যারা ধর্ষকের ক্রসফায়ার চায়, তাদের ধর্ষণ নিয়ে আপাত অর্থে ‘মহাউদ্বিগ্ন’ মনে হলেও আদতে ধর্ষণের মতাদর্শিক বাস্তবতা উৎপাদন ও প্রচারে তাদের ভূমিকাও কম না। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র আগাগোড়াই আইন-বেআইনের মোড়কে সহিংসতার উপর নির্ভরশীল একটা রাষ্ট্র, যেখানে সহিংসতাই রুল।আওয়ামীলীগ সরকার গত এক যুগে এই রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে নজিরবিহীন স্তরে নিয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর আবারো বাংলাদেশের রাজপথ তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষের বিক্ষোভে উত্তাল। সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে নৃশংস সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা বর্তমান বিক্ষোভের কারণ। সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগ নেতাদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। তার স্বামীর উপস্থিতিতেই এই ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের অভিযোগ বহু পুরানা। ২০০০ সালে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বাঁধন নাম্নী এক তরুণী, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ও বৃহৎ ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই আন্দোলনের সূত্রপাতও ঘটে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মানিক ধর্ষণের সেঞ্চুরি করার পর মিষ্টি বিতরণের খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ার পর। সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগের যে গ্যাং নারী ধর্ষণ করেছে, তাদের এবং তাদের আশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের বহু অপরাধের নজির অতীতেও ছিল। কিন্তু স্থানীয় ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী মহল এবং পুলিশ প্রশাসনের সমন্বিত আশ্রয়ে তারা দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে ধর্ষণ করার পর বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতন করেছে এবং সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দিয়েছে স্থানীয় যুবলীগের কর্মী দেলোয়ার ও তার গ্যাং। সঙ্গতকারণেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছে সারাদেশ। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে হতবুদ্ধিকর যে ব্যাপারটি ঘটেছে, বেগমগঞ্জের ওই নারীকে নির্যাতন করার ৩২ দিন পরে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরেই কেবল ক্ষোভ, প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর আগে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ কেউই কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি! হাইকোর্ট পর্যন্ত পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মন্তব্য করেছেন, ফেসবুকে না ছড়ালে ঘটনা গোপনই থাকত। ভাইরাল না হলে এই বর্বরোচিত ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থাই নেয়া হতো না সেটা পরিস্কার কারণ একই নারীকে আগে আরো দুইবার ধর্ষণ করেছে দেলোয়ার কিন্তু কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।স্থানীয় মানুষজনও এই যৌন নির্যাতন সম্পর্কে চুপ ছিলেন বিগত এক মাস, স্থানীয় আওয়ামীলীগের আস্কারা ও প্রশ্রয়ে এতটাই দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে দেলোয়ার বাহিনী!
অবশ্য, এই চিত্র গোটা দেশেই ; নিরঙ্কুশ ও একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করার ফলে সারাদেশে এমন শত শত বাহিনী, গ্যাং গড়ে উঠেছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গোটা ক্ষমতাসীন বলয়ের নজিরবিহীন জুলুমের কাছে জিম্মি হয়ে আছে বাংলাদেশের মানুষ।
ধর্ষণ-মারী
বাংলাদেশে করোনা মহামারিতে এখনো প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও মাস্ক পরা আর হাত ধোয়া এবং মানুষকে ‘সচেতন’ হতে বলার বাইরে করোনাকে কেন্দ্র করে আর কোন সরকারি পদক্ষেপ নেই। তবে মহামারি ‘মোকাবেলা’র নামে যত প্রকারের নন-মেডিক্যাল দমনমূলক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব, তার সবই সীমাহীন মাত্রায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই চলছে, রাষ্ট্রীয় পাটকলের বেসরকারিকরণ করা হয়েছে, স্বাস্থ্যখাতে তাক লাগানো দুর্নীতি, ক্রসফায়ার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারের হিড়িক, প্রবাসী শ্রমিকদের বিনা কারণে জেলে পাঠানোর মতো রাজনৈতিক বাস্তবতায় ধর্ষণের মহামারিও যুক্ত হলো। যদিও এটা স্পষ্ট করা দরকার, এমন মনে করা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত হবে না যে এ সকল সরকারি নিপীড়ন মহামারিসৃষ্ট ; বরং ক্রসফায়ার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিপীড়ন ও ধর্ষণের মহামারি বাংলাদেশে বরাবরই বিরাজ করেছে। করোনা মহামারির কালে সেইসব নিপীড়ন বেড়েছে কেবল। যেমন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে আসক ২০৮ টি ধর্ষণের ঘটনাকে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণ’ বলছে। যদিও আমরা মনে করি, প্রতিটি ধর্ষণই সংঘবদ্ধ ধর্ষণ তথা গ্যাং রেইপ। সে প্রসঙ্গে পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব।
আসকের প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যাচ্ছে: চলতি বছর গড়ে প্রতি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রায় ১০৯ জন নারী। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে ৪৩ জনের। ২০১৭ সালে ৮১৮ জন, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন; আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল ৭৬ জনকে।আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছিলেন ১০ জন নারী। নারীর প্রতি সহিংসতার অন্য চিত্রগুলোও ভয়াবহ৷ আসকের বরাতে জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলে জানাচ্ছে: ২০১৯ সালে যৌন হয়ানারীর শিকার হয়েছেন ২৫৮ জন নারী৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ১৭০ জন৷
২০১৯ যৌন হয়রানীর শিকার ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন৷ প্রতিবাদ করতে গিয়ে চারজন নারীসহ ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন৷ যৌন হয়রানীর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৪৪ পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷
তো, এই পরিসংখ্যান মাথায় রেখে আমাদের আলাপ শুরু করা দরকার যে, নানাবিধ রাষ্ট্রীয় সহিংসতার এই বাস্তবতার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘হিউম্যান সিকিউরিটি’র ‘চ্যাম্পিয়ন’ হিশেবে ভূষিত করেছে বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকেরা। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটি কর্তৃক আয়োজিত ওয়েবিনারে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁকে ‘বিশ্বে ও বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বের রোল মডেল’ বলা হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে ‘অগ্রযাত্রা’য় আছে তাতে অচিরেই বাংলাদেশ ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। নারী-শিশু-পুরুষসহ সকল ধর্ম-বর্ণ-জাতি-লিঙ্গের বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবন এক ভয়াবহ খুনে সার্বভৌম ক্ষমতার সম্মুখে নজিরবিহীনভাবে উন্মোচিত করার মাধ্যমে ‘নিরাপত্তা’র ‘চ্যাম্পিয়ন’ খেতাব পাওয়ার ঘটনা কেবল তাৎপর্যপূর্ণই নয়, মতাদর্শিক দ্বৈতচিন্তার অনন্য নজিরও বটে!
বিবিধ বয়ান
ধর্ষণ নিয়ে যেকোন আলোচনা বরাবরই বেশ স্পর্শকাতর বাংলাদেশে। একদিকে, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে কেবলই আত্মশুদ্ধি, পুরুষের ‘পশুত্ব’ বিসর্জন, নৈতিক শিক্ষা তথা মোটাদাগে সাংস্কৃতিক সক্রিয়তার ডিসকোর্স হিশেবে প্রতিষ্ঠা করেছে এ দেশের সুশীল সমাজ; অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচিতে লৈঙ্গিক নিপীড়ন ও সহিংসতাকে রাজনৈতিক এজেণ্ডা হিশেবে ভাবাই হয়নি। এমসি কলেজ কিংবা বেগমগঞ্জের মতো আলোচিত, ভাইরাল হওয়া ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ইস্যুভিত্তিক প্রতিবাদ দেখা গেলেও, সেই প্রতিবাদের অভিমুখও রাজনৈতিক হয়নি, সাংস্কৃতিক থেকে গেছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজ তাঁর সাম্প্রতিক এক লেখায় ধর্ষণের বিরাজমান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সংকটের দিক বিস্তারিত তুলে ধরেছেন।
আবার, এই দেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর অধিকাংশের জন্যও ধর্ষণের ঘটনা তাদের চিরাচরিত নারীবিদ্বেষী ও রক্ষণশীল অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করার মোক্ষম সুযোগের বাইরে তেমন কোন উপলক্ষ্য হয়ে উঠতে পারেনি। গত কয়েকদিনের আলোচিত প্রায় সমস্ত ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ হাজির হওয়ার পরেও ; সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীর ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে এক প্রকারের অস্বীকার ও ইনডেমনিটি দেয়ার পরেও (‘বিশ্বের কোথায় ধর্ষণ হচ্ছে না বলুন-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, নোয়াখালীর নারী নির্যাতনের ঘটনা ‘ষড়যন্ত্র’ হতে পারে-আইনমন্ত্রী), এই দেশের মানুষের ‘নৈতিক মুরুব্বি’ সেজে থাকা এইসব দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নারীর ‘পর্দাহীনতা’র মধ্যেই ধর্ষণের কারণ খুঁজে পাচ্ছেন।
সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্ন হাজির হয়, পর্দাহীনতাই যদি ধর্ষণের কারণ হবে তাহলে মাদ্রাসাগুলোতে একের পর ছাত্র/ছাত্রী ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে কেন? বেগমগঞ্জে যৌন সহিংসতার শিকার নারীর গগনবিদারী আর্তনাদ আমাদের সকলের মানসিক শান্তি লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে: আব্বারে, তোগো আল্লার দোহাই লাগে রে, আমারে ছাড়ি দে…। জাতির ‘নৈতিক মুরুব্বি’ দাবিদার ইসলামপন্থী নেতাদের বলতে পারা উচিত ছিল, বর্তমানে এমনই এক জালিমতন্ত্রের রোষানলে পড়েছে বাংলাদেশের মজলুম জনতা, যেখানে খোদার দোহাই দিয়েও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না, খোদার উপর খোদকারি করছে এক মহাজালিম সার্বভৌম ক্ষমতা। এই সার্বভৌম ক্ষমতার সম্মুখে আজকে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষই মজলুম; আর নারী মজলুমেরও মজলুম।
তবে আশার কথা এই যে, নানাবিধ মতাদর্শিক বাইনারির ঊর্ধে উঠে এসে এই দেশের বামপন্থী উদারপন্থী গণতন্ত্রী কর্তৃত্ববিরোধী ইসলামপন্থীসহ বহু মত পথের অনুসারী তরুণ প্রজন্ম ধর্ষণের পেছনে ক্রিয়াশীল ক্ষমতাকেই চিহ্নিত করতে শিখছে এবং রাজপথে সেই একচেটিয়া ক্ষমতাকেই প্রতিরোধে লিপ্ত আছে।
ক্ষমতা-সম্পর্ক ও সার্বভৌম ক্ষমতা
সমাজ-রাষ্ট্রে বিরাজমান ক্ষমতা-সম্পর্ক যদি অসম, একচেটিয়াধর্মী, কর্তৃত্বক্রমতান্ত্রিক হয় তাহলে লৈঙ্গিক ক্ষমতা-সম্পর্কেও তার ছাপ পড়তে বাধ্য।সহিংসতা যদি হয় ক্ষমতা-সম্পর্কের রুল তথা নিয়ম, তাহলে লৈঙ্গিক ক্ষমতা-সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়বেই। একচেটিয়া ক্ষমতাতন্ত্রের সহিংস মর্দামির স্বরূপ উদঘাটন না করে, ধর্ষণের শিকড় খোঁজার চেষ্টা তেমন কোন কাজে আসবে বলে মনে হয় না। বলপ্রয়োগ, নিপীড়ন, সহিংসতা সার্বভৌম ক্ষমতার’সার্বভৌম’ হয়ে ওঠার ভিত্তি। বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলপ্রয়োগ নির্ভর, সেই অর্থে এই ব্যবস্থা বলাৎকারী ব্যবস্থা। ধর্ষণ এই বলাৎকারী তথা বল-প্রয়োগকারী রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনিবার্য সামাজিক ফলাফল। এটা অসম লৈঙ্গিক ক্ষমতা-সম্পর্কের বল-প্রয়োগের তীব্রতম রূপ, ধর্ষকামী ক্ষমতার বীভৎসতম চেহারা ও উৎকটতম প্রকাশ। পাল্টা বলপ্রয়োগ করে এ জিনিস থামানো যায় না। বিদ্যমান সহিংস ও অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রেখে ধর্ষণের জন্য আলাদা করে ‘ন্যায়বিচার’ কায়েমের উপায় নাই।
ধর্ষণ, লৈঙ্গিক ক্ষমতা-সম্পর্কে , পুরুষের ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে আঁকড়ে থেকে দণ্ডবিধির মাধ্যমে ধর্ষণের ‘মূলোৎপাটন’ করার চিন্তা কেবল আত্মঘাতীই নয়, বরং পরিপ্রেক্ষিত ভেদে তা ধর্ষণের স্বাভাবিকীকরণ ঘটায় মাত্র। ধর্ষক হিশেবে দণ্ডপ্রাপ্ত এমন ১০০ জনের সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন মধুমিতা পাণ্ডে নাম্নী ভারতের এক নারী। তাঁর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালে Washingtong Post এ একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি বীথি সপ্তর্ষি সেই নিবন্ধটির অনুবাদ করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, এইসব দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর চৈতন্যে ধর্ষণের ধারণাই অনুপস্থিত।ধর্ষকদের কারোর মধ্যেই কোন অনুশোচনা ছিল না, দুই-একজন বিরল ব্যতিক্রম বাদে কেউই মনে করেনি ধর্ষণ করে তারা কোন ভুল করেছে ; বরং তারা মনে করেছে পুরুষের নারী ধর্ষণ একটি ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা। এই ধর্ষকদের অনেকে মনেই করেনি যে তারা ধর্ষণ করেছে। তাদের চিন্তাপদ্ধতি আর’পুরুষ’ হয়ে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণ, সম্মতি, অন্যের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদাবোধের ওপর বলপ্রয়োগের সংকট সংক্রান্ত ধারণাগুলোই নেই। অথচ তারা দিব্যি সাজা ভোগ করছে!
তাই বলে কোন সুনির্দিষ্ট ধর্ষণের ঘটনায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে না তা বলা হচ্ছে না। বরং একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতার আশীর্বাদ না পেলে ধর্ষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। প্রথম আলো’তে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নিবন্ধে নৃবিজ্ঞানী হেলাল মহিউদ্দীন ধর্ষণের মহামারী ঠেকাতে নিদেনপক্ষে চারটি আশু পদক্ষেপকে চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো উল্লেখ করে আমরা ধর্ষণের বৃহৎ আর্থ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণ উন্মোচনের চেষ্টা করব:
এক. ধর্ষকদের গায়ের রাজনীতির পোশাকটি (পরিচিতি) সরিয়ে ফেলুন বা পরতে দেবেন না। তাতেই ধর্ষণের সংখ্যা ৯০ ভাগ কমে যাবে। দুই. ইম্পিউনিটি, ‘আমি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকব, ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে আমার সংযোগ আছে’ এ রকম ভাবার সুযোগ বন্ধ করে দিন। আরও ৫টি ধর্ষণ বন্ধ হবে। তিন. ক্ষমতার রাজনীতিতে স্থান করে নেওয়া নারীরা রাজনীতির সুবিধাভোগী হয়ে এই দুই শ্রেণির দুষ্কর্মে নীরব থাকবে না, তা নিশ্চিত করুন,আরও ৪টি ধর্ষণ বন্ধ হবে। চার. বাকি যে এক ভাগ ধর্ষক, ধরা যাক, হ্যাবিচুয়াল রেইপিস্ট বা স্বভাবগত যৌন অপরাধী, তারা দুষ্কর্মের সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়বে। এমনকি আক্রান্ত নারীরাই তাদের কাবু করে ফেলতে পারবে। সেটা তখনই সম্ভব হবে, যদি তাদের আস্থা জন্মায় যে দেশের মানুষ রাজনীতিকে ব্যবহারকারী গুন্ডাদের আর ভয় পাচ্ছে না।
রাজনীতিকে ঢাল বানানো ধর্ষকদের যেকোনো রকম দায়মুক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
‘ন্যায়বিচার’ রূপে প্রতিশোধপরায়ণতা
তবে ধর্ষণের সমাধানের রাজনৈতিক বয়ান হিশেবে সংঘবদ্ধ প্রতিশোধপরায়ণতাকে ‘ন্যায়বিচার’ ভেবে আমরা যেন বিভ্রান্ত না হই। ন্যায়বিচারের নামে কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা, শাস্তির প্রদর্শনির অভিলাষ রাষ্ট্রীয় পরিসরে সহিংসতাকে আরো প্রবল, আরো অনিবার্য করে তোলে। ফলে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শর্ত সমাজে থেকেই যায়। বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত, ধর্ষকাম উৎপাদন অব্যাহত রেখে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে থাকার পর আমরা কি কেবল ধর্ষকের শাস্তি পেলেই সন্তুষ্ট? নাকি আমরা ধর্ষণের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গোড়া উপড়ে ফেলার মতো সমাজ-সম্পর্কের রূপকল্প ভাবতে শুরু করব? সমাজ-রাষ্ট্রের জটিল অসম ম্যাসকুলিন ক্ষমতা সম্পর্ক, পরিবার ও সামাজিক সম্পর্কপ্রণালীতে রাষ্ট্রীয় রক্ষণশীল মতাদর্শের পুনরুৎপাদন অব্যাহত রেখে, সার্বভৌম ক্ষমতার সহিংসতাকে প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিয়ে, লৈঙ্গিক ক্ষমতা-সম্পর্কে পুরুষকে ‘মনিব’ এবং নারীকে ‘দাস’ রেখে ধর্ষণ সমস্যার বিন্দুমাত্র কোন সুরাহা করা সম্ভব নয় সবার আগে এই উপলব্ধি প্রয়োজন।
প্রলোভনের পাটাতন ও যৌনতার ছাঁচ নির্মাণ
সেলিম রেজা নিউটন তাঁর ‘ধর্ষণ বলপ্রয়োগ বলাৎকার’ নামক দুর্দান্ত এক প্রবন্ধে প্রলোভনের সংস্কৃতির উপর বিকশিত রাজনৈতিক অর্থনীতির সাথে বলপ্রয়োগ ও ধর্ষণের সম্পর্ক দেখিয়েছেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সংস্কৃতির স্বার্থেই যৌনতা সম্পর্কিত এক্সক্লুসিভিস্ট ধারণা নির্মাণ করা হয়েছে। ‘আগ্রাসী’ পৌরুষ আর ‘কমনীয়’ নারীত্বের ধারণা গড়ে তোলা হয়েছে বিপুল মিডিয়া ,বিনোদন ও বিজ্ঞাপনী ইণ্ডাস্ট্রির মাধ্যমে। একদিকে আছে নারীর শরীর, মনোজগত, নারীর যৌনতা সহ সার্বিক নারীসত্তার উপর পুরুষালি একচ্ছত্র মালিকানা ও কর্তৃত্বপরায়নতা ; অন্যদিকে আছে নারীর’কমনীয়’ যৌনতার হাতছানি, ম্যানিপুলেশন।
এই দুইয়ে মিলে গড়ে উঠেছে পৌরুষ ও নারীত্বের বিশেষ ধারণা : নারী এবং পুরুষের মাঝখানে উপস্থিত যৌন ক্ষুধা এবং যৌন অবদমন। দু-জনের বেলায় এর প্রকাশ দু-রকম। পুরুষের বেলায় আগ্রাসন-আক্রমণ, অর্থাৎ নারীধর্ষণ। নারীর বেলায় যৌনসত্তার ‘সেক্সি’ বিনির্মাণ ও বিনিময় দিয়ে পুরুষকে ম্যানিপুলেট করা, করায়ত্ত করা। নির্দিষ্ট মাপমতো যৌনতা এখন ক্ষমতা বৈকি। এ দিয়ে পুরুষকে কব্জা করা যায়। দুটোই পুরুষতান্ত্রিক।দুটোই প্রেমহীন। কামপরায়ণ। প্রেম মানে সঙ্গীকে পরিতৃপ্ত করে নিজে সুখী হওয়া। কাম মানে সঙ্গীকে ব্যবহার করে আত্মরতি চরিতার্থ করা। এ আসলে কর্তৃত্বপরায়ণ বাসনা। অথরিটারিয়ান ডিজায়ার অফ ডমিনেশন। এই সুখ আধিপত্যের বিকৃত সুখ – এমনকি খুনের ক্ষেত্রেও, এমনকি ধর্ষণের ক্ষেত্রেও। দুটোই যুগের অসুখ। দুটোই নিওলিবারাল কালপর্বের রোগলক্ষণ। এই রোগ রাজনৈতিক, মানে ক্ষমতাকেন্দ্রিক– সামাজিক নয়। তাই বলে কোনোটাই অপরটার কারণ নয়। একটা আরেকটার ফলাফলও নয়। উভয়েরই কারণ কর্তৃত্বতন্ত্র। উভয়েরই ফলাফল কর্তৃত্বতন্ত্র। এ দুটোর একটা দিয়ে আরেকটাকে জায়েজ করা যায় না কিছুতেই। দুটোই অগ্রহণযোগ্য। দুটোই বাজারের বিকার। বাজারের যুগে মনুষ্যত্বের বিকার। সমাজের সর্বত্র এই বিকার দৃশ্যমান। শিক্ষার্থী-শিক্ষক অফিসার-কর্মচারী বিক্রেতা-খরিদ্দার উকিল-মক্কেল বিচারক-অপরাধী ডাক্তার-রুগি নারী-পুরুষ চোর-পুলিশ ইত্যাদি সম্পর্ক সমুচয়ে এই বিকারের আছর পড়েছে।
পুরুষের আগ্রাসী ও নারীর কমনীয় যৌনতার উপর বিকশিত রাজনৈতিক অর্থনীতি-সংস্কৃতির বাস্তবতাতেই কিন্তু ধর্ষণ নামক যৌন সহিংসতা আদৌ সম্ভবপর হয়ে ওঠে। কারণ যৌনতার এই সংস্কৃতিতে নারী যৌনতার ‘দাতা’, পুরুষ ‘গ্রহীতা’।
ধর্ষণ: সহিংসতার বাতাবরণ
ধর্ষণে যে আদতে সহিংসতাই লক্ষ্য, যৌনতা উপায় এই ধারণাও অনুপস্থিত। ফলে ধর্ষণকে ‘বিকৃত’ যৌনলালসা এবং ধর্ষককে ‘পশু’ ভাবার মতো কমনসেন্স তৈরি হয়। এতে মুশকিল হয় এই যে, বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার সহিংসতার মধ্যেই যে ধর্ষণের শর্ত বিস্তার লাভ করছে এই বাস্তবতা আড়ালে থেকে যায়। ধর্ষণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত মামলা ; ধর্ষক হয়ে ওঠে আমাদের সাজানো-গোছানো বাগানে তথা ‘সব ঠিক আছে’ সমাজ-সংসারে’বিশেষ’ ,’বিচ্ছিন্ন’ পৃথক এক প্রকার ‘অনুপ্রবেশকারী’ মাত্র। ধর্ষক ‘নির্মূল’ তথা লিঙ্গ কাটাকাটিই হয়ে দাঁড়ায় সারকথা।
সম্প্রতি নৃবিজ্ঞানী নাসরিন খন্দকারও ধর্ষণ ও সহিংসতাকে সম্পর্কিত করে সংক্ষিপ্ত একটি ফেসবুক পোস্ট লিখেছেন: খেয়াল করে দেখলাম বেশিরভাগ মানুষই যৌন সহিংসতাকে সহিংস যৌনতা বলে ভাবেন।
সহিংসতা মানে অন্যকে শারীরিক, মানসিক আঘাত দেয়া, নির্যাতন করা, অপমান করা, হেয় করা। যৌন সহিংসতা মানে হল যৌনাঙ্গ বা যৌনউপকরন ব্যবহার করে অন্যকে শারিরিক, মানষিক নির্যাতন করা। যৌনতা এখানে লক্ষ্য না, হাতিয়ায়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন উল্টাটা। তারা মনে করেন যৌনতা এখানে লক্ষ্য, সহিংসতা হাতিয়ার। মনে করেন ধর্ষণের কারণ যৌন আকাঙ্ক্ষা, আর এর পরিতৃপ্তির জন্যে সহিংস পথ বেছে নিতে তাদের বাধে না। এরকম ভাবনার কারণ হল তারা সহিংস যৌনতা বলে কিছু একটার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারেন। এই কল্পনা ভয়ঙ্কর। সহিংস যৌনতা বলে কিছু নাই। আর তাই ধর্ষণের লক্ষ্য যৌনতৃপ্তি না, সহিংসতার তৃপ্তি। ধর্ষণের সাথে যৌনতার সম্পর্ক করা বা একে সহিংস যৌনতা হিসেবে দেখা আর কোদাল দিয়ে মানুষ খুন করাকে বাগান করা বলা একই কথা।
তবে এটাও ভুলে গেলে চলবে না, ‘নারী’ কোন মনোলিথিক তথা সমরূপ জেণ্ডার আইডেন্টিটি নয়। শ্রেণী-বর্ণ-ধর্ম-জাতপাত ভেদে নারী ক্ষমতা-কাঠামোর একেক স্তরে বিরাজ করে, ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই একেকভাবে সহিংসতার সম্মুখে উন্মোচিত। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সংঘটিত যেকোন সহিংসতা নিয়ে আলাপের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, একেকক্ষেত্রে নারীর প্রান্তিকতার একেক ফ্যাক্টর মুখ্য হয়ে উঠতে পারে। যেমন সম্প্রতি ভারতের উত্তরপ্রদেশের হাথারাসে এক দলিত তরুণী নির্মম ধর্ষণের শিকার হয়েছে উচ্চবর্ণের বিজেপি সমর্থক পুরুষের দ্বারা, এই ধর্ষণকে কেন্দ্র করে ভারতে দলিত নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি আলাদা মনোযোগ পাচ্ছে।
কারণ দলিত হওয়ার কারণে ক্ষমতা-কাঠামোর একেবারে বাইরে অবস্থান করে ভারতের বিপুল সংখ্যক মানুষ, বর্ণগত প্রান্তিকতার সাথে জেণ্ডার প্রান্তিকতা মিলে বীভৎস সহিংসতার শিকার হতে হয় অসংখ্য নারীকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে দলিত নারীদের গড় আয়ুষ্কাল উচ্চবর্ণের নারীদের তুলনায় প্রায় ১৫ বছর কম।
একইভাবে জাতি ও ধর্ম পরিচয়ের কারণে যখন কোন নারী ধর্ষণের শিকার হয়, তখনও সেই জাতিগত-ধর্মীয় প্রান্তিকতাকে মুছে দিয়ে কেবল ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ হিশেবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করাটাও ত্রুটিপূর্ণ। এটা বিরাজমান নানাবিধ কাঠামোগত সহিংসতার পেছনে ক্রিয়শীল জাতিগত-ধর্মীয়-শ্রেণীগত-বর্ণগত মাত্রাকে অস্বীকার করতে চায়।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন কোন আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হয় কিংবা রোহিঙ্গা নারী যখন ধর্ষণের শিকার হয়, তখন জেণ্ডার পরিচয়ই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়, জাতিগত পরিচয়ও বিবেচ্য বিষয়। কোন নারী যদি তার মুসলিম পরিচয়ের কারণে ধর্ষণের শিকার হয় (ভারতে যেটা অহরত ঘটে), তখনও ধর্মীয় পরিচয় মুছে দিয়ে কেবলমাত্র ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা’ বলার মধ্যে ধূর্ততা অথবা নির্বুদ্ধিতা কাজ করতে পারে। অর্থাৎ কাঠামোগত সহিংসতাকে চিহ্নিত করতে হবে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতি-শ্রেণীর এক বা একাধিক প্রান্তিকতার পারস্পরিক ছেদ (intersectionality) এর মাধ্যমে।
সহিংসতার মতাদর্শিক পুনরুৎপাদন
বাংলাদেশ যেন এক অদ্ভুত গোলকধাঁধায় পড়েছে। এখানে দুনিয়ারভতাবৎ দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ডিস্কোর্স সম্পর্কে বোঝাপড়া (অন্তত দাবি তো সেরকমই!) এবং পশ্চিমের এনলাইটেন্টমেন্ট নখদর্পণে থাকার আস্ফালন লক্ষ্য করা গেলেও ; রাষ্ট্র, সার্বভৌম ক্ষমতা, সহিংসতা সম্পর্কিত বোঝাপড়ার চরম ঘাটতি দেখা যায়। বিরল ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এখানে নানা মত নানা পথের ‘বাদী’গণের আপাত পার্থক্যের বাইরে এক বিরল সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়: যেকোন ছুঁতোয় রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও দণ্ডকে আরো বিকল্পহীন করার/ভাবার ক্ষেত্রে। এইদিক বিবেচনায় অধিপতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-নৈতিক এলিটগণ সকলেই দণ্ডবাদী। পৃথিবীর তাবৎ সমস্যার তারা একটাই সমাধান ভাবতে পারেন : দণ্ড-প্রদর্শনিমূলক শাস্তি-কারাগার-নির্মূল।
এই বাস্তবতায় সমস্ত বাদ-প্রতিবাদ থেকে উৎসারিত বয়ান শেষমেষ সমাজকে আরো সহিংস করে তোলে। বিরুদ্ধ স্রোতের মানুষ ও চিন্তা যে একেবারেই নেই তা নয়, কিন্তু তাদের স্বর এতটাই ক্ষীণ যে তাদের অস্তিত্ব প্রায় টের পাওয়া যায় না বললেই চলে। এই বাস্তবতার সাথে যুক্ত হয়েছে মিডিয়া ও মব ট্রায়াল। অনেকেই ভাবেন, তথাকথিত ‘বিচারহীনতা’ ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতিই ক্রসফায়ার (বাংলাদেশের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক কীভাবে ক্রসফায়ারকে ধারণ করে তার বিস্তারিত আলাপ অনুসরণের জন্য এই লেখায় ঢুঁ মারুন) কিংবা মব লিঞ্চিং এর বাস্তবতাকে অনিবার্য করে তুলেছে; কিন্তু শ্বাশত ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং সদা সর্বদা ন্যায়পরায়ণ ‘আইনের শাসন’ নামক কোন ধারণায় যদি আমরা আস্থাশীল না হয়ে থাকি, তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব যে, বিদ্যমান মিলিটারাইজড মিডিয়া-ক্ষমতা কমপ্লেক্স আসলে একটা আরেকটার বিকল্প কিংবা অনুপস্থিতি নয়, বরং পরিপূরক।
অনেকগুলো কেইস স্টাডি উল্লেখপূর্বক দেখানো যায় যে, মিডিয়া ট্রায়াল কিংবা মব ট্রায়াল প্রাতিষ্ঠানিক ‘বিচারহীনতা’র ফল নয়, বরং আইনের শাসনের নামে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিশোধপরায়নতারই প্বার্শপ্রতিক্রিয়া মাত্র। বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ: প্রধান আসামী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে ক্রসফায়ারের নামে খুন করা, স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা ও এমপিপুত্রের নেতৃত্বে মিন্নির বিরুদ্ধে সংঘটিত প্রপাগাণ্ডা, নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নির চরিত্রহননের মাধ্যে বিরাজমান নারীবিদ্বেষী সামাজিক পরিস্থিতিকে আরো উস্কে দেয়া, মিন্নিকে সাক্ষী হিশেবে তুলে নিয়ে গিয়ে আসামী হিশেবে হাজির করা, সর্বশেষ রায়ে নিম্ন আদালতের পর্যবেক্ষণ : “মিন্নির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তাঁকে অনুসরণ করে তাঁর বয়সী মেয়েদের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই এ মামলায় তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।”
মিন্নির ফাঁসির রায়ে সমাজের বিপুল অংশের নারীবিদ্বেষী পুরুষকে ‘স্বস্তি’ প্রকাশ করতে দেখা যায়। যেন তাদের নুকুপুশু সমাজ সত্যিই এক’বিপথগামী’র হাত থেকে রক্ষা পেল! অথচ নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও দলীয় প্রভাবাধীন প্রশাসনের ছত্রছায়ায় যে মাদক ও অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে বরগুনাসহ সারাদেশে, যার জের ধরে রিফাত হত্যা সংঘটিত হয়েছে তা দিব্যি আড়ালে থেকে গেল। মিন্নির এই ঘটনায় প্রাতিষ্ঠানিক ‘বিচার’, মিডিয়া ও মব ট্রায়াল একটি অন্যটির অনুপস্থিতি নয়, বরং একটি অন্যটির পরিপূরক। ঠিক একইভাবে ইণ্ডিয়ার বাবরি মসজিদ ট্রায়াল কিংবা আফজাল গুরুর মৃত্যুদণ্ড বিশ্লেষণ করেও দেখানো যেতে পারে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিশেবে আদালত,মিডিয়া ও মব মিলেমিশেই এক বৃহৎ কমপ্লেক্স (নাকি ‘গ্যাং’? হিশেবে দানবমূর্তিসহ দাঁড়িয়ে আছে। (পড়ুন: লিঞ্চিং রিপাবলিক)
এই প্রসঙ্গ তুললাম কারণ, এমনই আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ধর্ষণের মতো চরম নৃশংস সহিংসতা নিয়ে আলাপ করার সময় আমাদের ক্রসফায়ার নিয়েও আলাপ করতে হয়। ধর্ষণ ‘নির্মূল’ করার লক্ষ্যে ক্রসফায়ারের দাওয়াই ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং এর পিছনে কাজ করছে রাজনৈতিক দল-মিডিয়া-সুশীল সমাজ-প্রগতিশীল মহল এমনকি দণ্ডবাদী নারীবাদী গ্রুপের একটা অংশের নিরলস প্রচার-প্রচারণা। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, কিন্তু সকল ধর্ষণের ঘটনাই সমান মনোযোগ ও আলোড়ন সৃষ্টি করে না। যখনই কোন ধর্ষণের ঘটনা কিংবা ভিডিও ভাইরাল হয় এবং জাতির বিবেককে তীব্রভাবে নাড়া দেয়, তখন সমাজে আগে থেকেই বিরাজমান গণবিকার ও মরবিডি যেন আরেকটু উস্কানি পায়। শুরু হয় মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে ক্রসফায়ারের অনিবার্যতা প্রমাণের তোড়জোড়।
এই তালিকায় যুক্ত হয় কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে নারীবাদীরাও! অনেকে ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন, ক্রসফায়ার,গণপিটুনির প্রেসক্রিপশন বাতলান রীতিমতো গর্বের সাথে। একটা সর্বাত্মক ক্ষমতাধর শাসনপ্রণালীতে এমনকি পৌরাণিক চরিত্রেরও সরকারীকরণ ঘটে: আবির্ভাব ঘটে হারকিউলিসের। তবে এটাও সত্য যে, ক্ষীণ হলেও বাংলাদেশের প্রতিরোধী নারীবাদী ধারার একটা অংশ কিন্তু নারীবাদী এজেণ্ডার সামরিকীকরণের বিপদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। নাসরিন সিরাজের ‘হারকিউলিসের আবির্ভাব : বাংলাদেশের নারীবাদী এজেণ্ডার সামরিকীকরণ’লেখাটি সেই ধারারই শক্তিশালী প্রতিনিধিত্বশীল একটি প্রবন্ধ।
যারা ধর্ষকের ক্রসফায়ার চায়, তাদের ধর্ষণ নিয়ে আপাত অর্থে ‘মহাউদ্বিগ্ন’ মনে হলেও আদতে ধর্ষণের মতাদর্শিক বাস্তবতা উৎপাদন ও প্রচারে তাদের ভূমিকাও কম না। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র আগাগোড়াই আইন-বেআইনের মোড়কে সহিংসতার উপর নির্ভরশীল একটা রাষ্ট্র, যেখানে সহিংসতাই রুল।আওয়ামীলীগ সরকার গত এক যুগে এই রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে নজিরবিহীন স্তরে নিয়ে গেছে।
ধর্ষণ, লৈঙ্গিক ক্ষমতা-সম্পর্কের বিবেচনায়, সেই একচেটিয়া সহিংস পরিস্থিতিরই উৎপাদ ; বিচ্ছিন্ন তো মোটেও নয়। এজন্যই একদিকে যেমন ক্রসফায়ার বেড়েছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্ষণ। ফলে যেসব ধর্ষণে এমনকি ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা জড়িত নয় ( বর্তমানে সংঘটিত অধিকাংশ ধর্ষণেই তাদের জড়িত থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে), সেসব ধর্ষণের জন্যও সরকার তথা রাষ্ট্রই দায়ী। [এটা বলার অর্থ কোনভাবেই সুনির্দিষ্ট ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে না তা না।]
সার্বভৌম ক্ষমতার ‘গ্যাং রেইপ’
সমাজ-রাষ্ট্রে বলপ্রয়োগ ও সহিংসতা ব্যাপক মাত্রায় কমানো সম্ভব হলে, ব্যক্তির চূড়ান্ত বিকাশ, স্বাধীনতাবোধ জাগ্রত করা গেলে এবং সমাজকে সার্বভৌম ক্ষমতার সহিংসতামুক্ত গণতান্ত্রিক ও স্ব-শাসিত করা গেলে ; লৈঙ্গিক ক্ষমতা-সম্পর্কে তার প্রভাব না পড়ে পারে না। অর্থাৎ, সহিংসতার উৎপাদন করে সরকার ও রাষ্ট্র ; তার মতাদর্শিক পুনরুৎপাদন ঘটায় ক্রসফায়ারপ্রেমী বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা অংশ। ‘আম জনতা’র ক্রসফায়ার সমর্থক অংশ মূলত সেই বাস্তবতারই গ্রাহক/ভোক্তা মাত্র।
তো, একদিকে ধর্ষণ নিয়ে আপাত উদ্বেগ; আবার অন্যদিকে ক্রসফায়ারের মাধ্যমে ধর্ষক ‘নির্মূল’ করার বাসনা ; রীতিমতো আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা। এর মাধ্যমে ধর্ষণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক রাজনীতির মূলোৎপাটনে বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখা সম্ভব না। বরং, সমাজে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বৈধতা প্রদানের মাধ্যমে ধর্ষণের বাস্তবতা/শর্ত জিইয়ে রাখা সম্ভব মাত্র।
সেলিম রেজা নিউটনের উল্লেখিত প্রবন্ধে তিনি বলেছেন: ধর্ষণ ব্যক্তিগত মামলা নয়। ধর্ষণ কোনো ফৌজদারি মামলাও নয়। কোনো ক্রাইমই আসলেক্রিমিনাল কেস নয়, পলিটিক্যাল কেস। ধর্ষক হয়ে ওঠার আগেই সম্ভাব্য ধর্ষকের সামনে সদাহাজির থাকে খোদ ‘ধষর্ণ’ এর ধারণা।” আর আমরাআগেই দেখিয়েছি, খোদ বিদ্যমান ব্যবস্থাই বলাৎকারী তথা ধর্ষকামী। এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত থাকে ধর্ষণের রাজনীতি, ধর্ষণের সংস্কৃতি। উত্তেজককথাবার্তা ও ‘সমাধান’ থেকে মনোযোগ সরাতে পারলে আমরা ঠিকই বুঝতে পারব: ধর্ষণ জিনিসটা তাই আইনের শাসনের নিছক একটি বিজ্ঞাপন বা প্রকাশ। আইনের শাসনের মূলনীতি বলপ্রয়োগ; আর ধর্ষণের মূলনীতি বলাৎকার। এইটুকুই যা পার্থক্য। আসলে ঐটুকুই তো মিল। অভিধান ও অর্থতত্ত্ববলছে, বলপ্রয়োগ আর বলাৎকার আদতে একই বস্তু।
সাংবাদিক ও গবেষক আরিফ রেজা মাহমুদ যথার্থই চিহ্নিত করেছেন: প্রতিটি ধর্ষণই আসলে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। ধর্ষণ হিসেবে একজনের মুখ দৃশ্যমান হয় বটে, কিন্তু এই ধর্ষণকে যৌক্তিক করে তোলে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র বলতে লাগামহীন সার্বভৌম ক্ষমতার অক্ষ : রাজনৈতিক দল-পুলিশ-আইন-বিচার ব্যবস্থা-মিডিয়া- মহাজন সমগ্রটাই। রাষ্ট্র স্বয়ং ধর্ষক রূপে ছিন্নভিন্ন করে শরীর আর আত্মাকে। তাই ধর্ষণ সবসময়ই সংঘবদ্ধ ও পরিকল্পিত। আর একে সংঘটিত করে পুরুষতন্ত্র। পুরুষের সার্বভৌম ক্ষমতা আর রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা এখানে পারস্পরিক— মিলে মিশে একাকার। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে শুধু পুরুষতন্ত্র কল্পনার অর্থ হচ্ছে ক্ষমতাভক্তি। আর আর পুরুষতন্ত্র বাদে রাষ্ট্রের আইনের শাসনের ঘাটতি আবিস্কার, খোদ ধর্ষণকে ‘গণতান্ত্রিক’ করে তোলার মনোবাঞ্ছা।
স্বাধীনতাশীল ও একচেটিয়া কর্তৃত্বমুক্ত সমাজ-সংগঠন-সম্পর্কপ্রণালীর রূপকল্প
বিদ্যমান বলাৎকারী শাসনপ্রণালীকে ছাপিয়ে ভিন্ন এক সমাজ-সম্পর্ক আমাদের ভাবতে পারতে হবে ; যেখানে অন্যকে অপমান-অপদস্থ করা, অন্যের উপর জবরদস্তি করার অর্থ আদতে নিজেকেই অপমান করা, নিজের মানবিক সত্তার মর্যাদানাশ করা। যেখানে লিবার্টির অর্থ হচ্ছে স্ব-অধীনতা ; প্রত্যেকে প্রত্যকের বিরুদ্ধের বদলে সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যকে মোরা পরের তরে।
এমন এক সমাজ-সম্পর্ক, যেখানে অন্যের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত না করে, অন্যের মর্যাদাকে স্বীকার না করে, নিজের স্বাধীনতা-মর্যাদার কথা কল্পনাই করা যায় না। এমন এক সমাজ-সংগঠন; যেখানে নারীর ওপর পুরুষের, নারী-পুরুষ ও সমাজের ওপর রাষ্ট্রের, প্রাণ-প্রকৃতির ওপর মনুষ্যকেন্দ্রীক সভ্যতার সার্বভৌমত্বের অবসান ঘটবে। মানুষ ও না-মানুষ (non-human) সত্তার কোয়ারেন্টাইন দশা ( state) কাটবে অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ-সম্পর্ক এবং মানুষ ও প্রাণ-প্রকৃতির সহাবস্থানের মাধ্যমে।
এমন এক সর্বাত্মক সমতা-সম্পর্কে নারী-পুরুষের সম্পর্কের রেপ্রিজেণ্টেশন কেমন হবে? গণতান্ত্রিক, পরস্পর পরস্পরের অধীন, সমান এজেন্সিসম্পন্ন,হায়ারার্কি/কর্তৃত্বের একমুখী (পুরুষ থেকে নারী) পাটাতনকে ভেঙ্গে ফেলা। অর্থাৎ ব্যাপারটা যাচ্ছে, একটা কর্তৃত্বমুক্ত, গণতান্ত্রিক সমাজ-সম্পর্কের দিকে; যেখানে নারীর সত্তা পুরুষ কর্তৃত্বের কোয়ারেণ্টাইনে থাকবে তা কেবল অসম্ভবই নয়, অকল্পনীয়ও বটে।
ছবি কৃতজ্ঞতা
প্রচ্ছদ: ঋদ্ধ অনিন্দ্য
ছবি ১: অজ্ঞাত
ছবি ২: রুবি মানজুমান মৌ
ছবি ৩: আবদুল্লাহ কাফি
ছবি ৪: আবদুল্লাহ কাফি
Sarwar Tusher is an author and activist; interested in studying the state, power, authority, sovereignty, violence, and social relations.