বাঙালি জাতীয়তাবাদ : একটি পর্যবেক্ষণ

Share this:

জাতীয়তাবাদ

মানুষের আত্মপরিচয় জাতি-পরিচয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে; আবার শ্রেণি, বংশ, ধর্ম কিংবা ভাষা-পরিচয়কে কেন্দ্র করেও গড়ে উঠতে পারে। তবে আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদী চেতনা অতিমাত্রায় খেয়ালি এক আদর্শ।

জাতীয়তাবাদী আদর্শের সফলতা এবং তা থেকে একটি রাষ্ট্রের জন্ম কীভাবে হতে পারে সে বিষয়ে তিনটি বিশ্লেষণ জারি আছে। যথা—

ক . কোন জাতি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নিতে পারে। যেমন : ইসরায়েল। সারাবিশ্বে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিরা একটি মাতৃভূমির দাবি করে আসছিল বহুকাল ধরে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই দাবি বিবেচিত হয়ে ১৯৪৭ সনে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল।

খ . শাসকেরা তাদের লক্ষ্য হাসিলের জন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আমলাতন্ত্রের সহায়তায় জাতির ধারণাকে  চাপিয়ে দিতে পারে। যেমন : রাশিয়ার জার পিটার তাঁর দেশকে আধুনিকীকরণের জন্য জাতীয়তাবাদের স্মরণাপন্ন হয়েছিলেন। সম্রাট নিকোলাসও সক্ষম হয়েছিলেন রুশ জাতীয়তাবাদের প্রবল ঢেউ জাগিয়ে তুলতে। জাপানের সম্রাট মেইজি কিংবা অটোমান শাসকেরাও তাদের নিজ নিজ দেশে একই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন।

গ . তৃতীয় ধরনের জাতীয়তাবাদ জন্ম নিতে পারে তখন, যখন কোন একটি জাতিগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোতে তার সাবল্টার্ন অবস্থানের জন্য ( কিংবা সংখ্যালঘু থাকার কারণে ) নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়। ক্রমাগত শোষণ ও নির্যাতনের এক পর্যায়ে একটি জাতি অধঃস্তনতার অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী হতে পারে; এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশ।

 

বাঙালি জাতীয়তাবাদ      

সাধারণ পর্যবেক্ষণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের তিনটি ধাপ দৃশ্যমান। প্রথম ধাপটি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষ অধ্যায় চলাকালের। সে সময় সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে যত ক্ষুদ্রই হোক একটি ভিন্ন ধারা স্থান করে নিয়েছিল। সেটি ছিলো অখণ্ড বাংলাকে নিয়েএকটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা। সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল বটে, কিন্তু দ্বিতীয় ধাপে সেটি পুষে যায় ১৯৭১-এ, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ সফল হয়েছিল দুটি কারণে : এক .  জাতির অভ্যন্তরীণ সঙ্গতি গড়ে তোলায় সফলতার জন্য। দুই . অন্য জাতি থেকে তার ভিন্নতা নির্ণয়ে ও জনগণকে সচেতন করবার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্য।

কেন ও কী কারণে বাঙালি পাকিস্তানের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী থেকে আলাদা এবং কোন কোন রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণে তাদের পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে ভিন্ন একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে, তা  তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল । বাঙালি যে একটি পৃথক জাতি এবং বিচ্ছিন্নতা ছাড়া যে তাদের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয় তা ক্রমে দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে  উঠেছিল। ‘আমরা’, ‘ওরা’ কিংবা ‘তারা’ এই বিভাজন রেখা জাতীয়তাবাদী চেতনার বিজয়কে ত্বরান্বিত করে, এক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছিল ।

আর, স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে এই জাতীয়তাবাদের তৃতীয় ধাপ দৃশ্যমান/চলমান।

 

জাতীয়তাবাদের সংকট

মানুষের জাতি-পরিচয়-শক্তিকে খাটো করে দেখা অনুচিত, কিন্তু তাকে খুব শক্তিশালী ভেবে নিশ্চিন্ত হওয়াও কঠিন। প্রকৃত বিবেচনায়, কোন শক্তি জাতীয়তাবাদের পেছনে দাঁড়িয়ে, কার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে জাতীয়তাবাদী শ্লোগান, এসবের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। ফলে দোষ-গুণটা আসলে জাতীয়তাবাদের নয়, বরং জাতি-পরিচয়ের অনুভূতিটিকে সমাজের কোন শক্তি কীভাবে ব্যবহার করছে তার ওপরই মুখ্যত জাতীয়তাবাদের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। তাই এর যেকোনো সাফল্য-ব্যর্থতাই রাজনৈতিক ও সাময়িক।

আত্মপরিচয় ও স্বাধিকার অর্জনের আবেগে আপ্লুত জাতি সংগ্রাম, আন্দোলন, সমষ্টিগত ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করে, আবির্ভাব ঘটে জাতিরাষ্ট্রের। সদ্য-স্বাধীন জাতিটিকে সংগ্রাম করতে হয় অর্থনীতির কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে। তাছাড়া, জাতীয়তাবাদী নেতাদের জনপ্রিয়তার মূলে অতি উচ্চাভিলাষী সব দাবি পূরণের প্রতিজ্ঞা তো থাকেই। বাস্তবে দেখা যায়, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করারই জাতীয়তাবাদের ধারায় সবসময় মেটানো সম্ভবপর হয়ে  ওঠে না, মানুষের মনকে প্রবল  আশায় উদ্দীপ্ত করা উচ্চাভিলাষী দাবি পূরণ তো অনেক পরের ব্যাপার।

এভাবেই মানুষের মন থেকে অত্মপরিচয়ের ক্ষুধা দ্রুত মুছে যায়। সে-স্থান দখল করে অর্থনৈতিক মুক্তি ও আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রবল ইচ্ছা।মোহ ও মোহমুক্তির এই অন্তর্বর্তীকাল জাতির জীবনে জন্ম দেয় গভীর হতাশার। যা জাতির অভ্যন্তরীণ বিরোধকে উস্কে দিয়ে একে সমষ্টিগত ভাবে অচল করে দেয়। জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে গণসমালোচনা তার সব সাফল্যকে মুহূর্তের মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। মানুষ তখনতাকে প্রত্যাখ্যান করতে উদ্যত হয়ে তার ব্যর্থতাকে বড় করে দেখে।

তাছাড়া, মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক ধারায়, জাতীয়তাবাদকে কখনোই তেমন আমলে নেওয়া হয়নি। এই মতবাদে, জাতিকেন্দ্রিক আন্দোলনের চরিত্র বুর্জোয়া। বুর্জোয়ারা জাতি-পরিচয়ের অনুভূতিকে ব্যবহার করে তাদের শ্রেণিকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। তাই তারা জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে ভিন্নপথ নির্বাচনের পক্ষপাতী।

 

বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংকট    

ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, এগারো দফা, ১৯৭০-এর নির্বাচনের রায় বাস্তবায়নে পাকিস্তানি শাসকদের অনীহাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদি পর্যায় অতিক্রম করে বাঙালি জাতীয়াতাবাদ সক্ষম হয়েছিল স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। কিন্তু বহুবিধ চ্যালেঞ্জেরঅভিঘাতে বিগত ৫০ বছরে তার আকর্ষণ-শক্তি ক্ষীণ ও স্থিমিত হয়ে এসছে; ক্ষয় ঘটেছে ও ঘটছে তার প্রভাবের।

স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম দিককার সময় জাতির জীবনে বিকাশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলেও বাংলাদেশের জন্য তা ছিল এক হতাশার অধ্যায়। তৎকালীন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে  অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যর্থতা ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে। যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। এই সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় চরম ব্যর্থতা, স্বৈরতান্ত্রিকতার দাপট, সমাজতন্ত্রের পরীক্ষায় অর্থনীতির অপরিমেয় ক্ষতি, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি জাতীয়তাবাদের ভাবমূর্তিকে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে।

প্রথম অবস্থার এই বিশৃঙ্খলতা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরবর্তী বিকাশে স্থায়ী ছাপ ফেলেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মুখ থুবড়ে পড়ার কারণ এরমধ্যেই নিহিত। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত না হওয়ার অন্যতম কারণও এই প্রারম্ভিক বিশৃঙ্খলা।

কেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ একটি আধুনিক জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলো—এই প্রশ্নের উত্তরে গুড গভর্নেন্স-এর সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের দুর্বলতা বা ভ্রান্ত রাজনৈতিক কৌশল যেমন দায়ী তেমনি অনেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার স্বরূপের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যেমন :  বদরুদ্দীন উমর ( সম্ভবত তিনিই প্রথম ) বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধর্মীয় দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে ১৯৭২ সনে Holy Day পত্রিকায়  ‘The Basis Of Bengali Nationalism’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার ( সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ) কারণে আজ বাঙালি জাতিপরিচয়ের গা ঘেঁষে ধর্ম পরিচয়ের প্রবল উত্থান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিচয়ের যারা প্রতিনিধিত্ব করে তারাও নতুন প্রজন্মেরই। এরা মূলত আধুনিক সভ্যতার বাইরে থেকে আগত। শহরেও ক্রমান্বয়ে এদের প্রভাব বিস্তার ঘটছে। ব্যানার যা-ই হোক না কেন; তারা প্রায় সবাই মাদ্রাসা শিক্ষা-ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু সেটিই তাদের আসল পরিচয় নয়, তাদের সামাজিক শেকড় গভীরভাবে প্রোথিত গ্রামের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মাঝে। এরা গ্রাম ও শহরের মাঝে  বিরাজমান গভীর বৈষম্যের প্রতীক । অর্থাৎ এই শ্রেণিটি রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার। গ্রামকে দীর্ঘকাল অনেকটাই রাষ্ট্রীয় নজরের বাইরে রাখা, অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা ও উদাসীনতা প্রদর্শনের পরিণাম। একইসঙ্গে তা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষা-ব্যবস্থার সার্বজনীনতা প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার মাশুল ।

যবনিকা       

যদি আমাদের লক্ষ্য হয় একটি উদার অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক সমাজ কিংবা রাষ্ট্র গড়ে তোলা, তা হলে তা  কোন মতেই উগ্র জাতি বা ধর্ম-পরিচয় দিয়ে করা সম্ভব নয়। এর জন্য আমাদের একটি সুবিবেচনাপ্রসূত ও আন্তরিকতাপূর্ণ মধ্যপথ খুঁজতে হবে।

 

 

 

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!