প্রশ্নোত্তর:
শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কীভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?
মিসবাহ জামিল: ষষ্ঠ শ্রেণির চারুপাঠে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘সততার পুরস্কার’ গল্প পড়ে প্রথম মনে হয়েছিল এরকম ত আমিও লিখতে পারব। কিন্তু লেখা হয়নি। সপ্তম শ্রেণির সপ্তবর্ণায় কিছু কবিতা/পদ্য পড়ে কবিতা লেখার ইচ্ছা জাগে। তখন ক্লাসে বসে প্রথম কবিতা লিখি। আশরাফুলও আবদাল নামের দুই বন্ধুকে দেখাই। তারা উৎসাহ দিয়েছিল। পরে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় অন্য স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করেন চাচা। এরপর ২০১৪ সাল পর্যন্ত আর কবিতা লেখা হয়নি। ওই বছরই অদ্ভুত কঠিন অসুখ হয়। মানুষজন ভেবেছিল, আমি আর বাঁচব না। আমাদের পাড়ায় আলোচিত ছিল আমার অসুস্থতার খবর। এতে আমার খুব মৃত্যু ভয় হচ্ছিল। আত্মীয়স্বজনরাও ভেবেছিলেন, আমি মরে যাব। এমন মরণাপন্ন অবস্থায় নেওয়া হয়েছিল হাসপাতালে। এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর সুস্থ হই।কিন্তু মৃত্যুভয় পিছু ছাড়ছিল না। বন্ধুদের সাথে মিশতাম না, খেলাধুলায় যেতাম না। মূলত মৃত্যুভয় আমাকে এসব থেকে দূরে রাখত।একা থাকতাম। গান শুনতাম বেশি বেশি। মৃত্যুভয়টা দূর করার জন্য। এরপর ২০১৫ সালের এপ্রিলে ফেসবুক একাউন্ট খুলি। তখন থেকে ফেসবুকেই বেশি সময় পার করতাম। কয়েকমাস পরে ২০১৬ সালের দিকে ফেসবুকে একটা ছোট কাগজের লেখা আহ্বান চোখে পড়ে। ওখানে শর্ত দেওয়া ছিল ১০০ টাকা দিতে হবে। বিনিময়ে ৫ কপি ছোট কাগজ দেওয়া হবে। কবিতা ছাপা হবে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে কবিতা লিখে পাঠালাম। সেখানেই প্রথম কবিতা প্রকাশ হয়।
শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষাশৈলির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী।
মিসবাহ জামিল: সমসাময়িকতার প্রশ্নে শঙ্খ ঘোষের দুটি কথা উল্লেখ করতে চাই। তার ভাষ্যমতে, ‘সমসাময়িক হবার জন্য কোনো স্বতন্ত্র চেষ্টার বা স্বতন্ত্র রূপের দরকার আছে বলে মনে হয় না। যেকোনো সত্যাশ্রয়ই কবিতাকে সমসাময়িকতা দেয় চিরন্তনের অভিমুখে।’ আমিও তাই মনে করি।
এবার আসি রাজনৈতিক বোধে। আমার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছি, ‘দেখাটুকু, অভিজ্ঞতাটুকু, অনুভূতিটুকু, ভালোলাগাটুকু নিজের মতো বর্ণনা করে কবিতায় রূপান্তর করতে চাই কেবল।’ এই দেখা, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি তৈরি হয় সমাজের শ্রেণিবৈষম্য, অবিচার,অনিয়ম দেখতে দেখতে। জাগ্রত হয় রাজনৈতিক বোধ। মনে হয় রাজনীতি করা খুব দরকার। সাম্যের রাজনীতি। কিন্তু আমার সংগঠন করতে ইচ্ছা হয় না দুই কারণে। প্রথমত, রাজনীতিকদের সাথে বোঝাপড়ায় মিল পড়ে না। হয়ত আমার ব্যর্থতা এটা। দ্বিতীয়ত, আমি চাই না কোনো সংগঠনের অধীন হয়ে পরাধীন হতে। এর চেয়ে নিজেরেই সংগঠন ভাবতে পছন্দ করি। এজন্য হয়ত কিছুটা হলেও রাজনৈতিক বোধ কবিতায় চেপে বসে বা বসেছে।
তারপর বলি, নিজস্ব ভাষাশৈলির কথা। উপরে বইয়ের ভূমিকার যে লাইনটা উল্লেখ করেছি সেটা এই প্রশ্নেও প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।বিভিন্ন বিষয়কে নিজের মতো বর্ণনা করে নিজস্ব ভাষাশৈলি দাঁড় করাতে চাই বা চেয়েছি মাত্র।
শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
মিসবাহ জামিল: আমি শ্লীল অশ্লীলের ধার ধারি না, ধারতে চাইও না। আমার যা ইচ্ছা তা বলব, লিখব। সেটা কবিতায় হোক আর গদ্যে হোক। শ্লীল-অশ্লীল নিয়ে চিন্তার দরকার মনে করি না। যদিও এসব ব্যাপার নিয়ে হাউকাউ শুরু হয় আমাদের সমাজে। এখানে মুক্তমনাদের চেপে ধরার একটা সংস্কৃতি বিদ্যমান। কয়েকমাস আগে একজন আমার কবিতার প্রশংসা করলেন মেসেনজারে। বললেন, তিনি দেখা করতে চান। তার সাথে দেখা করি। নামাজ-রোজা করি কিনা, জিজ্ঞেস করলেন। এক পর্যায়ে বললেন, ‘পুণ্যভূমিতে থেকে তসলিমা নাসরিনদের মতো অশ্লীল হতে পারবে না। এসব করতে হলে ঢাকা বা কলকাতা যেতে হবে।’ কথাগুলো আমাকে খুব কষ্ট দেয়। ভাবি আমি কি এখানের শরণার্থী? যে আমাকে একজন মানুষ এরকম বলতে পারে! মর্মাহত হই, পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, যাই। কিন্তু যখন দেখি এসব ব্যাপারে অধিকাংশ প্রগতিবাদীও আপত্তি করেন, আমাকে হতাশ হতে হয়। ভাবি তাদের প্রগতির সংজ্ঞাটা আদতে কী? ভেবে মূর্ছা যাই।
শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে কোনো সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।
মিসবাহ জামিল: বর্তমান কালের কথাই বলি। এখন ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে, চর্চা হচ্ছে বলা যায়। কবিতার ধরনের ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। সেটা কেবল বাংলাদেশে নায়, পশ্চিমবঙ্গেও হচ্ছে। পঞ্চপাণ্ডব পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ যে গ্রন্থগুলো রয়েছে, সেগুলোর স্রষ্টাদের কবিতাযাত্রা শুরু হয়েছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ দুই জায়গাতেই। মতিন বৈরাগী একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘মূলত পঞ্চাশের দশকই আমাদের কাব্য আন্দোলনের গতি, প্রগতি ও আধুনিকতার ভিত্তি তৈরি করে দেয় এবং পরবর্তী দশক ষাটের অধিকতর তরুণ কবিদের জাগরণকে নিশ্চিত করে’। যদিও সেসব কবিদের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর বিচারে তাদের পঞ্চাশ কিংবা ষাটের কবি নামক বৃত্তের ভেতরে রাখা যাবে না বলে মনে করি। শঙ্খ ঘোষের ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ প্রকাশ হয় ১৯৯৪ সালে, সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’ প্রকাশ হয়েছে ১৯৯১ সালে, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহিন ভিতর’ প্রকাশ হয়েছে ১৯৮০ সালে। কিন্তু তাদের চিহ্নিত করতে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কথা উল্লেখ করা হয়। ওই সময়টায় তাদের কবিতাযাত্রায় প্রবল সম্ভাবনার ছাপ ছিল বলেই হয়ত। আমি দ্বিতীয় দশকে কবিতাযাত্রা শুরু করা কয়েকজন কবির মাঝে সেই প্রবল সম্ভাবনা দেখতে পাই। মনে করি তারা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন।
শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।
মিসবাহ জামিল: সাম্প্রতিক সময়ে আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বইটা হলো জফির সেতুর দীর্ঘ কবিতার বই ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’। বইটা সম্পর্কে আমাকে বলেন, ইয়ার ইগনিয়াস ভাই। তারপর জফির সেতুর কবিতাসমগ্র সংগ্রহ করি। সেখান থেকে প্রথমেই পড়ি ‘ডুমুরের গোপন ইশারা’।এক বসাতে পাঠ শেষ করতে পেরেছিলাম। বলা যায়, একটা ধ্যানের ভেতর ঢুকে গিয়েছিলাম। বইটা আমাকে ফ্রেশনেস দিয়েছিল অন্তর্গতভাবে।
কবিতা:
ডালে বসে গান গাব
ডালে বসে গান গাব, খাবার খোঁজার চিন্তা ভোলে
ক্ষুধা পেলে খেয়ে নেব, পৃথিবীর শস্য, পোকাগুলো-
এমন সুদিন কবে আমার নিকটে ধরা দেবে?
তুমুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছি সুদিনের
মানুষ ঘুমালে রাতে জুতা যেলা অপেক্ষায় থাকে
আধার আনতে গেলে বাবুইয়ের বাচ্চা যেলা ডাকে
সেরকম বসে বসে সুদিনেরে নিকটে ডাকছি…
শুনেছি সুদিন আসে, তবে তার গতি কাছিমের
‘সবুরে মেওয়া ফলে’ -এ কথায় রাখছি ইমান
অপেক্ষায় দিনগুলো ফুলের মতন বাসি হয়
বঁড়শি সুতার মতো জীবনেও বেরা লাগি যায়
খুব সুক্ষ্ণ মনোযোগে খোলবার চেষ্টা করে যাই…
বেঁচে থাকি। পৃথিবীটা যেন এক হাজিরার খাতা
প্রত্যহ পায়ের ছাপে উপস্থিতি নিশ্চিত করছি…
লেপা আছি তীব্র অপবাদে
মনে হচ্ছে লেপা আছি তীব্র অপবাদে
পরীক্ষায় ফেল করা শিশুর মতন।
কিছুই করার নেই, চিন্তা করছি
কিছুই খাওয়ার নেই, হিমশিম খাচ্ছি
কোথাও যাওয়ার নেই, মৃত্যু-দিকে যাচ্ছি
প্রেমে যায়, থেমে যায়, ঘেমে যায় দিন
মাঝেমধ্যে ঝেকে বসে এত অস্থিরতা!
মনে হয় বক্ষঃস্থলে ফিঙে নাচতেছে
নিজেকে আন্দাজ করি এতই ভঙ্গুর
মনে হয় মরে যাব, বাতাসে হঠাৎ
দপ করে ফুল ঝরে পড়ার মতন
আর ভাবি মৃত্যু পরবর্তীকাল নিয়ে-
আমি মরে গেলে স্মৃতি ঠিক রয়ে যাবে
যেমন রসিদ থাকে টাকা আদায়ের
পরিবার
আমাদের পরিবার এতই সুন্দর ছিল। মানুষ ঈর্ষা করত, আমাদের পরিবার ভাঙে না কেন। যেন মানুষের ঈর্ষাই আমাদের পরিবারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল প্রসাধন দ্রব্যের মতো। শেষে ভেঙে গেল। বুঝতে পারি পরিবারের সঙ্গে আয়নার মিল রয়েছে। দুইটাই ভেঙে গেলে জোড়া লাগে না। জোড়া লাগানোর চেষ্টা করলেও ফাটলের দাগ দৃশ্যমান রয়ে যায়।
সুমনা বিশ্বাস
সুমনা বিশ্বাস যদি আন্ধারে দাঁড়ায়
মনে হবে এই যেন চাঁদ। আর তাকে
লুকাইতে পুরোদমে ব্যর্থ অন্ধকার
এমন দারুণ তার রূপের বয়ান
তাকে দেখে মারাত্মক মোহগ্রস্ত হই
মার্বেলের মতো হই ভারসাম্যহীন
গড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা পেয়ে বসে
গড়িয়ে গড়িয়ে যাই এদিক ওদিক
মনে হতে থাকে কেউ খেলছে আমাকে
মার্বেল হিশেবে তার ব্যবহার করে
আমার ত ইচ্ছা নায় খেলনা হওয়ার
যেহেতু আমিও এক পাক্কা খেলোয়াড়
কাস্তের দানার মতো ধার ভাষা দিয়ে
মরমে আঘাত করে স্থান পেতে চাই
চৌহাট্টা
চৌহাট্টা মোড়ে গিয়ে রঙ বেরঙের নারী দেখি। পেট ভরে না, মন ভরে। মন ভরলেই পেট আংশিক ভরে যায়। টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেলে মনে দোল খায়। গতিরোধক পার হওয়ার সময় যেলা দোল খায় রিকশায় চড়া নারীর বক্ষবন্ধনীহীন স্তন। আমি প্রেমে ভেসে থাকি। যেন এক ভেলা। ডুবে যাওয়া আমার স্বভাব নায়। আমার স্বভাব ভেসে থাকা, ডোবার পর ভেসে ওঠা।
উল্লাপাড়া
আমাদের মধ্যে বিয়োগচিহ্ন হয়ে বসল ইসরাতের বাবার বদলির খবর। বাবার চাকরির বদলি হওয়ায় উল্লাপাড়া চলে গেল ইসরাত জাহান। সেই থেকে উল্লাপাড়া নাম চিনা জোঁকের মতো মনে ধরেছে। কোথাও বেড়াতে যাই না যাই উল্লাপাড়া যাব। আমার সংশয় হয় তার বাবার চাকরির বদলির মতো আামদের প্রেমও বদলে গেল কিনা। তাই সংশয়কে কাগজের মতো মোচড় দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে উল্লাপাড়া যাওয়া দরকার। আমার সুখের ঘ্রাণ; ইসরাত জাহান।
শান্তিগঞ্জ
আমার পছন্দ আলাভোলা মেয়ে। শান্তিগঞ্জ সেরকম সুন্দর। তার শরীল ভালো লাগে। জল, হাওর, হিজল-করচ বাগ আর উর্বরতায় সুগঠিত সে। একা লাগলে তার কাছে যেতে মনে চায়। ইদানিং নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে। ধানকাটা শেষে কৃষকের ভুলবশত খেতে রয়ে যাওয়া কোনো ধানের আঁটির মতো একা। আমি শান্তিগঞ্জে যাব। ‘মরণ বারণ হবে তার দরিশনে।’
অসাধারণ ছিলো প্রতিটা শব্দ প্রতিটা শব্দের লাইন।
ভালো লাগলো কবিতাগুলো।
মিসবাহ জামিল – আপনার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা রইলো।