ভুমিকা: ইসলামে ও ইসলামি দুনিয়ায় মূর্তি, ভাষ্কর্য, ছবি, ফিগারেটিভ ইমেজ বা প্রতীককে কেন্দ্র করে যে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ও রাজনীতি চালু ছিল বা আছে সে বিষয়ে কিছু প্রবন্ধ/নিবন্ধ শুদ্ধস্বর ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার বিবিসিতে প্রকাশিত জন ম্যাকমানুসের (John McManus) একটি নিবন্ধ অনুবাদ করা হয়েছে। ২০১৫ সালে, শার্লি হেব্দোতে আক্রমণের প্রেক্ষাপটে, বিবিসি ‘Have pictures of Muhammad always been forbidden?’ শীর্ষক নিবন্ধ প্রকাশ করে। এখানে শার্লি হেব্দোর কার্টুন বা ব্যাঙ্গাত্মক ছবি নিয়ে আলোচনা করা হয় নি; বরঞ্চ ইসলামে ছবি আঁকা ও নবী মুহাম্মদের ছবি নিয়ে বিভিন্ন গবেষক ও আলেমদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন শুদ্ধস্বরের অনুবাদক টিম।
নবী মুহাম্মদ এর বিদ্রূপাত্মক কার্টুনগুলো অপমানজনক কিনা সে প্রশ্ন যদি একটি পাশে সরিয়ে রাখি, তাহলে ইসলামের মধ্যে আরেকটা আলাদা ও জটিল বিতর্ক পাবো: যে কোনো ধরণের ছবি আঁকা, এমনকি সেটা সম্মানজনক হলেও, নিষিদ্ধ কি না।
বেশিরভাগ মুসলমানের জন্য এটি সম্পূর্ণ হারাম বা নিষেধ; মুহাম্মদ বা ইসলামের অন্যান্য নবীদেরকে কোনোভাবেই চিত্রিত করা যাবে না।মূর্তি ও ছবি মূর্তি-পূজাতে উৎসাহ করতে পারে বলে মনে করা হয়।
এটি ইসলামী দুনিয়ার অনেক অংশে অবিতর্কিত। ঐতিহাসিকভাবে, ইসলামী শিল্পের রূপগুলোর মধ্যে জীবজন্তুর ছবি বা ফিগারেটিভ আর্টের চেয়ে জ্যামিতিক, ঘূর্ণায়মান নিদর্শন বা ক্যালিগ্রাফি বেশি প্রভাবশালী ছিল।
মুসলমানরা নবী ইব্রাহিম বিষয়ক কোরআনের একটি আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করেন: ‘[ইব্রাহিম] যখন সে তাহার পিতা ও তাহার সম্প্রদায়কে বলিল, ‘এই মূর্তিগুলি কী, যাহাদের পূজায় তোমরা রত রহিয়াছ!’ উহারা বলিল, ‘আমরা আমাদের পিতৃপুরুষগণকে ইহাদের পূজা করিতে দেখিয়াছি।’ সে বলিল, ‘তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের পিতৃপুরুষগণও রহিয়াছে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে।’
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মোনা সিদ্দিকীর মতে, তবুও কোরআনে নবীর চিত্রায়নকে নিষিদ্ধ করার কোনও সুস্পষ্ট রায় নেই। বরং, বিভিন্ন হাদিস থেকে এই ধারণার জন্ম নিয়েছে।
সিদ্দিকী মঙ্গোল এবং অটোমান সাম্রাজ্যের কাল থেকে মুসলিম শিল্পীদের আঁকা মুহাম্মদের চিত্রের দিকে ইঙ্গিত করেন। তাদের মধ্যে কয়েকটিতে মুহাম্মদের মুখের বৈশিষ্ট্য লুকানো- তবে এটি স্পষ্ট যে এটি তিনিই। তিনি বলেন, ছবিগুলো ভক্তি ও শ্রদ্ধার সহিত আঁকা হয়েছে: “বেশিরভাগ লোকেরা এই ছবিগুলো ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার জায়গা থেকে এঁকেছেন, মূর্তিপূজা করার উদ্দেশ্যে নয়।”
তাহলে কখন মুহাম্মদের চিত্রায়ন হারাম বা নিষিদ্ধ হয়ে গেলো?
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক আর্টের গবেষক ক্রিশ্চিয়ান গ্রুবার বলেছেন, ১৩০০ দশক থেকেই নবী মুহাম্মদের অধিকাংশ ছবি কেবল ব্যক্তিগতভাবে দেখার নিয়তে করা হয়েছিল, মূর্তি পূজা এড়ানোর জন্য। তার মতে, ‘সম্ভবত অভিজাতদের বিলাসবহুল উপাদান হিসেবে মাঝে মাঝে এগুলি গ্রন্থাগারে স্থান পেত।’
এগুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিত্রও অন্তর্ভুক্ত ছিল যা ইসলামের বিভিন্ন চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতো।
গ্রুবার বলেন, ১৮০০ শতকের প্রিন্ট মিডিয়ার অগ্রগতি এবং বহুল প্রচার একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে হাজির হয়। ইউরোপীয় বাহিনী ও চিন্তা কর্তৃক কিছু মুসলিম ভূমির উপনিবেশায়নও ছিল উল্লেখযোগ্য বিষয়।
গ্রুবার যুক্তি দেন যে, এ ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতিক্রিয়া ছিল এটা দেখানো যে খ্রিষ্টধর্ম থেকে তাদের ধর্ম কতটা আলাদা; এমনকি জনপরিসরে মূর্তি শিল্পের [পাবলিক আইকনোগ্রাফি] ক্ষেত্রেও। তখন থেকেই মুহাম্মদের ছবিগুলো অদৃশ্য হতে শুরু করে, এবং ছবি আঁকার বিরুদ্ধে একটি নতুন বক্তব্য প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়।
তবে যুক্তরাজ্যের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ, লিডস মক্কা মসজিদের ইমাম ক্বারী আসিম এই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের বিষয় অস্বীকার করেছেন।তার মতে, জীব জন্তুর ছবি আকার বিরুদ্ধে হাদিসশাস্ত্রের হুকুম মোহাম্মদের ছবির ক্ষেত্রেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষেধাজ্ঞা হাজির করে।
তার মতে, মধ্যযুগীয় চিত্রগুলোকে পরিপ্রেক্ষিত অনুসারে বুঝতে হবে। ‘এ ছবিগুলো একটি বিশেষ রাতকে কেন্দ্র করে। শবে-মেরাজের ঘটনা।ঘোড়াসদৃশ প্রাণী রয়েছে, তিনি তার উপর উপবিষ্ট। আগের আলেমরাও এই চিত্রগুলো খুব তীব্র নিন্দা করেছেন। তবু সেগুলোর উপস্থিতি রয়েছে।’
একটি মূল বিষয় হল এগুলো নবীজীর সাধারণ প্রতিকৃতি নয়। আসিম আরও যুক্তি দেন যে, অনেকগুলো চিত্রের বিষয় অস্পষ্ট। তার মতে, ‘সবগুলো চিত্রই নবীকে নাকি তার কোনো ঘনিষ্ঠ সহচরকে চিত্রায়ন করেছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’
এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হিউ গডার্ড বলেছেন যে, একটা পরিবর্তন এসেছে। ‘কোরআন ও হাদিস উভয়ের মধ্যে সর্বসম্মতি নেই।পরবর্তী বিভিন্ন মুসলমান সম্প্রদায় বিভিন্ন প্রশ্নে একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন।’
আরব পন্ডিত মুহাম্মদ ইবনে আবদ আল-ওহাব ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি; তার শিক্ষাই ওহাবিবাদের রাস্তা প্রশস্ত করে দিয়েছিল।‘মুহাম্মদ ইবনে আবদ আল-ওহাবের আন্দোলনের সাথে সাথে এই বিতর্ক আরো জোরালো ও তীব্র হয়ে ওঠে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যে কিছুর প্রতি ভক্তি বা শ্রদ্ধাকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো; এমনকি নবীও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।’
‘অবশ্যই গত ২০০ বা ৩০০ বছর ধরে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে।’
গডার্ডের মতে, ভাস্কর্য বা অন্য যে কোনও ধরণের ত্রি-মাত্রিক চিত্র সম্পর্কে পরিস্থিতিটা ভিন্ন। এখানে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সর্বদা পরিষ্কার করা হয়েছে।
সিদ্দিকী বলেছেন, কিছু কিছু মুসলমানের ছবির প্রতি এতই বিতৃষ্ণা জন্মেছে যে সে ঘরবাড়িতে মানুষ বা প্রাণীর যে কারোরই ছবি রাখতে অস্বীকার করেছে।
চিত্রকল্পের বিরুদ্ধে এমন নিষেধাজ্ঞা সর্বত্র ছড়িয়ে যায়নি – অনেক শিয়া মুসলমানের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা আলাদা ছিল বলে মনে হয়। ইরানি আলেম হাসান ইউসেফী এশকাওয়ারীর মতে মুহাম্মদের সমসাময়িক চিত্রগুলি এখনও মুসলিম বিশ্বের কিছু অংশে পাওয়া যায়। তিনি বিবিসিকে বলেছেন যে, আজও অনেক ইরানের বাড়িতে মুহাম্মদের ছবিগুলি ঝুলছে: ‘ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই ছবিগুলিতে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। এই ছবিগুলো দোকানের পাশাপাশি ঘরদোয়ারেও রয়েছে। ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলোকে আপত্তিজনক হিসাবে দেখা হয় না।’
মুসলমানদের মধ্যে পদ্ধতিগত পার্থক্যগুলো চিরাচরিত শিয়া/সুন্নি বিভাজনের আলোকে দেখা যেতে পারে, কিন্তু যারা দাবি করেন যে ঐতিহাসিকভাবে এমন নিষেধাজ্ঞা সর্বদা ছিল তারা ভুল বলেন।
এই যুক্তি অনেক মুসলমান গ্রহণ করেন না।
ইনস্টিটিউট অফ ইসলামিক পলিটিকাল থটসের সাবেক প্রধান ড. আজ্জম তামিমি বলেন, ‘কুরআন নিজে কিছু বলে নাই, কিন্তু সকল ইসলামি কর্তৃপক্ষ এটা মানেন যে, নবীজী এবং অন্যান্য নবীদের ছবি আঁকা যাবে না কারণ ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী তারা অভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ, অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব; ফলে তাদের অসম্মান হতে পারে এমন কোনো উপায়ে তাদেরকে উপস্থাপন করা উচিৎ নয়।’
তিনি এই যুক্তিতে বিশ্বাসী নন যে, মধ্যযুগে নবীজীর চিত্রাবলী আছে বলেই এ ব্যাপারে কোনো কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে না। ‘এমনকি এটি থাকলেও আলেমরা এর নিন্দা করতেন।’
ছবি সূত্র: The Praiseworthy One: Devotional Images of the Prophet Muhammad in Islamic Traditions