নিরামিষ-যাপনের বিপরীতে আনন্দিত অন্ধকার 

Share this:

‘আমিষ’ শিরোনামের অহমিয়া একটি সিনেমাকে কেন্দ্র করে কিছুদিন যাবৎ তুমুল আলোচনা চলছে।তা চলতেই পারে।কথা হলো,আমি সিনেমার গল্পটির সারসংক্ষেপ শোনার পর ছবিটি দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম।ক্যানিবল বা নরখাদক শুধু গল্পে না, বাস্তবেও এর নমুনা মিলেছে একাধিকবার।বিদেশি ছবিতে বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে বহুবার।

অতি সাম্প্রতিক কালেই, প্ল্যাটফর্ম(ফেব্রুয়ারি,২০২০)নামের একটি স্প্যানিশ সিনেমার নাম উল্লেখ করা যায়,ক্যানিবলিজমকে কেন্দ্র করে নির্মিত যে ছবিটি দর্শকের মনোযোগ ধরে রেখেছে।

 কিন্তু ‘আমিষ’ শীর্ষক ছবিটিতে যে প্রেক্ষাপট ব্যবহার করা হয়েছে এবং যেভাবে — তা দর্শকের মনে-মগজে-মননে বহুবিধ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

ছবি দেখার পর আমার নিজের  প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক,’সহজাত সংস্কার’ প্রসূত।মোট কথা,ছবি শেষ হওয়া পর্যন্ত আমার কাছেও পুরো বিষয়টি দুর্বোধ্য আর অস্পষ্ট ছিল।তারপর ধীরে ধীরে এই ছবির প্রাঞ্জল মেটাফোরিক রূপটি আমার চোখে স্পষ্ট হতে থাকে। রিভিউটি লেখার উদ্দেশ্য আমার এই ব্যক্তিগত ব্যাখ্যাটুকু তুলে ধরা।

সিনেমার গল্প খুব সামান্যই।একজন মধ্যবয়সী পেডিট্রিশিয়ানের সঙ্গে নৃতত্ত্বে পিএইচডি রত এক ছাত্রের অসমবয়সী প্রেম।মাংসপ্রেমী প্রেমিকাকে খুশি করতে ছাত্রটি নিজের শরীরের মাংস কেটে খাওয়াতে থাকে এবং শেষে একটা খুনও করে বসে।

এবার দেখা যাক,সিনেমায় কীভাবে মেটাফোর(রূপক) আর ইমেজারি(চিত্রকল্প)গুলো রূপায়িত হয়েছে।

১.

একটি দৃশ্যে দেখা যায়, নির্মালি তার স্বামীর সঙ্গে  ডিনার করছে।ডাইনিং টেবিলে নানা রকম খাবার ফোকাস করে দেখানো হয়।কেন?কারণ সবগুলো আইটেমই ছিল  নিরামিষ এবং যে কারণে নির্মালি খাওয়ার ব্যাপারে কোন আগ্রহ পাচ্ছিল না। (নিরামিষ দাম্পত্যের সুস্পষ্ট প্রতীক?)।এরপর টেবিলেই স্বামী দিলীপ নির্মালির হাত স্পর্শ করলে নির্মালি এক মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে পাশের ঘরে যায়।ফ্রিজ থেকে চিকেন পিস বের করে লোভীর মতো খেতে থাকে।(স্বমেহন? অনিচ্ছুক সান্নিধ্যে যাবার আগে নিজেকে প্রস্তুত করার প্রতীক?)। খাবার ঘরটি আসলে আনন্দবিহীন শয্যাগৃহ নয় তো?

২.

দিলীপ হঠাৎ বিদেশ থেকে ফিরে আসায় নির্মালি বিরক্ত আর বিব্রত হয়েছিল। শীতল দাম্পত্য, যেখানে দূরত্বই কাম্য? বিখ্যাত স্বামী ফিরে আসায় পার্টি দেয়া হয় বাড়িতে। সেই পার্টিতে নির্মলাকে সবাই অভিনন্দন জানায় এভাবে, প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে।

যেখানে নির্মালি নিজেও একজন সফল পেশাজীবী,ডাক্তার — তবুও তাকে স্বামী দিলীপের পরিচয়ের ছায়ায় বাঁচতে হয়।আইডেন্টিটি ক্রাইসিস?যা কিনা ভেতরে ভেতরে নির্মলাকে ক্ষুব্ধ আর বিদ্রোহী করে তুলছিল?

৩.

সুমন বড়ুয়া নামের পিএইচডি ছাত্রটি নির্মলার জীবনে মুক্তির আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে।নির্মালিতে মুগ্ধ সুমনের সাথে খাদ্যরুচিতেও মিলে যায়।দুজন ঘুরে বেড়ায়,বিভিন্ন জায়গায় খাওয়া দাওয়া করে — এমন সব জায়গা,যেখানে এলিট শ্রেণীভুক্ত নির্মালি বা তার স্বামী দিলীপ কোনদিনই ভুলেও পা রাখত না।

এ পর্যন্ত বোঝা যায়। দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে কখন? তার নিজের শরীরের মাংস কেটে প্রেমিকাকে রেঁধে-বেড়ে,সাজিয়ে পরিবেশন করাতে?মাংস কি সুমনের অস্তিত্ব নয়? যা সে একটু একটু করে উৎসর্গ করছিল প্রেমিকার জন্য। সামাজিক কারণে পুরোটা দেয়ার সুযোগ ছিল না যে তার।তাতেই অবশ্য তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছিল,থিসিস সাবমিশন ডিলে হচ্ছিল।যে ধরনের স্যাক্রিফাইসিং প্রেম সাধারণত মেয়েরা করে — সামাজিক কারণে,বাধ্য হয়ে।(বলা বাহুল্য, স্যাক্রিফাইস বেশির ভাগ সময় গুণবাচক বৈশিষ্ট্যকে বহন করে না।) তবে একথাও অনস্বীকার্য, নারীটির জীবন যাপন দীর্ঘকাল যাবত অবদমিত ছিল।তাই হঠাৎ আকাঙ্ক্ষা পূরণে তার চাওয়াটা অস্বাভাবিক মাত্রার হওয়া বিস্ময়কর নয়।

৪.

সুমনের মাংস প্রথম যখন নির্মালি গ্রহণ করছিল সেই সময় সে শারীরিক আনন্দে ভাসছিল।কিন্তু যখন তার হুঁশ ফেরে(এখানে হবে সে জানতে পারে)তখন সে সহজাত সংস্কারবশত বমি করে দিয়েছিল।কিন্তু তারপর সে আনন্দকেই প্রায়োরিটি দেয় এবং সুমনকে বলে,সুমনের দেয়া অল্প অল্প  মাংসে(শারীরিক আনন্দ?) তার আর মন ভরছে না।তার অনেক অনেক চাই,মন ভরে(ছবিতে পেট ভরে।)

মন ভরে বা পেট ভরে মেয়েদের চাওয়াটা কবে কখন আমাদের দেশে স্বীকৃতি পেয়েছিল,এমনকি স্বামী বা প্রেমিকের কাছেও? এই ছবিতে যুবক প্রেমিকটি তাকে মন ভরিয়ে (বা পেট ভরিয়ে) দিতে চায়।নিজে না পারলে যে কোন উপায়ে।কিন্তু কতদিন? অসামাজিক নিষিদ্ধ গোপনীয়  কাজ কতদিন চাপা দেয়া যায়?

 সুমন নির্মালিকে বলেছিল,আমি তোমাকে খুশি করতে এই অভ্যেস করিয়েছি, কাজেই মাঝপথে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। অর্থাৎ ছেলেটি পূর্বাপর দায়িত্বশীল ছিল রিলেশনশিপ নিয়ে। যা ছিল না তার স্বামী। ব্যস্ত স্বামী দিলীপ  ডাক্তার পত্নীর ঘাড়ে সংসারের সকল দায়িত্ব ফেলে দিয়ে কাজ আর খ্যাতির পেছনে দৌড়ে বেড়ায়।

৫.

এখন আপনারা যে কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন,এতকিছু থাকতে এই ঘৃণ্য মেটাফোর কেন? উত্তরটা সহজ।না হলে কি মধ্যবয়সী নারীর শারীরিক চাহিদার রূপ প্রকাশ হয়ে গেলে সমাজ তাকে কেমন ঘৃণার চোখে দেখে তা বোঝানো যেত? মাংস খাওয়ার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে গেলে মিডিয়ায় ঝড় ওঠে।তাদের ভাষা ছিল অনেকটা এরকম,এই প্রথম একজন নারী মানুষখেকোর দেখা মিলেছে, যে কিনা আবার উচ্চ শিক্ষিত,ডাক্তার এবং হাই সোসাইটিতে বিলং করে।অর্থাৎ নিম্নবর্গের মানুষ হলে এবং পুরুষ হলে বিষয়টা অপেক্ষাকৃত কম বিস্ময় আর ঘৃণার সঞ্চার করত?

৬.

‘আমিষ’ ছবিটিতে উপস্থাপিত প্রেম প্লেটোনিক কিনা সেই বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি  করেছে শেষ দৃশ্যটি।পুরো ছবিতে প্রেমিক যুগলের কোন ঘনিষ্ঠ দৃশ্য না থাকায় শেষ দৃশ্যে তাদের হাতে হাত রাখাটা বিষয়টিকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। কিন্তু তাহলে এতসব মেটাফোর আর সিম্বলিক আয়োজনের কী প্রয়োজন ছিল? আমার দৃষ্টিতে পুরো ছবিটিই আমিষিয়,অর্থাৎ নর-নারীর জৈব রাসায়নিক ভালবাসার উপস্থাপনা,রক্ত-মাংসে মিশে যাওয়া অকৃত্রিম অযান্ত্রিক প্রেম,যা শুধু আমরা লোককাহিনীতে জেনে এসেছি। অসমবয়সী,অবৈধ,শরীরী এই প্রেম সমাজের চোখে নরমাংস ভক্ষণ তুল্য হয়ে দাঁড়ায় কিনা ভেবে দেখুন।শেষ দৃশ্যটিকে আমি দেখেছি আস্থার প্রতীক রূপে।  চূড়ান্ত বিপদের মুহূর্তে, এই অবিশ্বাস আর ঘৃণার পৃথিবীতে, তারা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বুঝিয়ে দেয় তাদের সম্পর্ক কেবলি শরীর নির্ভর ছিল না।এবং যারা ভাবছেন,এই ছবিতে ছেলেটির প্রেম একতরফা, স্যাক্রিফাইসিং — এই দৃশ্যটি তাদের জন্যেও জবাব দিয়ে যায়।

৭.

‘আমিষ’ ছবিটি আমার কাছে কেবলি প্রেমের ছবি বলে মনে হয় নি। সুমন বড়ুয়াদের একটা গ্রুপ ছিল ‘মিট ক্লাব’ নামে।ক্লাবটি ছিল মূলত ফ্রোজেন মিটের বিরুদ্ধে নীরব আন্দোলন বিশেষ।সুমনরা পশুর মাংস খাওয়ার আয়োজন করত তাৎক্ষণিকভাবে।জঙ্গলে থাকা মানুষদের মতো(সভ্যতার ভাষায় জংলী) কাটা-বাছা-খাওয়া।ভাবা যাক,ফ্রোজেন মানে কী?

ফ্রোজেন মানেই বিস্বাদ,ফ্রোজেন মানেই সংরক্ষণ,আর সংরক্ষণ মানেই পুঁজিপতির হিমাগারের সদ্ব্যবহার, বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অনাহার। ফ্রোজেন ফুড মানেই খাদ্য উৎপাদনের সাথে ভোক্তার দূরত্ব, শ্রমের শোষণ আর বিক্রি-বাট্টার বাজার। ফ্রোজেন ফুড মানেই খাদ্যের মৌলিক আনন্দ থেকে সরে গিয়ে সাফল্যের পেছনে দ্রুতগতির দৌড়,তাই এর আরেক নাম ফাস্টফুড।ফাস্টফুড খেয়ে ওবেসিটি,তারপর নিরামিষ খেয়ে ওজনের ভারসাম্য বজায়ের চক্র। এক জায়গায় পড়েছিলাম, পৃথিবীতে এখন যারা প্রাণীর বিলুপ্তি রক্ষার্থে ভেজিটারিয়ান কিংবা ভিগানে রূপান্তরিত হচ্ছে তারা মূলত প্রাণীদের মূল খাবারগুলো গ্রহণ করে আবারো তাদের বিলুপ্তির দিকেই ঠেলে দিচ্ছে।

আমরা যখন রবীন্দ্রনাথের সুরে ‘ফিরিয়ে দাও সেই অরণ্য’ উচ্চারণ করি তখন ভাবি না অরণ্য যাপন কোন মুখের কথা না।

৮.

ছবিটির পরিচালনা নিয়ে নতুনভাবে কিছু বলার নেই।তবে মাংস খাওয়ার প্রতীকটি আরো বেশি বুদ্ধিদীপ্তভাবে উপস্থাপন করা যেত কিনা এমন প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। অনবদ্য ছিল এর সিনেমাটোগ্রাফি, বিশেষত ছবির মূল বিষয়বস্তুকে ফোকাসে রেখে ফুড ফটোগ্রাফির আকর্ষণীয় পরিবেশনা মুগ্ধ  করার মতো ছিল।

ছবিটি শেষ পর্যন্ত আলোকিত সভ্যতার বিপরীতে এক অন্ধকারের যাত্রার গল্প বলে দর্শককে,যে যাত্রার অভিযাত্রীগণ আনন্দিত পথের সন্ধানী। সভ্যতার হাতে গড়া ‘আলোকিত মানুষ’, ‘সাদা মনের মানুষে’র উল্টো দিকে ‘অসভ্য বর্বরতা’র বাইনারী ধারণার বিরুদ্ধে এ এক অনবদ্য প্রতিবাদের গল্প।

Rokhsana Chowdhury is a Bangladeshi literary critic, prose writer, translator, and researcher. She wrote a book about the novels of Jibonanodo Dash titled “Jibonanodo Dasher uponnash: bishoybostu o prokoron,” published in 2006. She also completed her Ph.D. research from Dhaka University, focusing on “Reflections of feminist thought in Rokeya Sakhawat Hossain, Humayun Azad and Selina Hossain’s novels.” She is currently an Associate Professor at Government College in Bangladesh.

1 thought on “নিরামিষ-যাপনের বিপরীতে আনন্দিত অন্ধকার ”

  1. সাইমুম সোহরাব

    আমি এত্তকিছু বুঝি না। প্রথম দিকে ছবিটা আর দশটা সাধারণ ছবির মতোই ঠেকছিল। আস্তে আস্তে একজন নারীর জৈবিক মানবিক চাহিদার অপূর্ণতাই মাংসের বিমূর্ততাই ধূসর রঙে সেলুলয়েডে এঁকেছেন বলে মনে হয়েছে। নিরির অল্প মাংসে হচ্ছে না ব্যাপারটা সুমন তার মতোই বুঝেছে। সাধারণ একটা গল্পের অসাধারণ হয়ে ওঠবার কাহিনি এই আমিষ। শেষের দৃশটি মাংসের বিমূর্ততাকে ছাপিয়ে জীবনের দিকেই দৃঢ়তার অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে বলে মনে হয়েছে।
    আমি আউটসাইডার কিছুই ভিতর থেকে দেখতে পারি না আমার মন্তব্যে গুরুত্বেরর কিছু নাই। আপনার রিভিউ ভাল লেগেছে।
    আমি এমন গল্প বাস্তবেও সমাজে সংসারে কানাকুঞ্ছিতে লুকিয়ে থাকতে দেখেছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!