Feminism and Literature | Rokhsana Chowdhury
English Summary:
The second wave of feminism brought about a new section of literary criticism. The emergence of the genre came from the patriarchal views within literature, which represented women as subordinate and marginalized. Mainly male-written literature portrayed women as weak or as soft characters with no significant role. This form of literature normalized the subordination of women.
There are two distinct approaches to feminist criticism. One approach tried to identify the patriarchal tendencies throughout myths, holy books, and other literary pieces. Another approach talks about women’s rights, freedom, and gender consciousness. The optimal goal of this branch is to prescribe a new women-friendly genre and abolish the existing power structure of patriarchal society.
Both the history of feminism and feminist literary criticism are parallel to each other, and their goal is the same though they are different in form. The feminist movement raises questions about patriarchal practices and wants to break the bio-political power structure existing in society. Gender discrimination is prevailing in society, and women should accept the challenge to empower themselves in society through their experiences. In this regard, Begum Rokeya is the pioneer of feminist literature in Bangladesh. As an early phase ‘feminine’ writer, she used the established patriarchal literary structure to portray independent women. Her literary pieces depicted that women’s freedom can only be achieved by becoming men. She portrayed a woman who is independent economically and socially, which was a significant step forward in her time.
In the history of Bengali literature, we can come across only one female poet who is the translator of Ramayana, Chakrabarty. Even today, not only in Bengali literature but also worldwide, there are very few female poets and authors. We can learn the reason behind this by reading Virginia Woolf and many other feminist writers. Women had to snatch their right to write in male dominant societies. We can read about women and have a glimpse of them in Charyapada and Srikrishnakirtan who are portrayed as regular characters however not economically powerful. Even Rabindranath Tagore’s famous characters like Charulata and Binodini did not get a positive response due to their rebellious portrayal. What we see in early literature is that many male authors who wrote about women, however, never talked about their freedom and equal rights. Astonishingly, before the 1930s, women were the key subject of every author’s writing no matter how they were portrayed. Sadly, after that, women were portrayed as a side or minor character. The fact is that in real life, women were seen in a negative eye even if they got out of their homes. Hence, it is very obvious that this will reflect in novels as well since novels portray truth about life.
Feminism and literature have a very close and deep relation. Feminism began through literature’s womb; it began to see the world through a women’s eyes. Literature reflects life. That is why it can be said that we can discuss the past, judge the present, and plan the future through literature. Since presently the world is a patriarchal space, everything we read and see is from a man’s perspective. Feminism raises a question right there by asking that we look at the world and literature through feminist and women’s perspective as well. However, the question remains whether this is possible? Is it possible to give the world a vision of seeing things from the feminist point of view through literature? To make this happen, women have to lead this revolution, and also everyone needs to come forward to work together.
১.
নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা তত্ত্ব
নারীবাদী সাহিত্যসমালোচনা শুরু হয় নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়, যখন নারীমুক্তির লক্ষ্যে রাজনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি সমাজে প্রচলিত নারীত্বের সীমাবদ্ধ ধারণাকে পালটানোর জন্য সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।নারীবাদীরা সাহিত্যের বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে বললেন, আমরা যে সাহিত্য পড়ি, যে সাহিত্য রচনা করি, তা আসলে নারীকে পুরুষতন্ত্র যেভাবে দেখে, সেভাবেই তুলে ধরে। এ সময় বিভিন্ন সাহিত্যে নারীকে কীভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, সেটি তুলে এনে বিশ্লেষণ করে বলার চেষ্টা করা হয়, সাহিত্য বলতে যা বোঝায়, তা আসলে পুরুষদের লেখা বলেই নারী এই সাহিত্যে তার সত্যিকারের ভূমিকায় উঠে আসেনি। এতদিনকার সাহিত্য যে নারীকে উপস্থাপন করেছে, সেখানে উঠে এসেছে পুরুষের চোখে তৈরি সীমাবদ্ধ এক নারী, যে নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে ভেতরের শক্তি আর সামর্থের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে অথবা পাশ কাটিয়ে এক চিরন্তন ঘরোয়া কোমল নারীর প্রতীকে। এই সাহিত্যে পুরুষ স্রষ্টা, আর নারী তার সৃষ্টি পুরুষ শিল্পী আর নারী হলো তার শিল্প; পুরুষ পৃথিবীর কর্মযজ্ঞে কর্মী, পুরোহিত ও সম্রাট আর নারী তার সংসারের রক্ষক, তার প্রেরণাদায়িনী, কামনার ধন। নারী পুরুষের সমান হয়ে উঠতে পারে না তা নয়, নোবেলজয়ী অক্তাভিও পাজের ভাষায় এই সমাজে তা শুধু প্রেমের মধ্য দিয়ে তার অধস্তন অবস্থা থেকে উঠে এসে পুরুষের পাশে বসতে পারে মাত্র। কিন্তু এই প্রেমও পুরুষের মুখাপেক্ষী, নারীর নিজের শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে নয়, প্রচলিত সাহিত্যে নারী ও পুরুষের যে প্রেমময় পৃথিবী তৈরি করা হয়েছে, তা আসলে নারীকে বন্দি করে রাখারই একটি কৌশল। সমাজে নারীকে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারীত্বের এই প্রতীককে ভাঙতে হবে, প্রচলিত সাহিত্য, যা নারীকে সাংস্কৃতিকভাবে বন্দি করে রাখে, তার বিপরীতে নারীত্বের সত্যিকারের প্রতীক তৈরি করতে হবে, যা সমাজে মানুষ হিসেবে নারীর নতুন ভূমিকা তুলে ধরবে। আর এজন্য যেহেতু পুরুষেরা নারীদের বুঝতে অক্ষম আর সেজন্যই নারীদের কথা নারীদের নিজেদেরই বলতে হবে। এই বলে ওঠা থেকেই নারীবাদী সাহিত্যসমালোচনা তত্ত্ব গড়ে ওঠে।
নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার সূত্রপাত ঘটে কেট মিলেটের সাড়া জাগানো গ্রন্থ Ôসেক্সুয়াল পলিটিকসেÕর (১৯৬৯) মাধ্যমে। যেটি মূলত ছিল তার পিএইচডি থিসিস। এই গবেষণায় তিনি কয়েকজন বরেণ্য লেখকের রচনাকে কেটে-ছিঁড়ে বিশ্লেষণ করে দেখান যে, তাদের লেখা কতখানি পুরুষতন্ত্রের পূজারী। এই গবেষণাতেই প্রথম লৈঙ্গিক রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচিত হয় ডি এইচ লরেন্স, হেনরি মিলার, জ্যাঁ জেনে প্রমুখ লেখকের লেখনীর ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে।
‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ উপন্যাসে নারীর মাধ্যমে পুরুষকে করে তোলা হয়েছে ‘ঈশ্বরের মত প্রভুসুলভ আর কর্তৃত্ব পরায়ণ।’ লৈঙ্গিক রাজনীতিতে সুকৌশলে ধর্ষকামী রূপকে সহজাত হিসেবে তুলে ধরা হয়। আর নারীকে বানিয়ে তোলা হয় মর্ষকামী চরিত্রে, যে চরিত্রে নারী নিজেই অভিনীত হতে শুরু করে।
সত্তরের দশকে এলিন শোওয়াল্টার (Elaine Showalter) ÔGynocriticism ev gynocriticsÕ (যার বাংলা হতে পারে Ôমাতৃক সমালোচনাÕ) প্রত্যয় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নারীদের নিজেদের তৈরি সাহিত্যকাঠামো তৈরির কথা বলেন। মূলত এত দিন ধরে চলে আসা পুরুষ সাহিত্যিকদের তৈরি করা পৃথিবী, মানুষ, সম্পর্ক, সমাজ, স্বপ্ন, নীতি-মূল্যবোধের ধারণা পালটে নারীদের নারী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা ও লক্ষ্যকে তুলে ধরে সাহিত্যের একটা নতুন রূপ তৈরি করার আহ্বান হিসেবে একে দেখা যেতে পারে। এর আগেই সিমোন দ্য বোভ্যোয়ার ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ বইটি পুরুষের দেখা পৃথিবীর বদলে নারীর চোখে দেখা পৃথিবী আবিষ্কারের প্রেরণা ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই মাতৃক সমালোচনাকেন্দ্রিক সাহিত্যবিচারের মধ্য দিয়ে সাহিত্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রচেষ্টাকে অভিহিত করা হয়েছিল একটি নতুন মানচিত্র রচনা ‘map the territory’ হিসেবে।
নারীর মুক্তির পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে নারীবাদী সাহিত্যসমালোচনা গড়ে ওঠে মূলত দুটো পথে। প্রথমটি হলো, পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচলিত সাহিত্যতত্ত্বকে বিশ্লেষণ করে এর রচনার পেছনে পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতাগুলোকে চিহ্নিত করা এবং দ্বিতীয়টি হলো, সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের আলোকে নারীর ভেতরকার স্বাধীন সত্তার অস্তিত্ব ও অস্তিত্বের সংগ্রামকে নানা দিক থেকে তুলে ধরা।
প্রাচীন মিথ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকে আজ পর্যন্ত রচিত সকল ধরনের সাহিত্যে (গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, সামাজিক ইতিহাস, আত্মস্মৃতি, জীবনী ইত্যাদি) নারীকে কীভাবে দেখা হয়েছে এবং উপস্থাপন করা হয়েছে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, তার বিশ্লেষণ পুরুষদের রচিত নারী চরিত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করে এর মধ্যেকার পুরুষতন্ত্রের আকাক্সক্ষাকে আবিষ্কার করার মধ্য দিয়ে নারীবাদী সাহিত্যের রূপরেখা তৈরি করা নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের একটি বড়ো উদ্দেশ্য। নারীদের লেখায় (আত্মজীবনী অথবা গল্প) উঠে আসা নারীর প্রতিচ্ছবির সঙ্গে পুরুষের লেখা নারীর প্রামাণ্য বা কল্পিত চরিত্রগুলোর তুলনামূলক উপস্থাপনার ভেতর দিয়ে পুরুষতন্ত্রের সামাজিক রূপটি স্পষ্ট করা; একটি সাহিত্যের প্রচলিত ভাষ্যের পাশাপাশি নারীবাদী পাঠভাষ্য তৈরি করা; একজন পুরুষ লেখকের অথবা একজন নারী লেখকের সব কটি লেখা বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে জেন্ডার চেতনার উপস্থিতির ধরন চিহ্নিত করা; সাহিত্যে উঠে আসা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক চিত্রের ক্ষমতাকাঠামোয় নারী ও পুরুষের ভূমিকাকে কীভাবে দেখা হচ্ছে, তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর নিজের অবস্থানকে বুঝে নেওয়া; সাহিত্যে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকামী যে ভাষা ও শব্দ প্রয়োগে নারীকে চিরায়তভাবে দুর্বল হিসেবে উপস্থাপন করে এবং পুরুষকে শক্তিশালী হিসেবে তুলে ধরে, তা থেকে মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন শব্দ ভাষারীতি তৈরি করা; নারী ও পুরুষের লেখার ধরন ও আঙ্গিক বিশ্লেষণ করে সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্যের ধরনকে আবিষ্কার করে তা থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণ করা; নারী লেখকদের সৃষ্টিকে বহুমাত্রিক জায়গা থেকে বিশ্লেষণ করে তাকে কণ্ঠস্বরে পরিণত করা, যেন নারীর কথা নারীর মুখ দিয়ে উঠে আসে, এমন বাস্তবতা তৈরি হয় এবং নারীরা তাদের কথা লিখতে উদ্বুদ্ধ হন -এটাই নারীবাদী সাহিত্যসমালোচনা মূল অন্বিষ্ট।
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের মূল লক্ষ্য নারীবাদী আন্দোলনের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। সেটা হলো পুরুষতন্ত্র বিলোপের মধ্য দিয়ে এমন একটি সমাজ তৈরি করা, যেখানে নারী মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে তার জীবন গড়তে পারে। সাহিত্য যদি সমাজ গড়ার হাতিয়ার হয়, তবে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচলিত সাহিত্য
সমাজে, রাষ্ট্রে নারীদের ওপর পুরুষের আধিপত্যমূলক বৈষম্য রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। নারীবাদী সাহিত্যসমালোচনাতত্ত্ব পুরুষতন্ত্রের এই শক্তিশালী হাতিয়ারের বিরুদ্ধে নতুন এক হাতিয়ার তুলে ধরার চেষ্টা করে, যা পরিবারের মধ্যে ও বাইরের সমাজে নারীর অধস্তনতাকে কাটিয়ে তার শক্তি ও সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় থাকবে।
২.
নারী লেখকের বিরুদ্ধে একটা সাধারণ অভিযোগ হলো, তাদের লেখায় নাকি পদে পদে বুঝিয়ে দেয়া হয় তারা নারী। কোন টেক্সট যখন পাঠ করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া হয় সেটি পুরুষ কণ্ঠস্বর। অর্থ্যাৎ পুরুষ লেখক তার যাপনকেই তুলে ধরেন যদি তা রাষ্ট্র-সমাজ-রাজনীতি কেন্দ্রিকও হয়ে থাকে। কিন্তু সেই বয়ানকে কদাপি পুরুষালি বলে ব্যাখ্যা দেয়া হয় না। খুব সাধারণভাবে দুটি উপন্যাসের কথা মনে করা যাক, সুনীলের Ôএকা এবং কয়েকজনÕ কিংবা হুমায়ুন আজাদের ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’ -এইসব উপন্যাসে একজন সাধারণ সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠা কোন ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যেখানে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংকট কাল তাদের চারপাশকে ঘিরে থাকে। কিন্তু তার ভেতর দিয়েও স্বাভাবিকভাবেই ‘রিয়ালিস্টিক’ সাহিত্যের ধর্ম অনুযায়ী তাদের একান্ত ব্যক্তিজীবন বা ভাবনা ফুটে ওঠে। দুটি উপন্যাসের নায়ককেই দেখা যায় একাধিক সম্পর্কে জড়াতে। ‘টেক্সট রিডিং’ শেষ হলে নায়কের উন্মূল অবস্থান, রাজনৈতিক মতাদর্শ বিষয়ক দ্বন্দ্ব, সর্বোপরি সার্বিক জীবন সংক্রান্ত নিজস্ব দর্শনের প্রতিফলনজনিত রেশ যতখানি পাঠকের ভাবনাকে আলোড়িত করে ততোখানিই গৌণ বিবেচনায় থাকে তার জৈবিক জীবন। যদিও যাপনজনিত অভিজ্ঞতায় সেই পরিসর নিতান্ত গৌণ নয়।
পুরুষরচিত রচনায় জৈবিক জীবনের সব ধরণের অভিজ্ঞতাই বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত হয়েছে। হস্তমৈথুন, বয়োঃসন্ধিকালে অজাচারজনিত নানা অনুভূতি, ধর্ষকামী মনোভাবসহ চায়ের আড্ডায় বন্ধুদের সাথে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কটাক্ষ, রম্যভাষ্য অনায়াস অবলীলায় পরিবেশিত হয়। কিন্তু সেই লেখাকে আমরা ‘পুরুষালি’ দোষে দূষণীয় অভিহিত করি না। কারণ ‘পুরুষালি’ কোন দূষণযোগ্য ‘ভাষ্য’ই না আসলে, ‘মেয়েলি’ যতখানি।
যে কারণে ‘পুরুষালি’ শব্দের বিপরীত ‘মেয়েলি’ নয়। ঠিক একই কারণে টেক্সটের ডিসকোর্স বদলে যায় যদি একই ভাবে নারী তার সকল অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করে। একইভাবে বয়োসন্ধি, মাসিক/ পিরিয়ড, অর্গাজম, মেয়েমহলে পুরুষ বিষয়ে হাস্যরস, রাস্তাঘাট/কর্মক্ষেত্রে যৌন নিগ্রহ এই সবকিছুই নারীর জীবনের আবশ্যিক অংশ।
কিন্তু নারীর প্রান্তিক অবস্থানের কারণে তার কোন আচরণই সাধারণীকরণের পর্যায়ে পড়ে না। তাই নিরপেক্ষ পাঠে উত্তম পুরুষে গল্পের বিবরণ থাকলে আমরা দ্বিধামুক্তভাবে পুরুষ ভেবেই পাঠ করতে থাকি।
সেই কারণেই নারীবাদের ইতিহাসের সাথে নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বেরও ইতিহাস সমান্তরালে গড়ে উঠেছে। সাহিত্য-শিল্পের নানা দিক, রম্য কৌতুক ছাড়াও মানব সভ্যতার ইতিহাসের বয়ানও আজ নতুন বিচারপদ্ধতির বিশ্লেষণের অপেক্ষায়।
কেবল নারীবাদ কেন, যে-কোন তত্ত্বের কর্কশ প্রয়োগই সাহিত্যকে মৃতপ্রায় করে তুলতে পারে। কিন্তু ঠিক কতখানি নিরপেক্ষতা সম্ভব, নারীর জীবনকে পরিস্ফূটন করবে আবার নারীবাদী ভাবনার বিস্তরণ ঘটবে না, কে জানে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ ঘটেছিল নারীবাদী সংগ্রামের এক শক্তিশালী অঙ্গরূপে। নারীবাদী সংগ্রাম পুরুষতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং ভেঙে দিতে চায়, নারীবাদী সাহিত্য তত্ত্ব ভিন্ন পন্থায় হলেও গন্তব্য তাদের একই।
এলিস মানরো (১৯৩১) কানাডার লেখক। ২০১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। তার লেখায় সাধারণত নারীর জীবন যাপন এবং তাদের বিভিন্ন মাত্রার সম্পর্কের টানাপোড়েন তুলে এনেছেন। কিন্তু তিনি ‘নারীবাদী’ কিনা প্রশ্ন করায় তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ফেমিনিস্ট শব্দ বা তত্ত্ব দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয় আমি সেরকম নারীবাদী কেউ নই। আমাকে নারীবাদী বলতে পারেন এই অর্থে যে, আমি নারীর জীবনের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।’ (দি আটলান্টিক)
ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের নারী লেখকগণের বড় অংশই স্বীকার করেন না নিজেদের নারীবাদী হিসেবে। অথচ সেলিনা হোসেন কিংবা নাসরীন জাহানের কথাসাহিত্যের পুরোভাগ জুড়ে আছে নারীর জীবনের অভিজ্ঞতা। তত্ত্বের দিক থেকে কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের দিক থেকে তাদের রচনাসমূহ নিও লিবারেল নারীবাদের আওতায় পড়ে যায় বৈ কি। যদিও সেলিনা হোসেন ছোটগল্পে (জেসমিনের ইচ্ছাপূরণ) ব্যতিক্রমীভাবে জরায়ুমুক্তিতে স্বাধীনতার অনুভব বিধৃত হয়েছিল। এই একটি গল্প বাদ দিলে তার অধিকাংশ ছোটগল্প-উপন্যাসে একক মাতৃত্বের বিষয় ইতিবাচকরূপে উঠে এসেছে। পুরুষের কর্তৃত্বেবর্জিত এই মাতৃত্ব কোন ক্ষমতায়নের স্মারক নয়, বরং পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা প্রকল্প।
যেভাবে সভেৎলানা আলিক্সিয়েভিচ (১৯৪৮) একজন নন-ফিকশন রাইটার হিসেবে প্রথম সাহিত্যে নোবেল জয় করে নিয়েছেন (২০১৫)। কারণ সাংবাদিক হিসেবে তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর চেরনোবিল দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দুর্দশার নির্মমতাকে তুলে ধরেছেন তথ্যের বিবরণ নয়, মনুষ্যসত্তার আবেগময় প্রতিভাষ্যে।
পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বিলুপ্তি ঘটেছিল সম্পদ বণ্টন ও উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে। রাজ্য দখলে শারিরীক শক্তি প্রাধান্য দেখা দেয়ায় নারীকে অন্দর মহলের কাজের জন্য পৃথক করে আবদ্ধ করে দেয়া হয়। নতুনভাবে ভূমিগত ভেদাভেদের যে অবয়ব সৃষ্টি হলো তার নাম রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র গঠনের পটভূমি প্রধানত ছিল যুদ্ধ আর জবরদখল। যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন অস্ত্র আর প্রযুক্তি। পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে এনিমেশন সিনেমা, কার্টুন, গেমস সর্বত্র তাই অস্ত্রের ঝনঝনানি আর রাজ্য দখল। জেমস বন্ড আর ম্যাট্রিক্সের নায়কেরা ধ্বংসের ইতিহাস ভুলিয়ে দেয় মোহনীয় মাচো ইমেজের আড়ালে। বিজয়ের ধ্বজা বুমেরাং হয়ে ধ্বংস এখন পৃথিবীর দোরগোড়ায়। আমাজন পুড়ছে, হিমালয় গলে যাচ্ছে, নদী মরে যাচ্ছে, বিলুপ্ত হচ্ছে একের পর এক মিথোজীবিতা নির্ভর প্রাণীকুল।
সভেৎলানাকে যদি নারীবাদী লেখক হিসেবে ঘোষণা নাও দেয়া হয়, তবু তার এইসব ‘টেক্সট’ ইকোফেমিনিজমের দিশা দেখিয়ে যায় না কি? যে তত্ত্বের বলা হচ্ছে, নারী যেমন ধরিত্রীর মত বংশগতি বহন করে, নীরবে বংশ পরিচয়ের তোয়াক্কা না করেই, আবার নারী প্রকৃতির মতই শৃঙ্খলিত, পর্যুদস্ত, নিপীড়িত পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীর কর্কশ শক্তির প্রতিযোগিতার কাছে।
১৯৯৫ সালে শির্লি জ্যাকসন প্যাচওয়ার্ক গার্ল নামে যে ইলেকট্রনিক বুক প্রকাশ করেন সেটি মূলত মেরি শেলির ফ্রাংকেনস্টাইন (১৯১৮) এবং বাউম-এর দ্য প্যাচওয়ার্ক গার্ল (১৯১৩) এর একত্রিত পুনর্বিন্যাস। জ্যাকসন এই উপন্যাসের একেকটি অধ্যায়ের নারীদেহের বিভিন্ন অংশকে এক একটি পৃথক টুকরো হিসেবে ছবির মাধ্যমে বর্ণনা করেন। এই জোড়াতালি দেয়া বর্ণনায় হয়তো প্রতীকীভাবে পরিবেশিত হয়েছে যে নারীদেহ কাব্যে বর্ণিত পৃথক পৃথক মাংসখন্ড নয়, সবমিলিয়ে তার মনুষ্যসত্তা। এই সামগ্রিকতা ধারণা করতে না পারলে হয়তো পুনর্নিমাণ ফ্রাংকেনস্টাইনের মতো দানবে পরিণত হয়, যা বুমেরাং হয়ে ¯স্রষ্টাকেই ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়।
সভেৎলানা দীর্ঘ ত্রিশ-চল্লিশ বছরের পর্যবেক্ষণে উপলব্ধি করেছেন নারীর অপর নাম জীবনদাতা বা রক্ষাকারী। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শত শত নারীর বয়ান গ্রহণ করেছেন, যারা যোদ্ধা, গুপ্তচর ডাক্তার বা নার্স হিসেবে কর্মরত ছিল। এই সব উচ্চারণ বহুমুখি স্বরে (Polyphonic) প্রতিফলিত করেছে নিষ্করুণ ইতিহাস। যার ফলশ্রুতিতে সভেৎলানা নারীকে বর্ণনা করেছেন মাত্র একটি শব্দে তা হলো ‘সমবেদনা’।’নারী’ এবং ‘জীবন’ তার কাছে সমার্থক প্রতিশব্দ।
সেলিনা হোসেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধ এবং সংগ্রাম-আন্দোলনকেন্দ্রিক দশটি উপন্যাসে যুদ্ধে নারীর অবস্থানকে তুলে ধরেছেন। যে-কোন যুদ্ধে-সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ থাকে বহুমুখি। কিন্তু শারিরীক নির্যাতনের দিক থেকে সর্বদাই তারা প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রীতিলতাকে নিয়ে লেখা উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে জেলখানায় তার ওপর চালানো নৃশংস যৌন নিগ্রহের চিত্র। আবার ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে দেখতে পাই তারামন বিবি যুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করতে চাইলেও তাঁকে প্রথমে রান্নার কাজে যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। জেন্ডার বৈষম্যের এইসব গুরুত্ববহ ইতিহাস নারীবাদী ভাবনার আলোক ব্যতীত কীভাবে সম্ভব ব্যাখ্যাভাষ্য প্রস্তুত করা।
নারী লেখক আসলে নিজেদের নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন কেন? সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক হয়ে যাবার ভয়ে? তৃতীয় লিঙ্গ নামভুক্ত মানুষেরা তাই প্রশ্ন করছেন, আমরা যদি তৃতীয় লিঙ্গ হই তাহলে প্রথম লিঙ্গ কারা? কেন তারা ‘প্রথম’?
শেরিল স্যান্ডবার্গ (১৯৬৯) ফেসবুকের বর্তমান সিইও। তিনি ১৯১৩ সালে ‘Lean Inn’ নামে যে বইটি লেখেন সেটি বেস্টসেলারে পরিণত হয়। এটিও কোন ফিকশন ছিলনা। বরং নারী, তার কর্মক্ষেত্র এবং নারীর ক্ষমতায়ন অর্জনে করণীয় বিষয় সম্পর্কে আলোকপাতই ছিল এই গ্রন্থের সারবস্তু। তিনি কর্মক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বেও নারী কীভাবে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হয়, কীভাবে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয় -সেই সব চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের সংগ্রাম-সাফল্যও তুলে ধরেন। নিজের জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি প্রতিটি নারীকে কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়ন অর্জনের চ্যালেঞ্জ নিতে বলেন। যদিও প্রকটভাবে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার তিনি নিজেও হয়েছেন তবুও সম অধিকারের একটি পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানান।
তিনি নারীর অন্তর্গত বিপুল ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলতে বলেন এবং নারীর ভাষ্য, তার নিজস্ব উচ্চারণকে বিনির্মাণ করতে পরামর্শ দেন কর্মক্ষেত্রে সংলাপ প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রে। কেননা, তিনি নারীকণ্ঠের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখেন।
উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদী রোকেয়া সাখাওয়াতে কি আমরা এই নয়া ভাষ্য, বয়ানের বিনির্মাণ দেখতে পাই?
৩.
রোকেয়ার নারীবাদ
রোকেয়া রচনায় প্রধানত নারীর শরীরী ভাষা (Body Language) এবং অবয়বের প্রকাশগত জড়তা পরিবর্তনের বৈপ্লবিক প্রতিফলন দেখতে পাই।
‘পদ্মরাগে’ তিনবার বিপদগ্রস্ত পুরুষের সাহায্যাথে নারীকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। কেবল সেবা শুশ্রূষাই নয়, আর্থিক সাহায্য প্রদান, মানসিক ভাবে উদ্দীপিত রাখা, সার্বিক খোঁজ খবর নেয়া -এ সবকিছু অত্যন্ত অকপট ভঙ্গিমায় জড়তাহীনভাবে সম্পাদিত হওয়াতে নারীর পেশাদার অবয়বটি জেন্ডার নিরপেক্ষ ভাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। আর্থিক সাহায্য করার জন্য এগিয়ে দেয়া হাতকে নায়কের দৃষ্টিতে ফুল, পাখি, তরুলতার পরিবর্তে ‘কেমন সুন্দর স্বাধীন হাতটি’ -এইভাবে ধরা দেয়। রান্নাঘর থেকে ব্রীড়ানম্র নারীর Ôচাল ধোয়া ¯স্নিগ্ধ হাতÕ দাপ্তরিক কর্মপরিবেশে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সৌন্দর্যে আলোকিত হয়ে ওঠে। ‘তারিণী ভবনে’র অফিসিয়াল অবয়বটিও যেন জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে ‘ইংরেজি সংবাদ’ পত্রপাঠ, ঘড়ির ঘন্টা আর টাইপ রাইটারের শব্দে মুখরিত হয়ে জানান দিতে থাকে।
সত্যিকার অর্থে, জেন্ডার নিরপেক্ষতা নয়, রবং পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার জন্য রোকেয়া তার আদর্শ নারীদের রূপ সম্পর্কে নীরব থাকেন। পোশাকে রঙের বাহুল্য থাকে না, পুরুষের মতোই অলংকার বর্জিত তার ‘পদ্মরাগ’ এবং ‘সুলতানার স্বপ্নে’র নারীরা।
ভাববার বিষয় হচ্ছে সেখানে যে, এদেশে নারীর শিক্ষা ও কর্মজীবন শুরুর কালে পুরুষকে আদর্শ ভেবে তার সমকক্ষতা চাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। যে কারণে কর্ম পরিবেশে নারীর মাতৃত্ব বিষয়ক টানাপোড়ন, যৌন নিগ্রহ প্রসঙ্গগুলো অনেকটা হালকাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
(সুলতানার স্বপ্নে পুরুষকে সন্তানের দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে, যৌন নিগ্রহ বন্ধে তিনি নারীকে সর্ব বিষয়ে সুপিরিয়র পদ গ্রহণে সমাধান দিয়েছেন, যা এখনো মোটামুটি অসম্ভব।)
‘বিবাহ’ বিষয়ে তিনি সর্বত্র নারীকে নিরুৎসাহিত করলেও এর সমাধান কি হতে পারে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন রূপরেখা প্রদান করেন নি। নারী কি পদ্মরাগের মত কর্মময় জীবনের লাভ করতে গিয়ে তারিণী ভবনের নারীদের মত সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করবে?
সমস্যা রোকেয়াকে নিয়ে নয়। সমস্যাটা হচ্ছে এত বছর পেরিয়ে গেলেও, ভারতবর্ষ দুই তিন দফায় বিভক্ত হলেও নারীর কোন অবয়বটিকে আমরা গ্রহণ করেছি, এখন পর্যন্ত? কবিতায় নারী এখনো চাঁদ, ফুল, মদ ইত্যাদির কাতারে জড়বৎ প্রতিস্থাপিত হয়ে চলেছে। পুরুষ ¯স্রষ্টা আজো নারীকে সৃষ্টি করে চলেছে প্রাণহীন প্রতিমাসম।উপহাসের শিকার হচ্ছেন তসলিমা নাসরীন এবং তার অনুসারীগণ।
ব্যক্তি বা বস্তু-নিরপেক্ষতার অবয়ব সৃষ্টি হয়ে আছে সাহিত্যের ইতিহাসের রচয়িতাদের হাত ধরে। ‘তথাকথিত’ এই নিরপেক্ষতার হাত থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে জেন্ডার বা লিঙ্গ?
‘নষ্টনীড়’ ছোট গল্পের অমল শেষ পর্যন্ত চারুলতার প্রাণাবেগকে পাশ কাটিয়ে ভূপতির প্রতিই সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। এরই নাম ‘ভ্রাতৃত্ববোধ’। কিন্তু চারুলতা-মন্দার ভগ্নিত্ববোধের ইতিহাস সৃষ্টি হতে দেয় নাই পুরুষ প্রধান সমাজ, বিধায় চারু-মন্দা (নষ্টনীড়), বিনোদিনী-আশা (চোখের বালি) অথবা লাবণ্য-কেতকীর (শেষের কবিতা) পৃথক পৃথিবী বহে সমান্তরাল। এ কারণেই বাংলা প্রতিশব্দ ‘সৌভ্রাতৃত্ব’ থাকলেও ‘সিস্টারহুড’ শব্দের কোন বাংলা প্রতিশব্দ নাই।
রোকেয়া রচনায় সর্বত্র ‘ভগিনি’ সম্বোধন আমাদের ‘নারীই নারীর শত্রু’ -জাতীয় ক্লিশে হতে মুক্তির পথ দেখায়। যদিও সে পথে পূর্বসূরীও ছিল না, উত্তরসূরীরও দেখা মিলছে না।
৪.
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সমগ্র মধ্যযুগের সাহিত্যে মাত্র একজন নারী কবির দেখা মেলে। তিনি রামায়নের অন্যতম অনুবাদক চন্দ্রাবতী। আজো বাংলা সাহিত্য কিংবা বিশ্ব সাহিত্যে নারী কবি-লেখকের সংখ্যা চোখে পড়ার মত সংখ্যালঘু। এর পেছনে কী কারণ হতে পারে তা আমরা ভার্জিনিয়া উলফসহ আরো অনেক নারীবাদী লেখকের রচনায় জানতে পেরেছি, তবু পুরোপুরি উত্তর মেলেনি। তাই বাংলা সাহিত্যের পুরুষ রচয়িতাদের লেখা থেকেই নারীর ভাবমূর্তিটুকু উদ্ধারের চেষ্টা নিতে হয়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে আছে ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ -অর্থাৎ এই পদে শরীরকেই নারীর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে পুরুষ Ôভিকটিম ব্লমিংÕ করেছে এবং নির্যাতনের শিকার নারীটির নির্যাতক রূপে নিজের সকল দায় থেকে মুক্ত হতে চেয়েছে।
প্রতিটি ধর্মের জন্য পৃথক প্রার্থনাস্থল থাকলেও পতিতালয়ে কোন ধর্ম-শ্রেণীর ভেদ কোনকালেই ছিল না। তাই ডোম্বীর সঙ্গে ব্রাহ্মণের সংসর্গে যাবার চিত্র আছে।
চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বা চন্ডীমঙ্গলে নারীকে পসরা নিয়ে হাটে-বাজারের যেতে, নৌকা চালাতে দেখা গেলেও তা অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার নিদর্শন নয়। ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রয়োগ তার আওতার বাইরেই থেকে যায়, তাই প্রণয় কিংবা সংসার ধর্ম ছাড়া পুরুষের রচনায় তার অবয়ব ছায়াচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান দেখা যায়।
নারীর প্রণয়ই বা কেমন? শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের নায়ক কৃষ্ণ বহুগামিতা, নারীর প্রতি অসম্মানজনক উত্যক্তকরণ, অশালীন প্রস্তাব, বলাৎকার -এই সব কটি অপরাধেই চরিত্রটি প্রত্যক্ষরূপে একজন নারী নিপীড়ক হিসেবে বর্তমান কালের আয়নায় ধরা পড়বে।রাধা কৃষ্ণের আখ্যান থেকেই হয়তো শুরু। অথচ পুরুষের এই বলপ্রয়োগকে প্রেমের পূর্বরাগ লক্ষণ রূপে চিহ্নিতকরণের বিষয়টি রাধা ছিল কৃষ্ণের কাছে জাতীয় দায়িত্ব পালনের ফাঁকে সাময়িক অবকাশ যাপনে। খেলা শেষে ধুলা ঝেড়ে কৃষ্ণ মথুরায় ফিরে যায়। রাধা-কৃষ্ণের এই অলীক মোহসঞ্জাত সম্পর্কে প্রেমের আদর্শ রূপে যুগ যুগ ধরে জয়গান গাওয়া হচ্ছে। পুরুষ রচয়িতা বলেই কি রাধার প্রেমের মূল জায়গাটা এড়িয়ে যান? বিবাহিত রাধার স্বামী আইহনকে আখ্যানে নপুংসক রূপে বিধৃত করা হয়েছে। রাধার শরীরী আকাঙ্খার আতৃপ্তিই কি কৃষ্ণ চরিত্রের যাবতীয় নেতিবাচকতাকে গৌণ করে তুলেছিল?
মঙ্গল কাব্যগুলোতে দেব-দেবতাদের আধিপত্য। কিন্তু দেবী মনসা নারী বলেই তার বশ্যতা মেনে নেন না পুঁজিপতি চাঁদ সদাগর। পথের ভিখিরি হয়ে গেলেও না। দেবী তথা ক্ষমতায়িত নারীকে অমান্য করবার এই দুঃসাহস বা পৃষ্ঠ পোষকতা চাঁদ সদাগর কোথায় পান, পুরুষ রচয়িতার কলম থেকেই তো। আর বেহুলা? হিন্দুধর্মে নারীর পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ, বিবাহ ও স্বামীই একমাত্র গ্রন্তব্য। তাই জলে ভাসমান ঠিকানাহীন নারী গন্তব্যে পৌঁছাতে চায় জলে ভেসেই। স্বর্গে দেবতাদের আরেক পুরুষশাসিত সমাজে পৌঁছে গিয়ে দেবতারূপী পুরুষের যৌন আবেদন মেটাতে নৃত্যগীতে মুগ্ধ করে তোলে বেহুলা। রাধার যেমন ছিল শরীরী প্রয়োজন, বেহুলার তেমনি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ, কেননা বিকল্প হিসেবে সামনে সতীদাহ নয়তো আমরণ বৈধব্য।
এখানেও ভুল ব্যাখ্যায়, প্রেমের ভাবমূর্তি নির্মিত হয়ে আছে আচিরকাল।
নারীকে মানুষরূপে প্রতিষ্ঠা দিতে আর অধিকারের জন্য যুক্তিপূর্ণ বয়ান নির্মাণের ইতিহাস রচনা করেন দুই নমস্য ব্যক্তি। রাজা রামমোহন রায় যতটা না বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন নারীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে, ঠিক ততোটাই বিরূপ-বিদ্বেষ, ঘৃণ্য আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর নারীকে সমাজে অধিকারসমেত পুন:প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে। এতে প্রমাণিত হয়েছিল যে, প্রাণ ফিরিয়ে দেয়া যত সহজ, জীবন দান করা ততোটাই কঠিন। ঈশ্বর গুপ্ত তাই অকপটে জনসমর্থন সাথে নিয়ে নারীমুক্তির প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেন, যেখানে কোন ব্যাখ্যা প্রদর্শন নিষ্প্রয়োজন।
‘লক্ষ্মী মেয়ে যারা ছিল
তারাই এখন চড়বে ঘোড়া, চড়বে ঘোড়া।
ঠাট ঠমকে চালাক চতুর সভ্য হবে থোড়া থোড়া।
(এরা) এবি পোড়ে বিবি সেজে
বিলিতি বোল কবেই কবে
ড্যাম হিন্দুয়ানি বলে বিন্দু বিন্দু ব্র্যান্ডি খাবে।
আর কিছুদিন থাকলে বেঁচে
সবাই দেখতে পাবেই পাবে….’
(বাঙ্গালীর মেয়ে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
স্মরণযোগ্য বিদ্যাসাগরের সেই আক্ষেপোক্তি:
‘যে দেশের পুরুষজাতির মধ্যে দয়া নাই, ভালো-মন্দের বিবেচনা বোধ নাই, লৌকিক ধর্মকে রক্ষা করাই প্রধান ও পরম ধর্ম মনে করে, সে-দেশে যেন হতভাগা অবলা জাতি জন্মগ্রহণ না করে।’
তাই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরৎচন্দ্রে শেষ পর্যন্ত কেবলি ভালো মেয়েদের জয়জয়কার। ঈশ্বর গুপ্তের মত সরল ভঙ্গিতে নয়, বরং অনেক বেশি কপটতার আশ্রয়ে।
বঙ্কিমের রোহিণী-কুন্দ মৃত্যু যুগলের চাইতে করুণ পরিণতি দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনী- মৃণালিনীতে। বিনোদিনীর (চোখের বালি) জীবনতৃষ্ণা আর মৃণালের (স্ত্রীর পত্র) বিদ্রোহ সম্পন্ন হয়, গল্পশেষে কাশীগামী হয়ে। কুমু (যোগাযোগ) লম্পট স্বামীর ঘরে ফিরে যায় অনাগত সন্তানের জন্য। বিমলা (ঘরে-বাইরে) বাইরের জগতে পা ফেলতে গিয়ে প্রতারিত হয়ে ঘরে ফেরে। উচ্চারিত না হলেও লেখক মহাশয় নারীর জন্য ঘর আর স্বামীর আশ্রয় নিরাপদ একথা বুঝিয়ে দেন। অনিলা (পয়লা নম্বর) সঠিক মানুষটির দেখা পেয়েও লেখকের রোমান্টিক ভাবনায় উধাও হয়ে যায়। লাবণ্য (শেষের কবিতা) কিংবা ললিতা-সুচরিতা (গোরা) বিবাহেই সকল সৃজন ক্ষমতার সমাপ্তি ঘটায়।
সবচেয়ে বড় কথা, রবীন্দ্রনাথ চারুলতা কিংবা বিনোদিনীর সমাজ বহির্ভূত আকাঙ্খাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে গ্রহণ করেন নি। বিহারীর মধ্যে Ôবিবেক রবীন্দ্রনাথÕ জাগ্রত হয়ে নীতিকথার মাধ্যমে নারীর গন্তব্য সম্পর্কে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
বিনোদিনীর যাবতীয় জীবনতৃষ্ণা ব্যক্ত করার প্রতুত্তরে বিহারীর বয়ান-
‘যদি তুমি নিতান্ত নির্বোধ মূর্খ সরলা বালিকা হইতে তাহা হইলেও সংসারে ভালোবাসা হইতে বঞ্চিত হইতে না –কিন্তু নাটকের নায়িকা স্টেজের উপরেই শোভা পায়, ঘরে তাহাকে লইয়া চলে না। … অসাধারণ কিছু করিতে চাহিয়ো না। সাধারণ স্ত্রীলোকের শুভবুদ্ধি যাহা বলে, তাহাই করো।’
(চোখের বালি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আত্মসচেতন নারীর বিপরীতে ‘নিতান্ত নির্বোধ মূর্খ সরলা বালিকা’র বিজয় ঘোষিত হয়ে যায় এভাবেই। সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্যে তাই নারী চরিত্রসমূহ বাইনারী অপজিশনে নির্মিত। চারু-মন্দা(নষ্টনীড়),…লাবণ্য-কেতকী (শেষের কবিতা), আশা-বিনোদিনী (চোখের বালি), হেমনলিনী-কমলা (নৌকাডুবি), ঝুমু-শ্যামা (যোগাযোগ) অবিরল এইসব উদাহরণ।
বঙ্কিম অনুসৃত রবীন্দ্রনাথের পরে শরৎচন্দ্রেও আর নতুন কিছুই মেলে না। এমনকি ‘পথের দাবি’ উপন্যাসে সশস্ত্র বিপ্লবীদের নেতা ডাক্তারবাবুও দলের ভেতর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুমিত্রাকে অগ্রাহ্য করেন, কারণ সে বিশ্বাসঘাতক অপূর্বর মৃত্যুদন্ড দাবি করেছিল।
তিনি বরং অপূর্বর প্রেমিকা ভারতীয় অশ্রুতেই ভারতমাতার মুক্তি দেখতে পান।
বাংলা সাহিত্যের এই অতি সংক্ষিপ্ত নারীবাদী সমালোচনায় এক নজরে যা দেখা যায় তা হলো, মহৎ লেখকেরা নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য ও প্রান্তিক অবস্থানকে তুলে ধরেছেন ঠিকই কিন্তু কেউই পিতৃতন্ত্রের ব্যবস্থাদির প্রতি প্রশ্ন তোলেন নি, নারী মুক্তিকেই পুরোপুরি সমর্থনও করেননি। তবে সবচেয়ে বড় কথা, নারীর নিজস্ব Ôস্বরÕ উপস্থাপিত হয়নি কোথাও। তার একান্ত জীবন-যাপন সত্যিকার অর্থে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় নি পূর্ণাঙ্গভাবে। ‘কবি’ উপন্যাসে পতিতাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যার চিত্র আংশিকভাবে উঠে এসেছে।
অদ্ভুত বিষয় হলো, বরং ত্রিশের দশকের আগে নারী ছিল কথাসাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু তা যেভাবেই রূপায়িত হোক না কেন। কিন্তু তারপর থেকে নারী যেন পার্শ্বচরিত্র। হয়তো বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, সশস্ত্র আন্দোলন, স্বাধীনতা পরবর্তী সমগ্র ভারতবর্ষের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সাহিত্যেকের দৃষ্টি সরে গেছে দেশ ও সমাজচিত্রের রূপায়ণে। তাই একজন শশী, নিতাই, কুমুদ, কুবের, হোসেন মাঝি কিংবা অপুর কাছে কাপিলা, কুসুম অথবা বসন্তরা অনেক বেশি জীবন্ত চরিত্র হয়েও কিছুতেই সামগ্রিকতা নিয়ে রচনার কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি।
প্রকৃত কারণটা কি এই যে, বাস্তব জীবনেও নারী কোণঠাসা, ঘর থেকে বের হলেও। তাই রিয়ালিস্টিক উপন্যাসে বাস্তবের প্রতিফলন ঘটবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
৫.
নারীবাদের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক অনেক নিবিড় ও গভীর। নারীবাদের শুরু হয়েছিল সাহিত্যের গর্ভে, নারীদের হয়ে পৃথিবীকে দেখার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তি ও সমাজ সংগঠনকে নানান মাত্রায় দেখার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সাহিত্য গড়ে ওঠে। এজন্য বলা যেতে পারে, সাহিত্যের মধ্যেই থাকে সমাজের ছবি, সেটা হোক অতীতের মূল্যায়ন, বর্তমানের বিশ্লেষণ কিংবা ভবিষ্যতের ভাবনা। যেহেতু বর্তমান সমাজ পুরুষতান্ত্রিক, তাই সাহিত্যও গড়ে উঠেছে পুরুষতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া চোখে দেখা পৃথিবীর গল্প – যে গল্পটা পুরুষতন্ত্র নারীদের ওপরে চাপিয়ে দেয়, বিশ্বাস করতে বাধ্য করে পৃথিবীটা এমনই, যেখানে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে পুরুষেরাই নারীদের ওপর আধিপত্য করবে এবং নারীর মন হবে পুরুষের অনুগামী।নারীবাদী সাহিত্যসমালোচনা ঠিক এ জায়গাতেই প্রশ্ন তোলে, সাহিত্যকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করার কথা তুলে ধরে।
কিন্তু তারপরও কথা থেকেই যায়, সাহিত্যের সমালোচনা তত্ত্বের মাধ্যমে কি সম্ভব বিপুলায়তন ‘পুরুষ-সৃষ্টির’ বিকল্প শিল্পের ভূবন সৃজন করা? ক্ষমতায়িত হওয়ার আগে, নারীর চোখে বিশ্ব দেখার ‘চোখ’ উন্মীলিত হওয়ার আগে, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের দাবি চিরকালই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের বৈষম্য দূরীকরণে শোষিতের ‘এ্যাকটিভিজমের’ চেহারায় রয়ে যাবে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে শেকল- প্রেথিত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক অবকাঠামো মারফত, সেই শেকলের অবমুক্তিই বড় কথা নয়, বিকল্প বিশ্বের সৃজন কল্পনায় নারীর মানচিত্রটির রূপরেখা দাঁড় করাতে হবে তাদের নিজেদেরই, একক কিংবা সম্মলিত প্রচেষ্টায়।
Rokhsana Chowdhury is a Bangladeshi literary critic, prose writer, translator, and researcher. She wrote a book about the novels of Jibonanodo Dash titled “Jibonanodo Dasher uponnash: bishoybostu o prokoron,” published in 2006. She also completed her Ph.D. research from Dhaka University, focusing on “Reflections of feminist thought in Rokeya Sakhawat Hossain, Humayun Azad and Selina Hossain’s novels.” She is currently an Associate Professor at Government College in Bangladesh.