পাঠকের নোট: আরজ আলীর জেরা ও জবানবন্দী

Share this:

শয়তানে আইসা আরজ আলীরে জিগায়- ও মাতুব্বর। আল্লায় কইছেন তারে ছাড়া কাউরে যেন সিজদা না করি। তো সেই কারণে আমি তুমগো আদমরে সিজদা করি নাই। ঠিক করছি না?

আরজ আলী কন- হ। ঠিকই তো আছে…

শয়তানে কয়- আল্লায় নরক বানায়া আমারে দিছেন আদম সাপ্লাইয়ের ঠিকা; তো সেই কারণেই আমি মাইনসেরে নরকের ভিসা দেই। ঠিক আছে না?

আরজ আলী কন- হ। ঠিকই তো আছে…

শয়তানে কয়- আল্লায় তো আমারে বড়ো দায়িত্ব দিছেন। আমার কাম হইল মাইনসের ইমান শক্ত কি নরম সেইটা পরীক্ষা করা। আমি হইলাম গিয়া মানুষের বিশ্বাসের পরীক্ষক। ঠিক আছে না?

আরজে কন- হ। ঠিকই তো আছে…

শয়তানে কয়- তাইলে আমারে ক্যান মাইনসে শয়তান কইয়া গালি দেয়? আমি তো অক্ষরে অক্ষরে আল্লার কথা মাইনা চলি…

আরজ আলী কন- তা তো ঠিক। শয়তানরে ক্যান মাইনসে শয়তান কইয়া গালাগালি করে?

ধর্মবিধান ও ধর্মপুরাণগুলা নিয়া আরজ আলী মাতুব্বরের (১৯০০-১৯৮৫) মাথায় প্রশ্নগুলা উদয় হইতে থাকে তার মায়ের লাশ দাফন নিয়া একটা ঘটনার পর। তার মা আছিলেন বিধিমোতাবেক নামাজ কালাম মাইনা চলা ধার্মিক নারী। আরজের শৈশবকালে বাবা মইরা যাবার পর চাইয়া-চিন্তিয়া কষ্টেমষ্টে পোলারে বড়ো করছেন এই নারী। তাই মা মারা যাবার পরে পুতের মনে হইল জীবনদাত্রী এই নারীর একখান ফটো তুইলা রাখা দরকার…

আরজ আলী তার মরা মায়ের ছবি উঠাইলেন। তাতেই ফটো তোলা হারাম বইলা মায়ের জানাজা-দাফন না কইরা চইলা গেলো মোল্লা মৌলভীর দল। তখনই প্রথম প্রশ্নটা চক্কর দিয়া উঠে আরজ আলীর মাথায়- ছবি তুললাম আমি। দোষ যদি হয় তো সেইটা আমার। সেই অপরাধে সারাজীবন ধর্ম করা আমার মায়ের লাশেরে ক্যান এই অপমান? এইটা কোন জাতের ধর্মবিধান?

নিজেই নিজের মায়ের কবর দিয়া প্রশ্নপত্র তৈরি করতে থাকেন আরজ আলী মাতুব্বর…

“এলোমেলোভাবে মনে যখন যে প্রশ্ন উদয় হইতেছিল, তখন তাহা লিখিয়া রাখিতেছিলাম, পুস্তক প্রণয়নের জন্য নহে, স্মরণার্থে। ওগুলি ভাসাইতেছিল অকূল চিন্তাসাগরে এবং আমি ভাসিয়া যাইতেছিলাম ধর্মজগতের বহিরে।” কহেন মাতুব্বর…

আরজ আলীর প্রশ্নচিন্তা লামছড়ি গ্রাম ছাড়ায় বরিশাল পর্যন্ত যায়। বেখোদা মানুষ হিসাবে তার বদনামও হয়। তারে বুঝায়া ধর্মের লাইনে নিয়া আসতে একদিন তার বাড়িতে আইসা হাজির হন বরিশালের এক উকিল কাম তবলিগি হুজুর। আরজ আলী কন- যদি আমার প্রশ্নগুলার উত্তর দিতে পারেন তয় নিশ্চয় আমি আপনের লগে তবলিগে যাব…

ভাবিয়া উত্তর দিবার কথা বইলা প্রশ্নগুলা নিয়া গিয়া কয়দিন পরে মোল্লা উকিল আরজের নামে পাঠায়া দেন কমুনিজমের অপরাধে ফৌজদারি মামলার একখান ওয়ারেন্ট…

সেই মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন কইরা আরজ আলী ১৯৫১ সালে আদালতে যে জবানবন্দী দাখিল করেন; সেইটাই পরবর্তীতে ‘সত্যের সন্ধান’ নামে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়; তবে বহুত বছর পরে। বাংলাদেশ স্বাধীন হইবার পরে। কারণ আরজের ব্যাখ্যার পর পাকিস্তানী আদালত তারে শাস্তি না দিলেও তার এই ধরনের লেখালেখির উপরে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি কইরা বসে…

আরজ আলীর কপাল ভালো; সেই যুগে আইজকের দিনের মতো অনুভূতিময় ডিজিটাল আইন আছিল না। নাইলে জবানবন্দী লিখিবার পূর্বে মাতুব্বররে ছেঁচিয়া দিত পুলিশ…

তার নামে কমুনিস্টগিরির অভিযোগ থাকলেও আরজ আলীর মতে দুনিয়াতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হইলেও শ্রেণিহীন সমাজ একেবারে আজব কল্পনা। দুনিয়াতে শ্রেণি থাকিবেই; তবে শোষণ বন্ধ করা সম্ভব…

আঞ্চলিক ঈশ্বর

“কোনো ধর্ম একথা কখনো স্বীকার করে না যে, অপর কোনো ধর্ম সত্য অথবা অমুক ধর্মাবলম্বী লোকদের স্বর্গপ্রাপ্তি, মুক্তি বা নির্বাণ ঘটিবে। বরং সকল সম্প্রদায়ের ধর্মযাজকেরা এই কথাই বলিয়া থাকেন যে, তাহাদের আপন আপন ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম, অন্য কোনো ধর্মই সত্য নহে।”

…চিরাচরিত এই বিবরণ স্মরণ করায়া আরজ আলী পয়লাই ধর্মগুলার বৈশ্বিক ও অলৌকিক দাবির ভিত্তিগুলারে উপড়ায়া দিয়া কন- “আমরা যাহাকে ধর্ম বলি তাহা হইল মানুষের কল্পিত ধর্ম।”

এর পরেই আরজ নাইমা আসেন তার আলোচনার মূল কেন্দ্রে। তিনি কন- আগুন থাইকা পারমাণবিক শক্তি পর্যন্ত অন্য কোনো আবিষ্কারেই আঞ্চলিকতা নাই। কিন্তু মানুষের আবিষ্কারগুলার ভিতর ‘ধর্ম আর রাষ্ট্র’ হইল ‘আঞ্চলিকতায় ভরপুর’…

আরজ আলী পড়ার লাইগা তার এই বিবৃতিটা জরুরি। রাষ্ট্র নিয়া আরজ আলী কিছু লিখেন নাই। আরজের মূল নজর ধর্মগুলার আঞ্চলিক উপাদানে। যেইগুলা মাইনসেরে শোনানো হয়; যেইগুলা মাইনসেরে জ্বালায়। ধর্মের গ্রামীণ প্রসঙ্গে গ্রামীণ সরলতা দিয়া প্রশ্ন ও ব্যাখ্যাগুলা তৈরি করেন আরজ আলী মাতুব্বর…

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ধর্মের প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে যাগো কিছু ধারণা আছে; আরজ আলীরে বুঝতে তারা কিঞ্চিত বেশিই সুবিধা পাবেন…

“হিন্দুদের নিকট গোবর পাক পবিত্র কিন্তু অহিন্দু মানুষ মাত্রেই অপবিত্র। পুকুরে সাপ, ব্যাঙ মরিয়া পচিলে উহার জল নষ্ট হয় না, কিন্তু বিধর্মী মানুষে ছুঁইলেও উহা হয় অপবিত্র।” কহেন আরজ…

পুকুর কিংবা কুয়া থাইকা পানি খাওয়ার ঘটনা বর্তমান নাগরিক মানুষের পক্ষে কল্পনা করা কঠিন। গত দুই প্রজন্ম ধইরা বাংলাদেশের গ্রামেও আর কেউ কুয়া বা পুকুরের পানি খায় না। কিন্তু বারোয়ারি টিউবওয়েলের উপরে গরুর পেশাব ছিটায়া শুদ্ধ কইরা তারপর কল চাইপা পানি নিয়া যাওয়ার ঘটনা নিজেই দেখছি আমি…

আরজের উদাহরণগুলা তিন প্রজন্ম আগের গ্রামীণ ধর্মসমাজের উদাহরণ। তার রচনার মূল বৈশিষ্ট্য হইল হাঠেমাঠে ঘাটে বিবিধ বিষয়ে ধর্মকারদের মুখে যেইসকল কথা শোনা যায়; সেইসকল পয়েন্ট থাইকা আলোচনা শুরু কইরা প্রশ্ন উঠানো; বিষয়ের বিশ্লেষণ…

ইন্টারনেটের কল্যাণে কিছুটা ভেক বদলায়া গ্রামীণ হাটমাঠঘাট এখন ঢুইকা পড়ছে অনলাইনে। অনলাইন ধর্মকারগো ক্ষেত্রেও আরজ আলী এখনো প্রাসঙ্গিক…

আরজ কথা কইছেন চাইরখান ধর্ম নিয়া; ইহুদি খ্রিস্টান মুসলমান আর হিন্দু। মাঝে মাঝে তিনি তিনখান সেমেটিক ধর্মরে এ কাতারে আইনা সমীকরণ টানছেন। হিন্দু ধর্মের আলোচনায় তিনি যেমন ঋগবেদ নিয়া আসছেন তেমনি রামায়ণ-মহাভারতের আখ্যানের উদাহরণও টানছেন। গ্রামীণ ধর্মগুলা পাঠ নির্ভর না; শ্রুতি আর পরম্পরা নির্ভর। শোনা কথাই সেইখানে ধর্মীয় আচরণের প্রধানতম ভিত্তি…

আরজে জিগান- আল্লার সকল নবী আরবে জন্মাইলেন ক্যান? মূর্তিপূজারী পৌত্তলিকগো এলাকাগুলাতে একজনও নবী আসার সংবাদ পাওয়া যায় না ক্যান?

এর উত্তর সোজা। আল্লা মূলত আরবের আঞ্চলিক ঈশ্বর। তার নবীরাও তাই ওই একই এলাকার বাসিন্দা…

আরজে জিগান- মেরু অঞ্চল; যেইখানে দিন আর রাইতের হিসাব আমাগো মতো না; সেইখানে মুসলমানগো পাঁচ বেলা নামাজের হিসাব তো প্রয়োগযোগ্য না…

এরও উত্তর সোজা- নামাজের বিধান তৈরির সময় মেরু অঞ্চল সম্পর্কে ধারণা আছিল না আরবি আল্লার…

তয় কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞান আর কুবিদ্যার ফারাক করতে পারেন নাই আরজ আলী মাতুব্বর। পৃথিবীতে ভিনগ্রহবাসীগো আগমন বিষয়ক এরিক ফন দানিকেনের ভুয়া থিউরিরেও মাঝে মাঝে আরজ আলী বৈজ্ঞানিক যুক্তি হিসাবে দাঁড় করায়া দিছেন। কিছু ক্ষেত্রে তার কিছু তথ্যের সূত্রপুস্তকের বস্তুনিষ্ঠা প্রশ্নবোধক। আরজ আলীর জীবন বাস্তবতায় সঠিক তথ্যের ঘাটতিই মনে হয় আছিল এর বড়ো কারণ…

এই নোটে পাঠসূত্র হিসাবে ব্যবহার করা হইছে পাঠক সমাবেশ থাইকা প্রকাশিত ‘আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র ১’ এর ২০১২ সালের দ্বিতীয় মুদ্রণ। রচনাগুলার নতুন কোনো সংস্করণ ছাপা হইলে সম্পাদকের কিছু নোট যোগ করা জরুরি। কিছু কিছু তথ্যের যেমন আপডেট দরকার; তেমনি কিছু প্রাচীন গ্রামীণ উদাহরণের কিছু ব্যাখ্যাও দরকার নতুন পাঠকদের লাইগা। কারণ বাপ মরার পর আরজের জমিজমা কেমনে লাটে উঠল; বর্তমানে হয়তো অনেকের পক্ষেই সেইটা আর ব্যাখ্যা ছাড়া বুইঝা উঠা সম্ভব না…

 

আল্লার প্রশাসন ভজঘট

আরজ আলী মাতুব্বর যখন সত্যের সন্ধানে বইখান লিখেন তখন দুনিয়াতে আছিল তিনশ’ কোটি মানুষ; কালে কালে সেইটা বাইড়া কয়দিন আগে আটশ’ কোটি ছাড়ায়া গেছে। এতে অবশ্য আরজ আলীর কোনো সমস্যা না কারণ মুমিনগো খাওয়ানোর কথা আল্লায় আর বেমুমিনরা প্রযুক্তি ফযুক্তি দিয়া নিজেরাই খাদ্যের জোগান বাড়ায়া নেয়। আরজ আলীর মাথা ঘোরে শয়তান আর ফেরেশতাগো জনসংখ্যার হিসাব মিলাইতে গিয়া…

যত জন্ম তত মৃত্যু; কহিছে কোরান। আবার যত মানবজন্ম তত জোড়া কান্ধে চড়া কেরানি ফিরিশতা; তাহাও বলিছে বিধান। আবার যত মৃত্যু তত জোড়া গদায়ন ফিরিশতা; তাহাও বলিত আছে…

আবার বিধানমোতাবেক ফিরিশতারা মরেনও না; রিটায়ারও করেন না; এক ফেরেশতার দুই কাম করার বিধানও নাই। মানুষ মইরা গেলেও প্রতিটা মানুষের কান্ধের দুই কেরানি ফেরেশতা ফাইলপত্র গুটায়া সেইগুলা জমা দিবার লাইগা কিয়ামত পর্যন্ত বইসা ঝিমাবেন। কারণ কিয়ামতের আগে তাগো ফাইল জমা দিবার লাইগা কোনো দপ্তর রাখেন নাই আল্লায়…

মানে মইরা যাওয়া সকল মানুষের এক জোড়া কইরা ফিরিশতা এখন ফাইল হাতে নিয়া খাড়ায়া আছেন। আবার প্রতিটা মানুষ মইরা যাবার পরে কবরের ভিতরে রিমান্ড ও প্যাদানির লাইগা নির্ধারিত দুইখান ফেরেশতা; তাগো দায়িত্বও খালি একজনের ইন্টারভিউ ও প্যাদানি; সেই কাম শেষ হইলে তিনাদেরও হাতে প্রশ্নপত্র আর কান্ধে গদা নিয়া ঝিমানো ছাড়া কোনো কাম নাই…

মানে দুনিয়াতে জন্মানো প্রতিটা মানুষের লাইগা আছে এক হালি ফেরেশতা। তাগো মোট সংখ্যা কত? আর থাকে কই? হিসাব মিলে না। না মিলুক। হিসাবের চাইতে বড়ো সমস্যায় মাথা ঘোরে আরজ আলীর- ফিরিশতারা জন্মায় কেমনে?

আল্লায় তো সৃষ্টিফিস্টি থাইকা সেই কবে রিটায়ার নিছেন। এখন প্রতিটা মানুষ জন্মের লগে লগে এক হালি ফিরিশতা কেমনে জন্মায়? ফিরিশতারা তো আবার বন্ধ্যা প্রাণী; নিজের বংশ নিজে বাড়াইতে পারে না। শয়তানও তাই। তাইলে অত ফেরেশতা আর শয়তান জন্মায় কেমনে? ঝামেলা…

আল্লায় নাকি ইচ্ছা করলেই সব করতে পারেন তো আল্লার সরকারে অত আমলা-কর্মচারী ক্যান?

আল্লায় মুখের কথায় দুনিয়ার সব কিছু তৈরি কইরা ফেলতে পারেন কিন্তু ধ্বংস করার লাইগা তিনি আবার আরেক ব্যাটারে বাঁশি হাতে খাড়া করায়া রাখছেন সেই কবে থাইকা…

আল্লায় নাকি আজরাইল ফিরিশতা দিয়াই সব মানুষের জান কবজ করেন। তো আরজে জিগান- তাইলে নুহ নবীর সময় দাগি মানুষগুলার জান নিতে আজরাইলরে না পাঠায়া আল্লায় ক্যান ৪০ দিন ধইরা দুনিয়ারে পানিতে চুবাইলেন?

আবার বৃষ্টি ঝরানোর লাইগা এক ফেরেশতারে দায়িত্ব দিয়া রাখলেও সেই বেটা সেরা নবীর জন্মস্থান আরবে ফসলের চারা গজানোর মতো বৃষ্টিও সাপ্লাই না দিয়া সব বৃষ্টি আইনা ঝরায় বেমুমিন এলাকা চেরাপুঞ্জির পাহাড়ে। অন্যদিকে বিবিধ পৌত্তলিকগো তীর্থস্থান কাশীতে ঝড়বন্যা না পাঠায়া আল্লার আবহাওয়া দপ্তরের প্রধান এই মিকাইল ফিরিশতা প্রতি বচ্ছর ঝড়বন্যা দিয়া হুতায়া ফালায় চিটাগাং; অথচ চাঁটগাইয়ারা উঠতে বইতে কতই না আল্লাবিল্লা করে…

ফিরিশতারা তো আবার নিজের ইচ্ছায় কিছু করতে পারে না; খালি আল্লার হুকুম তামিল করাই তাগো কাম। ফিরিশতারা কি তয় আল্লার হুকুম বুঝে না? নাকি আল্লা নিজেই বেসামাল? জিগান আরজ…

আল্লা বিষয়ে অতি প্রাচীন প্রশ্নটাও চক্কর দেয় আরজের মাথায়- আল্লার ইচ্ছা ছাড়াই যদি কিছু না ঘইটা থাকে তয় পাপও নিশ্চয় ঘটে আল্লার ইচ্ছায়; তাইলে সেইক্ষেত্রে পাপের দায় মানুষেরে দেয়া হয় ক্যান? সেই পাপের লাইগা আবার নাকি বিচার হইব মানুষের। সেইখানেও ঝামেলা। আল্লায় নাকি একই লগে ন্যায়বান আর দয়ালু…

আরজে কন- বিচারের ক্ষেত্রে একই লগে ন্যায় আর দয়ার সমাবেশ তো অসম্ভব। কারণ দয়া দেখাইলে ন্যায় সরায়া রাখতে হবে আর ন্যায় করলে দয়ামায়া বাদ…

আল্লার কথিত মৌলিক ক্ষমতা নিয়াও প্রশ্ন উঠান আরজ। তিনি কন- আল্লায় নাকি সব কিছুর প্রাণ তৈরি করেন। তো একটা গাছের ডাল কলম দিয়া যখন দশখান গাছ তৈরি করা হয়; তখন সেই নতুন দশখান স্বতন্ত্র গাছে প্রাণ কেমনে আসে? আল্লা থাইকা নাকি আগের গাছ থাইকা?

 

স্বর্গের সাকিন

মহাভারতের আখ্যান টাইনা আরজে কন- যুধিষ্ঠির কিন্তু হাইটাই স্বর্গে গেছিলেন। রামায়ণের আখ্যান টাইনা কন- রাবণ রাজায় তো স্বর্গে গিয়া দেবতাগো পিটানিও দিছে…

যুধিষ্ঠিরের স্বর্গযাত্রার গতিপথ হিসাব কইরা আরজে কন- সেই স্বর্গটা আছিল হিমালয় পর্বতমালার একাংশে; হেডম থাকলে রাবণের মতো যেইখানে গায়ের জোরেই যাওয়া সম্ভব আছিল…

আরজে কন- যুধিষ্ঠির যেই স্বর্গে গেছিল সেইখানে এখন আর হয়তো কোনো লোকবসতি নাই। থাকলে বর্তমানের পর্বতারোহীগো সামনে পড়ত সেইসব স্বর্গবাসী দেবতারা…

আরজের হিসাবে তৌরাতের ইডেন উদ্যানই হইল মুসলমানগো বেহেস্ত। ভৌগলিক হিসাবে যেই স্থানটা বর্তমানে পড়ছে আর্মেনিয়া অঞ্চলে…

তৌরাত বাইবেল কুরান; তিন কিতাবের বংশলতিকা হিসাবে নবী আদমের জন্ম খিপূ ৪০০৪ সালের দিকে। মানে মিশরের কৃষিজীবী মানুষেরা বছর গণনা শুরু কইরা দেওয়ার প্রায় আড়াইশ বছর পরে জন্মাইছেন নবী আদম। সুতরাং কোনোভাবেই তার দুনিয়ার পয়লা মানব হইবার যুক্তি নাই…

আরজ কন- আদম মূলত আছিলেন আর্মেনিয়া অঞ্চলের কোনো গোষ্ঠীর খেদায়া দেয়া মানুষ। যিনি পরে ঘুরতে ঘুরতে আইসা হাজির হইছিলেন আরবে…

তৌরাতের বিবরণ মতে আদমের বাসস্থানটা একটা উদ্যান। আরজে কন- ঈশ্বরের সৃষ্টিরে বাগান কয় না; কয় বন বা জঙ্গল। বাগান হইল মানুষের হাতে তৈরি করা পরিকল্পিত গাছের সমাহার। যেইখানে থাকতেন আদম…

বিবরণ মতে স্বর্গে কোনো কাম করতেন না আদম। সেই সূত্র ধইরা আরজে কন- এইটা এমন এক সময় আছিল যখন সমাজের সকলের কিছু না কিছু কামকাজ না করলে জীবন চলত না; সেই সময়ে কোনো কামকাজ না কইরা ঘুইরা বেড়ানোর দায়ে মূলত বেহেস্ত বা ইডেনের সর্দার আদমরে খেদায়া দেয়; যেইটারে পরে স্বর্গ থাইকা আদম বিতাড়ন নামে কাহিনী বানাইছেন কবিগণ…

তৌরাত বাইবেল কোরানের বিবরণে নবীগণের সংখ্যা হিসাব কইরা আরজে কন- আদম হইতে ঈসা নবী পর্যন্ত চাই হাজার বছর আল্লায় নবী পাঠাইছেন প্রতি বছর গড়ে ৩১ জন। মানে প্রতি দুই সপ্তার কম সময়ে পয়দা হইছেন একেকজন নবী। কিন্তু ঈসার পরে নবীগো জন্মহার কইমা ৫৭০ বছরে আসছেন মাত্র একজন নবী; আর তারপরে একেবারে বন্ধ…

আরজে জিগান- দুনিয়াতে পাপ বেশি হইলে নাকি আল্লায় নবী পাঠাইতেন। সেই হিসাবে নবী পাঠানো বন্ধ দেইখা তো মনে লয় দুনিয়াতে পাপ কইমা গেছে গা। অথবা নবী পাঠাইতে পাঠাইতে আল্লায় ফেডাপ হইয়া গেছেন…

হইতেই পারেন। কারণ আল্লার হিসাব বহুত বেসামাল। এক নবীর লগে খোশ গল্প করার লাইগা তিনি ডেলি আইসা বইসা থাকেন পর্বতের মাথায়; তো তিনারে লগে দেখা করার লাইগা আরেক নবীরে ঘোড়ামানবী চইড়া যাইতে হয় আসমানে…

আল্লায় তো সরাসরি নবীগো লগে কথা কইতে পারেন; তাইলে আবার মাঝখান জিব্রাইল ফিরিশতারে দিয়া নবীগো কাছে বাণী পাঠানোর কী কাম? আর হঠাৎ কইরা মুসার লগেই বা ডাইরেক্ট কথা বলা লাগল ক্যান?

আর যদি কথা বলতেই হয় তো মুসারে দিয়া পাহাড় না ভাঙায়া তলায় বইসাই তো দিতে পারতেন দশখান বাণী। আল্লা তো সবখানেই থাকেন। তো বেহুদা ঘোড়া না দাবড়ায়া নিজের ঘরেই তো আল্লার লগে দেখা করতে পারতেন মোহাম্মদ। আল্লা তো ওই সময় মোহাম্মদের ঘরের ভিতরেই ছিলেন…

আল্লা নাকি নিরাকার। তাইলে নিরাকাররে কেমনে দেখলেন মুসা-মোহাম্মদ? তা না হয় দেখলেন। কিন্তু আল্লার মতো প্রাণও নাকি নিরাকার। তো এক নিরাকারের লগে আরেক নিরাকারের ফারাক কী? এক নিরাকাররে আরেক নিরাকার থাইকা কেমনে আলাদা করে? জিগান আরজ…

সিংহাসনে বইসাই নাকি আল্লার ইচ্ছায় নবী সুলেমান উইড়া বেড়াইতে পারতেন। এই ঘটনা মনে করায়া আরজে কন- রামায়ণে রাবণের পুতেরে তো আর আল্লায় দয়া করেন নাই। কিন্তু তারেও তো কবিরা আসমানে উড়াইছেন। কবিরা মেঘনাদের বাতাসে উড়াইতে পারলে সুলেমানরে পারবে না ক্যান?

 

আল্লার আউলা গণিত

মরা মাইনসের জমির উত্তরাধিকার ভাগাভাগির বিষয়ে আল্লার একটা হিসাবের ভেজাল চতুর্থ খলিফা হযরত আলী সংশোধন কইরা দিছেন। যেইটা উত্তরাধিকার হিসাবের ক্ষেত্রে সকল মুসলমানেরা মাইনা চলেন। পেশাদার আমিন আরজ আলী জিগান- আল্লায় না কইছেন তার কথা না হুনলে নরক। তো এইখানে আলী তার গণিতের উপরে পণ্ডিতি করলেন আর আল্লার বিধান না মাইনা আলীর বিধান মানতেছে মুমিনগণ; এখন কী হবে?

ধরেন এক লোক দুই মাইয়া; এক বৌ আর মা-বাবা রাইখা মরছে; লগে রাইখা গেছে ২৪ শতাংশ জমি। তাইলে কোরানের বিধানমতে দুই মাইয়া পাবে তার জমির তিনভাগের দুইভাগ; মানে ১৬ শতাংশ। জনপ্রতি ছয় ভাগের একভাগ হিসাবে বাপ-মা দুইজনে পাবে মোট ৮ শতাংশ। আর আট ভাগের একভাগ হিসাবে বৌ পাবে তিন শতাংশ জমি…

কিন্তু এইবার সকলের পাওনা একলগে যোগ করলে পাওনার পরিমাণ খাড়ায় ২৭ শতাংশ…

তো এই ঝামেলা মিটাইতে আলী আল্লার গণিতজ্ঞানের উপরে একখান মুসদ্দরি করেন। আলীর বিধানমতে পয়লা আল্লার গণিতের ভগ্নাংশগুলা যোগ কইরা দেখতে হবে মোট পাওনা ইউনিটের পরিমাণ কত; মানে গণিতের ভাষায় যারে কয় যোগফলের লব; এই উদাহরণের ক্ষেত্রে মোট পাওনা ইউনিটের পরিমাণ ২৭ শতাংশ জমি…

দ্বিতীয় ধাপে গণিত উল্টায়া লব দিয়া হর ভাগ কইরা ইউনিট ভ্যালু বাইর করতে হবে। মানে এই ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ জমিরে ২৭ দিয়া ভাগ করতে হবে। এতে প্রতিটা ইউনিটে জমির পরিমাণ হবে শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশের কাছাকাছি…

তৃতীয় ধাপে আল্লার বণ্টনবিধির লগে জমির ইউনিট ভ্যালু গুণ কইরা বাইর করতে হবে প্রত্যেকের পাওনা। এই হিসাবে বাপ-মায়ে মোট পাবে সাত শতাংশ থাইকা কিছু বেশি; দুই মাইয়া মোট পাবে সোয়া ১৪ শতাংশের মতো জমি আর বিধবা পাবে আড়াই শতাংশ থাইকা কিছু বেশি। সকলেই পাবে তয় প্রত্যেকেরই পাওনা হবে আল্লার বিধানমতে প্রাপ্য থাইকা কিছু কম। তয় মরা বেটারে অন্তত কবর থাইকা আইসা বাড়তি জমি ম্যানেজ করা লাগবে না…

হিসাবের উদাহরণ দিয়া আরজে জিগান- আল্লার গণিতবুদ্ধি কি তয় আলী থাইকা কম আছিল? কোরানের গণিতে ভুল ক্যান?

 

সীতার অগ্নিপরীক্ষা আগুনে না; হইছে গঞ্জনায়

“সীতাদেবী বন্ধ্যা ছিলেন না” কহেন আরজ। আরজের হিসাবে বন্ধ্যা আছিলেন রাম। অশোক বনে সীতার সতীত্ব রক্ষার কোনো উপায় না পাইয়া কবিরা রাবণের উপরে নারী ছুঁইলে অভিশাপের কাহিনী জুইড়া দিছেন বইলা মনে করেন আরজ…

বনে যাবার আগে রামের লগে সীতা সংসার করছেন ১২ বছর; বনে ১৪ বছর। কিন্তু তিনি গর্ভবতী হন নাই। সীতা গর্ভধারণ করছেন রাবণের বাড়ি দশ মাস থাইকা ফিরার পর…

ব্রিটেনের রাজা অষ্টম অ্যাডওয়ার্ডের উদাহরণ দিয়া আরজে কন- এই সাধারণ রাজা নিজের বৌয়ের লাইগা সিংহাসন ছাইড়া দিলো (১৯৩৬) আর রাম জনগণের মন রাখার লাইগা বৌ খেদায়া দিলেন?

রামায়ণ মতে রাম নাকি সীতারে ‘নিষ্কলঙ্কা’ বইলা জানতেন। তো আরজে জিগান- “রাজেশ্বর রামচন্দ্র বৈবাহিক জীবনের দীর্ঘ ২৬ বছর পর আসন্ন সন্তান পরিত্যাগ করলেন শুধু কি প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য? নিশ্চয়ই তা নয়। তিনি জানতেন যে, সীতার গর্ভস্থ সন্তান তার ঔরসজাত নয়, ঔরসজাত রাবণের।”

এই কারণেই সীতার গর্ভজাত সন্তানের প্রতি রামের মায়ামমতার বদলা “ঘৃণা ও অবজ্ঞা” আছিল বইলা মনে করেন আরজ। আর এই কারণেই রাম বহু বছর সীতার পোলাগো কোনো খোঁজ নেন নাই; অথচ সীতা যেইখানে থাকতেন; ঋষি বাল্মিকীর সেই আশ্রম অযোধ্যার কাছেই আছিল। সেই আশ্রম রামেও চিনতেন…

আরজের হিসাবে; সীতার অগ্নিপরীক্ষাটা মূলত লঙ্কা থাইকা ফিরার পরে তার চরিত্র নিয়া তার উপর যে নির্যাতন সেইটারই কাব্যিক বিবরণ। এইটা আগুনে পোড়ায়া পরীক্ষা না…

অযোধ্যায় “হয়তো সীতার স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য প্রথমত জেরা-জবানবন্দি, কটূক্তি, ধমকানি-শাসানি ও পরে মারপিট ইত্যাদি শারীরিক নির্যাতন চালানো হচ্ছিল তাঁর প্রতি। কিন্তু তিনি নীরবে সহ্য করছিলেন সেসব নির্যাতন, ফাঁস করেননি কভু আসল কথা। আর সেটাই হচ্ছে সীতার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া,” কহেন আরজ…

শেষকালে কুশ-লবরে গ্রহণ করলেও রাম সীতারে গ্রহণ করেন নাই; এই ঘটনা মনে করায়া আরজে কন- “সীতাদেবী হয়তো আশা করেছিলেন যে, বহু বছরান্তে পুত্ররত্নসহ রাজপুরীতে এসে তিনি আবার সমাদর পাবেন। কিন্তু তা তিনি পাননি, বিকল্পে পেয়েছিলেন যত অনাদর-অবজ্ঞা।”

রাগে দুঃখে সীতা আত্মহত্যা করার পরে সেইটা লুকাইতে সীতার মরদেহ মাটিতে পুঁইতা ফেলা হয় বইলা আরজের অনুমান। আর সেইটারেই কবিরা সীতার ‘ভূগর্ভে প্রবেশ’ বইলা প্রচার দিছেন…

সীতার মরদেহের কবর হওয়ার ঘটনাগুলা আরজ ছাড়া অন্য সূত্রেও মিলে। সীতা আছিলেন রত্নাকর বাল্মিকী বা রত্নাকর ভালিওর আশ্রমে। ইনি ভিল জাতির মানুষ; ইনিই সীতার শেষকৃত্য করেন…

ভিল জাতির নিয়মে পুরুষদের মরদেহ পোড়ানো হইত আর নারীরা পাইত কবর। আবার কিছু রামায়ণের সূত্র মতে সীতা নিজেও আছিলেন ভিল জাতির নারী। দুই হিসাবেই মরার পরে সীতার কবর হওয়াটা যৌক্তিক; যেইটা কাব্যিক ভাষায় ‘ভূগর্ভে প্রবেশ’…

আরজ আলী মাতুব্বরের হিসাবে রামায়ণের রাবণ আছিল খুব উচ্চ রুচির উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। তিনি কন ‘আর্যপ্রীতি আর অনার্যবিদ্বেষ’ থাইকা কবিরা রামরে প্রদীপ্ত আর রাবণরে হীন করার চেষ্টা করলেও কবিগণের কলমের চিপা দিয়া প্রকাশ পায় রাবণের কৌলীন্য; শৌর্য আর জ্ঞানের বিবরণ; যেইগুলার ঔজ্জ্বল্য “রামচরিত্রের উজ্জ্বলতার চেয়ে বহুগুণ বেশি”…

রাবণে সীতারে যেইখানে রাখছিল তার নাম অশোক কানন। যেইখানে গেলে কারো কোনো দুঃখ থাকে না। সেই বাগানের গাছপালা ফুল-ফলের বিবরণ স্মরণ কইরা আরজে কন- এই বাগানটা কিন্তু রাবণের সুরুচির পরিচয়। এক জায়গায় শতজাতের ফুলফল লতাগুল্ম বৃক্ষরাজির সমাবেশ ঘটায়া তার যত্ন করা সোজা কথা না…

এর পরেই তিনি কন; রামের বাড়িতে কোনো ফুল-ফলের গাছ আছিল কি না তার কিন্তু কোনো বিবরণ নাই…

মরো মরো রাবণের কাছে গিয়া রাম রাজনীতি শিখার আব্দার করছেন। মরণ শয্যায় শুইয়াও রাবণে রামেরে রাজনীতির শিক্ষা দিছে; এই একটা ঘটনাই রাবণের জ্ঞান সম্পর্কে ধারণার লাইগা যথেষ্ট; কহেন আরজ…

 

আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র-১, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১২, প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ISBN: 984-8120-04-1

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!