পরিবেশ নীতিবিদ্যা

Share this:

বুদ্ধির সত্য সবসময় বাস্তবের সত্য না-ও হতে পারে। অভিজ্ঞতার ওপর অধিক নির্ভরতা জন্ম দিতে পারে উগ্র সংশয়ের। সেই ক্ষেত্রে কান্টশিয়ান স্কুলের সাথে উপরিউক্ত মতবাদের সমন্বয় হলে বুদ্ধি-আশ্রিত অভিজ্ঞতাযুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ নীতিবিদ্যার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তবে এটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নীতিবিদ্যায় বুদ্ধির অবস্থান তুলনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, অভিজ্ঞতার চাইতে।

 

দার্শনিক কান্ট একবার বলেছিলেন তিনি আকাশপানে তাকালে যেমন দেখতে পান অসংখ্য তারা, ঠিক তেমনি নিজের দিকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাকালে দেখতে পান অসংখ্য নৈতিক নিয়ম। এই নৈতিক নিয়ম কিভাবে তৈরি হয়েছিল? প্রত্যেকটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমাদেরকে একধরনের নৈতিকতা দেয় বটে কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়; ধর্ম-অতিরিক্ত নৈতিকতার অস্তিত্বও রয়েছে। প্রত্যেকটি সমাজেরই কিছু রীতি-নীতি রয়েছে। রয়েছে সংস্কৃতি। এই রীতি, প্রথাগুলোই একসময় আমাদের ধর্ম-অতিরিক্ত নৈতিকতার জন্ম দিতে পারে এবং দেয়ও। তবে ধর্মসংক্রান্ত নৈতিকতার সঙ্গে পাপ-পুণ্যের ভাবনা জড়িত। আর ধর্মনিরপেক্ষ নৈতিকতার ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ। এই দুই ধরনের নৈতিকতার ক্ষেত্রে সহ-অবস্থান বজায় থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধ লক্ষণীয়। যেমন: একটি মেট্রোপলিটন নগরের  অধিবাসীর নাগরিকবোধ (Civic Sense)  যে ধরনের নৈতিকতাকে অনুমোদন করে তার সাথে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকর্তৃক অনুমোদিত নৈতিকতার বিরোধ থাকতেই পারে।

 

কেন আমরা নৈতিক কাজ করব?

এই প্রশ্নটির উত্তরে যাওয়ার আগে আমাদের ‘কেন আমরা যুক্তিসঙ্গত আচরণ করব?’-এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা দরকার। অনেক দার্শনিক এই প্রশ্নের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তাঁদের মতে এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে গেলে, তা যুক্তিসঙ্গত উপায়েই দিতে হবে। তাই যুক্তি নিয়ে তোলা এই প্রশ্নে যুক্তিবৃত্তিকে পূর্বনির্ধারিতভাবে ন্যায় হিসেবে অনুমান করে নেওয়া হয়েছে। একই কথা আমাদের আলোচ্য প্রথম প্রশ্নের উত্তরেও প্রযোজ্য। প্রশ্নটি নৈতিক এবং যৌক্তিকভাবে ভ্রান্ত। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের যুক্তিসম্পন্ন ও ন্যায়ানুগ হওয়ার কারণগুলোই উল্লেখ করতে হবে, যা পূর্ব থেকেই অনুমিত। এই প্রসঙ্গে F.H Bradley’র মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য “যখন আমাদের নিকট প্রশ্ন রাখা হয় আমাদের কেন নীতিবান হওয়া উচিত? তখন আমরা এই প্রশ্নের কী উত্তর দিতে পারি? বিশেষ করে এই অর্থে যখন প্রশ্ন করা হয় যে, নৈতিকতা আমাকে কী সুবিধা প্রদান করবে? এক্ষেত্রে পুণ্যের সুখকর সকল প্রসঙ্গকে পরিহার করলেই আমরা ভালো করবো। আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে, এ বিষয়টি অসৎ গুণের সম্ভাব্য সকল আনন্দকে অতিক্রম করে।”

এই প্রশ্নটির এমন কোনো উত্তর দেওয়া যায় না যা সকলকে নৈতিক কাজ করার জন্য প্রেরণাদায়ক যুক্তি প্রদান করবে। হয়তো নৈতিকভাবে অসমর্থনযোগ্য আচরণ সবসময় অযৌক্তিকও নয়। তবে এই ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষমতার (Power) সাথে যুক্তির সম্পর্ক মনে রাখতে হবে। নৈতিক আদর্শের মারাত্মক পর্যায়ে লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত যুক্তি প্রদানের জন্য আমাদের সম্ভবত সবসময় আইনের অনুমোদন এবং সামাজিক চাপের প্রয়োজন হবে।

 

প্রসঙ্গ নীতিবিদ্যা

এই প্রবন্ধে আমরা নীতিবিদ্যাকে দেখব প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তাত্ত্বিকতাকেও একেবারে বাদ দিয়ে নয়। কিন্তু এই তত্ত্ব কিছুতেই স্পিনোজার Ethics, Demonstrated in Geometrical Order -এর মতো মাত্রাতিরিক্ত বুদ্ধিবাদী পর্যায়ে পৌঁছাবে না। চিরায়ত উপযোগবাদীদের মতো অভিজ্ঞতাবাদিতায়ও পর্যবসিত হবে না। হবে অনেকটা কান্টশিয়ান নীতিবিদ্যার মতো। যেখানে  উপযোগবাদকে নীতিবিদ্যার একমাত্র অবস্থান হিসেবে গ্রহণ না করে অধিকারসমূহের মতবাদ, ন্যায়পরায়ণতার মতবাদ, জীবের পবিত্রতার মতবাদ ইত্যাদির অবস্থানকেও মূল্যায়ন করা হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বুদ্ধির সত্য সবসময় বাস্তবের সত্য না-ও হতে পারে। অভিজ্ঞতার ওপর অধিক নির্ভরতা জন্ম দিতে পারে উগ্র সংশয়ের। সেই ক্ষেত্রে কান্টশিয়ান স্কুলের সাথে উপরিউক্ত মতবাদের সমন্বয় হলে বুদ্ধি-আশ্রিত অভিজ্ঞতাযুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ নীতিবিদ্যার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তবে এটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নীতিবিদ্যায় বুদ্ধির অবস্থান তুলনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, অভিজ্ঞতার চাইতে।

আমরা আমাদের নৈতিক বিচার-বিবেচনায় যেমন নিজেদের স্বার্থকে গুরুত্ব দেই, ঠিক তেমনি আমাদের কাজের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত সকলের স্বার্থের প্রতিও সমগুরুত্ব প্রদান করা উচিত। তিমি, ডলফিন, শিম্পাঞ্জি, গরিলা মানুষের মতোই বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ও আত্মসচেতন। তাই এদের স্বাভাবিকভাবে হত্যা করা অন্যায়। এসব অবপ্রাণী সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা উপভোগ করতে সক্ষম। সুতরাং তাদের হত্যা করা হলে তাদের আনন্দপূর্ণ জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রমাণ করেছেন উদ্ভিদেরও প্রাণ ও সুখ-দুঃখের অনুভূতি আছে।

চিরায়ত উপযোগবাদ একটি কাজকে ভালো বলে মনে করে যদি অন্য কোনো বিকল্প কাজের চেয়ে এই কাজটি সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ সুখ বা অধিকতর সুখ উৎপাদন করে; এবং কাজটি মন্দ হবে যদি তা না করে। একজন উপযোগবাদী কখনোই বাস্তব অভিজ্ঞতাবর্জিত বা ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা করে এমন কোনো অপরিবর্তনীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবেন না। তাঁরা কাজের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে একটি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মিথ্যা কথা বলাকে মন্দ এবং অন্য একটি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মিথ্যা বলাকে ভালো বলে বিবেচনা করেন।

আমাদের করণীয় বিষয়ে সমাজ কী ভাবছে তা জানলেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে  যায় না। আমাদের সিদ্ধান্ত আমাদের নিজেদেরকেই গ্রহণ করতে হবে। যে বিশ্বাস ও রীতি-নীতি নিয়ে আমরা মানুষের সঙ্গে বসবাস করি সেগুলো আমাদের ওপর খুবই প্রভাব বিস্তার করে কিন্তু আমরা যখন ঐ বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করি তখন আমরা স্থির করতে পারি যে, আমরা ঐ বিষয়গুলো অনুসারেই কাজ করব, না আমরা এর বিরুদ্ধে যাব।

কোনো নৈতিক নিয়মের ন্যায্যতা পক্ষপাতপূর্ণ বা দলীয় মতামতের ভিত্তিতে হতে পারে না। নীতিবিদ্যার একটি সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা অতি জরুরি। এর মানে এই এই যে, কোনো একটি নৈতিক অবধারণাকে সার্বজনীন প্রয়োগযোগ্য মনে করতে হবে। বরং একে ‘আমি’ ‘তুমি’ ও ‘সে’-কে অতিক্রম করে একটি বিশ্বজনীন সাপেক্ষযোগ্য অবধারণ হিসেবে মনে করা যেতে পারে। এই অবধারণ আমাদের মনোভাব বর্ণনা করার চেয়ে বরং ব্যক্ত করে। এই সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি বিশেষ নৈতিক মতবাদে উপনীত হওয়া কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। নীতিবিদ্যার এই সার্বজনীন দিকটি একটি ব্যাপক উপযোগবাদী অবস্থান গ্রহণ করার পক্ষে চূড়ান্ত না হলেও একটি প্ররোচনামূলক যুক্তি প্রদান করে। এই যুক্তির সাথে জন রলস (John Rawls)-এর উপযোগবাদ সম্পর্কিত চিন্তাভাবনাকে গুরুত্ব দিলে এর গুণগত মান বাড়বে বৈ কমবে না। “মনে করুন আপনি এমন একটি বিশিষ্ট পরিষদের সদস্য যার কাজ হচ্ছে ভবিষ্যতের সমাজের জন্য সমস্ত আইন প্রণয়ন করা।…তাদেরকে প্রতিটি খুঁটিনাটি মাথায় রাখতে হবে কারণ তাঁরা একই ঐক্যমতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে এবং প্রত্যেকে আইনে সই করার পর মারা যাবেন।…কিন্তু যে সমাজের জন্যে তাঁরা আইন প্রণয়ন করলেন সে সমাজের সদস্য হিসেবে সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ ফিরে পাবেন তাঁরা। তবে কথা হচ্ছে সমাজে তাঁদের অবস্থান কী হবে সে সম্পর্কে আগে থেকে কোনো ধারণা থাকবে না তাঁদের। …সেই সমাজই হবে ন্যায়পরায়ণ সমাজ।”

আমরা যদি একবার নীতিবিদ্যার সার্বজনীন দিকটিকে সরল প্রাগ-নৈতিক সিদ্ধান্ত গঠনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি, তাহলে আমরা প্রাথমিকভাবে খুব দ্রুত উপযোগবাদী অবস্থায় উপনীত হই। এই অবস্থান হচ্ছে ন্যূনতম একটি ভিত্তি যাতে আমরা আত্মস্বার্থ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গঠনকে সার্বজনীন করার মধ্য দিয়ে উপনীত হই। যদি আমরা নৈতিকভাবে চিন্তা করি, তাহলে আমরা এই পদক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি না।

 

প্রসঙ্গ পরিবেশ

এমন জনশ্রুতি আছে যে, পরিবেশের সাথে সংঘাতে জয়ী হওয়াই হচ্ছে উন্নয়ন। প্রকৃতির অঙ্গ হিসেবে একসময় মানুষ প্রায় অসহায় জীবন যাপন করেছে। বৃষ্টিতে ভিজেছে, রোদে পুড়েছে, ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায়ের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হয়েছে হিংস্র প্রাণীর খাবার। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মানুষ এসব অসুবিধা, অসহায়ত্বকে জয় করেছে। পরিবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে। তারা তৈরি করেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট এমনকি শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। যে হিংস্র পশুদের খাবারে তারা পরিণত হত তাদেরকে বন্দি করে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। হাজার মাইল দূরত্ব অতিঅল্প সময়ে অতিক্রমের ব্যবস্থা করেছে। আরো করেছে তাদের আরাম-আয়েশের নানা ব্যবস্থা। ক্রমাগত তাদের এই চাহিদা বেড়েই চলেছে। এখানেই বেধেছে যত বিপত্তি। মানুষ কোনোকিছুর ব্যবহার ব্যতীত নতুন কিছু তৈরি করতে পারে না। মানুষ যেটা পারে সেটা হচ্ছে তাদের বুদ্ধিমত্তার কৃত্রিম বিকাশ সাধন করতে। এরই ফলে মানুষ গাছ কেটে, মাটি পুড়িয়ে, খনিজ আকরিক সংগ্রহ করে এদের রূপান্তর ঘটিয়ে আধুনিক সময়ের বাড়িঘর বানাচ্ছে। মৌলিক অভাব, অসুবিধা পূরণের জন্য প্রকৃতিকে যতটুকু ব্যবহার করা প্রয়োজন তা করলে প্রকৃতি, পরিবেশ হয়তো তাদের নিজেদেরকে নিজেরাই মেরামত করে তাদের নিজেদের স্বাভাবিক ও সুস্থ বিকাশ বজায় রাখতে পারত। কিন্তু মানুষের ক্রমাগত লোভের (চাহিদার) যোগান দিতে পরিবেশ অপারগ। এভাবে মানুষের লোভের যোগান দিতে দিতে প্রকৃতি, পরিবেশই এখন অসহায়, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

মানুষ যেমন একসময় প্রকৃতির কাছে অসহায় ছিল, ঠিক তেমনি প্রকৃতি, পরিবেশও এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণহীন লোভের কাছে অসহায়। মানুষ তার অসহায়ত্ব নিয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও প্রকৃতি, পরিবেশ নিজে অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতিসহ হয়তো টিকে থাকত। কিন্তু এখন প্রকৃতি যদি মানুষের অপরিসীম লোভের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে তাহলে মানুষসহ সকল উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুলের বিলুপ্তি নিশ্চিত। এখন পর্যন্ত প্রকৃতি তথা পরিবেশ মানুষের লোভ ও চাহিদার ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে পারবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিশিষ্ট সত্তার অধিকারী মানুষেরই দায় পড়ে তার অস্তিত্ব রক্ষার সাথে সাথে অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলকে রক্ষার।

মানুষ তাদের চাহিদার ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে না পেরে উদ্ভিদের যথেচ্ছ অপব্যবহার করছে। কিন্তু সে জানে তার বেঁচে থাকার জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন তা পায় উদ্ভিদের কাছ থেকেই। প্রকৃতিতে একসময় মানুষের সংখ্যা ছিল কম কিন্তু উদ্ভিদ ছিল বেশি। ফলে তার অক্সিজেন-স্বল্পতার প্রসঙ্গ ছিল অবান্তর। কিন্তু বর্তমানে হয়েছে ঠিক এর উল্টো। তাই তাদের অক্সিজেনের প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হতে যাচ্ছে। তাছাড়া উদ্ভিদস্বল্পতায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এরই ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে, স্থলভাগের আয়তন কমছে। CFC গ্যাসের ব্যবহারে ওজোন স্তর ক্ষয় হচ্ছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সরাসরি ঢুকে পড়ছে অতিবেগুনি রশ্মি। যা স্পষ্টতই মানুষের জন্য সুখবর নয়। অপরিশোধনযোগ্য বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে, যা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। এইরকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় যে, প্রকৃতি-পরিবেশ তাদের নিজস্ব নিরাময় ব্যবস্থার প্রয়োগে নিজেদেরকে সুস্থ স্বাভাবিক করতে পারছে না। এর (কু)প্রভাব মানুষের ওপর পড়ছে।

এটা মানুষের মনে রাখা উচিত যে প্রকৃতি তাদের সম্পত্তি নয়, সম্পদ। মানুষের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রকাশের এক পর্যায়ে রাজনীতির উদ্ভব। এরই ফলে সৃষ্টি রাষ্ট্রের। একটি রাষ্ট্রের অধিবাসীদের পক্ষে আবশ্যিকভাবেই মনে রাখা জরুরি যে, প্রকৃতির সকল উপাদানের ওপর তাদের অধিকার একচ্ছত্র নয়; কিছু কিছু উপাদানের ক্ষেত্রে তা হতে পারে (বাস্তব প্রয়োজনের নিরিখে)। যেমন : পদ্মার উৎপত্তিস্থল ভারতের রাষ্ট্রীয় সীমানায় হলেও এর পানির অধিকার বাংলাদেশিদেরও, কেননা নদীটি বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কোনো কারণে ভারত তার রাষ্ট্রীয় সীমানায় পদ্মার উপর বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহে বিঘ্নের সৃষ্টি করলে এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়তে বাধ্য। আর সেই দায় ভারত অস্বীকার করতে পারে না। একইভাবে আমাজান বাদল বনের অধিকার শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্রের হতে পারে না। যদিও একটি রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের অধীনে তার অবস্থান হওয়ায় একে রক্ষণাবেক্ষণের দায় তার ওপর প্রাথমিকভাবে বর্তায়, দ্বিতীয়ত তা সমগ্র মানবজাতির।

 

ন্যায়ের ধারণা ও সাপেক্ষতা

নীতিবিদ্যা ন্যায়ের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই বিষয়টির সর্বজনস্বীকৃত কোনো সংজ্ঞা নেই। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্লেটো তাঁর Republic গ্রন্থে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন ‘শক্তিমানের স্বার্থই কি ন্যায়?’ তিনি এই গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন যে, ন্যায় ব্যক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। প্রতিষ্ঠিত হতে পারে রাষ্ট্রে। বর্তমানে তো রাষ্ট্রের চেয়ে বহুগুণ বড় প্রতিষ্ঠান আছে। তখন রাষ্ট্রই ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান।

Republic -এ গ্লকনের মারফত প্লেটো নিম্নোক্ত মতবাদটি উত্থাপন করেছিলেন, ‘তারা বলেন যে, অন্যায় করাই প্রকৃতিগতভাবে ভালো; অন্যায় ভোগ করাই মন্দ। কিন্তু প্রথমটিতে যতটুকু ভালো আছে তার চেয়ে শেষেরটিতে অধিকতর মন্দ রয়েছে। সুতরাং, মানুষ যখন অন্যায় করা এবং অন্যায় ভোগ করা উভয় প্রকার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, আর এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছিল যে, কারো পক্ষেই দ্বিতীয়টি ভোগ করা ব্যতীত প্রথমটি ভোগ করা সম্ভব নয়, তখন তারা নিজেদের মধ্যে এ মীমাংসায় উপনীত হয়েছিল যে, অন্যায় করা আর অন্যায় সহ্য করা কোনোটিতেই লিপ্ত হওয়া সঙ্গত নয়। এভাবেই তারা আইন এবং পারস্পরিক চুক্তি স্থাপন করতে শুরু করেছিল এবং যা আইন দ্বারা আদিষ্ট তাকেই তারা আইনসম্মত ও ন্যায়সঙ্গত বলে অভিহিত করেছিল। দাবি করা হয় যে, ন্যায় কথাটির উৎপত্তি এবং ন্যায়ের প্রকৃতি হচ্ছে একটি মধ্যবর্তী অবস্থা বা আপোষভিত্তিক ভাব। এ দুটোর মধ্যে সর্বোত্তম অবস্থাটি হচ্ছে অন্যায় করা ও শাস্তি ভোগ না করা এবং সবচেয়ে খারাপ অবস্থাটি হচ্ছে প্রতিশোধের ক্ষমতা ব্যতীত অন্যায়কে ভোগ করা।”

বলাই বাহুল্য সক্রেটিস এই মত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাছাড়া এই মতটি  জনসাধারণের স্বীকৃতিও লাভ করেনি। হাজার বছরের ব্যবধানে এখন বোঝা যায় এর ভ্রান্ততা। আইন দ্বারা যা আদিষ্ট তা আইনসম্মত হলেও সর্বক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত  নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা গাত্রবর্ণের অধিকারীরা আইন করেই এমন অনেক কিছুই করেছিল, সেই আইনের শাসনের বিরোধিতা করেই আজকের নেলসন ম্যান্ডেলার আবির্ভাব। তাছাড়া উপরের মতটিতে অন্যায়কর্তা এবং অন্যায়গ্রস্ত উভয়েই ছিল মানুষ। কিন্তু আমাদের প্রবন্ধে আলোচ্য ‘বিনষ্টকারী’মানুষ হলেও ক্ষতিগ্রস্ত ‘প্রকৃতি-পরিবেশ’। ‘মানুষ বনাম মানুষ’ অবস্থায় অন্যায় করে পার পাওয়া গেলেও ‘মানুষ বনাম প্রকৃতি’ অবস্থায় অন্যায় করে পার পাওয়ার সুযোগ তেমন থাকছে না। অতএব এই ক্ষেত্রে আইনসমূহকে হতে হবে আরো স্বচ্ছ ও ন্যায়ানুগ। এর অন্যথা হলেই মানবজাতির হবে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা! কিন্তু নির্মম হলেও বাস্তব, গ্লকনের এই মতবাদের আবেদন এখনও পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

সম্ভবত এই পরিপ্রেক্ষিতে ও কিছুটা পরিবর্তিত বাস্তবতায় শোয়েটজার তাঁর Civilization and Ethics গ্রন্থে লেখেন–

“প্রকৃতি দর্শন অবশ্যই চেতনার সবচেয়ে তাৎক্ষণিক এবং ব্যাপক তথ্যাদি দিয়ে শুরু হবে। বিষয়টিকে নিম্নলিখিত সূত্রাকারে গঠন করা যেতে পারে; ‘আমার একটি জীবন আছে যা বেঁচে থাকতে ইচ্ছে প্রকাশ করে, এবং আমি এমন জীবন পরিমণ্ডলের মধ্যে অস্তিত্বশীল যা বেঁচে থাকতে ইচ্ছে প্রকাশ করে…। আমার নিজস্ব জীবনধারণার ইচ্ছার মধ্যে যেমন অধিকতর জীবনের আকুল আকাক্সক্ষা আছে তেমনি বিলুপ্তি সাধনের দুঃখেরও ভয়ও আছে। ইচ্ছার সেই রহস্যময় পরমানন্দের জন্য একে বলা হয় আনন্দ এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছার প্রতি আঘাতের জন্য একে বলা হয় বেদনা। সুতরাং, বিষয়টি (প্রকৃতি ও পরিবেশ) তারা নিজে আমাদের উপলব্ধির নিকট ব্যক্ত করতে পারুক বা বিষয়টি অনুচ্চারিতই থাকুক, আমাদের চতুর্দিকে বেঁচে থাকার ইচ্ছাকারী সকলেই সমভাবে লাভ করে।

আর নৈতিকতা গঠিত হয় এভাবে : আমি যেমন আমার নিজস্ব জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তার অভিজ্ঞতা লাভ করি, তেমনি বেঁচে থাকার ইচ্ছাকারী সকলের জীবনের প্রতি একই শ্রদ্ধা অনুশীলন করার প্রয়োজনীয়তার অভিজ্ঞতা লাভ করি। এর মাধ্যমেই আমি নৈতিকতার প্রয়োজনীয় মৌলিক নীতিটি পেয়েছি। জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সযত্নে লালন করাই ভালো; জীবনকে ধ্বংস করা এবং নিবৃত্ত করা মন্দ…। একজন মানুষ শুধু তখনই প্রকৃতভাবে নৈতিক যখন সে সব ধরনের জীবনকে সাহায্য করার জন্য তার ওপর অর্পিত দুর্বার চাপকে মেনে চলতে এবং তাদের মুক্ত করতে সক্ষম, এবং যখন সে নিয়মের বাইরে হলেও যেকোনো জিনিসকে আঘাত করা পরিহার করে চলে। সে প্রশ্ন করে না এই প্রাণী বা ঐ প্রাণী (কিংবা উদ্ভিদও হতে পারে) নিজ মূল্যে মূল্যবান হিসেবে সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য কিনা, কিংবা অনুভূতি লাভে কতটুকু সক্ষম। তার নিকট জীবন মানেই পবিত্র। যে বরফ স্ফটিক সূর্যের আলোতে ঝলমল করে, সে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে না, কোনো গাছের পাতা ছিঁড়ে না, কোনো ফুল ছিন্ন করে না এবং চলার সময়ে কোনো কীটপতঙ্গ যাতে পায়ের নিচে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ না হয় সে দিকে সে যত্নবান। গ্রীষ্মের কোনো সন্ধ্যায় সে যদি দীপালোক দ্বারা কাজ করে, তাহলে বরং সে তার টেবিলের উপর ঝলমলে এবং পাখাসহ নির্জীব পতঙ্গের পর পতঙ্গ উড়ে এসে পড়া দেখার চেয়ে জানালা বন্ধ করে দূষিত বাতাস গ্রহণ করতে অধিকতর পছন্দ করে।”

এর সঙ্গে যদি স্টুয়ার্ট মিলের On Liberty’র মন্তব্য যুক্ত করা যায় তাহলে তো বহুত খুব; “অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যেই শুধু একটি সভ্য সম্প্রদায়ের যেকোনো সদস্যের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ওপর ক্ষমতাকে আইনসঙ্গতভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে…আইনসঙ্গতভাবে তাকে কাজটি করতে বাধ্য বা নিবৃত্ত করা যায় না। কারণ ঐ কাজটি তাকে অধিকতর সুখী করবে; কারণ অন্যের অভিমত অনুসারে, ঐ কাজটি করা বিজ্ঞজনোচিত বা সঠিকও হবে।”

যতটা সম্ভব ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করলেই মানুষ স্বাধীন হবে। মানুষ যতটুকু স্বাধীন হবে তার দায়ও ঠিক ততটুকুই।

 

 

Ahmed Lipu is an author. The topic of interest in Philosophy. Published Books: Byaktikotay Nyorbyaktik(2011), Darshan(2017), Byakto : Bibidho Phenomena’r Darshonik Parzalochona(2018), Yugolsandhi : Muldhara-Bikalpodhara(2019)

 

 

 

 

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!