নাদিন শান্তা মুরশিদ । বিষয়ঃ নারী-পুরুষের সম্পর্ক

Share this:

যুক্তরাষ্ট্রে আমার মেয়ে বন্ধুরা যখন কারো সাথে ডেট এ যায়, আমাদের কাউকে জানিয়ে যায়। আমরা জানি কোথায় তাদের দেখা হবে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বন্ধুর কাছ থেকে একটা মেসেজ পাই, বাড়ি ফিরেছি, অলগুড।
এটা কেন করতে হয়, সেটা নিশ্চয় খুলে বলার প্রয়োজন নাই।

কিন্তু তাও বলি। আমরা যে হাইপার সেক্সুয়াল অতি যৌনায়িত সংস্কৃতিতে বসবাস করি, সেখানে ধর্ষণ একপ্রকার অপরিহার্য বাস্তবতা। তবে ধর্ষণ নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে চুরান্ত এবং নিকৃষ্টতম পরিণতি। তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম তীব্রতর হলো যৌন সহিংসতা, এবং এই সহিংসতা অহরহ ঘটে চলেছে নানান জায়গায় নানান মাত্রায়, নানান ভাবে। নিজের বাড়ি থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাট, কর্মক্ষেত্র, গণপরিবহন সবখানে। তবে যৌন সহিংসতা সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে পরিচিত মানুষদের দ্বারাই। যেমন প্রেমিকের হাতে প্রেমিকার যৌন নিপীড়ন হওয়ার সম্ভাবনা যে কোনো অপরিচিত মানুষের তুলনায় বেশি। তারপরও অপরিচিত মানুষকেই আমরা ভয় পাই, সন্দেহের চোখে দেখি বেশি। এই ভয় পাওয়া খুব অস্বভাবিক কিছু নয়। মেয়েদের দিকে পুরুষদের দৃষ্টি নিক্ষেপের শ্লীলতা-অশ্লীলতা নির্ভর করে অবশ্য সমাজের রক্ষণশীলতা বা প্রগতির উপর। কিন্তু অশ্লীল দৃষ্টি নিক্ষেপ অবশ্যই এক ধরনের অনধিকার চর্চা, নারী বা মানুষ হিসাবে তার ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রবোধের উপর চরম হস্তক্ষেপ। এবং গবেষকরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণ যারা করে তারা সাধারণত নিপীড়িতা বা ধর্ষিতার পরিচিত কেউ; এজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা যখন ডেট করতে যায় তখন বন্ধুদের জানিয়ে যায়, কোথায় যাচ্ছে। এবং বাড়ি ফেরার সংবাদটুকু জানানোর ভদ্রতাটুকু করে।

কিন্তু মানুষ যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণ কেন করে? বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা এ সম্পর্কে নানান ধরনের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। কয়েকটা মূল কারণ এখানে তুলে ধরছি:

  1. স্ট্যাটাস ইনকন্সিস্টেন্সি তত্ত্ব অনুযায়ি আর্থিক বা সামাজিক বৈষম্য বা সমস্যা নিয়ে নিজেকে পরাজিত ভাবলে বিশেষ করে স্ত্রী বা প্রেমিকার তুলনায়, অনেক পুরুষ নির্যাতন ও ধর্ষণ করেন নিজেকে সাহসী বা শক্তিশালী প্রমাণ করার জন্য, তথাকথিত পৌরুষ রক্ষার জন্য।
  2. সোশ্যাল লার্নিং তত্ত্বে বলা হয় ছোটবেলায় যারা সহিংসতা দেখে বড় হয় বা উপলব্ধি করে থাকে, তারা দ্বন্ধ-বিরোধ সমাধানের অস্ত্র হিসাবে সহিংসতা ব্যবহার করে থাকেন।
  3. নারীবাদিরা বলেন ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন দ্বারা পুরুষ নারীদেরকে অধীনস্থ করে রাখেন, নিয়ন্ত্রণে রাখেন। নারীদের উপর জবরদস্থি করার অধিকার পুরুষদের জন্মগত, ধর্মগত এবং বংশানুক্রমিক বলে এমন পুরুষরা মনে করে থাকেন।

সবগুলো কারণ এক করে দেখলে যে চিত্রটি এখানে পাই সেটি হলো, পরষ্পরকে কিভাবে ভালবাসতে হয় তা আমরা এখনো শিখতে পারিনি। আমরা শিখেছি নিজের কষ্টটা বেশি করে বুঝতে, কিন্তু সেকারণে যে আরেকজনের ক্ষতি করা যায় না সেটা শিখিনি। শিখিনি সহমর্মিতা কাকে বলে। এমনকি ভালবাসার মানেটাও আমাদের ঠিকমতো শেখা হয়নি। সিনেমা দেখে, বই পড়ে আমরা যা ভালবাসা বলে ভাবি, সেটা আদৌ ভালবাসা নয়। সে কারণেই হয়তো নারীদেরকে ভালবাসার নামে ধর্ষণ পর্যন্ত মেনে নিতে হয় অথবা ভাল বউ/প্রেমিকার কর্তব্য হিসাবেই নিপীড়ন সহ্য করতে হয়।

অবশ্য আশার কথা যে, আজকাল অনেকেই এসব আর মানছেন না। এই কারণেই ডিভোর্সের হার বেড়ে গিয়েছে। সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতার হার বেড়ে গিয়েছে। এতদিন আমরা দেখে এসেছি নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে একটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে মেনে নিতে এবং সাথে সাথে এর জন্য নানান ছুতোয় নির্যাতিতা নারীকেই দোষারোপ করতে। এই ভিক্টিম ব্লেমিং এর মানসিকতা খুবই ক্ষতিকর। বিষয়টা নিয়ে খোলামেলা কথা বলা অনেক বেশি প্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। প্রকৃত প্রেম ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপার নিয়ে শিক্ষা ও ধারনার আদান প্রদান করাটা জরূরী। তাছাড়া সম্পর্কের মধ্যে কষ্ট দেয়্, যৌন নিপীড়ন করা, ধর্ষণ করা, মানসিক চাপ দেয়া, গালাগালি করা বিষয়গুলো যে আইনগত অপরাধ সে সম্পর্কেও সচতেনতা বাড়ানো প্রয়োজন।

এখানে আরেকটা বিষয়ে কথা বলা আবশ্যক সেটা হলো নারী ও পুরুষের সামাজিক বৈষম্য। আমাদের সমাজের কাঠামো এবং চিন্তাভাবনাতেই নারী ও পুরুষের ভেদাভেদ ও বৈষম্য তৈরি করে দেয়া আছে। যেমন, নারীদের জন্য রাস্তাঘাট নিরাপদ না, নারীরা সব কাজ করতে পারে না বা তাদের গর্ভকালীন/মাতৃত্বকালীন সময় ছুটি দিতে হয় ইত্যাদি। এটা একটা চক্রাকার সমস্যা। সমাজে এটা প্রতিষ্টিত হয়ে আছে যে, কার্যক্ষমতা ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় পুরুষরা নারীদের চেয়ে এগিয়ে আছে। চক্রাকার এজন্যই বলেছি যে ,উপরোক্ত কাঠামোগত কারণেই মানুষ এধরনের ধারনা পোষণ করে। আরেকদল আছেন যারা মনে করেন নারীর স্থান আরও নিচে। তাদের ধারনা প্রচলিত পুরুষদের কাজ যদি নারীরা করেন তাহলে পুরুষদের জাত যেন চলে গেলো। যেমন প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া ইত্যাদি। এদের মনোবিকার মনে করিয়ে দেয় সেই পুরোনো কথাটি Equality feels like oppression অর্থা্ত্‌ কখনো কখনো সমতাও যেন ওদের কাছে নিপীড়নের মতো লাগে।

যে নয়া উদারপন্থি নিওলিবারেল অর্থনীতি আর সমাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আমাদের জীবন, সেখানে বেশিরভাগ মানুষই একধরনের বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছেন। অনেকের কর্ম নাই আবার অনেকে স্বল্প বেতনের দুটো বা তিনটি কাজ করছেন। দারীদ্র ও ‍‍ঋণের অনেকে তলিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করেও বসবাস করেন নিঃসঙ্গ পরিবেশে। বিপরীতদিকে এই সমাজের অনেকেই আবার বসবাস করে অভাবহীন প্রচন্ড জৌলুসের মধ্যে। তো এই গোষ্ঠির মধ্যে যে ভয়াবহ অসমতা সেখান থেকেই জন্ম নেয় নানান ধরনের সহিংস মনোভাবের। এই বৈষম্য যত বাড়বে তার সাথে বাড়বে সামাজিক ব্যাধির পরিমাণ। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় এমনটাই স্বাভাবিক। এইসব ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করাটা সবচেয়ে প্রাথমিক প্রয়োজন। তার মানে এই না যে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে। তবে বৈষম্যের সংস্কৃতি কমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষের সম অধিকারবোধ এবং সন্মানজনক সম্পর্কের ধারনার সংস্কৃতি বিকশিত হবে।

About The Author

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!