স্বাধীন, মুক্ত জীবন থেকে মানুষ নিরাপত্তার প্রয়োজনেই নিজেকে শৃংখলিত করেছে একসময়। আর তা ঠিক কখন বা কোন ঘটনা থেকে জন্ম, তার ইতিহাস আমরা পাই না। কেবল জানি, মানুষ ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছে, আগুন আবিষ্কার দিয়ে অন্য পশু থেকে এক লাফে উপরে উঠেছে , কৃষি আবিষ্কার দিয়ে ভবঘুরে জীবনের ইতি ঘটিয়েছে, পশুপালন পশুচারণ দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ক্রমাগত নিজের মালিকানা বাড়িয়ে স্থায়ী এক সমাজ সৃষ্টি করেছে। এঙ্গেলসের মতে, ঠিক সেই সময় থেকেই নারীজাতির মানুষ হিসেবে অর্ধাঙ্গ হবার পরিণতিও ঘটেছে। এইসব শৃংখলার আধুনিকতায় এসেছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব টিকে থাকে শক্তি বলে, ক্ষমতা দিয়ে। ক্ষমতা রক্ষার কৌশল শুরুটা শক্তিবল দিয়ে হলেও পরে তাতে স্থান পেয়েছে মানব মন।
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো ক্ষমতা নিয়ে কী বলেন একটু দেখি। ফুকো ক্ষমতার তিনটি পদ্ধতির কথা বলেন, সার্বভৌমত্ব, ডিসিপ্লিন ও প্রশাসনিকতা। শুরুতে সার্বভৌমত্ব বলতে শাসকের কথাই বোঝানো হতো। ফলে তা রক্ষায় যে আইন হতো, তা দৈহিক শাস্তির ভয় দেখিয়ে পালনে বাধ্য করা হতো। এরপর এলো আলোকপ্রাপ্তি ও সংস্কারের যুগ। শাস্তির কৌশল গেল বদলে। বেছে নেয়া হল মানুষের মন। শাস্তিকে প্রথমে অপরাধীর কাছে যুক্তিযুক্ত করা হলো। ডিসিপ্লিনের ছকে আনা হল। ফুকো মনে করেন, আধুনিক মানুষ নিশ্ছিপদ্র বেড়ার ভেতর জন্মগ্রহণ করেন। বিভিন্ন অবয়বে তাদের ওপর চলে নজরদারি। ফুকো দেখালেন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিটি মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বানায়। এসব প্রতিষ্ঠান মানুষের ব্যক্তিক ও সমাজ রাজনৈতিক সমস্ত আচরণের কিছু মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়। সেই মাপকাঠি লঙ্ঘন করলে পেতে হয় শাস্তি। বিধিগুলো মেনে চলার শিক্ষা শুরু হয় শিশু বয়স থেকেই। শিক্ষাদানে অংশগ্রহণ করে বিদ্যালয়, ধর্মালয়, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদি।
ফুকো ক্ষমতার সাথে জ্ঞান ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়েও বলেছেন। তার মতে, ক্ষমতা জ্ঞানকে বৈধতা দেয় আর জ্ঞান সেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে। এখন তা অনুশীলন করছে কে? ফুকোর মতে, আধুনিক জগতে ক্ষমতা এমনভাবে কেন্দ্রচ্যুত হয়েছে যে তার কোন বিশেষ মালিক নেই, সমাজের সকলেই এই যন্ত্রের এক একটি অংশ। এখানেই আমার বক্তব্য, এর মানেই প্রচলিত ব্যবস্থাপনায় নারীর উপর বৈষম্য প্রতিরোধে যে আইন বা সামাজিক ধ্যানধারণা গড়ে উঠছে তা আসলেই বৈষম্য রোধে কোন ভূমিকা রাখবে কিনা! যেখানে একই সাথে শোষক ও শোষিত সম চিন্তাধারার অধিকারী? ফলে এ যাবৎকালে যতধরণের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাই তৈরি হয়েছে বা ক্ষমতায়নের যত স্তরেই নারীর অবস্থানকে জোরদার করার চেষ্টা করা হয়েছে সেখানে নারীর কিছু অবস্থা পাল্টালেও অবস্থানের পরিবর্তন তেমন হয়নি। নারীরা ক্ষমতা পেলে পুরুষের চেয়ে স্বতন্ত্র কোন সত্তা আনতে সক্ষম হয়নি। অথচ যার ইতিহাস আদি কাঠামোতে ছিলো একেবারেই অনুপস্থিত। আদি সমাজ ব্যবস্থায় নারী-কর্তৃত্বের যে স্বরূপ জানা যায়, তাতে লিঙ্গগত বৈষম্যের কোন প্রমাণ কী পাওয়া যায়?
এবার আমরা আশ্রয় নিই ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদার তত্ত্বে। তার প্রবর্তিত তত্ত্ব বিনির্মাণ বা ডিকন্সট্রাকশন নামে অভিহিত। দেরিদার ডিকন্সট্রাকশন এর বাংলা হিসেবে আমরা পুনঃনির্মাণ শব্দটা যদি ব্যবহার করি, বুঝতে কিছুটা সহজ হয় এজন্য যে, প্রাচ্য এই পুনঃনির্মাণ বিষয়টির সাথে বহু আগে থেকেই জড়িত। আর দেরিদার ‘অফ গ্রামাটোলজি’র অনুবাদক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ভূমিকা বক্তব্যে বিনির্মাণ আর পুনঃনির্মাণের ব্যবধান তেমন দেখা যায়নি। পিনাকী ভট্টাচার্যের এক বক্তব্য তুলে ধরি বিষয়টি বুঝতে, পাশ্চাত্য চিন্তা কোন একটা কেন্দ্রের আইডিয়া বা সেন্টারকে—একটি উৎসকে, একটি শাশ্বত ফর্মকে একটি অনড় বিন্দুকে, একটি ইমমুভেবল মুভারকে, একটি নির্যাস, একটি ঈশ্বর, একটি অস্তিত্বকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই ভিত্তিটাকে দেরিদা বলেছেন সেন্টার। এই সেন্টারকে ব্যবহার করা হয় আর সবকিছুকে অর্থ দেওয়ার জন্য। যেমন ২০০০ বছর ধরে পাশ্চাত্য চিন্তা খ্রিস্টানিজমকে সেন্টার করে আবর্তিত হয়েছে। খ্রিস্টানিজম ঠিক করেছে গ্যালিলিও ঠিক বলেছে কিনা। একই বিষয় ঘটেছে অন্যান্য সভ্যতার ক্ষেত্রেও।
দেরিদার ধারণাটি এভাবে ব্যাখ্যা করি। যে কোন বিষয়কে একটি মাত্র ভাষা দিয়ে প্রকাশ করে , বাকিগুলোকে মার্জিনালাইজ করার চেষ্টা থাকে। যেমন ধরি, পানির নানা সমার্থক থেকে শুধুমাত্র বারি ও জল গ্রহণ করে পানির অন্যান্য প্রতিশব্দের উপর তাকে অধিষ্ঠিত করলাম অর্থাৎ এই দুইটি শব্দকেই কেবল সেন্ট্রালাইজ করলাম। বাকিগুলোকে মার্জিনালাইজ করে করলাম ডিফরেন্ট। এই ডিফরেন্টকে দেরিদা বলেছেন, বাইনারি অপজিট। ঠিক আমাদের সমাজ ব্যবস্থাতেও নারীকে পুরুষের বাইনারি অপজিট হিসেবে মনে করার চেষ্টা চলে। অর্থাৎ একজনকে কেন্দ্র হিসেবে নিয়ে বাকিকে মার্জিনালাইজ করা হয়। একজন সাজে সেল্ফ , অন্যজন হয় আদার। এখন সেল্ফ সবসময় আদারের ফ্রি প্লে বন্ধ করে তাকে ডমিনেট করবার চক্রান্ত করতে থাকে। ডিকন্সট্রাকশন পারে কেবল মার্জিনালাইজডকে খুঁজে নিয়ে সেন্টারকে অবদমন করে মার্জিনালাইজড কে সেন্টার করে অন্য অর্থ খুঁজতে। এখন এই বিনির্মাণে কোন স্তরের বিষয়টি সবার আগে প্রয়োজন? তা চিন্তা করতে এইবার ভারতীয় আধ্যাত্মিক গুরু ইউ জি কৃষ্ণমূর্তির বক্তব্যে আসি।
নারী-পুরুষ সম্পর্ক, প্রেম, যৌনতা নিয়ে ইউ জি এর সাধারণ কিছু বক্তব্য তুলে ধরি স্বল্প পরিসরে। ইউ জি বলেন, একজন নারীর সৌন্দর্য নির্ভর করে হেলেনা রুবিনস্টেইন বা এলিজাবেথ আর্ডেন বা অন্য কারও ধারণার ওপর। বোঝা যাচ্ছে যে, এখানে ধারণার ওপর অর্থাৎ চিন্তার ওপর প্রভাববিস্তারকারীই মূলত প্রতিটি বিষয়ের দিক নির্দেশনার ক্ষেত্র তৈরি করছে। ইউ জি বলেন যে, যারা মানবজাতির উপর সেবা করছে বলে দাবি করে, তাদের মতো তুমিও বেশ ভালো বোধ করছ। সেটাই হলো মানবতাবাদির ঘোর। রাস্তা পারাপারে কোনো বৃদ্ধাকে একটু সাহায্য করে ভাবলে খুব ভালো কাজ হলো। কিন্তু এটা হলো একটা আত্মকেন্দ্রিকতা কাজ। নারীর ক্ষেত্রে পুরো সমাজ কাঠামোর গড়া আইন, সামাজিক আচার যেন ইউজির কথার প্রতিরূপ।
ইউজি বলেন, মানুষের সম্পর্কের ভিত্তির মূল কথা হলো নিরাপত্তা, তারপর অধিকারিত্ব। অন্য মানুষকে তুমি অধিকার করতে চাও। নানা কারণে যখন অন্যজনের উপর তোমার প্রভাবটা দুর্বল হয়ে আসে, তোমার সম্পর্কটা নিঃশেষ হয়ে যায়। একজন পুরুষ এবং একজন নারীর মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিটা হলো, পরস্পরকে নিয়ে তাদের দুজনের নিজের জন্য সৃষ্ট প্রতিরূপ। সুতরাং, দু’জন ব্যক্তির মধ্যে প্রকৃত সম্পর্কটা হলো দুইটা প্রতিরূপের মধ্যেকার একটা সম্পর্ক। … দুর্ভাগ্যক্রমে, এই যৌনতা জিনিসটাকে আমরা অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি। এ প্রাণীর একটা সাধারণ জৈবিক প্রয়োজন মাত্র। দেহ শুধু দুইটা জিনিসে আগ্রহী – টিকে থাকা আর নিজের অনুরূপ বংশবিস্তার করা। এখানে ফুকোর যৌনতার ইতিহাস বইয়ের একটি বক্তব্য উল্লেখ করি, ফুকো কিন্তু যৌনতাকে কেবল বংশ বিস্তারের অংশ হিসেবে দেখেননি, অবশ্যই তা একটি অংশ, কিন্তু যৌনতার আরেকটি অংশ জড়িত আমাদের আনন্দময় ভোগের সাথেও। এখানে ইউ জি আবার যা বলেছেন, অথচ যৌনতা আমাদের জন্য একটা সাংঘাতিক সমস্যা হয়ে গেছে, কারণ দেহের এই মূল জৈবিক ক্রিয়াটাকে আমরা একটা ভোগকর্ম বানিয়ে নিয়েছি। চিন্তা না থাকলে দেখ যৌনতাও নেই। যেমন ধর, তুমি একটা সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকালে যখনই তুমি বলছ যে, এটা একটা সুন্দরী মেয়ে, ইতিমধ্যেই তুমি একটা সমস্যা সৃষ্টি করে ফেলেছ। তখন শুধু চোখে দেখার চাইতে তার হাত ধরাটা বেশি সুখকর, আরও বেশি সুখকর হলো তাকে আলিঙ্গন করা, এমনকি আরও বেশি সুখকর হলো তাকে চুম্বন করাটা, এই রকম। এই প্রবর্ধনটাই হলো আসল সমস্যা। আমার মতে, এখানেই আসল সত্য। আমাদের চিন্তন পদ্ধতি। আমরা যাকে নেচার হিসেবে ভাবি, তা মূলত আর কিছুই না, কেবল আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত ধারণার যোগফল মাত্র। অর্থাৎ আমাদের মনোজগতের অভ্যস্ততা যা দিয়ে গড়ে উঠেছে তারই প্রকাশ মাত্র। এখন আমরা অনেক ক্ষেত্রে বলি, আমাদের নেচার অমুক, আর তা আমরা কালচারের আড়ালে ঢেকে রাখি। এখন একটা সত্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করি, আমরা যখন শুনি কোন বাবা তার কন্যাকে ধর্ষণ করেছে অর্থাৎ জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তা শুনলে আমাদের প্রবল ঝাকুনি দেয়। কেননা দীর্ঘদিনের লালিত বিষয়বস্তুতে মা, বাবা, সন্তান, ভাই, বোন ইত্যাদি আমাদের ধারণার এক বলয় তৈরি করেছে। আর সেই বলয়েই আমরা এই সম্পর্কগুলোর মাঝে স্নেহ মমতা ছাড়া অন্য কোন সম্পর্ক স্থাপনের চিন্তা স্বাভাবিক রূপে আনতে পারি না।
নারী পুরুষের সম্পর্ক নির্ধারণের কাঠামো নির্মাণ করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, আইন, বিদ্যালয়, ধর্মালয়, শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্যও। প্রজননে পুরুষের ভুমিকা আবিষ্কারের আগে নারী লিঙ্গ ছিলো পরম পূজণীয়। আজও গ্রামীণ সংস্কৃতিতে তান্ত্রিক বা গ্রাম্য কবিরাজ কর্তৃক বাচ্চার কোমরে যে কড়ির বন্ধনী দেয়া হয়, তা মূলত নারী লিঙ্গেরই প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত ছিলফ। বর্তমানে ঝাঁড় ফুকে এর ইতিহাস জানা না থাকলেও পরম পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহারের অবস্থান আছে। বর্তমানে ফ্যালিক স্থাপত্যে পুরুষ লিঙ্গের ব্যবহার যেমন! তবে আদি সময়ের সাথে বর্তমানের পার্থক্য একটাই, নারী লিঙ্গকে শক্তির মাধ্যম ধরেও তা দিয়ে নিগৃহীতের ইতিহাস রচিত হবার আখ্যান কিন্তু শোনা যায় না, যা পুরুষ লিঙ্গকে শ্রেষ্ঠত্ব দানের কালে আমূল পাল্টে গেছে। নারী পুরুষের সম্পর্ক উন্নয়নে , বৈষম্যকে নাকচ করতে বিনির্মাণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। যদিও গত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে নারীরা মূলত এই বিষয়ই ঘ্যানঘ্যান করছে। বিনির্মাণটা হবে কোন উপায়ে ? কোন পথে? জ্ঞানের শাখাগুলো ভয়ংকরভাবে পুরুষদের শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। এর প্রাচীর ভাঙা রীতিমতো অসাধ্য, যখন আমরা নারীরাই এই জ্ঞানের দ্বারা বিকশিত। তাহলে উপায় কী? একমাত্র উপায়, কাঠামোর প্রতিটি স্তরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া, প্রচলিত জ্ঞানের উপরিকাঠামো ভেঙে নতুন কোন ধারণার জন্ম দেওয়া। ইতিমধ্যে তা ভাঙছে। নবজন্ম ঘটছে চিন্তা চেতনার। অপেক্ষা আর কয়েকটি দিনের ..।
Camellia Alam is an assistant professor of political science at Tejgaon College, Dhaka. She usually writes columns, and short stories.