোদ ‘তথ্য-উপাত্তে’র উপস্থিতিই আসল কথা। অর্থাৎ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বৈধতা হাসিলে গুজব, বানোয়াট তথ্য ইত্যাদির কথা বারংবার শোনা গেলেও আইনের ভেতর ‘তথ্য-উপাত্ত’ই মূল সমস্যা। দুই, এই ‘তথ্য-উপাত্ত’গুলো উপরোক্ত কোনো ঘটনা সাধন না করলেও কেবল যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘নিকট প্রতীয়মান হয়’ যে, এই ঘটনাগুলোর কোনো একটা ঘটতে পারে, তাতেই চলবে। আর বাদবাকি শব্দগুলো বা কারণগুলো ব্যাখ্যা এতই অস্পষ্ট (প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘আপেক্ষিক’) যে, এর ব্যবহার নানান কিসিমের হতে পারে। পুরো আইনজুড়ে এমন কিসিমের অনাচার-অনায্যতা ঘাপটি মেরে আছে।
রুহুল আমিন ও পাটকল আন্দোলন
গত ০৫ মার্চ শ্রমিক নেতা রুহুল আমিনকে মুক্তির দাবিতে রুহুল আমিনের সহযোদ্ধা ও খালিশপুরের শ্রমিকরা একত্রে মিছিল করার কথা ছিল। প্রচণ্ড পুলিশি বাধা, ভয় ও ভীতির মুখে কোনো কর্মসূচিই নেয়া যায়নি। যে শ্রমিক নিজেই অটো চালিয়ে নিজেই মাইকিং করে মিছিলের কথা জানাচ্ছিলেন পুলিশ তাকেও তুলে নিয়ে যায়। যদিওবা রাতে আবার ছেড়ে দেয়। খালিশপুরের শ্রমিকদের মধ্যে যারা মিছিলে এসেছিলেন যোগ দিতে, কিন্তু পারেননি, তারা তাদের খেদোক্তি প্রকাশ করছিলেন।
একজন শ্রমিক বলছিলেন, ‘আমাদের অপরাধটা কি? আমাদেরকে রাস্তায় দাড়াইতে দেয়া হয় না ক্যান?’ আরেকজন বলছিলেন, ‘রুহুল ভাইয়ের অপরাধটা কি? তিনি আমাদের পাশে থাকে দেইখা তারে খালি খালি ধরা হইছে’।
পুলিশ যখন টহল দিচ্ছিল, একসাথে কয়েকজনকে দেখলেই ঘরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছিল। মিছিলের জন্য নাকি পুলিশের অনুমতি মিলেনি। এটা শুনে আরেকজন শ্রমিক মন্তব্য করছিলেন, ‘ঘর থেইক্কা আমারে তুলে নিতে অনুমতি লাগে না, খালি আমার ভাতের দাবি জানাইতে অনুমতি লাগে, আমি রাস্তায় নামতে অনুমতি লাগে।’
পাটকল শ্রমিকদের অনেকেই মনে করেন যে, তাদের আন্দোলন দমন করার জন্য রুহুলকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, কয়েকমাস পূর্বে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের বেসরকারি করার ঘোষণা দেয়। এই বিষয়ে বিভিন্ন দল ক্রমাগত আন্দোলন করে যাচ্ছিল। ‘শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য’ নামক প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক এলাকায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল; রুহুল আমিন ছিলেন এই প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ক। পাটকল আন্দোলনের জন্য রুহুল আমিনকে বিভিন্ন সময়ে আরো তিনবার তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার সক্রিয়তাই তাকে শ্রমিকদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিল; শ্রমিকদের কথা থেকেই এটা ফুটে উঠে, ‘তার [রুহুল] কি কোনো স্বার্থ আছে এই আন্দোলন কইরা, উনি তো আমাদের জন্যই করছিলেন’।
শ্রমিকদের কেউ কেউ বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করে তাদের আন্দোলন দমন করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা জানে রুহুলকে মাঠ থেকে তুলে নিয়ে গেলে পাটকল আন্দোলনের গতি নষ্ট হবে। উল্লেখ্য, রুহুল আমিনকে গ্রেফতার করার কয়েকদিনের মধ্যেই পাটকল বিষয়ে একটু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসে: ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫ পাটকলের সবগুলোকে বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।’ ফলে কেউ কেউ এমন সিদ্ধান্তের সাথে রহুল আমিনের গ্রেফতারের ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছেন।
দুটো ধারা এবং আন্দোলন
প্রথমেই ২৫ নং ধারাটা পড়ে ফেলা যাক:
২৫। আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি।—(১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে।—
(ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিযোগে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা
(খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন,
এবার ৩১ নং ধারাটা:
৩১। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ইত্যাদির অপরাধ ও দণ্ড।—
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
এই দুটো ধারা কীভাবে বাকস্বাধীনতা বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ব্যাহত করেছে তা নিয়ে ইতোমধ্যে আলাপ হয়েছে। ফলে আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যাতে না গিয়ে কেবল আন্দোলন দমনে কীভাবে এই দুটো ধারাকে ব্যবহার করা যেতে পারে তা নিয়েই আলাপ করবো।
২৫ নং ধারাতে ‘আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক’ এবং ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার’ দুটো বর্গ এবং ৩১ নং ধারার ‘অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে’ এবং ‘আইন-শৃঙ্খলার অবনতি’ দুটো বর্গ এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, জেল হাজতে মুশতাকের মৃত্যুর পর আপনি একজন নাগরিক বা এক্টিভিস্ট বা আন্দোলনকারী হিসাবে আন্দোলনের ডাক দিলেন, মিছিলের ডাক দিলেন, বা সমাবেশের ডাক দিলেন। যেমন রুহুল আমিন ঢাকায় আয়োজিত একটা অনুষ্ঠানের পোস্টার শেয়ার দিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘আর কাল বিলম্ব নয় এবার সবাই ঢাকা চল, সংসদ ভবন ঘেরাও হবে’। তার শেয়ারকৃত পোস্টারে (আরো বহুজন এটা শেয়ার করেছিলেন) লেখা ছিল, ‘হাসিনা সরকার ও রাষ্ট্রকর্তৃক লেখক মুশতাক হত্যার প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ অভিমুখে লাশের প্রতিবাদ মিছিল’। তার অভিযোগনামায় যে দুটো পোস্টের কথা উল্লেখ আছে তাতে এটাও আছে।
এখন দেখুন, খুবই স্পষ্ট যে, তার শেয়ারকৃত পোস্টার লেখক মুশতাকের মৃত্যুর জন্য সরাসরি শেখ হাসিনা সরকার, মানে বিদ্যমান রেজিম এবং রাষ্ট্রকেই দায়ী করছে। নাগরিক হিসাবে সেটা করাটা খুবই স্বাভাবিক কাজ। বিনা কারণে দিনের পর দিন ধরে আটক কেউ যদি জেল হাজতে মারা যান (পরবর্তীতে নির্যাতনের কথাও শোনা গিয়েছে কিশোরের মুখ থেকে) তার দায় অবশ্যই রাষ্ট্র ও সরকারের ওপরই বর্তায়। সেই পোস্ট শেয়ার করে রুহুল আমিন সবাইকে আহ্বান করেছেন মিছিলে যেতে। সেটাও তার নাগরিক অধিকার। জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। যেহেতু খোদ প্রধানমন্ত্রীই দাবি করেছেন, এই আইনের ব্যাখ্যা ‘আপেক্ষিক’ ও ‘দৃষ্টিভঙ্গি’নির্ভর সেহেতু রুহুল আমিনের এই দুই বাক্যের খেদোক্তি ও আহ্বান উপরোক্ত চারটা বর্গে ফেলে দেয়া সম্ভব, যদি সেটা রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীনদের ‘দৃষ্টি’ ও ‘ভঙ্গি’ দিয়ে দেখা হয়ে থাকে।
বলা যেতেই পারে রুহুলের আহ্বান ‘আক্রমণাত্মক’, বলা যেতেই পারে রুহুলের শেয়ারকৃত পোস্টার রাষ্ট্রকে দায়ী করে ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ণ’ করেছে, বলা যেতেই পারে রুহুলের মিছিল বা সংসদ অভিমুখে প্রতিবাদ মিছিলের আহ্বান ‘অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি করতে পারে, বলা যেতেই পারে রুহুল যা যা বলেছেন তা করলে ‘আইন শৃঙ্খলার অবনতি’ ঘটতে পারে।
তাহলে খুবই স্পষ্ট যে, গুম খুন ক্রসফায়ারের মতন রাষ্ট্রীয় জুলুমের বিরুদ্ধে নাগরিকদের যে কোনো ধরনের ক্ষোভ প্রকাশ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সবই উপরোক্ত কয়েকটি বর্গতে আঁটানো সম্ভব। ছাত্র আন্দোলন থেকে শ্রমিক আন্দোলনসহ যে কোনো আন্দোলন বা যে কোনো আন্দোলনের আহ্বানই এই বর্গগুলোতে ফেলে আন্দোলনকে ‘আইনিভাবে’ দমন করা সম্ভব।
এই আইনকে অমান্য করতে হবে
এখানে খুবই স্পষ্টত দুটো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। একদিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে হাতিয়ার বানিয়ে বিবিধ কার্য হাসিল করা সম্ভব, অন্যদিকে এই আইনকে ব্যবহার করে যে কোনো ধরনের আন্দোলনকে দমন করা সম্ভব। আইনে হাজির বিভিন্ন অস্পষ্ট শব্দাবলী ও বাক্যাংশ দিয়ে বাংলাদেশের তাবৎ আন্দোলন সংগ্রামকে নস্যাৎ করার এতো বড়ো আইনি হাতিয়ার আর নেই। এই আইন সরাসরি গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী। এই আইনকে জিইয়ে রেখে বাংলাদেশে পরিবর্তনকামী রাজনীতি-সংগ্রাম করাও সম্ভব না। ফলে নানামুখী সৃজনশীল কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে এই আইনকে অমান্য করতে হবে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে পঞ্চাশ বছরে পা দিতে যাচ্ছে। পাকিস্তান আমলের যাবতীয় আন্দোলনের ইতিহাস বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সহ নানান গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াই এর ইতিহাস। এর নানান নমুনা ইশারা ইঙ্গিত সেই আন্দোলনগুলোর দাবিদাওয়াতেই লেপ্টে আছে। যেমন, অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে ৩ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ’ থেকে যে ইশতেহার পাঠ করা হয়েছিল তাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল, ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ গঠন করে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে’। আজ পঞ্চাশ বছরের মাথায় এসে বাংলাদেশ রাষ্ট্র, বিদ্যমান আওয়ামী রেজিম এমন এক আইন বানিয়েছে যে আইন যেমন বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করেছে, আন্দোলন-সংগ্রামের অধিকারকে নস্যাৎ করছে, তেমনি রাষ্ট্রের চোখে প্রতিটি নাগরিককে ‘সম্ভাব্য অপরাধী’ করে তুলছে। যে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, এই আইন খোদ সেই নীতি-বিরুদ্ধ। এই আইন উপনিবেশিক আমলের আইনের চেয়েও নিকৃষ্ট। এই আইন আমাদেরকে অমান্য করতে হবে।
রণজিৎ গুহ একটা সাক্ষাৎকারে প্রজার সাথে নাগরিকের তফাত নিয়া বলছিলেন: ‘প্রজার সঙ্গে নাগরিকের মৌলিক তফাত এই যে, নাগরিকের অধিকার আছে, প্রজার নেই। প্রজার ভালো মন্দ, মরা-বাচা সবই প্রভুশক্তির অনুগ্রহ-নির্ভর। প্রভুর কাছে প্রজা প্রার্থনা করতে পারে, আবেদন করতে পারে, অবস্থাবিশেষে নালিশ জানাতে পারে; এক কথায়, সে চাইতে পারে। কিন্তু সে দাবি করতে পারে না। কারণ তার কোনো অধিকার নাই।’ আপনি যদি প্রজা হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি প্রধানমন্ত্রীর [প্রধানরাজার] কাছে অনুনয়-বিনয় জানাবেন। কাতরকণ্ঠে একটু নজর দেয়ার জন্য রাজাকে ডাকবেন। আবদার করবেন। মায়ার ডাক দিবেন রাজাকে। আর যদি আপনি নাগরিক হয়ে থাকেন, বা হয়ে উঠতে চান, তাহলে আপনি দাবি জানাবেন। এইটা আপনার হক। মিছিল করা আপনার অধিকার। মিটিং আপনার অধিকার। এখানে কোনো অনুনয়-বিনয়ের জায়গায় নেই।
যদিও আমাদেরকে ‘আইনকে মান্য করো’ শেখানো হয়ে থাকে, কিন্তু আইন আর ন্যায়বিচার বা জাস্টিস এক নয়। আইন যখন অনায্য হয়ে উঠে, নাগরিকের জন্য গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেই আইনকে উপড়ে ফেলতে হয়। হাওয়ার্ড জিন এক আলাপে বলেছিলেন, আইনকে অমান্য করা এটা সমস্যা নয়, বরঞ্চ আমাদের সমস্যা হচ্ছে অইনের প্রতি আমরা অনুগত, বাধ্য। আইনের প্রতি ‘এবসুলিউট’ বাধ্যতা ও আজ্ঞানুবর্তিতা খোদ ন্যায়বিচার বা জাস্টিসকেই অমান্য করে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করার পাশাপাশি যে কাঠামো বা ব্যবস্থার মাধ্যমে এমন গণবিরোধী আইন বানানো সম্ভব হয়েছে সেটাকেও উপড়ে ফেলা নাগরিক হিসাবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
Sohul Ahmed, activist, and author. Topics of interest are politics, history, liberation war, and genocide. Published Books: Muktijuddhe Dhormer Opobabohar (2017), Somoyer Bebyocched (2019), and Zahir Raihan: Muktijuddho O Rajnoitik Vabna (2020)