নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যূথবদ্ধ আন্দোলন নেই কেন?

Share this:

Why is there no effective movement against the oppression of women? | Supriti Dhar

English Summary:

Is the women’s movement in South Asia restricted to the middle class only? Such a question is often heard. Additionally, there are allegations that women’s movements in South Asia practice class discrimination. It is alleged that most of the women who are currently involved in the protest are urban educated people; since they have little or no work experience in the field, so they have no involvement with marginalized women population. These are all allegations. Unfortunately, the main problem is that there is no unity among our women and women’s organizations. As a result, we do not see any gain at the end. But why? This question is for everyone to ponder.

দক্ষিণ এশিয়ায় নারী আন্দোলন কি কেবলই মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ? এমন একটা প্রশ্ন প্রায়শই শোনা যায়। মধ্যবিত্তের পাশাপাশি শ্রেণিবৈষম্যের অভিযোগও উঠে এসব আন্দোলনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে, বর্তমানে যেসব নারী প্রতিবাদে শামিল আছেন, তাদের সিংহভাগই যেহেতু শহুরে শিক্ষিত মানুষ, যেহেতু তাদের মাঠে কাজের অভিজ্ঞতা কম বা একেবারেই নেই, সুতরাং প্রান্তিক নারী জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। ফলে এই আন্দোলন একটা অসম্পূর্ণ আন্দোলন। বিশাল জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে বা বঞ্চিত রেখে কোনো আন্দোলন সফল হতে পারে না। আরও অভিযোগ, মাঠে-ময়দানে নেমে পরিবর্তন আনতে না পারলে বর্তমান সময়ের এসব অনলাইনে ‘চাপাবাজি’ করে মূলত কোনোকিছুই অর্জন হবে না।

এরকম ধারণা করার কারণ অবশ্যই আছে। গণমাধ্যমগুলো প্রধানত শহরের ঘটনাগুলোর ওপরই জোরারোপ করে থাকে। আর তাছাড়া বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসে সমস্ত আন্দোলনই গড়ে উঠেছে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই, নারী আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম নয়। মধ্যবিত্তরা সবসময়ই স্পষ্টবাদী, তারা কেবল শারীরিকভাবে সক্রিয়ই থাকে না, আন্দোলনের অন্যান্য যেসব পদ্ধতি আছে, তার সবগুলোতেই সমান অংশগ্রহণ থাকে তাদের। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে শহুরে, এলিট বা শ্রেণিবৈষম্যের অভিযোগ এনে আন্দোলনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে অস্বীকৃতির সংস্কৃতিরই জয় হবে।

প্রশ্ন আরও আছে, দেশে এখন এতো এতো প্রতিবাদী নারী কণ্ঠস্বর, অনলাইনে এতো প্রতিবাদী লেখকের পদচারণা, এতো নারী সংগঠন, তবুও কেন কোনো জোর প্রতিবাদ হচ্ছে না? কেন তারা একাত্ম নয়?

পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে গত ছয় মাসে চারশরও বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সলিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিলো ৭৩২জন৷ অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে দ্বিগুণ যা ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি৷

২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে৷ আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী৷ কোথায় হচ্ছে না এই ধর্ষণ? নারীরাও বাসা-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-কর্মক্ষেত্র, কোথাও নিরাপদ নয়।

ধর্ষণ এই মুহূর্তে যেভাবে মহামারীর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তারপরও কেন সবাই একাত্ম হয়ে দিল্লির নির্ভয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর গড়ে উঠা আন্দোলনের মতোন কিছু করতে পারছে না? চিলিতে, মেক্সিকোতে গড়ে উঠা নারী নির্যাতন ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনগুলো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেলেও বাংলাদেশে এর প্রতিফলন নেই কেন? খোদ আমেরিকাতে উইমেন মার্চে লাখো নারীর অংশগ্রহণ দেখে একবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এরকম একটি উইমেন মার্চের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেখানে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল হাতে গোণা। পরিচিত নারীমুখগুলোই সেদিন অনুপস্থিত ছিল। সংগঠনগুলো তো নয়ই।

টাঙ্গাইলের একটি বাসে রূপা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু চত্বরে বিক্ষোভ প্রতিবাদে অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। এছাড়াও ধর্ষণবিরোধী একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল ২০১৮ সালে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে এই প্রতিবাদে অংশ নেয়ার সংখ্যাও ছিল লজ্জাজনক। যেন ধর্ষণ বিষয়টা সার্বজনিন ইস্যু হয়ে উঠতে পারেনি এখনও।

বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের রেশ ধরে ২০১৮ সালের শেষদিকে #MeToo আন্দোলনের কথাই যদি ধরি, তবে একরাশ হতাশা ছাড়া কোনো প্রাপ্তি আমাদের নেই বললেই চলে। যেসব মেয়েই সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে মুখ খুলেছিল, তারা এখন পর্যন্ত নানাভাবে অপদস্থ হচ্ছে। যেভাবে নির্যাতকদের পক্ষ নিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ভিক্টিমদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাতে এইদেশের নারী আন্দোলন কয়েক যুগ পিছিয়ে গেছে বলেই আশংকা হয়।

এই প্রশ্নটা আমাদের ভাবায়। বন্ধুমহলে এ নিয়ে আমরা দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আলোচনা করি। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসি যে আমাদের মধ্যকার রাজনৈতিক মতাদর্শগত ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আর বিভক্তিই আজ দেশের নারীসমাজকে অনৈক্য এবং বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আর এর সুফল ভোগ করছে শোষক সমাজ।

সাংবাদিক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বিশ্বাস করেছি যে সংসদে নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেই বুঝি নারী অধিকার আদায়ের পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে। আরও বিশ্বাস করেছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে যে হারে কাজ হচ্ছে, তাতে করে আশান্বিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর ‘সর্বত্র নারীর আরও উন্নয়ন ও অংশগ্রহণ চাই’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় কিছু সুপারিশ উঠে এসেছিল:
● সর্বত্র নারীর শুধু অংশগ্রহণ বাড়ালে চলবে না, তার গুণগত উন্নয়ন জরুরি
● কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ
● নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে
● নারীর অনানুষ্ঠানিক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা দরকার
● কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সংবেদনশীল পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে
● মেয়ে ও ছেলেশিশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের পূর্ণ ব্যবস্থা করতে হবে
● নারীবান্ধব আইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি
● কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হবে
● নারীর উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বে আরও ক্ষমতায়ন প্রয়োজন

এখন প্রশ্ন করতেই পারি, আজ কতোগুলো টার্মে আমাদের দেশ পরিচালনায় নারী নেতৃত্ব? বিশ্বের অন্য কোনো দেশেই এমন নজির নেই। অথচ নারীর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি? হয়তো উপরোক্ত সুপারিশগুলোর অনেকগুলোই প্রতিষ্ঠানবিশেষে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিন্তু এতে করেও কি বৃহত্তর ক্ষেত্রে নারী জীবনের আদৌ কোনো পরিবর্তন হচ্ছে? পরিবর্তন যেহেতু হচ্ছেই না তাহলে আন্দোলন কেন যূথবদ্ধ হচ্ছে না?

এই যে ‘গ্রহণ করতে হবে’, ‘দূর করতে হবে’, ‘ব্যবস্থা নিতে হবে’ এসব শব্দমালাকে কেবলই ‘বুকিশ’ মনে হয় না আপনাদের? ‘নিতে হবে’ না লিখে ‘নেয়া হয়েছে’ কবে লিখবো আমরা? যারাই আজ ক্ষীণপ্রায় আওয়াজ নিয়েও টিকে আছি, তাদের জন্য এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা খুবই জরুরি। নইলে আজকের তারুণ্যের মাঝেও বিষাদ ভর করতে কতক্ষণ!

২০০৭ সালের দিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সভানেত্রী হেনা দাসের একটা সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। সেখানে হেনাদি বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে এখন যতটুকুই নারী আন্দোলন হচ্ছে সেসবই হচ্ছে এনজিও পদ্ধতিতে, মানে এনজিও’র প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী। সাক্ষাতকারটি প্রকাশের পর নারীনেত্রীদের অনেকেই ভীষণভাবে ক্ষেপে গিয়েছিলেন ৮৪ বছর বয়সী হেনাদির ওপর। কারণ তাদের আঁতে ঘা লেগেছিল এই কথায়। কিন্তু হেনাদি মিথ্যা বলেছিলেন, তা কিন্তু তারা বলতে পারেননি সেদিন।
হেনাদির কাছে ভবিষ্যত নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন করেছিলাম। তীব্র হতাশা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, নেতৃত্ব তৈরির জায়গাটিতেই কাজ করা হয়নি। তরুণদের কাছে গতানুগতিক আন্দোলনের প্রক্রিয়াটি যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি, তেমনি নারী সংগঠনগুলো বৈশ্বিক পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে পারেনি, আন্দোলনের ভাষাতেও তাই পরিবর্তন আসেনি। নির্যাতনের ধরন বা মাত্রা যেমন নতুনত্ব পেয়েছে, প্রতিবাদগুলোও হওয়া উচিত ছিল যুগোপযোগী। সেখানে ব্যর্থ হয়েছে নারী সংগঠনগুলো।
বিখ্যাত ভাস্কর শামীম সিকদারও এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘নারী আন্দোলন, নারীবাদ বা নারী উন্নয়ন যাই বলেন না কেন, এসবই হলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নারীদের জন্য এরা কিছুই করে না, বরং অসহায় মেয়েদের নিয়ে ব্যবসা করছে, নিজেদের আখের গোছাচ্ছে’। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত খামখেয়ালি এই ভাস্কর তাঁর সৃষ্টিতে মাটির প্রলেপ লাগাতে লাগাতে এভাবেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্যেও গোস্বা করেছিলেন আমাদের নারীনেত্রীরা।

এই যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপ্রসূত একেকজনের বক্তব্য অস্বীকার করার প্রবণতাও একধরনের বৈকল্য তৈরি করেছে নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে। অথচ বৃহত্তর নারী অধিকার আদায় এবং তা সমুন্নত রাখার স্বার্থেই আমাদের মধ্যে ডিভিশন বা বিভক্তিটা হওয়ার কথা ছিল না, আমাদের একাত্ম হয়ে পুরুষতন্ত্রের মুখে চ্যালেঞ্জটা ছুঁড়ে মারা উচিত ছিল। অথচ সবাই কেমন নির্জীব হয়ে পড়ছে ক্রমেই, কোথাও কোনো উচ্চকণ্ঠ নেই, প্রতিবাদ নেই। যারা আমাদের অগ্রজ, তাদের মুখপানে চেয়েছিলাম, যেন তারা নেতৃত্ব দেন, এগিয়ে নিয়ে যান, সমস্ত বিভেদ ভুলে আমরা যেন একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল হতে পারি। কিন্তু আমাদের নিজেদের পরস্পরের মাঝে এতো বিভেদ, এতো অনৈক্য, এতো স্বার্থদ্বন্দ্ব যে পুরো উদ্দেশ্যটাকেই ভারসাম্যহীন করে তুলেছে।

আমরা সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়াই ভুলে গিয়ে ভুল বিষয়বস্তু, ব্যক্তিদ্বন্দ্ব নিয়ে লড়াই করছি। অথচ আমাদের প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল খুবই স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ এবং সুচারু। যে সিস্টেম আমাদের নির্যাতনকে বৈধতা দিচ্ছে, বৈষম্যের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সেই সিস্টেমকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার মতোন চ্যালেঞ্জ করা উচিত ছিল। পরিবর্তে আমরা কেউ ধর্ম নিয়ে, কেউ হিজাব নিয়ে, কেউবা নারীবাদের প্রথম ওয়েভে তো কেউ ফোর্থ ওয়েভে চলে গেছি। কোথাও কোনো সামঞ্জস্য নেই। ফলে একটা জনগোষ্ঠী, যারা হিজাবের আবরণেই নিজেদের ঢুকিয়ে আনন্দ পাচ্ছে, তাদেরকে আমরা প্রতিপক্ষের কাতারে ফেলে দিয়েছি। আমরা তাদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে নারীবাদ এবং ধর্ম একসাথে বা পাশাপাশি চলতে পারে না। দুটো সম্পূর্ণতই পরস্পরবিরোধী।

আবার আন্দোলনের প্রক্রিয়া নিয়েও মতদ্বৈততা লক্ষ্যণীয়। কেউ মাঠে আন্দোলন করে পরিবর্তন আনতে বদ্ধপরিকর, আবার যারা মাঠে যেতে পারছে না তারা লেখালেখিকেই প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহী। একে বিভাজন না ভেবে ব্যক্তিবিশেষের কৌশল বলে ধরে নিলেই সহজ হয়। কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগেও যখন পরিবর্তনে শামিল হচ্ছে তাকে ঠেলে দেয়ার কোনো কারণ নেই।

এখন আসা যাক আজকের দিনে লেখালেখির মাধ্যমে যেটুকুই নারীবাদী আন্দোলন হচ্ছে তা আসলে কোন পর্যায়ে! এর প্রভাবই বা কতোটুকু? এ নিয়ে ভাবনার অবকাশ থাকলেও আশার কথা যে এই আন্দোলনে প্রকাশ্যে না জড়িয়েও মেয়েরা আজকাল তাদের কথা লিখছে নির্দ্বিধায়। এই সাহস তাদের জুগাচ্ছেও অন্যদের লেখালেখিই। তসলিমা নাসরিন যে আমাদের প্রজন্ম এবং পরবর্তি প্রজন্মকে এই সাহসটুকু দিয়েছেন, এটা বলার অপেক্ষাই রাখে না।

যদি বলি যে লেখালেখির মাধ্যমে পরিবর্তন আগেও এসেছে, সামনেও সম্ভব, একদল তখন নাক সিঁটকাবে। কিন্তু আগের প্রজন্মের লেখকদের কথাই যদি ধরি, তারা যে মেয়েদের কথাই লিখেছেন, সংসারের কথা শুনিয়েছেন এমন তো না। তাঁরা নিজেদের বৃত্তে পৃথিবীটাকে যেমন দেখেছেন, তেমনই লিখেছেন।

“সেই আমলের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একজন কামিনী রায় বা সুফিয়া কামাল, একজন ইসমত চুঘতাই বা একজন বেগম রোকেয়া, একজন আশাপূর্ণা দেবী বা প্রতিভা বসুর উত্থান মানে পাশ্চাত্যের নারীবাদী উগ্র আন্দোলনের থেকে তার তীব্রতা অনেক বেশি ভেবে নিতে হবে। আবার সেইদিক থেকে কবিতা সিংহ অনেক স্পষ্ট। তাঁর লেখায় মেয়েদের বঞ্চনাজনিত ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে তীব্রভাবে। নবনীতা দেব সেন তাঁর উচ্চারণে যেমন স্বাক্ষর রেখেছেন কবিতা, গদ্যে, রম্য রচনায়, ভ্রমণেও তেমনি”।
শারীরিক, মানসিক, সামাজিক অত্যাচারের ভয়ে বা লজ্জায় এতোদিন মুখ খুলতে পারতো না মেয়েরা, কিন্তু এখন সরব হচ্ছে। নারীবাদী লেখার মূল বিষয় ছিল – মেয়েদের নিজেদের লেখা, তাও হচ্ছে প্রবলভাবে। কী রাজনৈতিক, কী সামাজিক সব জায়গাতেই বর্তমান সময়ে ফেমিনিজম বা নারীবাদের ব্যাপক প্রভাব। পাশ্চাত্যে এর বিস্তার ঘটছে খুবই দ্রুততার সাথে, সাহিত্যের পাশাপাশি সমাজেও। বাংলা সাহিত্য বা লেখালেখির জগতও পিছিয়ে নেই। বলা চলে বাংলায় নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখালেখিতে বিশাল জোয়ার এসেছে সাম্প্রতিক সময়ে। এই জোয়ারে পিতৃতান্ত্রিক সুক্ষ্ম বিভেদগুলো অত্যন্ত স্পষ্টতার সাথে উঠে আসছে। ফলে সমাজের প্রতিটি ধাপ নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হচ্ছে ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও।

তবে হ্যাঁ, নেতৃত্বের অভাব আছে, এটা আমাদের মানতেই হবে। শুধুমাত্র নারীবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেই নয়, রাষ্ট্রের একেবারে উচ্চ পর্যায় থেকে সমাজের সবক্ষেত্রেই নেতৃত্বহীনতা দৃশ্যনীয়। সামষ্টিকভাবে ভাবতেও শিখছে না কেউ, যতটুকু যাই হচ্ছে সবই ব্যক্তিগত। অথচ মানুষে মানুষে এই জনসংযোগ তৈরির মুখ্য ভূমিকাটা নেয়ার কথা ছিল গণমাধ্যমের। সেটিও এখন ধ্বংসপ্রায়। ভয়েস রেইজ করার জায়গাটাই সম্পূর্ণ এবং পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এটা পুরুষতান্ত্রিক একটা চাল। কোনো আন্দোলনই দানা বেঁধে উঠতে পারছে না!

কী নিয়ে লিখছে মেয়েরা? যৌনতাও আর কোন ট্যাবু নয় এখন। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানকে, মাতৃত্বের দায়ভারকেও চ্যালেঞ্জ করতে শিখছে। হাজার বছর ধরে মাতৃত্বের মধ্যে নারীর সৌন্দর্যকে মহিমান্বিত করে পুরুষতন্ত্র যেমন শেকলে বেঁধে রেখেছিল নারীকে, আজ সেই শেকল খুলে বেরিয়ে আসছে নারী। ফলে প্রথাগত সমাজ ‘গেছে গেছে’ বলে হাহাকার করে উঠছে, নারীর বিরুদ্ধে নারীকেই আবার লেলিয়ে দিচ্ছে সমাজ।

তাদের এই সরব হওয়াকে ভয় পাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কিছু গোষ্ঠী এবং যেখানেই নারীবাদিতা কোনো বড় সফলতা অর্জন করে সেখানেই প্রতিপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগছে এবং তীব্র নিপীড়নমূলক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ওই অসম এবং অসাংস্কৃতিক লড়াইয়ে নারীরা পিছিয়ে থাকলেও ফাইটব্যাকটা দিতে পারছে এখন।

শেকড় ধরে টান দেয়ার বিকল্প নেই। নারী নির্যাতনের বিষবৃক্ষ উপড়ে আসুক। নারীবাদের প্রথম পর্যায় থেকেই নারী অধিকার আদায়ের পথিকৃতেরা তাদের ক্ষুরধার কলম চালিয়ে যাচ্ছেন। নারীর লেখা কেবলই লেখা নয়, সমাজের পরিবর্তন এবং চ্যালেঞ্জগুলোকে উৎসাহিতও করে। হাজার বছর ধরে যে সমাজ, যে ধর্ম নির্মিত হয়েছে পুরুষকে নারীর অধীন হিসেবে বিবেচনা করে, নারীবাদ সেই সমাজ পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করছে। আর লেখাগুলো একধরনের গঠনমূলক বিশ্লেষণ।
শেষ করি বেগম রোকেয়ার একটি উক্তি দিয়ে, “সত্যের কিন্তু অপর পৃষ্ঠা নাই -উহা স্বচ্ছ সুনির্মল। এই জন্য বলি, একতার ভিত্তি সত্য হউক”।

Supriti Dhar is a journalist and a women’s rights activist. She is the Founder Editor of Women Chapter, womenchapter.com/ , the first-ever online writing platform for women in Bangladesh. Since its inception in 2013, the Women Chapter has received national and international awards. Currently, she is living in Sweden as an ICORN Guest Writer.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!