দিলওয়ার বাংলাদেশের পঞ্চাশের মূল ধারার কবি। যাঁদের কবিতার ভেতরে খেলা করেছে দ্রোহী-সংগ্রামী চেতনার বহুমাত্রিক সুর ও স্বর, তিনি তাঁদের একজন। নিঃসন্দেহে কবিতা একটি প্রধান শিল্পমাধ্যম যেখানে একজন কবিরূপী শিল্পী শব্দের ইট-মাটি দিয়ে শিল্পচর্চার খেলা খেলে থাকেন। একজন কবি হিসেবে শিল্পচর্চার পথে ধাবিত হয়েছিলেন দিলওয়ার। তাঁর কল্পিত পৃথিবী আর দর্শিত পৃথিবী যখন ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দিয়েছে তখনই তাঁর ভেতরে আত্মজিজ্ঞাসার উদয় হয়েছিল। এই আত্মজিজ্ঞাসাই তাকে ‘কবিতা’নামক শিল্পচর্চায় দীপান্বিত করেছে ঠিক; কিন্তু শিল্পসত্তার মর্মবীজ কবিতায় কতটুকু খেলা করেছে, কিংবা যুক্ত হয়েছেÑএরকম ভাবনায় কবিকে দ্বিবাচনিক কল্পিত স্রোতে ভাসিয়েছে। কবিতার বাইরে সাক্ষাৎকারে কবি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন নিজের কবিতার বিষয়কে যতটুকু তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন, প্রকরণকে ততটা গুরুত্ব দিতে পারেননি। তাই দিলওয়ারের কবিতা প্রকরণকে ছাপিয়ে কবিরতার বিষয়ই হয়ে উঠেছিল মুখ্য। অন্য অর্থে শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক কিংবা শহীদ কাদরীর মত সমকালীন কবিরা কবিতার শরীরী সত্তাকে যেভাবে প্রাকরণিক নন্দনসৌকর্যে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নানা কারণে দিলওয়ার সে পথে কতটুকু অগ্রসর হয়েছিলেন বিষয়টি বিচার ও বিচারিত হওয়ার দায় অনিবার্য ভবিষ্যতের ওপরই ছেড়ে দেওয়া যৌক্তিক হতে পারে। নানা কারণে দিওয়ারের কবিতা বিচার-বিশ্লেষণে এই জায়গায় কিছু জিজ্ঞাসা থেকে যায়। তবে এটাও ঠিক, কবির যে অভীপ্সা কবিতার বিষয়কেন্দ্রিক, মানুষকেন্দ্রিক কিংবা মানুষকে ভালোবাসা, মানুষ হওয়ার বাসনা সেটাকে যে ছোটো করে দেখার অবকাশ রয়েছে সেটা কিন্তু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বরং দিলওয়ার খানের কবি দিলওয়ার হওয়ার গল্প এরকম এক রৈখিক নয়, বহুমাত্রিক, বহুবাস্তবিক রূপকল্পে ভরপুর ছিল।
কবি কখন কবিতা লিখেন, অথবা চাইলেই কবি কবিতা লিখতে পারেন? এরকম প্রশ্নের উত্তর কবিমাত্রেই জানা। দিলওয়ারের সমকাল ও সমকালীন দুনিয়ার কঠিন জীবনবোধ তাঁকে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি করেছিল, সেই আত্মজিজ্ঞাসার জায়গা থেকে; সমাজ-রাষ্ট্র ও তাবৎ পৃথিবীর প্রতি গভীর দায় অনুভবের জায়গা থেকে দিলওয়ারের যে কবি হয়ে ওঠা সেটা সহজে উপলব্ধি করা যায়। দিলওয়ার সারা জীবনে রচিত-সঞ্চিত কবিতা থেকে বিষয়টি প্রমাণিত করেছেন এবং বিচ্ছিন্নভাবে নিজের সাক্ষাৎকারে বিষয়টি যুক্তও করেছেন। তাঁর কবিতাচর্চার শুরু সিলেটের প্রাচীন পত্রিকা যুগভেরীর সাহিত্যপাতায় `সাইফুল্লাহ হে নজরুল’কবিতা দিয়ে। এরপর কবিতাচর্চাকে সঙ্গী করে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠার গল্প আমাদের কাছে স্পষ্ট। পঞ্চাশের দশকে জিজ্ঞাসাকাব্য থেকেই এই কবির ভবিষ্যৎ নির্মাণের কাজটি শুরু হয়। প্রথমত, দিলওয়ার কাকে কী জিজ্ঞাসা করছেন? এখান থেকেই তাঁর কবিতার লক্ষ্য অনুভব করতে হয়। দ্বিতীয়ত, তাঁর সমকাল তাঁর কাছে কী দাবি করছেÑএটাও একটা প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে ওঠে অন্তত কবির নিজের ক্ষেত্রে।
একটি বিষয় দিলওয়ারের কবিতার পাঠককে স্মরণে রাখতে হবে যে, কবির জন্মের আগে একবার পৃথিবীবাসী বারুদের তেজস্ক্রিয়তায় অন্ধকার হতে দেখেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে; দ্বিতীয়বার পৃথিবীবাসী কবির জন্মের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বারুদের তেজস্ক্রিয়তাই দেখেনি দেখেছে মানবসভ্যতার ধ্বংসযজ্ঞ। দেখেছে জাপানের বিপন্ন মানুষের আর্তনাদের করুণ চিত্র। প্রশ্ন হলো কবি কীভাবে এগুলো অনুভব করলেন? উত্তর খুব সহজ, কবিদের অন্তর্দৃষ্টিই শুধু নয় তাঁদের বর্হিদৃষ্টিও প্রখর থাকে, দিলওয়ার নিজে তা-ই ছিলেন। নতুবা কৈশোরজীবন থেকে বিবিসি পর্যন্ত তাঁর চোখ আর শ্রবণেন্দ্রিয় পৌঁছাতে পারত না। কৈশোর জীবন থেকেই তাঁর মধ্যে একরকম সমাজবোধ ও সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টি জেগে উঠছিল। এরকম সমাজ-পরিবেশ, তাবৎ পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা তাঁকে গণমুক্তির আকাঙ্ক্ষার দিকে ধাবিত করেছিল; রাজনীতি সচেতন করে তুলেছিল যদিও তিনি রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেননি কোনোকালে। বরং গণমুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষাই তাঁকে কবিত্বের অমোঘ শক্তি যুগিয়েছিল। তাঁর কবিতার সুর ও স্বরে উচ্চারিত হয়েছিল গণমুক্তির প্রতিধ্বনি :
বিপ্লবের রক্তঅশ্ব ডেকে গেছে বহুবার
বাঁধন ছিঁড়েÑ
সর্বহারা মানুষের ভিড়ে \
বহুবার একখানি বাঁকা তলোয়ার
কেটে গেছে জমাট আঁধার,
জীবনের শ্রেষ্ঠ স্বপ্ন নেমেছে কতো না তাই
মৃত্তিকার সুলভ কুটীরে,
শান্তির গান গেয়ে ধীরে‘
`শাণিত অতীতের গান’, জিজ্ঞাসা
জিজ্ঞাসার এই কবিতায় দিলওয়ার প্রথমেই জানান দিয়েছেন বিপ্লবের, যুক্ত হয়েছেন সর্বহারা মানুষের সঙ্গে! তাঁর গণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা যুক্ত হয়েছে প্রথম কাব্যের কবিতাগুলোর ভেতর থেকেই। কবি কল্পনা করেছেন; তাঁর কল্পনায় ভেসে উঠেছে একখানা ‘বাঁকা তলোয়ারের’প্রতিচ্ছবি। এটি কী করতে পারে? জমাট আঁধার দূর করতে পারে। এরপরেই কবি শান্তির গান শোনাতে চান। তাঁর কবিতার কল্পিত আঁধার সমাজ-রাষ্ট্র ও পৃথিবীময় ছড়িয়ে যাওয়া অন্ধকার। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে যে যুদ্ধের দামামা, শোষণ ও বঞ্চনার নানা ঔপনিবেশিক জালবিস্তার করেছিল, আক্ষরিক অর্থে এটিই কবির কল্পিত অন্ধকারের চিত্র। একটি বিষয় অনুভব করা জরুরি যে, কবির অনুভব আর আট-দশটা মানুষের অনুভবের মাত্রা এক নয় বরং অন্য প্রতীকী আট-দশটা কিংবা সামষ্টিক মানুষগুলোর অনুভূতি কবির ভাবনায় একীভূত হয় বলে কবির স্বরও হয়ে ওঠে সর্বজনীন। এজন্য দিলওয়ারের বেশিরভাগ কবিতায় সামষ্টিক গণমুক্তি বার বারই উচ্চকিত হয়েছে :
এবার এলো শক্তিহীনের
শক্তি লাভের দিন,
নবীন ভুবন সৃষ্টি হবে
ঐক্যে অমলিন
`এবার এলো’, জিজ্ঞাসা
অথবা,
জাগ্রত হও, জাগ্রত হও, জাগ্রত হও ভাই
এখনো যাহারা ঘুমায়ে রয়েছো আমার কর্মী ভাই
`এখনো যাহারা’, জিজ্ঞাসা
মানুষের দুঃখ, দারিদ্র, শোষণ-বঞ্চনা দিলওয়ারের মধ্যে একরকম উত্তাল ঝড় তুলেছিল। তাই শক্তিহীন দরিদ্র মানুষকে কবিতায় শক্তিসঞ্চয়ের ও ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। কবির কল্পিত পৃথিবী রুগ্ন, ঝরাগ্রস্থ। কারণ, কবি এমন এক সমাজ-পৃথিবীতে বসবাস করেছেন যেখানে চারদিকে অশান্তি, শোষণ-বঞ্চনার মধ্যে মানুষের প্রাত্যহিক বসবাস। এজন্যে কবি নতুন পৃথিবী গড়তে চান সাধারণ মানুষকে নিয়ে। তাই কবি ঐক্য চেয়েছেন। যে-ঐক্যের ভেতরেই বিনির্মাণ হবে একটি রাষ্ট্রিক ভূগোল কখনও কখনও একটি স্বপ্নীল পৃথিবী। যেখানে শোষণ থাকবে না; বঞ্চনা থাকবে না; থাকবে না-চারদিকে ক্ষুধার ‘উহুরুহু’যন্ত্রণার আর্তনাদ। এই জায়গাটি একান্ত দিলওয়ারের। যেটি চল্লিশের দশকে সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিংবা সুকান্ত ভট্টাচার্য নির্মাণ করার প্রয়াস দেখিয়েছিলেন। তবে কবি হিসেবে দিলওয়ারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল তিনি সাধারণের কাতারে এসে বার বার যুক্ত হয়েছেন। গণমানুষের আকাক্সক্ষার কথা কবিতার দ্রোহী স্বরে উচ্চারণ করেছেন :
ভুলতে পারিনে আমি অতর্কিতে মনে পড়ে যায়
সেই কবে পথে দেখা রোঁয়াওঠা কুকুরের ছবি,
দেখেছি নীরবে তারে জনস্রোতে ভেসে যেতে হায়,
বুভুক্ষায় দেহ ক্ষীণ : জান্তব আকাশে ম্লান রবি।
`মানবিকতা’, ঐকতান
অথবা,
খুনহারা মুখে, ম্লান মরাচোখে
প্রাণঝরা শোকে, বুকফাটা দুখে :
ক্ষুধায় কোঁকাই মোরা বেকার মজুর
মোরা বেকার মজুর \
‘বেকার মজুরের গান’, জিজ্ঞাসা,
উল্লিখিত কবিতার প্রথম স্তবকে দেখা যায় একজন মানবতাবাদী দিলওয়ারের কাব্যিক রোদন। পথের রোয়াওঠা কুকুরের ছবি তিনি দেখেন, বুভুক্ষ প্রাণ তিনি দেখেন; কবির আকাশে তখন সূর্যের আলো অনেকটা ম্লান হয়ে আসছে। আসলে এখানে কবির মানবিকতাবোধেরই একটি চিত্রকল্প আভাসিত হয়েছে। সূর্যের আলো ম্লান হওয়া মানে পৃথিবীবাসীর করুণ ও কঠিন সময়েরই ইঙ্গিত দিয়ে যান তিনি। যে-আকাশে আজ আর মানবিকতার কোনো মূল্য নেই, সেই আকাশে সূর্য প্রতিদিনের মত হাসিমাখা আলো ছড়াতে পারে না; জাতির দুর্দিন তাই সূর্যের আলো ম্লান হয়ে এসেছে। উল্লিখিত দ্বিতীয় কবিতায় একইরকমভাবে কবি মানুষের শোক আর দুঃখবোধের কথা বলেছেন। যে-মানুষগুলোর চোখে-মুখে বুকফাটা আর্তনাদ আর মলিন মুখ! মানুষের-মানবসমাজের নিদারুণ দুঃখবোধের, শোষণের-বঞ্চনার ইঙ্গিত দিয়ে যান তিনি। কবি রোয়াওঠা কুকুর থেকে বেকার মজুর কোনো কিছুকেই বাদ দেননি কবিতায়। এখানে কবির শুধু স্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায় না, দেখা যায় কবির মানস, কবিতার দৈহিক শক্তির জায়গা যেখানে গণমানুষ, গণমানুষের শোষণ-বঞ্চনার চিত্র ভেসে ওঠে। শুধু তাই নয়, দিলওয়ারের কবিতার সুর ও স্বরে উচ্চারিত হয়েছে দ্রোহ-সংগ্রামের প্রজ্ঞাদীপ্ত বাণী যেগুলোর মর্মবীজ উৎসারিত হয়েছে কাজী নজরুল, সুভাষ-সুকান্তের কবিতার দ্রোহ-সংগ্রাম আর সাম্যবাদী চেতনার ভেতর থেকে। দিলওয়ারের গানেও এরকম গণমুক্তির আকাক্সক্ষার চিত্র উদ্ভাসিত হয়েছে :
ভূখের জ্বালায় মত্ত পাগল
অজগরের মতো
আছাড়-পিছাড় খাইছেরে ঢেউ
হায়রে কত শত
ওরে বৈঠা দিয়া মাররে বাড়ি
তীরের পানে চেয়ে \ সামলারে তোর…
`একা’, পূবাল হাওয়া
অথবা,
ও চাষীরে,
কার লাগি তোর মুখের মাঝে
সুখের হাসি নাই \ ও চাষীরে…
[…]কপালরে আর দোষ দিওনা
কপাল তোমার হাতে,
এমনি কি আর ফলে ফসল
বীজ না রুইলে মাঠে?
তবে র্ক উঁচা শির তোর,
দলার মতোন সকল বাঁধা
ভাঙ্গি সমান র্ক,
তবেই সুখের হাসি দুশমনেরে
দিবে দুখের ছাই \ ও চাষীরে…
`আট’, পূবাল হাওয়া
গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা নানাভাবে ধ্বনিত হয়েছে দিলওয়ারের কবিতা ও গানের মধ্যে। এই গণমানুষ শুধু বাংলাদেশের নয়; এই গণমানুষে দিকে দিকে বিস্তৃত সমস্ত পৃথিবীর। দিলওয়ার একজন হয়ে সমগ্র পৃথিবীবাসীর কথা তাঁর কবিতার শরীরে যুক্ত করেছেন। সুরমাপারের কবি দৃষ্টি দিয়েছেন টেমস তীরের দিকে। ভুলে যাননি সমগ্র ইউরোপের বর্ণবৈষম্যের কথা। কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ বর্ণগত যে বৈষম্য সমগ্র ইউরোপকে বিভাজন করে রেখেছিল সেটিও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। তাইতো তিনি কবিতায় যুক্ত করেছেন তাঁদেরকে যাঁরা সারা জীবন গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন মেনডেলা, রুশনেতা মহামতি লেনিন, চিনের নেতা মাওসেতুং থেকে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কবিতায় যেন একই সুতোয় গ্রন্থিত করেছেন। কারণ, এসকল নেতা আমৃত্যু মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্তির ও স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর গণমুক্তির সুরের মধ্যে মাঝে মাঝে কবি আশ্রিত হয়েছেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্য ও সেমেটিক মিথের কাছে। তাঁর এই দ্রোহ-সংগ্রামের ধ্বনি সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুর ও স্বর হয়ে উচ্চারিত হয়েছে। সর্বোপরি, মানুষ হয়ে ওঠার, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার এবং গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে তাঁর কবিতায়।
দিলওয়ার মানুষকে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার তাগিদ অনুভব করেছিলেন সমাজ-রাষ্ট্রের নানারূপ শোষণ ও বঞ্চনার মধ্যে। সুভাষ মুখোপাধ্যায় যে-অর্থে রাজনৈতিক আদর্শে প্রাণিত হয়েছিলেন সেই অর্থে দিলওয়ার কোনো রাজনৈতিক ভাবাদর্শে প্রথমদিকে খুব একটা ঝুঁকে পড়েননি। তবে এটা বলা যায় দিলওয়ার রাজনৈতিক সচেতন কবি ছিলেন। আদর্শের ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যক্ষভাবে প্রাণিত হয়েছেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী কার্ল মাকর্সের সাম্যবাদী নীতি দ্বারা। সাম্যবাদকে তিনি মনে-প্রাণে লালন করতেন বলেই কবিতায় সাম্যবাদের কথা বলেছেন। তিনি চেয়েছেন পৃথিবীতে সাম্য প্রতিষ্ঠা যেন হয়; তাঁর কল্পিত পৃথিবীতে ধনী-গরিবের ব্যবধান যেন না থাকে। একটি শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার আহ্বান তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। আর, এ-ক্ষেত্রে কবি আদর্শের পাঠ নিয়েছেন মার্কস-লেনিনের কাছ থেকে।
এবং জননীরা
ভগিনীরা
প্রেয়সীরা
সময় কে ভাগ করে নিয়ে,
প্রাত্যহিক কর্মের অবসরে
আমাদের শ্রম-সুন্দর মহাচেতনাকে
গুচ্ছ গুচ্ছ পাকা আংগুরের মতো
বণ্টন করে দেবে :
সুখ, শান্তি, মৈত্রি আর প্রেম।
[…]জগতের মানবিক সমস্ত হৃদয় :
হাতে হাত,
বুকে বুক
সুষম চলার উল্লাস।
ঘৃণার বল্লমে বিঁধে
অরাতির বুক
পূর্বাশার পাদপীঠে
একবিশ্ব : একটি জীবন।
`একটি বিশ্ব : একটি জীবন’, ঐকতান
অথবা,
যাদের চোখের মণি জ্বলে ওঠে
রাত পোহাবার আগে
পৌঁছিয়ে দিতে পৃথিবীর কথা
সূর্যের পুরোভাগে,
শ্রমজীবী সেই মহামানবের
রক্তগোলাপী হাতে
ছড়িয়ে দিলাম আমার কবিতা
নিদ্রাবিহীন রাতে
`প্রবেশক’, উদ্ভিন্ন উল্লাস
অথবা,
ওহো, আয়রে ছুটে মেহনতীরা
ছিঁড়তে ভাষার বৈরীশিরা,
শোষণ-মুক্ত গড়তে সমাজ
নেইকো সময় থামার,
বাংলা তোমার-আমার\
`বাংলা তোমার-আমার’, বাংলা তোমার-আমার
উল্লিখিত কবিতার উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় দিলওয়ারের সাম্যবাদ ও সমাজবাদের স্বরূপ। গুচ্ছ গুচ্ছ পাকা আংগুরের মতো সমবণ্টন ও সাম্যব্যবস্থা তিনি চেয়েছেন। তাঁর সাম্যচেতনার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সুখ, শান্তি , মৈত্রী আর প্রেম। মানবের হৃদয়ে যেন মানবিকতা প্রজ্জ্বলিত হয় সুখ, শান্তি আর প্রেমের বন্ধনে। অন্ধকারের পাহাড় যেন চূর্ণ হয়ে সমাজের সকল অশান্তি, শোষণ ও বঞ্চনা বিদূরিত হয়, এটি দিলওয়ারের কবিতার রূপকল্পিক বার্তা দিয়ে যায় প্রতি মুহুর্তে। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ আর সামন্তবাদকে ব্যক্তিকবি আজীবন ঘৃণা করেছেন। তাইতো তিনি শ্রমজীবী মানুষের রক্তগোলাপী হাতে তাঁর কবিতা সমর্পিত করেছেন। শোষণমুক্ত সমাজপ্রতিষ্ঠার এক মানবিক বার্তা দিলওয়ারের কবিতা। তাঁর কবিতা উচ্চারণ করে সাম্য, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা। মানুষের তরে, মানুষের জন্যে, মানুষ হবার বাসনায় যুদ্ধপীড়িত পৃথিবীতে স্বতোৎসারিত মানবিক স্বর হয়ে ভেসে আসে মানুষের কাছে ও কবিতার পাঠকের কাছে। তাঁর কবিতায় কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবাদী আদর্শ খুব সহজেই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন যদি অপরাধ হয়,
আমরা কি আজো দিতে পারলাম
মানুষের পরিচয়?
ডুবে আছি আজো খণ্ডে খণ্ডে সাম্প্রদায়িক পাঁকে
দম্ভদূষিত নাগপাশে বেঁধে
মানুষের বিধাতাকে।
`শ্রদ্ধেয় পিতা ক্ষমা করবেন’, রক্তে আমার অনাদি অস্থি
অথবা,
চাই বিপ্লব, চাই বিপ্লব, চাই-
বিপ্লব ছাড়া মুক্তির উপায় নাই
পুরাতনকে করে কর্তন
আনো নব পরিবর্তন
নরদানবের বংশ
করবে সমূলে ধ্বংস,
বুঝে লও আজ এই ধরণীর
প্রাপ্য যে যার অংশ
`মাউ মাউ-দেরে’, জিজ্ঞাসা
দিলওয়ার কবিতার সাধনা চালিয়েছেন দীর্ঘজীবন। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি কবিতাচর্চার সাধনায় যুক্ত করেছেন মানুষ ও মানবতাকে। কঠিন জীবনবোধ, জীবনের লব্দ অভিজ্ঞতা, র্দাশনিক প্রজ্ঞা দিয়ে কবিতায় যুক্ত করেছেন অন্যরকম সুর ও স্বর। যে স্বরে উচ্চকিত হয়েছে সমাজ-রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা অসাম্য, শোষণ, বঞ্চনা তথা পুঁজিবাদের আগ্রাসনের কাব্যিক চিত্রকল্প। র্দীঘ ঔপনিবেশিক শাসনের মূলে এই অঞ্চলের মানুষ দেখেছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত। একজন কবি হিসেবে তিনিও কবিতায় এই সাম্প্রদায়িকতাকে যুক্ত করেছেন ক্ষুব্ধ অভিপ্রায় নিয়ে। পৃথিবীর তাবৎ মানবসমাজ এখনও যে মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি, মানুষের মধ্যে এখনও যে মানবিকতার তীব্র সংকট রয়েছে সেই বিষয়টি তিনি কবিতায় উচ্চারণ করেছেন। বিপ্লব, আর গণজাগরণই পারে মানবমুক্তি; সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সামন্তবাদী পকিস্তান রাষ্ট্র গণমানুষের অধিকার যে কেড়ে নিচ্ছিল; কেড়ে নিচ্ছিল মানুষের মুখের গ্রাস বিষয়টি দিলওয়ারের দৃষ্টি এড়ায়নি। ষাটের দশকে পাক সামরিকতন্ত্রের টুটি চেপে ধরেছিল পূর্বপাকিস্তানের অধিকারবঞ্চিত জনমানুষ। দিলওয়ারের কবিতা-গান পাক মসনদে আঘাত করেছিল প্রতিবাদী সুর ও স্বর হিসেবে উচ্চারিত হয়ে। কবি বুঝেছিলেন পশ্চিমপাকিস্তানিরা আমাদেরকে শাসনের নামে নানাভাবে শোষণের বন্দোবস্ত করে ছেলেছে। তাই পূর্বপাকিস্তানের রাজপথ যখন উত্থাল তখন তিনিও উচ্চারণ করলেন সংগ্রামী স্বর এভাবে :
চলছে মিছিল, চলবে মিছিল
চলবে, চলবে, চলবে
লক্ষ্য পথে রবির মতোন
জ্বলবে জ্বলবে জ্বলবে […]
তাই, বজ্রকঠিন হুংকারে তার
অত্যাচারীর টুটবে মিনার,
সাম্যবাদের নিশান ধরে
অনন্তকাল বলবে :
বীর জনতার চলছে মিছিল
চলবে, চলবে, চলবে \
‘ছয়’, বাংলা তোমার আমার
অথবা,
দিকে দিকে ধিকি ধিকি লাল-উত্তাল
দুর্জয় জনতার প্রাণের মশাল,
গানের মশাল।
চলে তারা একতার মন্ত্রে
চূর্ণিতে শোষণের যন্ত্রে
জ্বলে তারা সমতার মন্ত্রে
সূর্যের সাথী যেন কোটি মণি লাল \
`একুশ, বাংলা তোমার-আমার
ষাটের দশকে দিলওয়ারের লেখা কবিতা-গান থেকে থেকে জনতার দীপ্তপ্রাণে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ ঝরেছিল; তাঁর গানের সুরে ধ্বনিত হয়েছিল পূর্বপাকিস্তানের অধিকারবঞ্চিত মানুষের মিছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’থেকে ভেসে এসেছিল দিলওয়ারের গণজাগরণী-বিপ্লবী গান। তাই পাক সরকারের ভীত কেঁপে উঠেছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সংগ্রামী গানের যে সুর উচ্চারিত হয়েছিল তা মুক্তিবাহিনীকে প্রেরণা যুগিয়েছিল :
আমাদের ইতিহাস পৃথ্বী
সমুদ্র সম্ভাষে ধন্যা,
সংগ্রাম আমাদের ভিত্তি
ভালোবাসা রক্তের বন্যা \
আমাদের যাত্রায় তাইরে
সংশয়-আঁধিয়ার নাইরে
নাই-নাই-নাই, নাইরে
আমরণ আমাদের কাম্য
এই ধরা সূর্যের কন্যা \
`আট’, বাংলা তোমার আমার
১৯৭১ সালের বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সেই দিনগুলোতে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’থেকে দিলওয়ারের জাগরণী গান মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণিত করেছিল দেশের জন্য সংগ্রামে ও আত্মত্যাগে আরও বলিয়ান হতে। যদিও দিলওয়ারকে রাজনীতির মাঠে দেখা যায়নি তবে তিনি যে রাজনীতি-সচেতন কবি হয়ে উঠেছিলেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতা লিখেছেন, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে কবিতায় গ্রন্থিত করেছেন সেই অর্থে তাঁর আদর্শ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেরÑএটা সহজে প্রতীয়মান হয়। তাই বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে, দিলওয়ার মুক্তি-সংগ্রামের কবি এবং রাজনৈতিক পোশাকি কবি না-হলেও তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী কবি। সেটি প্রমাণিত। তাঁর কবিতায় মুক্তিসংগ্রাম যুক্ত হয়েছে, বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের মহানায়কের কথা যুক্ত হয়েছে এভাবে :
শুনেছি তোমার নামে, ঘাটের মড়ার করোটিতে
তরঙ্গ সঙ্গীত রচে, ঝিনুকে মুক্তোর ভাঙ্গে ঘুম,
বিষুবরেখার স্বপ্নে শর্বরী হারায় বেমালুম,
নিস্তব্দ কবরে সূর্যে সোচ্চার আলোক থাকে দিতে,
`স্বাধীনতা’, উদ্ভিন্ন উল্লাস
অথবা,
তোমার স্তাবক নই। তোমার তুমুল ক্ষমতার
জলভ্রমি কোলাহলে দিইনি কখনো আমি ঝাঁপ
মাছরাঙ্গা অুনরাগে। দিবাস্বপ্নে বিিকনি প্রলাপ
তবুও তোমাতে আমি পেয়েছি স্বাক্ষর মমতার।
চেয়েছি তোমাকে তাই বুকের নিভৃত পরিবেশে
দুহাতে ধারণ করে শুনাতে জাতির ইতিহাস।
`শেখ মুজিবুর রহমান’, স্বনিষ্ঠ সনেট
দিলওয়ারের বিভিন্ন কাব্যের কবিতার বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করলে খুব সহজে চোখে পড়ে তাঁর কবি হয়ে ওঠার বাস্তবানুগ পরিবেশ-প্রতিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার নানা গল্প ও স্বপ্নকথা। সুরমাপারের কবি নিজের বোধীসত্তার কাছে কিংবা রাষ্ট্রপিতার কাছে জিজ্ঞাসু ও কল্পিত মন নিয়েই কবিতার চাষ শুরু করেছিলেন, তরী ভাসিয়েছিলেন সেই পঞ্চাশের ভেলায়। তখন থেকেই কবিতার সৌকর্যে লালন করেছেন সাম্যিক দ্রোহ-সংগ্রামী চেতনা। কবিতার সাধনায় দীর্ঘপথ চলতে চলতে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে গণমুক্তির আকাঙ্ক্ষার দ্যোতক; হয়ে ওঠে গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামী সুর ও স্বর। ভাষাসংগ্রাম থেকে একাত্তর কিংবা এরও আগের দেশভাগের দাঙ্গার আগুন সবকিছুর প্রত্নচিহ্নই দেখি তাঁর কবিতার শরীরে লেগে আছে। পাক সামরিক সরকারের দুঃশাসনেরকালে পূর্বপাকিস্তানের রাজপথ যত আন্দোলন-সংগ্রামে উত্থাল হয়েছিল সেখানেও দিলওয়ারের চিরচেনা কবিতা কিংবা গানের সুর অধিকারহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে দীপ্ত হয়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দিলওয়ারের গান-কবিতা ভেসে আসত। মুক্তিবাহিনীর কাছে দিলওয়ারের গানের সুর রক্তজাগানিয়া প্রেরণা দান করত। তাঁর কবিতায় সমাজবোধ প্রকট। এই সমাজবোধের জায়গা থেকে দাঙ্গা, ভাষিক চেতনা, গণআন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধ সবখানেই গণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা, বিপ্লবীচেতনা উচ্চকিত হয়েছে। এজন্য তাঁকে ‘গণমানুষের কবি’হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে গণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুর ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কবিতায়।
Azir Hasib is writer, teacher and researcher.