এমনিতে নারীকে গণমাধ্যমে কোন কোন চেহারায় তুলে ধরা হয় তার একটি গবেষনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিতা বিভাগের শিক্ষক ড. গীতি আরা নাসরীন। গবেষনাটি সম্পন্ন হলে বিস্তারিত জানানো যাবে। প্রাথমিকভাবে দেখানো হয়েছে, সাধারণত নাচ-গান বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মতো বিষয়গুলো যেগুলিকে পত্রিকার ভাষায় “সফট আইটেম” বলা হয় সেসব জায়গায় নারীর ছবি ছাপা হয়। দুর্যোগ বা দুর্বিপাকে নারীর কান্না বা দুর্ভোগের ছবিও ছাপা হয়। মোট কথা, নারীকে সম্পূর্ণ অংশীদারীত্বে অস্বীকার করে গণমাধ্যম।
জানুয়ারিতে নারী অধিকার কর্মী আয়েশা খানম মারা গেলে বাংলাদেশের পুরো নারী অধিকার আন্দোলন আমার জীবদ্দশায় দেখাটুকু এক লহমায় সামনে এসে হাজির হয়েছিল। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল আমার। স্বীকার করি যে আমার নারীবাদের বোঝাপড়া তসলিমা নাসরীন আর হুমায়ুন আজাদ পড়ে। ছোটবেলায় সরকারীভাবে রোকেয়া দিবস পালিত হতে দেখেছি আর নারী দিবস এর অনুষ্ঠান করতো বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সেইখানে ৮ই মার্চের সূতা কারখানার নারীদের বঞ্চনা পরবর্তী ইতিহাস প্রথম জানা। ক্লারা জেটকিনের নাম প্রথম শোনা। খুবই আগ্রহোদ্দীপকভাবে এই ইতিহাস মহিলা পরিষদের সদস্য আমার সাধারণ মায়ের মুখে শোনা। পাঠ্যপুস্তকে এই ইতিহাস আমি পড়িনি। আমার খড়ির চুলায় রান্না করা জীবনের নানান বঞ্চনা নিয়ে সেইসময় সদা অভিযোগকারী আমার মা আটই মার্চের অনুষ্ঠানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই ইতিহাস বলেছিলেন। তিনি সম্ভবত বক্তৃতা দেবার জন্য কোনও বাংলা পত্রিকা থেকে পড়ে তারপর এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। নারী দিবস সম্পর্কে আমার হাতেখড়ি হয় সেইদিন।
সেইসময় থেকে ২০ বা ২২ বছর পরে এসে এখন কেমন দেখছি নারী অধিকার আন্দোলন? আমি কয়েকটা ভাগে ভাগ করতে পারি এই সময়ের নারী আন্দোলন। বা কয়েকটা ক্ষেত্রে। নারীর ক্ষমতায়ন, রাজনীতি, প্রশাসন এবং জনপরিসরে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে অনেক। সেইসাথে বেড়েছে নারী নির্যাতন। সহিংসতার ধরন বদলে গেছে। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রমের পরপরই “উইম্যান চ্যাপ্টার” নামে সুপ্রীতি ধরের সম্পাদনায় অনলাইন পোর্টাল বের হয়। নারীর দৈনন্দিন জীবনের নানান বঞ্চনা উঠে আসে পোর্টালের লেখায়। কয়েকজন মিলে লেখালেখি শুরু করলেও পরে প্রচুর নারী লিখতে শুরু করেন এই পোর্টালে। এবং এই একই সময়ে অনলাইন প্লাটফর্মে নারী হয়রানির যে বীজ রোপিত হয় তাই এখন মহীরুহ হয়ে পোর্টালের কমেন্ট সেকশনের হাজারো নারীবিদ্বেষী কমেন্ট । এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে যে রাজনৈতিক এবং নারীবাদী অ্যাপ্রোচ দরকার-তার কোনও কার্যক্রম চোখে পড়ে না অথচ নারীর ক্ষমতায়নের সূচক বেড়েছে।
পরিসংখ্যান: নারী নির্যাতন শুধুই সংখ্যা?
এই ক্ষমতায়নের সমান্তরালে শুধু একবছরের নারী নির্যাতনের চিত্র দেখা যাক। মনে রাখতে হবে যে গত বছরটি ছিল করোনা মহামারীর সময়।বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ৩৪৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে শিশু-কিশোরীই বেশি যাদের বয়স ৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। করোনার শুরুর সময়ই ইউএনএফপিএ নারীর জীবনে এই মহামারী কি প্রভাব ফেলতে পারে সেই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘ইমপ্যাক্ট অব দ্য কোভিড ১৯ প্যানডেমিক অন ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যান্ড এনডিং জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন অ্যান্ড চাইল্ড ম্যারেজ” নামে। সেখানে বিশ্বব্যাপী নারীর জীবনে সহিংসতা বাড়বে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়। সেই শংকা সত্য হয়ে দেখা দেয় বাংলাদেশের নারীদের জীবনে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে এর তথ্য পাওয়া যায়।পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা হয়, বিদায়ী বছরে দেশে লকডাউনকালে উল্লেখযোগ্য হারে নারীরা শারীরিক, মানসিক, যৌন ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেক নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। স্কুল বন্ধ থেকেছে আর বাল্যবিয়ে বেড়েছে। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কয়েক দফা জরিপে জানায়, এমন অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে যারা আগে কখনও নির্যাতনের শিকার হয়নি।
নভেম্বরের শেষে দেশের ৫৯ জেলার ১০ লাখ নারীর অংশগ্রহণে করা এক জরিপে দেখা যায়, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০ হাজার নারী পারিবারিক সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী প্রথমবারের মতো নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সংস্থাটি জানিয়েছে, লকডাউন চলাকালে নারীর ওপর সহিংসতার মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। জরিপে দেখা গেছে, পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও মানসিক নির্যাতনের মাত্রা বেশি।
আইন-আদালত: কাজীর গরু কেন শুধুই কিতাবে?
সহিংসতা বা ধর্ষণ চেহারা পাল্টে যে মনস্টারে পরিণত হয়েছে তার একটি উদাহরণ গতবছর নোয়াখালীতে এক নারীকে পিটিয়ে তার যৌনাঙ্গে লাঠি প্রবেশ করানোর ঘটনা। আমাদের প্রচলিত আইনে “পেনিট্রেশন না হলে ধর্ষণ বলা যাবে না” বলে যে ধারা রয়েছে সেইসব ধারা অনেকটাই প্রশ্নের মুখে পড়ে এই ঘটনা দ্বারা। এবং সেইসময় আন্দোলনের মুখে ওই বছরই ১৩ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি এতদিন ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এ আইনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পাশাপাশি দ্রুতবিচার ও রায় কার্যকর করার জন্য আইন সংশোধনের দাবি দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। কিন্তু বারবার বলা হচ্ছে, কাজীর গরু কিতাবে আছে আসলে নেই। অনেক ভালো ভালো আইন নারী নির্যাতনের প্রতিরোধে থাকলেও বাস্তব কারণেই তার সুরাহা হয় না। এখন নারী নির্যাতন হলে থানায় রিপোর্টিং এর সংখ্যা বাড়লেও ৯৪ ভাগ মামলাই আলোর মুখ দেখে না। এমনকি দুএকটি ছাড়া দেশ জুড়ে আলোড়ন তোলা বিভিন্ন নারী নির্যাতনের মামলারও সুরাহা হয়নি। যেমন এই শুদ্ধস্বরেই লিখেছিলাম পাঁচ বছরের শিশু পূজার কথা। মামলাটি এখনও ঝুলে আছে।
নারী নির্যাতনের সংবাদ এবং গণমাধ্যম:
শুধু নির্যাতন নয়, মানুষ হিসেবে নারীকে অবজেক্টিফাই করে দেখার প্রবণতা গণমাধ্যমের একটুও কমেনি। নারী নির্যাতনের ঘটনা কালেভদ্রে পত্রিকার এবং টেলিভিশনের হেডলাইন হয়েছে। বেশিরভাগ সময়েই চটকদার খবর হিসেবে নারী নির্যাতনের খবর পরিবেশিত হয়েছে। কোনও ঘটনায় নারীর বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা থাকলে সেই নারী শিকার হয়েছেন মিডিয়া ট্রায়ালের। বরগুনার মিন্নি বা ডাক্তার সাবরিনার ঘটনা স্মর্তব্য। অনলাইন পোর্টালগুলো অসুস্থ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে সার্ভ করতে বিরতিহীনভাবে ভিকটিম ব্লেমিংমূলক নারীর প্রতি অসংবেদশীল বিভিন্ন ভাষা ব্যবহার করে সংবাদ ছাপিয়ে গেছেন। এমনিতে নারীকে গণমাধ্যমে কোন কোন চেহারায় তুলে ধরা হয় তার একটি গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. গীতি আরা নাসরীন। গবেষণাটি সম্পন্ন হলে বিস্তারিত জানানো যাবে। প্রাথমিকভাবে দেখানো হয়েছে, সাধারণত নাচ-গান বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মতো বিষয়গুলো যেগুলিকে পত্রিকার ভাষায় “সফট আইটেম” বলা হয় সেসব জায়গায় নারীর ছবি ছাপা হয়। দুর্যোগ বা দুর্বিপাকে নারীর কান্না বা দুর্ভোগের ছবিও ছাপা হয়। মোট কথা, নারীকে সম্পূর্ণ অংশীদারিত্বে অস্বীকার করে গণমাধ্যম।
জনপরিসরে নারী :
জনপরিসরে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এবং সেইসাথে বেড়েছে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার নানান হাতিয়ার। হিজাব নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত এসেছে। নারী সংক্রান্ত যেকোনও সংবাদের নিচে “খানকি মাগী হিজাব কই” শীর্ষক কমেন্ট রীতিমতো ট্রেডমার্ক। যে নারীরা কোনওদিন ঘরের বাইরে আসতে পারতেন না, অন্তত হিজাব মাথায় নিয়ে হলেও তারা বাইরে আসতে পারছেন, কাজ করতে পারছেন-এটি নারীমুক্তির একটি পিলার বলে বলতে চাইছেন কেউ কেউ। কিন্তু তারা এই প্রশ্ন তুলছেন না যে, যে কারণে একজন নারী অনিরাপদ বোধ করে হিজাব করছেন, সেই কারণগুলো উৎপাটন করা জরুরি না হিজাব ব্যক্তির চয়েস হিসেবে ক্যাম্পেন করা জরুরি? কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানেও এখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী হিজাব করেন, কেন তাদের গুড মুসলিম হতে হয় সে বিষয়ে তেমন কোনও গবেষণা পাওয়া যায় না।
এই মুহূর্তে নারী আন্দোলন:
“ফেসবুকে বড় বড় কথা” বলে কৌতুক করলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম অবশ্যই আন্দোলনের একটা বড় প্ল্যাটফর্ম। এর বাইরে কোনও আন্দোলন তেমন দানা বাঁধেনি। তবে ভালো উদ্যোগ অনেক ছিল। ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যা অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার সময়কার আন্দোলন কাজে দিয়েছে। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে দেখা যায়, রাষ্ট্র কোনটির বিচার চায় অথবা কোনটিতে রাষ্ট্র আগ্রহী নয় সেটাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অবরুদ্ধ এই সময়ে যেকোন নারী আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত করাটা জরুরি নাকি নারী আন্দোলনকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে ভাবা দরকার-সেটিই এখন আলোচনার বিষয়।
Israt Jahan Urmi is a journalist and activist.