ফুরিয়ে যাবার আগেই ক্ষুধার্তের মতো জীবনের সমস্ত শব্দরঙ, রূপ-রস-গন্ধ, ভাষার আকাঙ্ক্ষাকে কুড়িয়ে নিয়ে খাতায় কবিতা আঁকতে শুরু করি

Share this:

প্রশ্নোত্তর:

শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?

সেঁজুতি বড়ুয়া: কলেজের গণ্ডি পেরুইনি তখনো। প্রিয়জনদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে ডায়েরি, নোটবুক, রাইটিং প্যাড এসব পেতাম। নিজেও কলেজের আসা-যাওয়ার খরচ, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কিনতাম। সেসব ডায়েরি, নোটবুকে বড় বড় মনীষীদের ভালো লাগার বচন, উক্তি, বাণী এসব লিখে রাখতাম। এসময় হঠাৎই হাতে এলো এপার বাংলা, ওপার বাংলার কবিতা সংকলন, বুদ্ধদেব বসুর ‘শার্ল বোদলেয়ার’, জয় গোস্বামীর ‘ওঃ, স্বপ্ন’ সহ আরও বেশক’টি বই। কবিতায় এমন মজে গেলাম, মনীষীর বাণীর পরিবর্তে খেরোখাতাগুলো ভরে যেতে লাগলো ছোট ছোট পছন্দের কবিতায়। এরপর টিএসসি-তে একটি নাটকের দলের সাথে যুক্ত হলাম। একদিন  ডায়েরির পাতা উল্টে যাচ্ছি, আমার কো-আর্টিস্ট বললেন, বাহ, তুমি তো ভালো লেখো! আমাদের পড়তে দাও না কেন? ব্যাপারটিকে প্রথমদিকে মজা হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, পরে চুপিচুপি কখন যে লিখতে শুরু করে দিলাম! আমার একলা ছাদের নির্জনতা, জন্মভিটের স্রোতস্বিনী কর্ণফুলী, খাল পেরিয়ে সকালের শিশিরে জমে যাওয়া নদীচর, বিহারের নিমগ্ন অশ্বত্থ সব, সবই খণ্ড খণ্ড মেঘের মতো খেরোখাতায় জমা হতে লাগলো। ডায়েরির পাতায় একদিকে বোদলেয়ার, অন্যদিকে আমার কবিতা। খুব বেশি বড় নয়, চার কি পাঁচ লাইনের। একদিন সেই কো-আর্টিস্টকে প্রথমে আমার লেখা কবিতাটিই দেখিয়ে বলি, আপনি তো পড়তে চেয়েছিলেন, দেখুন তো কেমন? তিনি আবৃত্তির ঢংঙে উচ্চকণ্ঠে চমৎকার পড়ে যান। পড়া শেষ করে অনুরোধ করেন, বুয়েটে নিজের ডিপার্টমেন্টের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এটি পড়ে আমার কাব্য প্রতিভার কথা  ছড়িয়ে দিতে চান। তখন থেকেই নিজের মধ্যে পরিহাস্যময় কেমন এক অজানা আনন্দ, অস্পষ্ট ভাঙন টের পাই! এতেদিন অন্যের কবিতাকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে লুকিয়ে গভীর রাতে নয়তো দরজা বন্ধ করে লিখতাম। এখন ধীরে ধীরে সমস্ত কবিতা ডায়েরিগুলো প্রকাশ্য হতে থাকে। নাটকের দলে কবি পরিচিতি জোটে। টিএসসি সড়কদ্বীপে বা অন্য কোথাও দলের পথনাটক বা শো থাকলে নিজের কবিতাও পড়তে হয়। যদিও স্কুল ম্যাগাজিনে আমার প্রথম প্রবন্ধ ‘পেন্সিল’ প্রকাশিত হয়, যখন আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি।

কিছুদিন পর কাছের এক বন্ধু জোর করে ধরে পত্রিকা অফিসে নিয়ে গেল। শুক্রবারের সাময়িকীতে কবিতা আসে! খুশিতে উপচে পড়া আমার সেই আনন্দ আর কে দেখে! এরপর ফুরিয়ে যাবার আগেই ক্ষুধার্তের মতো জীবনের সমস্ত শব্দরঙ, রূপ-রস-গন্ধ, ভাষার আকাঙ্ক্ষাকে কুড়িয়ে নিয়ে খাতায় কবিতা আঁকতে শুরু করি।

 

শুদ্ধস্বর: আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিকবোধ, নিজস্ব ভাষাশৈলির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী।

সেঁজুতি বড়ুয়া: কবিতা অবাধে ফুল, পাখি, প্রকৃতির নন্দন জগতে চলাফেরা করলেও কখনো কখনো সাম্প্রদায়িকতার রোষানলে পড়ে, অর্থ সংকটে দিন কাটায়, পারিবারিক সম্পর্কচ্ছেদের দীর্ঘশ্বাসে আটকে গিয়ে হাঁসফাঁস করে। এগুলোই একজন লেখককে রাজনীতি, সামাজিক নিষ্পেষণ, এক জাতির প্রতি অন্য জাতির বিদ্বেষমূলক আচরণ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। তখন কবিতায় সুগন্ধী ফুলের বদলে ভয়াবহ কাঁটা, নিষ্প্রভ পাতা বারংবার মানবিকতার দেয়ালে আঘাত হানে। চারপাশের ঘটনাগুলো এমনভাবে ধেয়ে আসে যখন  এক সময়ের দুরন্ত কিশোরবেলা ইতস্তত পায়ে তারুণ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সোনার চামচ মুখে না দেয়া আমিও ঘর-মনের কবাট বন্ধ রেখে বন্ধুতায় দুরত্ব বাড়াই, নতমুখে রাস্তা পেরুই, মায়ের একাকীত্বের পাশে দাঁড়িয়ে গভীর রাতে ফুঁপিয়ে কাঁদি! তখন সমস্ত চিন্তাচেতনাকে বিবশ করে দিয়ে সেই অন্ধকারে কবিতা আমাকে আপাদমস্তক গ্রাস করে ফেলে। ফলে জীবন চেঁছে তুলে আনা সমস্ত শব্দনির্যাস, বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখা দানাদার হতাশা সহ সমস্তকিছুই কবিতায় অবাধে প্রবেশ করতে থাকে।  আমার গদ্য কিংবা কবিতা তাই আলাদা কিছু নয়। গোপন ডাকবাক্সে এক-দু’দিন পর পর, কিংবা সপ্তাহান্তে বা পনের দিনে, মাসে অন্তত একবার হলেও স্তব্ধ সময়ের লেখা পোস্ট করে যাই।

 

শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

সেঁজুতি বড়ুয়া:  কবিতায় শ্লীল-অশ্লীল বলে কিছু নেই। যে ভাষাতেই তা লেখা হোক না কেন, শিল্পগুণই এখানে মুখ্য বিষয়। কবিতায় শব্দ বা ভাষার প্রয়োগেই যদি এই শ্লীল-অশ্লীল প্রসঙ্গটি উঠে আসে, তাহলে চিন্তার আরও গভীরে গিয়ে দেখা যাবে, এই ভাষাই সাহিত্যে এমন এক বাঁকবদল তৈরি করে যেখানে সমসাময়িক সমাজের চিন্তাচেতনা, দৃষ্টিভঙ্গী, সাংস্কৃতিক আচরণ সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা পাওয়া যায়। সেরকম হলে বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ আগেই সেই দোষে দুষ্ট হতো, কারণ রূপমুগ্ধ  রাবণ দণ্ডকারণ্যে সীতাকে প্রথম দেখেই নারীরূপের যে শরীরসর্বস্ব বর্ণনা দেন কিংবা বাল্মীকির ‘রামায়ণ’ যাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল, কবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’-ও অশ্লীল কবিতা হিসেবে আগে আখ্যা পেতো। কেননা, এ কাব্যে দেহের সৌষ্ঠব-বর্ণনায় যেভাবে এ অঞ্চলের নারীদের সৌন্দর্যের মাপকাঠি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সেখানে পাঠকের কাছে শ্লীল-অশ্লীলতা নয়, এর অসামান্য কাব্যমাধুর্যই গুরুত্ব পায়।

 

শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যে কোনো সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।

সেঁজুতি বড়ুয়া: এটি তো সত্যি, ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা শহরকে ঘিরে বাংলা সাহিত্যের যে নতুন যুগ শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকে ধরলে পশ্চিম বাংলার সাহিত্য বাংলাদেশের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে আছে। এটির কারণ হয়তো সেখানকার যুগোপযোগী সাহিত্য। তবে পশ্চিম বাংলায় গদ্য যতোটা পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে, কবিতা ততোটা নয়। যেমন- জীবনানন্দ দাশ, উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়ে যেমন আলাদা করা যায়, এখনকার কবিদের কবিতা পড়ে সেভাবে আলাদা করা যায় না। একই দশা, বাংলাদেশের কবিতায়ও চলছে। তবে আশার কথা, বাংলাদেশের কবিতা এখন ছন্দ, প্রকরণ, শব্দ অলংকারের পাশাপাশি সুমিষ্ট আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারে অন্য সুরে গান গাইছে। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে শহুরে ভাষার সাথে হিন্দি, ইংরেজি মিলেমিশে একাকার। পশ্চিমবঙ্গের পাঠক তাদের সাহিত্যের ব্যাপারে খুবই উৎসাহী। বই কেনার সময় এদের অনেকেই আবার লিটল ম্যাগাজিনের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখেন। যেকারণে সাহিত্যকে জীবিকা হিসেবে নেয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে জনপ্রিয় ধারার সুনির্দিষ্ট কিছু লেখক ছাড়া সাহিত্যের পাঠকের অবস্থা শোচনীয়, সাহিত্য বাজারের অবস্থাও ভালো নয়। এমনকি এখানকার স্বনামধন্য পত্রিকাগুলোও লেখা ছাপা হবার পর তরুণ কবিদের প্রাপ্য সম্মানিটুকুও দিতে চান না।

 

শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।

সেঁজুতি বড়ুয়া: একসাথে বেশকিছু বই পড়া ও নাড়াচাড়া করার অভ্যেস। যদিও  এ মুর্হূতে পড়ছি বুদ্ধদেব বসু’র ‘তিথিডোর’। কেমন যেন মন হু-হু করা হাহাকারে বিদ্ধ উপন্যাস। কৈশোরে পড়েছিলাম। মানসিক পীড়ন থেকে বেরুতেই আরেকবার এই মিষ্টি, সতেজ উপন্যাসটি ঝালাই করে নেয়া। স্বাতী বা সত্যেনের বইয়ের ভাঁজে ডুবে থাকা নিঃসঙ্গতাকে উপজীব্য করে এবং এদের চারপাশের আটপ্রৌঢ়ে সাধারণ জীবনযাত্রার অন্তঃসারশূন্যতা এখানে লেখক সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এর পাশাপাশি বইমেলা থেকে সংগ্রহ করা কিছু বইও উল্টেপাল্টে দেখছি। এগুলোর মধ্যে মোস্তাক শরীফের ‘আলমপানাহ’ রয়েছে। বিডি আর্টসে নিয়মিত পড়তাম। সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের প্রেমাখ্যান ও মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে চমৎকার একটি উপন্যাস। ভালো লাগছে।

 

 

কবিতা:

ক্রমাগত যা শুধু হারাই

কয়েকটা নিশি আমগাছ পিঁপড়ের বাসার ওপর হেঁটে যেতে যেতে

প্রচণ্ড উপেক্ষায় আমাদের চুমু খাওয়ার সবুজ অন্ধকার পিষে দিয়েছিল

সেই পথের বাঁকবদলে গেলে- ঠোঁট এতো শুষ্ক, পিপাসার্ত থাকে

যেন গলা পেঁচিয়ে নিঃশ্বাসে ওঠা-নামা করে এক আহত চন্দ্রবোড়া সাপ

জিহ্বায় স্বপ্নদৃশ্য খুঁড়ে আমার সমস্ত ঠোঁটক্ষুধা নিয়ে পালায় প্রেমিক

আশ্চর্য করুণচোখে সরে যায় ভোর বন-বাদাড়ের এপাশে, ওপাশে

আর আমি জারুল গাছের নিচে সবুজ অন্ধকার খুঁজে পেয়ে কতো না খুশি!

 

যা কিছু ঘটেছিল, সবই কাল্পনিক!

রাতে কী, কীসব মনে হয়েছিল, সারারাত সে করেছে এপাশ, ওপাশ

ক্লান্ত চোখে তাকিয়েছিল অন্ধকারে, এখুনি দেখতে পাবে বীভৎস লাশ

এর আগে দেখতো তরুণী মাকে, কারা যেন আক্রোশে, টানছে সেগুনবনে

ব্রিজের ওপর ট্রাক, জ্বলে ওঠে সংকেতে, মা তখন যেন জ্যোস্না  দুলছে জনে জনে

রাতে কী, কীসব মনে হয়েছিল, সে বালিশে মাথা রেখে, মুখ ঢেকেছে অনুশোচনায়

ক্লান্ত চোখে তাকিয়েছিল সিলিংফ্যানে, যেন ঝুলছে রাইকিশোরী, ধ্বস্ত পায়..

 

দেউলিয়া

আমরা মাটিতে পা পোড়াই, কাঁটা বিঁধি- তবুও পাঁচিল ঘেঁষে চর্যাপদের স্বপ্নকে তিলেতিলে গাঁথি

জীবনের খাঁজে খাঁজে নিজেদের সঞ্চিত অভাব ঢাকি, কাঁটাঝোপের আগুনে দুঃখকে জমায়েত করি

তবুও যত্নে ক্ষুধার্ত অতিথির পাতে তুলে দেই লাউডগা, কুমড়ো ফুলের বড়া, সজনে পাতার ঘণ্ট

তৃপ্তির ঢেঁকুরে অতিথি খুনে দৃষ্টিতে তাকায়। সমস্ত হারাতে হারাতে চোখে সর্ষেফুল দেখি

দিনেশেষে ঋণ করে বোনা আমাদের খড়কুটোর সামান্য বাসা গিলে নেয় অভুক্ত অজগর

 

প্রতারণা

আশ্চর্য চকমকি পাথরে ঢেউগোণা রাত বসে আছে একা। জীবনের আনাচে-কানাচে

পাহাড়ি মলিন মুখ এক বাতাসের আদি ভূস্বর্গে রাতের আলাদা অর্থময়তা খোঁজে।

না সে উড়ন্ত শ্যামা পাখি নয়, না মুক্তোদানা, না ইলোরা-অজন্তার নৃত্যরতা ছায়া

তবু শ্যামের শঠতা লোহার খাঁচায় পুরে একেএকে লুঠ করে নেয় তার স’বি।

সোনা-রুপা মেশানো পবিত্রতা ভেঙে দিয়ে গেছে মন, সমস্ত সম্পর্ক আজ আতংক

একেকটি মৃত্যুর মতো অচিহ্নিত কালো রাত বুকের বন্দরে অস্থির সাইরেন তোলে

পাহাড়ি অপ্রস্তুত মুখ সম্পর্ক ও পরিণয়ের ক্ষতচিহ্নগুলো তুলে রাখে পাথর ফলকে!

 

হার মানা হার

ঝড়ের পূর্বাভাসে পাখি দিকভ্রান্ত হয়, ব্যূহচক্রে পড়ে পাখি- অসতর্ক ওড়াওড়ি করে। কে সঙ্গ দেবে তাকে, চেনাবেকে রাত্রি নিমর্মতা? বিষের পৃথিবী যেন নীলে জরোজরো শঙ্খচূড় বিষে।

অস্পষ্টে যে খোলে জাল- ছোবলময় মৃত্যুশিথিলতা, চুপিচুপি সে-ই ছাঁটে ঘাসের পেলব ডানা! সুনিপুন হাতেএকেকটি পালক তুলে মাংসে দেয় গেঁথে গোলাপের চিরন্তন মিথ। সে যে এখন বধির অন্ধ এক গোলাপ সুন্দরী! উড়িবার সাধে, লুকায় অসুখী মুখ আজীবন লোহার শেকলে!

 

সন্ধ্যায়, তীব্র সমুদ্র

 প্রতি সন্ধ্যায়, আমি আর ভবঘুরে সমুদ্র- অবচেতনে, বিষাদের উড়ন্ত পথে মাউথঅর্গান বাজাই।কখনো, কখনো ফাঁকা নির্জনে সে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, কখনো ঢেউয়ের ফণা তুলে বোঝাপড়ার ঊর্দ্ধে চলে যায়। হাত ধরে স্ফটিক অরণ্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়, ঠেলে দেয় দূ-রে, পরিহাসময় অমীমাংসিত রাত্রিকালীন সংলাপে-

দাঁড়াও, স্থির হও! পায়ে মন্থন করো ঘুমহীন, সুতীব্র জলের কোরক। তোমার মরুসংসার কাঁটাঝোপের মতো জবুথবু, দলা পাকিয়ে ঘুমায়। ফুটে উঠেছিল যে অনন্ত মিথ ফুল, তা এখন তিনবেলা মগজ চিবায়। অনুভব করো- কান্নার প্রস্রবণ থেকে বেরিয়ে ঝাউের অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে যেতে হেমফেনিল স্রোতে, বিস্মরণের দাগে দাগে পা ফেলছো তুমি। নোনাগন্ধী অসীম বিস্তার চোখের সামনে ঢেউ বদলের বাঁকে বাঁকে দুলে দুলে ওঠে। না বালি, না কোনো বালিয়াড়ি- রেখে যাও পায়ের ছাপে আসমুদ্র জলপিপাসা। কুয়াশাঘন এই ক্রোশ ক্রোশ নিষ্কলঙ্ক গভীর ওঙ্কারে খুঁজে নাও গোপন আস্তানা।

বালিকা মিথুনরাশি, টের পাও- তোমার সমস্ত ক্রন্দন শুষে নিতে, আমি গাই ক্ষুধার্ত বুদ্বুদ সঙ্গীত? সমস্ত গোপনতা খুলে তোমাকে দেখাবো বলে একখণ্ড নতুন সন্ধ্যায় রাশি রাশি জলে হাজির হয়েছি! টের পাও, ঢেউশীর্ষে আমি কতটা অর্থব, একা? বয়ে বেরাচ্ছি উন্মাতাল ক্রোধে কামাতুর নীলাভ স্রোতের লালা বিস্তৃত জল আয়নায়।

এই মৃদু স্তবগান ঢেউয়ের নির্জনতায় গ্রাস করে প্রতিদিন, প্রতিটি সন্ধ্যায়। এইসব জড়ো হওয়া নিঃশব্দ গর্জন, অলৌকিক বিপুল বিস্ময়ে কাঁপতে থাকা প্রেমিকের জলচূর্ণ স্খলন আর শঙ্খ-ঝিনুকের বিবিধ আধখানা খোলে মোহগ্রস্ত আমি- উৎকর্ণ হরিণীর কাঁপুনিতে জ্বরতপ্ত মেঘমঞ্জরি হয়ে যাই!

 

বন্ধুনাম

তোমাকে দুশ্চিন্তার মতো ভয় পাই। বোবা হয়ে যাই- যখন মুঠোয় সবুজ আঙুরদানা ভরেও ক্রূর হাতে কেড়ে নাও সমস্ত।

 

আমার আনন্দেরা পথে পথে নিঃসঙ্গ পাখির ডানায় ছড়ানো। উড়ন্ত বাজের ছোবলে, পথে এমন তীব্র বিষাদছড়াও- আতংকে পাখিরাও পালায় ওপারে, বিমর্ষ মেঘশূন্যতায়।

ফাঁদ পেতে অনিঃশেষ ছোবলে ছোবলে পান করো প্রেমান্ধ সরলতাটুকু। ভীতিকর ঈর্ষায় ঢুকে পড়ো ব্যক্তিগত চিলেকোঠায়। তখন আমার সুহৃদ-বন্ধুরা, যেন তুমি কত আপন, বিছিয়ে দেয় রোদে- হাতে বোনা নরোম মাদুর।আমার পায়ের মাটি ক্রমশ দূরে সরে যায়, মনের স্তুপে শিলাবৃষ্টি ঝড় তুমি ও তোমরা সহ সমস্ত বন্ধুনাম উড়ে যায়…

More Posts From this Author:

    None Found

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!