বৃহত্তর বাংলায় গড়ে ওঠা গণসঙ্গীতের ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা বিষয়ক যে কোন আলোচনার পূর্বে আমাদের বুঝে নিতে হবে, যে গণসঙ্গীত বলতে আমরা মূলত কী বোঝাতে/বুঝতে চাইছি, এবং ঠিক কোন জায়গা থেকে তার এই ‘গণ’-চেতনার ব্যুৎপত্তি। প্রথমেই বুঝে নেওয়া ভালো, আন্তর্জাতিকভাবে গণসঙ্গীত বলতে যে ধারার গানকে উদ্দেশ্য করা হয়, তার জন্ম বামপন্থী, কমিউনিস্ট রাজনীতির অন্দরমহল থেকে। কিন্ত ভারতবর্ষের মাটিতে ফেলে গণসঙ্গীতকে যাচাই করতে গেলে জানতে হবে, এই ধারার জন্ম বামপন্থী রাজনীতি ঘেঁষে হলেও, এর উত্থান বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনকে হাতিয়ার করেই। আজকের ভারতবর্ষের মত দেশ আর রাষ্ট্র একাকার হয়ে নয়, সেদিনের গণ আন্দোলনে দেশের লড়াই, দশের লড়াই গড়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যার মাঝ থেকে রচিত হয় অবিস্মরণীয় সমস্ত গণসঙ্গীত। কিন্ত যদি লিঙ্গচেতনার আয়নায় ফেলে একবার দেখা যায় সেই সমস্ত গণসঙ্গীতদের, যাঁদের আসলেই সর্ব অর্থে মানুষের গান হয়ে ওঠার কথা ছিল, তাহলে কেমন দাঁড়াবে সেই চিত্র? প্রশ্নটা সত্যিই বড্ড ভাবনার।
২
বাংলার গণসঙ্গীত বলতে আমরা আজ যা বুঝি, তার একটি নির্দিষ্ট ধারা তৈরী হয়েছিল বিগত শতকের চল্লিশের দশকে। একদিকে যেমন ছিল লোক আঙ্গিককে মাথায় রেখে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘বাহিরানা’-র গান, অন্যদিকে গমগম করছিল সলিল চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সেতু গড়া সুর-বাণীতে ভরা ‘ঘুম ভাঙানোর গান’। গণনাট্য আন্দোলনের ভূমিকা এই সময়ের ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। তবে আমার মাথায় ঘুরছে একটাই গান, যা সেই সময়ের সমগ্র রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে অতি সূক্ষ্মভাবে সমসাময়িক লিঙ্গচেতনার অবস্থা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে যায়। তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে বিনয় রায়ের কথা ও সুরে রচিত হয় এই গান। গানটির শিরোনাম ‘অহল্যা মায়ের গান’, চন্দনপিঁড়িতে সন্তানসম্ভবা শহীদ, অহল্যা’র স্মৃতির উদ্দেশ্যে, এবং তার বাণী এইরূপ-
“আর কতকাল বল কতকাল
সইব এ মৃত্যু অপমান?
শহর বন্দরে চাষীর কুটিরে
নরখাদক দলের অভিযান
এ আর সহে না
কমলাপুর শহীদ ডাকে আয়রে, আয় রে
ডোঙ্গাজোড়ার শহীদ সুরেন তাদের পানে চায় রে, চায় রে
চন্দনপিঁড়ির সরোজিনী, অহল্যা মা,
তাদের খুনের তর্পণ হল না
এ আর সহে না
সুন্দরবনের জঙ্গল কেটে ফলালো কে সোনা
তার মা-বোনের রক্তে হল সোনার মাটি লোনা
রক্তের ধার বেধে মোদের প্রতি গ্রাসে গ্রাসে
কবে বল, কবে শুধব তা
এ আর সহে না
শুনি নাকি স্বরাজ এখন
এই কি তার নমুনা?
মা-বোনের ইজ্জত লোটে কোন স্বরাজের সেনা
চরকা নয় খদ্দর নয় আর
নয় অহিংসার বুলি
বুকে বেধে গরম সীসার গুলি
এ আর সহে না
অহল্যা মা তোমার সন্তান জন্ম নিল না
ঘরে ঘরে সেই সন্তানের প্রসব-যন্ত্রণা
শত কংস ধ্বংস করে যে শিশু জন্মিবে
মাঠে মাঠে তারই জল্পনা
এ আর সব না”
এখানে দুটি জিনিস লক্ষণীয়। প্রথমত, গানটির নাম ‘অহল্যা মায়ের গান’ হলেও গানটি কোনভাবেও অহল্যার নিজস্ব বক্তব্যে রচিত নয়। এমনভাবে লেখা, যেন অহল্যার ভাগের লড়াই, শপথ সব অন্য আরেকজন বলে, করে দিচ্ছে। সুতরাং অহল্যা এখানে কেবলই একজন প্রতীক, মূল লড়াইয়ের শরিক নন। দ্বিতীয়ত, গানে ব্যবহৃত চিরাচরিত কিছু শব্দবন্ধ সেই সময়ের নারীদের প্রতি বিপ্লবের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। বামপন্থী ধারায় গড়ে ওঠা বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলি আশা দেখিয়েছিল নারীমুক্তির, সামানাধিকারের। কিন্ত সমসাময়িক সঙ্গীত-শিল্পকলাকে যদি তৎকালীন রাজনৈতিক মনোভাবের প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায়, তাহলেই বোঝা যায় কীভাবে নারীকে একটি ইজ্জতবাহক বস্তুতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। নারী কমরেড বহু পরে, আগে সে রক্ষণীয় বস্তু, যার রক্তক্ষরণ, সম্মানহরণ বৃহত্তর বিপ্লবের পথে বাধা ঠিকই, কিন্ত সৈনিকের কর্তব্য হয়ে উঠতে পারে কি? তবে এই বোঝাপড়া সম্পূর্ণ পালটে যায় যখন আমরা এই গানটি পরবর্তীতে রেবা রায়চৌধুরীর কন্ঠে শুনি। পাঠ্য এবং শ্রাব্যের মাঝের ফাঁকটুকু যে আসলেই কত বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ, তা ধরা যায় সেখানেই। শুধু পাঠ করলে যে ভাষ্যটি আপাতভাবে নারীর কন্ঠরোধক মনে হয়, গায়নে সেই ভাষ্য হয়ে যায় এক নারী-সৈনিকের কন্ঠে আরেক কমরেডের স্মৃতিতে শপথগ্রহণের গান। তেভাগা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নারীদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়বার মত, কিন্ত সংখ্যার আধিক্য দিয়েও গানের ফাঁকফোকর দিয়ে চলকে পড়া লিঙ্গ-অন্ধত্ব ঠেকানো যায়নি পুরোপুরিভাবে, যা নারী-কন্ঠের গায়ন দিয়ে কিছুটা হলেও রোধ করা গেছে হয়ত।
সাধারণত, সঙ্গীতকে পাঠ করবার যে রীতিগুচ্ছ আমরা জানি, তার থেকে বেশ অনেকটাই দূরত্বে বসবাস করে থাকে শ্রবণ-গায়নকে পাঠ করবার নীতিগুচ্ছ। ফলে, মাঝের সেতুগুলি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রয়ে যায় অধরা। গণসঙ্গীতকে, বিশেষ করে চল্লিশের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক অবধি বাংলায় গড়ে ওঠা গণসঙ্গীতকে, কোনমতেই সম্পূর্ণরূপে পাঠ করা যাবে না, যদি আমরা পাঠ্যের চিরাচরিত সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে শ্রাব্যকেও পাঠ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না করি। যে গানটি রচিত হয়েছিল তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে, তা কীভাবে একবিংশ শতাব্দীতে গণসঙ্গীত গবেষক, ডঃ সুমঙ্গলা দামোদরনের কন্ঠে নতুন অর্থলাভ করেছিল, তা বোঝা যাবে সেভাবেই। কারণ গণসঙ্গীতের মালিকানা কখনোই সুরকার, গীতিকারের একার নয়। যত কন্ঠে যতবার গাওয়া হবে, মালিকানার ভাগ হবে ঠিক ততবারই। এই শিক্ষাই দিতে চেয়েছিল বোধহয় ফেলে আসা যৌথ খামারের স্বপ্ন।
৩
যৌথ খামারের স্বপ্ন ও তাঁর বিভ্রান্তি/বিচ্যুতির প্রশ্নে আসি এই লেখার মূল বিষয়বস্তুর দিকে। নকশালবাড়ি আন্দোলন- যা আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে আনে সাহসের বার্তা। এই নকশালবাড়ি আন্দোলনের গান প্রসঙ্গে আসতে আসতে হয়ত অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা বলা হয়ে গেল। বললাম, কারণ প্রেক্ষাপট বিহীন যে কোন তর্কই রয়ে যায় বিচ্ছিন্ন এবং কিঞ্চিৎ বিরক্তিকরও বটে। কিন্ত তেভাগা প্রসঙ্গে আগে এলাম কারণ বাংলার মাটিতে গড়ে ওঠা যে দুটি কৃষক আন্দোলন সমকালীন রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল, তা তেভাগা এবং নকশালবাড়ি নিঃসন্দেহে। এবং এই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ে, প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে একসাথে পড়লে পাওয়া যাবে সেই সময়ের গানের মধ্যে অন্তর্নিহিত যোগসূত্র বা উত্তরাধিকার, যা সমসাময়িক লিঙ্গচেতনার আয়নাও বটে। নকশালবাড়ির গানের কথায় আসার আগে সেই আন্দোলন সম্পর্কে দু’চার কথা বলে নিই।
১৯৬৭ সালের মে মাসে দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি অঞ্চল গর্জে ওঠে কৃষকদের অভ্যুত্থানে। জমি আইনকে নানাভাবে ফাঁকি দিয়ে বড় জমিদারেরা বহুদিন ধরেই সেই অঞ্চলে সৃষ্টি করছিলেন অমানবিক অত্যাচার এবং ক্ষুধার পরিবেশ। শুধু তাই নয়, পুলিশ-সহ রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্টতা বজায় রেখে চালু ছিল গরীবকে আরো গরীব, দুর্বলকে আরো দুর্বল করে তার ওপর জোর খাটানোর চক্রান্ত। এহেন পরিস্থিতিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)-র একটি অংশ, যা পরে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী অংশে পরিণত হয়, নেতৃত্ব দেয় কৃষকদের বিক্ষোভের। ক্ষমতার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে তারা গেরিলা যুদ্ধপন্থায় রত হয়। নকশালবাড়ি আন্দোলন শুধুমাত্র দার্জিলিং জেলাতেই আটকে থাকেনি। উত্তরবঙ্গ থেকে মেদিনীপুর ছাড়িয়ে খোদ শহর কলকাতাতেও এসেছিল তার হাওয়া। এই আন্দোলনের শুরু যদিও কৃষকদের হাতে, ক্রমেই কৃষক-শ্রমিক পরিবারের নারীরা হয়ে ওঠেন এই আন্দোলনের অনস্বীকার্য অংশ। কখনো গুপ্তচর, কখনো সক্রিয় ক্যাডার বা কখনো স্রেফ সহমর্মী রাঁধুনি—পুলিশ-রাষ্ট্র-জমিদারের চোখে ধুলো দিয়ে নারীরা আস্তে আস্তে এই আন্দোলনের গর্ভগৃহে প্রবেশ করেন। গোটা প্রক্রিয়াকে আর জোরদার করে তোলে বামপন্থী রাজনীতির অন্তর্গত লিঙ্গ-নির্বিশেষে সমানাধিকার। মিটিং, মিছিল থেকে চাঁদা তোলা, ভাতের জোগান—নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া এই আন্দোলন ছিল প্রায় অসম্ভব।
নকশালবাড়ি আন্দোলনে নারীদের অগ্রণী ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায়না। মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় সেই ছোটবেলাতেই পড়েছিলাম নকশাল আন্দোলনের আখ্যা। মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’-এ পর্দায় জ্বলতে দেখেছি হেরে যেতে থাকা মানুষের, নারীর জ্বলে ওঠার গল্প। কিন্ত সেই সময়ে বা পরবর্তীকালে নকশালবাড়ির স্মৃতিতে রচিত গানে কীভাবে ধারণ করা হয়েছে নারীকে? বাণীতে, সুরে, গায়নে, শ্রবণে কীভাবে নারীরূপ বোঝানো হয় বা আদৌ বোঝানো হয় কি? এই গানগুলি কারা লেখেন, কাদের হয়ে লেখেন, কারা গেয়ে থাকেন গানগুলি? এই প্রশ্নগুলিও করা খুব জরুরী।
৪
২৫শে মে, আন্দোলন শুরু হবার দিনেই তৎকালীন ছাত্রনেতা এবং গণসঙ্গীতশিল্পী দিলীপ বাগচী রাজবংশীদের আঞ্চলিক ভাষায় লিখলেন একটি কবিতা, যা পরে সুরারোপ করে গান হিসেবে গাওয়া হয়। ‘নিশান্তিকা’ গোষ্ঠী এবং দিলীপ বাগচীর কন্ঠে এই গানটি নকশালবাড়ি আন্দোলনের ত্রিশ বছরপূর্তি উপলক্ষে ‘তরাইয়ের গান’ শীর্ষক একটি সংকলনে প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। গানটির বাণী এইরূপ-
“ও নকশাল, নকশাল, নকশালবাড়ির মা
ও মা তোর বুগত্ অকেতা ঝরে
তোর খুনত্ আঙ্গা নিশান লঘ্যা(লইয়া)
বাংলার চাষী জয়ধ্বনি করে।।
…ও মা তোর বুগত্ অকেতা ঝরে
সেই অকেতা হইতে জন্ম নিবে
জঙ্গাল সাঁওতাল বাংলার ঘরে ঘরে।।”
এই গানটি ষাটের-সত্তরের দশকে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। রাজনৈতিক বক্তব্যে পরিপূর্ণ এই গানে যে ‘নকশালবাড়ির মা’-এর কথা বলা হয়েছে, তা আন্দোলনের প্রাক-মূহুর্তে শহীদ গৃহবধূদের প্রতীক। এই গানটিতে নারী প্রকাশ পায় ‘মা’ রূপে,যার আত্মবলিদান নমস্য, যার ত্যাগ থেকে শিক্ষা নেবে ভবিষ্যতের নকশাল সৈনিকেরা। গানটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গাওয়া হয়েছিল (এবং আজও গাওয়া হয়ে থাকে) মূলত পুরুষ কন্ঠে, সুতরাং ‘অহল্যা মায়ের গান’-এর মত এখানে কোন অন্য ন্যারেটিভ জন্ম নেয় না। নকশালবাড়ির মা এই গানের মধ্যে প্রতীকী দেবী হয়ে থেকে যান, কমরেড হন না।
আমরা যারা নকশাল আন্দোলনের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেছি (আমি নব্বইয়ের দশকের সন্তান), তাঁদের কাছে নকশাল আন্দোলনের গান-কাব্য-সাহিত্য কিছুটা দূরবর্তী। হাতের কাছে বই-ক্যাসেটে যতটুকু পাওয়া যায়, তার চেয়ে কিছুটা বেশি পেতে পারি আমরা সেই সময়ে মাঠে-ঘাটে লড়ে বেরানো মানুষগুলি থেকে শোনা কথায়-গানে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘তরাইয়ের গান’ ক্যাসেটটি আমার শোনার সুযোগ হয়েছিল। সেই সংকলনটি খুঁটিয়ে শুনলে ষাটের-সত্তরের দশকের উত্তাল সময়ের গান নিয়ে খুব উপযুক্ত না হলেও সমসাময়িক ধাঁচের আন্দাজ করে ফেলা যায়। সেই একই সংকলনে ‘নকশালবাড়ির মা’-এর সাথে প্রকাশিত হয়েছিল আরেকটি গান-
“মা গো তোমার বুকের ঝরলো যে খুন
তাই আমার বুকে জ্বলে যে আগুন”
আগের গানটির মতই এই গানটিও শুরু হয় পুরুষকন্ঠে, মায়ের ঝরা রক্তের বিলাপের মধ্য দিয়ে। কিন্ত গান-পথে বদল ঘটে শীঘ্রই। যে মূহুর্তে “ওদের করব না ক্ষমা/ ওদের করব না ক্ষমা” বাণী ধ্বনিত হয়, নারী-পুরুষের মিলিত কন্ঠে গানটি পূর্ণতা লাভ করে। এই প্রথম, নারীকন্ঠের গানের ওপর, লড়াইয়ের শপথবাক্যের ওপর সমানাধিকার জন্মায় এই সংকলনে।
‘নিশান্তিকা’ শিল্পীগোষ্ঠীকে বাদ দিলে আরো কয়েকটি শিল্পীগোষ্ঠীর কথা স্মরণ করতেই হয় নকশালবাড়ির প্রসঙ্গে—‘গণবিষাণ’ (জলি বাগচী, বিপুল চক্রবর্তী, অনুশ্রী চক্রবর্তী), ‘অরণি’ (অমিতেশ সরকার), ‘অপেরা গ্রুপ’ (অজিত পাণ্ডে, শ্যামসুন্দর বসু) প্রমুখ—যাঁদের লেখা/গাওয়া গানগুলি আজও বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে নকশালবাড়ির স্মৃতিতে গাওয়া হয়। আমার সীমিত শ্রবণ-অভিজ্ঞতায় ‘গণবিষাণ’-এর পরিবেশনায় অনেক বেশি নারীকন্ঠ খুঁজে পেয়েছি, যা হয়ত অন্য কোন কারণে বাকি দলগুলিতে সেভাবে প্রকাশ পেত না। জলি বাগচী, যিনি এই গোষ্ঠীর মূল প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর কথায়, সুরে, কন্ঠে পাওয়া যায় ‘গণবিষাণ’-এর বেশ কিছু গান। কিন্তু এ ছাড়া? একটা কারণ হতে পারে অন্যান্য দলগুলিতে পুরুষ ‘স্টার’ গায়কের আধিক্য বা সুগায়িকাদের অভাব। কেউ কেউ এমনও ছিলেন যারা প্রত্যক্ষভাবে নকশালবাড়ির রাজনীতির সাথে সম্পূর্ণরূপে একাত্ম না হলেও, সাংস্কৃতিকভাবে পাশে থেকেছেন। কবি-গায়ক বিপুল চক্রবর্তী (যিনি সহধর্মিনী, অনুশ্রী’র সাথে দ্বৈতকন্ঠে বহু গানকে আমাদের এবং তার আগের প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন সযত্নে) টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সে কথা। এ ছাড়াও সেই সময়ে স্মরণীয় সমস্ত গান/কবিতা লিখে গেছেন সুরেশ বিশ্বাস,প্রতুল মুখোপাধ্যায়, বিনয় চক্রবর্তীরা। কিন্ত নকশাল আন্দোলনের সময়ে গান লিখেছেন এমন নারীর কথা (জলি বাগচী বাদে) আমরা জানিনা বললেই চলে। হয়ত আমার বা আমার সময়ের অজ্ঞতা তার জন্যে দায়ী, কিন্ত নিজের জানাবোঝার পরিসরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটিও নাম আমি অন্তত বের করতে পারিনি। নকশালবাড়ি কি তবে আর একজন নারীর হাতেও সুরেলা কলম তুলতে বাধ্য করতে পারেনি? বা ২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে, প্রযুক্তি অত্যন্ত উচ্চমানের হওয়া সত্ত্বেও কেন একজন নারী-গীতিকার/সুরকারের কথা জানতে এত বেগ পেতে হয়? তুলনায় পুরুষেরা বড্ড সহজলভ্য। তাঁদের মহিমাণ্বিত করবার সুযোগের সত্যিই কোন অভাব নেই।
অন্যদিকে নকশাল আন্দোলন থেকে উঠে আসা গানমালায় নারীচরিত্রের বা তার প্রতিরূপের কোন কমতি নেই। সেই পুরোনো ‘অহল্যা’ থেকে ‘নকশালবাড়ির মা’ হয়ে ‘সুবর্ণরেখা’ বা ‘মাতৃভূমি’—নারী প্রতীকের ছড়াছড়ি। কিন্ত লড়াইয়ের বাস্তবিক চিত্রাঙ্কণের সময় ‘ওরা ক্ষুদিরামের ভাই/ ওরা ভগৎ সিং-এর ভাই’ (রচয়িতা বিপুল চক্রবর্তী) বা ‘চুপ করো তোমরা/ এখানে ঘুমিয়ে আছে আমার ভাই’ (রচয়িতা বিনয় চক্রবর্তী) এবং অন্যান্য গানগুলি কেবল আন্দোলনের পুরুষ সদস্যদের কথাই বলে। সেখানে কোন শয়ে শয়ে মহিলারা যেভাবে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পুরুষ কমরেডদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন, তার ছাপ কোথায়?
৫
বিভিন্ন গবেষকেরা এই বিষয়ে একমত যে নকশালবাড়ি আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল দুর্দান্ত এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে একপ্রকার নজিরবিহীন। সত্তরের দশকে নকশালবাড়ির অদূরেই জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ, যে দেশের জন্ম হাজার হাজার বীরাঙ্গনার আত্মত্যাগের প্রতি চিরঋণী। ওপার বাংলা থেকে এপারে—সত্তরের দশক দুই বাংলার জন্যেই ছিল স্বপ্নের বার্তাবহ। একদিকে ছিল ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা জাতি আর ওপরদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রের মিলিত প্রতিরোধ। দু’জায়গাতেই নারীদের অংশগ্রহণ, অবদান যথেষ্ট। সময়ের সাথে সাথে দুটি স্বপ্নের অন্তর্গত খামখেয়ালিপনাগুলি একে একে চোখে পড়তে থাকে। স্পষ্ট হতে থাকে বাস্তবের সাথে স্বপ্নের ফারাক। যে সমস্ত আশ্বাস নিয়ে শুরু হয়েছিল নকশালবাড়ি, ক্রমে সে নিজেই হতে থাকে এক পথভোলা পথিক-সম।
আর তার গান? সেখানেও ধরা পড়তে থাকে জোড়াতালি, বয়সের ছাপ।
স্বল্প মাপের গায়িকা হলেও গণসঙ্গীত বিষয়ক আমার নিজস্ব একটি উপলব্ধির কথা এখানে বলি। ধরুন সলিল চৌধুরীর বিখ্যাত গান, “ও আয়রে”, আমি গাইব ধর্মের নামে হানাহানির বিরুদ্ধে। কোনো ভুল নেই। একদম খাপে খাপ। কিন্ত যেই গানের পংক্তির মোড় ঘুরবে, বাণী হবে এমন-
“ও গাঁয়ের যত জোয়ান মরদ লাঠি নিও হাতে
ঐ খুনে রাঙা ঝান্ডা যেন থাকে সবার সাথে
আর দুশমন যদি আসে, যেন চোখের জলে ভাসে
যেন লুটে খাবার ক্ষুধা তাহার মেটে একেবারে।
ও গাঁয়ের যত মা–বোন আছে,তোমরা থেকো ঘরে
ঐ আঁশবটি আর কাটারিটা রেখো হাতে করে
যেন দালাল বেইমান যত, পায় শিক্ষা উচিত মতো
(এই) বাংলাদেশের মা–বোন কত শক্তি হাতে ধরে।”
মানছি, যে সময়ে এই গান রচিত সেই সময়ের এবং গানটির ‘টার্গেট গ্রুপ’-এর জন্য হয়ত এমন বাণীই সঠিক, কিন্ত ছাব্বিশ বছরের শহুরে গায়িকা, যে নিজে কখনও ‘আঁশবটি আর কাটারি’ হাতে যুদ্ধে নামবে না, যার ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত যুদ্ধের পরিসর চল্লিশের-সত্তরের দশক থেকে অনেকখানি আলাদা, তার কাছে এই গান স্রেফ বিগত দিনের আদর্শের স্মৃতিচারণ হয়েই থাকবে, বর্তমান লড়াইয়ের অঙ্গীকার হয়ে উঠতে পারবে না। শুধু তাই নয়, গণসঙ্গীতের সংজ্ঞা, তার অন্তর্নিহিত শব্দ (form) এবং অর্থ (content) হতে হবে সময়োপযোগী এবং ঘটমান রাজনীতির সাথে সংলাপমুখী, যা না হলে আন্দোলন এবং আন্দোলন থেকে উঠে আসা শিল্পের মধ্যে কোন সংযোগ স্থাপন হবে না।গণসঙ্গীত মিটিং-মিছিলের‘কম্পালসরি কোয়েশ্চেন’-এই বাঁধা থাকবে আজীবন।
নকশালবাড়ির আন্দোলন থেকে উঠে আসা গানের শব্দ বা অর্থ কিছুতেই নারীর অংশগ্রহণের কোন প্রতিফলন ছিলনা।সেই খামতিকে পোষানো যাচ্ছিল নারীকন্ঠে সেই গানগুলির পরিবেশনের মাধ্যমে, যাকে হয়ত কেউ কেউ বৃহত্তর অর্থের (content) অন্তর্ভুক্ত বলে ধরতে পারেন।কিন্ত বামপন্থী নারী আন্দোলনের যে প্রাথমিক শিক্ষা, নারীর হাতে তার নিজস্ব বক্তব্য স্থাপনের ও জ্ঞাপনের অধিকার, তা মাঠ পর্যায়ের লড়াইয়ে আংশিকভাবে আনতে পারলেও, শৈল্পিক পর্যায়ে তা হয়নি।এখানে বুঝতে হবে, যে এই ধারা কেবলমাত্র নকশাল আন্দোলনের জন্যেই প্রযোজ্য নয়।নব্বইয়ের দশক থেকে সারা পৃথিবীব্যাপী ঘটে যাওয়া ব্যাপক পরিবর্তনের বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি বাংলায়(মূলত পশ্চিম বাংলায়, কারণ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ অন্য, যা সময়াভাবে এখানে আলোচনা করছি না)রচিত গণসঙ্গীতে এবং তৎকালীন বামপন্থী সংগঠিত সংস্কৃতিতেও।গানের বাণী যেমন রয়ে গেছে‘মা-বোন’ ভাষ্যে বন্দী, সুরারোপ বা গায়নেও তেমন আলাদা করে চোখে পড়ার মত কিছু ঘটেনি।বিচ্ছিন্ন কিছু স্বীকৃতিযোগ্য কাজ অবশ্যই হয়েছে(উদাহরণস্বরূপ,আকাশ চক্রবর্তীর কথায়-সুরে‘চিৎকার কর মেয়ে’ গানটি ২০১৩ পরবর্তী সময়ের দাবীকে যথার্থভাবে কথায়-সুরে ধরতে পেরেছে), কিন্ত সংগঠিতভাবে বৃহত্তর বামপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির কাছে প্রত্যাশা থেকেই যায়।
২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে নকশালবাড়ির গানে মেয়েদের প্রতিচ্ছবি কেবল ইতিহাস ঘাঁটার অজুহাত হয়ে থাকুক, এটা কাম্য নয়।১৯৬৭’র মে মাসে যেভাবে সেই আন্দোলন শিখিয়েছিল সমাজের শোষিতের ক্ষোভের পরিণতি, বর্তমান শোষণের রূপ কীভাবে গানে ধরা পড়বে তার শিক্ষাও আমরা বরং একদম মাঠ পর্যায়ে গিয়ে নিই।হেঁড়ে, সুরহীন গলায় চেঁচানোকে‘গণসঙ্গীত’বলে না ভাবি।বিপরীতে নতুন করে আবিষ্কার করি আমাদের চিরাচরিত লোকধারাকে, যার পরতে পরতে লুক্কায়িত আছে জাগরণের উপাদান।যদি সত্যিই বিশ্বাস করি বামপন্থায় অগ্রাধিকার শোষিতের, তাহলে শোষিতের শব্দে-অর্থে হোক গান।আর নারীদের প্রতীকে বন্দী না করে, শ্রোতা-গায়কের বেড়া ভাঙতে সাহস রাখি।
মনে পড়ছে কলকাতায় একটা বিকেলের কথা। শুভেন্দুজেঠু, মানে শুভেন্দু মাইতি কী একটা কাজে আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আর সত্তরের দশকের উত্তাল সময়ের কথা বলছেন। কথার মাঝে মাঝে এসে পড়ছে গানও। এমনই এক দিনের কথা বলতে লাগলেন যখন তিনি একটি গ্রামে গেছেন পার্টির প্রচারে। সেই গ্রামে তখন ঘরের পর ঘর শূন্য। সরকারবিরোধী নকশাল আন্দোলনের জেরে কেউ হয় মিথ্যা মামলায় জেলে,বা কেউ আত্মগোপনে। এমনই এক অনুষ্ঠানে তিনি গাইবেন যেখানে দর্শক সকলে তেমনই ছেলেহারা ঘরের লোকেরা। গান ধরবার আগমূহুর্তে প্রতিটা মুখের দিকে তিনি তাকান। আর কল্পনায় হারিয়ে যাওয়া ছেলেগুলি সবাই হয়ে ওঠে এক একজন সন্ন্যাসী নিমাই,আর তারা এক একজন শচীমাতা-লক্ষ্মীপ্রিয়া-বিষ্ণুপ্রিয়ার প্রতিভূ। জেঠু গান ধরলেনঃ
“বিদায় দে মা, শচীরানী, আমি সন্ন্যাসেতে যাই
তুমি মনরে বুঝাইয়া কইয়ো গো,
মা তুমার নিমাই আর নাই
বিদায় দে মা, শচীরানী, আমি সন্ন্যাসেতে যাই!”
এই গানের গায়কের মনে যেমন তখন কোন অপ্রয়োজনীয় বিশ্বাসের পরিচয় ছিলোনা, তেমনই পুত্রহারা হবার আকুতি বোঝার জন্যে আলাদা করে ধার্মিকও হতে হতনা, নারীও নয়।লিঙ্গপরিচয় একটি উপলক্ষমাত্র আর বাংলা বিখ্যাত নিমাই সন্ন্যাসের পালা তখন শুধুই একটি মাধ্যম। প্রোপাগান্ডা নয়। আদ্যোপান্ত গণসঙ্গীত। সর্বহারার চরম আকুতি!
মানুষের ইতিহাসকে মানুষেরই কবল থেকে দূরে সরিয়ে রাখার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে ধর্ম ও অন্ধবিশ্বাস এতদিন। সফল হয়েছে মানুষের সাথে শিল্পের দ্বন্দ্ব ঘটাতে। অতিবিপ্লবের পথে হাঁটতে গিয়ে গণসঙ্গীতও পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে বারবার। আর তাই আমরা অঙ্গীকারের গান বলতে শুধুই বুঝি অহেতুক চিৎকার। আর সন্তর্পণে এড়িয়ে যাই যে গান বিশ্বাসের কথা বলে। বুঝতে হবে এই বিশ্বাস অন্ধ করে, ভরসা জোগায় না মোটেও,অনেকটা প্রশ্নহীন আনুগত্যের মত। গণসঙ্গীতকে ইতিহাস থেকে বর্তমানে এনে প্রাপ্তবয়স্ক করে তুলতে পারে কেবল এই প্রশ্ন করার ধকটাই, যা তেভাগা থেকে নকশালবাড়ি, প্রতিটা গণ-অভ্যুত্থানের মূল নীতি। এই প্রশ্নের হাত ধরেই কে জানে, হয়ত নব-জাগরণের গানে নতুন করে জায়গা পাবে নারীর মুক্ত, স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর।
Shabnam Surita is a Research Associate (Wissenschaftliche Mitarbeiterin) at the Department of South Asian Studies, University of Bonn, Germany, where she is also pursuing her PhD degree. Besides, she works as a freelance Journalist at the Bengali department of Deutsche Welle, Germany’s international public broadcaster. Apart from the two jobs, Shabnam juggles between India and Germany, where she manages both her cultural activism, blogging and music career.
*(লেখাটি প্রথম ২০১৮ সালে জয়ী পাল সম্পাদিত ‘নকশালবাড়ি মেয়েদের বয়ানে‘ সংকলনে ‘গাঙচিল‘ কর্তৃক প্রকাশিত হয়।)