বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের জনপ্রিয় পাঠ ও তার সীমাবদ্ধতা

Share this:

বাংলা‌দে‌শের উপকূলীয় অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্পগু‌লো জলবায়ু প‌রিবর্তনের জনপ্রিয় ও ভ্রান্ত পাঠ দ্বারা প‌রিচা‌লিত। এর প্রধান কারণ হ‌চ্ছে বাংলাদে‌শের উন্নয়ন কারখানাগু‌লো জলবায়ু প‌রিবর্তন সম্প‌র্কে যে জ্ঞান উৎপাদন ক‌রে তা অ‌নেকাং‌শে সীমাবদ্ধ। পুঁজির কতৃত্ববাদী উন্নয়নের ধারণার মধ্য থে‌কেই আর্ন্তজাতিক দাতা‌গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রযন্ত্র জলবায়ু প‌রিবর্তন‌কে প্রতিহত কর‌তে চায়। এগু‌লো অর্থনৈ‌তিক উন্নয়ন ও প্রগতিশীলতার জ্ঞানভা‌ষ্যের মাধ্যমে জলবায়ু প‌রির্তন‌কে ন্যায্যতা প্রদান করে। বালো‌দে‌শের জলবায়ু সম্প‌র্কিত উন্নয়ন প্রকল্পগু‌লো অ‌ধিকাংশ ক্ষে‌ত্রেই প‌রি‌বে‌শের ভ্রান্ত পা‌ঠের জন্ম দেয়। এ‌টি উপকূলীয় বন্যাকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভা‌বক হি‌সে‌বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণের ম‌ধ্যে সংকু‌চিত ক‌রে রা‌খে। বন্যা প্রতি‌রো‌ধের প্রকল্পগু‌লোই বর্তমা‌নে জলবায়ু প‌রিবর্তন প্রতি‌রো‌ধের ব্যর্থ প্রকল্প হি‌সে‌বে ব্যবহৃত হ‌চ্ছে। প্রধানত বাঁধ নির্মাণকে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতি‌রো‌ধের অন্যতম কৌশল হি‌সে‌বে উপস্থাপন করা হয় যা বাস্তুসংস্থা‌নের স্বাভা‌বিক প্রক্রিয়া‌কে ব্যহত ক‌রে ব‌লে ঐতিহাসিক এবং স্থানীয়ভাবে প্রমা‌ণিত। জলবায়ু প‌রিবর্তন ও বন্যা প্রতি‌রো‌ধে বিশ্ব ব্যাং‌কের ম‌তো দাতা‌গোষ্ঠীগু‌লোর যেসব প্রকল্প র‌য়ে‌ছে তার প্রধান লক্ষ্য হ‌চ্ছে বাংলা‌দে‌শে ব্যাপক হারে বাঁধ তৈ‌রি করা। উপকূলীয়  অঞ্চলে বন্যা প্রতি‌রো‌ধের জন্য বাঁধ তৈ‌রির কৌশল হ‌চ্ছে ঔপ‌নি‌বে‌শিক শাসনাম‌লের নির্মাণ। য‌দিও এর পূ‌র্বে এসব  অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ করা হ‌তো কিন্তু তা ছি‌লো ভিন্ন উ‌দ্দে‌শ্যে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনের প্রথম বাঁধগুলি বন্যা প্রতি‌রোধ করার জন্য তৈরি করা হয়নি বরং বন উজাড় ক‌রে আবাদযোগ্য জমি সম্প্রসারণের জন্য তৈ‌রি করা হ‌তো। এছাড়া এসব অঞ্চলে লবণাক্ততা প্রতি‌রোধের জন‌ সাম‌য়িক বাঁধ তৈ‌রি করা হ‌তো।  এসব স্থানীয় বাঁধগু‌লো‌কে প্রয়োজনম‌তো সহ‌জেই প্রত্যেক বছর মেরামত করা যেত। অন্যদি‌কে ব্রিটিশ প্রশাসন কতৃক নি‌র্মিত বাঁধগু‌লো‌ ছি‌লো বৈজ্ঞা‌নিক প্রযু‌ক্তি হি‌সে‌বে আধু‌নিকায়‌নের প্রতীক  যা‌কে খুব বে‌শি মেরাম‌তের প্রয়োজন ছাড়াই সহ‌জেই প‌রিচালনা করা যায়।

ঔপ‌নিবে‌শিক শাসনামলে বাংলা অঞ্চ‌লের জীবন যাপ‌নের জল‌ভি‌ত্তিক দৃ‌ষ্টিভ‌ঙ্গি ও ব্যবস্থাপনা গুরুতর প‌রিবর্তন ঘ‌টে। তখন থে‌কে সবধরণের বন্যাকে দেখা হ‌তো জীবন ও সম্প‌ত্তির জন্য ক্ষ‌তিকারক বিষয় হি‌সে‌বে। বি‌শেষত বর্ষাকালীন বন্যাকে বাস্তুসংস্থা‌নের জন্য উর্বরতার আশীর্বাদ হিসাবে স্বীকৃ‌তি প্রদান থেকে সরে গি‌য়ে সমস্ত বন্যাকে ঔপ‌নি‌বে‌শিক ব্যবস্থাপনা ও জ্ঞানভা‌ষ্যের ম‌ধ্যে ক্ষতিকারক হিসাবে চি‌হ্নিত করা হয়। ঔপ‌নি‌বে‌শিক শাসক‌দের প্রধান সমস্যা ছি‌লো বন্যা হ‌লে যোগা‌যোগ বি‌চ্ছিন্নতার কার‌ণে সহ‌জেই রাজস্ব সংগ্রহ করা যেত না। তখন বন্যার সমস্যা‌কে প্রযুক্তিগতভাবে মোকাবেলা করার জন্য স্থায়ী বাঁধকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু ব্রিটিশ‌দের এই প্রযু‌ক্তি জলরোধী বাঁধ হি‌সে‌বে মৌসুমী বন্যার প্রাকৃ‌তিক প‌রি‌স্থি‌তি‌কে বাধা প্রদান করত, যার ফলে ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পা‌নি সেচ ব্যাহত হত। ঔপ‌নি‌বে‌শিক প্রযু‌ক্তিক দৃ‌ষ্টিভ‌ঙ্গি ও ব্যবস্থাপনা বন্যা ও নদীর গ‌তিশীলতা‌কে তাৎপর্যহীন ক‌রে তু‌লে। স্থানীয় বাঁধকে সে‌চের দরকা‌রে খুব সহ‌জেই চাষাবা‌দের জন্য উন্মুক্ত করা যেত। পুকুর এবং নদীর পাড় কে‌টে প্রয়োজনম‌তো প্লাবন সেচ ব্যবস্থায় প্রয়োজনম‌তো জ‌মি‌তে পা‌নি আনা হ‌তো। আধু‌নিক সেচ ব্যবস্থার অন্যতম পু‌রোধা ও বৃ‌টিশ প্রকৌশলী উই‌লিয়াম উইলকক্স বাংলার প্রাচীন সেচব্যবস্থা‌কেই এ অঞ্চ‌লের প‌রি‌বেশ বি‌বেচনায় গুরুত্বপূর্ণ হি‌সে‌বে চি‌হ্নিত ক‌রে‌ছেন। বাংলার প্রাচীন সেচব্যবস্থা‌ ছি‌লো প্লাবন সেচব্যবস্থা। এই সেচব্যবস্থা ফস‌লের উৎপাদন বৃ‌দ্ধির জন্য সব‌চে‌য়ে অনুকূল ব্যবস্থা, কেননা প্লাবন সেচ জমির অম্লতা ও বন্ধ্যাত্বতা ক‌মি‌য়ে জ‌মির উর্বরতা বৃ‌দ্ধি ক‌রে। এই সেচ ব্যবস্থা মা‌ছের উৎপাদন বৃ‌দ্ধি ও পা‌নির উচ্চপ্রবা‌হের মাধ্যমে বসন্তকা‌লে ম্যালে‌রিয়ার জীবাণু প্রতিহত করার ক্ষে‌ত্রে বি‌শেষ ভূ‌মিকা রাখত। কিন্তু ঔপ‌নি‌বে‌শিক পা‌নি ব্যবস্থাপনা ও স্থায়ী বাঁধের ফ‌লে কৃ‌ষির সা‌থে নদীর যে স্বাভা‌বিক সম্পর্ক সে‌টি ব্যহত হ‌তে শুরু ক‌রে। জল‌নির্ভর অঞ্চল‌কে তার অর্ন্তনি‌হিত প্রবণতা থে‌কে বি‌চ্ছিন্ন করা হয়।‌ বি‌শেষত ঔপ‌নি‌বে‌শিক শাসক‌দের তৈ‌রি বাঁধের ফ‌লে ব-দ্বী‌পের সমতল জ‌মি‌তে প্লাবন সে‌চের পথ রুদ্ধ হ‌য়ে যায়। এর ধারাবা‌হিকতা পা‌কিস্তান ও বাংলা‌দশে শাসনাম‌লে লক্ষ‌ণীয়।

১৯৬১ সালে, নবনির্মিত পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (EP-WAPDA) উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের (CEP) জন্য USAID এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে তহবিল লাভ করে। এই প্রক‌ল্পের কাজ ছি‌লো বাংলাদেশের সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চলে চার হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সম‌য়ে পূর্ব পা‌কিস্তা‌নে প্রযুক্তিগত সহায়ক হি‌সে‌বে মা‌র্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠান (বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জা‌তিক মুদ্রা তহ‌বিল) বি‌শেষভা‌বে স‌ক্রিয় ছি‌লো।  সূচনা পর্ব থে‌কেই এসব প্রতিষ্ঠান উন্নয় ও সহ‌যোগীতার না‌মে প‌রি‌বেশ এবং সমা‌জের উপর তা‌দের হস্ত‌ক্ষেপ‌কে বৈধতা প্রদান ক‌রে আস‌ছে। বিদেশি ঋণের অ‌বি‌চ্ছেদ্য অংশ হি‌সে‌বে দাতাগোষ্ঠী সামাজিক ও প্রাকৃ‌তিক প‌রি‌বে‌শের উপর প্রযু‌ক্তিগত হস্ত‌ক্ষেপ ক‌রে থা‌কে। প‌শ্চিমা দাতারা আধু‌নিক প্রযু‌ক্তি ও প্রকৌশ‌লের জ্ঞান‌কে ঔপ‌নি‌বে‌শিক ধারাবিা‌হিকতার উত্তরা‌ধিকার হি‌সে‌বে প্রত্যেক অঞ্চ‌লে সার্বজনীনভা‌বে প্রয়োগ ক‌রে আস‌ছে। দাতা সংস্থা ও দেশগু‌লো বাংলাদে‌শের প‌রি‌বেশ সংকট ও জলবায়ু প‌রিবর্তনের ব্যপা‌রে খুবই সরলভা‌বে ঔপ‌নি‌বে‌শিক দৃ‌ষ্টি প্রয়োগ ক‌রে থা‌কে। জলবায়ু প‌রিবর্তনের ধারণা দাতা সংস্থা ও রা‌ষ্ট্রের জন্য প্রকৃ‌তির উপর হস্ত‌ক্ষেপ ও পুঁজি‌কে‌ন্দ্রিক উন্নয়ন য‌ন্ত্রে প‌রিণত হ‌য়ে‌ছে। স্থানীয় প‌রি‌বেশ‌কে বি‌বেচনায় না নি‌য়ে পাশ্চা‌ত্যের অনুকরণ ও প্রযু‌ক্তিক সহায়তার মাধ্যমে পুঁজিকেন্দ্রীক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়‌নের প্রবণতা এখ‌নো বাংলা‌দে‌শে প্রভাবশালী। দাতাগোষ্ঠী, এন‌জিও এবং রাষ্ট্রয‌ন্ত্রের বি‌ভিন্ন অংশ মি‌লে এসব প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন ক‌রে থা‌কে। নেদারল্যান্ডের অনুকর‌ণে ই‌তিম‌ধ্যে নতুন পা‌নিনী‌তি “বাংলা‌দেশ ডেল্টা ওয়াটার ২১০০” প্রকল্প গ্রহণ করা হ‌য়ে‌ছে। নেদারল্যান্ডের পরাম‌র্শ ও অনুকর‌ণে যে ব-দ্বীপ প‌রিকল্পনা ও প্রযু‌ক্তিক সমাধান গ্রহন করা হ‌য়ে‌ছে তা স্থানীয় বাস্ত‌সংস্থান থে‌কে বি‌চ্ছিন্ন এক প্রকল্প । নদী এবং ভূ-প্রকৃ‌তি‌কে বি‌বেচনায় নি‌লে নেদারল্যান্ড এবং বাংলা‌দে‌শের বাস্তুসংস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রধান ভিন্নতাগু‌লো হ‌চ্ছেঃ ১) বাংলা‌দে‌শের নদীগু‌লো‌তে বিপুল প‌রিমাণ প‌লির উপস্থিত র‌য়ে‌ছে, নেদারল্যা‌ন্ডের নদী‌ক্ষে‌ত্রে তা খুবই সামান্য। ২) নেদারল্যান্ডের বৃ‌ষ্টিপাত ও নদীপ্রবাহ সারা বছর একই থাক‌লে ঋতু‌ভে‌দে বাংলা‌দে‌শে  বৃ‌ষ্টিপাত ও নদীপ্রবাহের প‌রিমাপ ভিন্ন। ৩) এক-পঞ্চমাংশ ভূমি সমুদ্রের নি‌চে থাকার কার‌ণে নেদারল্যা‌ন্ডের বাস্তুসংস্থা‌নের প্রধান জ‌টিলতা হ‌চ্ছে সমুদ্র প্লাবন, অন্যদি‌কে বাংলা‌দে‌শের জন্য প্রধান জ‌টিলতা হ‌চ্ছে নদী প্লাবন। তাই নেদারল্যা‌ন্ডের প্রযু‌ক্তিগত কৈৗশল‌কে রূপান্তর না ঘ‌টি‌য়ে এককভা‌বে অনুকরণ বাংলা‌দে‌শের প‌রি‌বেশ ও জলবায়ু প‌রিবর্বতন প্রতি‌রো‌ধে অপ‌রিহার্য ও পর্যাপ্ত নয়। বাংলা‌দেশ ডেল্টা ওয়াটার ২১০০ প্রকল্পের ভি‌ত্তি মূলত স্থানীয় ইতিহাস এবং প‌রিবে‌শের জটিলতার কন্ঠস্বর‌কে উপেক্ষা করে‌ গ‌ড়ে উ‌ঠে‌ছে। নেদারল্যান্ডের অনুকর‌ণে পোল্ডার পদ্ধ‌তি প্রর্বত‌নের ফ‌লে এ‌টি উপকূলীয় অঞ্চ‌লে মুক্ত প্লাবন‌কে ব‌্যাহত ক‌রে। এর ফ‌লে সমত‌লে প‌রিমাণম‌তো প‌লি না জমায় জমির উর্বরতা হ্রাস, মা‌ছের নিজস্ব বাস্তুসংস্থা‌নের সংকোচনের ম‌তো প‌রি‌বে‌শের বহু‌বিধ সঙ্কট তৈ‌রি হয়। বাংলা‌দেশ সর্বপ্রথম ১৯৬৪ সা‌লে পোল্টার পদ্ধ‌তি‌কে মাস্টার প্ল্যান হি‌সে‌বে গ্রহণ ক‌রে। মা‌র্কিন যুক্তরাষ্ট্রভি‌ত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং  কোম্পানি’   (আইইসিও) প্রণীত নী‌তিমালা অনুযায়ী ‌পোল্টার পদ্ধ‌তি বাস্থবায়ন করা হয়। এ‌টি হ‌চ্ছে নদীসমূ‌হকে অব‌রো‌ধের এক‌টি পদ্ধ‌তি।১০ কিন্তু এ পদ্ধ‌তি তখন ব্যর্থ হয়। ডেল্টা প্ল্যা‌নের এই পদ‌ক্ষপেগু‌লো এ অঞ্চ‌লের বাস্তুসংস্থা‌নের সা‌থে সামঞ্জস‌স্যপূর্ণ নয়, এ‌টি বরং জলবায়ুর নে‌তিবাচক প‌রিবতর্নের প‌ক্ষেই সহায়ক। ডেল্টা প্ল্যা‌নের মাধ্যমে মূলত ব-দ্বী‌পের বাস্তুসংস্থা‌নের মা‌লিকানা কতগু‌লো ক‌র্পোর‌টের কোম্পানির ম‌ধ্যে বন্ঠন করা হ‌য়ে‌ছে।

সকল সঙ্কট‌কে সমু‌দ্রের উচ্চতা বৃ‌দ্ধি ও জলবায়ু প‌রিবর্তনের ম‌ধ্যে সংকু‌চিত ক‌রে উন্নয়ন প্রকল্পগু‌লো তার কাজ চা‌লি‌য়ে যাচ্ছে। দাতাগোষ্টি, এন‌জিও এবং রাষ্ট্রয‌ন্ত্রের উন্নয়ন প্রকল্পগু‌লো উপকূলীয় অঞ্চ‌লে লবণাক্ততার কারণ হি‌সে‌বে  সমু‌দ্রের উচ্চতা বৃ‌দ্ধি ও জলবায়ু প‌রিবর্তনকে বি‌শেষভা‌বে উপস্থাপন কর‌লেও বা‌ণি‌জ্যিকভা‌বে বাগদা চিং‌ড়ি চাষই প্রধাণত দায়ী। ‌লবনাক্ততা বৃ‌দ্ধি‌তে শুধুমাত্র জলবায়ু‌ প‌রিবর্তন‌কে কারণ হি‌সে‌বে দায়ী করা জলবায়ু সম্প‌র্কে আ‌রেক‌টি সীমাবদ্ধ পাঠ। বাগদা চিংড়ি চাষের প্রবক্তারা যখন বলেন যে বাংলাদেশে লবণাক্ততা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে হয়, তখন তারা এই বাস্তবতা‌কে আড়াল ক‌রেন যে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা মৌসুমী এবং বাধ তৈ‌রি, জলাভূমি এবং খাল দখলের ম‌তো মানবসৃষ্ট কার‌ণেও ঘ‌টে থা‌কে। বাগদা চিংড়ি থেকে বাংলাদেশে অ‌নেক বৈ‌দে‌শিক মুদ্রা অর্জন কর‌লেও স্থানীয় লোকজন থেকে কিছুই হয়না বরং ক্ষ‌তির সম্মুখীন হয়। লোনা বাগদা চিং‌ড়ি যে অঞ্চ‌লে চাষ হয় সে অঞ্চ‌লে সহ‌জেই অন্যকিছু চাষাবাদ করা যায়না। এ‌টি স্থানীয় খাদ্যের প্রবৃদ্ধি ক্ষমতাকে নষ্ট করে এবং জীবনযাত্রার মান হ্রাস করে।১১ ‌কেননা বাগদা চিংড়ি চাষের  ফ‌লে সৃষ্ট লবণাক্ত এবং অনুর্বর ভূমির কারণে উপকূলীয় জনসাধার‌ণের খাদ্য সার্বভৌমত্বের ক্ষতিগ্রস্থ হ‌চ্ছে। ১৯৮০ সাল থে‌কে বাংলাদেশ সরকার বৈদে‌শিক তহ‌বি‌লের সহায়তায় বাগদা চিংড়ি শি‌ল্পের বিকাশ ঘটায়। ১৯৮৫ সা‌লে এরশাদ সরকার চিং‌ড়ি চা‌ষের ব্যাপা‌রে নতুন এক নী‌তিমালা প্রয়োগ ক‌রে। ‌যে নী‌তিমালা অনুযায়ী চিং‌ড়ি চা‌ষে আগ্রহী‌ ব্যক্তি ও সংস্থা‌কে দশ হাজার একর জ‌মি ‌লিজ প্রদান করা হয়। এ চিং‌ড়ি চা‌ষের ফ‌লে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরি নদীর মোহনায় অব‌স্থিত সুন্দরব‌নের বাস্তুসংস্থান ক্রমশ বিলুপ্ত হ‌তে থা‌কে।১২ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিশ্বব্যাংক যৌথভা‌বে ১৯৮২ সাল থে‌কে চক‌রিয়া প্রকল্পের অর্থায়ন ঘটায়।১৩ ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে, চিংড়ি রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনৈ‌তিক প্রবৃ‌দ্ধির একটি প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এসব চিং‌ড়ি চা‌ষের ব্যাপা‌রে বিদেশি তহবিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দ‌ক্ষিণ ও দ‌ক্ষিণ-পূর্ব সামু‌দ্রিক উপকূলীয় অঞ্চ‌লে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং ইউএসএআইডি চিং‌ড়ি চা‌ষের জন্য যথেষ্ট সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করে আস‌ছে।১৪

উপকূলীয় অঞ্চ‌লে জলবায়ু প‌রির্বতনের ভয়াবহতা হি‌সে‌বে বৈ‌শ্বিক উষ্ণতা‌কে বি‌শেষভা‌বে দায়ী করা হ‌লেও এর আভ্যন্তরীণ কারণগু‌লোকে খুব বে‌শি আম‌লে নেওয়া হ‌চ্ছেনা বরং উন্নয়ন ও প্রগতির নামে বায়ু, পানি ও মা‌টি দূষ‌ণের নিয়ামকগু‌লো‌কে বৈধতা দেওয়া হ‌চ্ছে। বাংলা‌দে‌শের জলবায়ু‌কে যথাযথভা‌বে পা‌ঠের প্রথম পদ‌ক্ষেপ হ‌চ্ছে সব সমস্যার উপর্সগ হি‌সে‌বে জলবায়ু‌কে দায়ী ক‌রে স‌ত্যিকা‌রের সমস্যাকে এ‌ড়ি‌য়ে যাওয়ার প্রবণতা‌কে বর্জন কর‌তে হ‌বে। আভ্যন্তরীণ উপর্সগগু‌লো‌কে স্বীকৃ‌তি প্রদান না কর‌লে জলবায়ু প‌রিবর্তনের চ্যালেঞ্জকে সা‌র্বিকভা‌বে মোকা‌বেলা করা সম্ভব নয়। এজন্য পুঁজিকেন্দ্রীক দৃ‌ষ্টিভ‌ঙ্গি ও ব্যবস্থাপনার বিপরী‌তে বাস্তুতা‌ন্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সম্প্রসারণ ঘটা‌তে হ‌বে। জলবায়ু সমস্যা‌কে ঔপ‌নি‌বে‌শিক প্রযু‌ক্তিগত দক্ষতার ধারাবা‌হিকতার ভি‌ত্তি‌তে নয় বরং স্থানীয় প্রেক্ষাপট , জ্ঞান ও দক্ষতার ভি‌ত্তি‌তে প্রতিহত কর‌তে হ‌বে।

তথ্যসূত্র

১) Dewan, C. (2021) Misreading the Bengal Delta: Climate Change, Development, and Livelihoods in Coastal Bangladesh, University of Washington Press, p.22

২) Ibid, p.23

৩) Ibid, p.34

৪) উইলকক্স, উইলিয়াম (২০২১) বাংলার নিজস্ব সেচ ব্যবস্থা,  অনুবাদ, ফারুক ওয়াসিমের, ডাকঘর, পৃ.৩৯

৫) প্রাগুক্ত, পৃ.৭২-৭৩

৬) প্রাগুক্ত, পৃ.৪২

৭) Dewan, C. (2021), Ibid, p.41

৮) বিশ্বাস, অ‌নিল ও জাহিদ, ক. ই. (৭ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা) ডেল্টা প্ল্যান -২১০০ ও বঙ্গীয় ব-দ্বীপ: পটভূমি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল , সর্বজনকথা।

sarbojonkotha.info/sk-26-delta-plan-2100/

৯) প্রাগুক্ত।

১০) প্রাগুক্ত।

১১) Dewan, C. (2021), Ibid, p.76

১২) ইউসুফ, মোস্তফা (২০২২,মার্চ ২১) চিংড়ি চাষে হারিয়ে যাওয়া এক সুন্দরবনের গল্প, দ্য ডেইলি স্টার

১৩) Dewan, C. (2021), Ibid, p.82

১৪) Ibid, p.81

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!