বিনয় বালার বাড়ি দখলের দিন

Share this:

বিনয় বালার বাড়ি দখলের দিন

 

ভরদিয়া হাটে দলের আস্তানায় বসে আজিজ সিকদার সামনে তাকায়। দ্যাখে বিনয় বালা যায়। তখন ত্রিমোহনার পাড়ে তার বাড়ির কথা মনে পড়ে- স মিল বসানোর পারফেক্ট জায়গা। কিন্তু এত লোকের সামনে ডেকে এনে তা বলা যায় না। তাই অফিসে লোকজনের ভিড় কমলে, নিরিবিলির পথে দু’কদম হাঁটলে জিকুরে ফরমাশ করে- দ্যাখো তো বিনয় বালা কই? তারে ডাইকা আনো।

বিনয় বালার আগামুড়া জিকুর চেনা। দুই নম্বর ওয়ার্ডের কোকড়াকাঠি গাঁওয়ের বাসিন্দা। পুরাদস্তুর নমশূদ্র, হিন্দুগো তলানির জাতের লোক। তারপর আবার নিজের কোনো জমি-জিরাত নাই। পরের বাড়ি কাম কইরা খায়। এরহম জাতে ছোট, কামে হীন লোকরে আবার দরকার ক্যান?

-অর বাড়িডা নিমু। স মিল বসামু।

অ্যাঁ! হিন্দুরা সব আমাগো লোক। দলের বগলতলায় তাগো বসবাস। তাই তাগো বাড়িঘর নেয়া, হাতের মুঠোয় পোরা আইজকাল খুব সোজা। তারপর নমশূদ্রগোডা তো একেবারে জলের মতো তরল। কয়েকজন মিইল্যা গিয়া ধাওয়া দিলেই তারা ভা–বাটি, হাড়ি-কুড়ি গুটায়। বস্তাবন্দি কইরা ওপাড়ে পাড়ি জমায়। মামলা-মোকদ্দমা, কোর্ট-কাচারি, থানা-পুলিশ- কোনো কিছুর ধার ধারে না। তাহলে বিনয় বালার বাড়ি নেবার লাইগা তারে আবার ডাকাডাকির কী আছে?

-এ্যাকটা মাস সময় দিয়া দ্যাহি। যদি শান্তিমতো ছাড়ে।

কিন্তু আইজ মঙ্গলবার, ভরদিয়া হাট পাকার দিন, জমজমাট হয়ে বসার বার। তারপর এখন সন্ধ্যার আগেভাগে, ভর বিকালে তার তুঙ্গ মুহূর্ত। বুকজুড়ে তাই হাজারো লোকজনের সরগমা সমাবেশ। তাগো মধ্যে বিনয় বালারে কই পাই? কোথায় তারে খুঁজি? জিকু তাই একটু ইতস্ততায় ভর দেয়। তখন আজিজ সিকদারই পথ বাতলায়- ‘এ্যাকটু আগে হ্যারে ঐ দিকে যাইতে দ্যাখছি। মোনে অয় তরকারি হাটায় গ্যাছে।’

দলের অফিসটা হাটের মাঝ বরাবর। তার শিরদাঁড়া, সদর-সড়কের পাশে। যেহেতু দল এখন ক্ষমতায়, তাই গা-গতর জুইড়া হাজারো রঙিলা পোস্টার-ব্যানারের বহরে ঘোমটা দেয়া নববধূর মতো অবস্থা তার। তবে তার ফাঁক-ফোকর গলে হাটের সদর-সড়ক, মেইন রোড চোখে পড়ে। সে পথ ধরেই তাহলে, আর কারও না হলেও আজিজ সিকদারের চোখ ঠিকই বিনয় বালারে দ্যাইখা নিছে।

জিকু তাই অফিস থেকে বার হয়ে লিডারের দেখানো পথে, ডানদিকের রাস্তায় তরকারি হাটা পানে পা বাড়ায়। দুটো গলি পার হয়ে তার সামনে গিয়া দাঁড়ায়। দ্যাখে, রাস্তার দুপাশের খোলা জায়গায় শাক-সবজি বিক্রেতাদের আসর। তাদের ঘিরে লোকজনের তেমন ভিড় নাই। তাই এক নজরেই চিনে ফ্যালে- হ্যাঁ, ঐ তো খাটো করে পরা লুঙ্গির উপর  রংজ্বলা তোবড়ানো শার্ট গায়ে বিনয় বালা। হাতে সারের বস্তা কেটে বানানো ব্যাগ। আর পঞ্চমীর চাঁদের মতো ফালি ফালি করে কেটে রাখা কুমড়ো পানে নজর। জিকু দু’কদম আগায়ে তার পাশে গিয়া খাড়ায়- ‘পার্টি অফিসে আজিজভাই আপনেরে ডাকে।’

কুমড়োর ফালি থেকে চোখ তুলে একনজর তাকায়েই বিনয় বালা যেন সরকারি দলের লোকাল লিডারের ডাইন হাত হিসাবে পরিচিত জিকুরে চিনে ফেলে। তাই তার আর না করার উপায় থাকে না। কিন্তু অত বড় লিডারে তারে ডাকে ক্যান? তা জানার কৌতূহল তার কুমড়োর ফালি কেনা ছিকায় তোলে। তা রেখে তাই জিকুর সাথ নেয়- ‘লও যাই।’

আজিজ সিকদার উঁচা-লম্বায় তালগাছি নেতা। ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় লিডার। একেবারে সভাপতি তার পদ। বছর দুই আগে তার হাত ধইরা জিকুর রাজনীতিতে পা। তারপর তার পিছু পিছু হাঁটা। তাই এবারের কমিটি করার সময় জিকুরে একটা পদ দেবার চাইছিল। কিন্তু আর সব নেতাগো চাপে পারে নাই। তবে লাইগা থাকলে আগামী কমিটিতে আর বাদ যাবে না বইলা ষোলোআনা আশ্বাস দিয়া রাখছে। তাই তার ফরমাশ অনুযায়ী বিনয় বালারে নিয়া আবার অফিসে ফিরে আসে। তারে দেখে আজিজ সিকদার যেন অভ্যর্থনার পরাকাষ্টা দেখায়। উঠে এসে হাত ধরে নিয়া পাশের চেয়ারে বসায়।

একটু দূরে বসে জিকু তখন বিনয় বালা পানে পূর্ণ চোখে তাকানোর সুযোগ পায়। দ্যাখে চেহারাজুড়ে কালোর রাজত্ব। তবে সম্ভবত হাটে আসার প্রস্তুতি হিসাবে আজকেই ক্লিন সেভের পর তেলের পরশ দেয়া। তাই নারকেলের খোলের মতো এতটুকু চেহারাখানায় চকচকে ভাব। আর তার বাড়ি, আসা-যাওয়ার পথে জিকুর বহুবার দেখা। তবে তা যে স মিল, গাছরে চেড়াই-ফাড়াইয়ে সাইজ কইরা তক্তা বানানোর কারখানা বসানোর পারফেক্ট জায়গা তা কখনও মনে হয়নি। কিন্তু আজিজভাই, তার আদি ও অকৃত্রিম রাজনৈতিক মুরশিদ, চোখে আঙুল দিয়া দেখানোর পর এখন হিসাব কইরা দ্যাখে আসলেই তাই। স মিলের জন্য একেবারে সুইট্যাবল প্লেস। কেননা বিনয় বালার বাড়িখান কোকড়াকাঠি গাঁওয়ের উত্তর মাথায়। তার দুই দিকে খাল। জোয়ার-ভাটার শাসনে তারা নিত্য দুই বেলা আসা-যাওয়া করে। তাতে তাই নৌকা-ট্রলারের অবাধ যাতায়াত। আবার বাড়ির সামনে দিয়া কালো পিচে গতর মোড়ানো রাস্তা। থানা সদর থেকে জেলা শহর ছাড়াইয়্যা রাজধানী পানে তার মসৃণ দৌড়। তাই আশপাশের চৌদ্দগ্রাম থেকে নৌকা-ট্রলারে গাছ-গুঁড়ি এনে তাদের সাইজ করে লরি-ট্রাকে দূর-দূরান্তে চালান দেবার সুবর্ণ-সুযোগ জায়গাটার হাতের মুঠায় পোরা। সুতরাং তারে স মিলের জন্য পারফেক্টের চেয়েও দু-চারি ডিগ্রি বেশি কিছু বলা আর অন্যায় হবে না। জিকু তাই মনে মনে লিডারের চোখের প্রশংসা করে- দ্যাখো, এক নজরেই আসল জায়গা খুঁইজা পাইছে।

কিন্তু তার, মানে আজিজ সিকদারের মতো লম্বা-চৌড়া লিডারের পাশের চেয়ারে বসার সাথে সাথে বিনয় বালারে ঘামে পায়। কেননা দল ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি রমরমা হয়ে ওঠা, রঙিন পোস্টার-ব্যানার-তোরণে বিয়ে বাড়ির সাজে সাজা এ অফিসে তার আগেও দুএকবার আসা হইছে। তবে কখনও বসার চান্স পায়নি। বরং দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে কোনো আরজি পেশ করেছে কিংবা লিডারদের হুকুম-হাকাম শুনেছে। কিন্তু আজ সবচেয়ে বড় লিডারের ডেকে আনা, তারপর আবার হাত ধরে টেনে কাছের চেয়ারে বসানোয় সে ভড়কে যায়। তাই লিডার কী বলে সে ভাবনায় প্ল্যাস্টিকের চেয়ারের স্নেহ-মমতায় তার কোলে বসেও ঘামের হাত থেকে সে আর রক্ষা পায় না। তারা তার গা বেয়ে হাঁটাহাঁটি শুরু করে।

আর আজিজ সিকদার জনদুই কর্মীর সাথে আলাপ শেষ করে, তাদের বিদায় জানায়ে তবে বিনয় বালা পানে ফেরে- ‘দ্যাখো! মোরা একই লগের লোক। এ্যাক পাট্টি করি। এ্যাক মার্কায় ভোট দেই। এহন তোমরা যদি মোগো সাহায্য-সহযোগিতা না করো তাঅইলে ক্যামনে চলে, কও?’

আজিজ সিকদার আগেও দুএকবার সাহায্য-সহযোগিতা চাইছে। দুই হাতের মধ্যে হাত জোড়া দিয়া ধরছে। কিন্তু তা তো কেবল ভোটের সময়- ভোট। এখন তো তার কোনো আলামত নাই। তাহইলে আবার কী চায়? বিনয় বালা তাই হাঁ হয়ে লিডারের পানে তাকায়।

-হোনো, কয়দিন আগে তোমাগো বাড়ির ওদিক দিয়া যাবার সময় দুই খালের ঠোডায়, তিন মোহনার পাড়ে তোমাগো বাড়িডা চোখে পড়ে। আগেও দ্যাখছি, তহন মোনে অয় নাই। কিন্তুক হেদিন মোনে অইলো জাগাডা স মিলের লাইগা পারফেক্ট। তাই তোমারে কইতাছি, টাহা-পয়সা যা লাগে লও, বাড়িডা ছাইড়া দাও।

শুধু বাড়ি না, বিনয় বালা দ্যাশও ছাড়তে রাজি। এ্যাই পোড়ার দ্যাশে মুসলমানগো লাথি-গুতা খাইয়্যা আর কত। কিন্তু তাই বইলা এ্যাই লিডারের কাছে? মুহে আগ বাড়াইয়্যা টাহা-পয়সার কথা কইলেও দেবে না ফুডা-পয়সাডাও। কয়মাস আগে তুতখালির নন্দীগো বাগান-বাড়িডা দখল নিছে, দিছে কিছু? উল্ডা হুমকি-ধামকি ঝুরছে। শ্যাষে নন্দীরা ওপাড়ে গিয়া বাঁচছে। কিন্তু তার হাত থাইকা বাঁচার লাইগা কীসের দোহাই পাড়ি? হাতের কাছে আর কোনো উপায় না পাইয়া বিনয় বালা শেষে বুড়িমার ঘাড়ে সওয়ার হয়- মোগো মায় ছাড়তে চায় না। হ্যার সোয়ামির ভিটা। চৌদ্দপুরুষ ধইরা বাস। তাই হ্যার মায়া পইড়া গ্যাছে।

-হ্যারে বুঝাইয়্যা কও। হ্যার লাইগা একমাস সময় দিলাম। আইজ মাসের বিশ তারিখ। আগামী মাসের বিশের মইধ্যে এ্যাকটা ফয়সালা কইরা ফালাও। তা না হইলে মোগো অ্যাকশন নিতে হইবে।

তাগো অ্যাকশন কী বিনয় বালার তা ভালো কইরা জানা। তাই তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বার হয়। বাজার-সওদা পানে আর না ফিইরা সরাসরি বাড়ির পথ ধরে।

আজিজ সিকদারের তখন আবার জিকু পানে ফেরার সুযোগ হয়- ‘যে রহম ঘাড় ত্যাড়াইল তাতে মোনে অয় সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। সহি-সালামতে বাড়িডা ছাড়বে না। আঙুল বাঁকা করতে অইবো। তাই ওর দিকে একটু নজর রাখো। খোঁজখবর নাও। কী করে, কার কাছে যায়?’

তবে জিকুর নিজের কিছু করতে হয় না। দুইদিন পর খবর আপনিই আইসা হাজির হয়- বিনয় বালা চেয়ারম্যানের কাছে গ্যাছিল। হ্যার কাছে নালিশ দিছে।

ব্যস, আজিজ সিকদার সাথে সাথে গর্জে ওঠে- অ্যাঁ! মোর লগে টক্কর দেবার মতল! মুইও দ্যাইখা লমু। এ্যাতোদিন টাহা-পয়সা দিয়া বিদায় করতে চাইছি এহন তাও পাইবে না। জিকু! যোগাযন্ত্র কর, আগামী মাসের বিশ তারিখ ফাইনাল অ্যাকশন।

 

।। দুই।।

আজিজ সিকদারের কাছে মায়ের দোহাই পাড়লেও বিনয় বালার বাড়ি কিংবা দ্যাশ, তার কোনো একটা ছাড়ার আদত বাধা অজিত, তার বড় পোলা। বংশের চেরাগ। তাই বাড়ি ফিরেই সে পেয়ারের পোলারে ফোন দেয়- ‘মোগো বাড়ির উপর লিডারের নজর পড়ছে। বাড়ি ছাড়া কইরা ছাড়বে। তহন আর মোগো থাহার আর কোনো জাগা থাকপে না। দ্যাশ ছাইড়া যাইতে অইবে।’

আগেও একবার দ্যাশ ছাড়ার কথা উঠছিল। তখন আগের সরকার ক্ষমতায়। ধোনের আগা কাটা মুসলমানগো বড় উৎপাত। আইজ এক বাড়িতে চড়াও হয় তো কাইল আরেক বাড়িতে আগুন লাগায়। পুইড়া সাফ কইরা ফালায়। তাই ওপাড়ে গিয়া সুখে-শান্তিতে থাকার, ইচ্ছামতো ধর্ম-কর্ম করার কথা ওঠে। কিন্তু অজিত বাগড়া দেয়- ‘ওপাড়েও শান্তি নাই। বাঙাল বইলা ক্ষ্যাপায়। তারপর ওহানে মোগো জানা-পরিচয়, আত্মীয়-স্বজন কেউ নাই। কাম-কাইজ পামু কই? শ্যাষে না খাইয়্যা মরতে হইবে।’

হ্যাঁ, কথা ঠিক। এখানে সবাই চেনা-জানা, আত্মীয়-স্বজন। আবার হিন্দু-মুসলমান সবাই ডেকে নিয়ে কাম দ্যায়।

-কিন্তুক এহানে মুসলমানগো চোটপাট দ্যাখছো? য্যানো দ্যাশটা কেবল ওগো এ্যাকলাগো।

– দিন এরহম থাকপে না। এ্যাকদিন পাল্ডাইবে। আমাগো দিন ফিরবে।

হ্যাঁ, সত্যি সত্যি দিন একদিন ফেরে। নিজেগো সরকার ক্ষমতায় আসে। অজিতের চাকরি অয়। নাজিরপুরে থানা সদরের রেজিস্ট্রারি অফিসে। হোক না তা পিয়নের, কিন্তু সরকারি তো। তাই সে থানা সদরেই থাকে। সপ্তাহে সপ্তাহে ছুটি-ছাটায় কেবল বাড়ি আসে।

আজিজ সিকদারের বাড়ি ছাড়ার হুমকির কথা শুনে সে তার বাজানরে  চেয়ারম্যানের কাছে যেতে বলে- ‘সোবান মিরধা মোগো গেরামের লোক। হ্যারে গিয়া ধরো।’

তা ঠিক, নতুন চেয়ারম্যান সোবহান মৃধার বাড়ি কোকড়াকাঠির দক্ষিণ মাথায়। চানকাঠির বগলতলায়। সুতরাং চেয়ারম্যান বইলা শুধু নয়, একই গেরামের বাসিন্দার খাতিরেও তার কাছে যাওয়া যায়। বলা যায় নিজেগো সুখ-দুঃখের কথা।

কিন্তু সেও তো আজিজ সিকদারের গোত্রের লোক। বর্ণ-অবয়ব, চেহারা-সুরতও প্রায় অভিন্ন। নেতাও একই দলের। একজন যদি হয় ইউনিয়নের সভাপতি তাহলে আরেকজন সেক্রেটারি। একেবারে পিঠপিঠি পদের অধিকারী। তয় গত ইলেকশনের সময় তাগো হাব-ভাব পাল্টায়। দুইজনে মুখোমুখি হয়।

কেননা আজকালকার নির্বাচনে সৌভাগ্যের পরশমণি- দলের মার্কা- বাগাতে সক্ষম হয় আজিজ সিকদার। আর তা ধরার দৌড়ে হাইরা গেলেও সোবহান মৃধা থামে না। বরং আলাদা মার্কা নিয়া আগায়। ফলে দুইজনে একেবারে মুখোমুখিতে পৌঁছায়। শুরু হয় দুই মার্কার লড়াই। রাত-দিন তার মিছিল-মিটিং-  স্লোগান। আর ফাইনালের দিন, ভোট নেবার কালে রীতিমতো রক্তারক্তি। আজিজের মার্কার একজন খুন আর সোবহানের মার্কার জনপনেরো আধাআধি, রক্তে মাখামাখি অবস্থায় গিয়া দাঁড়ায়।

– মোগো এহন বাঁচা-মরার সমস্যা। হ্যাগো মারামারি, কামড়াকামড়ি দ্যাহনের সময় নাই। তুমি সোবান মিরধার কাছে যাও। হ্যায় এহন চেয়ারমেন। হ্যার হাতে অনেক ক্ষমতা।

তয় তার হাতে ক্ষমতা যতই থাকুক, ভরদিয়া হাটে পা দেবার মুরোদ নাই। তার এমাথা ওমাথা, দলের অফিস-আস্তানা সবটাই আজিজ সিকদারের হাতের মুঠোয়। তার আঙুলের ডগায়। কিন্তু ইউনিয়নের বাদবাকি অংশ, গোটা দশেক গাঁও-গেরাম আবার সোবহান মৃধার করতলে, তার শাসনের অধীনে। তাই পরদিন সকাল সকাল তার বাড়ি পানে বিনয় বালা পা বাড়ায়।

কদমে কদমে হিসাব মেলাতে যায়- গত ইলেকশনের সময় তারা সোবান মিরধার বিরোধিতা করছে। তাই এহন তাগো বিপদে যদি হ্যায় আগাইয়া আসতে না চায়। যদি দরজা থাইকা বিদায় দেয়। তাঅইলে কি বাড়ি ছাড়া অইয়া দ্যাশ ছাড়তে অইবে? কিন্তু বাড়ির একমাত্র শিখ্খিত পোলা, কলেজ পাড়ি দেয়া অজিতের মুখে শোনা- সাতচল্লিশে এ্যাই দ্যাশের হিন্দুগো শিকড় আলগা হইয়া গ্যাছে। তারপর আর গাঁথে নাই। তাই এহন একটু-আধটু ঝড়-ঝাপটা, রাজনৈতিক আলোড়ন-বিলোড়ন উঠলেই তারা নড়বড়ে হইয়া পড়ে। কেউ কেউ একেবারে উপড়ে যায়। পরিবার-পরিজন নিয়া ওপাড়ে গিয়া নতুন জমিতে নতুন শিকড় গাড়ে। তয় তা শুনতে যতই মধুর লাগুক, মিষ্টিভাবের হউক না কেন কামে খুবই কষ্টের। নাড়ি ছেঁড়ার বেদনার নাহান। বুড়া মা, বউ-পোলাপান লইয়া এ্যাই বয়সে তা ক্যামনে সইমু?

সে হিসাব মিলানোর আগেই বিনয় বালা, ছোট গাঁওয়ের ওমাথায় চেয়ারম্যানের বাড়ি পৌঁছে যায়। দ্যাখে, তার সামনেই কাচারিঘর, আজকাল অবশ্য তা অনেকেই বলে না, বৈঠকখানা কিংবা অফিসঘর বইলা জাতে ওঠানোর চেষ্টা চালায়, তা যেন নতুন করে বানানো। তাই চকচকে চেহারার পাকা দালানের অবয়ব তার। তাতে উঁকি দিয়া দ্যাখে তার আগেই জনচারেক এসে হাজির, ভেতরে বসা। বাড়ি থেকে বার হয়ে অফিস-আদালতে যাবার আগেই নিজ নিজ সালিশ-মোকদ্দমা নিয়া চেয়ারম্যানরে সরাসরি ধরার কৌশল। বিনয় বালাও তাদের দলে ভিড়তে জুতা-স্যান্ডেলবিহীন খালি পা ভেতরে ফেলতেই তার পুরো শরীর শিরশির করে ওঠে- ওহ! কী কাল আর পেলব।

ভেতরে খানকতক প্ল্যাস্টিকের চেয়ার এলোমেলো করে রাখা। তাদের সামনের টেবিলের ওপাড়ে কারুকাজঅলা উঁচাপিঠের কাঠের বিশাল আসন। চেয়ারম্যানের রাজসিংহাসন যেনবা।

কিন্তু তিনি এখনও বাড়ি থেকে বার হন নাই। বিনয় বালা তাই আর সবার সাথে চুপচাপ বসে থাকে। আর মনে মনে তার নালিশের মহড়া ভাজে- অজিত বলে দিছে শুরুতেই গুণকীর্তন করতে- আপনের কৃপায় ইউনিয়নের চেহারা-সুরত ফিরছে। রাস্তাঘাটের উন্নতিতে তাগো রূপযৌবন খোলতাই হইয়া উঠছে। তারপর লাগলে আজিজ সিকদারের দুর্নাম- দুর্নীতিতে ছাইয়্যা গ্যাছে। লোকজনের না-পছন্দের হইয়া উঠছে।

কিন্তু ঘন্টাখানেক পর, সাদা ধবধবে পাঞ্জাবির ওপর দলের কোট চাপাইয়া সোবহান মৃধা ভিতর বাড়ি থেকে বার হয়ে কাচারিঘরে পা রাইখাই আর সবাইরে বাদ দিয়া, সিরিয়াল ব্রেক কইরা, বিনয় বালারে পাকড়ায়- ‘তোমার পোলা অজিত্যার হুনি পাঙ্খা গজাইছে। উড়াল দিতে শিখছে। তাই এ্যাক গেরামের পোলা হইয়াও ইলেকশনে আজিজ সিকদারের মার্কার লগে ভিড়ছে। স্লোগান দিছে।’

হ্যাঁ, তা ঠিক। বিনয় বালারা মার্কার মায়া ছাড়তে পারে নাই। তাই দলের মার্কা যে পাইছে তার পক্ষে নাড়া দিছে। স্লোগানে মাতছে।

– তোমরা মালাউনের জাত। তোমাগো চিনতে মোর বাকি নাই। এহনো মার্কা ছাড়া কিছু বোঝো না। অহন সিকাদারে বাড়ি ছাড়তে কইছে। স মিল বসাইতে চাইছে। অমনি নালিশ লইয়্যা আইছো।

অ্যাঁ! কিছুই তো বলা হয় নাই। মুখ খোলারও সুযোগ পায় নাই। তার আগেই নালিশের কথা চেয়ারমেনে জানল ক্যামনে? বিনয় বালা তাই মুখ হাঁ করে তাকায়ে থাকে।

– মুই ইউনিয়নের চেয়ারমেন। মোর কানে হগোল কথা আহে। কাক-পক্ষীতে কী কয় তাও মুই হুনি।

– মোরা এহন বাড়ি ছাউড়া কই যামু?

– ক্যান, ওপাড়ে যাও। হেহানে তো তোমাগো লাইগা ফুল নিয়া, লাল বিছানা বিছাইয়া হগোলে খাড়াইয়া রইছে। গ্যালেই জমি-জমা, বাড়িঘর হগোল দিয়া দ্যায় হুনছি।

– মোরা যামু না। মোগো সিকদারের হাত থাইকা বাঁচান।

– হ্যাঁ, কয়দিন সময় দিছে?

– আগামী মাসের বিশ তারিখ তামাইত।

– হ্যারা আওনের আগেই মোরা দখল নিয়া ক্লাবঘর বানাইয়্যা দিমু। পোলাপাইনে খেলাধুলা করবে। তাগো শরীর-স্বাইস্তো ভালো থাকবে।

চেয়ারম্যানের কথায় বিনয় বালা হাঁ- অ্যাঁ! এ দ্যাহি আরেক কাঠি সরেস। সিকদারে তবু কিছু টাহা-পয়সা দেবার কথা কইছে। কিন্তু এ-তো তাও না। একেবারে মিনি-মাগনা দখলের মতলব আঁটছে।

বাড়ি ফিরে সে তাই ঘর লয়। ভয়-আতঙ্কে তা থেকে আর বার হয় না। রাস্তাঘাটে পা ফেলা, হাটবাজার করা, এমনকি কামকাজে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আয়-রোজগারে একেবারে শিকল পড়ে।

দুচারদিন পর খালের ওপাড় থেকে তাই কোব্বাত চাচা এসে হাজির হয়। উঠানে খাড়াইয়্যা হাঁক পাড়ে- ‘বিনয় বাড়ি আছো? কয়দিন ধইরা কামে যাও না। রোয়ার গোন তো শ্যাষ হইয়্যা যায়।’

তার কণ্ঠস্বর পেয়ে ভয়-আতঙ্কের মুঠোয় পোরা বিনয় বালার বাঁধ ভেঙে যায়। ঘর থেকে ছুটে বার হয়ে তার পায়ে হুমড়ি খায়- চাচা! মোগো বাঁচান। লিডার আর চেহারমেনে মোগো বাড়ির উপর নজর দিছে। ঘরবাড়ি হগোল লইয়্যা গিয়া মোগো দ্যাশ ছাড়া করার মতলব আঁটছে।

– তুই বাড়ি বন্ধক দে। মোরা দিছি। বাড়িতে চোর-ছ্যাচড়ে ভইরা গ্যাছিল। আইজ হাঁস নেয় তো কাইল মুরগি। ধানের গোলায়ও  দুইদিন হানা দিছে। তাই বন্ধক দিয়া দিছি। এহন আর কেউ তিরিসীমানায়ও পাও দ্যায় না।

– বন্ধক ক্যামনে দিমু?

– মোর খোঁজে ভালো হুজুর আছে। কামেল লোক। হ্যায় বন্ধক দিয়া দেবে।

– মোগো জাতের বাড়িতে হ্যায় আইবে?

– দুইডা টাহা বেশি দিলে আর না করবে না।

– এ্যাতো টাহা কই পামু?

– তুই চিন্তা করিস না। মুই দিয়া দিমু। তুই কাম কইরা শোধ কইরা দিস।

দুদিন পর কোব্বাত চাচা মুখে দাড়ির ঘন ঝাড়ের লগে লম্বা ঝুলের জামা গায়ের এক হুজুর নিয়া আসে। সে বিনয় বালার বাড়ির কোনায় কোনায় মাদুলি গাঁথে-চাইর কোনায় চাইর ফেরেশতা বসাইয়্যা দিলাম। তারা এহন বাড়ি পাহারা দিবে। কোনো শয়তান সীমানায় পাও দিলেই হ্যার ঠ্যাং ভাইঙা দিবে।

পরদিন বিনয় বালা আবার রাস্তায় বার হয়। হাটে যায়- আহো! যত দলের লিডার, ইউনিয়নের চেহারমেন, দ্যাহি ক্যামনে মোর বাড়িতে পাও দাও।

 

।। তিন।।

আইজ বিশ তারিখ। বিনয় বালার বাড়ি দখলের দিন।

জিকু তাই দলবল নিয়া যাত্রা করে। ভরদিয়া হাটে দলের আস্তানা থেকে বার হয়ে কোকড়াকাঠির পথ ধরে। তাদের গন্তব্য- তার উত্তর মাথায় গোটা চারেক আম, হালি দুই নারকেল-সুপারি ও বাদাম-গাব গাছের সাথে ছনে ছাওয়া খান দুই ঘর নিয়া বিনয় বালার চৌদ্দপুরুষের ভিটা। বেশি দূরের পথ না। তাই পদব্রজই তাদের ভরসা। জিকু অবশ্য জোগাড়যন্ত্রের সময় গোটা দশেক মোটরসাইকেলের কথা বলছিল। তাতে চেপে সাঁ করে ছুটে গিয়া সব কিছু দখলে নিয়া, স মিলের সাইনবোর্ড ফিট করে দিয়া, আবার সাঁ করে চলে আসার প্ল্যান ছিল তার। কিন্তু আজিজ সিকদার না করে- ওরা এমনিতেই হিন্দু, সংখ্যালঘু জাতের লোক, তারপর আবার নমশূদ্র, একেবারে তলানির জাতের দ্বি-পায়ী, অগো বাড়ি দখলের লাইগা অত আয়োজনের দরকার নাই। তাতে তেল খরচ আছে, মোটরসাইকেলের ভাড়া আছে তারপর আছে তার চরণদারগো বখশিশ- সে অনেক খরচের বহর। তার চাইতে জনপঁচিশেক লোক জোগাড় করো, তাগো নিয়া গিয়া কাম সাইরা আহো।

জিকু তা-ই করেছে। জনপঁচিশেক কর্মী-সমর্থক জোগাড় করে তাদের হাতে আড়াই থেকে তিন হাত অবয়বের বাঁশের লাঠি ধরাইয়্যা দিছে। আর নিজে নিজে আকারে-আয়তনে বিঘাতের মধ্যকার হাতিয়ার। তবে সে অবয়বে ছোট দেহি হলেও স্বর-সোরে বিপুলা। তার ট্রিগারে আঙুলের সামান্য একটু চাপেই সে তর্জন-গর্জন করে ওঠে। চারদিক কাঁপাইয়া তোলে। আর কারও বুকে লাগলে এফোঁড়-ওফোঁড় কইরা ছাড়ে। কিন্তু এখন আর সব হাতিয়ার, বাঁশের আড়াইহাতি লাঠি, হাতে হাতে মাথা উঁচা কইরা থাকলেও জিকুরটা লজ্জাবতীর মতো তার কোমরে মুখ গোঁজা। লোকচক্ষুর অন্তরালে। কেননা জিকু তারে খুব যত্ন-আত্তি কইরা শরীরের সাথে গাঁইথা রাখছে যেন দরকারের মুহূর্তে হাতে তুইলা নিতে আর এতটুকু কসরত করতে না হয়।

এছাড়া আর কোনো হাতিয়ার তাদের কাছে নাই। তবে এর চেয়ে বড়, আকার-আয়তনে কিংবা ভার-ভারতি বা শক্তি-সামর্থ্য- যে রকমই হোক না কেন, তা জোগাড় করার সোর্স জিকুর হাতের মুঠায় ঘোরাফেরা করে। ইলেকশনের দিন তার পাকাপোক্ত নজিরও দেখাইছে। সুতরাং চাইলেই নিয়া আসতে পারত। কিন্তু সামান্য কাঠাপাঁচেক ব্যাসার্ধের বাড়ি দখলের জন্য তার দরকার নাই বইলা আজিজ সিকদার বইলা দিছে। তার এক বাক্যেই জিকু বুইঝা যায় যে, লিডারে ছুঁচো মেরে হাত নষ্ট করতে চায় না। কেননা তাতে থানা-পুলিশের সাথে, পত্রপত্রিকা, আজকাল তারা যেভাবে গ্রামেগঞ্জে ছড়াইয়া পড়ছে, তাগো সামলানোরও রিস্ক হাজির হয়ে যেতে পারে। তবে আর কোনো হাতিয়ার না নিলেও দখলের চিহ্ন, নিজেদের হাতের মুঠায় পোরার আলামত হিসাবে চার বাই ছয় ফিটের একটা সাইনবোর্ড নিছে। তার বুকের উপর বড় অক্ষরে আঁকা ‘আজিজ স মিল’। জিকু তা একজন কর্মীর হাতে দিয়া রাখছে। দখলে নেবার পর, সব কিছু নিজেদের আয়ত্বে এনে তা কোনো গাছের সাথে গেঁথে দেবার আয়োজনও করা আছে। সুতরাং এক কথায় বলা যায় পূর্ণ জোগাড়যন্ত্রের সাথেই তারা আগায়। বিনয় বালার বাড়ি পানে কদম ফেলে।

এমনিতে তারা যে কয়জন আছে চুপচাপ গিয়া ঝাপাইয়া পইড়া দখল নিয়া নিতে পারে। কিন্তু তাহলে হয় হামলা, রাজনৈতিক ভাষায় অসিদ্ধ, শতভাগ হারাম কাম। আর সবাই মিইল্যা স্লোগান দিতে দিতে গিয়া হাতের মুঠায় পুরলে, নিজেদের কব্জায় নিলে হয় অ্যাকশন, ষোলোআনা জায়েজি কাজ। তাছাড়া স্লোগানের আপাদমস্তকজুড়ে কেবল ভাইটামিন, মুখে তুললেই কাজে গতি, সাহস সঞ্চার।

তাই তারা কদমে কদমে তার দ্বারস্থ হয়- ‘আজিজভাই যেখানে’ ‘আমরা আছি সেখানে’, ‘আমারভাই তোমারভাই, ‘আজিজভাই আজিজভাই’ দিয়া শুরু আর থানা ও জেলার নেতাদের পর দলের নেত্রীর নাম দিয়া শেষ। মাঝেখানে কিছু দলের স্লোগানও থাকে। ফলে তার লম্বা বহর পাড়ি দিতে দিতে তারা হাটের চৌহদ্দি পার হয়। গ্রামের পথে নামে।

যুদ্ধের ময়দানের যত কাছে যাওয়া যায় তত তার দামামা কানে বাজে, রব উচ্চতর হয়। তেমনি জিকুরা যত বিনয় বালার বাড়ির কাছে যায় তত তাদের স্লোগান মাতে। উঁচু হইয়া চারদিক ছড়াইয়া পড়ে।

কিন্তু বাড়ির সামনে গিয়া দ্যাখে- একি! বিনয় বালাদের মধ্যে কোনো ভয়-ভীতি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, এমনকি সামান্য চঞ্চলতাটুকুও নাই। তাই তারা থমকে দাঁড়ায়।

হিন্দুদের বাড়ি- পর্দার আড়াল কম, আউলি বেড়ার বালাই নাই। তাই রাস্তা থেকে উঠানের পুরোটুকু, ঘরের বারান্দার সবটাই চোখে পড়ে। দ্যাখে- উঠানের এক কোনায় বসে খোদ বিনয় বালা ঝাঁকা বানায়। বাঁশের চাঁচ ঘুরায়ে ঘুরায়ে তার অবয়ব দেয়। তার বউ রূপারানী আরেক কোনায় হাঁস-মুরগির তালাফি করে, তাদের সামনে খুদ-কুঁড়া ছিটায়। আর চৌদ্দপুরুষের বসতভিটার জন্য যার সবচেয়ে বেশি মায়া, মরণের আগে ছাড়তে চায় না, বিনয় বালার সে-ই মা, খুনখুনে বুড়ি বারান্দার খুঁটিতে ঠেস দিয়া বসা।

তাদের বাড়ির কান্দে যে যমদূত হাজির, গ্রাস করার জন্য তর্জন-গর্জনে মাতোয়ারা তার প্রতি তাদের এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নাই। সবাই সংসারের নিত্যকর্মে ব্যস্ত।

জিকু তাই বাড়ির বড় পোলা অজিতরে ফোন দেয়। তারা দুজন কিছুদিন একই ক্লাসে পড়ছে। তাছাড়া ইলেকশনের সময় একই মার্কার স্লোগান দিছে। তাই জিগায়- হ্যালো অজিত! তুই কই?

– মুই নাজিরপুরে। অফিসে। . . . . ওহ! আইজ বিশ তারিখ। তোরা মোগো বাড়ি দখলের লাইগা আইছো। কিন্তু পারবি না। বাড়ি বন্ধক দেয়া। তাই মোরা নিশ্চিন্ত, মোগো কোনো ভয়-ডর নাই। সীমানায় পাও দিলেই. . .

অ্যাঁ! দুই বছরে এত বাড়িঘর দখল করলাম, কেউ একটু শব্দও করে নাই। আর অজিত্যা, নমশূদ্র অইয়া হুমকি দ্যায়? ঠ্যাং ভাইঙা ফালানোর ডর দ্যাহায়? জিকু সাথে সাথে দলবল নিয়া ঘুরে দাঁড়ায়। সামনে আগাতে যায়। কিন্তু তার আগেই দ্যাখে তাদের বিপরীতে আরেক দল। তারা পশ্চিমে, আর ঠিক তাদের অপরদিকে, সোজা পুবের সীমানায় এসে সে দল হাজির। আকার-আয়তন, সাজ-গোজে তারাও জিকুদের মতো। মাঝখানে বিনয় বালার বাড়ি রেখে উভয় দল একেবারে খাঁটি ও নির্ভেজাল মুখোমুখি।

জিকু এক নজরেই বুঝে যায় ওরা সোবহান মৃধার লোক। ওদের দলনেতা বজলুরে চিনতে তার এতটুকু ভুল হয় না। কেননা ইলেকশনের দিনের ফাইটে তার মাথা দুই ভাগ করে দেবার স্মৃতি এখনও ষোলোআনা জাগরুক। এতদিন মনে হয় আত্মগোপন কইরা ছিল। খুনের দুই নম্বর আসামি তো। তাই রাস্তাঘাটে দেখা যায় নাই। আইজ বিনয় বালার বাড়ি দখলের লাইগা মনে হয় সোবহান মৃধা আবার হায়ার কইরা আনছে।

সাপ বেজি দেখলেই যেমন ফণা তোলে, হিসহিস করে ওঠে, দুই পক্ষ তেমনি মুখোমুখি হয়ে স্লোগানের বহর ছোটায়। গলার সর্বোচ্চ স্বর ব্যবহার করে। তবে ‘আজিজভাই’ আর ‘সোবানভাই’ বাদে বাদবাকি সব স্লোগানের কথা ও সুর, ভাব ও ভঙ্গি এক ও অভিন্ন।

জিকু বজলু পানে চোখ কড়া করে। দ্যাখে তার মতো ওর কোমরের দিকটা উঁচা উঁচা। নিশ্চয়ই সেখানে লজ্জাবতী হাতিয়ার গোঁজা। তাই দুই হাত দুই দিকে ছড়ায়ে দিয়া তার দলবলের সবাইরে থামায়ে রাখে। সামনে, বিনয় বালার বাড়ির সীমানার ভেতরে কাউরে আর এক কদমও আগাতে দেয় না। কেননা ওরা, মানে সোবান মিরধার দল এখন ইউনিয়নের ক্ষমতায়, চেয়ারম্যানি-মেম্বরি সব তাগো হাতের মুঠোয়। থানা-পুলিশও তাই ওদের কথায় উঠবস করে। সুতরাং কেউ সামনে পা বাড়ালে, বিনয় বালার বাড়ি দখলে নেবার চেষ্টা করলে বজলু নিশ্চয়ই চুপ কইরা থাকবে না। বরং সাথে সাথে কোমরে গোঁজা হাতিয়ার ছোটাবে। আর সে হাতিয়ার যে, যে-কারো বুক এফোঁড় ওফোঁড় কইরা দিতে মুহূর্তমাত্র বিলম্ব করবে না তা জিকুর ভালো কইরা জানা।

তবে সেও সতর্ক চোখ রাখে- ওদের কেউ বিনয় বালার বাড়ির সীমানার ভেতরে পাও দেয় কিনা। কেননা দিলে সেও বসে থাকবে না। কোমরে গোঁজা লজ্জবতীর ট্রিগারে আঙুল দাবায়ে লজ্জা ভেঙে একেবারে চুরমার করে দেবে। তাতে যদি কেউ সাবাড় হয়? কী আর হবে? কেননা ইলেকশনের দিনের ফাইটে গোটা তিনেক মাথা ফাটানোর পর কী অইছে? দুইডা দিনও জেলের ভাত খাওয়া লাগে নাই। সুতরাং সাবাড় করলে তার দৌড় আর কত দূর যাবে? পলিটিক্যাল কেস, যার দম এতটুকু। দুচার কদম আগায়ে মুখ থুবড়ে পড়ে না-হয় নতুন মোড় নেয়। শেষে হয়তো দুচার বছর জেলের ঘানি টানতে হয়- এই যা। আর আজিজভাইর দলের সেন্ট্রালের লগে যে হটলাইন, সকাল-বিকাল আলাপ, তাতে হ্যায় বইলা দিলে সে ঘানিটুকুও আর টানা লাগবে না হয়তো। বজলুর নাহান কেবল কয়েকটা দিন এলাকা ছাইড়া, শহর-বন্দরে আত্মগোপন কইরা থাকলেই খেল খতম হইয়া যাবে।

জিকু তাই ওঁৎ পেতে থাকে। অপরপক্ষের ওপর কড়া নজর রাখে। কিন্তু কই! এপক্ষ ওপক্ষ কোনো পক্ষের কেউ-ই তো বিনয় বালার বাড়ির সীমানায় এক পাও দেয় না। #

 

 

প্রশ্নোত্তর

শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?

জিয়া হাশান: আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখে দেখে গল্প লেখার তাড়না বোধ করি। সেগুলোকে ফুটিয়ে তোলার জন্যই মূলত গল্প লেখা হয়ে থাকে। আর যেহেতু জীবনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে হাজারো আনন্দ ও বেদনা তাই তা-ই উঠে আসে গল্পের ভাঁজে ভাঁজে।

শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?

জিয়া হাশান: ব্যক্তিগত যোগাযোগ যতটা না তার চেয়ে বরং অভিজ্ঞতা-ই গল্পকে আগায়ে নিয়া যায়। তার উপর ভিত্তি করেই প্রথমত কাহিনিটা দাঁড়ায়। তারপর পঠনপাঠন তার সাথে যোগ হয়ে গল্প পা ফেলে। বাক্যের পর বাক্য গড়ে ওঠে। শেষে গিয়ে একটা পরিণতি লাভ করে।

শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।

জিয়া হাশান: রাজনীতি কথাসাহিত্যের এক বিরাট উপাদান। তাই তাকে এড়ায়ে কথাসাহিত্য চলতে পারে না। আর যেহেতু সমসাময়িক রাজনীতি যেকোনো লেখকের চোখের উপর ঘটে। তাই তাকে এড়ায়ে কোনো কিছু লেখা হলে তা পরিপূর্ণতা পায় না। আমার নিজের লেখালেখির ভেতরে তাই সমসাময়িক রাজনীতি বিপুলভাবে আছে। তবে আজকাল রাজনীতি এতই কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে যে, তাকে অনেক লেখকই ভয় পায়। তাকে তার লেখায় নিয়ে আসতে সংশয়ে ভোগে। তার চেয়ে বরং লতাপাতা-প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি চালায়ে যায়। ফলে তাদের লেখার রসদ যেমন অতিশীঘ্রই ফুরায়ে যায় তেমনি তা বেশির ভাগ সময়ই রসকষহীন হয়ে ওঠে।

শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।

জিয়া হাশান: গল্প পড়ে কখনও কান্নাকাটি করার দিন অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একেবারেই অবহেলিত কিংবা আলোচনা-সমালোচনার বাইরের একটা গল্প ‘খাতা’ পড়ে তখন খুব আলোড়িত হয়েছিলাম। মনে আছে প্রথম যখন গল্পটি পড়ি, সে-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিকে, তখনই গল্পের মূলচরিত্র বালিকা উমার মনোবেদনা আমায় জাপটে ধরে। আমার ভেতরে গভীরতর, প্রায় চৌদ্দ ইঞ্চি দাগ আঁকে। যা আজও অমোচনীয়। তা-ই কি, কারও মনের কথা, হোক না তা বিরুদ্ধ মত, এমনকি অযৌক্তিক কোনো কথা কিংবা মূল্যহীন বাচালতা, তারপরও তা প্রকাশে আমার সায় ষোলোআনা।

শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?

জিয়া হাশান: গল্পের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমি কথ্যভাষার কাছাকাছি ভাষা ব্যবহারের পক্ষপাতী। তবে সেটা যাতে সবধরনের পাঠকের বোধগম্য হয়, পড়তে এবং বুঝতে পারে সেদিকটার দিকে খেয়াল রাখি। আর সব লেখকই নিজস্ব ফর্ম তৈরি করতে চায়। আর ফর্ম না ভাঙলে নতুন বা নিজস্ব ফর্ম তৈরি হবে কীভাবে? তাই আমার সব সময়ই চেষ্টা থাকে একটা নিজস্ব ফর্ম তৈরি করার।

শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?

জিয়া হাশান: একটা ছোটোগল্পের সবচেয়ে জরুরি উপাদান তার ‘গল্প’। আজকাল অনেকেই দেখি গল্পহীন গল্প লেখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধুমাত্র ভাষা, মোটিভ ও ইঙ্গিতের মাধ্যমে ছোটোগল্প লিখছেন। কিন্তু আমার এখনও মনে হয় যেকোনো ছোটোগল্পের মধ্যে একটা গল্প থাকা জরুরি। আর সার্থক গল্প তখনই হবে যখন তাতে কাহিনি অনুযায়ী নতুন ধরনের ভাষা, উপমা-উৎপেক্ষা ইত্যাদি থাকবে।

শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখককের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

জিয়া হাশান: যেহেতু জীবনের সাথে রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই তার বোধ থাকা যেকোনো লেখকের জন্য জরুরি। যেকোনো রাজনৈতিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লেখকের ভূমিকা থাকতে হবে। তবে তার জন্য যে রাস্তায় নেমে যেতে হবে, মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতে হবে তা নয়, বরং তা তার লেখার মধ্যে ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে। তাহলে তা হয়ে থাকলে সেটা হয় স্থায়ী এবং তার প্রভাব পড়ে সুদূরপ্রসারী।

শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!

জিয়া হাশান: নতুন একটা গল্প লিখছি। আজকাল আমার গল্পগুলো বেশ বড় হয়, একটু একটু করে লিখতে অনেক সময় লাগে। কখনও কখনও তিন-চার মাসও কেটে যায়। নতুন গল্পটা লেখা শেষ হলে যে উপন্যাসটা আধাআধি লিখে রেখেছি সেটা শেষ করার প্ল্যান আছে।

More Posts From this Author:

    None Found

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!