পুত্র কেন অপরাধী?

Share this:

পুত্র কেন অপরাধী?

 

‘পবিত্র আত্মার ফল হলো ভালোবাসা, আনন্দ, শান্তি, সহ্যগুণ, দয়ার স্বভাব, ভালো স্বভাব, বিশ্বস্ততা, নম্রতা ও নিজেকে দমন। এইসবের বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই।’ (গালাতীয় ৫.২২.২৩)

বাইবেলের এই অংশটি পাঠ করে তপন কুমার বর্মণ তাঁর সকাল শুরু করেছিলেন।

কিন্তু তিনি জানতেন না কিছুক্ষণের মধ্যেই সকালের সেই অমলিন পবিত্রতা ভরে উঠবে অপ্রত্যাশিত ভয়, তিক্ততা আর বিরক্তিতে। কোনোকিছু নিয়েই সহজে ভয় পাওয়ার পাত্র নন তিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে খানিকটা ভয় লাগছে তাঁর। ভয়ের সঙ্গে মিশেছে দুশ্চিন্তা। মনে হচ্ছে মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। সময়টা ভালো নয়, জানেন তিনি, কারণ চারিদিকে এমন সব ঘটনা ঘটছে যা তাঁর এত বছরের জীবনে আগে কখনও ঘটতে দেখেননি। তার দুশ্চিন্তার কারণ একটি চিঠি। চিঠিটি কিছুক্ষণ আগে ডাকপিয়ন দিয়ে গেছে। তপন কুমার চিঠিটা হাতে নিয়ে প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলেন, তাকে ব্যক্তিগত চিঠি লেখার মতো তেমন কেউ নেই আজকাল। অথচ খামের উপর বাংলায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে তারই নাম-ঠিকানা লেখা আছে।

রেভারেন্ট তপন কুমার বর্মণ    

চার্চ অব গড মিশন হাউস।

ঈশ্বরের মন্ডলী  উপাসনালয়

স্টেশন রোড, লালমনিরহাট।

চিন্তিত মুখে খামটা খুলে এর ভেতরে ভাঁজ করা কাগজটা মেলে ধরলেন তিনি। সাদা কাগজে অপরিচ্ছন্ন হাতের লেখা। তপন কুমার বাঁ হাত দিয়ে নাকের উপর বসে থাকা চশমাটা ঠিক করে চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন, পড়তে গিয়ে তার চেহারায় পরিবর্তন ঘটল, কপাল কুঞ্চিত হলো, মনে হলো রেগে গেছেন, সবশেষে একটা উদ্বেগের ছাপ ছড়িয়ে পড়ল মুখমন্ডলে। চিঠিটা কুৎসিত আর কুরুচিপূর্ণ ভাষায় লেখা।

ফাদারগণ, যাজকগণ (তপন বর্মণ) 

তোমার যা খেতে মন চায় তৃপ্তি করে ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে খেয়ে নাও। আর স্ত্রীর কাছে বিদায়টুকু নিতে ভুলিও না।

সিরিয়ার আইএসের কমান্ডার তোমার মস্তক চেয়ে আমাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। শীঘ্রই তোমার মস্তক সিরিয়ায় উপহারস্বরূপ পাঠানো হবে। আর যারা লালমনিরহাট জেলার খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার করে তাদের গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যথাশীঘ্রই তাদের হত্যা করা হবে। কান্তজির মন্দিরে আমরা বোমা ফাটিয়েছি। ক্ষমতা আছে কি না সময়ে বুঝিয়ে দেবো। পেপার পত্রিকায় যত লেখালেখি করেন না কেন, প্রশাসন আমাদের একটি বালও ছিঁড়তে পারবে না।

কমান্ডার আই এস,

বাংলাদেশ শাখা,  দিনাজপুর।

 

কোনো সন্দেহ নেই, চিঠির প্রেরকের উদ্দেশ্য ভীতি তৈরি করা। আর সম্প্রতিক সময়ে ভীতি উৎপাদন অনেক সহজ। চিঠিটা টেবিলে রেখে তিনমাস আগে ঈশ্বরদীর প্যাস্টর লুক সরকারের উপর ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে পড়ে তপনকুমার বর্মণের। পাবনার ঈশ্বরদী থেকে লালমনিরহাটের দূরত্ব কতটুকু? লুক সরকারের মতো তিনিও কি তবে আক্রান্ত হবেন, নিজের জন্মভূমি, এই প্রিয় স্বাধীন বাংলাদেশে?

ঈশ্বরদীর ব্যাপ্টিষ্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’ এর পাদ্রী লুক সরকার সরল, সহজ, গোবেচারা টাইপের ভালো মানুষ। চার্চের কাজের পাশাপাশি হোমিওপ্যাথিরও চর্চা করেন তিনি। এলাকার গরিবগুর্বো মানুষগুলোকে নামমাত্র মূল্যে ওষুধ দেন, অন্তত বিনা চিকিৎসায় মরার চেয়ে ফাদারের দেওয়া দু’ফোটা ওষুধ যে তাদের মুখে পড়েছে এই সান্ত্বনা নিয়েই হয়তো সন্তুষ্ট থাকে দরিদ্র মানুষগুলো।

প্রতি সকালেই পবিত্র বাইবেল পাঠ করে দিন শুরু করেন লুক সরকার। তারপর চার্চে যান। বিকেলের দিকে গ্রাম-গ্রামান্তরের রোগীরা আসে, তিনি অসুখের বিবরণ শুনে ওষুধ দেন। ওদের সাথে গল্প-গুজব করেন। এর মধ্যে হয়তো কোনোদিন ছেলে ফ্রান্সিস ঢাকা থেকে ফোন করে, কোনোদিন সাতক্ষীরা থেকে ভাইপো ফোন করে খোঁজখবর নেয়। মোবাইল যন্ত্রটা এদিক দিয়ে ভালোই, দূরের মানুষকে কেমন কাছে এনে দিচ্ছে! এর মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। গলাটা ঠিক চিনতে পারেন না লুক সরকার।

‘কে?’

‘আমরা কয়েকজন আপনার কাছে খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে জানতে চাই।’ অচেনা কন্ঠটি বলে।

ধর্ম আলোচনা করতে লুক সরকারের আপত্তি তো নেই-ই বরং মনে মনে তিনি খুশিই হন। আমার ধর্মবিশ্বাস আরেকজন যদি নিজে থেকে জানতে চায়, শুনতে চায়, তবে আমি কেন বলব না, ভাবেন তিনি। গম্ভীর গলায় টেলিফোনকারীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তা, আপনাগের বাড়ি কোথায়?’

‘সুজা নগর। পাবনা।’ ছেলেটা বলে।

লুক সরকার বলেন, ‘ধর্মকথা শুনতে চাইলে একবার সময় করে আপনারা আসতে পারেন,  আমার বলতে তো আর দোষ নেই, বলব, আপনারা শুনতে চাইলে শুনবেন, মোবাইলে তো হবে না, সামনে বসে কথা বলি, আসেন একদিন…’

‘আচ্ছা, আপনি কি খ্রিস্টান বানান না?’ অপর প্রান্ত থেকে জানতে চায় ছেলেটি। লুক সরকার হাসেন,

‘না ভাই, খ্রিস্টান বানানের কোনো মেশিন আমার কাছে নাই। আমরা শুধু প্রচার করতে পারি, ধর্মের গুণগান গাই। এইটুকুই আমাগের কাজ।’

তো ছেলেগুলো আসলো দিনকতেক আগে, বলল, ‘আমরাই ফোন করেছিলাম। আপনাদের আল্লা-ঈশ্বর সম্বন্ধে বলেন।’

লুক সরকার দেখলেন ছেলেগুলোকে। ভালো পোশাক-আশাক পরা, চেহারা-ছবিও ভালো। তিনি বাইবেল বের করলেন, ‘এটা আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। মুসলমানদের যেমন কোরআন, হিন্দুদের যেমন গীতা, তেমনি আমাদের বাইবেল ‘

এরপর বাইবেল থেকে পাঠ করে শোনালেন তিনি ‘কারণ ঈশ্বর এই জগতকে এতই ভালোবাসেন যে তিনি তার একমাত্র পুত্রকে দিলেন, যেন সেই পুত্রের ওপর যে কেউ বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয় বরং অনন্ত জীবন লাভ করে।’

‘আপনাদের এই ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত, ঈশ্বরের আবার পুত্র হয় কীভাবে? আল্লাহর কোনো পুত্র-কন্যা নাই।’

একটা ছেলে বলে। লুক সরকার তখন বিষয়টা নিয়ে তর্ক না করে আবারও বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে খ্রিস্টীয় বিশ্বাস বোঝানোর চেষ্টা করেন। বলেন, ‘যিশু বলেছেন, আমিই পথ, আমিই সত্য ও জীবন। পিতার কাছে যাবার আমিই একমাত্র পথ।’

‘আপনেদের পিতা পুত্রের বিষয়টি বেদাত। ঈসা আলাইহিস সালাম এর সময় এমন কিছু বলা হয়নি।’

‘দেখো বাবারা, তোমরা জানতি চেয়েছো, তাই বলছি, আসলে আমার ধর্ম আমার, তোমারটা তোমার!’

ভেতর থেকে লুক সরকারের স্ত্রী পদ্মা সরকার একটা ট্রেতে করে অতিথিদের জন্য চা বিস্কুট নিয়ে আসলে ছেলেগুলো আর তর্ক না করে সেসব খেয়ে বিদায় নেয়।

কয়েকদিন পর আবার এক সকালে লুক সরকার তখন সবে প্রার্থনা শেষ করেছেন। তখনও সকালের নাশতা খাননি, ছেলেগুলো আবার এসে হাজির।

‘এবার তো আর মোবাইল করেনি ওরা। কোনো খবর না দিয়েই আসছে। তা আসছে যখন তাড়িয়ে তো আর দেয়া যাবে না। আমি এসে ওদের কাছে বসলাম। বসার পরে ওদের সঙ্গে আমি কথা বলছি ‘ লুক সরকার পরে পুলিশকে বলেছিলেন।

‘হাতে বাইবেল নিয়ে কথা বলছিলাম, তখন তারা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে যে আমাকে উঠাতে, বলছে, আরেকটা বই বের করেন। আমি বলি যে, না, এই বই দিয়েই হবে এই বাইবেলেই যথেষ্ট। আর লাগবে না, এটাই আমাদের বিশ্বাস। এটার মাধ্যমেই আমরা ঈশ্বর বিশ্বাস করি, আল্লাহকে বিশ্বাস করি, এভাবে বলতে না বলতেই হঠাৎ অতর্কিতভাবে ওদের মধ্যে স্বাস্থ্যবান যে ছেলেটা সে আমার মুখ চাইপে ধরল, যখন মুখ চাইপে ধরে তখন আমি চিন্তা করছি, এর বোধহয়, মৃগী রোগ-টোগ বা কিছু একটা আছে, এত সুন্দর চেহারা এত সুন্দর কথা বলছে, তাদের ভেতর কোনো খারাপ চিন্তা আছে বলে তো আমি বুঝতে পারছি না।’

ততক্ষণে আরেকটা ছেলে ত্বরিতে উঠে এসে লুক সরকারের হাত দুটি ধরে ফেলেছে, আর একজন জামার ভেতর থেকে বের করে এনেছে ধারালো ছুরি আর সেটা বসিয়ে দিয়েছে লুক সরকারের গলায়। মুখ চাপা দিয়ে ধরায় জোরে চিৎকারও করতে পারছেন না তিনি। বুঝতে পারছেন গলায় কেটে বসছে ছুরির ধার। এদিকে ভেতরের ঘর থেকে ধস্তাধস্তির বিষয়টা অনুমান করতে পেরে বাইরের দরজায় জোরে ধাক্কা দিচ্ছেন পদ্মা সরকার। ছেলেগুলি এতে একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল, কোন দিক সামাল দেবে যেন ঠিক বুঝতে পারছে না। আর সেই ফাঁকে যে ছেলেটা মুখ চেপে ধরেছিল তার আঙুলে সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরে একটা কামড় বসালেন সন্ত্রস্ত ফাদার। ‘আহ্‘ করে ফাদারের মুখ ছেড়ে দিল ছেলেটা। ছুরির নিশানা গেল সরে। লুক সরকার চিৎকার করে উঠলেন, ‘বাঁচাও, বাঁচাও, কে আছো, মাইরে ফেলল আমারে…’

শেষমেষ দিশেহারা হয়ে দরজা খুলে মোটরসাইকেলে চড়ে পালালো ঘাতকেরা।

পদ্মার চিৎকারে প্রতিবেশীরা এলো। ফার্মেসি থেকে ডাক্তার আনা হলো। ডাক্তার সাহেব গলার আঘাত পরীক্ষা করে জানালেন, ‘ক্ষত খুব বেশি গভীর হয়নি’।

তাই হয়তো এ যাত্রা বেঁচে গেলেন লুক সরকার। ঘটনার পর পুলিশ এলো। সাংবাদিক এলো। আত্মীয়স্বজন এলো। সবার সামনে মুখস্ত পড়ার মতো বারবার ঘটনার বিবরণ দিল লুক সরকার। ‘ওরা ভালো মানুষের মতো আসলো, বইসলো, ধর্ম নিয়ে জানতে চাইল, তা আমি বাইবেল খুললাম…’

একসময় এই গল্প শেষ হলো। লুক সরকারের স্কুল রোডের সেমি পাকা ভাড়া বাড়িটা খালি করে সব মানুষ চলে গেল। বন্দুক কাঁধে ইউনিফর্ম পরা দুই জন পুলিশ শুধু অলস পাহারায় বসে রইল দরজার বাইরে।

পদ্মা এসে স্বামীকে বলল, ‘অনেক ধকল গেছে। এবার একটু বিশ্রাম নেও, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, বড় বাঁচা বেঁইচে গেছো…‘

স্ত্রীর কথায় হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন প্রৌঢ় ফাদার। গলার ক্ষততে যেখানে ডাক্তার সেলাই করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছে সেখানে হাত বুলালেন তিনি। তারপর বর্ষাকালের বৃষ্টির মতো হঠাৎ হুহু কান্নায় ভেঙে পড়লেন,

‘ওরা আমাকে মারতে চাইল কেন, বলো দিনি? কী অপরাধ করিছি আমি? কেন মারতে চাইল? আমার তো কোনো শত্রু ছিল না, ওরা কেন আমার শত্রু হইল?’

পদ্মা ছুটে এসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরল, ধরা গলায় সান্ত্বনা দেয়ার মতো করে বলল, ‘কুকুরের কাজ কুকুর কইরেছে, তোমার দোষটা কী? কানছো কেন তুমি এ্যাঁ? শুয়ে পড়ো তো, শুয়ে বিশ্রাম নেও।’

পরদিনই ছাত্রশিবিরের এক কর্মী ওবাইদুলকে ধরল পুলিশ। ঘটনার একমাসের মাথায় ধরা পড়ল আরও ৬জন আসামি। এদের মধ্যেই একজন রাকিবুল। পুলিশ জানালো, রাকিবুল জেএমবি বা জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ শাখার আঞ্চলিক কমান্ডার।

রাকিবুলের আঙুলে মানুষের কামড়ের দাগ ছিল। দাগটা প্রথমে ছিল কালচে লাল, তারপর ধীরে ধীরে কালো হয়ে ফুলে উঠেছিল ওটা। সেই সঙ্গে তীব্র ব্যথাও অনুভব করছিল রাকিবুল। মানুষের দাঁতেও নাকি সাপের বিষের চাইতে তীব্র বিষ থাকে। রাকিবুলের ভয় হলো, লুক সরকারের দাঁতের বিষ আঙুল বেয়ে আবার তার সারা শরীরে না ছড়িয়ে পড়ে। অপারেশন সাকসেসফুল না হওয়ায় এমনিতেই তার মন ভালো নেই। তাছাড়া ওই ঘটনার পর থেকে আত্মগোপনে চলে এসেছে সে। খুনের নির্দেশদাতা বড়ভাই ফোন করে তিরস্কার করেছেন প্রথম অপারেশনেই ব্যর্থ হওয়ার জন্য। নিজের ব্যর্থতায় নিজেই মরমে মরে যাচ্ছে সে। অথচ পরিকল্পনায় তো কোনো খুঁত ছিল না। বেশ কয়েকবার বৈঠক করে, সবদিক বিবেচনায় রেখে খুনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে তারা। কয়েক দফা রেকি করেছে। ইশ্ আরেকটু যদি সময় পাওয়া যেত। যদি ওই খ্রিস্টান কাফের লুক সরকার হঠাৎ ওইভাবে তার আঙুল কামড়ে না ধরত, তাহলে হয়তো ওই বিধর্মীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া তেমন কঠিন হতো না। রাকিবুল আবার তার আঙুলের দাগের দিকে তাকায়। মনে হচ্ছে দাগটা বড় হচ্ছে, আগে যা ছিল মানুষের একটা দাঁতের সমান, এখন সেটা প্রায় জিহ্বার সমান লম্বা হয়ে গেছে। রাকিবুলের হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে বুকটা হাহাকার করে ওঠে। ছোটবেলায় পড়ে গিয়ে যতবার ব্যথা পেয়েছে, যতবার হাঁটু বা কনুইয়ের চামড়া উঠে গেছে, মা ততবারই উঠেনের আনাচকানাচ থেকে সবুজ দূর্বাঘাস চিবিয়ে যত্ন করে রসটা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিয়েছেন। নানারকম বুনো লতাপাতা আর শেকড়বাকড়ের উপকারিতা জানা ছিল মায়ের। আহা কতদিন মাকে দেখে নাই রাকিবুল! কতদিন ঘর ছাড়া সে! কতদিন বড় ভাই, বাবা আর ছোট বোনটার সঙ্গে দেখা হয় না! কিন্তু না, এসব ভেবে মনকে দুর্বল করা যাবে না। সে আল্লাহর পথের পথিক। নিজেকে উৎসর্গ করার শপথ নিয়ে এই কঠিন দুর্গম জেহাদের পথে যুক্ত হয়েছে সে। পৃথিবী থেকে বিধর্মী কাফেরদের উৎখাত করার ব্রত নিয়েছে, এই পথে কোনো দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। শক্ত হতে হবে। রাকিবুল দ্রুত চোখের পানি মুছে নেয়। তারপর হাতের কামড়ের দাগটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। মনে হচ্ছে, দাগটা নিকষ কালো অন্ধকার হয়ে আরও বেশি ছড়িয়ে যাচ্ছে। আগের চাইতে ক্ষতটা আয়তনে আরও বেড়েছে। মা হয়তো মানুষের দাঁতের বিষ নামানোর ওষুধ দিতে পারতেন। হয়তো ক্ষতের উপর কোনো মলম লাগিয়ে দিতেন অথবা কোনো দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতেন আর তখনই রাকিবুল ভালো হয়ে যেত।

একা এই গোপন আস্তানায় এমন কেউ নেই যার সঙ্গে খোলা মনে একটু কথা বলা যায়, যাকে দেখানো যায় আঙুলের এই কামড়ের দাগ। মাকে একবার ফোন দেয়ার কথা ভাবে রাকিবুল। পরক্ষণেই চিন্তাটা বাতিল করে দেয় সে। পুলিশ পাগলা কুত্তার মতো তাকে খুঁজছে। এখন একটা ভুল পদক্ষেপ নিলেই সর্বনাশ। কারও সাথে যোগাযোগ করা ঠিক হবে না। কিন্তু, দুপুরের দিকে হঠাৎ শব্দ করে ফোন বেজে উঠলে চমকে উঠে রাকিবুল। তার এই নাম্বারটি শুধু মা জানে। মা’কে নিজের মাথার কসম দিয়ে বলে এসেছিল, যদি খুব খুব খুব খারাপ কিছু হয়, যদি খুব বড় বিপদ হয়, শুধু তাহলেই যেন ফোন করে, না হলে নয়। তাহলে কি সত্যিই ভয়ংকর খারাপ কিছু হয়েছে?

রাকিবের মায়ের নাম আজমিরা খাতুন। মাজিদপুর গ্রামে নিজেদের বাড়িতে কয়েক ঘন্টা ধরে পাথরের মতো মুখ করে টিনের বেড়ায় হেলান দিয়ে এক জায়গাতেই মূর্তির মতো বসে আছেন তিনি। গত কয়েকদিন ধরেই সকাল বিকাল রাত বাড়িতে পুলিশ আসা-যাওয়া করছে। তারা আজমিরা খাতুনের মেজ ছেলে রাকিবুলের খোঁজ জানতে চায়। কিন্তু কেমন করে রাকিবুলের খোঁজ দেবেন তারা? বছরখানেক হয়ে গেল, রাকিবুলের সঙ্গে বাড়ির কোনো যোগাযোগই তো নেই। হ্যাঁ বটে, মাজিদপুর হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেছিল সে। তারপরে তো আটঘরিয়া ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হলো এইচএসসি পড়বে বলে। সেসময়ই কেমন একটা পরিবর্তন এসেছিল ওর মধ্যে। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে দিল, মুখে লম্বা দাড়ি রাখল, দরকার ছাড়া কারও সাথে স্বাভাবিক কথা বলাই বন্ধ করে দিল  এবং দিন নেই, রাতে নেই মোবাইলে মুখ গুঁজে কাদের সাথে যেন গোপনে ফিসফিস করে কথাবার্তা বলা শুরু করল সে। তারপর হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল। সে কই গেল? কী করছে? কোথায় আছে কিচ্ছু জানি না আমরা।

‘কিচ্ছু জানেন না?’ নাছোড়বান্দা পুলিশেরা ছাড়ে না। জেরা করতেই থাকে।

‘শেষ কবে বাড়ি এসেছিল সে? কোথায় তাকে সবশেষে দেখা গেছে? ওর বন্ধু-বান্ধব কারা? কাদের সঙ্গে মেলা-মেশা করত? ওর কোনো মোবাইল নম্বর জানা আছে কি না?’

রাকিবের বাবা আবদুল মালেক আর বড় ভাই আমিনুল পুলিশের প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনে আর তার উত্তর দিতে দিতে নাজেহাল হয়ে গেল।

‘আপনারা কি জানেন, কত বড় অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়েছে রাকিবুল? জানেন, এটেম্প টু মার্ডারের চার্জ আছে ওর বিরুদ্ধে? ও রাষ্ট্রদ্রোহী, ও ভয়ংকর অপরাধী, জানেন এসব?’

‘না বাবা, আমরা তো কিছুই জানিনে। আপনেরা বাড়িতে না এলে তো বুঝতেই পারতাম না ও কী করছে, না করছে! ও তো হঠাৎ করেই কাউরে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, মাঝেমধ্যে ওর মায়ের সঙ্গে নাকি মোবাইলে কথা ক’তো এছাড়া তো…’

পুলিশ এবার চেপে ধরল আজমিরা খাতুনকে। রাকিবুলের নাম্বার দিতেই হবে, নইলে পুরো ফ্যামিলি শুদ্ধা চলো হাজতে। কোনো ছাড়াছাড়ি নাই। আইনের চোখে তোমরা সবাই অপরাধী। কান টানলে মাথা আসবে। পরিবার ধরে টান দিলে অপরাধীও নিজেই এসে ধরা দেবে।

রাকিবের বাবা আবদুল মালেক ছাপোষা নিরীহ মানুষ। নিজের সামান্য পরিমাণ জমিতে গেরস্থী করে কোনোরকমে দিনাতিপাত করে। বড় ভাই আমিনুল ছোট একটা চাকরি করে ডিসি অফিসে। ছোট বোনটা সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে। পুলিশ এখন তাদের সবাইকে কোমরে দড়ি বেঁধে যদি জেলখানায় ঢোকায় তবে কী হবে ভাবতেও শিউরে উঠছে আবদুল মালেক। গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বাররাও পুলিশের হয়ে আবদুল মালেককে চাপাচাপি করছে রাকিবুলের খবর বলে দেয়ার জন্য। বলছে, রকিবুলকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়াতেই সবার জন্য মঙ্গল হবে।

‘যা জানো বলে দাও মিয়া!’

এতসব হট্টগোলের মধ্যে আজমিরা খাতুনের যেন জবান বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি ভাবছেন, ছেলেটা কেন এই ভুল করল? কেন সে মাকে মাঝেমধ্যে ফোন দিত? কেন সে বলছিল খুব বড় বিপদ হইলে মা যেন তারে এই নম্বরে ফোন দেয়। বিপদ তো এখন তার ছেলের, খুব বড় বিপদ। কারা তার সহজ সরল ছেলেটারে এমন বিপদের পথে টাইনে নিয়ে গেল? কেমন করে তার ছেলে জেনে-বুঝে আগুনে ঝাঁপ দিল? এই আগুন তো এখন সবাইকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে!

পুলিশের বড় কর্তারা বাড়িতে এসে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনেই বড় ছেলে আমিনুল মায়ের কাছ থেকে মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বাটন টিপলো, আজমিরা খাতুন স্পষ্ট শুনতে পেলেন, আমিনুল ফোনে বলছে, ‘বাড়ি আয় রাকিবুল, মায়ের খুব অসুখ। তোকে শেষ দেখা দেখতে চাচ্ছে। মা বোধ হয় আর বাঁচবে না রে।’

আজমিরা খাতুনের চেহারায় যেন সত্যিকারের মৃত্যু এসে বাসা বাঁধে। বুকের ভেতর ঝর ঝর করে ভেঙে পড়ে ইছামতি নদীর পাড়। মুখের মধ্যে মরুভূমির তৃষ্ণা নিয়ে তিনি আকুল হয়ে কাঁদেন, ‘হে দয়াময়, মায়ের হৃদয় ভেঙে পুত্র কেন অপরাধী হয়?’

 

প্রশ্নোত্তর

শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?

শাহ্‌নাজ মুন্নী:  আমি খুব ছোট বয়সে গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম। এই ফাইভ সিক্সে পড়ার সময় থেকেই। মায়ের ডানার নিচ থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি মুরগিছানার দুঃখের সঙ্গে মাতৃহারা একটি কিশোরের দুঃখকে মিলিয়ে লেখা হয়েছিল সেই গল্প। সেটি কোথাও প্রকাশিত হয়নি কেবল আমার গোপন লেখার খাতার পাতা জুড়েই রয়ে গিয়েছিল।

পাঠাভ্যাস হয়তো গল্প লেখার একটা তাড়না তৈরি করতে পারে কারণ সেই সত্তর আশি দশকে ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা নিস্তরঙ্গ জীবনে পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়াই ছিল সবচে বড় বিনোদন আর আনন্দ। কোনো বাছবিচার ছাড়াই হাতের কাছে যা পেতাম তাই পড়তাম। আমার মামা খালা মা বাবার পাঠের অভ্যাস ছিল। ছোটবেলায় নানাবাড়ি নেত্রকোণায় পাবলিক লাইব্রেরির সদস্য ছিলেন বড় মামা। যে ১০/১৫ দিন মামার বাড়ি থাকতাম সেই কদিন পাবলিক লাইব্রেরির কার্ডটি থাকত আমার দখলে। ইচ্ছামতো বই বাসায় আনতাম আর নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনরাত এক করে সেগুলো পড়তাম বা গিলতাম।

প্রথম গল্প কলেজ ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। ১৭/ ১৮ বছরের কাঁচা আবেগে লেখা সেই গল্পে প্রেম ছিল, দুঃখ বেদনা ছিল, মনে পড়ে।

সম্ভবত পড়ার অভিজ্ঞতা, ভাবার প্রবণতা, পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহ মিলেমিশে মনের মধ্যে সচেতন ও অবচেতনভাবে যে আলোড়ন তৈরি করেছিল তা থেকেই গল্প লেখার তাড়না জন্মেছিল। গল্পের জগৎ আমাকে তীব্র-তুমুল যন্ত্রণাদায়ক আনন্দের অনুভব দিয়েছে। সেই অনুভবও হয়তো একটা তাড়না।

শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?

শাহ্‌নাজ মুন্নী: ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা অভিজ্ঞতা অনেক সময় গল্পের ভিত্তি নির্মাণে সহায়তা করে। কিন্তু অভিজ্ঞতালব্ধ অভিজ্ঞান আত্মস্থ করে, তার সঙ্গে লেখকের কল্পনা ও প্রকাশভঙ্গির সম্মেলন ঘটিয়ে একটি লেখা ধীরে ধীরে গল্পের আকার পায়। এই বিক্রিয়া সচেতনভাবে যে ঘটে না তা বলাই বাহুল্য। অভিজ্ঞতা মাত্রই গল্প নয় আবার গল্পমাত্রই অভিজ্ঞতা নয়। গল্প কীভাবে যে আকার নেয় তা সুনিদিষ্টভাবে বা চূড়ান্তভাবে বলা সম্ভব না। আমার অনেক গল্পের বীজ আমার মা খালাদের কাছ থেকে শোনা কাহিনি থেকে পেয়েছি। বাস্তব ঘটনা থেকেও গল্পের উপাদান নিয়েছি। তবে সেগুলো হুবহু নয় বরং গল্প লিখতে গিয়ে শোনা ও দেখা ঘটনাগুলোর এক ধরনের পুনর্নির্মিতি ঘটেছে আমার হাতে।

শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার  প্রভাব  কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।

শাহ্‌নাজ মুন্নী: লেখক যেহেতু এই পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট দেশে বা সমাজে বসবাস করেন তখন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব তার উপর পড়বে এটাই স্বাভাবিক। কোনো লেখকই হয়তো সেই প্রভাব এড়াতে পারেন না। কারণ লেখক-শিল্পী তো আর সমাজবিচ্ছিন্ন জীব নন। জীবনের সঙ্গে রাজনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, আর লেখক তো সেই জীবনকেই গভীরভাবে দেখেন ও লেখেন। তার সময় ও সেই সময়ে বাস করা মানুষের গতি প্রকৃতি চিন্তা-চেতনা, তাদের যাপিত জীবনের যন্ত্রণা, হতাশা, দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, ভালোবাসা সবকিছুই একজন লেখককে সংবেদনশীলতার সাথে অনুভব করতে হয়। ফলে লেখক সরাসরি না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে রাজনীতিকে অস্বীকার করতে পারেন না। বিশ্বসাহিত্যের অনেক বিখ্যাত লেখক গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক চিন্তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা এত বেশি প্রভাবিত হয়েছেন যে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বাংলাসহিত্যের দিকে তাকালে দেখতে পাই তিন বন্দোপধ্যায়, মানিক, বিভূতিভূষণ, তারাশংকর ছাড়াও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, দেবেশ রায়, শওকত ওসমান, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, শহিদুল জহির প্রত্যেকেই নানা আঙ্গিকে তাদের লেখায়  রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

বর্তমান সমাজে রাজনীতি-বর্জিত কিছুই নেই। লেখককে অবশ্যই সেই রাজনীতিটা বুঝতে হবে। এখানে রাজনীতি  বলতে কোনো বিশেষ দলের প্রতি সমর্থন, আনুগত্য প্রকাশ, ভোট দেয়া কিংবা রাজপথে স্লোগান, মিছিল, মিটিং করা নয়- আমি রাজনীতিকে দেখি এক ধরনের জীবনদর্শন বা পরিপার্শ্বকে বিচার করার একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে। লেখক তার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কখনও সুক্ষ্ণভাবে, প্রতীকী ব্যঞ্জনায় আবার কখনও মোটা দাগে খোলাখুলি রাজনীতির প্রকাশ ঘটাতে পারেন।

শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।

শাহ্‌নাজ মুন্নী: আসলে আমার পাঠ অভিজ্ঞতায় একটি দুটো নয়, এমন অনেক গল্প আছে। মনে পড়ে, রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে অনাথ বালিকা রতনের দুঃখ বুকে বড় বেজেছিল। কিংবা বনফুলের সেই ছোট্ট গল্প ‘নিমগাছ’– পড়ে শেষ লাইনটাতে কেমন ধাক্কা খেয়েছিলাম। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্প পড়েও থমকে গিয়েছিলাম। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অতি ছোট গল্প ‘তুচ্ছ’ পড়ে ভিজে ওঠা মন সামলাতে গিয়ে ভেবেছি, এমনও গল্প হয়? কিংবা আই এ ক্লাসে পড়া মারজরি কিনান রওলিংস এর হৃদয় ছোঁয়া গল্প ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’-এর জেরির কথা কি ভোলা যায়? এমন আরও অসংখ্য গল্প আছে যা বিভিন্ন সময় চিন্তাকে নাড়া দিয়ে গেছে- এই মুহুর্তে সোমেন চন্দ’র ‘ইঁদুর’ আন্তন চেখভের ‘কেরানির মৃত্যু’র কথাও মনে পড়ছে।

শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?

শাহ্‌নাজ মুন্নী: কাঠামো, ভাষা ও ব্যাকরণ নির্মাণের সঙ্গে গল্পের বিষয়বস্তুর একটা যোগসাজশ থাকে বলে আমার মনে হয়। গল্প এসবেরই একটা সমন্বিত ব্যাপার।  চকমকি পাথরে ঠোকা একটা বিচ্ছুরণের মতো মনের মধ্যে গল্পের জন্ম তারপর ধীরে ধীরে তার বিস্তার। এ এক ধারাবাহিক পথচলা। গল্পের উপর আমি কখনও জবরদস্তি করি না। সে নিজেই নদীর গতির মতো প্রবাহিত হয়ে তার জন্য সংগতিপূর্ণ ভাষা ও কাঠামো খুঁজে নেয়। প্রতিটি লেখকই ক্রমাগত নিজেকে ভাঙেন, ভেঙে আবার গড়েন। অনবরত ভাঙা গড়ার এই খেলা আমার ভেতরেও চলে। শুরুতে যে ফর্মে লিখেছি পরবর্তী কালে হয়তো সেই ফর্মকে আর উপযোগী মনে হয়নি।

শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?

শাহ্‌নাজ মুন্নী: কোন উপাদানে গল্প সার্থক হবে, তার কোনো একক সূত্র বা চূড়ান্ত উপাদান নাই। গল্পের বিষয়, ভাষা, আঙ্গিক, প্রকাশভঙ্গি বা বর্ণনা কৌশল সব মিলে একটা সুষম সমন্বয় ঘটলেই হয়তো একটা সার্থক ছোটোগল্প লেখা সম্ভব। সফল গল্পে সাধারণত আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর সুন্দর সমন্বয় ঘটতে দেখা যায়। দেখা যায় বাস্তব অভিজ্ঞতা ও কল্পনার চমৎকার মিশেল। গল্পে বক্তব্য থাকলেও সেই বক্তব্য থাকে প্রচ্ছন্ন। গল্প ছাপিয়ে বক্তব্য প্রকট হয়ে উঠলে প্রায়ই গল্পের সৌন্দর্য নষ্ট হয় বলে আমার ধারণা। লেখকের কল্পনা ও অভিজ্ঞতার নির্যাস থেকেই জন্ম নেয় শিল্প। আর ভাষার উপর লেখকের দক্ষতা ও চিন্তার কারুকৌশল মিলিয়ে নির্মিত হয় একটি সার্থক গল্প।

শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

শাহ্‌নাজ মুন্নী: লেখকের রাজনৈতিক বোধ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। একটি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি চলমান ও গতিশীল রাখেন শিল্পী-সাহিত্যিক ও লেখকেরা। লেখকের কর্তব্য সমাজের অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, বৈষম্য ও রাজনৈতিক অন্যায্যতাকে প্রশ্ন করা, এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। লেখক তার সীমিত সাধ্য নিয়ে হলেও নিপীড়িত নিযাতিত নিষ্পেষিত মানুষের পাশে দাঁড়াবেন এটাই কাম্য। লেখকের রাজনৈতিক বোধ হওয়া উচিত ন্যায় ও মানবিকতার পক্ষে, অন্যায় ও অত্যাচারীর বিপক্ষে। প্রকৃত লেখক কখনোই অন্যায় অবিচারের পক্ষে কলম ধরেন না বলেই বিশ্বাস করি।

শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!

শাহ্‌নাজ মুন্নী: এখন একটি উপন্যাস লিখছি। দুটি ছোটোগল্পের আইডিয়া মাথায় ঘুরছিল। সেগুলো খাতায় টুকে রেখেছি। উপন্যাস লেখা শেষ হলে পরে লিখব। এর ফাঁকে টুকটাক একটি দুটো কবিতাও লেখা হচ্ছে। আমি আসলে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু লেখার চেষ্টা করি। একটা লাইন বা দুটো শব্দ হলেও লিখি।

More Posts From this Author:

    None Found

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!