দ্বিমুখী আয়না
এই ঘোর সন্ধ্যাবেলাতেও কালো রে-ব্যান সানগ্লাসে চোখ ঢেকে রেখেছেন তিনি। মাঝে মাঝে চোখ ঢেকে রাখাটা তার অভ্যাস। চোখের মানবিক এক্সপ্রেশনগুলো ঢেকে রাখতে চান। সেখানে দিন কি রাত এটা ম্যাটার করে না। কোনোরকম মানবিকতা প্রকাশ পেলেই যেন তিনি দুর্বল হয়ে পড়বেন অন্যের সামনে। এটা তিনি চান না।
আবছা আলো, বাইরে বৃষ্টি আর তার সামনে রাখা এসপ্রেসো কফির মগ থেকে ওঠা ধোঁয়ায় মিলেমিশে এক অদ্ভুত মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অফিস রুমের প্রশস্ত কাচের জানালায় আছড়ে পড়ছে গুঁড়ো কাচের মতো বৃষ্টি। মগজে ঢু মারছে আবুল হাসানের কবিতার লাইন, ‘আমি জানি তোমার স্তনেরও পরিমাণ আর্শির নিকটে জমা আছে’। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আবুল হাসানের কবিতা পড়তেন। আবুল হাসান, রুদ্র তখন ক্রেজ, কবিতা ছাড়াও তাদের প্রেম ও বোহেমিয়ান জীবনযাপনের জন্য। গল্প, আড্ডায় বা তর্কবিতর্কে ওসব রেফারেন্স না জুড়লে ব্যাকডেটেড, ক্ষ্যাত টাইটেল জুটে যেত। কী দুর্দান্ত একটা সময় ছিল। সব যেন আজ এক ভারি পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে। যে পাথর আর নড়ানোর সাধ্য তার নেই। পাওয়ার প্রাকটিসের ইদুর দৌড়ে সব মানবিক বিষয়-আশয় বিলীয়মান হয়ে গেছে।
হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকালো। এই শব্দের ক্ষিপ্রতা এক ঝটকায় তাকে আবার নিয়ে এলো বর্তমান বাস্তবতায়।
আজ অনেকদিন পর এত বৃষ্টি কেন পড়েছে, তাও আাবার বজ্রসহ! বলতে গেলে এ বছরের প্রথম ভারি বৃষ্টিপাত আজই হলো। অন্যদিন হলে এই বৃষ্টি তাকে স্বস্তি দিত, কিন্তু আজ রাজ্যের অস্বস্তি বয়ে এনেছে। একটা অপারেশনে যাওয়ার কথা তার টিমের। বৃষ্টির কারণে আবার অভিযানটা ভেস্তে না যায়!
এমন সময় জুনিয়র কমান্ড সাইফুল রুমে ঢুকল।
অপারেশন সাকসেসফুল বস!
ওহ্ গ্রেট! আমি ভেবেছিলাম বৃষ্টিটা আবার বাগড়া হয়ে না দাঁড়ায়। যদিও প্রপোজালটা রোমান্টিক। এমন একটা বৃষ্টি বিষয়টা আরও মধুর করে তুলত নিঃসন্দেহে। বাট যার যা ভবিতব্য। এনিওয়ে, ওয়েল ডান সাইফুল, এরকমটাই চেয়েছিলাম আমি। শিকার স্বেচ্ছায় এসে জালে ঢুকবে।
থ্যাংক ইউ বস।
কিন্তু একটা বিষয়ে খটকা রয়েই গেছে। খুব ইন্টেলিজেন্ট ভেবেছিলাম লোকটাকে, বাট ইমোশনাল ফুল নিকলা! বলে একটু ব্যাঙ্গের হাসি হাসলেন তিনি। কীভাবে সম্ভব হলো বলো তো?
ওই যে বললেন ‘ইমোশনাল ফুল’। ইমোশনাল এটাচমেন্টটা এড়াতে পারে নাই। একটু বেশিই ইনভলভড হয়ে পড়েছিল।
বলো কী! প্রতিভাবান, ক্ষমতাবান, বিত্তবান পুরুষের অসংখ্য নারী ভক্ত থাকবে তাদের কি এভাবে দুর্বল হলে চলে?
ওনার তাড়নাটা হয়তো একটু বেশি ছিল, ভক্তের সংখ্যাও বেশি কিনা! নারী ভক্তদের সঙ্গে ফ্লার্ট করত অনবরত। কেউ একজন লেখার প্রশংসা করল, তো কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হলো ফ্লার্ট করা। এবং এটা করতে করতে কী অবলীলায় শোয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসত আপনি ভাবতেও পারবেন না বস! আর সে জায়গায় ইনি তো যেনতেন কোনো নারী না, সাক্ষাৎ নায়িকা!
হুম। এরা যে কেন বুঝতে পারে না, এসব সাইবার স্পেস মূলত দ্বিমুখী আয়না! কালোচশমার মুখে বিজয়ের গৌরব স্পষ্ট। বললেন, হোয়াট এবাউট অনিন্দিতা?
এখনও চুপ আছে।
চুপ থাকতেই হবে। এতদিনে ভেতর, বাহির, অন্তর ধরে টান মারা গেল।
চুপ থাকার অন্য আরেকটা কারণ আছে বস, ওটাই মোক্ষম।
কী কারণ?
হতে পারেন তিনি সুন্দরী অভিনেত্রী, কিন্তু বড়শিতে হাজবেন্ড নামক তিমি মাছটা গাঁথতে তাকে তো কম বেগ পেতে হয় নাই! এখন যদি এরকম একটা স্ক্যান্ডাল সামনে এসে যায়, তাহলে তো আম ছালা দুটোই যাবে।
লেখকের একটা ওয়েব সিরিজে অনিন্দিতা মেইন কাস্ট। এটা খুব ইন্টারেস্টিং না! নায়িকাদের মূলত সম্পর্ক থাকে পরিচালক-প্রযোজকদের সাথে। সে কেন স্ক্রিপ্ট রাইটারের সাথে সম্পর্ক করতে গেল?
লেখক তো লীলাখেলা জানে। আপনি তো সব জানেনই বস।
জানে বলেই তো, তার সব দোষ ছাড়িয়ে এটাই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। হোয়াই অনিন্দিতা, হোয়াই? দেশে কি আর কোনো নায়িকা ছিল না! তার সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটাতে কেন হাত বাড়াবে সে! মনে মনে বললেন কালোচশমা।
বিসাইড দ্যাট, উনি মিডিয়া ওয়ার্ল্ডে বেশ প্রভাবশালীও। পরিচালকের কাছে তার কথার গুরুত্ব আছে। তিনি একটা কাস্ট করতে বলবেন, বা বিশেষ কাস্টিংকে ভেবে লিখবেন, আর সেটা ওই পরিচালক মানবে না এমন হওয়া অসম্ভব! তাছাড়া এরা এক একটা জোট। লেখক-শিল্পীদের একেকটা জোট থাকে না! পিঠ চুলকানো জোট, আদর্শিক জোট, রাজনৈতিক জোট। এরা মুখে বলে বেড়ায় প্রতিটি লেখকই একা। সবার মধ্যে থেকেও নিঃসঙ্গ। ‘মিছিলে মিছিলেও একা’! সব ভুয়া কথা। এদের মতো দলবাজ, এদের মতো আড্ডাবাজ, ফুর্তিবাজ কখনও কখনও ধান্দাবাজ আপনি কোথাও খুঁজে পাবেন না।
কালো চশমাটা নাকের সাথে ঠেসে দিতে দিতে তিনি ভাবলেন, অনিন্দিতার মতো একজন নারীর পক্ষে এরকম নন গ্লামারাস চেহারার একজনের প্রেমে পড়া কীভাবে সম্ভব! কালোচশমার মুখে এক বিষাদমাখা বিস্ময়! অনিন্দিতাকে সে ভীষণ পছন্দ করে। অনিন্দিতার বক্ষ সৌন্দর্য তাকে মহাভারতের নারী চরিত্রগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। পীনস্তনী, সুস্তনী পীনশ্রোণীপরোধরা- আরও কী কী যেন আছে না! নামকরা এক কবি তাঁর কবিতার বইয়ে লিখেছিলেন, শৈশবে মা হারিয়েছেন, মাতৃদুগ্ধ বঞ্চিত হয়েছেন তাই হয়তো নারী স্তনের প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ বরাবর। এজন্যই স্তন নিয়ে তিনি একটা গোটা কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন। কীসের সাথে কীসের তুলনা! এই কবিদের মাথায় কী যে থাকে!
কালোচশমার এই ধরনের কোনো অপ্রাপ্তি নাই, তবে নারী স্তনের প্রতি তার আছে এক দুর্বিনীত আকর্ষণ। অথচ প্রেমিকা, বা স্ত্রী কাউকেই পীনস্তনী পান নাই। ফ্যাশনেবল ফোমড ব্রা খুললেই হয় সাহারা মরুভূমি আর নয়তো ঢলঢলে নরম মাটির দলা! অথচ কত হাজারো নারী শরীর যেন ক্লে দিয়ে তৈরি মোলায়েম অথচ স্ট্রং।
সাইফুল জানে কালোচশমার অনিন্দিতার প্রতি একটু দুর্বলতা আছে। এটা একেবারে ভেতরের কথা। তার জানার কথা নয়। তবে তার স্ত্রী শিপ্রা নাকি কোন এক পার্টিতে কালোচশমার স্ত্রীর মুখে শুনেছে অনিন্দিতার প্রতি তার স্বামীর মুগ্ধতার কথা। যদিও অনিন্দিতাকে তার স্ত্রী সুন্দরী মনে করেন না। এটা খুব স্বাভাবিক, স্বামী যার প্রতি মুগ্ধ, সেই নারীর হাজারো খুঁত পজেসিভ স্ত্রীর চোখে পড়ে যায়। সাইফুলের ধারণা কালোচশমা হয়তো ট্রাই করেছিলেন অনিন্দিতাকে বাগে আনার কিন্তু পারেন নাই। আচ্ছা অনিন্দিতা কি এতটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে! নাকি কালোচশমার ওই ভুঁড়িওয়ালা ষন্ডামার্কা লুক অনিন্দিতাকে ঠিক ইমপ্রেস করতে পারে নাই! স্বভাবসুলভ কাঠিন্য ভেঙে তিনি তাই অনেক কথাই জিজ্ঞেস করে ফেলছেন আজ!
শুধু কি ওয়েব সিরিজে চান্স পাইয়ে দেয়া, নাকি আরও কোনো কারণ থাকতে পারে লেখকের সাথে অনিন্দিতার সম্পর্কের? মেইল, চ্যাট মেসেজ ইত্যাদি থেকে আর কী কী উদ্ধার করতে পারলা সাইফুল?
লেখক সাহেব অনিন্দিতাকে নিয়ে একশো একটা কবিতা লিখেছেন বস। যেখানে শুধু তার সৌন্দর্যের প্রশংসা বাদ দিয়েও, আছে অনিন্দিতার প্রতি তার প্রেম, যৌন আকাঙ্ক্ষা, যৌনাচার ইত্যাদি।
যৌনাচার শব্দটা কালোচশমাকে যেন ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে চুরমার করে ফেলল। প্রবল বিতৃষ্ণায় যেন দূর থেকে সাইফুলের দিকে ছুড়ে দিলেন শব্দটা, ‘যৌনাচার’?
ওই আরকি বস। বইটা এবার বইমেলায় বেস্টসেলার ছিল। যদিও কবি বইয়ের কোথাও অনিন্দিতার কথা উল্লেখ করেন নাই, পাঠকের পক্ষেও বোঝা সম্ভব হবে না। আমরাও কি বুঝতে পারতাম যদি কনভারসেশনগুলো না দেখতাম! তবে অনিন্দিতা বারবার ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকতে চেয়েছে, কিন্তু কবিতা তাকে কাছে এনে দিয়েছে। নিজের এমন প্রশংসা শুনতে কার না ভালো লাগে বলেন!
কিন্তু আমি তো দেখেছি ওখানে গুম নিয়ে কবিতা আছে।
গুমের শিকার হওয়া মানুষদের কি প্রেম থাকে না? আত্মীয়-পরিজন সংসার থাকে না? থাকে না একজন প্রেমিকা?
থাকতে পারে। কিন্তু এইসব প্রশংসাবাণীর স্ক্রিনশট দিয়ে নিশ্চয়ই অনিন্দিতাকে ম্যানেজ করা যায় নাই!
সত্যিই তাই। কারণ লেখকের সাথে অনিন্দিতা কোনো হোটেল, রিসোর্ট ইভেন কি তার বাড়ি বা লেখকের নিজের ফ্ল্যাটেও দেখা করেন নাই।
তাহলে কী করে সম্ভব হলো? যেখানে পুরোটাই ভার্চুয়াল প্রেম! হতে পারে প্রেমের অভিনয়!
অভিনয় না বস। কালোচশমার এই দুর্বল জায়গাটাতে খোঁচাতে সাইফুলেরও এখন ভালো লাগছে। যদিও অনিন্দিতা লেখকের সাথে তার কোনোরকম রোমান্টিক রিলেশনের কথা স্বীকার করে নাই, তবুও কালোচশমাকে সাইফুল এখন একধরনের ইমোশনাল চাপে রেখে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করছে। সে তার প্রটোকলের বাইরে গিয়ে বলছে, ‘সত্যি প্রেম বস। আর ছিল ভার্চুয়াল সেক্স। আমরা সেক্স চ্যাট এর স্ক্রিনশট শো করেছি! এত জীবন্ত রগরগে বর্ণনা যে ওটা পড়লে আপছেই অর্গাজম হয়ে যায়। মাস্টারবেশন লাগে না।
কালোচশমাকে এখন একটা পরাজিত সিংহের মতো লাগছে দেখতে। আহা চোখ দুটো যদি একবার দেখা যেত!
কালোচশমা খনখনে গলায় জানতে চাইলেন, আর সেই স্ক্রিনশট দেখাতেই অনিন্দতা রাজি হলো?
দেখানোর সাথে সাথে অনিন্দিতা চমকে উঠেছিলেন। তারপর দীর্ঘ নীরবতা। যেন কোনো যোগ বিয়োগের হিসাব মেলালেন। তারপর গলায় বরফের শীতলতা ঢেলে দিয়ে শুধু বললেন, ‘কী করতে হবে আপনাদের জন্য’?
তবে চ্যাট মেসেজগুলো পুরোটাই বানোয়াট না, শুধু লেখকের বদলে অনিন্দিতার সাথে অন্য একজনের সাথে রগরগে সেক্সচ্যাট দেখিয়েছে তারা।
মিডিয়া জগতে একজন অনিন্দিতাকে যে কতরকম উইয়ার্ড হ্যান্ডেল করতে হয়!
এটা অনিন্দিতা যেমন জানে, তেমন জানে সাইফুলরাও। এক্ষেত্রেও অনিন্দিতার ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু আসল কথাটা কালোচশমার কাছে ডিসক্লোজ করল না সাইফুল। এই লোকের দুর্বল জায়গাটায় যত আঘাত করছে, তত ভালো লাগছে তার।
অনিন্দিতা যখন ফাঁদে পড়া পাখির মতো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে জানতে চাইল, কী করতে হবে আপনাদের জন্য?
তখন তারা বলল, কিছু না ম্যাম, আপনি জাস্ট ফোন করে বা মেসেজ দিয়ে লেখক সাহেবকে ডাকবেন মিট করার জন্য।
অনিন্দিতা এবার প্রায় আর্তনাদের স্বরে বললেন, তারপর আপনারা কী করবেন তাঁর সাথে?
কিছু না। জাস্ট একটু আলাপচারিতা।
আপনাদের আলাপচারিতার মধ্যে আমাকে কেন জড়াচ্ছেন?
আপনারা তো সরাসরি তার সাথে মিট করতে পারেন।
দ্যাট ইজ নান অফ ইওর বিজনেস। আপনাকে এখন আমাদের স্ক্রিপ্টে অভিনয় করতে বলছি, জাস্ট ওটা করবেন।
অনিন্দিতা এরপর আর কোনো তর্কে যাওয়ার সাহস পেল না। আর্তনাদটা গিলে ফেলে ভারি গলায় শুধু বলল, কখন ডাকতে হবে?
বেটার টুডে অ্যাট ইভনিং।
এই আইডিয়াটা তোমরা খুব ভালো বের করেছ। সাদা, কালো বা নীল পোশাকে কেউ তাকে তুলে নিয়ে যায় নাই। নো সিসিটিভি ক্যামেরা, নো লাইভ স্কোপ। জাস্ট লেন্সের বাইরে কট।
কিন্তু বস সোশ্যাল মিডিয়ায় তো এটা নিয়ে খুব হইচই হবে, যখন তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এত দ্রুত জানাবেটা কে?
উনার স্ত্রী স্যার।
এরপরও উনার স্ত্রী জানাবেন?
এত এত নারী সংসর্গ, তিনি ঈর্ষান্বিত হবেন না, শোধ নিতে চাইবেন না?
এরা উদার স্ত্রী বস।
হ্যাঁ তাই তো দেখছি! আপছে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে পড়ে কালোচশমার ভেতর থেকে। বুঝতে পারি না স্ত্রীকে কী বলে বুঝ দেয় এরা!
হয়তো এরা স্ত্রীকে বলে, প্রেম ছাড়া লেখা আসে না। নতুন নতুন গল্প, কবিতার জন্য নতুন নতুন প্রেম। সাথে আসে ফেম।
এরপর উনারা আর ঝামেলা করে না। আর কথা বলে না। নইলে এসব সম্পর্ক টিকে থাকে কী করে!
আর ইউ শিওর? তাহলে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জন্য এরা কী করে, রাজনীতি?
মানুষ তো জন্মগতভাবেই রাজনৈতিক জীব। সব সময় রাজনীতি তো করা লাগে না। ওটা আসে দায়বদ্ধতা থেকে।
সব রকম দায়বদ্ধতা এনারাই কেন কাঁধে নিয়ে ঘোরেন বলো তো? জানে এতে রিস্ক আছে। যেমন আছে প্রেমে, তেমন আছে সামাজিক দায়বদ্ধতায়। তারপরও এরা এটা করবে। এই একটা জায়গাতেই জানো, উনাদের অন্য দোষগুলো ম্লান হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ তাদের জন্য কাঁদে। যা আমাদের জন্য সামাল দেয়া একটু কঠিন হয়ে যায়। আচ্ছা উনার আন্তর্জাতিক লিংক-আপ কেমন?
আছে বস, বেশ ভালোই।
কালোচশমা নিচু স্বরে বললেন, তেমন কিছু করার অর্ডার যদিও নাই, জাস্ট একটু চাপে রাখা। এদের বিষয়ে সিস্টেম কী বলে জানো তো, বেশি ভয়েস এরাইজ করলে ‘কিপ দেম শাট’।
যদি চাপ আসে, সে ব্যবস্থা তো করাই আছে বস। যদিও এসব স্ক্রিপ্ট আজকাল কেউ আর বিশ্বাস করে না। তবুও কোনো এক রিসোর্টে অনিন্দিতাসহ খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁকে। লাইভে রগরগে উদ্ধার অভিযান দেখানো হবে।
সাইফুল কথাটা বলতেই কালোচশমার মুখটা মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল। তার মুখের টানটান পেশিগুলো যেন ঝুলে পড়েছে। বয়সটাও খানিকটা বেশি দেখাচ্ছে।
অনিন্দিতার প্রতি তাহলে তার মোহ না শুধু, আছে প্রেমও। সাইফুলের করুণা হয় লোকটার প্রতি। অনিন্দিতারা এতজনের হৃদয় হরণ করে বসে থাকে, অথচ নিজের হৃদয়টা বেঁধে রাখে ভিন্ন তারে! টাকা, ক্ষমতা সে ঝংকার ছুঁতেই পারে না। এ লোকটাকে সে কথা কে বোঝাবে!
কালোচশমার চোখেমুখে অস্বস্তির চিহ্ন স্পষ্ট। হাতে থাকা কলমটা কাচের টেবিলে আলতো করে ঠুকতে ঠুকতে ভাবছেন, অনিন্দিতার হয়তো এক্ষেত্রে হারানোর কিছু নাই, লেখকের জনপ্রিয়তায়ও পড়বে না কোনো ভাটা, তবে তার ভেতরটা কেন এমন করছে! এসব ক্ষেত্রে এর আগে সোজাসাপটা ডিসিশন নিতে কোনো বেগ পেতে হয় নাই। তবে এবার কেন একটা সূক্ষ্ণ তারের ওপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে তাকে! স্ক্রিপ্টের বাইরে গেলে বিষয়টা আরও ভোঁতা আর দুর্বল মনে হতে পারে। তবু কালোচশমা গলার স্বরে কোনো রকম পরিবর্তন না এনে, সব রকম গাম্ভীর্য অটুট রেখে বললেন, অনিন্দিতা না। অনিন্দিতাকে এর মধ্যে আর টানা হবে না, ও-কে!
সাইফুলের মেজাজটা হঠাৎ খিঁচড়ে গেল। যদিও সে আগে থেকেই জানত, কোথাও স্বার্থের একতিল ছাড় দেবে না এই লোকটা!
কালোচশমা কি থট রিডিং জানে! সাইফুলের ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে কি তার ভেতরের বিরক্তি ফুটে উঠেছে? নইলে যেন খুব একটা জুতসই অজুহাত খুঁজে পেয়েছেন এমন ভঙ্গিতে তিনি কেন বললেন, ‘ঘুড়ি কাটার জন্য কেউ নাটাই হাতছাড়া করে না, বুঝলা সাইফুল! এটা সব সময় মনে রাখবা। তাইলেই ক্যারিয়ারে উন্নতি, জীবন হবে স্মুথ’।
‘স্মুথ লাইফ মাই ফুট’, সাইফুলের মুখ ফসকে প্রায় বের হয়ে আসছিল কথাটা, কিন্তু কিছু না বলে গিলে ফেলে সে তার মুহূর্তের দুর্বলতা। একটা সো কলড স্মুথ লাইফের জন্য কী কী না করতে হয় তাদের!
কী ভাবতেছ সাইফুল?
কিছু না বস। সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করে সে।
শোনো সাইফুল, তুমি বরং এটাকে একটা খেলা হিসেবে নাও। দেখো, নিষ্ঠুর এবং ঝুঁকিপূর্ণ খেলাগুলোও কিন্তু খেলাই। ভালো হয়, এই মহান লেখককে নিয়ে খেলার পরবর্তী পর্ব বা এক্সিট পয়েন্ট হিসেবে যদি একজন প্রফেশনাল সোসাইটি গার্ল খুঁজে বের করো।
প্রশ্নোত্তর
শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?
গাজী তানজিয়া: মানুষের জগৎ মূলত গল্পের জগৎ। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গল্প। তার ভেতর থেকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় হয়তো আমার কাছে গল্পের রসদ হয়ে ধরা দেয়। গল্পের সেই উপাদানকে ছেঁকে তুলে ব্যাখ্যাপ্রবণ করে তোলার তাগিদ থেকে আমার গল্প লেখার শুরু। তাছাড়া সাহিত্যের যতগুলো মাধ্যম আছে তার মধ্যে গল্প আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবেগ, অনুভূতি, সংগ্রাম, প্রতিবাদের ভাষা যত তীব্রভাবে গল্পে উপস্থাপন করা সম্ভব তা হয়তো সাহিত্যের অন্য কোনো শাখায় করা সম্ভব নয়। আমি মনে করি প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবে অনুভূতিসম্পন্ন, সংবেদনশীল, কল্পনাপ্রবণ, প্রতিবাদী বা কখনও সংগ্রামী। কেউ তার মত প্রকাশের জন্য সংগঠন তৈরি করেন, কেউ রাজনীতি করেন, কেউ হয়তো কিছু করার কথাই ভাবেন না, আর কেউ কেউ লেখেন। সবাই লেখেন না। কারণ আমি মনে করি লেখাটা (ফিকশনের ক্ষেত্রে) তীব্রভাবে কল্পনা ও বাস্তবের মিশেল। লেখক যখন নানাবিধ মানসিক চাপ থেকে লিখতে বসেন তখন তার প্রথম কাজ হলো নিজেকে অবমুক্ত করা। লেখার মাধ্যমে লেখক তার একান্ত অনুভূতি, যন্ত্রণা, আবেগের একটি বস্তুগত আকার যেমন দেন, তেমনি সাহিত্য যেকোনো অসংগতিকে চিহ্নিত করার বা তার বিপরীতে সোচ্চার হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
আর গল্প লেখার ক্ষেত্রে এই প্রতিটি তাগিদই আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুভব করেছি। আমরা এখন যে সময়টাতে দাঁড়িয়ে আছি, এই সময়টাতে ব্যক্তি বা একটি জনগোষ্ঠী তাদের ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক নানা ক্ষেত্রে বঞ্চনা ও শোষণের শিকার হচ্ছেন। আমাদের মতো দেশের প্রেক্ষাপটে এর তীব্রতা আরও বেশি। যার সবটা হয়তো একজন লেখকের লেখায় উঠে আসা সম্ভব নয়। তবে যে যার দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে তাদের লেখায় যতটা তুলে ধরতে পারেন ততটাই মঙ্গল। পীড়িত বা নিপীড়িতের পক্ষে যতটা উচ্চকণ্ঠ হওয়া সম্ভব আমার বেলায় এটা লেখার মাধ্যমে সহজ হবে বলে আমি মনে করেছি। আর সেরকম একটা তাগিদ থেকেই লিখতে আসা।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?
গাজী তানজিয়া: ব্যক্তি মানুষ জন্ম থেকে শুরু করে নানা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বড় হয় এটাই স্বাভাবিক। পরিবার, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত তার নানা রূপ নিয়ে ব্যক্তির সামনে হাজির হয়। এটা ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়। কারও ক্ষেত্রে সরল, কারও ক্ষেত্রে জটিল, কারও ক্ষেত্রে নাটকীয়তাপূর্ণ। নিস্তরঙ্গ জীবনধারা তো কখনও গল্প, উপন্যাস, নাটকের বিষয় হয়ে ওঠে না! তবে আমার পরিচিত ব্যক্তিরা কখনও আমার গল্পের চরিত্র নয়। সেক্ষেত্রে পরিচিত ঘটনা যা আমার চারপাশে ঘটছে তা অবশ্যই আমার গল্পের ভিত তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিছু কিছু ঘটনা বা বিষয় হয়তো আমাদের প্রবলভাবে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে ভীষণভাবে। সামাজিক অসংগতি, রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণ, অবিশ্বাস্য রকমের জিঘাংসা বা অকারণ বঞ্চনা, শোষণ, ক্ষুধার্ত মানুষের বেদনা, প্রেম, প্রতারণা এই সবকিছু আমরা আমাদের চারপাশেই ঘটতে দেখি। যার ভেতরে খুব চেতনে বা অবচেতনে আমার গল্পের চরিত্রেরা বাস করে। এইসব মানুষেরাই লেখকের কল্পনায় তৈরি করতে সাহায্য করে তাদের গল্পের জগৎ।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।
গাজী তানজিয়া: প্রতিটি মানুষ যেমন কোনো না কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক, তেমনি অতি অবশ্যই তাকে রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যেই বসবাস করতে হয়। তাতে তার ওপরে রাজনীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকুক বা না থাকুক। ব্যক্তি যদি কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করে, সব রকম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, তাহলে রাজনৈতিক বিষয়-আশয় তার কাছে খুব একটা গুরুত্ব বহন না-ও করতে পারে। যদি না সে স্বেচ্ছায় এমন একটা বিষয়ের সাথে নিজেকে জড়াতে চায়। কিন্তু যেসব দেশের নাগরিকরা নানাভাবে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, এমনকি বঞ্চিত হয় ন্যূনতম মানবাধিকার থেকেও। প্রতি পদে পদে তাকে অবদমনের শিকার হতে হয়। অগণতান্ত্রিক পরিবেশে কাটিয়ে দিতে হয় দিনের পর দিন। বা যেখানে রয়েছে যুদ্ধ অবস্থা, দুর্ভিক্ষ, মূল্যস্ফীতি, খাদ্যাভাব সেখানে মানুষ রাজনৈতিক হতে বাধ্য। আর সেইসব দেশের সাহিত্যে এর উল্লেখ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীর মহৎ সব সাহিত্যে এর প্রতিফলন দেখা যায়। আমাদের দেশের সাহিত্যেও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব দেখা গেছে ইতিপূর্বে প্রবলভাবে। তবে সমসাময়িককালে লেখকদের একরকম সেন্সরশিপের মধ্যে দিয়ে যেতে দেখা যায়। বা নৈর্ব্যক্তিকভাবে বলার প্রবণতাও থাকে। লেখার পর প্রকাশের ক্ষেত্রেও তো নানা সেন্সরশিপ কাজ করে! তবে সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা এড়িয়ে লেখা বা লিখতে চাওয়া প্রকৃত লেখকের পক্ষে সম্ভব না।
সর্বোপরি লেখককে তার লেখার ক্ষেত্রে হওয়া দরকার নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ।
শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
গাজী তানজিয়া: পড়তে শুরু করার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শত শত গল্পই তো পড়া হয়েছে। এর মধ্যে নির্দিষ্ট একটা গল্প সম্পর্কে বলা খুবই কষ্টকর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জোসেফ কনরাড, কাফকা, জেমস জয়েস, বোরহেস, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ বা সমসাময়িককালে হারুকি মুরাকামিসহ আরও অনেক লেখকের অনেক গল্প আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ ও আলোড়িত করেছে। তবে এই মুহূর্তে প্রিয় গল্পগুলোর মধ্য থেকে সমরেশ বসুর ‘ঠাট্টা’ গল্পটি বিশেষভাবে মনে পড়ছে।
এই ঠাট্টাটা যেন গোটা সমাজব্যবস্থার প্রতি। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের প্রতি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বৈষম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামোর যে প্রভাব, তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক। আর এই বৈষম্যকে প্রবলভাবে চিহ্নিত করার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন একটি নারী চরিত্রকে। বিয়ের আসরে বাসর জগতে বসে অদ্ভুত এক বাজি ধরল স্বয়ং বর- যার নাম শিবেন। বাজিটা হলো, যে মেয়ে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে তিন টান দিতে পারবে তাকে ২০ টাকা দেয়া হবে। (যেটা সেই সময়ের টাকার মূল্যমান অনুযায়ী অনেক)। কিন্তু মানসম্মান ধুলোয় লুটানোর ভয়ে কোনো মেয়ে-ই এই বাজি জিততে রাজি হয় না। রক্ষণশীল সমাজ কোনো মেয়ের জন্য যা করা উচিত নয় বলে নিদান দিয়েছে তার বিপরীতে হাঁটার সাহস কোনো মেয়ে দেখাতে চায় না। কিন্তু সে আসরেই নববধূর পিসতুতো বোন মায়া, তুলনায় দরিদ্র, পিতৃহারা ঘরে অসুস্থ মা ও চারটা ছোট ছোট ভাইবোন রয়েছে। সেই মায়া’র অভাবের সংসারে বিশ টাকা, অনেক টাকা। মায়া তাই সব রকম সংস্কারকে পায়ে দলে এই বাজি জিততে এগিয়ে আসে। আর তখনই সে পেয়ে যায় নষ্ট মেয়ের তকমা। যেন সে খুব সস্তা। হাত বাড়ালেই তাকে পাওয়া যায়। শিবেনের মতো পুরুষেরা এই ধরনের মেয়েদের ছলে বলে কৌশলে চায় ভোগ করতে। শিবেন সদ্য বিয়ে করেছে। নববিবাহিতা সুন্দরী স্ত্রী তার পাশে, তারপরও সস্তা মেয়ের প্রতি তার লোলুপতা থেমে থাকে না। অন্যদিকে সমাজের নিয়ম-নীতির পরোয়া না করা, রক্তচোখের শাসানিকে উপেক্ষা করা, খারাপ আখ্যা পাওয়ার ভয়কে তুচ্ছ করা মেয়েরা একটু অন্যরকম। এই অন্যরকম মেয়েকে নারী বা পুরুষ কেউই সহজভাবে মেনে নেয় না। তাই তো আসরে উপস্থিত মেয়েরা পুরুষের চেয়ে কম পুরুষ হয়ে ওঠে না। পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক যেন তারা। হাজার হাজার বছর ধরে তাদের মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া পুরুষতান্ত্রিক মতবাদই তারা বহন করছে। তাদের দৃষ্টিতে মায়া নষ্ট নারী। তারা শিবেনের দোষ না ধরে বরং মায়াকে খারাপ ভাবতে শুরু করে।
সমরেশ বসু শিবেনকে দিয়ে বাসরঘরে যে ঠাট্টাটা করালেন, তার একদিকে যেমন মুখ্য হয়ে উঠেছে সমাজে নারীর নাজুক অবস্থা তেমনি দরিদ্র্যের প্রতি ধনীর উপহাস।
লেখক যখন রূপক অর্থে বলছেন, ‘নোটে থাকা সিংহের হিংস্র দাঁত’। এই হিংস্রতা যেন নারীর প্রতি পুরুষের প্রকারান্তরে দরিদ্রের প্রতি ধনীর।
শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
গাজী তানজিয়া: ভাষা কোনো নির্ধারিত বিষয় নয়। প্রাত্যহিকতার ভাষা আর সাহিত্যের ভাষা এক নয়। ভাষার কারণে যদি গল্প নির্মিত হয়, তাহলে তার রূপ বা কাঠামো একরকম হবে, আর গল্পের কারণে যদি ভাষার সৃষ্টি হয়, তারও রূপ বা কাঠামো ভিন্নরকম হবে। এমনকি প্রাত্যহিক ভাষা যদি গল্পে ব্যবহার হয়, সেটাও ঠিক প্রাত্যহিক ভাষা থাকে না। কেননা এটা স্মৃতি বা ভবিষ্যৎ হয়ে দাঁড়ায়। সৃষ্টিশীল ভাষার সুবিধা এখানেই। তাছাড়া সাহিত্যের ভাষা প্রথাগত ভাষার বাইরে থাকে। একজন প্রকৃত গল্পকার যখন লেখেন, কাহিনির স্থান, কাল, পাত্রের কারণে তার ভাষা বদলে যায়। ভাষার এই বদলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। আমার গল্পের ক্ষেত্রেও তেমন পথ অনুসৃত হয়। ভাষার জন্য গল্প নাকি গল্পের জন্য ভাষা, প্রথমটা জবরদস্তি হলে, দ্বিতীয়টাই স্বতঃস্ফূর্ত। মানে প্রথমটা নির্মাণ হলে, দ্বিতীয়টা সৃষ্টি। তবে গল্পের প্রয়োজনেই ভাষা প্রকৃতির মতো স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। সেটাই হয়তো একজন গল্পকারের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। সেটাকে আমরা হয়তো নিজস্ব ভাষা বলে দাঁড় করাই।
শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?
গাজী তানজিয়া: ব্যক্তি বা বিষয়ের প্রকৃত সমস্যার জায়গাটাকে চিহ্নিত করে তাকে কল্পনা ও নান্দনিকতার মিশেলে উপস্থাপন করার শৈল্পিক প্রক্রিয়া হলো ছোটোগল্প।
আমরা জানি ছোটোগল্পের পরিধি সীমাবদ্ধ। আর এই সীমার মধ্যে থেকে অসীমকে উপস্থাপনের একটা চ্যালেঞ্জ ছোটোগল্পের মধ্যে আছে। তবে ছোটোগল্প লেখার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম থাকা দরকার আছে বলে মনে করি না। ব্যাকরণ মেনে হয়তো গঠন প্রক্রিয়া আর আঙ্গিকটাকে ঠিক রাখা যেতে পারে। তবে একটা আঁটোসাঁটো টানটান পরিসরে যে কথা বলা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অকথিত, অব্যক্ত ও ব্যাখ্যাপ্রবণ রেখে পাঠকের ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়ার মধ্যেই ছোটোগল্পের সার্থকতা।
শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
গাজী তানজিয়া: মানুষ জন্মগতভাবে রাজনৈতিক জীব। প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক। সেখানে একজন লেখককে রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একজন লেখকের কাজই হচ্ছে যেকোনো বিষয়কে বিশেষভাবে দেখা, সমাজের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা ও মানুষের কল্যাণের জন্য লেখা। সেখানে রাজনীতি, সমাজ বাস্তবতা তাদের লেখায় প্রবলভাবে আসতে বাধ্য। অগণতান্ত্রিক পরিবেশে সবাইকে ঠুলি পরিয়ে রাখার যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, লেখকের দায়িত্ব সেই অদৃশ্য পর্দা ভেদ করে পাঠককে বাস্তবের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়া। তার ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া, চিন্তাকে পরিণত করা। সেক্ষেত্রে লেখক নানা ফর্মের আশ্রয় নিতে পারেন। হতে পারে তা খাপ খোলা রূঢ় বাস্তব ভঙ্গিমা, কখনোবা রূপক অথবা জাদুবাস্তবতার আদলে। তথাপিও সত্যের উন্মোচন লেখকের নৈতিক দায়িত্ব।
শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!
গাজী তানজিয়া: দীর্ঘদিন ধরে আমি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে একটা জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছি। তাঁর ওপরে পঠনপাঠন ও গবেষণা চলছে। লেখাও কিছুটা এগিয়েছে। তবে কাজটা আমি সময় নিয়ে করতে চাই।
এছাড়া গল্প ও প্রবন্ধ লিখছি মাঝে মাঝে। আর পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখা চলছে।