বারান্দা
লীনা চোখ বন্ধ রেখে পাশের বালিশটা হাতড়াবে। কিংবা চোখ খুলতে না খুলতেই তার হাত চলে যাবে সাদা কাভারটায়। তারপর বালিশ ছাড়া অন্য কিছুর স্পর্শ না পেয়ে মাথাটা সামান্য তুলে চমকে তাকাবে সেদিকে; দেখবে বিছানায় আমি নেই। আমি কী করে হুইল চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছলাম, সেটা নিয়ে মুহূর্তে উতলা হয়ে উঠবে। আসলে রাতে ঘুমানোর আগেই আমি ক্র্যাচটা মাথার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম। হুইল চেয়ারটা করিডোরে থাকে, এনে না দিলে আমার পক্ষে সেটাতে চড়ে বসা সম্ভব না, লীনা জানে। ক্র্যাচটা হাতের কাছে রেখেছিলাম লীনা ঘুম থেকে ওঠার আগেই বারান্দায় গিয়ে বসব বলে। ক্র্যাচের নিচে পাতলা রাবার দিয়ে মুড়িয়ে নিয়েছি, ঠকঠক শব্দে লীনার ঘুম যেন ভেঙে না যায়। এসবকিছু করেছি ভোরবেলা বারান্দায় গিয়ে বসব বলে। লীনা দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। অবশ্য অফিসের জন্য সময় মতোই ওঠে, তবে আমার হিসেবে সেটা অনেক দেরি। আমি সকাল বেলার পাখি। ক্র্যাচে সামান্য আওয়াজ না করে আমি ঠিকই বারান্দার হেলানো চেয়ার পর্যন্ত পৌঁছে যাব। ঘুম আর ভোর দেখা কখনও একসাথে হতে পারে না। আমি ভোরটা বেছে নেই, লীনা ঘুম।
বারান্দায় গিয়ে আমি তেমন কিছুই করব না। নিজেকে ভালোমতো ব্যালান্স করে ইজি চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিলেই হলো। ক্র্যাচটা দাঁড়িয়ে থাকবে পাশে। প্রথম প্রথম ওটা আমি বগলে ছোঁয়াতে পারতাম না, শুধু হাসি পেত। আমার অবস্থা দেখে লীনাও হাসত। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে আসত, তারপর গম্ভীর হয়ে যেত। বারান্দায় ভাগ্যিস ইটের রেলিং নেই, আগাগোড়া গ্রিল, তাই চেয়ারে আধশোয়া হয়েই বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাব। গ্রিলগুলো না থাকলে অবশ্য আরও ভালো হতো। প্রচুর বাতাস এলেও মনটা মাঝেমধ্যে খুঁতখুঁত করে, মনে হয় কিছু বাতাস গ্রিলে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে। আর তাছাড়া, ওপরে গ্রিল না থাকলে পথভোলা দু’একটা চড়ুই বারান্দায় এসে বসত, আমিও ইচ্ছেমতো ঝুঁকতে পারতাম। অফিসের গাড়ি যখন লীনাকে নামিয়ে দিয়ে যায়, তখন আমার ঝুঁকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। লীনা কী করে নামে, বিদায় জানাতে কাউকে না কাউকে হাত দেখায়, কেমন হয় তখন তার মুখটা, আমার দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, তা করা হয় না। আর গ্রিলের জন্য আমি বাতাসের পুরো ভাগটা পাচ্ছি না, এটা অবশ্য ঠিক না। এ বাড়ির নাম ‘দখিনা’, গলির শেষ প্রান্তে গলির দিকে মুখ করা, ওদিকটাই দক্ষিণ। নামের জন্য নয়, দিকের জন্যই বাড়িটাতে দিনভর বাতাস খেলে। আমি হা করে বসে সেসব গিলি, ভোরের বাতাস সবচেয়ে সুস্বাদু। মাঝে মাঝে এত পেট ভরে যায় যে লীনা অফিস থেকে এসে দুপুরের খাবার টেবিলেই পড়ে থাকতে দেখলে রেগে যায়। আসলে পেট ভরে যাবার জন্য খাই না, তা নয়। আমি গলির শেষ মাথায় মেইন রোড পর্যন্ত দেখতে পাই। দেখতে দেখতে এমন নেশা হয়ে যায় যে চলমান সেসব দৃশ্য ছেড়ে কিছুতেই ওঠা যায় না। ওই হেলানো চেয়ারটাই হয়ে ওঠে আমার গ্যালারি আর গলিসহ মেইন রোডের সামান্য অংশ খেলার মাঠ। শুধু পিচ বদলে যায়, একেক সময় একেক দিকে আমাকে মনোযোগ দিতে হয়। দেখতে দেখতে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে কখন পিচ কোথায় সরে যাবে। তিন বাড়ি পরে একটা বাড়ির গেটে ‘সংবাদপত্র’ লেখা একটা গাড়ি এসে দাঁড়াবে ঠিক ভোর পাঁচটায়। একজন নামবেন আর বিল্ডিঙের গেট খুলে যাবে। কোনোদিন গেট খুলতে সামান্য দেরি হলে গাড়িটা ছোট্ট একটা হর্ন দেবে, সারারাত জেগে থাকার পরে ভোরের দিকে বাড়ির দারোয়ানের চোখ বুজে আসাটা স্বাভাবিক। তবে একটা হর্নের বেশি নয়, গেট খুলে যাবে, রাত জেগে কাজ করা উশকোখুশকো চুলের অপেক্ষমান মানুষটি ধীরে পা বাড়াবে। এই দৃশ্যটা দেখতে না পেলে আমার বুঝতে অসুবিধা হবে না যে আমি বারান্দায় আসতে দেরি করেছি, পাঁচটা বেজে গেছে। পৃথিবীতে ব্যাতিক্রম নেই, তা নয়; একদিন দেখি গাড়ি আসেনি, লোকটি ফেরেনি। আমি নিশ্চিত পাঁচটা বাজার কয়েক মিনিট আগেই এসে বসেছিলাম বারান্দায়। উত্তেজনায় বারবার কবজি উলটে ঘড়ি দেখছিলাম। পাঁচটা আঠারো…পাঁচটা ছত্রিশ…নাহ্। তারপর ভেবে নিচ্ছিলাম, আজ লোকটি ছুটি নিয়েছে, সংবাদপত্রে কাজ বলে কি কোনোদিনই ছুটি পাবে না? আরও পরে মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে মেঘের ফাঁক গলে আলো আসা দেখছিলাম। তখন আসে কিছু মানুষ, সাইকেলের পেছনে পেপারের স্তূপ নিয়ে আসে। আমার চোখ তাদের গতিবিধি জানে। কোন সাইকেল কোন বাড়ির গেটে দাঁড়াবে আমার মুখস্ত। সেখানেও ব্যতিক্রম আছে। কোনোদিন অবিরাম ছুটতে থাকা হকার কোনো বাড়ির গেটে খানিকক্ষণ দাঁড়ায়, দারোয়ানের সাথে দুটো গল্প করতে করতে ফ্লাস্কে চা বয়ে বেড়ানো কোনো মানুষকে ডেকে চা খায়। তবে বেশিক্ষণ দাঁড়ায় না, কাউকে না কাউকে সকালের নাস্তার টেবিলে পেপার পৌঁছে দেয়ার তাড়া থাকে তার। তারপর সেদিন সংবাদপত্রের লোকটি ফিরল, তবে দেড় ঘণ্টা দেরিতে। সাড়ে ছ’টায় যখন আমি বারান্দা থেকে উঠব উঠব করছি তখন দেখি গাড়ি এসে দাঁড়াল। সাথে একটি মেয়েও নামল, তার গলায় ক্যামেরা ঝোলানো। পেছন থেকে নেমে সে সামনের সিটে বসল। গাড়িতে ওঠার আগে লোকটিকে হাত দেখাল, হাসল। নিশ্চয়ই হঠাৎ কোনো জরুরি কাজ এসে পড়েছিল, জরুরি কোনো রিপোর্টিং। মেয়েটিকে দেখে আমার কলিগ নিশিতাকে মনে পড়ে গিয়েছিল। ব্যাংকে আমার পাশের টেবিলে বসত। তখন আমি আমার দু’পায়ে ভর করে নিশিতার টেবিলের দিকে হেঁটে যেতাম, কোঁকড়া চুলের রিংগুলো কপাল থেকে সরিয়ে নিশিতা বলত, ‘কিছু বলবেন, আনিস ভাই?’ আমার হয়তো অন্য কিছু বলতে ইচ্ছে করল কিন্তু আমি বললাম, ‘লোনের জন্য ওমুক ক্লায়েন্টের ফ্যাক্টরি ভিজিটে যেতে হবে, আজ আর অফিসে ফিরব না মনে হয়।’ নিশিতা হেসে মাথা দোলালো, পরমুহূর্তেই কাজে ডুবে গেল। আমার অ্যাক্সিডেন্টের পরে একবার মাত্র এসেছিল নিশিতা, অফিসের বাকি অনেকের সাথে। কথার ফাঁকে একইভাবে মাথা দোলাচ্ছিল, বাড়তি সান্ত্বনার কথা বলেনি।
ওপরের বারান্দা থেকে খানিকক্ষণের মধ্যে বিরতি দিয়ে দিয়ে ছাই পড়তে থাকবে। ওখানে কেউ থাকে যে সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়। এটা বুঝতে বেশ কিছুদিন লেগেছিল আমার। সবার শেষে সিগারেটের ফিল্টারটা ফেলে দিতেই আমি মাথা বাড়িয়ে দেখেছিলাম মাটির দিকে। তারপর বুঝেছি তার আগপর্যন্ত বাতাসে উড়ে উড়ে কী পড়ে। কোনোদিন দখিনা বাতাসে সেই ছাই উলটো দিকে ঘুরে আমার বারান্দায় এসে পড়েছে। আমি কিছু মনে করিনি। মানুষ কি জানে তার কোন কাজের ফল কোথায় গিয়ে ঠেকে? যে বাস আমার পায়ের গোড়ালি থেতলে দিয়ে চলে গিয়েছিল, সে জানে না লীনার ওপরে তার কী প্রভাব পড়েছে। লীনা আমাকে ইউনিভার্সিটির করিডোরে ছুটতে দেখেছে, তাকে পেছন থেকে ঝুপ করে কোলে তুলে নিতে দেখেছে, আবার হাঁটুর নিচে কিছুটা এসেই টুপ করে পা শেষ হয়ে যেতে দেখেছে। লীনার কেমন লাগে? আমি ঠিক জানি না। মাঝেমধ্যে বোঝার চেষ্টা করি। লীনা এমন ভাব করে যেন কিছুই হয়নি, আমাদের জীবন বরাবর যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু আমি জানি এটা লীনার ভান। কখনও আমার খুব রাগ হয়, আর বেশিরভাগ হয় সন্দেহ, মনে হয় সে অনেক কিছু লুকায়। যদিও আমি জানি যাকে সন্দেহ করা হয় বিষয়টি তাকে মোটেও স্পর্শ করে না। যে করে সে-ই নিজেকে কুরে কুরে খায়। এসব ভাবনা থেকে বেরোতে চাইলে আমি যার সাহায্য নেই, সে হলো বারান্দা।
বাসা থেকে খানিক দূরে ম্যানহোলের ঢাকনার পাশে রাস্তার পিচ ফেটে গেছে গত সপ্তাহে। ভেতরের চাপেই হবে হয়তো। যে প্লটে একটি বাড়ি ছিল, একটি মাত্র পরিবার থাকত, সেই একই প্লটে এখন অন্তত ছয় তলা, দশ-পনেরোটা পরিবার। আগের সেই একই ম্যানহোল কী করে এতটা চাপ নেবে? তাছাড়া কোথাও না কোথাও লাইন আটকে আছে নিশ্চিত। ফাটল দিয়ে প্রথমে সামান্য কালো পানি বেরোনো শুরু হলো। তারপর দুদিনেই রাস্তার এক পাশ পানিতে তলিয়ে গেল। সেদিকে যাদের বাড়ি তারা খুব কষ্ট করে আসা-যাওয়া করছে। মোটামুটি ভালো এলাকা এখন সুয়েরেজের পানিতে ভাসছে। আমাকে রাস্তায় হাঁটতে হয় না তাই এটা আমার সমস্যা নয়, কিন্তু দখিনের বাতাসের সাথে সুয়েরেজের গন্ধ আজকাল প্রায়ই বারান্দায় বসার আনন্দ মাটি করছে। তবু আমি প্রায়ই বসে থাকি। পরশু একটা রিকশার চাকা ওই ফাটলে পড়ে কাত হয়ে থাকল। রিকশাওলা কালো কুচকুচে পানিতে পা ডুবিয়ে রিকশাটাকে উঠিয়ে নিল বহু কসরতের পর। রিকশায় ছিল এক তরুণী মা আর তার ফুটফুটে স্কুলড্রেস পরা কন্যা। মায়ের আতঙ্কিত মুখটা ছিল দেখার মতো, মেয়েটাকে এক হাতে আকড়ে ধরে আরেক হাতে কোনোরকমে রিকশায় টিকে ছিলেন তিনি। লীনার চোখে ওরকম আতঙ্ক দেখলে আমি হয়তো খুশি হতাম, আমার জন্য দুশ্চিন্তা। অস্বাভাবিক জীবনে এমন স্বাভাবিক হয়ে যাবার ভান করার কোনো মানে হয় না।
নিচের তলার কলেজপড়ুয়া মেয়ে প্রেমে পড়েছে। আমার ঠিক নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে বান্ধবীর সাথে ফোনে আলাপ করে, প্রেমিকের খুঁটিনাটি জানায়। তার রিনরিনে আহ্লাদী গলা শুনলে আমি নড়েচড়ে সমনে এগিয়ে বসি। কথা আর হাসির দমকে মনে হয় পাতলা কাচ চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ছে। আমি কান পেতে থাকি। মাঝে মাঝে এত ফিসফিস করে বলে যে কিছুই বুঝতে পারি না। কখনও আবার হুট করে থেমে যায়। নিশ্চুপ। তারপর অন্যরকম গলায় কারও কথার জবাব দেয়, বারান্দায় কেউ এসে পড়ে হয়তো। এমনিতে রিনরিনে গলা কতকিছু বলে, শহরের পরিবর্তনের কথা জেনে যাই। বিরতিসহ একদিকের সংলাপ, কিন্তু বুঝতে পারি ঠিকই।
‘না না, বসুন্ধরা সিটি না, যমুনায় গেলাম।’ ‘ভাবলাম ওখানে তো অনেক দেখা হয়েছে, যমুনা ফিউচার পার্কের কী অবস্থা, সেটা দেখি।’ ‘হ্যাঁ, দূর হয়। ও-ই তো বলল ওখানে যাবে।’ ‘দুপুরে কলেজ থেকে টাইম ম্যানেজ করলাম, বুঝলি? ভাবলাম ফাঁকা থাকবে।’ ‘ফাঁকা থাকলে সুবিধা কি তুই জানিস না?’ ‘না রে, ছিল না। একটা সিটও খালি ছিল না। কী অবস্থা! দিনে-দুপুরে আমার মতো এতগুলো মানুষ বাং মারল? ভাবাই যায় না।’ ‘একেবারে হতাশ, বুঝলি? যতই অন্ধকার হোক, কিছুক্ষণ পরে তো সবই দেখা যায়। হাতটাও ঠিকমতো ধরা যায় না।’ ‘চুপ, হাসবি না।’ ‘ভেবেছিলাম “জিরো ডিগ্রি” দেখব। ভাবলাম, দেখে তরুণ সমাজের সাথে আমিও একটু নষ্ট হই। কিন্তু কী করা, উনি দেখবেন “ফ্যাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস”। ’ধুর আর বলিস না, শালার প্রেম-ট্রেম কিছু নেই, গাড়ি ভেঙে টুকরো টুকরো কিন্তু মানুষগুলো অমর, একটা আঁচড়ও লাগল না।’ ‘আরেকটা কথা শোন, যমুনা ফিউচার পার্কের বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টের সিট বানিয়েছে ছয় নম্বর বাসের সিট বানানোর লোকেরা। একদম এক সাইজ আর লাল রেকসিনে মোড়ানো।’ ‘আরে বাবা, ও চাইলে আমি কী করব বল!’…আহা, শেষের দিকে মেয়েটির গলা যে কী আদুরে হয়ে গিয়েছিল! নাকি-গলা যাকে বলে। ওরকম আদুরে গলায় লীনাও একসময় কথা বলত আমার সাথে। প্রথম দিকেই হবে। ঠিক মনে নেই কবে থেকে লীনার গলাটা অফিসের কলিগের মতো হয়ে গেছে, শুধু কাজের কথা, এটা করতে হবে, ওটা করা উচিত, এটা কিন্তু আজও করা হলো না; যেন অ্যাকাউন্ট্যান্ট। হাজার হিসেবের ভিড়ে লীনার আবেগী সে কণ্ঠটা ঠিক কবে কী করে হারিয়ে গেছে, মাথার ওপরে জোর দিয়েও মনে করতে পারি না। একসময় বাড়ি ফিরে আমাকে না দেখলেই লীনা ফোন করত, ‘অ্যাই, ফেরনি দেখি এখনো! কখন আসবা বলো না…’ লীনার টিভি প্রোডাকশনের কাজ, কখনও আগেআগে কখনও আবার দেরি হয় ফিরতে। যখনই ফিরুক, এখন কথা হয় অন্যরকম, অন্য গলায়। সেই লীনা যে কোথায় চলে গেল! লীনার চোখে আমি আমার প্রতি করুণাও খুঁজে পাই না। অথচ আমি জানি পাব, নিশ্চয় লীনা লাগাতার তা লুকিয়ে রাখতে পারবে না। এখন লীনা নির্লিপ্তভাবে কথা বলে, করুণা প্রকাশের ভঙ্গি হিসেবে সে নির্লিপ্ততায় আশ্রয় নিয়েছে। অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় আসে। আমি জানি ঠিক কতক্ষণের মধ্যে সে এখানে উপস্থিত হবে, কারণ তার আগেই গলির মাথায় তার অফিসের গাড়ি ঢুকতে দেখি। জানি নিয়মমাফিক সে এসে বলবে, ‘এখনও বারান্দায়! আজও দুপুরে খাওনি?’
‘বসে বসে থেকে যে ক্ষিদে পায় না।’
‘দিনের পর দিন দুপুরে খাও না। শরীর খারাপ করবে কিন্তু।’
ব্যস এটুকুই। লীনা দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলে। আমার ইচ্ছে করে সে কাছে আসুক। তার নিশ্চয় কাপড় বদলানোর বা রাতের খাবারের ব্যবস্থা করার তাড়া থাকে। তবু আমার ইচ্ছে করে সে আমার সামনে টুল টেনে বসুক। কেন যেন সেটা তাকে বলা হয় না। বরং আমি ভাবতে থাকি, লীনা কি এখন আগের মতো আদুরে গলায় কারও সাথে কথা বলে? বলতেই পারে। অফিসে কেউ কি নেই যাকে হুট করে লীনার ভালো লেগে গেছে? রফিক আজাদের কবিতার মতো আটত্রিশ বছর বয়সে হয়তো লীনার চোখ খুলে গেছে আর সে তাকে দেখে ফেলেছে! হ্যাঁ, আমার বিয়াল্লিশ, তবে লীনার বয়স আটত্রিশই বটে। কিন্তু তাকে দেখতে দেখায় আঠাশের মতো। বাসা সামলানো, আমাকে দেখাশোনা, অফিস এবং নিজেকে পরিপাটি করে রাখা, সবকিছুতেই সে এ-প্লাস পেতে পারে। কোথাও লীনার কোনো খুঁত পাই না, জোর করে খুঁজে বের করতে চাই হয়তো। যেমন এই সেদিন সে অফিসের গাড়িতে না ফিরে অন্য একটা গাড়িতে ফিরল। সাদা চকচকে একটা প্রিমিও। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম, নিচের দিকে চোখ পড়তেই দেখি গাড়ি থেকে নামছে লীনা। এক ঝলক দেখতেই সে পোর্চের দিকে সেঁটে এল, তাই আর দেখতে পাইনি। কিন্তু দেখবার আকাঙ্ক্ষায় ক্র্যাচে ভর দিয়ে কপালটা ঠেসে ধরলাম গ্রিলের সাথে। এত জোরে ধরলাম যে কপালে গ্রিলের লম্বা দাগ বসে গেল, হাতে ছুঁয়ে বুঝলাম কপালটা অ্যামবুশ প্রিন্টের মতো হয়ে গেছে। লীনা তখনই চলে আসবে ওপরে, কপালটা কোথায় লুকাই, ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল। অথচ লীনা আনুমানিক সময়ের আগেই বারান্দায় চলে এল, আর এল একেবারে আমার কাছে। কপালে হাত দিয়ে বলল, ‘তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন, জ্বর-টর না তো?’ আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘না তো, একদম ঠিক আছি।’ লীনা দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি মন থেকে এই ভাবনা ওড়াতে পারলাম না; কপালের ভাঁজ দেখেই লীনা বুঝেছে আমি ঝুঁকে তাকে অনুসরণ করছিলাম, সেটা বোঝানোর জন্যই আমার কপালে হাত রাখল। ওভাবে দেখতে চাওয়া আমার উচিত হয়নি। কিন্তু লীনাও তো বলতে পারত কেন সে সেদিন অফিসের গাড়িতে আসেনি কিংবা কার সাথে কোথা থেকে এল।
সে রাতে সত্যিই আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে লীনা কপট রাগ দেখাচ্ছিল, ‘রোদ-বৃষ্টি যাই হোক, সারাদিন বারান্দায় বসে থাকা, জ্বর আসবে না তো কী?’ আমি কোনো উত্তর দেইনি। পৃথিবীকে দেখার আমার একটাই তো জানালা- ওই বারান্দা। লীনা কি তা বুঝবে! বারান্দাই যে আমার সব সেটা লীনা একেবারে বোঝে না, তা নয়। এই তো সেদিন সে মিস্ত্রি ডেকে ছাদে হুক লাগিয়ে তাতে ফ্যান ঝুলিয়ে দিল। পট্টি ভেজাতে ভেজাতে লীনা বলল, ‘কাল এই জ্বর নিয়ে অন্তত বারান্দায় যেও না, ঘুমিও।’ জ্বরের ঘোরে চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম, আমার না হয়ে লীনার জ্বর হলে যে কী হতো! আমি কি এভাবে তার সেবা করতে পারতাম?
হকাররা বাড়িবাড়ি পত্রিকা বিলি করে যাবার পরে স্কুলের ড্রেস পরে ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা একে একে বেরিয়ে যায়। গলিতে তাদের দেখলে আমার চোখ চকচক করবে, আমার সামনে আয়না না থাকলেও বলে দিতে পারি। তারা কেউ স্কুলের গাড়িতে, কেউবা নিজেদের। আমার মনে হয় খানিক দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসত যদি! তাদের মধ্যে যে কী প্রাণ আছে আমি লীনাকে বলছিলাম সেদিন। হঠাৎ দেখি লীনার মুখ শক্ত হয়ে গেছে। মাথা নিচু করে কোলের ওপরে নেইল ফাইল করছে সে। আমি বাচ্চাদের নিষ্পাপ মুখের কথা বলতে বলতে হুট করে থেমে গেছি। আমি জীবনের পথেই কোথাও হুট করে থেমে গেছি। বহুদিন হলো আমরা বাচ্চার কথা ভাবি না। বিয়ের পরে বছরতিনেক ভেবেছিলাম, পরিকল্পনা প্রায় হয়েই এসেছিল। তারপরই আমার পা গেল, এখন বাচ্চা মানে সংসারে আরেকটি অস্তিত্ব, লীনার ওপরে দ্বিগুণ চাপ। বাবা হিসেবে কোনো দায়িত্ব কি আমি পালন করতে পারব? তখন চাকরি করে বাড়ি ফিরে লীনাকে সামলাতে হবে আমিসহ দুই বাচ্চা। সে রকম একটা পরিস্থিতি লীনা নিশ্চয় চায় না আর। লীনা এমনিতেও বাড়তি কিছু সামলাতে চায় না। যেমন ডান পা কাটার পরে আমার আর গাড়ি ড্রাইভ করার প্রশ্ন ওঠে না। লীনাকে বললাম ড্রাইভার রাখতে। সে তার বদলে পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়ে গাড়িটাই বিক্রি করে দিল। অফিসের গাড়িই নাকি তার জন্য যথেষ্ট।
ক’দিন হলো শহরে নির্বাচনি হাওয়া লেগেছে। টানা হরতাল-অবরোধ মাসের পর মাস, পেট্রল বোমায় পোড়া মানুষের মিছিল, সত্যি, এদেশের মানুষের সহ্যশক্তি অসাধারণ। শেষে একদিন ঘোষণা এল অবরোধ স্থগিত। তখন জানা গেল যে তাদের মনে ছিল তারা কোনোদিন অবরোধ ডেকেছিলেন। এই সময়টার চেয়ে বড়ো প্রমাণ আর কী-বা হতে পারে যে সাধারণ মানুষ মারা গেলে কারোই কিছু আসে-যায় না? তবু ভালো যে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এল। এসএসসি পরীক্ষা, বাণিজ্য মেলা, বইমেলাসহ হাজারও উপলক্ষ্য যখন হরতালকে একচুল নাড়াতে পারেনি, তখন নির্বাচনের স্বার্থে ঠিকই তা নড়ে গেল। তবে কারণ যাই হোক, মানুষ কিছুটা স্বস্তি তো পেল। রাতারাতি সাজসাজ রব শহরে। এই এক চিলতে বারান্দায় বসেই আমি স্পষ্ট সেই বিষয়টা ধরতে পারলাম। গলির আকাশ ঢেকে গেল পোস্টারে। দড়িতে টাঙানো পোস্টার, একেকটা একেক প্রার্থীর মহত্বের কথা বলে, বলে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। ওপর থেকে সেসব পোস্টারের গালভরা কথাগুলো পড়তে ভালোই লাগত। দখিনা বাতাসে পোস্টারগুলো পতপত করে উড়ত, রাস্তায় চলাচলকারী মানুষের চোখ পড়ত নিশ্চয় তখন। বিয়ের পর আমি আর লীনা ভুটানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। পাতলা কাপড়ের টুকরোয় মন্ত্র লিখে সেখানে দড়িতে টাঙানো থাকে। যতবার বাতাস সেগুলোকে নাড়িয়ে দেয় ততবার মন্ত্র পড়া হয়ে যায় বলে তারা বিশ্বাস করে। নির্বাচনের পোস্টার নড়তে দেখলে আমার ওরকম মনে হয়, ভোটের সিজনের দেবতা ভোটাররা ততবার সেদিকে তাকাবে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টটা দোতলায় হলে আমি তত ভালো দেখতে পেতাম না, তিনতলায় বলেই ওপর থেকে পাখির চোখে দেখি। ছোটোকালে দেখা বিয়েবাড়িতে যেমন একটা বাঁশ থেকে দড়ি চলে যেত আর তাতে আটকানো থাকত ত্রিকোণাকৃতি রঙ-বেরঙের কাগজ, ওপর থেকে গলির চেহারাটা দেখতে ওমনই লাগত তখন। তবে একা থাকি বলে যে সারাদিন মুখ গোমড়া করে থাকি, তা নয়। এর মধ্যেই একদিন আপন মনে হো হো করে হাসতে হয়েছে আমাকে। দুপুরের পরপর বসে ছিলাম বারান্দায়। হঠাৎ শুনি মিছিল আসছে; নির্বাচনি মিছিল নিঃসন্দেহে। একজন স্লোগান দিচ্ছে, পরপরই সমবেত কণ্ঠে সেই স্লোগান পূর্ণতা পাচ্ছে। আমি উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম গলির মাথার দিকে। বহুক্ষণ কেটে গেল কিন্তু গলিতে মিছিলের দলটি এল না। বহুদিন আমি অতগুলো মানুষকে একসাথে দেখিনি, আমার লোভ হলো। কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপারও তো ঘটতে পারে, কিছু ভাঙচুর, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। সেসব দেখার লোভে আমি অপলক তাকিয়ে থাকলাম। আরও কিছু সময় কেটে গেল স্লোগান শুনতে শুনতে, ‘বাসযোগ্য ঢাকা’ কথাটা আমার মাথায় বসে গেল, তা নিয়ে আমি আরব্য রজনী রচনা করে ফেললাম মনে মনে, অথচ মিছিলের কোনো দেখা নেই। পেপারে পড়েছি মেইন রোডে পোস্টার লাগানো নিষেধ, তাই পোস্টার কেবল গলিতে। কিন্তু মেইনরোডে নিশ্চয় মিছিল নিষিদ্ধ নয়। হয়তো ওটা মেইন রোড দিয়েই চলে যাবে, আমার আর দেখা হবে না। মোটামুটি হতাশ হয়ে গেছি, এমন সময় দেখি গলির মাথার দিক থেকে একটা ভ্যান খানিকটা এগিয়ে এসে দাঁড়াল। ভ্যানচালক ঘিরে থাকা মানুষদের মধ্যে লিফলেট বিলি করছে। সেই ভ্যানের ওপরে রাখা একটি স্পিকার থেকেই রেকর্ডেড মিছিলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি শব্দ করে হাসা শুরু করলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম যে ডিজিটাল বাংলাদেশে বাস করছি!
সেদিন লীনা অফিস থেকে আসার পরেও আমার মুখে হাসি লেগে ছিল। লীনা এসে গ্রিল ধরে দাঁড়াল।
‘কী, আজ খুব খুশি দেখছি?’
‘শোনোই না লীনা, আজ কী হলো-’
আমি পুরো ঘটনাটা সাসপেন্স মাখিয়ে বর্ণনা করলাম। কথা বলার সময়ে কেন যেন আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম যে আজকাল আমরা আর ওভাবে গল্প করি না, জোরে শব্দ করে হাসি না। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল এটা আগের কোনো সন্ধ্যার মতো একটা সন্ধ্যা যখন আমরা সামান্য আগেপরে অফিস থেকে ফিরতাম, তারপর এই বারান্দায় চা নিয়ে বসে হাসাহাসি করতাম। গল্প থেকে উঠে আসা গল্পের তোড়ে লীনা কাপড় বদলাতেই ভুলে গেল সেদিন। ক্লান্তি ভুলে রাতের খাবারের আগপর্যন্ত ওখানেই বসে ছিল। কথায় কথায় বলে ফেলল যে এর মধ্যে কয়েকবার সে আমার ব্যাংকের হেড অফিসে গিয়েছিল। মানবিক কারণে আমাকে এক বছরের ছুটিতে রাখা হয়েছে, তবে এটা জানাই কথা যে এ অবস্থায় আমি হয়তো আর অফিসে ফিরে যেতে পারব না। বরখাস্ত না করে আদর করে ‘ছুটি’ বলা হয়েছে সেটা শুধু আমি কেন, লীনা জানে, অন্যেরাও জানে। আবার আমার জয়েনিঙের ব্যাপারে লীনা তদবির করছে জেনে মনে মনে বিরক্তই হয়েছিলাম। তবে তার ভালোমানুষির সামনে কিছু বলতে পারিনি। দূরের মানুষেরা যেমন হরহামেশা ফোন করে সান্ত্বনা দেয়, লীনাও কেন যেন তখন সেরকম করছিল।
‘বছরখানেক হয়ে গেছে তুমি বসে আছ। চিকিৎসা তো প্রায় শেষ। ডাক্তার বলেছেন আর মাস তিনেকের মধ্যেই পায়ের নতুন গ্যাংগ্রিন বা অন্য ঝামেলাগুলো ঠিক হয়ে যাবে। তখন তুমি নিশ্চয়ই আবার ব্যাংকে যেতে পারবে। সেলসে বা কাস্টমার সার্ভিসে না থাকলে কী আর এমন ছোটাছুটি সেখানে? তোমাকে ওরকম একটা কোথাও দেয়া হবে। আমি ব্যাপারটা নিয়ে লেগে আছি।’
আমার কেন যেন কিছুই বলতে ইচ্ছে করেনি। লীনাকে অন্তত ধন্যবাদ দেয়া উচিত ছিল। নিজের কাজ করে, বাড়ির কাজ করে তারপর আবার আমার চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য তদবির করছে, ছোটাছুটি করছে। কিন্তু কেন যেন তা-ও বলতে ইচ্ছে হলো না। শুধু একটা কথা ভেতর থেকে উগরে আসার মতো মুখের কাছে হইহই করছিল, বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘লীনা, তুমিও জানো, সবাই জানে, আমার ভেঙেছে পা। কিন্তু শুধু আমি জানি, আমার ভেঙেছে মনোবল।’
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে লীনা অন্য কথা বলল, ‘আচ্ছা, এই যে বারান্দায় সারাদিন বসে থাক, মজাও আছে অবশ্য, আজ যা বুঝলাম। কিন্তু জানো টিভিতে কত মজার মজার অনুষ্ঠান হয়? সেসব দেখলে হয় না?’
তা আছে। টিভিতে কত কৌতুকাভিনয়ের প্রতিযোগিতাও হয়, জানি আমি। তবে টিভি আমি রাতে দেখি, লীনা জানে। অফিস থেকে ফিরে যেমন খাবারের পরে দেখতাম। দিনে কেন টিভি দেখব? ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই হাসি। এখনও যেন দিনে আমি অফিস করি! কোনো কোনোদিন লীনার কথামতো সত্যিই দিনের বেলা একটু-আধটু টিভি দেখি। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে অনুষ্ঠান নাকি অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখছি সেটা নিয়ে ভাবতে থাকি। কখনও কখনও বিজ্ঞাপন দেখতে না চাইলে অন্য চ্যানেলে চলে যাই তারপর বেমালুম ভুলে যাই কী দেখছিলাম। ঘণ্টাদুয়েক পরে হঠাৎ মনে পড়ে, হায়, আমি না ওই নাটকের শেষটা দেখতে চেয়েছিলাম! আমার জীবনের বর্তমান অবস্থার মতোই সেই নাটকের অর্ধেক কাহিনিটা ঝুলে থাকে আমার মাথায়, কিছুতেই নামে না, আবার পরিণতির ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্তও নিতে পারি না। কোনোদিন আগের রাতের টক-শোয়ের রিপিট টেলিকাস্ট দেখি। মধ্যরাতে নামিদামি লোকেরা কষ্ট করে ঘুম বাদ দিয়ে গলাবাজি করতে আসেন, কখনও দেখা উচিত। রাতে দেখলে লীনার ঘুমের ব্যঘাত আবার দেখাটা টেনশনেরও। এই তো সেদিন আলোচনার মাঝে একজন আরেকজনকে পেটাতে লাগলেন। সমাজে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত দুজন মানুষ হাতাহাতি করছেন, হাজার মানুষ তা লাইভ দেখল, নিরুপায় অ্যাংকার বিরতি নিয়ে ভেগে গেলেন। টিভি বন্ধ করে আমি কল্পনায় দৃশ্য সাজাতে লাগলাম। টক শো-কে কিছু সিম্পল পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম পর্বে আহ্লাদ, কোলাকুলি, ব্যাকগ্রাউন্ডে আনন্দময় মিউজিক। সেটে তখন ঈদ-ঈদ ভাব, কোমর বেঁধে তর্কে নামার আগে সামান্য শো-অফ। দর্শকরাও ফোন করে জানাবেন প্রতিপক্ষের সাপোর্টার কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে কোলাকুলিতে কী পরিমাণ আনন্দ পাচ্ছেন। দ্বিতীয় পর্বে জ্বালাময়ী রাজনৈতিক আলোচনা তবে হাতাহাতিবিহীন। কারণ হাতাহাতির জন্য তো তৃতীয় পর্ব পড়েই আছে। মনোমুগ্ধকর রেসলিংসর্বস্ব সেই পর্বের নাম ‘হাত থাকতে মুখে কী’। আলোচনা পর্বে যার আঁতে যত ঘা লেগেছে কিংবা অতীতের কোনো টক শোয়ের উসুল না হওয়া ক্ষোভ অনুযায়ী হিসেবনিকেশ চলবে সেখানে। ওদিকে দর্শকরাও ফোন করে বলতে পারবেন কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের নাক ফাটানো কি হাত ভাঙার কতদূর। এই রেসলিং পর্বটি চালু হলে আর চিন্তা নেই; তৃতীয় পর্বে শায়েস্তা করার লোভে দ্বিতীয় পর্বে একটা ’দেখে নেব’ গোছের ভাব আসবে, আলোচনায় স্পিড আনতে এটা খুব জরুরি। আসলে ভদ্রভাবে আলোচনা এগিয়ে নেয়ার জন্য তৃতীয় পর্বের মূলোটাই হবে ইনসেনটিভ। পুরো ব্যাপারটাতে সবচেয়ে নাজুক যার অবস্থান, তিনি হলেন অ্যাংকার, তৃতীয় পর্বে যিনি রেফারি, জাদুঘর থেকে প্রাচীন নাইটের তামার পোশাক ভাড়া করা মনে হয় ভালোই হবে তার আর মাথায় হেলমেটও থাকা উচিত। নিরপেক্ষ মানুষ তো সবার শত্রু, তাই তার নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। প্রায় প্রতিদিনই কল্পনার মাঝখানে আমি ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু তখন লীনার টিভি দেখার কথায় এসব বলতে ইচ্ছে করল না। কিছু না বলে বরং ক্র্যাচটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম; ভাবছিলাম ভাঙা পায়ের জন্য ক্র্যাচ- মৌলিক একটা আবিষ্কার। ভাঙা মনোবল নিয়ে উঠে দাঁড়ানোর জন্য এমন কিছু আবিষ্কার হয়েছে কি?
তবে শারীরিকভাবে উঠে দাঁড়ানোর জন্য যে আমি ক্র্যাচের ওপরেই নির্ভরশীল সেটা মাঝে মধ্যে একেবারে ভুলে যাই। এই তো সেদিন দেখি গলির মাঝামাঝি এক বাড়ির সামনে রিকশা এসে থামল। রিকশা থেকে এক মহিলা নেমে ব্যাগ থেকে ভাড়া বের করে দিতে যাবেন আর আমার এদিক থেকে একটা মোটর সাইকেল তার ব্যাগটা টান মেরে নিয়ে সোজা মেইন রোডে হাওয়া হয়ে গেল। সুনসান দুপুরে গলিতে আর কোনো মানুষের আনাগোনা না থাকায় কাজটা করতে মোটেও ঝামেলা হয়নি। মহিলার চিৎকারে রিকশাওলা খানিকটা পেছনে ছুটেছিল বটে, তবে মোটর সাইকেলের অনেক পেছনে পড়ে থাকল সে। আর এদিকে আমার যা হলো, আমার চোখ কোনো কারণ ছাড়াই মোটরবাইকটাকে অনুসরণ করছিল। নিস্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ গিয়ার বদলানোর আওয়াজেই হবে হয়তো। দেখলাম পেছনের জনের হাত মহিলার ব্যাগের দিকে প্রসারিত হচ্ছে। আসলে আমার কেন যেন মনে হয়েছিল মহিলাকে ছুঁয়ে দেয়ার মতলব। কিন্তু দেখি ব্যাগ শূন্যে উঠে গেল। এক মুহূর্তের ঘটনা, আমি হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালাম। গ্রিলের দিকে এগিয়ে চিৎকার করে কিছু বলতে চেয়েছিলাম হয়ত। কিন্তু গলা দিয়ে কিছু বেরোনোর আগেই পায়ে পা জড়িয়ে ধড়াম করে পড়ে গেলাম। আগের দিন কিছু ফুলের টবে মাটি নিড়িয়ে টবগুলো লাইন করে রেখেছিল লীনা। আমার কপালটা গিয়ে পড়ল সিমেন্টের এক টবের ধারে। ইঞ্চি দুয়েক কেটে গেল। সেটা কিছু না, তবে সোজা দাঁড়ানো থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম বলে কোমরে আর পায়ে বেশ ব্যথা পেলাম। অফিস থেকে ফিরে সেদিন লীনা আর দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলল না, সোজা চলে এল আমার কাছে। কপালে হাত রেখে উতলা হলো, ‘হায় হায়, কাটল কী করে!’
লীনার উৎকণ্ঠা আমার বেশ লাগছিল। কপালের ক্ষতটা সে বারবার পরীক্ষা করছিল। আমি কোনোরকমে উঠে গিয়ে স্যাভলন লাগালেও সে স্বস্তি পেল না। ফার্স্ট এইডের বাক্সটা নিয়ে পাশের টুল থেকে পেপার আর বইপত্রগুলো মেঝেতে রেখে সেটা টেনে বসল। ভালো করে পরিস্কার করে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে দিল। তার চোখেমুখে আতঙ্ক, কেন ওভাবে উঠে দাঁড়াতে গেলাম, চাইলেই কি এখানে বসে ছিনতাইকারীদের থামাতে পারতাম, এসব নানা কথা বলে আমাকে বকাঝকা করতে লাগল। রাগ পড়লে আলতো করে আমার কপালে হাত রেখে বলল, ‘ইস্ অনেকখানি তো, আবার দাগ না পড়ে যায়!’
লীনার এই কথায় আমার চোখে পানি চলে এল। আমার একটা পায়ের অর্ধেক নেই, অথচ লীনা আমার কপালে সামান্য আঁচড়ের মতো একটা দাগ থাকা না-থাকা নিয়ে চিন্তিত হচ্ছে! এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার মনে হলো, আমি যেমন আমার পা আস্ত না-থাকার কথা প্রায়ই ভুলে যাই, লীনাও ঠিক তেমনি ওটা ভুলে যায়। আমার কেন যেন হঠাৎ লীনাকে ডেকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। সে ততক্ষণে গোসলে চলে গেছে। পরেও আর জড়িয়ে ধরা হলো না, ক্লান্ত লীনা সারাদিনের কাজ সেরে ভেজা চুল বালিশের পেছনের দিকে পাঠিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। অনেক রাত পর্যন্ত প্রায় শব্দহীন টেলিভিশনের আলোর ঘনঘন তারতম্যে লীনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি; কখনও সে বিষণ্ন, কখনও ঘুমের ঘোরেই উদ্ভাসিত!
তার পরদিন সন্ধ্যায় আবার সেই ঝা চকচকে সাদা প্রিমিও। সেদিন আগে থেকেই আমি ক্র্যাচ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আগে থেকেই তৈরি হলাম, কেন যেন মন বলল কিছু দেখতে পাব। দেখলাম গাড়িটা বাসা থেকে অল্প সামনে পার্ক করা হলো। লীনা নামল আর সেখান থেকে মাথা উঠিয়ে আমার বারান্দার দিকে তাকাল। সে জানে আমি এখানেই থাকব কিন্তু সঙ্গে যিনি আছেন তিনি তা জানেন না। তিনি সাধারণভাবে লীনাকে অনুসরণ করলেন। লীনার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমি বিব্রত হলাম, যেন গ্রিলে কাটা কপাল ঠেকিয়ে এভাবে আমার দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হয়নি অথবা আমি ধরা পড়ে গেছি। লীনার সাথে খানিক পরেই কেউ আসবে জেনে আগে থেকেই বসার ঘরে এলাম। দেখি লীনার পরপর ঢুকল আমারই পুরোনো কলিগ জোবায়ের। সে কোথা থেকে লীনার সাথে জুটল বুঝলাম না। ‘কেমন আছেন, আনিস ভাই?’ বলে সে এগিয়ে এল। তাকে দেখে আমার খুশি হওয়া উচিত অথচ আমি কেন যেন অস্বস্তি বোধ করছিলাম। তবে সে খুব সহজ, সাবলীল।
‘অনেকদিন পরে দেখা, আনিস ভাই। এত ব্যস্ত থাকি, আসা হয় না। তবে ব্যাংকে আপনার কথা খুব হয়। যাই হোক, কথা হলো আজ ভাবি ডাক্তারের সব কাগজপত্র পৌঁছে দিতে অফিসে এলেন, কাজ কম ছিল, ভাবলাম দেখা করে যাই।’
‘ভালো করেছ।’
‘ফর্মালিটিজ যা আছে তিন-চারদিনের বেশি লাগবে না। কদিনেই আপনি জয়েন করতে পারেন।’
‘অনেক ধন্যবাদ।’
তার সঙ্গে কথা বলছিলাম ঠিকই তবে আমার মাথায় ঘুরছিল অন্য কথা। আজ যদি সে এ কারণে এল, তবে আরেকদিন এসেছিল কেন? আর এসেছিলই যখন তখন আমার সঙ্গে দেখা না করে কেবল লীনাকে নামিয়ে দিয়ে চলেইবা গিয়েছিল কেন। লীনা দ্রুত তাকে চা-নাস্তা দিল, ট্রে থেকে জিনিস নামাল, চা ঢালল কাপে, আমার তীক্ষ্ণ চোখ লীনা আর জোবায়েরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। অথচ আমি কারও ভঙ্গিতে কিছুই পাচ্ছিলাম না। মনকে বোঝালাম, হয়তো সেদিন জোবায়েরের তাড়া ছিল, প্রায়ই সে লীনার সাথে ঘুরে বেড়ায় এমন যে ভাবনাটা আমার মনে আসছে, সেটা ঠিক নয়। আমার চাকরি পুনর্বহাল রাখার জন্য লীনা যে ছোটাছুটি করছিল, জোবায়ের সেখানে তাকে কেবল সাহায্য করেছে, আর কিছু না। আমার মন হয়ত মানল ঠিকই কিন্তু কেন যেন লীনা এলে জড়িয়ে ধরব, এই ভাবনাটা আর মনে এল না।
আজও লীনা অফিসে যাবার পরে আবার বারান্দায় এসেছি। মাঝে মাঝে কেন যেন সে বেরিয়ে যাবার পর থেকেই তার ফেরার প্রতীক্ষা করতে থাকি। তবে আজ লীনার কথামতো দুপুরে খেয়ে টিভি দেখছিলাম। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছি। সন্ধ্যায় বারান্দায় আসতে না আসতেই লীনা এল, ছুটে এসে সোজা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি অবাক হলাম, সে কী করে জানল আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছি?
‘সবকিছু তৈরি হয়ে গেছে। তুমি কাল থেকে জয়েন করতে পার। যাবে না?’
‘অবশ্যই যাব, লীনা।’
‘আমি জানতাম। তুমি যতই বল আর সম্ভব না, কিন্তু তুমি চেষ্টা করবে, আমি জানতাম।’
লীনার চোখ চকচক করছিল। চা বানিয়ে নিয়ে সে বারান্দায় এল। দখিনা বাতাসে বসে অনেকক্ষণ আমরা গল্প করলাম। কতবার আমার অফিসে সে গেছে, কতজনের সাথে কত গল্প হয়েছে, অনেককিছু বলল। শেষে সংসারের কথা বললাম আমরা, আমাদের কথা বললাম। আমার ইস্ত্রি করা শার্ট আর টাই রেডি করা আছে, সে কথাও মনে করিয়ে দিল লীনা। কাল থেকে অফিসে যাব ভাবতেই মনে হলো মাঝে কোনো সময় ছিল না, কিছুই যেন হয়নি, শুধু কোথা থেকে হুট করে এক বারান্দা আমার জীবনে এসে পড়েছিল। তবে তারই মেঝেতে দাবার ছকের মতো সাদাকালো টাইলসের দিকে তাকিয়ে মনে হলো কোনো দানে আমি জিতে গেছি। লীনা আমাকে জিতিয়ে দিয়েছে।
প্রশ্নোত্তর
শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?
আফসানা বেগম: কল্পকাহিনি লেখার ব্যাপারে প্রধান তাড়না হলো কথা বলার তাগিদ। গল্প লেখার বিষয়টাও তেমনই। মনে হয় অনেক কথা জমে যায় আর কোনো না কোনো জায়গায় তা বলতে হয়। তবে বলার জায়গা থাকে বলেই বলতে শুরু করি ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং বলার প্রয়োজন হয় তাই বলার জায়গা তৈরি করে নিই। গল্প আমার কাছে সেরকম একটা প্ল্যাটফর্ম। গল্পকে নানারকম কল্পকাহিনির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয় আমার কাছে। গল্পে অল্প পরিসরে সুদূরপ্রসারী বিষয়ের ইঙ্গিত দেয়া যায়, তাই লিখতে চাইলে গল্প লেখার তাড়নাই বেশি বোধ করি।
বিশেষ একটা সময়ে একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, মনোযোগী পাঠ, নিরবচ্ছিন্ন অবসর এবং সর্বোপরি সাময়িকভাবে সামাজিক জীবন বিচ্ছিন্নতা আমাকে স্মৃতিময়তার ঘোরের মধ্যে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিয়েছিল।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?
আফসানা বেগম: লেখক হয়তো তার নিজের জীবনকেই বারবার লেখে। এক জীবনের হাজার ঘটনাকে বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে দেখতে বিভিন্ন প্রকাশ ঘটে। অর্জিত অভিজ্ঞতা তার নিজের থেকে হয়ে ওঠে সকলের। আমার ক্ষেত্রেও ছোটোবড়ো অভিজ্ঞতা লেখালেখির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্র ধরে কখনও বিস্তৃত কল্পনার দরজা খুলে যায়। অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে তাতে নতুন কোনো কাঠামো দেয়া সহজ হয়।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।
আফসানা বেগম: আমি মনে করি যে সময়ে একটি সাহিত্য রচিত হচ্ছে সেই সময়টা সামান্য হলেও সেই সাহিত্যে ছায়া ফেলবে। অর্থাৎ, আমি প্রত্যাশা করি একজন লেখক পৃথিবীতে তার বিচরণের কালটি নিজের রচনায় তুলে ধরতে ন্যূনতম চেষ্টা করবেন। এভাবে একটি যুগের বহু লেখকের সম্মিলিত লেখনীর মাধ্যমে যুগটি যুগান্তরের পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে। এখন কথা হলো, একটি যুগের খুঁটিনাটি লিখতে হলে তার রাজনৈতিক বাস্তবতা কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয়। তাই রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং তার ফলশ্রুতিতে মানুষের সামাজিক জীবনে আসা পরিবর্তন সুনির্দিষ্ট সময়ের কথাসাহিত্যে প্রভাব ফেলবেই।
রাজনৈতিক বাস্তবতা যদি লেখকের মননশীলতাকে প্রভাবিত না করত তাহলে জর্জ অরওয়েল রাশান বিপ্লবের পরে রাশিয়ার অযৌক্তিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কটাক্ষ করে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত কল্পকাহিনি হিসেবে খ্যাত দ্য অ্যানিমেল ফার্ম বা ১৯৮৪ রূপক উপন্যাসগুলো লিখতেন না। সোজা কথা, সেই আদিকালে চার্লস ডিকেন্স যেমন রাজনীতি থেকে প্রভাবিত হয়ে এ টেল অফ টু সিটিজলিখেছিলেন, তেমনি পরে সালমান রুশদি মিডনাইট’স চিলড্রেন লিখেছেন, আর মোটামুটি হাল আমলে ড্যান ব্রাউন দ্য ভিঞ্চি কোড লিখেছেন। সমসাময়িক রাজনীতির প্রভাব পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যে বরাবর লক্ষণীয়। যে কারণে বাংলা সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দোপাধ্যায়, মিহির সেনগুপ্ত এ অঞ্চলের মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বড়ো ঘটনা, দেশভাগ নিয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস রচনা করেছেন। আমাদের দেশের সাহিত্যের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করার পর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার প্রথম উপন্যাস, চিলেকোঠার সেপাই রচনা করতে উদ্বুদ্ধ হন। মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন, কলোবরফ উপন্যাসগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও তার পর বাংলাদেশের বড়ো রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিচ্ছায়া বহন করে।
শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
আফসানা বেগম: ঠিক কাঁদিয়েছে বলব না তবে তাৎক্ষণিক কান্নারও অধিক, আমাকে দীর্ঘদিন মানসিক অস্বস্তিতে রেখেছে, দিনের পর দিন ভাবনার চাপে অসহায় বোধ জাগিয়েছে- এমন গল্পের কথা বলতে পারি। যদি পাঠ করা বহু গল্পের মধ্যে মাত্র একটি গল্পের কথা বলতে হয় তবে আমি বেছে নেব, সুবোধ ঘোষের জতুগৃহ। অল্পবয়সে পড়া তবে তখন থেকে শুরু করে আমার এখনকার জীবনবোধেও এই গল্প ধাক্কা দেয়।
নর-নারীর প্রেম কল্পকাহিনি কিংবা তাবৎ শিল্পের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পৃথিবীর সমস্ত কিছুই বলতে গেলে প্রেম ও মানবিকতার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। তাই কল্পকাহিনির বিষয়বস্তুতে যতই বৈচিত্র আসুক তা মূলত মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রেম-বিচ্ছেদের মধ্যেই ঘুরপাক খায়। আর সেই প্রেমের সঙ্গে যদি যুক্ত হয় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও, তবে তা আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাহিনি হয়ে ওঠে। সুবোধ ঘোষের লেখার বেশিরভাগ বিষয়বস্তু তেমন। অভ্যর্থনা গল্পেও তিনি রীতিমতো একজন মনোবিজ্ঞানীর মতো মানুষের মনের অলিগলি ধাওয়া করেছেন, তবে শেষ বিচারে আামর কাছে জতুগৃহ শ্রেষ্ঠ। গল্পটি মানুষের জীবনের সঙ্গে যেকোনো কালে, যেকোনো স্থা্নেই প্রাসঙ্গিক।
বিবাহবিচ্ছেদের সাত বছর পরে শতদল ও মাধুরী নামের দুই নর-নারীর কোনো এক অখ্যাত রেলওয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে আকস্মিক দেখা হয়। ততদিনে দুজনেই ভিন্ন জীবনসঙ্গী বেছে নিয়েছেন। অপ্রত্যাশিতভাবে দীর্ঘসময়ের জন্য একসঙ্গে থাকার কালটুকু বিব্রতকর তাদের জন্য। অপ্রস্তুত এই পরিস্থিতিটি ছোটো ছোটো বাক্যে, অতি সাধারণ বর্ণনায় পাঠকের চেতনার গভীরে স্পর্শ করার মতো ঘটনা ঘটে এই গল্পে। গল্পে গল্পে নিজেদের অতীত আনন্দের স্মৃতিচারণ করেন তারা। তারপর রাত ফুরোলে যে যার গন্তব্যের দিকে ছোটেন। লেখকের বর্ণনায় পিছনে টেবিলের উপরে পড়ে থাকে দুটো চায়ের কাপ। কোথা থেকে দুজন ভিন্ন মানুষ তৃষ্ণা মিটিয়ে নিজ নিজ রাস্তায় চলে গেছেন আর কাপ দুটোও একটু পরে পরিষ্কার হয়ে হয়তো পড়ে থাকবে তাকের দূরবর্তী দুটি দিকে। জীবনের ভিন্ন বাস্তবতায় এবং ভিন্ন বয়সে বিচিত্র গল্প পাঠক হিসেবে আমাকে ধাক্কা দিয়েছে তবে এই গল্পে যে ধাক্কা তার রেশ বরাবর আমার মনকে আর্দ্র করে।
শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
আফসানা বেগম: আমি তাই লিখি যা আমার লিখতে ইচ্ছা করে। কাঠামো বা ফর্ম নিয়ে কখনও তেমন ভাবি না বা উপযুক্ত সাহিত্য-শিক্ষার অভাবে ভাববার যোগ্যতাও হয়তো আমার নেই। কাহিনি বা চরিত্র ভেবে নিতে পারলে তার উপযুক্ত পটভূমি আর বলার ভঙ্গির ব্যাপারে লেখার মুহূর্তে যে ভাবনা আসে তাকেই গ্রহণ করি। ফর্ম বা কাঠামো নিয়ে দীর্ঘ ভাবনা যেহেতু ভাবি না তাই ভাঙাগড়ার প্রশ্ন নেই। শুধু লক্ষ রাখি যেন একঘেয়ে গদ্য না লিখি, নতুন রচনা পুরোনো রচনার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। তাই বিষয় বৈচিত্র, পটভূমি ও চরিত্রের বৈচিত্র্য আনতে চেষ্টা করি।
শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?
আফসানা বেগম: ছোটোগল্প হতে হবে পাঠকের কল্পনার জগতে একটা ধাক্কার মতো। কয়েকটি মাত্র পাতা পড়ে পাঠক দীর্ঘ সময় তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হবে, এমনই হওয়া উচিত ছোটোগল্পের গঠন। আমার মনে হয় প্রথমত, কাহিনি যাই হোক, গল্পকারকে তা পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। সুতরাং বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতেই হবে, সঙ্গে থাকবে টান টান গদ্য। আর একটি গল্পে পাঠক যদি জীবনের বিশেষ কোনো সত্যের সন্ধান পান, গভীর কোনো অনুভূতি পাঠকের মনে সঞ্চারিত হয়, তাহলে তাকে সার্থক গল্প বলব।
শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
আফসানা বেগম: লেখক একজন মানুষ ও স্বাধীন নাগরিক। তার নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ বা প্রতিষ্ঠিত আদর্শের প্রতি সমর্থন থাকতে পারে। তবে নিদেনপক্ষে লেখকের রাজনৈতিক বোধ থাকাটা খুবই জরুরি। লেখক জীবন লেখেন তাই জীবনবোধ তার প্রাথমিক প্রয়োজন, এরপর সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে নাড়াচারা করার পূর্বশর্তই হলো লেখকের রাজনৈতিক বোধ।
লেখক নীরবে সমাজ পর্যবেক্ষণ করেন। যেকোনো ধরনের অন্যায় ও অন্যায্যতা লেখকের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার যে প্রতিবাদ তা লেখনীর মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধেও লেখকের অবস্থান একই থাকার কথা। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অনিয়ম, অরাজকতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লেখক একটি কণ্ঠ হয়ে উঠবেন।
শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!
আফসানা বেগম: একটি উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি অন্যান্য ধরনের কাজ, যেমন ছোটোগল্প কিংবা নিবন্ধ লিখছি। সাধারণত কয়েকরকম কাজ সমান্তরালে করতে আনন্দ পাই। কল্পকাহিনির ফাঁকে ফাঁকে ইতালো ক্যালভিনোর কিছু ছোটোগল্প অনুবাদ করছি।
More Posts From this Author:
- None Found