দুহাতে আগুন নিয়ে কারা আজও

Share this:

কবিতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা

আমরা যে নানা কারণে ‘কবিতাভাবনা’ লিখি বা লেখার চেষ্টা করি, তা কবিতা লেখার বহু আগে থেকেই ভেবে রাখি, নাকি ভাবনা তৈরি করবার জন্য পূর্বলিখিত কবিতাগুলোর দিকে তাকিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে লেখা তৈরি করি?

এর উত্তর এত সহজ নয়, আর সহজ নয় বলেই সেটি লেখার পরে তারও অব্যাহত তাড়না রয়ে যায়। ফাঁক রয়ে যায় বলেই এই তাড়না, যে-ফাঁক কোনোদিনই পূরণ হওয়ার নয়। ফলে ভাবনা লিখিত হয়ে যাওয়ার পরে যতক্ষণ না সেই লেখা মুদ্রণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় ততক্ষণ ফাঁক-পূরণের যথাসাধ্য চেষ্টা চলতে থাকে। এ অনেকটা সেই পৌরাণিক পুরু দেয়ালকে ঘিরে মুক্তি লাভের জন্য ইয়াযুজ-মাযুজের চেষ্টার মতো – শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্ক তো আসলে তা-ই।

যারা এ-কথার বিরোধী, তারা নিশ্চয়ই এমনটি বলবেন যে, তাহলে লিখিত কবিতায় ইতিহাস সংস্কৃতি সভ্যতা প্রভৃতির প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ এবং বিমূর্ত স্পন্দনসমূহ শৃঙ্খলা পায় কী করে? এর উত্তর, এই শৃঙ্খলা বহুটাই ভাষার, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, শব্দের, একান্ত শৃঙ্খলা; বাকিটা ভাবের। কবিরা মুহূর্তের আলোড়নে অতীতে বা কোথাও-না-কোথাও গিয়ে ফের বর্তমানে ফেরার চেষ্টা করেন; হয়ত সফল হন, নয়ত ব্যর্থ, তবে সবসময় লড়াই করে চলেন কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাবর্তনের জন্য। আমাদের মনে পড়তে পারে জীবনানন্দের সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী উক্তি দুটি : ‘কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’ এবং ‘হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্য-বিকিরণ তাদের সাহায্য করছে’। এই উক্তি দুটির নিহিতার্থ স্পষ্ট করতে চাইলে বলতে হয়, এ-লড়াই সুদূর/বিধুর অভিজ্ঞতার ওপর নিজের অভিজ্ঞতা যুক্ত/আরোপ করার চেষ্টা, যা কবিতানিহিত উচ্চাকাঙ্ক্ষারই অংশ, কোনো অর্থেই অনপেক্ষ কবিতাভাবনার নয়। কারণ ভাবনার সঙ্গে ‘ভাব’-এর যোগ নয় শুধু, ‘ভাব-না’ বা ‘অভাব’-এরও পরকীয় সম্পর্কও রয়েছে। আকাঙ্ক্ষার সিংহভাগই ভাবগত, আর ভাবনাকে আমরা এজন্যেই স্বচ্ছ করে তুলতে চাই- যে, তা সেই দ্বন্দ্বেরই অংশ, যা কিনা ভাব ও বস্তুর সমন্বয়, যা শুধু তৈরি হতে পারে কবিতা লিখিত-হওয়ার-ঘটনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে, আগে নয়।

এরপরও স্বীকার করা উচিত, কবিতা বিষয়ের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিসর জটিল ও বিস্তৃত, তা সহজ পন্থায় বাঁধাই করা যায় না বলে সবসময় অসীম মনে হয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা কবির নিজ সত্তাকে ঘিরে সৃষ্টি হয় যদিও, তবু তা শুধু তার নিজের নয় : ক্ল্যাসিকের সঙ্গে একাত্মতাবোধ; পৃথিবী ও মহাজগতের সঙ্গে যোগাযোগ; মহামানবের অনুভব, ভাষা-চেতনার -হতে পারে নিশ্চেতনারও জগৎ আবিষ্কার, দৃশ্য ও অদৃশ্য অস্তিত্বের মর্মান্তিক লব্ধি -এই সবকিছুর দ্বন্দ্ব ও মিলন-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্যই উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্ম।

তাই আজ এই কথাটাই মনে হয় যে, কবি যখন শেষ পর্যন্ত কবিতাটি লিখে ফেলেন, তখনই শুধু তার মধ্যে ‘কবিতাভাবনা’র একটি বিশেষ রূপ ফুটে উঠতে পারে। এই কথাটি মনে থাকে না বলেই যারা জীবনানন্দের ‘কবিতার কথা’ বা কবিতাভাবী অন্যান্য প্রবন্ধকে তাঁর ‘কবিতাভাবনা’ ঠাউরে নিয়ে এর আলোয় তাঁর কবিতা বিচার করতে বসে পেরেশান হন, তারা আসলে ভ্রান্তির মধ্যে পড়েন। এগুলো জীবনানন্দের কবিতাভাবনা যতটা, তার চেয়ে বেশি কবিতাকে নিয়ে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। জীবনানন্দ অকালপ্রস্থান না-ঘটলে শেষপর্যন্ত কী রূপ নিয়ে যে প্রকাশিত হতো বাংলার বিধ্বস্ত নীলিমা বা রূপসী বাংলা, তা আন্দাজ করা সহজ নয়। কারণ এখন জীবনানন্দ-পাঠকের আর অজানা নয় যে রূপসী বাংলার ‘সার্বিক বোধে একশরীরী’ কবিতাগুলো লেখার সময়কার অন্য পাণ্ডুলিপিতে অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো কতটা ভিন্ন ভিন্ন শরীর নিয়ে লিখিত ও প্রকাশিত হয়েছিল!

ফলে, কবি যখন কবিতাভাবনা লেখেন বা কবিতা ভাবেন, তখন আসলে তিনি নিজের সেই জটিল ‘রূপ’ আবিষ্কারের জন্যে নিরন্তর যুদ্ধে নামেন। এই আবিষ্কারের কাহিনিতে যারা বিজ্ঞানীর ভূমিকা পালন করেন, তারা কবি নন, তাদের অধিকাংশই সেই সমারূঢ়-মাংসকৃমি-খুঁটে-দেখা সমালোচক; ছায়াপিণ্ড; বা তারই প্রতিচ্ছায়া। আবিষ্কারের গল্পে কবি  বিহ্বল ও বিস্মিত, ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা; তবে যা কাঙ্ক্ষিত – তিনি তখনো বস্তুপৃথিবীর প্রতি কোনোভাবেই অকাতর নন -এই সব নিয়েই কবির নিয়তি।

 

 

নেশা

তুমি শুধু পাথরের কথা ভাবো

আমার জলগমনের

জলভ্রমণের নেশা ধরে যায়

 

আমি তাই বিরলে বসে

একা একা মেঘসাঁঝ ডাকি

আর সেই সাঁঝে,

চরপথ ধরে

দল বেঁধে

লেঠেলেরা আসে

 

তারা মাটি খোঁড়ে,

তারা মাঠে ঝাঁপাঝাঁপি করে

 

আমি শুধু পাথরের কাছে বসে

কারও রূপ ধ্যান করি

আমার জলগমনের

জলভ্রমণের নেশা ধরে যায়

 

 

দুর্বোধ্য

কোথাও জঙ্গল নেই, তবু কারা পাতা

পুড়াতে এসেছে এই মাঘ-পূর্ণিমায়!

এই ভিড়ে কার ঘর আগুনে পুড়বে,

প্রকাশ্যে নামবে কারা আজ? ঠগী-বর্গী, ঘরেরই প্রহরী?

 

এই দৃশ্য দেখে আমি হয়েছি নির্বাক

খঞ্জ অন্ধ, পাথুরে রাস্তায়;

ইটপাথরেরও বহু আগে কত ধূলি-খড় ওড়ে,

কত স্মৃতি উড়ে আসে স্বাগত সন্ধ্যায়

 

এই ভিড় সমুদ্র ভেবে মনে মনে

ভেবে বসি অজলসমাধি!

 

দুহাতে আগুন নিয়ে কারা আজও

পাতার বদলে রোজ বাতাস পোড়ায়?

 

 

অদ্বৈত

পাতা ঝরে পড়ে

পাতা তবু রয়ে যায় ডালে

যতটা বোঝা যায়

ঠিক ততটা শোষণপ্রিয় শোধনপ্রিয় নয় মাটি

বহুশাখ গাছে তাই রয়ে যায়

পরকীয় গাঢ় গুঞ্জরণ

 

পাতা ঝরে পড়ে ঠিকই

তবু সেও অন্য ভাবে অন্য রঙে

রয়ে যায়, মিশে রয় ডালে

 

ভাবি তাই চিরশরণীয়া

পাতার অধিক তুমি পত্র বিরচিতা

 

পথে-পথে জনারণ্য

পথে শত ভিড়

তবু তুমি নবজন্ম, তবু তুমি চিরনির্জনতা

 

 

নজর

এই স্থানে, মাটির উপরে

কারও-কারও পড়েছে নজর!

দশ হাত উপরে তার মেঘের উচ্ছ্বাস

পরিণাম : ধীরে ধীরে প্রস্তরিত জল!

 

নাবাল জমির ক্ষত আরও বিশ্রী হলো

আর সেই নেতিপ্রেতিনীরা ডানা মেলে

উড়ে যায় বহুদূর প্রান্তরের দিকে

 

জলধ্যান অর্থ তবে হয়ে যাবে ম্লান?

 

এখানে রাস্তার পাশে হায়ওয়ানেরা

রোজ রোজ করছে গিবত :

‘সজল মাটির দিকে দুয়োরানী বাড়িয়েছে হাত’!

 

ফলে, বৃষ্টি-গাছ-পাতার প্রেরণা আমি

যতটুকু মনে আনি, তত সে দুরাশা

তবু মেঘেরা আজও সত্যকীর্তিময-

বাইরে উচ্ছ্বাসী, আর ভাবাভাবে বাধা

 

নাবাল মাটিতে কাল বৃষ্টি পড়বে কি না এখনো জানি না

 

 

জলের পাশে

এমন সামান্য জলে,

তাও এই কটু মাংসগন্ধরাতে,

আর কত খেলাধূলা যায়?

 

জ্যোৎস্নায় বাজি ধরে

সমুদ্রসারসীকে আজও পাওয়া যায় নাকি?

 

আমি গোপগাঁয়ের

নীল সারণির কোল ঘেঁষে

ন্যাড়া গাছটির নিচে

শত রীতি ইস্তফা দিতে বসেছি একাই

 

মনে তিক্ত কটু ঘ্রাণ,

বিচলিত করে

 

 

Mostak Ahmad Deen  is a poet, essayist, and editor. He has published several poetry books, translations, and numerous edited books. He has won the HSBC-Kali o Kalam (2012), Chinha (2016), Loke (2016), and Korus (2019) awards. He obtained his PhD From Assam University and now is Teacher and Controller of Examinations at Leading University in Sylhet, Bangladesh.

 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!