স্যালি পোটারের চিত্রনাট্য এবং পরিচালনায় ১৯৯২ সালে মুক্তি পায় বৃটিশ সিনেমা ওরলান্ডো। জনরে, হিস্টোরি, ফ্যান্টাসি ড্রামা। ওরলান্ডো সিনেমাটি ভার্জিনিয়া উলফের ওরলান্ডো অ্যা বায়োগ্রাফি উপন্যাসের উপর বেইজ করে বানানো হয়েছে। সিনেমা ওরলান্ডো নিয়ে আলোচনা করার আগে অনেকটা পিছিয়ে গিয়ে ভার্জিনিয়া উলফের অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস ওরলান্ডো অ্যা বায়োগোাফি নিয়ে হাল্কা একটু কথা বলা যাক।
প্রায় চার শতাব্দী ধরে ঘটে যাওয়া (১৬০০ থেকে) ওরলান্ডোর বায়োগ্রাফি জার্নি শেষ হয় ১৯২৮ সালের ১১ই অক্টোবর, যে দিন ভার্জিানয়ার ওরলান্ডো উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেদিন। এই উপন্যাসে পাঠক একটি পরাবাস্তব চরিত্র পায়, যে চরিত্রটি শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থাকে কিন্তু বয়স বাড়ে না একদিনও। এটিকে মানুষের অস্তিত্বের এক দৃষ্টিভঙ্গি বলা চলে, তেমনি বলা যায়; প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, ভন্ডামী, মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে নান্দনিক হতে শেখানোর পন্থাও। এটি ছিল ভার্জিনিয়ার অবচেতন মনের ভাবনার প্রতিফলন। মানুষ মানুষ হয়ে জন্মায় আর সমাজ তাকে জেন্ডারে বিভক্ত করে দেয়। জেন্ডারের মোড়কে আবৃত একজন মানুষ নারী বা পুরুষ হয়ে বেঁচে থেকে অন্য জেন্ডারকে অনুধাবন করবার মতো সময় বা সুযোগ কোনোটাই পায় না। আমার মনে হয়েছে, একবিংশ শতাব্দীর নন-বায়োনারি ধারণাটির সঙ্গে ভার্জিনিয়া উলফের ওরলান্ডো উপন্যাসের সাযুজ্য রয়েছে। কেননা, এই ধারণা অনুযায়ী জেন্ডার হচ্ছে একটি স্পেকট্রাম। সিস্ জেন্ডার নারী বা পুরুষের পরিবর্তে নিজেদের নন-বায়োনারি হিসাবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। বিষয়টি এই ভাবে বলা যায়, তারা নারী বা পুরুষ কোনো সত্তায় নিজেদের আটকে রাখেন না। তবে নন-বায়োনারিরা যদি চান তারা কিছুটা বেশি মেয়েলি বা কিছুটা বেশি পুরুষালী ভাবমূর্তির দিকে ঝুঁকতে পারেন। এইসব দিক বিবেচনা করেই, ওরলান্ডো উপন্যাসের সঙ্গে নন-বায়োনারি ধারণাটি সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হয়েছে।
ভার্জিনিয়া উলফের ওরলান্ডো অ্যা বায়োগোাফি ইংরেজি সাহিত্যের একটি ব্যঙ্গাত্মক মূলক এবং নারীবাদী উপন্যাস । তিনি এই উপন্যাসটিতে জেন্ডার এবং ইন্টারসেক্সুয়ালিটি ওপর বিশেষ আলোকপাত করেছিলেন। ভার্জিনিয়া এমন একটা সময় জেন্ডার এবং ইন্টারসেক্সুয়ালিটি মতো বিষয়টি নিয়ে লেখেন, যখন সমাজে নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হতোএবং নারীদের স্বাধীন মত প্রকাশ এবং ভোটাধিকারের জন্যও লড়তে হচ্ছিল। ভার্জিনিয়া উলফ ওরলান্ডোতে সমাজকে যৌনতা ও লিঙ্গ বৈষম্য হতে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
উপন্যাসে ওরলানন্ডো নামে একজন অভিজাত, সম্ভ্রান্ত অল্প বয়সী দুঃসাহসি কবির বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি তার যৌবন ইংল্যান্ডের রাণীর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং শতাব্দী থেকে শতাব্দী বেঁচে থাকা ওরলান্ডো মাঝ পর্যায়ে পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হন। নারীতে রুপান্তরিত হওয়ার কারণে তিনি বেশ কিছু সমস্যায় পড়েন এবং রাণীর কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তি হারান, হারানো সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করেন এবং পরবর্তীতে তিনি একজন পুরুষকে বিয়ে করেন, সে পুরুষটিও ওরলান্ডোর মতো লিঙ্গ বৈষম্য মুক্ত ভাবনার ছিলেন।
একটা সময় ভার্জিনিয়া উলফের প্রেমিক, ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন ভিটা সেকভিল ওয়েস্ট (Vita Sackville West) যিনি নিজেও সে সময়ের একজন অভিজাত মহিলা কবি, সাহিত্যেক এবং সাংবাদিক ছিলেন। ভার্জিনিয়ার সঙ্গে ভিটা সেকভিলের দশ কী বারো বছরের সম্পর্ক ছিল এবং ভার্জিনিয়া ভিটা সেকভিল দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন। ভার্জিনিয়া উলফ্ ওরলান্ডো উপন্যাসটি ভিটা সেকভিলের পারিবারিক ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেন।
এবার সিনেমার প্রসঙ্গে আসা যাক। দর্শক ১৬০০ শতকের একজন তরুণ সম্ভ্রান্ত পুরুষকে দিয়ে সিনেমা দেখা শুরু করে। যদিও ওরলান্ডো চরিত্রে অভিনয় শিল্পী তিনি একজন নারীই, টিল্ডা সুইন্টন (Tilda Swinton)।একজন নারীকে পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করতে দেখে দর্শকের সংশয় কাটতে এবং কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে বেশ কিছু সময় যায়।
সিনেমাটি কয়েকটি এপিসোডে বিভক্ত করা, ডেথ, লাভ, পোয়েট্রি, পলিটিক্স, সোসাইটি, সেক্স এবং বার্থ। এই সব বিভিন্ন পর্যায়ে একজন মানুষ ওরলান্ডো, বিভিন্ন রকম চরিত্রে রোল প্লে করে। এপিসোডগুলোতেলাভ, পলিটিক্স এবং সেক্স দারুণ ভাবে দৃশ্যায়িত হয়েছে।
সিনেমার শুরু ডেথ এপিসোড দিয়ে, রাণী প্রথম এলিজাবেথ ওরলান্ডোর বাবার বাড়ী পরিদর্শনে আসেন। এক পর্যায়ে ওরলান্ডোকে রাণীর বিছানায় দেখে ধারণা করা যায়, রাণী তরুণটিকে তার বিছানার খেলার সঙ্গী হিসাবে নিয়েছিলেন। ওরলান্ডো রাণীর কাছ থেকে চির কালের জন্য একটি দারুণ বাড়ী এবং কিছু সম্পত্তির মালিকানাপান। সম্পত্তির মালিক হওয়ার শর্ত ছিলো, তাকে চির তরুণ এবং বয়সহীন থাকতে হবে। দর্শক সিনেমাটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ওরলান্ডোকে পুরুষ এবং নারী উভয় চরিত্রে চির তরুণ হিসাবে দেখতে পায়। উপন্যাসের আলোচনায় উল্লেখ করেছিলাম, এটি মানুষের অস্তিত্বের দৃষ্টিভঙ্গি, ঠিক তাই। ওরলান্ডো চরিত্রটি পরাবাস্তব। আর প্রাকৃতিক সত্য যখন অবচেতন মনে থাকে, তাই কল্পনা আর অবাস্তব ঘিরে মানুষের ভেতর ওরলান্ডোর মতো জীবনের সুপ্ত বাসনা তৈরী হয়! শতাব্দীর পর শতাব্দী তারুণ্য নিয়ে বেঁচে থাকা, নারী পুরুষ উভয় চরিত্রে নিজেকে আবিষ্কার করা, শতাব্দীর বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে মিলিত হওয়া, এটি একটি দুর্দান্ত ফ্যান্টাসি! পরাবাস্তবতা ছাড়া একে আর কী বলা যেতে পারে!
লাভ এপিসোডে ওরলান্ডো রাশিয়ার প্রিন্সেস সাশার প্রেমে পড়ে। সাশার সঙ্গে অভিসারে গিয়েও ওরলান্ডো বিমর্ষ ছিলো, সে প্রেমিকাকে হারানোর ভয়ে কাতর উচ্চারণ করে, Nothing thicker than a knife’s blade separates melancholy from happiness. যখন ওরলান্ডো নদীর ওপর সাশার জন্য অপেক্ষা করছিলো তখন টেমস নদীর জমে থাকা বরফ খন্ডে ধ্বস নেমে আসে, সে ধ্বসের মতো তার প্রেমেও ভাঙন আসে। প্রেম বিপর্যয়ের পর ওরলান্ডো কবিতায় নিজেকে নিবেদিত করার চেষ্টা করে। লিখে ফেলেন এক বিশাল কবিতা কিন্তু তাতেও সে ব্যর্থ হয়। তারপর ওরলান্ডোর জীবনে পলিটিক্সের আগমন ঘটে, রাষ্ট্রদূত হয়ে সে কনস্টান্টিনোপল চলে যায়। কনস্টান্টিনোপলের এক নাটকীয় সকালে ওরলান্ডো দীর্ঘ ঘুম থেকে জেগে আবিষ্কার করে সে একজন নারী! সে খুব বিস্মিত হয় না, নিজের নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে শুধু মনে হয়, Same person. No difference at all…just a different sex.
ঘরে ফিরে নারী ওরলান্ডোকে নিজের সম্পত্তি রক্ষার জন্য লড়াই শুরু করতে হয়। আর্চডুক হ্যারির ওরলান্ডোকে দেখে বিয়ে করতে চায়, তার বিয়ের প্রস্তাব ছিল ঔদ্ধত্য আর অশিষ্টপূর্ণ, I am England. And you are Mine. ওরলান্ডো জানতে চায়, On what grounds? দাম্ভিক আর্চডুক উত্তরে জানায়, That I adore you. এই সব কথোপকথন তৎকালীন সমাজে নারী সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনোভাব জানান দেয়। ওরলান্ডো বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে এবং পুরুষের হাত থেকে রক্ষার তাগিদে এক গোলক ধাঁধায় ঢুকে পড়ে। সময়ের পর সময় চলে যায়, ওরলান্ডো শুধু ছুটতে থাকে গোলক ধাঁধায়। ভীষণ সুন্দর সে দৃশ্যের চিত্রায়ন, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার পোশাকের পরিবর্তন হতে থাকে, ওরলান্ডোর ছুটে চলা নারী জীবনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ সংমিশ্রণ।
সেক্স এপিসোডে, অবশেষে, নারী ওরলান্ডোর জীবনে প্রেম আসে, নাবিক শেলমেরডিন প্রেমিক হয়ে আসে। প্রেমিকের সঙ্গে ওরলান্ডোর নীরব শুয়ে থাকার দৃশ্যে শতাব্দী থেকে শতাব্দী ছুটে চলা দর্শকের চোখ এই দৃশ্যে স্বস্তি পায় যেমন তেমনি এই সিনটি ক্রমাগত ছুটতে থাকা ওরলান্ডোর জীবনের প্রশান্তিও বোঝায়। নাবিক প্রেমিক বাতাসের আগমনের সাথে সাথে চলেও যায়।
ওরলান্ডো আবার যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে দিয়ে ছুটতে থাকে, সন্তানের জন্ম দেয়, বহু বছর আগে লেখা কবিতা ট্রি’ও প্রকাশিত হয়।
১৯০০ শতকে ঢুকে পড়া অরলান্ডো যুগের সাথে মানানসই একজন আধুনিক, দীর্ঘাঙ্গী,পাতলা গড়নের সুদর্শনা সিঙ্গেল মাদার, অবশ্যই নারী। তখনও সে বেঁচে আছে, কিন্তু তার সেই দারুণ ম্যানশনটি আর তার দখলে নেই। এই শতকে এসে সোসাইটি তার ব্যপারে কেয়ার করে না, কারণ, এটি আধুনিক ইংল্যান্ড।
ওরলান্ডো ভার্জিনিয়া উলফের উপন্যাস বেইস করে তৈরী হলেও, সিনেমাটি উপন্যাসের বিভিন্ন টুকরোর একটি সিনে রিল। সিনেমাটিতে শতাব্দীর সঙ্গে মানানসই ফ্যাসনকে দক্ষতার সঙ্গে দেখানো হয়েছে, ওরলান্ডোর ছুটে চলার মধ্যে শতাব্দীর পরিবর্তনকে বুঝানো হয়েছে। সিনেমার এই দিকগুলো খুবই ভালো আর দৃষ্টি নন্দন। ওরলান্ডোর ভুমিকায় পুরুষ এবং নারী চরিত্রে অভিনয় করা টিল্ডা সুইন্টনের অভিনয় ছিল যথার্থ। সুইন্টন বিভিন্ন সময় ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছোট একটি ডায়লগ বলে বা শুধু দৃষ্টি বিনিময় করে দর্শকেদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে, পরিচালনার এই বিষয়টি বেশ উপভোগ্য। সিনেমাটির পরাবাস্তবতা আর মানুষের অন্তর্গত স্বপ্ন, সীমাবদ্ধতা, বুঝতে পারার জন্য একটি যথাযথ সিনেমা।
সব শেষে সিনেমার গানটির দৃশায়ন চিত্তাকর্ষক। ১৯০০ শতকের আধুনিক পোশাকের ওরলান্ডোর মাথার ওপর দেবদূত এসে গান করছে, I am coming! I am coming! Here I am! Neither a woman, nor a man. We are joined, we are one, With the human face.
Shamim Runa is a novelist, playwright, film critic, and women’s rights activist.