“প্যারিস শহরের পখ দ্যা লাশাপিল এলাকায় বসবাস করি। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে আমি ফ্রান্সে আসি। আমি ফ্রান্সের একজন অনিয়মিত বাসিন্দা। গত ১৬ মার্চ থেকে আমার কাজ বন্ধ রয়েছে। খুবই আর্থিক সমস্যার মধ্যে দিন যাপন করছি। আমি যেহেতু অনিয়মিত বাসিন্দা সেহেতু ফ্রান্স সরকার যে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দিবে তা থেকে আমি কোন উপকৃত হবো না।”
উপরের কথাগুলো বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার এম সানির।
সানির বক্তব্যই এখন প্যারিস তথা ফ্রান্সে বসবাস করা অনিয়মিত বাংলাদেশীদের কথা। এখানে এসে ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত কারণে বাংলাদেশের মানুষরা সবক্ষেত্রেই অনেক পিছিয়ে থাকে, অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই পিছিয়ে থাকার বা সমস্যার মধ্যে পড়ার কিছু কারণ রয়েছে । সবচেয়ে বড় কারণ হলো এখানে ফরাসী ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় লোকজন কথা বলতে চায়না। বিশেষ করে ইংলিশ ত নয়’ই। বেশ কিছু সরকারী অফিসে আমি গিয়েছি, দেখেছি, কোনভাবে ইংলিশ ভাষায় কথা বললে উনারা (অফিস কর্মকর্তা/কর্মচারী) কথা বলতে চান না। যেমন আমি ব্যক্তিগত ভাবে উর্দু ভষায় কথা বললে তার সাথে কথা বলতে চাইনা ঠিক এই ভাবেই। ভাষাগত এই বৈষম্যের মূল কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে কিছুটা ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে। যাই হোক যা বলছিলাম, আমরা বাংলাদেশিরা বাংলার পর দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিখি , শিখতে চাই। কিন্তু এখানে সেই ইংরেজি ভাষা সচরাচর ব্যবহৃত হয়না বলেই আমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারিনা এবং বোঝাতে পারিনা।
তারপরের কারণটি হলো, ফ্রান্সে বসবাসরত বেশির ভাগ বাংলাদেশীরা এখানে এসে পড়ালেখা করেন না, বা ফ্রান্সে বাংলাদেশীদের জন্য স্টুডেন্ট ভিসার সুযোগ কম।
তৃতীয় কারণটি হলো , ইমিগ্র্যান্ট হওয়ার আশায় ফ্রান্সে থাকা বাংলাদেশীরা আওয়ার সেলারি মেইনটেইন না করেই যেখানে সেখানে কাজে লেগে যান। বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দোকান গুলোতে ঘণ্টা দুই বা ৩ ইউরো পারিশ্রমিকে কাজ করেন। এদেরকে নিজের এবং দেশে থাকা পরিবারের আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে দৈনিক বার তেরো ঘণ্টা কাজ করতে হয়। একজন ব্যক্তিকে যদি দিনে বারো তেরো কাজ করতে হয় তাহলে তার ক্যারিয়ার ডেভলাপ বা নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার কোন সুযোগই থাকেনা । এভাবে প্রতিবছর কার্ড নবায়ন করার জন্য কাজ করতে করতে পেশা পরিবর্তন বা উন্নয়নের অন্য কোন সুযোগ তারা আর নিতে পারেন না।
এসব দৃশ্যমান সমস্যার বাইরে আরো কিছু সমস্যা আছে, যা নীরব বা ইন্টারনাল। ফ্রান্সে প্যারিসে আবাসন সংকট এক মহা সংকটের নাম। এখানে নিজের একটি বাসা থাকা মানে সোনার হরিণ থাকা। প্রায় চারভাগের তিনভাগ বাংলাদেশী এখানে “ম্যাছ” বা বাউন্ডিং ব্যাচেলর সিস্টেমে বসবাস করেন। ছোট একটি ঘরে আট নয়জন থাকেন বেড শেয়ার করে। আর এই পাঁচমিশালি মানুষজন একসাথে থাকার কারণে অভ্যাসগত বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে কলহ লেগেই থাকে, যার প্রভাব পড়ে সামাজিক কার্যক্রম গুলোতে। যেমন – বাস্তুহারা বাংলাদেশীকে দুই গ্রুপ সহায়তা করবে যেকোন একটি ব্যাপারে । কিন্তু সহায়তা করার আগে বিবেচনা কবে করা হবে , মানুষটা কোন অঞ্চলের , বাড়ি কোথায় এবং কোন জেলার। এসব বৈষম্য এখানে প্রকাশ্য। এক এলাকার লোকজন আরেকজনকে ভালো চোখে দেখেনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় শেষ পর্যন্ত সাহায্যপ্রার্থী মানুষটি কোনরকম সহায়তাই পায় না।
রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মত বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব তো আছেই । প্রথমে রাজনীতির কথা বলি। আওয়ামী লীগের অনুসারীরা সবসময় হাইকমিশন কেন্দ্রিক । হাইকমিশন কেন্দ্রীক সব সুযোগ-সুবিধা এবং চ্যানেল এদেরই আয়ত্তে। ঠেকায় পড়া মানুষেরা এটাকে জমিদারগিরির সাথে তুলনা করেন। অপরদিকে যারা বিএনপি বা ডানপন্থি কেন্দ্রিক তারা প্যারিসকেও নয়াপল্টন ভাবেন। এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত। শুধু তাই নয়, বিগত দিন গুলোতে সাধারণ নিরীহ বাংলাদেশিরা, বাংলাদেশিদের মাধ্যমে এত পরিমাণ দালালি ফ্রড মানুষের ক্ষপ্পরে পড়েছেন , সহযোগিতার নামে পেছন পেছন ঘুরেছেন কমিউনিটি নেতাদের, যে এখন কাউকে বিশ্বাস করতেই ভয় পান, বা কেউ যদি সহযোগিতার হাত বাড়ায় তাকেও দালাল ভাবতে শুরু করেন! আমার জানা মতে এখন পর্যন্ত দুই ধর্মের ব্যাচেলরা একসাথে আছেন একটি বাসা ভাড়া নিয়ে এটা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। ঠিক বাংলাদেশের মত ধর্মগত নীরব বিভক্তি এখানেও আছে।
অপরদিকে প্যারিসে বসবাস করা বিশাল জনগোষ্ঠী হচ্ছে এরাবিয়ান অর্থাৎ আলজেরিয়ান, তিউনিশিয়ান, লেবানন, মরক্কো ইত্যাদি দেশের লোক। আছে আফ্রিকান বিশাল জনগোষ্ঠী । যুগযুগ ধরে তারা এই প্যারিসে বসবাস করছে অপরপক্ষে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীরা হলো দ্বিতীয় স্টেজ বা সেকেন্ড জেনারেশন ।
উপরে বলছিলাম ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সংস্কৃতি-গত ঘাটতি, ভাষা-গত সমস্যার কথা এখন আসি কোভিড ১৯ ভাইরাসে লক ডাউন ফ্রান্সে বাংলাদেশিদের কিছু কথা নিয়ে।
ফ্রান্সের অভারভিলা শহরের ব্যবসায়ী আহমেদ হোসাইন, চট্টগ্রামের লোক। ফ্রান্সে বসবাস করছেন দীর্ঘ ১১ বছর থেকে। উনার একটি ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট আছে। উনার সাথে কথা হচ্ছিল দুদিন আগে । ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে কথার প্রসঙ্গে বলেছেন, “গড়ে আটশ থেকে তেরো’শ ইউরো উনার দৈনিক লোকসান হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের কারণে গত ১৬ মার্চ থেকে লক ডাউন। ব্যবসা বাণিজ্য একেবারেই মন্দা”। এখানে আমার আরও একটি বিশ্লেষণ আছে। গত জানুয়ারি মাস পুরোটাই ফ্রান্সের পরিবহন সংগঠন বিভিন্ন দাবীতে পুরো মাস’ই স্ট্রাইক পালন করেছে। সেই জানুয়ারি মাসেই গড়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের লোকসান ছিল ৭ থেকে আট হাজার ইউরো। একমাস ঘুরতে না ঘুরতেই আবার লক ডাউন। আবার লোকসান। যদিও ফ্রান্সের সরকার বলছে, ক্ষতিগ্রস্থদের প্রণোদনা দেওয়া হবে। কিন্তু এতে যে খুব একটা লোকসান পুষিয়ে উঠবে তা নয়। এর অন্যতম কারণ হলো, ট্যাক্স, ভ্যাট এবং কর্মী নিয়োগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাগজপত্র খুব একটা ক্লিয়ার নয়। এই ক্লিয়ারনেস না থাকার কারণে কতখানি সরকারি প্রণোদনা সুবিধা পাবেন তা নিয়ে সবাই সন্দিহান।
এবার আসা যাক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত একজন বাংলাদেশির কথা নিয়ে। করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি গিয়েছিলেন হাসপাতালে। প্রাইমারি অবস্থা দেখে উনাকে ডোলে-ফিন (প্যারাসিটামল) এবং কিছু ভিটামিন সি প্লাস ক্যাপসুল দিয়ে উনাকে পাঠানো হলও আইসোলেশনে অর্থাৎ একটি হোটেলে। সেখানে তিনি ছিলেন চৌদ্দ দিন। কিন্তু এই চৌদ্দ দিনে হোটেলের যা খরচ এসেছে সেটা নিজেকেই বহন করতে হয়েছে। যেহেতু তিনি ফ্রান্সের ইমিগ্র্যান্ট নন অর্থাৎ অনিয়মিত বাসিন্দা সেহেতু তিনি স্বাস্থ্য সুবিধার খরচ সরকারের নিকট থেকে পাওয়ার কথা না। দৈনিক ৩০ ইউরো খরচের এই হোটেল বিল পুরোটাই তিনি বহ্ন করে দিশেহারা। একে ত উনার পার্মানেন্ট কোন কাজ নেই এর মধ্যে ৪২০ ইউরো হোটেল ভাড়া। এরকম নীরব অর্থনৈতিক চাপে আছেন শত শত বাংলাদেশী ।
এই হচ্ছে ফ্রান্সে থাকা বাংলাদেশিদের অবস্থা বা দূরাবস্থা। প্রায় আশি শতাংশের মত বাংলাদেশি এই করুণ অবস্থার মধ্যে আছেন। দূরে থেকে মনে হয় সোডিয়াম আলোর ঝলমলে শহর, আইফেল টাওয়ার , ল্যুভর মিউজিয়ামের দেশ ফ্রান্স কত না রঙিন বিচিত্র। কিন্তু কঠিন ও রূঢ় বাস্তবতার ঘানি টেনেই চলছে বাংলাদেশীদের জীবন।
Chowdhury Maruf, a citizen journalist and writer. Publishers and moderator of “motamot blog”
More Posts From this Author:
- None Found