নারীরা কবিতা লিখতে পারে না

Share this:

যদি একবার চোখখুলে আমরা লিখিত কবিতার ইতিহাসের দিকে তাকাই, তবে দেখবো- কবিতার আসলে কোনো জনক নেই। কবিতার আছে জননী। এনহেদুয়ান্না তাঁর নাম। যিনি জন্মেছিলেন স্বয়ং যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও আড়াই হাজার বছর আগে।

তিনি একজন কবি, একজন নারী। এখন পর্যন্ত তাকেই ধরা হয় এই মহাপৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম কবি।

কিন্তু যদি আপনার মনে একজন কবির আলপনা আঁকতে বলা হয়, খুব সাধারণত আপনার কল্পনা জগতে ভেসে ওঠার কথা নয় একজন নারীর প্রতিমূর্তি। কবি শব্দটি শুনলেই আমাদের ভাবনায় যে অবয়ব এসে প্রতীয়মান হয়, তা মূলত একজন পুরুষের।

এমনকি আপনার সমসাময়িক ১০ জন নারী কবি’র নাম’ও যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়, সাধারণত আপনি চট করেই এর জবাব দিতে পারবেন না। আমিও পারবো না আসলে।

কিন্তু এইযে আমি ‘নারী কবি’ শব্দ দুটি পাশাপাশি লিখলাম, পুরুষ কবির ক্ষেত্রে কখনো কী আলাদাভাবে ‘পুরুষ কবি’ লেখার প্রয়োজন পড়েছে আমাদের কোনোদিন? মনে পড়েনা। নাকি আমরা ধরেই নিয়েছি যে- ‘কবি’ শব্দটি একটা নির্দিষ্ট লিঙ্গভিত্তিক সম্পত্তি, আর নারী সে সম্পত্তির অর্বাচীন ভাগিদার!

তাই কোনো কবি সামাজিক অথবা শারীরিক লিঙ্গের অবস্থান থেকে নারী হলে আমাদের এখনো কবি হিসেবে তাকে স্বীকার করার আগে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় যে- এই কবি মূলত একজন নারী।

আমরা এখনো নারীকে কবি হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হইনি, এই অনভ্যস্ততার দাসত্বে থাকতে থাকতে আমাদের মস্তিষ্ক নিজেই নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে বহু মিথ। যার মধ্যে বহুল প্রচলিত একটা মিথ- “নারীরা কবিতা লিখতে পারেনা”।

যেকোনো মিথের সূত্রেই লুকিয়ে থাকে ঐতিহাসিক বাস্তবতা, মিথ কেবল সেটা প্রচার ও প্রসার করার এক লোকরঞ্জনমূলক মাধ্যম মাত্র।

মিথ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নারীরা সত্যিই কবিতা লিখতে পারে কী পারে না- এই বিতর্কে আমি যাবো না। তা হবে সরাসরি কবিতার ইতিহাসের সাথেই মুনাফিকী।

আমি কেবল কিছু বাস্তবতার কথা বলতে এসেছি। বলা শেষ হলেই যেকোনো শরণার্থীর মতো রওনা করবো অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে একথা অস্বীকার করার উপায় আসলে নেই যে- আরো অনেক ক্ষেত্রের মতোই নারীরা সাহিত্যে আজও পিছিয়ে আছে।

‘পিছিয়ে আছে’ কথাটার মাঝেও লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ পুরুষতান্ত্রিক চাতুরী। মূলত কথাটা হবে- আরো অনেক ক্ষেত্রের মতো নারীদের আজও পিছিয়ে রাখা হয়েছে সাহিত্যে।

কবিতা তো কোনো আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- কোনো ফেরেশতা এসে নাজিলও করে দিয়ে যায়না কবিতা।

কবিতা বাস্তবতার থেকেই আসে, আসে বাস্তবের অভিজ্ঞতা থেকেই। অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হয় নিজের সাথে কথোপকথন, আর নিজের সাথে কথোপকথনের এক নন্দিত রূপ’ই মূলত এই পৃথিবীর কবিতা।

কিন্তু এই পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় প্রকৃতিতে একজন নারীর নতুন কোনো অভিজ্ঞতা হবার মতো বাস্তবতাইবা আসলে কই? বিশেষ করে একজন পুরুষের তুলনায়। আমার দেখা অধিকাংশ নারীই মূলত কাটাতে বাধ্য হয়েছে একটা মুখস্থ জীবন। রহস্যহীন, রোমাঞ্চহীন, আমৃত্যু লকডাউনের একটা জীবন। এমনকি দৈনন্দিন ঘটনার বাহিরে তাদের জীবনে আলাদাভাবে তৈরি হওয়া অভিজ্ঞতা গুলোর সংখ্যাও আঙুলে গুনেই বলে ফেলা সম্ভব।

কবি এমিলি ডিকিনসন একবার লিখেছিলেন – “মস্তিষ্কের পরিধি মূলত আকাশের চেয়েও বিস্তৃত”

কিন্তু নারীর প্রতি এই সমাজ আর সংসারের আরোপিত বাস্তবতায় একজন নারীর খোলা মনে দুই মুহূর্ত আকাশ দেখার অভিজ্ঞতা নেবার সুযোগই কই? নাই তো। সেই অভিজ্ঞতা আর সুযোগহীনতা নিয়ে যখন নারীরা কবিতা লেখে, দেখে মনে হয় পৃথিবীর প্রত্যেক নারীর কবিতাই বোধহয় একই রকম, তাদের নতুন কোনো কথা নাই, আলাপ নাই, নতুন কোনো আগ্রহ অথবা আকাঙ্ক্ষা নাই। নাই নতুন কিছু। মনে হয় প্রত্যেক নারীর কবিতা আসলে একই কবিতা। মনে হয় একটা কথারই পুনরাবৃত্তি, একই ইপিসোডের রিপিট টেলিকাস্ট।

একই রকম দুটো বিষয়ের মধ্যে যেহেতু ভালো বা খারাপ নির্ণয় করার সুযোগ নেই আর শিল্প মানেই যেহেতু নতুন্বের স্বয়ম্বর সভা; তাই আমাদের অধিকাংশ মগজ ধরেই নিয়েছে “নারীরা কবিতা লিখতে পারে না”, ঘুরে ফিরে তারা মূলত একই গীত গায়।

আরো সহজ করে যদি বলি,

যখন রাত ১০ টার পর রাস্তায় হাটি, প্রতি ৩০ কিংবা তার বেশি সংখ্যক পুরুষের বিপরীতে আমি একজন নারীকে দেখতে পাই, রাত যত বাড়ে- আরো তীব্র হতে থাকে এই সংখ্যার বৈষম্য। মানে ৩০ জন পুরুষ জীবনের কোনো একটা পথে যতটা অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে এগোচ্ছ, তখন সেই পথে বড়জোর এগোতে পারছে মাত্র একজন নারী। তাও সমান অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে না। পথে চলতে গিয়ে ৩০ জন পুরুষের যখন অবচেতনভাবে ভাবতে হচ্ছে ৩০ রকমের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবার বিষয়ে, তখন একজন নারীর সচেতন ভাবতে বাধ্য হতে হচ্ছে পথে থাকা ৩০ জন পুরুষের থেকে নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে। এবং এই ভাবনা তার দৈনন্দিন। বাস্তবতা নারীদের জন্য এই সমাজে এতোটাই রুঢ়।

অথবা অন্যভাবে বলা যায়, একই সামাজিক বাস্তবতায় বাস করা, একই শ্রেণীর, একই পরিস্থিতিতে বিরাজ করা একজন পুরুষের জীবনের তুলনায় একজন নারীর জীবনে নতুনত্বের ছোঁয়া নেহাতই কম। যা সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী থেকে শুরু করে সবচেয়ে অসহায় নারী পর্যন্ত- সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

তাদের কবিতায়ও উঠে আসে ঠিক ততটুকই বাস্তবতার ছাপ, যতটুকু বাস্তবতার অভিজ্ঞতা লাভের  অনুমোদন করেছে তাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। যেই বাস্তবতা মূলত সিংহভাগ মানুষের জীবনে মুখস্থ বাস্তবতা।

এর বাহিরেও আরেকটা সমস্যা রয়েছে।

স্বীকৃতিহীনতা কখনো যেমন প্রতিভার বিকাশকে স্থবির করে, আবার কখনো এই স্বীকৃতিহীনতাই মানুষের প্রতিভার বিকাশকে কোরে তোলে আলোর গতির চেয়েও তীব্র। কিন্তু ভুয়া স্বীকৃতির ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি কখনো ঘটেনা। ভুয়া স্বীকৃতি চিরকালই স্থবির করে দেয় প্রতিভার বিকাশের গতি।

যখন কোনো নারী সকল প্রতিকূলতাকে অস্বীকার করে, সকল প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে সাহিত্য চর্চায় আসে – আমি দেখেছি তাদের চারপাশে অদ্ভুতভাবে ভুয়া প্রশংসার ঢোল পিটিয়ে যেতে থাকে অগণিত লোক। ঘটনাক্রমে এরাই সেই লোক যারা যেকোনো মুহূর্তে সচেতনভাবে বলে উঠতে পারে- “নারীরা কবিতা লিখতে পারে না”।

ভুয়া প্রশংসার মতো সর্বনেশে বিষয় কবিতার ক্ষেত্রে সম্ভবত দ্বিতীয়টি আর নেই। বুঝে অথবা না বুঝে এই সর্বনেশে বিষয়টার সার্বক্ষণিক ভুক্তভোগী হয় মূলত নারীরা।

ভুয়া প্রশংসার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে- এটা ধীরে ধীরে মানুষের নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার তাড়না নষ্ট করে দেয়, নষ্ট করে নেয় নিজেকে অর্জন করতে চাওয়ার চ্যালেঞ্জ সমূহকে। আর যেখানে একজন নারীকে লেখা শুরুই করতে হয় তার সমসাময়িক একজন পুরুষের তুলনায় অনেক দূরে পিছিয়ে থেকে, সেখানে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার তাড়না নষ্ট হয়ে যাবার চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারেনা।

প্রতি ৫-১০ বছর পর পর আমরা উল্লেখযোগ্য কিছু কবির সাথে পরিচিত হই, ঘটনাক্রমে সেই সব কবির তালিকাতেও আমরা দেখি না কোনো নারীর নাম। আমরা দেখি অসীম কাব্যিক সম্ভাবনা নিয়ে একেকজন কবিকে হারিয়ে যেতে, পরিসংখ্যান করলে হয়তো দেখা যাবে- শতাংশের হারে সেখানেও বেশিরভাগই নারী।

এড়াতে না পারার মতো অনেক বাস্তবতার সাথে ভুয়া প্রশংসাকেও এর জন্য অন্যতম কারণ বলে মনে হয়েছে আমার।

প্রথমধাপে এই সমাজ সিংহভাগ নারীর জীবন থেকে রদ করে রাখছে একটা কাব্যিক যাত্রার সবগুলো পথ। আর সেসব অতিক্রম করে কোনো নারী যখন সাহস করছে নিজেকে অর্জন করার যাত্রায় এগিয়ে যাবার- তখন তাকে কৃষ্ণগহ্বরের মাঝখানে ভাসিয়ে নেওয়া হচ্ছে ভুয়া প্রশংসার স্রোতে। যেখান থেকে সহজে ফেরার পথ থাকে না কারো।

এর পর আমাদের সামাজিক মস্তিষ্কে প্রচলিত হচ্ছে নিজেদের অংশগ্রহণে তৈরিকৃত মিথ-

“নারীরা কবিতা লিখতে পারে না”

শেষ করি মার্কিন কবি মায়া অ্যাঞ্জেল্যুর একটা লাইন দিয়ে-

“আমি জানি, খাঁচার পাখিরা কেন গান গায়”

 

Shoikot Amin is an anti-authoritarian poet and activist from Bangladesh. He believes in equal rights for all human beings on this planet and the right of every other living being to live free.

About The Author

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!