নিরবতার চুঁড়া- টাওয়ার অফ সাইলেন্স

Share this:

রাসেল পারভেজ। বাংলাদেশের ব্লগিং জগতের প্রথম যুগের ব্লগার। পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও তার পড়াশুনা,জানাশুনার ব্যপ্তি ছিল বহুমাত্রিক। ২০১৩ সালে ইন্টারনেটে ‘ধর্মীয় উসকানিমূলক’ লেখালেখির অভিযোগে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং তার কম্পিউটার-মোবাইল পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। শুদ্ধস্বরের জন্য এই ছোট গল্পটি তিনি পাঠিয়েছিলেন জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখ। শুদ্ধস্বরের এখনকার সংখ্যাগুলো বিশেষ বিষয় ভিত্তিক হওয়ার কারণে তার গল্পটি প্রকাশ করতে দেরি হচ্ছিল। রাসেল বিষয়টি অবগত ছিলেন এবং বলেছিলেন, যখন সুযোগ হয় প্রকাশ করতে। কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত রাসেল ফেব্রুয়ারির ১৯ তারিখ পৃথিবীর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরই সাথে শেষ হয়ে যায় তাকে প্রকাশিত লেখা দেখানোর সুযোগ এবং তার কাছ থেকে নতুন লেখা পাওয়ার সম্ভাবনা। রাসেলের অকাল মৃত্যু আমাদেরকে শোকাহত করে এবং সাথে সাথে মৃত্যু শয্যা থেকে পাঠানো তার লেখা যথাসময়ে প্রকাশ করতে না পারার প্রবল বেদনায় আক্রান্ত করে। তারপরই আমরা সিদ্ধান্ত নেই শুদ্ধস্বরে ব্লগ সংযুক্ত করার। রাসেল পারভেজ শুদ্ধস্বরের একজন বন্ধু ও শুভাকাঙ্খি ছিলেন। তাকে স্মরণ করে তার লেখা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে শুদ্ধস্বরের ব্লগ যাত্রার শুভ উদ্বোধন করা হলো। – সম্পাদক

Russel Parvez was one of the premier bloggers in blog activism in Bangladesh. During a 2013 crackdown against freethinking bloggers, he was arrested for allegedly violating the Information and Communication Technology Law by writing “religious provocations” on the Internet. Police confiscated his computer and mobile. For Shuddhashar, Russel sent this short story on January 10 this year, but Shuddhashar was following a schedule to publish a Special Issue. Russel asked us to publish when the opportunity arose. Cancer-stricken, Russel broke all ties with the world on February 19. We mourn his premature death and our failure to publish in time the story he sent from his bed of suffering and pain. Russel Parvez was a good friend and well-wisher of Shuddhashar. We inaugurate Shuddhashar’s blog journey by remembering Russel Parvez and publishing his story. – Editor

জড়ায়ুতে যুদ্ধের ক্ষত বয়ে যে মানুষটা সীমান্ত পারি দিলো তার নিজস্ব ধর্ম নেই, সংস্কার নেই, রাষ্ট্র নেই, নাগরিকত্ব নেই। আধুনিক রাষ্ট্র যেভাবে নিজের নাগরিক নির্মাণ করে, বেয়োনেটে ছিন্ন জরায়ু সব নাগরিক পরিচয় বিচ্ছিন্ন করেছে শরীর থেকে- যুদ্ধশুরুর আগে তার হয়তো নাম ছিলো- সীমান্তমুখী প্রতিটা পদক্ষেপে সে তার নাম-বিস্মৃত হয়েছে। যখন খাকী পোশাকের প্রহরী জিজ্ঞাসা করলো “আপ কা শুভ নাম?” ফোঁটা ফোঁটা তাজা রক্ত ঝরছে, সেই রক্তের দিকে নিঃস্পন্দ তাকিয়ে থেকে সে বললো- “লাল, লালারুখ”। প্রহরী হাজিরা খাতায় লিখলো ” ১৫৭- লালারুখ বেগম” তার নিজস্ব কোনো পরিচয় ছিলো না, নিজস্ব সংস্কার ছিলো না, জরায়ুতে যুদ্ধের ক্ষত বয়ে, অসংখ্য সীমান্ত ডিঙিয়ে যুদ্ধেবিপন্ন মানুষদের উদ্ধার করা হয়তো তার নেশা ছিলো না। আমি জানি না। হয়তো এটাই ছিলো তার আত্মহত্যার নেশার মতো, আত্মপরিচয়হীন একজন মানুষ, যার জড়ায়ুতে যুদ্ধের ক্ষত- বুলেট-বোমা-মাইনকীর্ণ ভুমি ডিঙিয়ে, উদ্যোতে বেয়োনেট ঠেলে সরিয়ে বিপন্ন নারী কিংবা শিশুকে জড়িয়ে ফিরে আসছে ক্যাম্প। লাইফ ম্যাগাজিন, টাইমসের মতো পত্রিকায় তাকে নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে, ফিয়ারসাম ফাইটার, ট্রু ফিনিক্স- আমি জানি না, সে কি ভাবতো? কিভাবে ভাবতো? আমি তার সাথে ছিলাম, বেলুচিস্তান, ওয়াজিরিস্তান, করাচির ক্যাম্প কিংবা বসনিয়ায়। কখনও সে শিয়া, কখনও সে সুন্নি, কখনও সে খ্রীষ্টান, কখনও সে ইয়াজিদি নারী। তার নিজস্ব কোনো সংস্কার নেই, নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই, তার ধর্ম নেই, জাতীয়তা নেই। তার প্রশান্ত মুখে দিকে তাকিয়ে বসে আছি, জীবাননন্দের কবিতার মতো গভীর প্রশান্তির ঘুমের মায়া লেগে আছে তার মুখে, তার ঠোঁটের কোণে অবশেষে ঘুমানোর তৃপ্তি- “বেগম লালারুখ, লাল বিবি” তোমাকে কি পরিচয়ে সমাহিত করা হবে এখনও আমরা জানি না? উপস্থিত মানুষেরা দ্বিধা-বিভক্ত। করবে সমাহিত করা হবে না কি দাহ করা হবে, এখনও ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারে নি কেউ। মেয়েটার বয়েস আর কত হবে, সদ্য ১৩ পেরুলো, ইয়াজিদি, ভাঙা গলায় যা বললো- তার অর্থ দাঁড়ায় আমার দিদি, আমার মতো যুদ্ধাহত জড়ায়ু নিয়ে পৃথিবীর বুকে ঘুরছে, তার ভেতরের আগুণটা আমরা দেখি নি কেউই? এখন তার জীবনাবসানে আমরা নিজেদের সংস্কার নিয়ে তাকে বিদায় দেওয়ার আয়োজন করছি। সে তার আত্মপরিচয় নিয়ে চুপ ছিলো তার সমস্ত জীবন। এই নিরবতাই হয়তো তার প্রতিবাদ। এই যে প্রচলিত সব সংস্কার, নাগরিকত্বের ফাঁদ স্বেচ্ছায় উপেক্ষা করে যাওয়া, এটাই তার মহত্ব।তাকে আমরা কি সমাহিত করবো, সে তো আমাদের সকল রীতি-নীতিকে কবর দিয়ে যুদ্ধহত জড়ায়ু নিয়ে এক জীবন কাটিলে দিলো অবলীলায়। তাকে দুরের নিরবতার চুঁড়ায় রেখে আসো। সেখানে নির্জনে প্রকৃতির সাথে মিশে যাবে সে আলগোছে। হয়তো এমনটাই সে চেয়েছিলো, উদযাপনহীন সাদামটা প্রস্থান। আমরা কেউই তার স্বজন ছিলাম না। সে আমাদের সহযাত্রী ছিলো গত ৪৮ বছর, আমরা তার নাম জানতাম না, সাদা একটা কাপড়ে মোটা আলকাতরার তুলিতে লেখা ছিলো ” ১৫৭: লালারুখ বেগম”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!