তত্ত্ব, তথ্য ও অভিজ্ঞতায় ছোট কাগজের আত্মকাহন

Share this:
নাসৌ-মুনির্যস্য মতং ন ভিন্নং
(যার নিজস্ব মত নেই, যিনি শুধু পরের মুখে ঝাল খান
তিনি কখনও মুনি বা মনীষী হতে পারেন না।)

 

প্রাককথন

‘ঐতিহাসিক পরিবেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই যেকোনো মতাদর্শের উদ্ভব। ‘এই কথায় অতিসরলীকরণ থাকলেও বাস্তবতা নেহাত কমনয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে গড়ে ওঠে, ছোট কাগজের উদ্ভবও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বব্যাপী সামাজিক পরিকাঠামোরভিন্নতার দরুন দেশভেদে এর রূপগত বৈসাদৃশ্য থাকলেও চেতনাগত সাদৃশ্য বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠিত প্রচলের বিরোধিতা করা এর অবশ্যকর্তব্য। তবে অপ্রিয় হলেও এটা বাস্তব, ছোট কাগজ দীর্ঘায়ু হলে এতে কিছু প্রতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান হয়।

 

Absolute Power makes a Man (Institute) Maximum Corrupt

বাঘ কেন হরিণের মাংস পছন্দ করে? এতে বাঘের দোষ কিংবা হরিণের দায় কি? এটি প্রকৃতির নিয়ম। ক্ষমতার নিয়মও এমন যে, এটি কেন্দ্র-প্রান্তের সমন্বয়ে গঠিত। প্রান্তের ওপর কেন্দ্রের প্রভাব অনিবার্য। এমনকি ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সত্ত্বেও এটি সমভাবে সত্য। অবশ্য বৃহৎ অর্থেকেন্দ্রে এক প্রকার প্রান্ত বিদ্যমান অর্থাৎ অধিক ক্ষমতাবান এখনে কম ক্ষমতাবানকে শোষণ করে। অনুরূপভাবে প্রান্তেও এক ধরনের কেন্দ্রথাকে। ছোট কাগজ মূলত কেন্দ্র-প্রান্তের অধিকারে সমতা চায়, চায় বৈষম্যের বিলোপ। তাই কখনও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে ছোট কাগজ তারউপযোগিতা হারাবে।

 

প্রতিষ্ঠান কী? কেন?

ছোট কাগজ কী? কেন?

 স্বাভাবিকভাবে এটা ধরে নেওয়া হয় মানুষ সবচেয়ে মৌলিক একক প্রতিষ্ঠান। সে অভিযোজনের মাধ্যমে বিবর্তিত হচ্ছে। মানবিক এইবিকাশধারায় অভিযোজনের স্বার্থে যৌগিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ঘটে। ফলে প্রতিষ্ঠানিক চরিত্রের গুণাবলি বদলে যায়। তৈরি হয় এক নতুনবাস্তবতা। যেমন : মানুষ নিজেদের স্বার্থে   কিছু মৌলিক অধিকার মুলতবি রেখে রাষ্ট্র তৈরি করে। অর্থাৎ নিজেদের অধিকার রাষ্ট্রের কাছে জমারাখে। বিনিময়ে রাষ্ট্র তাদেরকে নিরাপত্তা (অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি) দেয়। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্র নিজেই নাগরিকেরনিবর্তনের উৎস হয়ে ওঠে। ব্যর্থ রাষ্ট্র নাগরিকের অশেষ দুর্ভোগের কারণ। একই কথা এর চেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানের (জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ইত্যাদি) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ছোট কাগজ নিজেকে মতাদর্শিকভাবে শুদ্ধতম প্রতিষ্ঠান দাবি করে অন্য সব আধিপত্যবাদী ও ত্রুটিযুক্ত মতের বিরোধিতা করে। তাদেরকে বলে তুলনামূলক শুদ্ধ নির্ভুল ও ন্যায্য হতে।

 

ছোট কাগজ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা

প্রচলিত মত হলো এই, ছোট কাগজ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করে। কিন্তু এই বিরোধিতার স্বরূপ কী? যদি এর অর্থ হয় ‘অস্বীকার’,তাহলে মানবজাতির হাজার বছরের পথচলাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রয়োজন থেকেই সৃজনের শুরু। যৌক্তিক প্রয়োজনকে অস্বীকার করাস্বাভাবিকতা নয়। অবশ্য বিরেধিতার মানে যদি হয় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের অন্যায্যতা, আধিপত্যকামিতাসহ সমূহ দোষের বিরোধিতা, তাহলেবলতেই হয়—জয়তু ছোট কাগজ! ছোট কাগজ দীর্ঘজীবী হোক!

 

ছোট কাগজ এবং গোষ্ঠীবদ্ধতা

ব্যক্তি > পরিবার > সমাজ > রাষ্ট্র > জাতিসংঘ—এটাই বর্তমান বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিকতার সর্বোচ্চ ক্রমবিকাশ। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কল্পিতশুদ্ধতম প্রতিষ্ঠান ছোট কাগজের সম্পর্ক কেমন? গঠনমূলক সমালোচনা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে এদেরকে ক্রমাম্বয়ে সঠিক-শুদ্ধ পথে চলতে অনুপ্রাণিত করা। তাই বলা যায়, ছোট কাগজের জন্য গোষ্ঠীবদ্ধতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অপরিহার্য নয়। কেননা তা নমনীয়তা ও উদারতাকে সীমাবদ্ধ করে। ছোট কাগজের জন্য যা কাম্য নয়।

 

Value and Price

Nowadays people know the price of everything and the value of nothing

আজকের জামানায় লোকজন পণ্যের অর্থনৈতিক মূল্য (price) সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল কিন্তু অন্তর্নিহিত মূল্য সম্পর্কে নয়। উপর্যুক্ত বাস্তবতায় লিটল ম্যাগ সম্পাদক যদি price-কে আমলে না নিয়ে value’র ওপর গু্রুত্ব দেন তাহলে এর পরিণাম কী? পুঁজির (Capital) সাথেঅহংয়ের (Ego) অনিবার্য সংঘাত। এই সংঘাতে আজ পর্যন্ত কতজন জয়ী হয়েছে?  উত্তর সকলেরই জানা। তবুও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যাক—

মনে হল এ পাখার বাণী

দিল আনি

শুধু পলকের তরে

পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে

বেগের আবেগ।

………………………

………………………

ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে–

হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।

 

এবং আলাদা শ্রেণিতত্ত্ব

মানবীয় জ্ঞানের দৌড় এই পর্যন্ত : কোনো কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে মালিকপক্ষ সকল শ্রমিকের সঙ্গে একত্রে কিংবা আলাদাআলাদা কার্যকর সংলাপ করতে পারে না। যদি করে তবু একটি সার্থক নিষ্পত্তিমূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না। কেননা ঘটনা ও দাবি সম্পর্কেএকেকজনের মত একেকরকম, যা স্পষ্টত সার্থক  নিষ্পত্তিমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিকূল। এরকম অবস্থায় শ্রমিক নেতা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াশয় নিয়েমালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, যা সকলেই মেনে নেয়।  কিন্তু নিয়তির পরিহাস, যখন একজন শ্রমিক সকল শ্রমিকেরপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় তখন একটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। একজন শ্রমিকনেতা পুরোপুরি শ্রমিক কিংবা মালিকের প্রতিনিধিত্ব করে না। সে এই দুই বিপরীত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণির মাঝে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করে। এতে সে অর্থনৈতিকভাবে না হলেও ব্যক্তিহিসেবে সামাজিকভাবেলাভবান হয়। এর সঙ্গে একজন ছোট কাগজ সম্পাদকের মিল লক্ষণীয় নয় কি? সাধে রবীন্দ্রনাথ কহেন—

বসুমতী, কেন তুমি এতই কৃপণা,

কত খোঁড়াখুঁড়ি করি’ পাই শস্যকণা।

বিনা চাষে শস্য দিলে কিবা তাতে ক্ষতি?

শুনিয়া ঈষৎ হাসি কহে বসুমতী,

আমার গৌরব তাহে সামান্যই বাড়ে,

তোমার গৌরব তাহে একেবারে ছাড়ে।

 

জ্ঞানতাত্ত্বিক প্যারাডাইম

ইউরোপীয় চিন্তাবিদদের ‘মানব’দেরকে একটু দেখুন! হেগেল এক ধরনের দাসের কথা চিন্তা করেছেন, যারা বিপ্লব-পূর্ব কালে কোনো সমাজ-রাষ্ট্রেবসবাস করে শাসক দ্বারা শোষিত হয়। তাদের মনোকাঠামো কিরূপ হবে? এরা নিশ্চিতভাবেই শোষিত হতে চাইবে না। কিন্তু সময়টা তো বিপ্লবপূর্বের! তাহলে তারা শ্রেণি উত্তরণ ঘটিয়ে নিজেরাই শোষক হতে চাইবে। এবার বুঝুন ঠেলা! বিপ্লবের পূর্বের এই হেগেলের দাস যদি একজনছোট কাগজ সম্পাদক নিদেনপক্ষে ছোট কাগজ কর্মী হন, তাহলে? অবশ্য বিপ্লব-উত্তরকালে জন্মানো ফানো’র মানব হলে ভিন্ন কথা। (স্মর্তব্য যে, বিপ্লব সংঘটিত হলেই সকল বৈষম্য নিমিষে উধাও হয়ে যায় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় চীনে বিপ্লবের এত বছর পরে রাষ্ট্রের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন বৈষম্য ৫:১) । মরার উপর খাঁড়ার ঘা হবে যদি একজন ছোট কাগজ সম্পাদক বা কর্মী ফুকো মানব হয়। সে ভাষা সৃষ্টসম্মোহন দিয়ে নিজেকে ক্ষমতাকাঠামোর উচ্চতর স্থানে স্থাপন করতে সচেষ্ট হবে।

 

Not Goespel Truth

কোনো অপরিবর্তনশীল সত্য নয়, পরিবর্তনই জীবনের নিয়ম। কিন্তু আপাত অপরিবর্তনশীল কোনোকিছু পরিবর্তনের মাঝে ক্রিয়াশীল নাথাকলে কি পরিবর্তন হয়? পরিবর্তনই পরিবর্তিত হয়? পরিবর্তন পরিবর্তিত হওয়ার আদৌ কোনো অর্থ আছে! পরিবর্তনশীল এই জগতে যদিকোনোকিছু অপরিবর্তিত থেকে পরিবর্তনকে বাঙময় করে তোলে, তবে তা হচ্ছে ‘ছোট কাগজ’।

গোলাপের যেমন ‘গোলাপত্ব’ ধারণা—যতই পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন করা হোক গোলাপ হতে হলে  অবশ্যই ‘গোলাপত্ব’ থাকতে হবে।তেমনি এই পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে ‘ছোট কাগজ’ সকল প্রকার ধারণাগত কিংবা বাস্তব প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনকে বৈধতা দান করে।

তবুও বলতে হয়, স্থিরতাই মরণ, গতিশীলতা জীবন। বার্গোসের অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—

শব্দময়ী অপ্সরা রমণী

গেল চলি স্তব্ধতার তপোভঙ্গ করি

দিল আনি পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে

বেগের আবেগ।

 

All the Bachelors are Unmarried

সব ব্যাচেলরই অবিবাহিত। এ কথা চিরসত্য হলেও তা আমাদের নতুন জ্ঞান দেয় কি? কারণ— ‘ব্যাচেলর’ শব্দটির ভেতর ‘অবিবাহিত’ শব্দটিলুকিয়ে থাকে। এটি যুক্তির সত্য। বাস্তবের সত্য কি-না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাপেক্ষ বলা সম্ভব। একজন বিবাহিত লোক দেশান্তরী হয়ে বলতেপারেন তিনি ব্যাচেলর। অভিজ্ঞতার আলোকে তার দাবির সত্যতা নিরূপণ করতে হবে।

তদ্রুপ কেউ নিজেকে ছোট কাগজ কর্মী কিংবা কোনো কাগজ নিজেকে ছোট কাগজ দাবি করলেই সে ‘ছোট কাগজত্ব’ অর্জন করে ফেলে না।‘ছোট কাগজত্ব’ আছে কি-না সেই সিদ্ধান্ত অভিজ্ঞতার আলোকে নিতে হবে।

একজন সৃষ্টিশীল ‘আমি’ ‘ছোট কাগজত্বের’ মুখ্যগুণ। পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ লকের মতে বস্তুর (matter) গুণ দুটি—মুখ্যগুণ ও গৌণগুণ।মুখ্যগুণ স্থান (Space) দখল করা। রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ প্রভৃতির সমন্বয়ে মানব মনে সুখ, দুঃখ ইত্যাদির উৎপাদন সক্ষমতা হচ্ছে গৌণগুণ ।তদ্রুপ ছোট কাগজের মুখ্যগুণ একজন সৃষ্টিশীল ‘আমি’। গৌণগুণ হলো অন্য সকল শর্ত ও বাস্তবতা। তাহলে এই সৃষ্টিশীল ‘আমি’টা ঠিককী?

‘আমি’ মূলত একটি সাধারণীকৃত শব্দ। এই ‘আমি’  হতে পারে দেকার্তের ‘আমি’ (I think thererfor I am), লকের ‘আমি’ (Bundle of Memories) অথবা বৌদ্ধ পণ্ডিত নাগসেনের ‘আমি’ (বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বা অংশের সমন্বিত রূপ)। এই ‘আমি’ যে-ই হোক না কেন, সে তারসৃষ্টিকে শুধু নিজস্ব অহং (Ego) দ্বারা সত্যায়িত করতে চায়। দেখতে চায় নিজস্ব ‘ইচ্ছা সমাজে’ এর বিকাশ। স্পষ্টতই এই ‘আমি’ তারসৃষ্টিকর্মকে নিজের  ঈপ্সিত ‘ইচ্ছার সমাজ’ ভিন্ন অন্য কোথাও বিকশিত হতে দিতে চায় না। Power Structure-এর সহগামী দৈনিক বা সাহিত্য কাগজের কাজ ‘ফুকো মানব’ তৈরির করা। যারা ভাষা-সম্মোহনের মাধ্যমে নিজের প্রতিষ্ঠার বিনিময়ে প্রচলিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্যকে বৈধতা দেয়। স্পষ্টতই এটি তার পছন্দের ‘ইচ্ছা সমাজ’-এর বিপরীত। এই ‘আমি’ বাণিজ্যের পণ্য হিসেবে নিজেকে দেখতেচায় না। কেউ তার যাত্রাপথ বৃত্ত এঁকে সীমাবদ্ধ করে দিক এটা তার না-পছন্দ।

এরই অনিবার্য ফল নবীনদের ‘চিন্তার বিদ্রোহ’, ছোট কাগজের আবির্ভাব। লিটল ম্যাগের লেখক, সম্পাদক, প্রকাশকের অবশিষ্ট জীবনসংগ্রামযেন তারা ‘হাইডেগারের দাস’-এ পরিণত না হন (উল্লেখ্য, হাইডেগারের দাস তার ‘মৌলিক স্বাধীন সত্তাকে’ ‘সমগ্র সত্তায়’ হারিয়ে ফেলে। ফলে‘সমগ্র সত্তার’ সত্য-মিথ্যা হয়ে ওঠে তার নিজের সত্য-মিথ্যা)। অবশ্য পরিণত বয়সে অতিব্যতিক্রমবাদে এদের সকলেই ‘আত্মবিক্রয় না করেকোনো লেখক যদি তার সৃষ্টিকে যথার্থ প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপন-সক্ষম হন তাহলে তা তেমন দূষণীয় নয়’, এই ধরনের মত পোষণ করেন!

 

বাংলাদেশে ছোট কাগজ আন্দোলন/নামভেদ না বস্তুভেদ

(নাম বদলালেই বস্তু বদলায় না)

বাংলাদেশে আকার আকৃতিতে ছোট প্রচুর কাগজ পাওয়া যায় । এগুলোর অধিকাংশই প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন নয়। কারণ—সেখানে‘সৃষ্টিশীল আমি’র কোনো নির্দিষ্ট ‘ইচ্ছা সমাজ’ পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় কিছু সুযোগসন্ধানী, ধূর্ত ও অযোগ্য ‘আমিত্বে’র সন্ধান।অ্যাকাডেমিক লেখাপড়ায় ব্যর্থ হয়ে কয়েকজন ‘ভ্যাগাবন্ড’ মিলে ছোট আকার আকৃতির কাগজ করলেই তা লিটল ম্যাগ নয়। তারা মুখে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা যতই বলুক। বাস্তবে দেখা যাবে ‘প্রতিষ্ঠান’ কাকে বলে এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু আছে এর বিরোধের দাবি! এদের প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করে কীভাবে ‘ফুকোমানব’ হওয়া যায়! অবশ্য ফুকোমানব হতে চাইলে তোন্যূনতম পঠন-পাঠন ও যোগ্যতা প্রয়োজন। সেটাও যদি এদের থাকতো! আবার ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় কোনো গোষ্ঠী-পত্রিকা নিজেদেরকে‘ছোট কাগজ’ দাবি করছে। অথচ ‘ছোট কাগজ’ হতে হলে যতটুকু লিবার্টি, ফ্লেক্সিবিলিটি থাকা দরকার তা তাদের গোষ্ঠী-ইস্তেহারে নেই।অনেকটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো অবস্থা! অনেকে ‘আধিপত্যবাদী’ আচরণের মাধ্যমে নিজেদেরকে ছোট কাগজ কর্মী দাবি করে; বলে, তাদের কাগজ লিটল ম্যাগ। কিন্তু একজন ‘সৃষ্টিশীল আমি’-কে অসহযোগিতা করা কোন ধরনের ছোট কাগজ কর্মীর কাজ?

 

যে ভজন্তি মাং ভক্ত্যা/ময়ি তে তেষু চাপ্যহম

(আমার প্রতি যাদের অনুরাগ আমি তাদের ভেতর রয়েছি এবং তারাও আমার ভেতর রয়েছে)

 গীতায় এই উক্তি যে প্রসঙ্গেই আসুক না কেন এই বঙ্গদেশের ছোট কাগজ চর্চায় এটি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। যে ‘সৃষ্টিশীল আমি’ ছোটকাগজের প্রাণ তার ‘ইচ্ছা সমাজ’-এর সঙ্গে সহমত পোষণ করলে নতুন ছোট কাগজের আবির্ভাব অনাবশ্যক। কেবল সমমাত্রা ও সমধর্মী‘সৃষ্টিশীল আমি’র পরস্পরের ‘ইচ্ছা সমাজ’-এর সঙ্গে অপরিচয় হতে পারে নতুন ছোট কাগজের আবির্ভাবের কারণ। কিন্তু বাংলাদেশে কি এইবাস্তবতা বিদ্যমান? না-কি ছোট কাগজ কর্মী নামধারী ধূর্তরা একেকজন ‘ফুকোমানব’? নিজেকে ভাষা-সম্মোহনের মাধ্যমে সমাজ কাঠামোর উঁচু স্তরে স্থাপনই এদের অভিলাষ। একটু ভেবে দেখবেন…

 

ইতো ভ্রষ্টস্ততোনষ্টঃ

(দুকূল হারানো)

বঙ্গদেশে ছোট কাগজ চর্চায় এটিও একটি উল্লেখযোগ্য দিক। কিছুদিন ছোট কাগজ চর্চার পর হঠাৎ করেই ‘হাইডেগারের দাস’-এ পরিণত হওয়া! এ যেন অলঙ্ঘনীয় নিয়তি। ছোট কাগজ বলে চিৎকার করতে করতে এক সময় দৈনিকে যোগদান। তারপর অজুহাত, আমাকে তো জৈবিক ও পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে হবে! আমি তো আর সাহিত্যপাতায় কাজ করিনি, তাই না? তত্ত্বগতভাবে, দৈনিকে কাজ করে লিটল ম্যাগাজিনচর্চার সুযোগ কেন থাকবে না? আমি মনে করি আছে? এত কট্টর হাওয়ার মানে হয়? ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তরে বলতে হয়, জনাব কিঞ্চিত কষ্টকরে ফুকোমানব কাকে বলে উহা কত প্রকার ও কী কী ফুকো মানব কিভাবে তৈরি হয় ইত্যাদি জেনে নিন। কেন বাছাধন দৈনিক বাদে প্রচলিতpower structure-এর তুলনামূলক অধিক জনবান্ধব কোথাও কাজ করে জীবিকা নির্বাহের কসরৎ করলেই তো হতো। সত্যি করে বললে এর জন্য যে যোগ্যতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য ও সততার প্রয়োজন তা তাদের কতজনের থাকে?

 

মধ্বভাবে গুড়ং দদ্যাৎ

(মধু যদি দুর্লভ হয় তাহলে গুড়ের দ্বারাই তার কাজ সেরে নেয়া উচিত)

আমি এই সম্পর্কে কিছু না বললেও আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কী বলতে চাই। এই বিষয়ে আমি কিছু না বলে বরং আপনাদেররবিবাবুর একটি কবিতা শোনাই—

জীবনের যত পূজা হলো না সারা

জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।

যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে,

যে নদী মরুপথে হারালো ধারা,

জানি হে, জানি তা-ও হয়নি হারা।

 

যবনিকা

জগত দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় বিকশিত হয়। অর্থাৎ দ্বন্দ্ব বিকাশের পূর্বশর্ত। তাই সাহিত্যিক প্রেক্ষাপটে মতভিন্নতাকে মনোভিন্নতার কারণ বিবেচনা করা অনুচিত। সম্পন্ন মানুষ যুগে যুগে ভিন্ন মতকে আমলে নিয়ে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির চর্চা করেছেন। বঙ্গদেশের বাস্তবতা যেমনই হোক ছোট কাগজ মূলত একটি  সামগ্রিক ব্যাপার; যা বিকল্প-মাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব করে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় মূলধারার সঙ্গে এর সম্পর্ক অহি-নকুল। প্রকৃত প্রস্তাবে এই দ্বন্দ্ব বিকাশকে ত্বরান্বিত করছে। তাই একে স্বাগত না জানানোর কোনো কারণ নেই। এই দ্বন্দ্ব-বিকাশ আলোচনার পরিসমাপ্তিতে পালি ভাষার শ্লোকটির স্মরণ অপ্রাসঙ্গিক হবে না—

সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু / সকল সত্তা সুখী হোক

সব্বে সত্তা আভেরা হোন্তু / সকল সত্তা শত্রুতা থেকে মুক্ত হোক

সব্বে সত্তা অব্বপজ্জা হোন্তু / সকল সত্তা শোষণ থেকে মুক্ত হোক

সব্বে সত্তা আনিঘা হোন্তু / সকল সত্তা বিপদ থেকে মুক্ত হোক

সব্বে সত্তা সুখী আত্তান পরিহরন্তু / সকল সত্তা সৌখীন বিলাসিতা পরিত্যাগ করুক

 

Ahmed Lipu is an author. The topic of interest in Philosophy. Published Books: Byaktikotay Nyorbyaktik(2011), Darshan(2017), Byakto : Bibidho Phenomena’r Darshonik Parzalochona(2018), Yugolsandhi : Muldhara-Bikalpodhara(2019)

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!