বি-ঔপনিবেশিক বাস্তুসংস্থান

Share this:

ভূমিকা

আমাদের বাস্তুসংস্থানের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক তার প্রভাব ক্রমশ বিপর্যয়মূলক হয়ে উঠছে।যার ফলে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিবেশ সম্পর্কিত নীতিমালা ও আইন থাকা সত্ত্বেও তা কার্যকর হচ্ছেনা। পরিবেশের সাথে মানুষের যে মিথোজীবী সম্পর্ক রয়েছে তার তাৎপর্যকে এড়িয়ে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত তাড়না আমাদের রাষ্ট্রকাঠামো ও সামাজিক অন্তর্দৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে।এখানকার সামাজিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে পরিবেশ সাথে মানুষের সম্পর্কের বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়নি।ঐতিহাসিকভাবেই বদ্বীপ অঞ্চলে মানব পরিবেশ সম্পর্ক গতিশীল ছিলো। এই গতিশীলতা মানুষের সাথে পরিবেশের মিথোজীবী সম্পর্কেই জানান দেয়।

পাশাপাশি পরিবেশের সাথে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়েছে পরিবেশ সম্পর্কিত অন্তর্দৃষ্টি থেকে।এর সাথে রয়েছে উপনিবেশায়নের সম্পর্ক।ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় মানুষের সাথে পরিবেশের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের কোন গুরুত্ব ছিলোনা,বরং এ শাসনব্যবস্থা ছিলো অনেকাংশে পরিবেশ বিধ্বংসী।উপনিবেশায়নের লক্ষ্য ছিলো সবসময় মানুষের পাশাপাশি তার প্রাণ-প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। ঔপনিবেশিক শাসনকান্ডের মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কিত যে দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাপনা ছিলো তা কাঠামোবদ্ধভাবে এখনো বিদ্যমান রয়েছে৷ পরিবেশের উপনিবেশায়ন ও তার ধারাবাহিকতা ফলে পরিবেশের যে বিপর্যয় বিদ্যমান তা চিহ্নিত করার পাশাপাশি বি-ঔপনিবেশিক তৎপরতা নিয়ে এ প্রবন্ধে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

 

১) বদ্বীপে মানব পরিবেশ সম্পর্ক

পরিবেশের সাথে আমাদের ইতিহাস ও যাপিত জীবন সম্পর্কিত।এদেশের জনসাধারণের পেশা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার সমভূমি এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক নদ-নদী মানুষের জীবনধারা, যোগাযোগব্যবস্থা ও পেশার উপর প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। একসময় আমাদের দেশে তাঁত ও মসলিন শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।জলজ জমি ও আবহাওয়ার আর্দ্রতার উপর ভিত্তি করেই মসলিন কাপড় উৎপাদন করা হতো। মসলিন কাপড় সূক্ষ্মভাবে বোনার বিষয়টি বাতাসের আর্দ্রতার উপর নির্ভরশীল ছিলো।(১) জেমস টেলরের বর্ণনা মতে বয়নশিল্পে ব্রিটেনের চরম উন্নতি সত্ত্বেও ঢাকার মসলিন ছিলো তখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী।(২)

আমাদের এ অঞ্চলের নদী, বন, ভূমি ও সমুদ্র বাস্তুতন্ত্রের সজীব ও নির্জীব উপাদান পারস্পরিক নির্ভরশীল ও তাৎপর্যপূর্ণভাবে সম্পর্কযুক্ত। ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন সময় এখানকার পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতি আমাদেরকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে ।

এখনকার জমির সাথে কৃষকদের সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আইন গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের মাধ্যমে কৃষকদের সাথে এখনকার জমির একটি পরিকল্পিত বিচ্ছেদ ঘটে। যার ফলে পরবর্তীতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে ভূমি-বাস্তুসংস্থানের মতো বিষয়গুলো উৎস হিসেবে কাজ করে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকরা কৃষি-বাস্তুতনতান্ত্রিক সম্পত্তির উপর একক আধিপত্য লাভ করে।ব্রিটিশ শাসকদের নীল চাষ প্রচলনের ফলে এখানকার কৃষি পরিবেশ সংক্রান্ত বাস্তুসংস্থানের অবনতি ঘটে। নীল চাষ প্রচলনের ফলে কৃষকরা সঠিক সময়ে পরিবেশ উপযোগী ও বাণিজিকভাবে লাভবান শষ্য উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়।

সুন্দরবন সহ বিভিন্ন নদ-নদী ও অনুর্বর ভূমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের অধীন ছিলোনা। ১৮১৬ সালে কোম্পানি সুন্দরবন এলাকা থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে সুন্দরবন কমিশন গঠন করে।(৩) এ সময় পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় বিস্তৃত   বনভূমিসমূহকে কোম্পানি পতিত ভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে। ১৮২৫ সালের বিধিমালা অনুযায়ী এ  সমস্ত এলাকাকে কোম্পানির খাস মহলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।(৪) পরবর্তীতে ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ শাসক সমস্ত  পতিত ভূমিকে খাস ব্যবস্থাপনার অধীনে নিয়ে আসে।(৫) ব্রিটিশ শাসকরা পর্যায়ক্রমে বাস্তুসংস্থানগত প্রাচুর্যের উপর কৃষক বা জনসাধারণের অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে।

পরিবেশগত প্রাচুর্যের কারণে ব্রিটিশ শাসকরা সর্বপ্রথম বাংলা অঞ্চলকে বিভক্ত করে। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ শাসক কতৃক আসাম প্রদেশ গঠন করা হয়।আসামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সিলেটকে তখন আসামের সাথে সংযুক্ত করা হয়।চা শিল্প থেকে মুনাফা আদায় ছিলো এর অন্যতম লক্ষ্য।

একই সময়ে পরিবেশ এ অঞ্চলের জসাধারণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনুকূলে কাজ করে। ইফতেখার ইকবাল তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন এ অঞ্চলের বৈচিত্রপূর্ণ পরিবেশগত অবস্থান কিভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাধারণ কৃষকদের সংগ্রামে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ব্রিটিশ বিরোধী ফরায়েজি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো পরিবেশগত সম্পত্তির উপর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

ফরায়েজি আন্দোলনের যখন বিস্তার ঘটে তখন ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের যাত্রা শুরু হয়। ইউরোপ থেকে সুতিবস্ত্রের আমদানি স্থানীয় পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলের বাংলায় বেকারত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, পাশাপাশি বৈশ্বিক মন্দা এ অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। কৃষিপণ্যের মূল্য হ্রাস পায়। জমিদার কতৃক বিভিন্ন প্রকার কর আরোপ এখানকার কৃষক শ্রমিককে ফরায়েজি আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করে।(৬)ফরায়েজি আন্দোলন এমন সব চর এবং বনাঞ্চলে বিস্তৃত ঘটে যেখানে জমিদারদের কতৃত্ব ছিলো তুলনামূলক কম।ইফতেখার ইকবালের মতে ফরায়েজি আন্দোলন ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া পিছনে অন্যতম কারণ ছিলো নদীপথের অবনতি।(৭) ফরায়েজি আন্দোলনের জন্য যোগাযোগের অন্যতম ব্যবস্থা ছিলো এ অঞ্চলের নদীপথ।

শুধুমাত্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন নয়, আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধেও প্রাণ-প্রকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করতে নদ-নদীসমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।  ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা যমুনা’ এর মতো বহুল প্রচলিত স্লোগান গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন  ব্যবহার  বাংলাদেশের পরিবেশ সাথে জনসাধারণের তাৎপর্যপূর্ণ সংযোগকে স্পষ্ট করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে এদেশের পরিবেশ ছিলো অপরিচিত।নদী, টিলা বা পাহাড়ি এলাকাগুলো তাদের আয়ত্তে না থাকায় মুক্তিবাহিনীরা পরিবেশকে তাদের অনুকূলে কৌশলগতভাবে কাজে লাগায়।মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ-প্রকৃতির সহায়ক শক্তির ভূমিকা হিসেবে সুন্দরবনের অবদান উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন সুন্দরবনকে মুক্তিবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সুন্দরবনের ভেতরে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। দেশত্যাগের জন্য সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে যাত্রার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধারা সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গাকে বিশ্রামস্থল হিসেবে ব্যবহার করেন৷(৮) মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় এ সুন্দরবন বিভিন্ন ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সাধারণ জনজীবনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তিমূলকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

 

২) পরিবেশের উপনিবেশায়ন

বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ নেই।কেননা  বর্তমানে পরিবেশ সংক্রান্ত বিভিন্ন  দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাপনা  ঔপনিবেশিক শাসনকান্ড থেকে গৃহীত হয়েছে। এ গৃহীত ব্যবস্থাপনা দীর্ঘকাল ধরে চলমান৷  ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের প্রাণ-প্রকৃতি নিজের অধীনে নিয়ে আসে এবং এগুলোকে নিজেদের স্বার্থমত নিয়ন্ত্রণ করে।আমাদের বাস্ততান্ত্রিক অবক্ষয়ের ক্ষেত্রে পরিবেশের উপনিবেশায়ন ও তার ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণভাবে সম্পর্কিত।

কোম্পানির শাসনামলে অর্থাৎ ১৮৩০ এর দশকে সালে ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ উচ্চতা ছিলো ১৮-২২ ফুট। বর্তমান সময়ের সাথে তুলনা করলে এ উচ্চতার পরিমাপের অবনতি ঘটেছে ১৪০-১৬০ ফুট।(৯) বুড়িগঙ্গা নদীর গভীরতা ও বড় বড় নৌকা চলাচলের উপযোগিতা দেখে জেমস টেলর ঢাকা নগরীকে পাশ্চাত্যের ভেনিসের সাথে তুলনা করেছেন।(১০) ব্রিটিশ শাসনামলের সূচনায়  বুড়িগঙ্গা নদীকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হতো।বাণিজ্যিক কারণে নদীব্যবস্থা ছিলো কেন্দ্রবিন্দুতে।পরবর্তী রেললাইন স্থাপনের ফলে নদীব্যবস্থার গুরুত্ব কমতে থাকে। ঢাকা শহরে ক্রমশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে নদী ও নদীকেন্দ্রিক উন্নয়নের তাৎপর্য বিলীন হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নদীব্যস্থাকে আরো বেশি এড়িয়ে যাওয়া হয়। এটি আমাদেরকে বাস্তুসংস্থান সংক্রান্ত অন্তর্দৃষ্টির অনুপস্থিকে জানান দেয়।উপনিবেশ থেকে উপনিবেশোত্তর এর ধারাবাহিকতা পরিবেশ বিপর্যয়কে আরো বেশি বেগবান করেছে।

 

২.১) উন্নয়ন ভাবনা ও পরিবেশের অবক্ষয়

ঔপনিবেশিক শাসকরা এ ব্যাপারে খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তারা রেলনাইনের মতো  আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশের উপর কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন।ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ভারতবর্ষের  বাস্তুসংস্থানের ইতিহাস  এমন এক সন্ধিক্ষণ, যে পর্যায়ে প্রচুর পরিমাণ বনভূমি নিধন হয়েছে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের ফলে আগাম বিপ্লবের সম্ভাবনাকে রহিত করার জন্য ব্রিটিশ শাসকরা তাদের শাসনগত কৌশলের পরিবর্তন করেন। তারা জনসাধারণের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের পরিবর্তে ব্রিটিশ ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তারা ভারতবর্ষে বেসরকারি ব্রিটিশ বিনিয়োগ  ও পণ্যের বৈদশিক রপ্তানির মাধ্যমে পুঁজির বিকাশের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।(১১) যার ফলে পরিবহন ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে আধুনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি রেললাইনের সাথে ভারতবর্ষের উন্নয়নের বিষয়কে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাবে।(১২) কার্ল মার্কসও ভারববর্ষে রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা ও পুঁজির বিকাশের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন।তাঁর মতে রেলপথ নির্মাণের ফলে ভারতবর্ষ সত্যিকার অর্থে আধুনিক শিল্পায়নের অগ্রদূতে পরিণত হবে। মার্কস মনে করতেন এর সুবিধা হিসেবে ভারববর্ষে যে বংশভিত্তিক শ্রম বিভাজন রয়েছে তা নির্মূলে সহায়ক হবে।(১৩)

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে ভারতবর্ষে পণ্য রপ্তানি মূল্যের পরিমাণ ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।নীল,  চা ও পাট জাতীয় দ্রব্য ইউরোপে এবং ধান ও আফিম দূরপ্রাচ্যে রপ্তানি করা হতো।(১৪) পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য রেলপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে৷  ব্রিটিশ শাসকদের এ উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে রেলপথ ছিলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভারতবর্ষের পাঞ্জাব প্রদেশে তখন প্রচুর পরিমাণ গম উৎপন্ন হতো। ১৮৬০ সাল থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে যখন পাঞ্জাব প্রদেশে অধিকাংশ রেললাইন স্থাপন করা হয় তখন গম রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতি তখন ক্রমশ বিশ্ব বাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত হতে শুরু করে।(১৫)

উনিশ শতকে ব্রিটিশ ভারতে খুব দ্রুততার সাথে রেললাইনের বিস্তার ঘটে, যার ফলে  ব্রিটিশ উপনিবেশের মধ্যে ভারতবর্ষ  রেল যোগাযোগর ক্ষেত্রে সর্বাধিক ও সর্বোন্নত অবস্থানে পৌঁছে। রেলপথ প্রতিষ্ঠার জন্য কাঠের স্লিপার,নুড়ি ও রেল  ইঞ্জিনের জ্বালানি শক্তি হিসেবে কয়লার মতো যেসব কাচামালের প্রয়োজন ছিলো যা  তাৎক্ষণিকভাবে পরিবেশ থেকে দখল করা হতো।

১৮৬০ সাল থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত তেরোশত মাইল রেলপথ নির্মাণাধীন ছিলো, যেখানে প্রত্যেক মাইল রেলপথের জন্য প্রায় আটারশত স্লিপারের প্রয়োজন হতো। এসব স্লিপারের গড় কার্যকারিতা ছিলো আট বছর।(১৬) এই বিপুল পরিমাণ কাঠের স্লিপারের যোগান আসত বনভূমি ধ্বংস করে। উত্তর ভারতের তৎকালীন সময়ে মাদ্রাজ প্রদেশে দুইশত পাঁচ মাইল রেলপথ নির্মাণ করা হয়। হিমালয় সংলগ্ন বনভূমি থেকে কাঠ কেটে   রেললাইনের জন্য এসব স্লিপার সংগ্রহ করা হতো।

 

২.২) রেলপথের প্রচলনে বাস্তুতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

রেলপথ প্রচলের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ছিলো বিধ্বংসমূলক। রেলপথের উপর অত্যাধিক গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসকরা জলপথের আপেক্ষিক গুরুত্বকে তাৎপর্যহীন করে তুলেন। যার ফলে রেলপথ নির্মাণ করতে গিয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা হয়। পূর্ববঙ্গে অপেক্ষাকৃত উর্বর ও সম্ভাবনাময় এলাকাগুলো তার প্রাকৃতিক অবস্থান হারায়।বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে রেলপথ  স্থাপনের ফলে চলনবিলের যে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ছিলো তা বাধাগ্রস্থ হয়। পানির মুক্ত প্রবাহ রোধের ফলে এখানকার কৃষি জমি ও ফসলের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।এ অঞ্চলের একমাত্র ফসল  আমন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়৷ স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের অনুপস্থিতে বিলের পলিমাটি সঞ্চয় ও জলধারণ ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পায়।(১৭) রেলপথ প্রচলের ফলে এ অঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়ের ও মাছ শিল্পের অবনতি ঘটে। রেল যোগাযোগের ফলে স্থানীয় বাজার ও জেলেরা  বৃহত্ত বাজারে একক আধিপত্যের কারণে অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত হয়।

ঔপনিবেশিক প্রশাসন ও স্থানীয় অভিজাত গোষ্ঠী রেলপথ স্থাপন ও নদী অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাস্তুসংস্থানের দীর্ঘমেয়াদি অবক্ষয়কে খুব বেশি আমলে নেয়নি।চাষাবাদের ধরণের ধ্বংসের ফলে  জনজীবনের পেশা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অবনতি ঘটে।

 

৩) পরিবেশ বিপর্যয়ের ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা

ঔপনিবেশিক শাসনামলের মতো উপনিবেশোত্তর বাংলাদেশেও তথাকথিত উন্নয়নের সাথে পরিবেশ ধ্বংসের এক যোগসূত্র রয়েছে। বর্তমান সময়ে বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রচুর পরিমাণে বনজঙ্গল কাটা হচ্ছে। খনিজ সম্পদ উত্তোলন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ও যোগাযোগের সম্প্রসারণ অথবা কর্পোরেটদের মুনাফার স্বার্থে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ নির্মাণ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ রয়েছে৷উন্নয়ন মানে যেন আদিবাসীদের জমি দখল করে পাহাড়ের চূড়ায় পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণ।  উন্নয়ন ভাবনার ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতার যে সারসত্তা রয়েছে তা পরিবেশবান্ধব দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও রূপান্তরের ব্যাপারে অনাগ্রহী। উন্নয়ন ও আধুনিক হওয়ার তাৎক্ষণিক প্রচেষ্টা একধরণের দ্বৈততা তৈরি করে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণকে সচেতনভাবে উপেক্ষা করে।উন্নয়ন, আধুনিকতা, প্রবৃদ্ধির সাথে ঔপনিবেশিক সূত্রে পরিবেশের যে ধারাবাহিক সম্পর্ক তা অসংযতভাবে বিধ্বংসী।

আয়তনে ক্ষুদ্র এ দেশ প্রাণবৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ।এখানকার পানি সম্পদ,উর্বর জমি ও পর্যাপ্ত জনসংখ্যাকে পরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার না করে বরং এগুলোকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। পাশাপাশি উন্নয়নের নামে পরিবেশের প্রতি প্রতিকূল আচরণ করা হচ্ছে। উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষাকারী উদ্যানগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে৷ পার্ক তৈরির নামে  সর্বশেষ ধ্বংস করা হয়েছে ওসমানী উদ্যান।(১৮)

বিদুৎ শক্তি উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দূষণে প্রায় তিশ হাজার মানুষ বায়ুবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে বলে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।(১৯) সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও কয়লাভিত্তিক তাপশক্তি উৎপাদনের ফলে এখানাকার পরিবেশের ক্রমশ অবনতি ঘটছে। উন্নয়নের নামে  পরিবেশ ধ্বংসের এ ধারাবাহিকতা কাঠামোবদ্ধভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। পরিবেশ ধ্বংসের এ প্রক্রিয়া একটি আত্মঘাতীমূলক প্রক্রিয়া৷ ব্লুমবার্গের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে ব্যাপক পরিমাণ মিথেন গ্যাসের বিস্তার ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল্ড থেকে ঘন্টায় চার হাজার কেজি মিথেন গ্যাস নির্গত হয়।অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ধানের জমিতে অতিরিক্ত সেচের কারণেই প্রধানত এ গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে।(২০)

বাংলাদেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ মহাপরিকল্পনা’ তৈরি করা হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর ভিত্তি করে এ পরিকল্পনার আওতায় ছয়টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের বদ্বীপ পরিকল্পনাকে অনুসরণ করে আমাদের দেশে বদ্বীপ পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। তবে দুই দেশের প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক অবস্থানের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে।নেদারল্যান্ডসের প্রায় ৬০ ভাগ ভূমি সমুদ্র সমতলের নিচে৷  অসংখ্যক ড্যাম ও ডাইক দিয়ে তাদের দেশের উপকূলকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের সাথে তুলনা করলে তাদের বদ্বীপ পরিকল্পনা তুলনামূলক পরিবেশবান্ধব।নেদারল্যান্ডসে রয়েছে পর্যাপ্ত  উইন্ডমিল যা পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।(২১) বাংলাদেশের বদ্বীপ পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা হচ্ছে উজানের দেশগুলোর উপর নির্ভরশীলতা। পর্যাপ্ত ও ন্যায্য পানি বন্টন ব্যতীত এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এজন্য আন্তঃনদী ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত সহযোগিতা ও পরিকল্পনার প্রয়োজন।

বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের আরেকটি দিক হচ্ছে আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বাইরের দেশ থেকে আমদানি। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ৩০০ প্রজাতির বিদেশি উদ্ভিদকে চিহ্নিত করেছেন যার মধ্যে ৬৯ প্রজাতি আগ্রাসী। সুদীর্ঘকাল থেকে বিদেশি পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা এসব উদ্ভিদকে তাদের সাথে নিয়ে এসেছেন৷ এসব উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম লতা ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। ঔপনিবেশিক শাসনামলে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ব্রিটিশরা এগুলা সাথে করে নিয়ে আসে। ব্রাজিল থেকে কচুরিপানা, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে নিয়ে আসা হয় আকাশমণি ও মেহগনির মতো বৃক্ষ।(২২) পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এসব আগ্রাসী প্রজাতির বৃক্ষকে চিহ্নিত করে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে।

 

৪) বি-ঔপনিবেশিক তৎপরতা

আমাদের দেশে বিকল্প ও বি-ঔপনিবেশিক বাস্তুসংস্থান গড়ে তুলতে হলে এর তৎপরতা হতে হবে পরিবেশগত সমস্যাকেন্দ্রিক। পাশাপাশি উপনিবেশকেন্দ্রিক উন্নয়নের যে দৃষ্টিভঙ্গি  রয়েছে তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে। আমাদের দেশের উন্নয়নের পরিকল্পনা পুঁজিবাদী ও ঔপনিবেশিক যুক্তি ও কাঠমো দ্বারা পরিচালিত। আমাদের বাস্তুসংস্থানের সংরক্ষণের লক্ষ্যেই এ বিচ্ছেদায়ন জরুরি। বাস্তুতান্ত্রিক ভাবনা সম্পর্কিত প্রান্তিক অন্তর্দৃষ্টিকে কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে।

বি-ঔপনিবেশিক তৎপরতার অংশ হিসেবে প্রধানত পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বায়ুশক্তি ও সৌরশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এগুলো হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উৎস।বায়ুপ্রবাহের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নয়টি সম্ভাবনাময় এলাকা অনেক পূর্বেই আমাদের দেশে চিহ্নিত করা হয়েছে।(২৩) তবে  বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে তৎপরতা শুরু হয়েছে তা খুবই সীমিত। আমাদের ৭১০ কিলিমিটার দীর্ঘ সমুদ্র উপকূল অঞ্চল রয়েছে।সমুদ্রপাড়ে তুলনামূলক বায়ুপ্রবাহ বেশি থাকার কারণে উইন্ডমিল খুব সহজেই পরিচালনা করা যাবে। এ উৎসকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যাবে। বায়ুশক্তির মতো বাংলাদেশে সৌরশক্তি থেকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনেরও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে ভোলা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোকে বিশেষভাবে ব্যবহার করা যাবে।

তবে পরিবেশের সমস্যা সমাধানকল্পে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের চিন্তাভাবনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবেনা, কারণ এর একটি সামাজিক রাজনৈতিক দিকও রয়েছে।বাস্তুসংস্থানের সাথে সামাজিক-রাজনৈতিক বিরোধকে মোকাবিলা করতে  পরিবেশগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পরিবেশের সাথে আমাদের যৌক্তিক এবং ন্যায্য আচরণ করতে হবে কারণ আমাদের এ বাস্তুসংস্থানের সবকিছুই পরস্পরের সাথে সংযুক্ত ও বৈচিত্রপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। পরিবেশের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সার্বিকভাবে ন্যায্য ও যৌক্তিক হয়ে উঠেনি। আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে পরিবেশকে যতো পারা যায় নিজের অধীনে নিয়ে আসা। এ দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছে তাই আমরা পরিবেশের সমস্যাকে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমেই সমাধান করতে চাই।

বি-ঔপনিবেশক তৎপরতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে হবে ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতার কেন্দ্রীয় শাসন ও পরিকল্পনা নীতি থেকে বের হয়ে আসা। উদ্যান, পার্ক, স্থানীয় বনভূমি, পাহাড়, নদী রক্ষার স্থানীয় জনসাধারণের মতামত ও অধিকারকে প্রাধান্য দেওয়ার লক্ষ্যে স্থানীয় জনগণের হাতে ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। স্থানীয় স্ব-শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে৷ কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেই যেনো উন্নয়নের নামে পরিবেশের উপর মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করতে না পারে৷বর্তমানে আমাদের দেশে যে স্থানীয় শাসন রয়েছে তা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহীর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এজন্য ঔপনিবেশিক শাসনের এ ক্ষমতা কাঠামোর রূপান্তর ঘটাতে হবে। যে রূপান্তরের মাধ্যমে বি-ঔপনিবেশিক বাস্তুসংস্থান কার্যকর হবে।

 

উপসংহার

পরিবেশের উপর আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত প্রবণতার ফলে বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষভাবে বিভিন্ন সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। এ সংকট খাদ্য,বাসস্থান ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তাকে বিপর্যয়গ্রস্থ করে তুলছে।পরিবেশের ন্যায্যতার সাথে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নায্যতাও জড়িত।তাই পরিবেশের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত না হলে সামাজিক শোষণ বঞ্চনা বিলুপ্ত করা সম্ভব নয় ।

পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক পাঠের সীমাবদ্ধতার রয়েছে। এ সীমাবদ্ধতাকে মাড়িয়ে পরিবেশ চেতনার বিস্তৃতি ঘটাতে হবে।কেননা বিস্তৃত সচেতনতা আমাদের  প্রাণ-প্রকৃতির ইতিহাসের সাথে পুঁজি এবং  ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ধারাবাহিক জটিল সম্পর্ককে ক্রমশ উন্মোচন করে।যে সম্পর্ক ক্রমশ  জীববৈচিত্র্যের নির্বিচার ক্ষতি করে চলছে।

প্রকৃতির গতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই আমাদেরকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।এজন্য সৌরতাপ, সূর্যরশ্মি, পানিশক্তি, বায়োমাস ও বায়ুশক্তির মতো পরিবেশাবন্ধব শক্তিসমূহের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের সমাজের উৎসমূলে যেহেতু প্রকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাই পরিবেশের মুক্তি ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। বি-ঔপনিবেশিক তৎপরতা মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলতে হবে যেখানে পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা থাকবে কেন্দ্রে।আমাদের উন্নয়ন সচেতন পরিকল্পনার মধ্যে পরিবেশ বিষয়টি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ওঠেনি।বাস্তুসংস্থানের বি-ঔপনিবেশিক তৎপরতার মাধ্যমে পরিবেশের মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বিচ্যুত ঘটিয়ে বাস্তুসংস্থানের মধ্যে সজীব ও নির্জীব সত্তার মিথোজীবী সম্পর্ক কেন্দ্রিভূত করতে হবে।

 

 

তথ্যসূত্রঃ

(১)Labib Hossain,Decolonising the cities to address flood, rain and water,The Daily Star

August 17, 2020

(২) জেমস্ টেলর, কোম্পানি আমলে ঢাকা,অনুবাদক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, অবসর প্রকাশ, ঢাকা (২০০১), পৃ: ৮৫

(৩)Iftekhar Iqbal, The Bengal Delta: Ecology, State and Social Change,1840–1943 Palgrave Macmillan, New York (2010), p.20

(৪)Ibid, p. 22

(৫)Ibid, p.25

(৬)Ibid, p.68-69

(৭)Ibid, p.87

(৮)ফয়সাল আহমেদ,মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনের নদী,দেশ  রূপান্তর www.google.com/amp/s/www.deshrupantor.com/amp/specially/2021/04/01/285125

(৯)Iftekhar Iqbal,Environmental history of Dhaka: An outline, The Daily Star,October 05, 2020

(১০)জেমস্ টেলর, প্রাগুক্ত, পৃ.৪০

(১১)Pallavi V. Das, Colonialism,Development, and the Environment : Railways and Deforestation in British India, 1860–1884, Palgrave Macmillan, New York (2015), p.21

(১২) Ibid, p.22

(১৩)karl Marx, ‘The Future Results of British Rule in India’, NYDT, 8 August 1853, MECW, vol. 12, p.217 marxists.architexturez.net/archive/marx/works/1853/07/22.htm

(১৪)Pallavi V. Das, Ibid, p.10

(১৫)Ibid, p.13

(১৬)Ibid,  p.53

(১৭)Iftekhar Iqbal, Ibid, p.130-31

(১৮)ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, একটি উদ্যান ধ্বংসের ‘উন্নয়ন’, প্রথম আলো, ২৫ নভেম্বর ২০২০

(১৯)কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণে ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে: গবেষণা,News Bangla 24, ২১ এপ্রিল ২০২১

(২০)বাতাসে মিথেন, কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ?, দ্য ডেইলি স্টার,মে ০৫, ২০২১

(২১)Ainun Nishat,Interview: Bangladesh ‘cannot have’ a fixed delta plan for 2100,,The Third Pole,

www.google.com/amp/s/www.thethirdpole.net/en/climate/bangladesh-delta-plan-for-2100/%3famp?fbclid=IwAR3h9i366E9O8VQrpUtzvtOjmStA4R5LJ3QD2oI5ifmVRpBp17U2bSHy2mM

(২২)ইফতেখার মাহমুদ,৬৯ প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী আগ্রাসী,প্রথম আলো, ২৪ আগস্ট ২০২০

(২৩)মুশফিকুর রহমান,বায়ুশক্তির সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে, প্রথম আলো,২০ আগস্ট ২০১৯

 

 

 

About The Author

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!