বিশ্বায়ন হল যুগপৎ একটি সাম্রাজ্যিক ও শ্রেণিপ্রপঞ্চ।
—জেমস পেত্রাস
প্রাককথন
উৎপাদনের চারটি উপাদান—ভূমি, শ্রম, পুঁজি ও সংগঠন উৎপাদন শেষে তাদের নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে নেয়। পুঁজি কালক্রমে উৎপাদনের অন্য তিনটি উপাদানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। একটি বিশেষ সীমার পর নির্দিষ্ট স্থানে উৎপাদন আর বাড়ে না তাই পুঁজি পুনঃউৎপাদন ও আত্মরক্ষার তাগিদে নিজের স্থানান্তর ঘটায়। সৃষ্টি হয় আপাত এক নতুন অবস্থা-ব্যবস্থার। এরই নাম বিশ্বায়ন। বিশ্বায়ন নতুন কিছু নয়। এর সৃষ্টি মূলত উৎপাদনের অন্য উপাদানগুলোর ওপর পুঁজির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকে। কালের আবর্তনে এর রূপগত পরিবর্তন হলেও গুণগত পরিবর্তন তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। সময়ের প্রবাহমানতায় নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হলে পুঁজির সঞ্চালনে একপ্রকার আপাত বাধার সৃষ্টি হয়। তাই পুঁজি কৌশলে নিজেকে ভূমি হতে পৃথক করে নেয়। আমরা দেখি-শুনি কার দ্বারা পণ্য উৎপাদিত হল, কোথায় উৎপাদিত হল সেটি নয়। পুঁজি নিজের আত্মরক্ষা ও বিকাশ ব্যতীত অন্য সকল ক্ষেত্রে অন্ধ। কিন্তু সে প্রথম যে স্থানে ও সংগঠনে শ্রমের সহায়তায় নিজের বিকাশ ঘটায়, উৎপাদনের অন্য উপাদানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, নিজের অজান্তেই তা সঙ্গে বহন করে। তা ছাড়া নিজের আত্মরক্ষা ব্যতীত তার অন্য কোনো দর্শন না থাকলেও যাদেরকে (ব্যক্তি, সংগঠন) সে নিজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়োজিত করে তাদের নিশ্চয়ই কোনো না কোনো দর্শন থাকে। পুঁজির স্থানান্তরের এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় ক্ষমতার (অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক) কেন্দ্র-প্রান্ত সম্পর্ক। বর্তমান বিশ্বের অবস্থা-ব্যবস্থায় (রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক) কেন্দ্র-প্রান্ত সম্পর্ক বিদ্যমান। বর্তমানে পুঁজির একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদন হচ্ছে তথ্য এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি। আবার এই তথ্য-প্রযুক্তি পুঁজির স্থানান্তরে সক্রিয় সহায়তার মাধ্যমে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রূপগত বদলে যাওয়া পৃথিবী
১. সুশীল সমাজ, প্রেশার গ্রুপ, এডিবি, আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, জাতিসংঘ
২. আপনি তা-ই, যা আপনি ক্রয় করেন
বেনিয়া পুঁজিপতি, বাণিজ্যিক কোম্পানি, দাসবণিকদের দ্বারা প্রারম্ভিক ঔপনিবেশিক দখল প্রক্রিয়া (১৫শ শতাব্দী থেকে ১৮শ শতাব্দী) ছিল প্রারম্ভিক বিশ্বায়ন। সংরক্ষণবাদ, জাতীয় শিল্পের বিকাশ ও সর্বোপরি ঔপনিবেশিক কলোনিগুলোতে জাতীয় আত্মমর্যাদার উপলব্ধি (১৮শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ১৯শ শতাব্দী) বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার গতিকে আপাত শ্লথ করলেও ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বহিঃস্থভাবে সৃষ্ট প্রবৃদ্ধিমুখী বিশ্বায়ন বেগবান হয়। বর্তমানে এর সাথে সহায়ক শক্তি হিসেবে যুক্ত হয়েছে পণ্যরূপে তথ্যের অত্যাশ্চর্য ব্যবহার।
অতিকায় কর্পোরেট কোম্পানির মাধ্যমে পুঁজির এই সঞ্চালনে শ্রেণিস্বার্থের এবং স্বরূপের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ধনী ক্রমান্বয়ে আরো ধনী হচ্ছে আর গরিব হচ্ছে তুলনামূলকভাবে আরো গরিব। অর্থাৎ ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সম্পদের (আয়ের) বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এরই ফলে আমরা দেখি পৃথিবীর ‘জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের কম লোক ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তির প্রায় ৯০ শতাংশের অধিকারী।‘১
বিশ্বায়নের এই পর্যায়ে আমরা কোনো কল্যাণরাষ্ট্রের উদ্ভব হতে দেখি না, দেখি না কোনো কল্যাণরাষ্ট্রের রক্ষক হয়েছে এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া। বরং আমরা দেখি বেসরকারিকরণের নামে রাষ্ট্রের সম্পত্তি কতিপয় ব্যক্তি বা একটি শ্রেণির হাতে কুক্ষিগত হওয়া, কর্পোরেট কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অতি উচ্চ বেতন ও কর্মচারীদের নিম্নবেতন, শ্রমিকশ্রেণির আরো বেশি কোণঠাসা হওয়া—বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, মধ্যস্বত্বভোগীদের ব্যাপক দৌরাত্ম্য এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূল উৎপাদকদের চাইতে বেশি লাভবান হওয়া। আমরা আরো দেখি ‘লেস ফেয়ার’-এর নামে দেশীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সর্বস্বান্ত হওয়া, প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম উপায়ে ব্যক্তির ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা তৈরি করে তার আত্মমর্যাদাবোধ ও সুখ ভুলুণ্ঠিত করা ইত্যাদি। অবশ্য সকল শ্রেণির জন্য একই গুণগত মানের সেবা ক্রয়ের সুযোগও আমরা দেখেছি।
বিশ্বায়নের গতিবিদ্যা : তথ্য ও প্রযুক্তি
“এক পাউন্ড চিনির দাম যদি মার্কিন মুদ্রার হিসাব মোতাবেক ১৫ সেন্ট হয় তাহলে একটি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশকে ৩০০ মার্কিন ডলার আয়ের জন্য ২০০০ পাউন্ড চিনি উৎপাদন করতে হবে। একটি শিল্পনির্ভর অর্থনীতির দেশকে সমপরিমাণে অর্থ উপার্জনের জন্য একটি রঙিন টিভি উৎপাদন করতে হবে। অন্যদিকে তথ্যভিত্তিক অর্থনীতির একটি দেশকে বিক্রি করতে হবে ‘ওয়ার্ড পারফেক্ট’র মতো প্রোগ্রামের কোনো একটি কপিমাত্র। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো তথ্য অর্থনীতিভিত্তিক দেশে ওয়ার্ড পারফেক্টের একটি কপি বিক্রি করেই ফিলিপাইন থেকে ২০০০ পাউন্ড চিনি কিংবা তাইওয়ান থেকে একটি রঙিন টিভি কিনতে পারছে। অথচ, ২০০০ পাউন্ড চিনি কিংবা একটি রঙিন টিভি উৎপাদনের তুলনায় সমমূল্যের একটি সফটওয়ার কপি করতে কি-ইবা এমন সময় ও শ্রম লেগেছে?”২ এইবার আপনারা নিজেরাই চিন্তা করুন পণ্য হিসেবে তথ্যের স্বরূপ কেমন? তথ্যকে উৎপাদন, ধারণ ও ব্যবহারের সম্মিলনে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ক্ষমতার কেন্দ্র প্রান্তের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। তথ্য ও প্রযুক্তির সম্মিলিত ব্যবহারের ফলে আমরা পাই স্যাটেলাইট টেলিভিশন। বাসায় টেলিভিশন আছে আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খবরাখবর কেউ রাখে না তা কি হয়? ইলেকশন ক্যাম্পেইনের মার্কিন পদ্ধতি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ানির্ভর। প্রতিদ্বন্ধী দলগুলো টেলিভিশনের সময় কিনে নেয়। অবিরাম চলতে থাকে তাদের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক নীতি নিয়ে বক্তৃতাবাজি, বিশ্লেষণ। হবু রাষ্ট্রপতি এবং তাদের স্ত্রী সন্তানদের পেছনে টিভিক্যামেরা ছুটতে থাকে। সারা পৃথিবীতে জনমত তৈরি হয় রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট পার্টির পক্ষে-বিপক্ষে। এইভাবে একটি শক্তিশালী প্রচারমাধ্যমের সহায়তায় আমেরিকা কার্যত সমগ্র পৃথিবীর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করিয়ে নেয়। এরই ফলে যুদ্ধবিগ্রহের সময়ে মিডিয়া আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে ‘মি. প্রেসিডেন্ট’ বলে সম্বোধন করে। যেন পৃথিবীর বাকি ভূগোল আমেরিকার অধীনে। এই মিডিয়ারই আরেকটি কুকর্ম, প্রান্তের বিভিন্ন ভাষাকে, সংস্কৃতিকে মসৃণভাবে হত্যা করা। কেন্দ্র তার রাজনৈতিক প্রভাব প্রান্তে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য এই কুকর্মটি করে থাকে। একটু ভাবলেই চিন্তাশীল ব্যক্তি প্রান্তের ভাষা, সংস্কৃতির এই নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে পারবেন।
তবে, অভিজ্ঞতা কিন্তু বলছে তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর দেশের জাতীয় অর্থনীতির জি.ডি.পি. প্রবৃদ্ধির হার আশানুরূপ নয়! এছাড়া এই তথ্যপ্রযুক্তি মানুষকে প্রচণ্ডভাবে গৃহকাতর এবং এক ধরনের সমাজ ও নৈতিক দায়িত্ব-বিচ্ছিন্ন করে তুলছে।
বিশ্বায়নের গতিবিদ্যা : অর্থনীতি
বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রের জাতীয় পুঁজির সঙ্গে আন্তর্জাতিক (বহুজাতিক) বেনিয়া কোম্পানির পুঁজি মিলে এর যতই প্রবৃদ্ধি ঘটে, ক্ষুদ্র বাজার অংশীদারি নিয়ে অধিক পুঁজির ধাবমানতার কারণে মুনাফার হারের ততই ঘটে অবনতি। এর সহজ সমাধান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে “পুঁজির স্থানান্তর-প্রক্রিয়ায় সকল আভ্যন্তরীণ এবং রাষ্ট্রিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙে ফেলার ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ নীতিটি।” অবশ্য চাহিদা বৃদ্ধির জন্য ‘শ্রেণিকাঠামোর আমূল পরিবর্তন’ ঘটিয়ে অবনতিশীল মুনাফা সমস্যাটি সমাধান করা যেতো, যা উপেক্ষিত হয়েছে।
মুনাফা যখন বাড়ে তখন সেটা জীবন-যাপন মানবৃদ্ধির ওপর নয় বরং শ্রম-খরচ কমানোর ওপর মাত্রাতিরিক্তভাবে নির্ভর করে। স্টকমার্কেটে যখন তেজিভাব, তখন উৎপাদন-শক্তিগুলো স্থবির হয়ে থাকে। যখন নতুন নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটে তখন প্রকৃত অর্থনীতির ওপর সেগুলোর প্রভাব ফটকাবাজদের মুনাফার নিচে চাপা পড়ে। ফলে মানবজাতির উৎপাদন, বণ্টন ইত্যাদি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও শুধুমাত্র বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো (ক্ষমতার প্রান্ত) ক্ষমতার কেন্দ্রের দেশগুলোর কাছে পরিচিত হয় উদীয়মান বাজার হিসেবে (!)। এটা তারা প্রকাশ্যে বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও করে না। এটাই হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়নের প্রধান দোসর। এর বর্তমান অবস্থা আমাদের চক্ষুর সম্মুখে প্রস্ফুটিত।
শ্রম, ভোগের নমুনা, ব্যক্তিগত যোগাযোগ ইত্যাদির পূর্ণ বিন্যাসের ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির বহুবিধ ব্যবহার অস্বীকারযোগ্য নয়। কিন্তু সেই ব্যবহারের পরিমাণই (সংখ্যাধিক্য) হল মূলকথা। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরের আধিপত্য, শোষণ ও স্থবিরতাকে দূর করার নিরিখে এর ব্যবহার উদ্ভাবনমূলক না হয়ে বরং বিদ্যামান বৈশ্বিক শ্রেণিগুলোর সাপেক্ষে অধিকতর অভিযোজনমূলক। মূলত বিশ্বায়নের এই পর্যায়টি হল ইতিহাসের সর্বশেষ স্তর। যার ভিতর সকল দেশ ও সকল অর্থনতি, পুঁজিবাদী বাজারের মাধ্যমে একসূত্রে গ্রথিত।
বিশ্বায়নের গতিবিদ্যা : রাজনীতি (ক্ষমতা)
“বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বায়নের বিষয় এবং বিষয়ীরা ছিল পৃথক পৃথক দলসমূহ। পুঁজি ও উৎপাদানসমূহ জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে সম্প্রসারিত হয়ে থাকলেও সেটা ঘনীভূত ছিল বিশ্বের নির্দিষ্ট জাতীয় রাষ্ট্রসমূহে। পুঁজি রপ্তানিকারক ও পুঁজি-গ্রহীতা উভয় প্রকার দেশগুলোতেই সম্প্রসারণের ফল হয়েছিল শ্রেণিসমূহের মধ্যে লাভের অসমতা। আজ ঐ প্রবণতাটি অধিকতর স্পষ্ট—এমনকি পূর্বে যেসব দেশ ছিল সিজিটির (পুঁজি, পণ্য, প্রযুক্তি) লক্ষ্যবস্তু সেগুলো আজ রপ্তানিকারী হয়ে ওঠা সত্ত্বেও। আজ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটি ঘটেছে সাবেক ঔপনিবেশিক দেশগুলো থেকে বহুজাতিক পুঁজির আবির্ভাবের মধ্যে, যে পুঁজিপতিরা এখন পুঁজি রপ্তানি করছে ও আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে।”৩
সম্প্রতিক বিশ্বায়নে (১৯শ-২০শ শতাব্দী) ক্ষমতার কেন্দ্র পরিবর্তন হয়নি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম চীন। সুদূর অতীতে চীন ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকলেও মধ্যবর্তী সময়ে ছিল না, বর্তমানে আবার এসেছে। শ্রেণিকাঠামো এবং স্বার্থের পরিবর্তন হয়নি, হয়নি নির্দিষ্ট শ্রেণিকাঠামোর ক্রয়ক্ষমতার ব্যাপক পরিবর্তন। অতএব এটা প্রমাণিত, বিশ্বায়নের ফলে পুঁজির পৃথিবীব্যাপী সঞ্চালন ঘটলেও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেনি। বরং ক্ষমতার কেন্দ্রমুখী প্রবণতা আরো বেড়েছে। ফলে বেড়েছে ক্ষমতার সংঘাত—অনিবার্য রক্তপাত ও সম্পদক্ষয়। ক্ষমতার কেন্দ্রমুখী প্রবণতার জন্য প্রান্তের রাষ্ট্রগুলো ক্রমান্বয়ে শক্তি ও আত্মমর্যাদা হারাচ্ছে। কিন্তু বাহির থেকে মনে হচ্ছে প্রান্তের রাষ্ট্রগুলো বুঝি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী ও আত্মমর্যাদাবান হচ্ছে। যেমন: ‘পূর্বে জাতীয় রাষ্ট্র কখনোই স্থানীয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক বিনিময় এবং বিনিয়োগ নিরূপণে এত বেশি প্রভাব ও পরিণতি সহকারে হস্তক্ষেপ করেনি, এত বেশি নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা পালন করেনি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, জাতীয় রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রাক-হস্তক্ষেপ ছাড়া বহুজাতিক কোম্পানি এবং ব্যাংকগুলোর পৃথিবীব্যাপী ব্যবসা করা অসম্ভব।’ এখানেই হচ্ছে শুভঙ্করের ফাঁকি। প্রান্তের জাতি-রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে (কেন্দ্রের রাষ্ট্র কর্তৃক) নিয়ন্ত্রিত করে তবেই তাকে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া প্রান্তের বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলসমূহ, উচ্চপদস্থ সামরিক বেসামরিক আমলা, বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপকদেরকে বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রের রাষ্ট্রসমূহের নিজেদের স্বার্থ, আধিপত্য রক্ষার বিষয়টিতো রয়েছেই। এরই ফলে বর্তমান বিশ্বের ক্ষমতার কাঠামো এখন দ্বিমেরু বা বহুমেরু নয়, একমেরু। ফলে এখন যেকোনো ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তি ক্ষমতার কেন্দ্রের স্বার্থ আরো বেশি রক্ষা করে, প্রান্তের নয়। এরই ব্যবহারিক রূপ হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক, সামরিক কার্যক্রমগুলোর ক্ষমতার কেন্দ্রের রাষ্ট্র/রাষ্ট্রগুলো হতে ক্ষমতার প্রান্তের রাষ্ট্রগুলোর দিকে সঞ্চালন, পৃথিবীব্যাপী অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবান শ্রেণি কর্তৃক কম ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণির দিকে সঞ্চালন (এখানে ক্ষমতার কেন্দ্র কর্তৃক প্রান্তকে অবদমনের নীতি স্মর্তব্য)।
বিশ্বায়নের গতিবিদ্যা : অভিবাসন এবং নৈতিকতা
বিশ্বায়ন থেকেই অভিবাসনের সূত্রপাত—এই কথায় অতিসরলীকরণ রয়েছে। রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি হওয়ার আগে অবশ্যই মানুষের স্থানান্তর ঘটেছে। ঘটেছে রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পরেও। বাইরে থেকে আসা অধিবাসীরা কোনো রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়নি। তারা অভিযোজনের স্বার্থে যতুটুকু সক্রিয় হওয়া দরকার ততটুকুই হয়েছেন। তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা সীমাবদ্ধ ছিল রাজনৈতিক এলিটদের মধ্যে। এলিটরা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম দেননি। তারাও এলিটদের বাধ্য করেননি কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। তারা ছিলেন রাজনৈতিক অস্ত্র। অস্ত্র যার হাতে থাকে তার ইচ্ছায় চলে, নিজের কোনো ইচ্ছা থাকে না।
বিশ্বায়নের এই যুগে অভিবাসনের ধরনে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। পুঁজি, পণ্য ও প্রযুক্তির সঙ্গে কুশলী শ্রমিক জাতি-রাষ্ট্রের বেড়াগুলো অবলীলায় অতিক্রম করছে। কিন্তু অকুশলী শ্রমিক তা পারছে না। জাতি-রাষ্ট্রের বেড়া সে অতি কষ্টে অতিক্রম করতে পারলেও বাধ্য হচ্ছে খুব সস্তায় তার শ্রম বিক্রি করতে। এটা বিশ্বায়নের অতি চতুর ধরনের বৈষম্য। দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তির মধ্য দিয়ে যে বর্ণবৈষম্যকে আমরা বিদায় করেছিলাম, বিশ্বায়নের মধ্যে আবার নতুন করে শিকড় গেড়েছে।
বর্তমানের এই অভিবাসীদের কাছে নাগরিকত্ব কোনো অমোঘ সত্য নয়, নয় দেশপ্রেমের অভিজ্ঞান। নাগরিকত্ব তাদের কাছে সুযোগ সুবিধা আদায়ের চাবিকাঠিমাত্র। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে অথবা প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম হলে এই চাবিকাঠিকে তারা ছুড়ে ফেলতে একটুও দ্বিধাবোধ করে না। তাছাড়া এই সময়ের অভিবাসীরা মোটেই নিষ্ক্রিয় নয়। তারা জাতি-রাষ্ট্র পরিকাঠামোর বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের নিজেদের সত্তাগত স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রেখে জাতি-রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে চায়। ভাষা এদের সঙ্গে জাতি-রাষ্ট্রের আদি বাসিন্দাদের সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে না। এই ধরনের অধিবাসী সারা পৃথিবীতে এখন নিতান্ত অল্প নয়। তারা উত্তরোত্তর রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হচ্ছে। এরই পরিণাম হচ্ছে বিশ্বব্যাপী জাতি-রাষ্ট্রের আদি অধিবাসীদের সংস্কৃতি, নৈতিকতা মূল্যবোধ ইত্যাদির মৌলিকত্বের ক্রম-যৌগিকায়ন। এই যৌগিকায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই একজন জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিক বিশ্বনাগরিকে পরিণত হয়।
স্বাতন্ত্র্য মানেই বৈরিতা নয়। কেউ স্বতন্ত্র হলেই তার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে, এমনও নয়। এই উদার-নৈতিক জাতি-উত্তর (Post National) নৈতিকতাই বিশ্বায়নের গতিবিদ্যায় অভিবাসন প্রক্রিয়ার মূল প্রেরণা। তবে এখানেও ক্ষমতার কেন্দ্রের দেশগুলোর কুশলী শ্রমিকরা তো বটেই অকুশলীরাও প্রান্তের অভিবাসীদের চেয়ে শ্রেয়তর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে।
যবনিকা
পুঁজির স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বায়নের উৎপত্তি বহুলাংশেই নির্ভর করে জাতি-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনসমূহের ওপর। বিশ্বায়ন অনিবার্য—এই ধারণার মূলে রয়েছে কম দার্শনিক কিন্তু অধিক বিশ্লেষাত্মক ধরনের উপলব্ধি। বিশ্বায়ন থেকে উদ্ভূত সামাজিক বিরোধসমূহ ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানিক অবস্থানগুলো থেকে প্রয়োগকৃত উচ্চ প্রযুক্তি দ্বারা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। এই শ্রেণি-অসাম্যের রাজনৈতিক যৌক্তিকীকরণ হিসেবে বিশ্বায়ন একটি অবশ্যম্ভাবী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করে। স্পষ্টতই বিশ্বায়ন হল ফটকাবাজ লগ্নিকারীদের জন্য ভবিষ্যৎ তরঙ্গ, একে মানবজাতির অবশিষ্টাংশের সাথে গুলিয়ে ফেলা হবে চূড়ান্ত রকম ধৃষ্টতা। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বর্ধিত সংখ্যক গোষ্ঠী পুনঃনিক্ষিপ্ত হয়েছে সীমিত সম্পদের মধ্যে। এর ফলে তারা প্রধানত যুক্ত হয়ে পড়েছে আত্মরক্ষার সংগ্রামে। তাই সকল বিরোধিতা সত্ত্বেও এটি উৎখাত হয় না। জড় বিজ্ঞানের ‘মহাকর্ষ-বিধি’র মতো এর সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার মধ্যেই এর ধ্বংসের কারণ লুকিয়ে আছে। ব্যবসায়ী পুঁজির সামাজিক পুঁজিতে রূপান্তর প্রক্রিয়া হতে পারে এমনই একটি কারণ।
দোহাইপঞ্জি
- Globalization: A Critical Ananlysis, James Petars, Journal of Contemporary Asia, 29 No. 1. 1999
- তথ্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি স্বরূপের সন্ধানে, রবার্তো ভারজোলা, অনুবাদ; হাসনাত কবির কল্লোল, ইনফারমেট্রিকস, জানুয়ারি ’৯৭, ঢাকা
- প্রাগুক্ত (১)