পৃথিবীর সকলেরই প্রিয় কোন ফুল ছিল

Share this:

কবিতার মতো লেখা

আমি কবিতা লিখি না। আমি ডায়েরি লিখি। তবে তা কেন কবিতার মতো দেখায়, তা খুঁজতে আমার শৈশবে যেতে হবে। আমার শৈশবে আমার আমি গান গাইছি, আমার বাবা তানপুরা বাজাচ্ছে, আমার মা তবলা বাজাচ্ছে। আমার শৈশবে আমার বাবা কবিতা পড়ছে।পড়ছে, ‘মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে’। পড়ছে, ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে’। আমার শৈশবে আমি পড়ছি, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়, আর কতকাল দেখতে হবে খান্ডবদাহন?’
কেন আমি ডায়েরি লিখি, কেন স্মৃতিই আমার কাছে সবচেয়ে সত্য, তার কারণও সম্ভবত আমার শৈশবেই আছে। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দু তিন বছর বাদেই আমরা বদলি হয়ে চলে যেতাম বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। এই ছিলাম মফস্বলের ব্রিটিশ আমলের পুরোনো বাগানঘেরা বাংলোতে। এই চলে এলাম সারারাত না ঘুমোনো শহরের একটা উঁচু বিল্ডিং এ। আবার চলে গেলাম ছোটছোট পাহাড়ঘেরা কোন বৃষ্টির শহরে। এতসব জায়গার মানুষ, ভাষা, খাবার, রঙ, ঋতুর গল্পের জন্য খুব অল্প সময়েই আমাকে স্মৃতিরএকটা বিশাল সিন্দুকের বন্দোবস্ত করতে হলো। সেই সিন্দুক, আমার ডায়েরি। আমার ডায়েরিতে থাকতো সবে বন্ধু হওয়া কারো ফোননম্বর, চিঠি পাঠাবার ঠিকানা। আমার ডায়েরির পাতার ভাঁজে থাকতো সবে পুরোনো হওয়া বন্ধুর পাঠানো ভিউকার্ড। পিকনিকের গল্প।আমার একাকী জন্মদিনের কথা।
খুব ছোটবেলাতেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম স্মৃতিই আসলে সব। স্মৃতিকে ধরেই মানুষ বেঁচে থাকে।
যা কিছু মিথ্যা অথচ যা কিছু সত্যি ছিল, যা কিছু মিথ্যা অথচ যা কিছু সত্যি হতে পারতো, হয়তো তাই নিয়েই থাকতে শিখে গিয়েছিলাম।সেটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
আজও আমার একান্ত কথাই আমার কবিতা, কিন্তু এইসব একান্ত কথা তাদেরও যারা আমার সময়কে দেখছে। যারা আমার আগের সময়কেও ধারণ করে। এইসব একান্ত কথা তাদেরও, যারা একটা অযাপিত জীবন বহন করে চলেছে।
কবিতার সব থেকে বড় উপাদান হলো কবির নিজেকেই টেনে বের করে নিজের সামনে দাঁড় করানোর কাজটা। এছাড়া শান্তি নেই, কবিতা নেই। আবার এছাড়া অশান্তি নেই, কবিতা নেই। মুখোমুখি দাঁড়ানো দুটো ‘আমি’র দুই জীবনের দ্বন্দ্ব এবং সঙ্গতির হিসাব রাখতে হয়তৃতীয় ‘আমি’কে। সেই তৃতীয় ‘আমি’টাই কবি। আর সে, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। এমনকি সে তার সামনে দাঁড়ানো মুখোমুখি তার নিজেরই দুই সত্তারও সে কেউ না৷ সে শুধু মাঝেমাঝে খুঁজে পায় ঠিক এমনই একটা দৃশ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ, শুধু সেটুকুই তার পাওয়া।

 

 

 

১.

ইরামতি,
আজকে লিখে আনব আমাদের সেই বানোয়াট গল্পটা। সমস্ত সত্যে পুড়ে গেলে, মিথ্যা তখন জলের মতো, সহজ। শহরের রাস্তা আমাদের নদীতে এনে ফেলেছে। আমরা এখন সাঁতার শিখে নেব। ঘুরে ঘুরে, লাল শৈবালের ডাকনাম কৃষ্ণচূড়া। আজকেই লিখে আনব আমাদের সেই বানোয়াট গল্পটা। নদীর নামে নাম দিয়ো তার। আগের জীবনে নদীর নামের চেয়ে সুন্দর কিছু ছিল না।

 

ইতি
ইছামতি

 

 

২.

ইরামতি,
পৃথিবীর সমস্ত ছোট দিন শেষ হয়ে গেছে। চোখের পলকে চলে যাওয়া দিন। চলে গেছে। দূরের কোন নদী থেকে হাওয়া আর বালু এসে ভরে যেতো তোমার মুখ। আর আমার চোখে এসে পড়তো আমারই চোখের ঝরে পড়া পাতা। আমাদের চুলের জটের ভেতর আটকে যেতো আঙুল। আমাদের শরীর থেকে জন্ম নিতো রঙিন পোশাকের পাখা। দূরের কোন নদীর হাওয়া এসে। আমাদের দিন চোখের পলকে কেটে যেতো।
ইরামতি,
পৃথিবীর সমস্ত ছোট দিন হারিয়ে গেছে। কোথাও কোন নদী নেই। বালুতে শুধু শহুরে কুকুরের গন্ধ। কোন হাওয়া নেই কোথাও। রঙিন জামার পাখা নেই। সব ঝরে গেছে। এমনকি আমাদের পায়ের পাতার কাছেও কিছু জমা নেই। চলে গেছে উবু হয়ে কোলে তুলে নেয়ার মতো স্নেহ-মুখ।
আমাদের কাছে এখন শুধু একটা নদীর সমান দৈর্ঘ্য নিয়ে দিন জেগে আছে। একটা চাঁদ অথবা অন্ধকারের নিচে দিনের বুকের চর জেগে আছে। চরের বুকে একটা চাঁদ অথবা অন্ধকারের নিচে আমরা জেগে আছি। আর পৃথিবীর সমস্ত দু:সংবাদ আমাদের উপর নেমে আসছে।
মৃত্যুসংবাদ পাওয়া পিঁপড়ার মতো আমরা পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কাওকে কিচ্ছু বলিনি। শুধু চলে যেতে দেখছি আকাশ থেকে নীল, গাছ থেকে পাতা আর পৃথিবী থেকে সমস্ত সুসংবাদ।
ইরামতি,
আমার ভীষণ ইচ্ছে করে সকলের কানের কাছ গিয়ে বলি, পৃথিবীর সকলেরই প্রিয় কোন ফুল ছিল।

 

 

 

৩.

একটা বড় পৃথিবীতে কতগুলো জীবনের ভিড়ে আমার একটা ছোট জীবন ছিল। সেখানে আমি মানুষ ভালবেসেছি। গাছ নদী ফুলপাখি পথ ভালবেসেছি। গরু ছাগল হাঁস মুরগি কুকুর ভালবেসেছি। সেখানে আমি মানুষ ঘৃণা করেছি।

ছোট জীবনে আমি কেঁদেছি, হেসেছি অনেক। থমকে গেছি। হেঁটেছি অনেক। ছুটে গেছি কারো দিকে। ফিরে এসেছি অনেক। জানালা খুলেছি। দরজা বন্ধ করেছি কত। মানুষের বুকে গিয়ে চুমু খেয়েছি কত। ছাদের সিঁড়িতে। পড়ে গেছি। উঠে দাঁড়িয়েছি অনেক। চোখ তুলে তাকিয়েছি প্রিয় মুখের দিকে। চোখের দিকে, ঠোঁটের দিকে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি অনেক। একা মাঠ। বসে থেকেছি। জ্বরে পুড়ে পুড়ে সেরেউঠেছি অনেক।
মানুষ ভালবেসে কবর দিয়েছি প্রিয়মুখ। মানুষ ঘৃণা করে কবর দিয়েছি প্রিয়মুখ।

ট্রাকের চাকায় থেঁতলে গেছে উৎসবের ফুল। ফুলের লাশ মাড়িয়ে ছুটে গেছি বেঁচে থাকা অথবা মরে যাওয়ার দিকে।
ছুটে গেছি ফিরে আসার দিকে।
ভালবেসেছি ঘৃণা করব বলে!

আমার পায়ের নিচে কারো লাশ হাজার বছর ধরে মাটি চাপা পড়ে আছে। তার উপরে আমার জীবন অর্থাৎ মৃত্যুৎসব।
ইরামতি, আমাদের জন্মমুহূর্ত আমাদের মনে নেই। আমাদের মৃত্যু-স্মৃতি থাকবে তো?

 

 

 

৪.

আগের জীবন কেমন ছিল, ইরামতি?
এ জীবনে সত্যিকারের নদীর কাছে যাই না। শহরের গাছ থেকে শুধু কাঠ হয়। ছায়া হয় না। বিকালের বাতাস এসে চোখে মুখে লাগে না। কারো সাথে সন্ধ্যা নামার রঙ কেমন দেখা হয় না।
এই জীবন আমি চাইনি। একটা অফিস ঘরের মধ্য দিয়েই সকাল এবং রাত হয়। জমাট বাঁধা মানুষ ঠেলে ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফিরি।
আঙুল ছুঁয়ে হাঁটি না। তারা দেখা যায় না কোনদিন। শহরের আলোর কাছে চাঁদকে খুঁজে দিতে বলা যায় না। এই জীবন আমি চাইনি।
একটা ফেঁসে যাওয়া বাগানবিলাসের ডালের উপর শহুরে বুলবুলিদের শেষ বংশধরকে দেখি। তাকে বিদায় জানাই। সন্ধ্যে হলে কাঁচের দেয়ালের গায়ে আমাকেই দেখা যায়। আর কিচ্ছু নেই। কোথাও। এমন জীবন আমি চাইনি।
দিনের শুরু এলে অপেক্ষা করি শেষের। সময়ের ক্ষুদ্রতম একক হয়ে সপ্তাহ চলে যায়। বুকের কাছের মানুষেরা এক হাত দূরত্বেও ধরা দেয় না। এমন জীবন আমি চাইনি।
বাঁচতে চাওয়ার শব্দ শুনি। ঝড়ের কাছে গাছের। মানুষের কাছে মানুষের। জীবনের কাছে মৃত্যুর। এমন মৃত্যু আমি চাইনি।

 

 

 

৫.

ইরামতি,
আমাদের পৃথিবীর জীবন আরেকটু খুশির হতে পারতো? আমরা তবে থেকে যেতাম।
সকালে শিউলি। দুপুরে পলাশ। সন্ধ্যা হচ্ছে যখন, বাগানবিলাস৷ রাতে কামিনী৷ এই করে পার হতে পারতো। আমরা তবে থেকে যেতাম।
আর একটা মানুষ। দুইটা মানুষ। সকাল দুপুর সন্ধ্যা রাতে৷ থেকে যেতে পারতো। আমরা তবে থেকে যেতাম। তার সাথে। তাদের সাথে।
একটা নদী৷ দুইটা পুকুর৷ বাড়ির পাশে দেবদারু গাছ। দেখতে গেলে আকাশ দেখা। হয়ে যায়। আমাদের জীবন এমন হতে পারতো৷ আমরা তবে থেকে যেতাম।

 

ইতি

ইছামতি

 

 

 

Koustuv Shree  is a poet and an architect by profession. She was born on the 1st of January 1991 in Rajshahi, Bangladesh. Her first book ‘Mohaproyan Sorok’ was published in 2017, and her second book ‘Nodir Namer Cheye Sundor Kichu Nei’ is going to be published in February 2020. She lives in Bangladesh.

 

 

  • More From This Author:

      None Found

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!