পাটকল

Share this:

পাটকল

ষোলোই ডিসেম্বরের আগের রাতে বেশ বড়সড়ো ঝামেলা শুরু হলো জুটমিলে। মাদারীপুরের এ আর হাওলাদার জুটমিল পাকিস্তান আমলে তৈরি হয়েছে। লতিফ মিয়া বাবার কাছে অনেক গল্প শুনেছে এই জুটমিলের, কত লোকের জমি ক্রোক করা হৈছে, অনেকে সর্বস্বান্ত হৈছে, বাবার এক মামা জমি-জিরাত সব হারাইছে মিল করার সময়, টাকা পাওয়ার কথা ছিল তাও পায় নাই, দিবে দিবে বলে অনেক ঘুরাইছে। লতিফ মিয়া অনেক লোকজন ধরে জুটমিলে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ পায়, এজন্য তার কম খরচ হয়নি।  অনুর বাপ, সোলায়মান, ম্যানেজার শ্যামল পোদ্দার সবাই তার কাছ থেকে টাকা খাইছে। লতিফ মিয়ার সম্পদ বলতে কেন্দুয়ার ওই ভিটাবাড়ি, বাড়ি লাগোয়া দুইবিঘা কলাবাগান আর বাড়ির সামনে একটা ছোট মনোহারি দোকান। কিন্তু সংসারে লোক বাড়তেছে, খরচ বাড়তেছে, মায়ের হাঁপানির ব্যারামটা দিনদিন গাঢ় হচ্ছে, মাদারীপুর শহরে নিয়ে বড় ডাক্তার না দেখালেই না। জুটমিলের কাজ লতিফ মিয়ার তত পছন্দের না, মায়ের মতো তারও শ্বাসের ব্যারাম, বেশি ধুলাবালি, পানি-কাদাতে থাকলে শরীর খারাপ করে, তখন টানা বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। রোজিনা সরিষার তেল বুকে মালিশ করতে করতে বুকের চামড়া তুইলা ফেলে তবু একটু আরাম পায় না লতিফ মিয়া। রাজৈর বাজার থেকে যদু শেখের তেলপড়া এনে বহুবার মালিশ করছে, মোস্তফাপুরের হেলথ কমপ্লেক্স থেকে ভিটামিন আইনা খাইছে, কিন্তু যে কে সেই।

অনেক ভেবে-চিন্তে এবার মিলের চাকরিটা নিছে সে, সোলায়মান কম খাটনির কামই দিছে তাকে, তবু যেন কেমন পেরেশানি লাগে। আগে কামলা নিয়া দিনরাত কলাবাগানের দেখাশোনা করছে, দোকানে বসে এটা-সেটা বিক্রি করছে, তখন মাথার উপর কেউ ছিল না। কিন্তু মিলে পদে পদে মাতবর, এ বলে এই দলে ভেড়ো, ও বলে ওই দলে ভেড়ো, সবাইকে তো খুশি করা যাবে না, তাই নিমকহারামি না করে দেশি ভাই সোলেমানের পিছন পিছন ঘুরে দিন কাটে। একবার জুটমিলে খুব বড় গণ্ডগোল হলো বেতনের টাকা নিয়ে। হাওলাদারদের বড় ছেলে বিদেশে অসুখে পড়ল, মরো মরো অবস্থা, তার চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে মিলের কর্মচারীদের বেতনের টাকা আটকে গেল, অনেকের পরিবার নিয়ে পথে বসার অবস্থা। যারা সাপ্তাহিক অথবা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে তাদের কাছে একদিনের বেতন বকেয়া মানে মাথায় বাজ পড়া, না খেয়ে থাকা। লতিফ মিয়ার ঠিক সেই অবস্থা না। রোজিনা নানা কিছু করে টাকা জমিয়ে রাখে। পুকুরের ধার ধরে বেগুন, চাল কুমড়া, লাউ আরও নানা কিছুর ফলন করে দেবর আসমতকে দিয়ে হাটবারে হাটে পাঠায়। বাড়ির পালা হাঁস-মুরগির ডিম বেচে, এখন আসমতই দোকানটা চালিয়ে নিচ্ছে।

কাজ শেষে লতিফ মিয়া বাসে করে বাড়ি ফিরে আসে, বড় ব্রিজে নেমেও দুই কিলো হাঁটতে হয়। রাতের খাওয়া-দাওয়া করে সবাই মিলে উঠানে বসে পান-বিড়ি খায়। রোজিনা এই সময়টাতে বিড়ি বাঁধে, মাদারীপুরের অনেক গ্রামেই মেয়েরা বিড়ি বাঁধার কাজ করে। লতিফ মিয়া একদিন দেখে রোজিনা রান্নাঘরে বসে মনের সুখে বিড়ি টানতেছে, সাথে পাশের বাড়ির চান্দুর মা। লতিফ মিয়া ওদেরকে কিছু বলে না, ভাবে রোজিনা সারাদিন খাইট্টা খাইট্টা মরতেছে, তারও যদি দুই-একটা বদ খেয়াল থাকে থাকুক তাতে দোষের কী? কিন্তু রাগ উঠলে তার হুঁশ থাকে না। সামান্য ভাত রান্না দেরি হয়ে গেলে সারাবাড়ি মাথায় করে নেয়। ছোট ছেলে-মেয়ে দুটোকে চড়-থাপ্পড় দিতে থাকে, রোজিনার দিকে পিঁড়ি ছুড়ে মারে, দা নিয়ে তাড়া করে। একবার পিঁড়ির আঘাতে রোজিনার কপাল ফেটে রক্তের ধারা, কিছুতেই বন্ধ হয় না, লতিফ মিয়া শেষে ভয় পেয়ে যায়, দৌড়ে হরিপদ কবিরাজকে রাত-দুপুরে ফিস দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে। ব্যান্ডেজ, ওষুধপত্র। ওইবার লতিফ মিয়ার মা ছেলেকে মাথার কিরা কাটায়ে বলে আর কোনোদিন যদি সে বৌয়ের গায়ে হাত তোলে তাহলে দুচোখ যেদিকে যায় চলে যাবে।

বৈশাখ মাসে মিলের গ্যাঞ্জামের সময় দুটো বোমা ফাটলো মিলের ভেতর, তাই নিয়ে দারুণ হৈ-চৈ, মামলা পর্যন্ত গড়ালো। অনেকের নামে মামলা দেয়া হলো, লতিফ মিয়াও বাদ পড়ল না। কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হলো। এ বাড়ি সে বাড়ি করে শেষে হাউসদিতে গিয়ে হাজির হলো। ওখানে খাঁ-বাড়ির সাথে লতিফ মিয়ার মায়ের দিকের কুটুম্বিতা, তারা এসব ঘটনার কিছুই জানে না, সেখানে কয়েকদিন থাকল। শেষে সোলায়মান খবর দিলো কোনো ভয় নাই, বাড়ি ফিরে আসো, দুপক্ষের সালিশ-মীমাংসা হয়েছে।

লতিফ মিয়া সারাদিন মিলের কাজ করে রাতে নিথর দেহে বাড়ি ফিরে আসে, রোজিনা সংসারের হাল ধরে আছে, খাটতে খাটতে হাড্ডি-চামড়া সার হচ্ছে। লতিফ মিয়ার এইসব দিকে কোনো খেয়াল নাই, শুধুই মনে হয় কেমন করে আরও দু-পয়সা রোজগার করা যায়। মিলের কিছু পাট সরিয়ে ফেলল সোলায়মানরা, সেই কাজে লতিফ মিয়াকেও শামিল করল। তার মনে একটা চাপা ভয় যদি কোনো বিপদ হয়, বিরোধীপক্ষের কেউ জানতে পারে। কিন্তু সোলায়মানের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার শক্তি তার নাই, দিনদিন আরও কিছু বিপজ্জনক কাজে জড়িয়ে ফেলল নিজেকে। ঘরের টিন বদল, ছেলে-মেয়েদের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি, মাকে নিয়ে শহরে বড় ডাক্তার দেখালো, ওষুধপত্র কত কী! নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে সুখে মাঝেমাঝে লতিফ মিয়ার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, আবার পরক্ষণেই মনে হয় যদি কোনো বিপদ আসে মামলায় পড়তে হয়, জেল-জুলুম? তখন কীভাবে সব সামাল দিবে?

সোলায়মান দুটো চটের ব্যাগ রেখে গেছে, বলল দুই সপ্তাহ লুকিয়ে রাখতে হবে। লতিফ মিয়া সোলায়মানের কোনো কথা না শুনে পারে না, সে এত উপকার করল, তার কথায় না করা যায় না। একদিন ব্যাগ খুলে চমকে উঠল, ছোট-বড় নানা অস্ত্র। এগুলো কি বন্দুক? কালো চকচকে দুটো পিস্তল। বাপের কাছে শুনেছে যুদ্ধের সময় ইয়া বড় বড় অস্ত্র সব আসত ভারত থেকে, বাপ-চাচারা মিলে পাঁচজন যশোর বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়া গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে আসছিল, তারপর কত মাস খালি যুদ্ধ আর যুদ্ধ। রক্ত, লাশ, আগুন, গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছিল। মুন্সিদের বাড়ির দুই বৌকে নিয়ে গিয়েছিল আলবদর বাহিনী। ছোট চাচাকে খন্দের মধ্যে ফেলে দুটুকরো করা হয়েছে। ছোটবেলায় এসব শুনলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যেত, হাতে গাছের বাঁকানো ডাল নিয়ে খেলতে খেলতে নিজেকে মুক্তিসেনা মনে হতো। লতিফ মিয়ার জন্ম যুদ্ধের পাঁচ বছর পর, তখন শুনেছে খুব অভাব ছিল, মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে গেছিল, একরকম আধপেটা খেয়ে বড় হতে হয়েছে তাকে। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বাবা কোনো কাজে তেমন মন বসাতে পারেনি, নানারা তখন অনেক সাহায্য করেছে।

ব্যাগের উপর হাত বোলাতে বোলাতে শিহরন জাগে, কলিজার ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে যায় আবার কেমন এক অস্থিরতা, একটা অস্ত্র হাতে নিয়ে বুকে চেপে ধরে, রোজিনা এসব দেখে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। লতিফ মিয়াকে বলে আপনি আর বিপদ ডাইকা আইনেন না, দুইটা পোলা-মাইয়া নিয়া দুইবেলা খাইয়া-পইরা দিন যাইতেছিল। মিলের কাজে ঢোকার পর থিকা আপনার ভাব-গতিক বদলাইয়া গেছে। ওই সোলায়মানই তার কপাল পোড়াইছে, এই বলে রোজিনা চিৎকার করতে লাগল। লতিফ মিয়া রোজিনার মুখ চেপে ধরে বলে চুপ হারামি একটা শব্দ করবি না, এই যে সক্কলে মিলা খাইতে পড়তে আছিস এইগুলান আসে কোনখান থিকা? এখন রিস্ক নেওন ছাড়া আর উপায় নাই। একবার হাত কলাও করলে তা আর সাদা বানানো যায় না। কাউরে এইসব কথা কবি না, খবরদার একদম মাটিতে পুঁইতা ফালামু। রোজিনা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে স্বামীকে দেখতে থাকে, বুক থেকে কাপড় সরে গিয়ে রোজিনার কালো উন্নত স্তনযুগল ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে দেখা যেতে থাকে, লতিফ মিয়া একবার সেদিকে তাকিয়ে আবার ব্যাগদুটোকে ভালো করে বাঁধতে থাকে।

মাঝরাতে ঘরের দরজায় ধুমধাম শব্দ শুনে সবার ঘুম ভেঙে যায়, ভয়ে কাঁপতে থাকে লতিফ মিয়া। তার মনে হয় সারা বাড়ি পুলিশ ঘিরে ফেলেছে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখে মিলের দুটো ছেলে ‘লতিফ মিয়া লতিফ মিয়া‘ বলে চিৎকার করে ডাকছে। পাটকলে আগুন লেগেছে। একথা শোনার পর গ্রামের লোকজন ছুটতে ছুটতে পাটকলের দিকে যাচ্ছে। অন্ধকার রাতে, গ্রামের পথে শোরগোল পড়ে যায়। হাতে বালতি, মগ, হাড়ি-পাতিল নিয়ে সবাই  ছুটছে। লতিফ মিয়া মিলের ভেতর ঢুকে পড়ে। পাটে আগুন ধরে যাওয়াতে ধোঁয়ায় সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেছে। আশেপাশের গাছ থেকে পাখিরা উড়ে ডাকাডাকি করছে, কালো ধোঁয়ার সাথে পাখিরা মাথার উপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। অনেকেই আগুন নেভাতে গিয়ে মিলের ভেতর আটকা পড়ে। মাদারীপুর শহর থেকে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি আসে, পুকুর থেকে পানি নিয়ে দশঘন্টা চেষ্টার পর আগুন নেভাতে পারে। ফরিদপুর থেকে, ঢাকা থেকে সাংবাদিকরা এসে ছবি তুলতে থাকে।

রোজিনা ছেলেটাকে সাথে নিয়ে মিলের বাইরে হাজার জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সারাদিন না খাওয়া, বুকের নালি পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে, দুচোখে অন্ধকার দেখে রোজিনা, ছেলে-মেয়ে দুটিকে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে। আগুন নেভাতে নেভাতে রাত হয়ে যায়। লতিফ মিয়াসহ যারা মিলের ভেতরে গিয়েছিল তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। পাঁচজনের শরীর ঝলসে গেছে, টেনে-হিঁচড়ে তাদের বের করে আনা হয়। রোজিনা অপেক্ষা করতেই থাকে, মিলের সামনে মাটিতে বসে বসে ঝিমাতে থাকে, চোখের সামনে পুড়ে যাওয়া মিল আর হাহাকার। কত লোক আসতেছে-যাইতেছে, কত কথা বলতেছে, কিছুই রোজিনার কানে যায় না, বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে, অপেক্ষার শেষ হয় না। মনে হয় অনন্তকল ধরে সে হাশরের ময়দানে দাঁড়িয়ে আছে, তার বিচার এখনও শুরু হয় নাই, খোদা-তালা কঠিন এক শাস্তির জন্য অপেক্ষা করাইয়া রাখছে তাকে। বাড়ির লোকেরা রোজিনাকে বাড়ি নিয়ে যায়, মুখে এক ফোঁটা পানিও দিতে পারে না সে, আগুনে পোড়া কয়েকজনের লাশ দেখার পর থেকে বমি শুরু হয়েছে, ঘরে রাখা চটের ব্যাগদুটোর কথা মনে হলে আবার ভয় তাকে ঘিরে ধরে। হাত-পা সব সিঁথিয়ে আসতে থাকে, চোখ বন্ধ করে আল্লাহ-খোদার নাম নিতে থাকে রোজিনা।

আগুন লাগার দুদিন পর ভেতর থেকে কয়েকজনের কয়লা-পোড়া লাশ বের করে আনা হয়। চামড়া সম্পূর্ণ পুড়ে হাড়েও আগুন ধরে গিয়েছিল সেজন্য শরীরগুলোর হাড়ের ভেতর গর্ত হয়ে গেছে। লতিফ মিয়ার ডান হাতের মধ্যমায় একটা পিতলের আংটি পুড়ে কালো  হয়ে গেছে, সেটা দেখে সবাই লাশ শনাক্ত করে। বাড়িতে যখন লতিফ মিয়ার লাশ নিয়ে আসা হয় সারা গ্রাম ভেঙে পড়ে। রোজিনা কয়েকবার মূর্ছা  যায়। কাউকে লাশের মুখ দেখানো হয় না। কিছু পোড়া হাড়কে গোসল করিয়ে সাদা কাফন পরিয়ে খাটে শুইয়ে রাখা হয়। রোজিনা ঘর থেকে বের হয় না। সবাই তাকে স্বামীকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য অনুরোধ করে কিন্তু সে ঘর থেকে বের হয় না, চটের ব্যাগদুটো বুকে চেপে বসে থাকে। তার দৃষ্টি স্থির। জানালা দিয়ে রোজিনা স্বামীর মরদেহ নিয়ে যেতে দেখে। একদিকে স্বামীর শোক, অন্যদিকে ভয় তাকে বোবা বানিয়ে রাখে। সবাই দেখে দুটো চটের ব্যাগ বুকে চেপে রোজিনা চকির উপর বসে থাকে।

রাত বাড়ার পর লোকজন ঘুমিয়ে পড়লে এক ফাঁকে চটের ব্যাগদুটোকে নিয়ে পুকুর পাড়ে যায় রোজিনা। শীতের রাত কুয়াশায় কিছু দেখ যায় না, পুকুরের চারপাশে কলাগাছের সারি, একটা সারির ফাঁক দিয়ে চটের ব্যাগদুটোকে পুকুরের কালো জলে ছুড়ে ফেলে। জোরে একটা শব্দ হয়, পানি চারদিকে ছড়িয়ে তরঙ্গের মতো সৃষ্টি হয়, রোজিনা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে, মনে হয় আজ স্বামীর সাথে সাথে তার সমস্ত পাপকেও যেন কবর দেয়া হলো, হাশরের ময়দানে তার কোনো দায় থাকবে না, সৃষ্টিকর্তা তাকে বলতে পারবে না তুই তোর স্বামীর ইজ্জত বাঁচাইতে পারলি না। লতিফ মিয়ার লোভের চোখ যেন রোজিনাকে গিলে খায়। কাদামাখা পায়ে রোজিনা পুকুরে নেমে পৌষের ঠান্ডা জলে ডুব দেয়, সারা শরীর কাঁপতে থেকে, পুকুর থেকে ঘরে আসার পথটুকু তার কাছে দীর্ঘ মনে হয়। ঘরে এসে কাপড় ছেড়ে রান্নাঘরে বসে হাড়িতে পড়ে থাকা ভাত খায় আর ভাবতে থাকে লতিফ মিয়া এমনভাবে কয়লা হইয়া পুইড়া মরল, তার মরণটা যেন আজরাইলরেও হার মানাইলো, চটের বস্তার অস্ত্রগুলো সারাজীবনের জন্য তার সাথী হয়ে পুকুরের মিশমিশে কালো পানিতে হারায়া গেল, যেমনভাবে লতিফ মিয়াও হারায়া গেল। লতিফ মিয়া দুনিয়াতেই যেন বিচার পাইয়া গেল, তার আর অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে না, পোড়া মরিচ ঠান্ডা ভাতে মেখে খেতে খেতে রোজিনা এইসব কথা ভাবতে থাকে। শীতের রাতে দলা পাকানো ভাত আর পোড়া মরিচ তার কাছে অমৃতের মতো লাগে।

 

প্রশ্নোত্তর

শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?

নভেরা হোসেন:  লেখালেখি এমন এক মাধ্যম যেখানে লেখক/কবি নিজের মনোজগতকে একটি ভাষার মাধ্যমে অনুবাদ করেন। এই মনোজগৎ বা মনস্তত্ত্ব তৈরি হয় বাস্তব পৃথিবীর সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।  তবে সাহিত্য বাস্তবের সরাসরি রূপান্তরণ নয়। সাহিত্যে বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে কল্পনার রসায়ন ঘটে।  নিজের অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলা যায় কবিতা বা গল্প লেখার ক্ষেত্রে সমসাময়িক পৃথিবী, সমাজ-রাজনৈতিক বিষয়গুলো প্রেরণা যোগায়। আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, যে মাটিতে হাঁটি, যে জনগোষ্ঠীর ভেতরে গড়ে উঠি তা একটু একটু করে মনের ভেতর প্রবেশ করে। ঔপনিবেশ-উত্তর স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে টিকে থাকার জন্য। লড়াইয়ের এই গল্পগুলো লেখার উপজীব্য হয়ে ওঠে। এই লড়াই বা টিকে থাকা শুধু অন্ন, বস্ত্রের জন্য লড়াই না। নারী পুরুষের দ্বন্দ্ব, ভূমির জন্য লড়াই, চাকরির জন্য লড়াই, ব্যক্তি  মানুষের ভেতরকার মনস্তাত্ত্বিক লড়াই আরও বহু কিছু।

শৈশব হতেই নগরে বেড়ে ওঠা। স্বভাবতই বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবার কাঠামো এবং নগরের সাথে মানুষের মিথস্ক্রিয়া আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। এছাড়াও আধুনিক ব্যক্তি মানুষের জটিল মনের গঠন লেখায় উঠে আসে নানাভাবে। আজকের আধুনিক বিশ্বেও নারী, সমাজ ধর্ম রাজনৈতিক পরিসরে মেরুকৃত। এই মেরুকরণের গল্পগুলো লেখার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে কখনও কখনও ।

শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?

নভেরা হোসেন:  মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের সাথে চলাফেরা করতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয়। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চলাফেরা করার সময় পাশের সিটে বসা যাত্রীর  সাথে কথা বলি। তাদের মুখভঙ্গি, কথা বলার বিষয়বস্তু, চারপাশের সাথে তাদের মিথষ্ক্রিয়া, অন্যের সাথে প্রতিক্রিয়া এগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করি। বলা যায় ঘর এবং বাইরের পৃথিবীতে একজন দর্শক হিসেবে প্রতিনিয়ত চলে পর্যবেক্ষণ। তবে একজন নিষ্ক্রিয় দর্শক হিসেবে নয়। নৃবিজ্ঞানীর মতো অংশগ্রহণকারী নিরীক্ষা চলে। নৃবিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে নিম্নবর্গের মানুষের সংস্কৃতি এবং ইন্ডিজেনাস পিপলের বিষয়ে বিশেষ আগ্রহ কাজ করে যা হয়তো লেখায় প্রচ্ছন্নভাবে চলে আসে। প্রকৃত অর্থে লেখকের ব্যক্তি-মানস লেখার বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিককে নির্মাণ করে। সমাজের একজন সদস্য হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা, অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, ভাঙা-গড়া, রাগ, ক্রোধ, আনন্দ সবকিছুই লেখায় প্রেরণা যোগায়। অতীত বা শৈশব স্মৃতি আমাকে বেশ আলোড়িত করে। কৈশোরে বৃহত্তর ফরিদপুরের মাদারীপুর মহকুমা বর্তমানে যা মাদারীপুর জেলা সেখানে অনেক যাওয়া হতো। মূলত গ্রাম এবং মফস্বল দেখার অভিজ্ঞতা ওই জায়গাকে ঘিরেই। ঢাকা শহরের বাইরে মাদারীপুরকে গভীরভাবে দেখেছি। আমার নানা আব্দুল হামিদ হাওলাদার একজন আইনজীবী ছিলেন। নানাবাড়িতে অনেক লোকজনের আনাগোনা দেখেছি ছোটবেলায়। বিচিত্র তাদের ধরন, চালচলন যা খুব আকৃষ্ট করত। নানার মক্কেলদের সাথে কথা বলতাম, জানতে চেষ্টা করতাম তাদের সম্পর্কে। ওই সময় গ্রাম দেখেছি কাছ থেকে। পুরোপুরি নাগরিক হওয়াতে গ্রাম আমাদের কাছে ছিল শ্বাস-প্রশ্বাসের জায়গা, যেন অক্সিজেন ভান্ডার। আসলে কবিতা গল্প এসব তৈরি হয় মনের ভেতরকার সুপ্ত  অনুভূতি, অভিজ্ঞতা থেকে। তবে কল্পনারও একটা বিরাট ভূমিকা থাকে লেখার ক্ষেত্রে। নিরেট বাস্তবতা থেকেই শুধু লেখা তৈরি হয় না। বাস্তবের সাথে  রক্ত-মাংস মন-মগজ সব তৈরি হতে থাকে মনের অজান্তেই। কোনো একটা দৃশ্য বা কথা বা অনুভূতি থেকে গল্প লেখা শুরু হয়। তারপর নিজস্ব গতিতে লেখা এগিয়ে চলে। এক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততা একটা বিরাট বিষয়। নিজের জীবনের যন্ত্রণা, আনন্দ, অভিজ্ঞতা এসব লেখায় উঠে আসে ।

শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।

নভেরা হোসেন:  মানুষ একইসাথে সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীব। রাজনীতির বাইরে আসলে কোনো পৃথিবী নেই। গভীর অরণ্যে বসবাসরত মানুষ, দক্ষিণ মেরুর ইগলু সংস্কৃতি সবকিছুই রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত। এটা প্রচলিত রাজনীতি নয়। একটি সংস্কৃতি পরিচালনার যে কাঠামো সেটি এক ধরনের দর্শন বা রাজনৈতিক চিন্তা দ্বারা পরিচালিত। সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা অবশ্যই কথাসাহিত্যকে প্রভাবিত করে। তবে এর প্রভাব লেখাতে থাকতেই হবে এমন করে আমি ভাবি না। রাজনৈতিক বাস্তবতা গল্প উপন্যাসে চলে আসে। কেউ ইচ্ছে করলেই এর বাইরে গিয়ে লিখতে পারে না। একটা সরল বাক্যের ভেতরে যে চিন্তা ও বাস্তবতার উপস্থিতি রয়েছে তা কোনো না কোনো রাজনৈতিক মনস্কতা থেকেই তৈরি হয়। আমরা সমাজ-ধর্ম-রাজনীতির বাইরে গিয়ে খুব কমই লিখতে পারি। মহাকাব্যগুলোতেও নানা ধরনের রাজনীতি দেখতে পাওয়া যায়। কল্পবিজ্ঞান বা সাইন্স ফিকশনে প্রচলিত রাজনীতির বাইরে চরিত্রকে নিয়ে যাওয়া যায় এবং কল্পনার পৃথিবীকে আঁকা সম্ভব হয় হয়তো। জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য লেখক। তার সমস্ত লেখালেখিতে একাত্তর পূর্ববর্তী সমাজের মানুষের মনের রাজনৈতিক সংক্ষুব্ধতা প্রকাশ পেয়েছে । জহির রায়হানের ‘‘হাজার বছর ধরে’’ উপন্যাসে বাঙালি জীবনের রাজনৈতিক কাঠামো ফুটে উঠেছে। সেখানে আরেকটি বিষয় এসেছে বাঙালি গ্রামীণ নারীর মেরুকৃত অবস্থা এবং একইসাথে তাদের নিজস্ব অনুভূতি, লড়াইয়ের জায়গায়ও স্পষ্ট হয়েছে। টুনি গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তির চতুর্থ স্ত্রী হয়ে নিজের মনের খেয়ালে রাতে পুকুরে মাছ ধরতে যায়, দেবরের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সময় কাটায় যা ওরকম একটা অবরুদ্ধ সমাজে অসম্ভব ছিল। এ সবকিছুই এক ধরনের সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা। শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসে একাত্তর সালের পুরনো ঢাকার অলিগলির ভেতরে যে জীবন এবং লড়াই চলছিল, স্থানিক প্রতিবাদের স্বর- এসব নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে।

শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।

নভেরা হোসেন:  মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব গল্পই ভিন্ন এক দ্যোতনা দেয় মনে। মানিকের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটি আমাকে অল্প বয়সে ভীষণ আলোড়িত করেছিল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচি থেকে গল্পটি পড়েছিলাম মানিকের গল্প সংকলন থেকে। প্রাগৈতিহাসিকের ভিখু ডাকাত বা কেন্দ্রীয় চরিত্র ভিখু সমাজের অধপতিত শ্রেণির মধ্যে বেড়ে ওঠা এক প্রান্তিক মানুষ। যে সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতে এক সময়ে ডাকাতে পরিণত হয়েছে। অপরাধ করার প্রবণতা কেউ জন্মগতভাবে পায়  না। পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে এই ধরনের মানসিক প্রবণতা তৈরি হয়। নৃবিজ্ঞানীরা ছিঁচকে চোরদের নিয়ে গবেষণা করে দেখেছে যারা চুরি পেশায় আসে তারা সেই ব্যক্তি এবং ব্যক্তির পরিবারের উপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এ কাজে জড়িয়ে পড়ে। সমাজের প্রভাবশালীরা যখন দরিদ্র শ্রেণিকে নিষ্পেষণের মাধ্যমে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয় তখন সেই জনগোষ্ঠীর অনেকেই চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক পেশায় জড়িত হয়ে পড়ে। তবে সকলে একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় যে তা নয়। প্রাগৈতিহাসিকের ভিখুও জীবন যুদ্ধে তেমন এক পথ বেছে নিয়েছে। ভিখুর জীবনের অন্তস্থ ঘটনাগুলো এমন দৃষ্টিতে লেখক বর্ণনা করেছেন যা সহজে জানা যায় না। একজন দাগি-আসামি, খুনির মনস্তত্ত্বকে এই গল্পে নিখুঁতভাবে আঁকা হয়েছে। ভিখু ক্রমাগত একের পর এক অপরাধ করে যায়। তার মন হয়ে ওঠে একজন ধর্ষকের মতো। নিজেকে নোংরা  অপরিচ্ছন্ন রেখে ভিক্ষাবৃত্তি করতেই তার সুবিধা। যেমন করেই হোক ভিখু বাঁচতে চায়। কাউকে মেরে, চুরি করে, ডাকাতি করে, ভয় দেখিয়ে, পালিয়ে বেড়িয়ে। ভিখুর সতীর্থরাও ওঁকে আশ্রয় দিতে চায় না। শেষে বাধ্য হয়ে আশ্রয় দেয়। ভিখুদের জীবনেও মানবিকতার স্থান দেখা যায়। পাঁচীকে পাওয়ার জন্য পাঁচীর  প্রেমিককে হত্যা করতে দ্বিধা বোধ করে না ভিখু। পাঁচীকও এই হত্যাকাণ্ডের পর ভয়ে বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক ভিখুর সাথে পথ চলতে শুরু করে। মানিকের এই গল্পটি অল্প বয়সে আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। ভাবতে শিখি সমাজের পতিত মানুষদেরও জীবন আছে এবং সে জীবন অনেক কষ্টকর, শ্রমসাধ্য।    সেখানেও প্রেম-ভালোবাসা, প্রতিযোগিতা, ঘৃণা, মানবিকতা, নৃশংসতা রয়েছে।  জীবনের অন্ধকার দিকের  গল্প যেন ফুঁটে  উঠেছে প্রাগৈতিহাসিক গল্পে।

শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?

নভেরা হোসেন:  ছোটোগল্প লেখার ক্ষেত্রে আমি সাধারণত প্রচলিত ধারাকেই অনুসরণ করি। তবে গল্পের প্রয়োজনে, চরিত্রের প্রয়োজনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফর্মের ভাঙচুর হয়ে থাকে। এটা ঘটে স্বাভাবিক নিয়মে, চিন্তাভাবনা করে ফর্মকে আমি কম তৈরি করি। তবে বহু দেশের, লেখকের গল্প পাঠের ভেতর দিয়েই ফর্মের তৈরি হয়। আমার একটা গল্প আছে ‘‘মায়াময়মিদমখিলাম’’- যার অর্থ পৃথিবী মায়াময়। এটি লেখা হয়েছে ডায়েরির আকারে। একজন তরুণের মনস্তত্ত্ব যে সমসাময়িক সমাজ কাঠামোয় ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তরুণ ছেলেটির কয়েক বছরের ডায়েরির পাতা থেকে কিছু তারিখ বেছে নিয়েছি। আরেকটি গল্প আছে ‘নাইটমেয়ার’- সেখানে গতানুগতিক চিন্তার কাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন একটা ফর্মে একজন নারীর মনস্তত্ত্ব গল্পের আকারে লিখেছি।  কাজ করতে গিয়ে নানা ফর্ম, ধরন, তৈরি হয় আবার বদলে যায়।

শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?

নভেরা হোসেন:  সার্থক কথাটি খুব ক্লিশে। আসলে প্রতিটি গল্পেরই নিজস্ব কিছু গল্প থাকে, বিষয়, রাজনৈতিক পটভূমি থাকে। সে কারণে ভালো গল্প, খারাপ গল্প বিভাজন করা কঠিন। তবে যে গল্প আমাদের ভাবায়, চিন্তার খোরাক যোগায় সেটিই তো কাম্য। এক্ষেত্রে গল্পের থিম বা বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণও।

শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

নভেরা হোসেন:  প্রতি মানুষেরই একটি রাজনৈতিক বোধ  থাকে। ব্যক্তি যে রাজনৈতিক পটভূমিতে বেড়ে ওঠে সেখানকার সাংস্কৃতিক প্রতিবেশে তার একটি সমাজ-রাজনৈতিক পরিচয় থাকে। এর বাইরে গিয়ে সে ভাবতে পারে না। একজন লেখকেরও রাজনৈতিক বোধ থাকে।

রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক অন্যায়, নিষ্পেষণ সব সময় লেখক-কবিদের ভাবায়, মনে যন্ত্রণার তৈরি হয়।  একেকজন লেখক একেকভাবে তার প্রকাশ ঘটান। নিজের অনুভূতিকে কলমে নিয়ে আসার জন্য যে দক্ষতা ও চর্চা প্রয়োজন তা সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সমাজ, রাজনীতি, ধর্মীয় যেকোনো ধরনের অসংগতি বিষয়ে লেখকদের একটা স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি  থাকা দরকার। মেরুদণ্ডহীনভাবে লেখকের জীবন কাটাতে হলে তা ভয়ংকর। সুবিধাবাদিতার জন্য অনেক লেখক কবি অন্যায় অসংগতির সাথে তাল মেলায়। এসব থেকে লেখকদের বের হয়ে আসা দরকার।

শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!

নভেরা হোসেন:  কবিতা লেখা হয় যেকোনো সময়ে। হয়তো ছাদে রোদ পোহাচ্ছি বা চায়ের মগ হাতে সোফায় বসে আছি এইসব সময়ে বেশি লেখা হয়। অনেক সময় বসে দীর্ঘ যাত্রায় পথে কবিতা লিখে ফেলি। গল্প , উপন্যাস লেখার জন্য অনেক সময় দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কোনো বড় লেখা, গল্প বা উপন্যাস শুরু করার আগে কিছুদিন চলে যায় প্রস্তুতিতে। অনেক সময় খুব দ্রুত একটি গল্প লেখা হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে বেশ সময় নিয়ে লেখা হয়। ‘ন্যায্য চালের হিস্যা’ নামে একটা গল্প লিখে শেষ করলাম। আমি সাধারণত কাগজ কলমে লিখি। সে কারণে আরও কিছুদিন কাটে কম্পিউটার কম্পোজ এবং সম্পাদনায়। ওই সময় গল্প কবিতার ভাষা বদলে যেতে থাকে। ‘ন্যায্য চালের হিস্যা’ গল্পটি লেখা হয়েছে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতিতে খেটে-খাওয়া মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে। রেশনের চাল আনতে  গিয়ে কী ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা সেটাই গল্পটির বিষয়বস্তু। একজন গ্রামীণ নারী শহুরে জীবনে এসে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গিয়ে কী ধরনের রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার শিকার হয় গল্পটিতে তা বর্ণিত হয়েছে।

About The Author

  • More From This Author:

      None Found

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!