তরুণী ও একটি বেড়াল
দীর্ঘ সময়, বলা চলে আজ তিন দিন ধরে আমি ওকে পর্যবেক্ষণ করছি। আমার পর্যবেক্ষণকে পাত্তা না দিয়ে সে দুদিন আমার চোখের সামনে নিজের মতো করে নিথর পড়ে থেকে শোক প্রকাশ করল। যেন আমাকে শেখানো, কী করে শোক করতে হয়, মাতম করতে হয়। তৃতীয় দিন আমি কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেলে পরে ফিরে এসে যখন বারান্দায় দাঁড়ালাম, ওকে কোথাও দেখতে পেলাম না। তবে কি ওর শোক-সময় অতিক্রান্ত! ওর শূন্য ঘরটি কেমন হা-হা রবে হাহাকার করছে। ওকে না দেখে আমার কিছুটা মন খারাপই হয়। আবার মনে মনে এ-ও ভাবি, বাড়াবাড়ি রকমের ন্যাকামোটা শেষ পর্যন্ত বন্ধ হলো তাহলে! ওর এই দীর্ঘ আর নিরবচ্ছিন্ন শোকযাপন আমাকে কিছুটা হলেও ক্লান্ত আর বিভ্রান্ত করে তুলেছিল; আমি নিজের মাঝে অনুতাপের আঁচ অনুভব করছিলাম আর বিড়বিড় করছিলাম, এত ন্যাকামোর কী আছে! এত দরদ কেন তোর ভেতর! তুই একটা পশু ভিন্ন আর কিছু নস্।
ওর হাহা করা ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি তলপেটে চাপা ব্যথাটি আবার অনুভব করি। আমার ডান হাতের তালু পেটের ওপর রাখলে এক মুঠ শূন্যতা প্রতিটি আঙুলের ডগায় হিম ছড়িয়ে দেয়। আমার ভেতর,পুরো ভেতরটা সে হিমে, বরফের মতো হিমে জমে যায়। আমি হিমেল কুয়াশায় ডুবে যেতে যেতে একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির উষ্ণতার কথা ভাবি। ডাক্তার (নাকি ধাত্রী?) মহিলা বলেছিলেন, আর কোনো সমস্যা হবে না। তার কথা শুনে আমি আমার ছড়িয়ে রাখা রান দুটি একত্র করতে করতে তার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতায় মলিন হাসি। তিনি আমাকে সকল সমস্যা থেকে মুক্তি দিয়েছেন, এই হাসি তার প্রাপ্য। এখন পেটের ব্যথায় হাত রেখে ভাবি,তবে কি তিনি আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলেন? তিনি কি জানতেন, এই নাভিমূল ধরে টান-মারা ব্যথা থেকে,এই শূন্যতা থেকে, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিমছড়ানো ভীতি থেকে আমার কখনো নিস্তার মিলবে না!
আমি ভাবতে চাই না, ভাবনাটিকে আমি এড়িয়ে যেতে চাই। ভাবতে চাই সমস্যাটি অন্য কারও ছিল কিংবা এটি আঙুল কেটে যাবার মতোই একটি ক্ষুদ্র দুর্ঘটনা ছিল। আজকাল অহরহ এরকম দুর্ঘটনার মাঝে পড়ছে অনেকে। তারা তা থেকে সহজে উদ্ধারও পাচ্ছে। এ নিয়ে এত দীর্ঘ ভাবনা বোকা মানুষদেরই শুধু মানায়। আমি একটি অকাট মূর্খ। তা না হলে কনসিভ, গর্ভধারণ করবার মতো ভুলও যে বর্তমান যুগে কেউ করতে পারে, তা কেন আমাকে অন্য কেউ ব্যঙ্গোক্তি করে বলবে! আবার কনসিভ করবার পর উটকো ঝামেলাটিকে নীরবে-নিঃশব্দে মিটিয়ে না ফেলে আহাম্মকের মতো তাকে জন্ম দেবার জন্য অবাস্তব স্বপ্ন দেখতে শুরু করি! এখন আমার নিজের ওপর নিজের রি-রি করা এ রাগ, নিজের বোকামির জন্য নিজের পাছায় কষে লাথি ঝাড়তে ইচ্ছে হয়। আমি তা করি না, তা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি যেমন নিজের পাছায় লাথি মারতে পারি না, তেমনি পারি না অনেক সমস্যার পাছায় লাথি ঝেড়ে চোখ বুজে আকাশ দেখতে! মাঝেমধ্যেই অফিসে গেলে বসকে দেখলেই এই ইচ্ছেটি করে। যখন দেখি, মিটিংয়ের নামে বস অফিসের সব কটি ললনাকে কনফারেন্স টেবিলে বসিয়ে সর্বভুক দৃষ্টিতে প্রত্যেকের বুকের ওপর আছাড়-বিছাড় খায়। বসের এমনই চোখের পাওয়ার, মাঝেমধ্যে তো মনে হয়, আমি কি ভুল করে জামা না পরেই অফিসে চলে এসেছি নাকি!
আমি দেখি ও, মিনি (আমি ওর নাম ভেবে নিই মিনি, এতে আমাদের দুজনের কথাবার্তা বলতে কিছু সুবিধা হবে।) ফিরে আসছে; সুপার মডেলের মতো স্মার্টলি পাছা দুলিয়ে দুলিয়ে ক্যাটওয়াক করে, শিলার মতো কঠোর মুখ-ভঙ্গিমায় সে আমার দৃষ্টিসীমায় এসে দাঁড়ায়। আমার দিকে কটাক্ষের দৃষ্টিতে তাকায়। আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ ওর সারা মুখে শোক খোঁজে, ওর দেহ-ভঙ্গিমায় সন্তাপ খুঁজে ফেরে। মনে হয়, ও বুঝি নিজেকে সামলে নিয়েছে। বাহ্! তুই তো আমার মতো হৃদয়হীন রে! কয় দিন আর শোক করা যায়, বল? না হয় ভুল করে গর্ভধারণ করেছি, তাই বলে সে অনাকাক্সিক্ষত রক্তের ঢেলাটির জন্য আমাদের মন এমন হু-হু করবেÑ এ কেমন কথা! মহীয়সী গঙ্গাও তো তাঁর সাত গর্ভ জলে বিসর্জন দিয়েছিলেন। আমরা তো কোন ছাড়! তোর ব্যথা অবশ্য আমার চেয়ে সামান্য বেশি। তুই তো তোর সন্তানদের জন্ম দিয়েছিলি। বাচ্চাদের মুখ দেখেছিস। কেমন ছিল সেসব মুখ? খুব নরম, তুলতুলে আর মায়াবী! আবির মাখানো নরম আঙুলের ডগা আর লাল আর ভেজা স্যাঁতসেঁতে একজোড়া ঠোঁট! বোজা চোখের পাতায় কি ওদের কোনো স্বপ্ন ছিল? সব বাচ্চার মুখই কি খুব মায়াবী আর আদরজাগানিয়া হয় রে,মিনি?
মিনি আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, পলকহীন দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে। কী বলতে চায় ও? আমি তোমার মতো হৃদয়হীন নই, এই তো! আমি স্বেচ্ছায় আমার সন্তানদের খুন করিনি, তোমার মতো। আমি তাদের জন্ম দিয়েছিলাম কিন্তু রক্ষা করতে পারিনি। আমার অসহায়ত্বের সুযোগে, আমার দুর্বলতার কারণে এক দঙ্গল কাক,খুনি তস্করের মতো; যেমনি করে তোমরা অসহায় বিশ্বজিৎকে অমানবিক নৃশংসতায় কুপিয়ে-খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করেছিলে, তেমনি করে আমার ছানাদেরও আমারই সামনে খুঁটে-খামচে রক্তাক্ত করেছে; টুকরো টুকরো করেছে, বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছে ওদের নরম আর ভেজা ছোট পশম, ওদের দৃষ্টিতে আলো প্রতিফলিত হবার আগেই ওরা অন্যদের খাবারে পরিণত হয়েছিল। আর তুমি পৃথিবীর বুদ্ধিমতী মানবী কতটা নিষ্ঠুর হতে পারলে এক অনাগত প্রাণের সাথে! রক্তের কণা একটি ঢেলায় পরিণত হতে না হতে খুঁচিয়ে তাকে খÐ খÐ করলে, ফেলে দিলে তাবৎ আবর্জনার সঙ্গে ড্রেনের কালো পানির ধারায়। তোমার কি একবারও মনে হয়নি, এটা কোনো বর্জ্য নয়, এ আমার সন্তান!
আমরা দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুজনেই অব্যক্ত এক কথোপকথনের মাঝে নিঃশব্দে মেতে উঠি, দুজনেই পড়ে নিচ্ছি দুজনের রক্তাক্ত ভেতর।
সন্তান! সন্তান শব্দটি অনেক গভীর আর ভারী এক দায়। এই দায় বইবার যোগ্যতা সকলের হয় না। ড্রেনের কালো পানির ধারার সঙ্গে যে বর্জ্য মিশে গেছে, তা শুধু শরীরের কিছু অপ্রয়োজনীয় রক্ত, আর কিছু নয়; আমার সন্তান নয়। ওই অবাঞ্ছিত রক্তের টিউমার আমার সন্তান হতে যাবে কেন? আমি তো তাকে চাইনি, কেউ তাকে চায়নি; আমরা, এই পৃথিবীর কেউই তাকে চাইনি। সে এসেছিল অনাহূত অতিথি হয়ে, তাই ওর আগমনবার্তা আমাকে ফেলে দিয়েছিল বিশাল অনিশ্চয়তার মাঝে। যখন প্রথম জানতে পারি সে আমার শরীরে ভর করেছে, তখন আমার মন এক বিজাতীয় অনুভূতিতে ভরে যায়। আমি কয়েক দিন অপেক্ষা করলাম তার উপস্থিতি নিশ্চিত হবার জন্য, আর এই অপেক্ষার ভেতর কখন যেন চুপিসারে সে আমাকে কিছুটা প্রলুব্ধ করে তোলে। আমিও ভাবতে লাগলাম, আসুক না সে। যখন তার উপস্থিতির কথা আমার পার্টনারকে জানালাম, সে বেশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকাল, পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোমার আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল।
আমি তার বিরক্ত মুখমÐলের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি ওকে রাখতে চাই। আমার কথায় সে ভয়ানক রকম চমকে ওঠে। আমার দিকে কিছু সময় নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে ও নিজেকে পুনরায় গুছিয়ে নেয়। ব্যাপারটা সে ভালোই পারে সব সময়, আমি কিন্তু কোনো দায়দায়িত্ব নিতে পারব না, জানোই তো সবই।
হ্যাঁ, জানি বইকি। ওর একটি গুছানো সংসার আছে, পেশাগত পরিচয় আছে; ভদ্রলোকের খ্যাতি আছে। সেখানে এমন সন্তানের দায়দায়িত্ব নেওয়া যায় না। আমার নীরবতায় সে নিজের কণ্ঠে আরও খানিক সহমর্মিতা আর দরদ মিশিয়ে নিয়ে বলে, আমি তোমার অনুভূতি বুঝি। আমাকে আরও কিছু দিন সময় দাও, সবকিছু ঠিক হলে পরে বাচ্চাকাচ্চা নেওয়া যাবে।
আমি ওর মুখের দিকে তাকাই, কবে সবকিছু ঠিক হবে? ছয় বছরের সম্পর্কেও যা ঠিক হয়নি, আর কত দিন পর সে সম্পর্ক ঠিক হবে? সে কি আমার জন্য তার রেজিস্ট্রি করা স্ত্রীকে ছেড়ে দেবে? তারপর আমার সঙ্গে সবার সামনে সংসার পাতবে আর বছর বছর আমাকে দিয়ে বাচ্চা ফুটাবে! হাহ্! আমার ভেতর বিজাতীয় অনুভূতি আবারও তোলপাড় তোলে। ছুটে যাই বাথরুমে। বেসিন ভাসিয়ে হড়হড় করে বমি করি। যখন ধাতস্থ হই, আয়নায় তাকিয়ে দেখি, রক্তরাঙা চোখ নিয়ে কে ও দাঁড়িয়ে! আমার দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে ধিক্কার নিয়ে সে কেবল বলে, ছি!
সে ধিক্কার শুনে আমি আবার বাথরুম থেকে পালিয়ে আসি। সে আমার দিকে করুণার চোখে তাকায়। আমার হাতে এক গোছা টিস্যু পেপার তুলে দিতে দিতে গলায় আবারও মধু ঢেলে বলে, দেখেছ, এ কয় দিনে তোমার কী অবস্থা হয়েছে? মা হওয়া অত সহজ নয়। তার চেয়ে যেমন আছ তেমনি থাকো না।
সত্যি তো, মা হওয়া অত সহজ নয়, আমি তা জানি। আমি তাকে চটিয়ে দিয়ে মা হতে গেলে এই মুহূর্ত থেকে আমাকে অনেকগুলো বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। আমাদের মফস্বলের টিনের বাড়িতে যে মানুষগুলো বাস করে, তারা সবাই আমার ওপর নির্ভর করতে শিখে গেছে। বাবার সামান্য বেতনের চাকরির টাকায় মা দীর্ঘ পঁচিশ বছর সংসার চালাতে অভ্যস্ত ছিলেন। এখন আর তা পারেন না। মাকে মাসের প্রথম দিক থেকে তাকিয়ে থাকতে হয় আমার পাঠানো টাকার দিকে। ছোট ভাইবোনদের স্কুল-কলেজের, কোচিংয়ের ফি, বিলাসিতার উপকরণের জন্যও আমি ছাড়া গতি কী! বাবা আমার সামনে দাঁড়ালে মূক, বধির, ঘাড় নোয়ানো এক মানুষ। ঠিকঠাক চোখ তুলে আমার দিকে তাকান না, যেন তার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেবার জন্য আমার ওপর তার যাবতীয় ক্ষুব্ধতা; যা ওই মূকতার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করে। বাবার সামনে আমি বরাবরই পলায়নপর, চোখ তুলে তাকাতে পারি না তার ভাঙাচোরা মুখটির দিকে। বাবা কি বোঝেন না, মফস্বল শহর থেকে মাস্টার্স করা একটি অসহায় মেয়ে ঢাকা শহরে কী এমন উজির-নাজির মারা চাকরি করতে পারে! জানেন, সবই জানেন; সবাই জানেন। বাবা জানেন, মা জানেন; ভাইবোন সবাই জানে, শুধু না জানার ভাণ করে যায়। যেমন আমি জানি, আমাকে সে কখনো বিয়ে করবে না। তার পরও মাঝেমধ্যে বিয়ের কথা তুলে নিজের ভেতর মরে যাওয়া একটি স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার নিষ্ফল চেষ্টা চালিয়ে যাই হয়তো।
এটি তো সত্যি, যদি সে আমাকে সাপোর্ট না করত, এই অরাজকতার নামীদামি ঢাকা শহরে আমি নিজে কয় দিন টিকতে পারতাম! সে যদি আমার দখল না নিত, তাহলেও হয়তো আমি আর কারও না কারও দখলে চলে যেতাম। তার চেয়ে বরং এই ভালো, এই লোক ভদ্র, মার্জিত; আমাকে ভালোবাসেন। কখনো-সখনো আমার ব্যথা তার বুকে ব্যথার অনুরণন তোলেÑ এটাই বা মন্দ কিসে! তার সঙ্গে আছি বলেই তো এই শহরের নামীদামি বুটিক শপ থেকে নজরকাড়া শাড়িটি কি থ্রিপিচে নিজেকে আবৃত করতে পারি। অনেকগুলো হট ড্রিংকসের স্বাদ প্রতিনিয়ত আমার জিব স্পর্শ করে তার বদান্যতায়। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে তার অশেষ কৃপায়, আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। এই কৃতজ্ঞতার কাছে একটি সন্তানপ্রাপ্তির আবদার কোনো দাবিই হতে পারে না।
একসময় সে চলে যায় অন্য অনেক দিনের মতো। যাবার আগে আদর করে বলে যায়, সকালে ক্রেডিট কার্ডটি নিয়ে বের হবে। আমি তোমার অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্স দিয়ে দেব। প্রয়োজন মতো উঠিয়ে নিয়ে তবে ডাক্তারের কাছে যাবে। নিজের সামান্য অযতœ যেন না হয়।
ও আরও অনেক কিছু বলে, তারপর একসময় সে চলে যায়: তার নিজের গৃহে, সংসারে; পরিবারের কাছে। নিজের পরিচয়ের কাছে, নিজের খ্যাতির জগতে। হায়েনার মতো ধারালো দাঁত নিয়ে রাত আসে আমার ছোট্ট ঘরে। আমি রাতভর জেগে থাকি; আমার সঙ্গে জাগে একটি রক্তপিÐ! আমাকে সারা রাত প্রলুব্ধ করে সে। ছোট ছোট নরম লালচে হাতের আঙুল নেড়ে সম্মোহিত করে তোলে সে আমাকে। একজোড়া লালায় ভেজা তুলতুলে ঠোঁট কী যে বলে! সেসব কথায় নিজেকে কাঙাল, আরও কাঙাল মনে হয় কেবল। একলা ঘরে শুয়ে আমার নিঃশ্বাস আটকে আসে। আমি বিছানায় দলা-মোচড়া হয়ে শুয়ে সারা রাত নিজের দুঃখে কাঁদি নাকি ওই রক্তপিÐের কারণে কাঁদি, জানি না!
সকালে নিজেকে পুরোদস্তুর গুছিয়ে নিয়ে আমি যখন ক্রেডিট কার্ডসমেত বেরোব, তখন আমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের গাড়িবারান্দায় ছাদে মিনিকে শুয়ে থাকতে দেখি। ওর ছোট্ট কাঠের বাক্সের বাড়ির বাইরে তিনটি সদ্য ভূমিষ্ঠ ছানা নিয়ে কী সুন্দর শুয়ে আছে। দেখে এত ভালো লাগে, আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তা দেখি। স্থির দৃষ্টিতে দেখি। দেখে দেখে আশ মেটে না, তার পরও দেখি। সেল ফোনের হইচইয়ে আমার সংবিৎ ফেরে। ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে ও বলে, এখনো বেরোওনি? গাড়ি নিয়ে মতিন অপেক্ষা করছে। ও তোমাকে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে। মনে করে টাকাটা তুলে নিয়ো।
আহারে, আমার জন্য ওর কী টেনশন! সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে নিপুণ দক্ষতায়। এখন আমার আর কোনো ভাবনা নেই। যাব আর সব সমস্যার সমাধান করে ফিরে আসব।
আমি রাতে একলা আর শীতল ঘরটিতে ফিরে আসি। এসে মিনির কোনো খোঁজ করবার ইচ্ছা আমার থাকে না। মনেও থাকে না মিনির কথা। নিজের বোধের ভেতর সারা রাত শেয়ালের ডাক শুনতে শুনতে ঘুমানোর চেষ্টা যখন করছিলাম, তখন নিস্তব্ধ-নীরব রাতে কোথা থেকে ভেসে আসে মিহি স্বরে কোনো একটি প্রাণীর ডাক। দূরের বিষণœ কোনো গীতের মতো সে ডাক আমাকে বিবশ করে তোলে।
রাতের আধেক ঘুম আধেক জাগরণ থেকে আমি যখন পুরোপুরি জেগে উঠি, আমি নিজের হাতের তালুটি রাখি নিজের পেটের ওপর। মেদ-চর্বিহীন টানটান ত্বক নিজের হাতের ছোঁয়াতে শিহরিত হয়ে ওঠে, এ যেন নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু! এ মধুর শিহরণ আমাকে আলোড়িত করে তোলে না। আমার দুচোখ উপচে নোনা জলের বান ধেয়ে আসে। আমি সে বান থামানোর চেষ্টা করি না। নামতে দিই, ঝরতে দিই। একসময় অনুভব করি নিজের ভেতর শ্রান্তি-ক্লান্তি। নিজের ভেতর হালকা। কাঁদতে কাঁদতে কিছুটা ধাতস্থ হলে আমার মিনির কথা মনে পড়ে। আমি মিনিকে দেখবার জন্য বারান্দায় ছুটে বেরিয়ে গিয়ে দেখি, বিমর্ষ মিনি; ওর চারপাশে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কিছু তুলা বা আবর্জনার মতো নাড়িভুঁড়ি ছড়ানো-ছিটানো। মিনির ছানারা নেই! মিনিকে ঘিরে এক দঙ্গল কাকের উল্লাসী ওড়াউড়ি! আমার ভেতরটা খাঁখাঁ করে ওঠে, আহারে!
তার পর থেকে আমার আর মিনির যৌথ শোকযাপন। আমি বারান্দায় আর মিনি গ্যারাজের ছাদে, দুজনেই মৌন আর ধ্যানী। প্রথমবার আমার মনে হতে থাকে, আমি একা নই, আমার সঙ্গে দুঃখ ভাগাভাগি করে নেবার জন্য কেউ একজন রয়েছে। পরপর তিন দিন শোকযাপনের পর দুজনেই ক্লান্ত হয়ে সন্তানশোক বিস্মৃত হতে চাই যেন। পুনরায়, নিত্যদিনের মাঝে নিমজ্জিত হতে চাই। সেই নিমজ্জনের মাঝেও বারবারই বোধ হতে থাকেÑ আমি, মিনি, আমরা পশু ভিন্ন আর কিছু নই।
প্রশ্নোত্তর
শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?
শামীম রুনা: আমার দেখা চারপাশ, মানুষজন, অভিবাবকের বদলিসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় বসবাস; এসবই আমাকে হাত ধরে গল্পের লেখার জায়গায় নিয়ে এসেছে। মার্ক টোয়েনের হাকলবেরি ফিন, টমসহায়ার পড়ার পর মনে হয়েছিলো, আরে এসব তো আমারই গল্প, আমাদেরই গল্প। এভাবেই লেখার তাড়নাটা অনুভব করতে শুরু করি।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?
শামীম রুনা: আমার বেশিরভাগ গল্পই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত। আমার ছোটবেলার একটা সময় কেটেছে বান্দারবান শহরে। সেই সময়ের সেই ছোট শহরের নানান ঘটনাবলী আমার অনেক গল্প ও উপন্যাসে এসেছে। আমার এখনো চোখে ভাসে, গভীর জঙ্গল থেকে শান্তিবাহিনীর সদস্যদেরকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে ঝুলিয়ে নিয়ে আসা হতো। আমার লেখায় এই বিষয়গুলো স্বতস্ফুর্তভাবেই এসেছে।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।
শামীম রুনা: নানান আকারে, রূপে রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যে থাকে এবং থাকা উচিত। একজন সচেতন লেখক যখন নিতান্তই প্রেমের গল্পও লিখেন, সেখানেও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন দেখা যায়। এই মূহুর্তে আমার শাহীন আখতারের শিস্, আহমাদ মোস্তফা কামালের কেয়ারলেস হুইসপার এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিমের কথা মনে পড়ছে।
শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
শামীম রুনা: গল্পের নামটা ঠিক মনে পড়ছে না এখন। হাসান আজিজুল হকের ভাত নিয়ে একটা গল্প আমাকে একসময় প্রচন্ডভাবে আক্রান্ত করেছিলো। এই গল্প নিয়ে আমি বেশকিছুদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এই ঘোরটা খুব তীব্র ছিলো।
শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
শামীম রুনা: লেখার সময় আমি কাঠামো বা ভাষা নিয়ে ভাবি না। আমি চেষ্টা করি আমার ভেতরের গল্প, গল্পের চরিত্র এবং চরিত্রগুলোর মনস্তাত্বিক দ্বন্দের বিষয়গুলো ঠিকঠাকমতো তুলে আনতে। আমার শেষের দিকের গল্পগুলোতে একধরনের ভাষার নিজস্বতা তৈরি হচ্ছিল বলে আমার মনে হয়। এরপর তো সব ওলটপালট হয়ে গেলো।
শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?
শামীম রুনা: গল্পের বিষয়বস্তু তো অবশ্যই। সাথে বলার বা উপস্থাপনের ধরণ।
শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
শামীম রুনা: রাজনৈতিক বোধ, রাজনৈতিক সচেতনতা যে কোনো লেখকের জন্যই জরুরী। এটি ছাড়া লেখকের লেখক হয়ে উঠা হয়ে উঠে না। একজন সচেতন লেখকের শিল্পের মধ্যেও জীবন থাকে এবং জীবনের মধ্যেও শিল্প খুঁজে পাওয়া যায়।
শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন।
শামীম রুনা: প্রায় সাত বছর হয়ে গেলো তেমন কিছু লেখা হয়নি। চেষ্টা করছি সামলে উঠতে। তবে এখনো স্বপ্ন দেখি লিখবো বলে। লিখবো, অবশ্যই লিখবো।
More Posts From this Author:
- None Found