নারীতন্ত্র নয় নারীবাদের চর্চা হোক

Share this:

লিঙ্গ ভিত্তিক চিন্তায় ভর করে যেসব নারীরা নারীবাদের কথা বলেন তাদের চর্চাকে বরং নারীতন্ত্রের চর্চা বলা যায়। তাদের এই একগুঁয়ে নারীবাদ চর্চায় কোথাও ট্রান্সওম্যান বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে ভাবনা দেখা যায় না, বরং শুধু মাত্র সমাজ স্বীকৃত নারীদের ঘিরে চিন্তার বাইরে অন্য লিঙ্গের মানুষরা অন্তরালে রয়ে যায়। এইসব র‍্যাডিকেল ফেমিনিষ্টরা তাদের আখ্যান থেকে ট্রান্সওম্যান, ট্রান্সম্যান এবং সর্বপরি ট্রান্সজেন্ডারদেরকে আড়ালে রাখে, যা মানবিকতার জায়গা থেকে কাম্য হতে পারে না। আগে যেমনটা বলেছি, ওরা পুরুষদের বিশ্বাসঘাতক ভেবে যেমন কোনো আবেগময় সম্পর্কে জড়ানোতে ভীত তেমনি ট্রান্সজেন্ডারদের বিষয়েও নিশ্চুপ। অথচ, গে, লেসবিয়ান রিলেশনশীপ আমাদের সমাজের অংশ। নারীবাদে যদি অন্য লিঙ্গকে প্রতিপক্ষ এবং অবাঞ্চিত না ভেবে, বরং সমতার মাধ্যমে সব লিঙ্গের অধিকার রক্ষার কথা ভাবা হয় তবে চর্চাটি অনেক বেশি সামগ্রিক এবং মানবিক হবে।

 

 

আশির দশকে অপর্ণা সেনের পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছিলো পরমাচলচ্চিত্র। পরমাতে দর্শক দেখতে পায়, পরমার স্বামী বাড়ি ফিরে জানতে চায়, পরমা কোথায়? পর মুহূর্তে সে নিজেই উত্তর দেয়, কোথায় আর যাবে? হয় নিউ মার্কেট না হয় মায়ের বাড়ি,  বা অমুক তমুক জায়গায়নারীর বিচরণের গণ্ডি পুরুষের বেঁধে দেয়া একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ, দৃশ্যের চিত্রায়ণ তা-ই জানায়। আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত, এতটা সময় পরও, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের নারীর স্বাধীনতার গণ্ডি কি আদৌ বেড়েছে? বাড়েনি। অল্প সংখ্যক নারী নিজেদের জন্য হয়ত কিছুটা স্বাধীনতার জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন, আর অন্যান্যদের ক্ষেত্রে সীমারেখার ধরন বদলেছে মাত্র। আমাদের দেশের ঘরের অভিভাবক এখনও পুরুষরা। একজন নারী, হোক সে শিক্ষিত কী অশিক্ষিত, হোক সে মা, স্ত্রী বা কন্যা, এখনও ঘরের বাইরে যেতে হলে তাকে ঘরের অভিভাবক তথা পুরুষের অনুমতি নিতে হয়।দিনে দিনে অনুমতি নেয়ার ধরন বদলেছে কিছু। কিন্তু আজও পুরুষের বেঁধে দেয়া পরিধির বাইরে নারীর অবাধ বিচরণ সমাজ মেনে নিতে শেখেনি।

শাহনাজ মুন্নির একটি গল্পে পড়েছিলাম, কর্পোরেট ‍‍অফিসে চাকুরীরত নারী, স্বামীর সাথে একটু আধটু মদ্যপানের অনুমতি প্রাপ্ত নারী, গার্লস পার্টিতে অন্যান্য নারীদের সঙ্গে ড্রিঙ্কস করে ঘরে ফিরা নারীকেও স্বামীর রোষানলে পড়তে হয়। এবং রোজ মাতাল হয়ে ঘরে ফেরা স্বামী মদ্যপানের জন্য স্ত্রীকে কটুক্তি করতে  দ্বিতীয়বার ভাবে না

সিনেমা বা গল্প থেকে ধার করা বর্ণনা হলেও বাস্তবে, আমাদের সমাজে হর হামেশা ঘটতে থাকা গল্পই এইসব। সমাজ নারীর জন্য বিভিন্ন আদর্শিক রূপ ঠিক করে দিয়েছে, সমাজের দৃষ্টি নারীকে সে পরিচিত রূপের বাইরে যেতে দেখলে মেনে নিতে চায় না। অথচ মানুষ হিসাবে একজন নারীর পুরুষের মতো সমঅধিকার রয়েছে সিদ্ধান্ত নেবার, সে কী রূপে সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করতে চায়। সচেতন, মানবিক এবং অপরের স্বকীয়তায় বিশ্বাস রাখা প্রতিটি মানুষের উচিত নারী পুরুষ উভয়ের ব্যক্তি স্বাধীনতা বা স্বতন্ত্রতায় সমর্থন দেয়া। মানুষ হিসাবে মানুষের প্রতি পারস্পরিক আস্থা, পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকেলে সব সময় নারীকে নিচু করে দেখা বা দমন করে রাখার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব

আধুনিক দেশগুলোতে নারীবাদ চর্চা বা নারীবাদ নিয়ে আলোচনা বর্তমান সময়ে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে নাবরং একটি সভ্য সমাজের নাগরিকরা এখন অনেক বেশি সমতায় মনোযোগী। সকল লিঙ্গের মধ্যে সমতার সুষম বন্টন আধুনিক সচেতন সমাজের যাপিত জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আসলে নারীবাদ তখনই পরিপূর্ণতা পাবে যখন সমাজ বা রাষ্ট্রে নারী ও পুরুষ তথা সবার মাঝে যথাযথভাবে সমতা স্থাপন করা সম্ভব হয়

ইউরোপে নারীরা বিশ শতকে নিজেদের অধিকার আদায়ে লড়াইয়ের পদক্ষেপ হিসাবে ভোটের অধিকার অর্জনের মধ্যমে নারী আন্দোলনের জয়ের সূচনা এনেছিলো

বাংলাদেশের সমাজের অসংখ্য মানুষের কাছে নারীর অধিকারের জন্য লড়াই করা এখনও অবাঞ্ছিত এবং হাস্য কৌতুকের বিষয়। ফলশ্রুতিতে, নারীবাদকে একটি গালি এবং নারীবাদীদের হেয় করার প্রবণতা আমাদের সমাজে লক্ষ্যণীয়। যদিও আমাদের মতো দেশ সমূহে নারীবাদ চর্চার অবস্থা খুবই নাজুকতারপরও গুটি গুটি পায়ে বিশ্বের সব দেশেই নারীবাদ আন্দোলন বিস্তৃত হচ্ছে, নারীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হচ্ছে এবং নারী পুরুষ উভয়ে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারছেন এবং নিজেরা এই বিষয়ে চর্চা করছেন

নারীবাদ শুধুমাত্র কোনো বাদ চর্চার বিষয় নয়, এটি প্রতিটি মানুষের বোধের ভেতর ধারণ করার বিষয়, এই চর্চার সঙ্গে বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিজেদের যৌন অধিকার রক্ষাঅধিকারের বিষয়টি ওতপ্রতোভাবে জড়িত

নারীর যৌন অধিকার রক্ষা বলতে, নারীর নিজের জীবন সঙ্গী  নিজের পছন্দ করার পূর্ণ অধিকারকে বুঝায়। নারীই সিদ্ধান্ত নেবে আদৌ সে কারও সঙ্গে জীবন যাপন করতে আগ্রহী কী আগ্রহী না। আমাদের দেশসহ আরও অনেক দেশ বা সমাজে আজও নারীর নিজের জীবন সঙ্গী পছন্দ করার অধিকার তার নেই, নারীর জীবনের দিক নির্দেশনা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বা পরিবারের পুরুষরা ঠিক করে দেয়

নারী তার জীবন সঙ্গী, স্বামীর কাছে অবহেলিত, অপমানিত, নির্যাতিত হলেও, সবাই নারীকে বলে, মানিয়ে চলতে। মানিয়ে চলতে গিয়ে আমাদের দেশে প্রতিবছর অনেক মেয়ে খুন হয় বা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।স্বামী দ্বিতীয় তৃতীয় বিয়ে করলেও সবাই নারীকে মানিয়ে নিতে যেমন বলে তেমনি আবার নারীকেই দোষারোপ করে বলে হয়ত নারীটির কোনো দোষ ছিল, তাই স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হয়েছে। ঠিক একই রকম ঘটনা যখন নারী দ্বারা ঘটিত হয় তখন আবার সবাই নারীটিকেই দুশ্চরিত্রার অপবাদ দিতে দ্বিধা বোধ করে না। সমাজের মানুষদের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দৃষ্টি ভঙ্গি মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। পুরুষের জন্য যা বৈধ নারীর জন্য তা অবৈধ এমন মনোভাব থেকে সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। একটি সমাজে নারী পুরুষ উভয়ের জন্য একই রকম অন্যায়ের একই শাস্তি ও একই অপবাধ থাকাটাই সঙ্গত

আমাদের চারপাশে অসংখ্য পুরুষ নারীবাদীদের আজকাল খুব শোরগোল দেখি- যারা ঘটা করে গৃহকর্ম করেন, রান্না বান্নাতেও খুবই পারদর্শী। তারা যেমন তেমনি তাদের সঙ্গিনীরাও, চারিপাশে ঢোল বাজিয়ে শোনাতে ভালোবাসে, তাদের সঙ্গী পুরুষ নারীবাদী বলে গৃহস্থালি কাজকর্ম করে। স্ত্রীকে ঘরের কাজে সাহায্য করে, সন্তানকে লালন পালন করে বা জানালার রেলিং এ ঝুলিয়ে রাখা ফুল গাছে পানি দেয়। কিন্তু একটি গৃহ নারী পুরুষ বা গৃহের সব সদস্যরা মিলেই গড়ে তোলে, তাহলে কেন পুরুষরা গৃহের কাজ করলে, বা পরিবারের জন্য রান্না করলেই নারীবাদী হয়ে যাবে? নারীর অধিকার আদায় এবং রক্ষার বিষয়টিকে শুধুমাত্র গৃহকর্ম থেকে নারীর সাময়িক বিরতির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা কী আদৌ নারীবাদ চর্চা হতে পারে?

এই সব নারীবাদী নারী পুরুষ উভয়ের কাছে, নারীবাদ মানে ঘরের কাজে পুরুষের অংশ গ্রহণ আর নারীর বাইরে কাজ করার জন্য পুরুষের অনুমতি প্রাপ্ত হওয়া। নারী পুরুষ উভয়েরই দুই একজন পুরুষ বা নারী বন্ধু থাকার অনুমতি থাকা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এই ধারণার নারী পুরুষদের জন্য নারীবাদ চর্চা আমাদের মতো দেশগুলোতে কটাক্ষের বিষয় এবং এতে করে নারীবাদ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে

নারীবাদের গণ্ডি যেমন সীমিত বা ক্ষুদ্র নয় তেমনি বিশাল আর জটিল কোনো পরিধিরও নয়, এর জন্য প্রয়োজন কেবল নারী পুরুষ তথা প্রতিটি মানুষের অপর মানুষের ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ, অধিকারকে যথাযথ রক্ষা করা, সম্মান করা এবং পারস্পরিক সমঅধিকারের বিষয়টি মেনে নেয়ার সচেতনতা নিজেদের ভেতর গড়ে তোলা

আমরা চারপাশে অনেক নারীবাদী নারীদের দেখি, যারা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন, বিয়ে করো না, তাতে করে নারীর অধিকার হারাবে, পুরুষ তোমার স্বাধীনতা কেড়ে নেবে। তারা ডিভোর্সি কারণ, তারা নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। তারা পুরুষদের সঙ্গে কোনো আবেগময় সম্পর্কে  জড়াতে চান না কারণ, পুরুষ মাত্রই বিশ্বাসঘাতক। অনেকটা প্রেমে না পড়ে সুখীএই রকম মনোভাব নিয়ে। তারা প্রতি কথায় পুরুষদের দোষারোপ করছেন। নারী যদি কথায় কথায় পুরুষদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেয়, তাহলে প্রকৃত নারীবাদ চর্চা অবশ্যই ব্যহত হয়।আমরা এমন অসংখ্য পুরুষদের দেখি, যারা নারীবাদ চর্চা করেন, নারী পুরুষ তথা প্রতিটি লিঙ্গের মানুষের মাঝে সমতার কথা বলেন, সকলের অধিকার রক্ষার কথা বলেন, কোনো পুরুষ হিসাবে নয়, বরং একজন মানুষ হিসাবেই

লিঙ্গ ভিত্তিক চিন্তায় ভর করে যেসব নারীরা নারীবাদের কথা বলেন তাদের চর্চাকে বরং নারীতন্ত্রের চর্চা বলা যায়। তাদের এই একগুঁয়ে নারীবাদ চর্চায় কোথাও ট্রান্সওম্যান বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে ভাবনা দেখা যায় না, বরং শুধু মাত্র সমাজ স্বীকৃত নারীদের ঘিরে চিন্তার বাইরে অন্য লিঙ্গের মানুষরা অন্তরালে রয়ে যায়। এইসব র‍্যাডিকেল ফেমিনিষ্টরা তাদের আখ্যান থেকে ট্রান্সওম্যান, ট্রান্সম্যান এবং সর্বপরি ট্রান্সজেন্ডারদেরকে আড়ালে রাখে, যা মানবিকতার জায়গা থেকে কাম্য হতে পারে না। আগে যেমনটা বলেছি, ওরা পুরুষদের বিশ্বাসঘাতক ভেবে যেমন কোনো আবেগময় সম্পর্কে জড়ানোতে ভীত তেমনি ট্রান্সজেন্ডারদের বিষয়েও নিশ্চুপ। অথচ, গে, লেসবিয়ান রিলেসনশীপ আমাদের সমাজের অংশ। নারীবাদে যদি অন্য লিঙ্গকে প্রতিপক্ষ এবং অবাঞ্ছিত না ভেবে, বরং সমতার মাধ্যমে সব লিঙ্গের অধিকার রক্ষার কথা ভাবা হয় তবে চর্চাটি অনেক বেশি সামগ্রিক এবং মানবিক হবে

পুরুষতন্ত্র আদিম, দাম্ভিক এবং প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় অন্যকে পরাজিত এবং  অধিনস্হ করার প্রচণ্ড স্পৃহা রয়েছে। ক্ষমতার বিচারে, নারীতন্ত্র পুরুষতন্ত্রের কাছে নস্যি। কিন্তু বর্তমানে, অনেক নারীবাদীদের নারীবাদ চর্চার কৌশল দেখে মনে হয়, অবচেতনে তারা হয়ত নারীতন্ত্রেরই চর্চা করে চলেছেন

 

Shamim Runa is a novelist, playwright, film critic, and women’s rights activist.

 

 

 

 

More Posts From this Author:

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!