বুক সেলফ জুড়ে ডাকছে ব্যাঙ

Share this:

কবিতা ভাবনা

জীবনের অনেকটা সময় কবিতা সঙ্গে কাটিয়ে কখনো সখনো হয়তো মনে হয় -‘কেন এই জীবনে কবিতাকে এতটা গুরুত্বের মনে করেছি’? তারপর অবাক হবার পালা, এর উত্তর একদম জানা নেই বুঝতে পেরে। কবিতা কি? কেন? কীভাবে? এইসব প্রশ্নেরও কোন নির্দিষ্ট উত্তরমালা কবির হাতে নেই! তাই প্রশ্ন করা এবং উত্তর খোঁজা-ই যেন এক কবিজীবন। এক একটি দিন এক এক রকমভাবে আসে প্রশ্নগুলো। কোন দিন সমুদ্রের শান্ত সেই অঞ্চলের মতো কেবল অতলতা আলস্য বিছিয়ে রাখে। আবার কোন দিন উত্তাল এক সমুদ্র, আছড়ে পড়ে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর? উত্তর সে যাই হোক, প্রশ্ন করতে পারাটাই মূখ্য; উত্তর হয়তো গৌণ। নিজের কবিতা ভাবনা নিজেকে নিয়েই ভাবনা। নিজের কবিতা ভাবনা লিখতে গিয়ে এই মুহূর্তে নিজেকে নিয়েও ভাবনার একটা ফুরসৎ উঁকি দিল। নতুন লিখতে আসা তরুণের কাছে এটি খুব স্বাভাবিক, তার যথেষ্ট অগ্রজ সামান্য অগ্রজ কিংবা সমসাময়িকরা পর্যন্ত তাকে শেখাতে থাকেন; কী লিখতে হবে কী লেখা উচিত। এমন কী পড়তে হবে কী পড়া উচিত তা নিয়েও বলতে থাকেন। ধারণা তৈরি করে দিতে থাকেন, কবিতা কী? অনেক ক্ষেত্রে চাপিয়ে দেবার মতো। তারপরও একজন কবির কবিতা নির্মাণ কিংবা কবিতা কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনা অন্যজন থেকে সামান্য হলেও আলাদা হবেই। বিস্তরও হতে পারে।

পশ্চিমে তুলসীগঙ্গা আর পূর্বে হারামতি নদী নাম পাওয়া দুটি ক্ষীণ জলধারা। এক সময়ে বাঁশের সাঁকো। এখন পাকা ব্রিজ। বাইকে চেপে পুবে কিংবা পশ্চিমে যেতে হয় প্রায় দিন। একদিন চার বছর বয়সের এক শিশুকে বাইকে বসিয়ে হারামতি ব্রিজ বেরুবার মুহূর্তে খরার প্রকোপে শুকনো খটখটে হারামতিকে দেখিয়ে শিশুটি বলে, -‘মামা নদী আসে নি’। চমকে উঠি শিশুটির কথায়। জানতাম, নদী প্রবাহিত হয়। ‘নদী আসে নি’ বলে প্রবাহ বন্ধ থাকা নদীকে বোঝাতে চাওয়া শিশুর কথাটিতে বিস্ময়বোধ করি। মনে করি, কবিতা তো এমনি, ভাষা-বিস্ময় তৈরি করাও তো কবিতার কাজ। কবিতায় যারা প্রকট বক্তব্য ও ভাষণের দাবিদার তাদের দলে নিজেকে দেখতে আমার ভালো লাগে না। একেবারে বক্তব্য প্রধান কবিতার সমজদার আমি নই। ভাষা বা শব্দের জাগলিং, একটু কাব্যিক আড়াল এমনি কবিতা আমার ভালো লাগা এ পর্যন্ত।

যতদূর মনে পড়ে ছেলেবেলায় থেকেই খুব ঘন ঘন জ্বরে পড়তাম। মজার বিষয় চোখ বন্ধ করলেই কত রঙের আলো ফুটত মনের চোখে। সেই সঙ্গে খুব নিঃসঙ্গবোধ হতো। বোধের শূন্যতা তৈরি হতো। আবার একটা সময় ছিল খুব মরে যেতে চাইতাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আত্নহত্যা করব। বলা বাহুল্য তা আর হয়ে ওঠেনি। ওই নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে একা একটি বাড়িতে থাকতাম। বাড়িটির টানা বারান্দায় সারাদিনে দু’একটি বিড়াল শুধু নিঃশব্দে হেঁটে যেত। সামনের প্রশস্ত উঠোনে দু’এক ঝাঁক শালিক বুলবুলি অন্যান্যরা। জানালা খুলে উত্তরে তাকালে ঘন কলাবন। আরও নানা গাছপালার সবুজ। পুবের জানালা ঘেঁষে হাস্নুহেনা গাছ। তারপর ছুটেচলা ধানখেত। আর সেই সময় জেনেছি কবিতা একাকিত্বের পাশে একঝাড় হাস্নুহেনা।

প্রকাশ্য কবিত্ব কবিতার বড় শত্রু। সেটি এক অদেখলাপনা ও  মূর্খতা ছাড়া আর কি হতে পারে? শব্দবাক্য ধরে কবিতার অর্থ খোঁজা লোকজনের প্রসঙ্গে আদিবাসীদের বন্যপশু শিকারের একটি দৃশ্য মনে পড়ে। ধান কাটা-মাড়ায়ের পর শীতকালে যখন হাতে তেমন কাজ থাকে না; দল বেঁধে প্রতিবেশি বিধুয়া টপ্প’দা তীরধনুক বল্লম সুরকি হাতে বেরিয়ে পড়েন শিকারে।

সেবার গ্রামের পাশে শুকনো খালের পাড়ে ওঁদের এক অদ্ভুত শিকার কৌশল দেখেছিলাম। পাড়ের উপর থেকে নিঃশব্দে খালের তলদেশ পর্যবেক্ষণ  করে সরে এসে পজিশন নিলেন বিধুয়া টপ্প। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সতর্ক পজিশনে বিধুয়ার শিকারি দলবল। বিধুয়া ধনুকে তীর লাগিয়ে টার্গেট করলেন আকাশের দিকে। সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আমরা যারা এই শিকারপর্ব উপভোগ করতে এসেছিলাম, তারা বুঝতে চেষ্টা করলাম উড়তে থাকা কোন পাখি নিশানা করছে বিধুয়া টপ্প। তীর ছুঁড়লেন বিধুয়া। দেখছি, তীর উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে; কিন্ত্ কোথায়(?) তীর কোন কিছুকেই বিদ্ধ না করে ফিরে আসছে। তীরটি গিয়ে পড়ল খালের তলদেশে। এবার খালের নিচে একটা গোঙানির শব্দ। একটা ছটফটানি।  সেদিকে দৌড় লাগাল বিধুয়া টপ্পর শিকার সহযোগীরা। দেখি, হইচই আনন্দ করে টেনে আনছে তীরবিদ্ধ একটি ধাড়ি শেয়াল।

 

তাহলে কি শেয়াল পাখা মেলেছিল আকাশে?

আকাশে তীর ছুঁড়ে একটি শেয়ালে বিদ্ধ করা কীভাবে?

কীভাবে?

কবিতার পাঠকমাত্র জানেন, কবি তো ওই বিধুয়া টপ্প!

 

সময় থেকে সময়ে কবিতার পরিবর্তনগুলো দেখি, ভাবি। অন্য পরিবর্তনগুলোর কথা ভাবি। ভাবি, গ্রামের কাঁচা রাস্তায় গরুগাড়ি চলাচলের দিনগুলো। পাকা রাস্তায় এখন ভ্যানরিক্সা, তাও এঞ্জিন চালিত। সামান্য সময়ে দেখা বড় পরিবর্তন! গ্রামে কাঁচা বাড়িঘর ক্রমে কমে আসছে। পাল্টে যাচ্ছে মানুষের অভ্যেস রুচি। কেবল পাল্টায়নি পাখিদের বাসার ধরণ, নির্মাণ কৌশল।

গ্রামের পথে চলতে গিয়ে নজর পড়লো গুম্বুজ করা নতুন মসজিদটির উপর। উঁচু তোরণের মাথায় আয়না বসানো। আয়নার সামনে কয়েকটি পাখি! খুব অবাক হবার পালা! পাখিগুলো আয়নায় দেখে নিচ্ছে নিজেকে। প্রসাধন করছে? হতেও পারে। তবে বুঝতে পারি, আয়নার ভিতরে নিজেকে দেখে পাখিগুলো ফুর্তিতে চেঁচামেচি করছে। এরপর থেকে আসতে যেতে দেখি, আয়নার নেশা পেয়ে বসা পাখিগুলোকে। ঘন্টার পর ঘন্টা সেই একই অবস্থা।

একটি আয়না সামনে পাখিদের স্বভাবেরও কি পরিবর্তন! কবিতার ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তনটি সত্য ও বাস্তব।

 

 

চাঁদগ্রস্থ  

‘রাজহাঁস চাঁদের দিকে উড়ে যাচ্ছে’, এ রকম সহজ দৃশ্যে অল্প অন্ধকার ভালো লাগে। কেউ কি সেতার নিয়ে বসেছে কোথাও! সুর আসছে, জোছনার মতো মৃদু সুর

 

কোথায় অঘ্রাণ রাত্রি? ঢেঁকিতে শব্দ উঠছে

 

ঢেঁকিতে শব্দ উঠতো, আকাশে উঠতো চাঁদ। মনে হতো ঢেঁকিশালে চাঁদ ভানছে কেউ

 

আকাশে এখনো সে চাঁদ ওঠে কবে কার ঢেঁকিছঁটা চাঁদ

 

কলপাড়ে মাহীনের যুবতীবউ স্নান সারে। আবাক তাকিয়ে দেখে চাঁদে পাওয়া একটি বালক

 

 

 

গরুর রচনা  

একটি গরুর সঙ্গে আর একটি গরুর দেখা হলো, কি প্রসঙ্গে কথা বলছে তারা? আড়ি পেতে শুনতে চেয়েছি। দুর্বোধ্য কবিতা সব কখনো বুঝিনি

 

এবারও আমার জন্য একজোড়া ক্যাম্বিসের জুতো উপহার পাঠিয়েছ। আমি সেই জুতোজোড়া পায়ে পরে পেরুচ্ছি ঘাসের প্রান্তর। হঠাৎ খেয়াল করে দেখি, জুতোজোড়া ঘাস খাচ্ছে। ডেকে উঠছে হাম্বা হাম্বা করে

 

 

 

আষাঢ়স্য কবিতা

 

১৪ আষাঢ়, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া মেঘ বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি জুড়ে বৃষ্টি ও বজ্রপাত। বাড়ি ভর্তি তুমুল বর্ষাকাল। কাঠের আসবাবগুলো গাছের জীবন পেয়ে ডালপালা মেলছে আবারও

 

অঝোর রাত্রি বউ পালঙ্কে ছাতা মেলে ঘুমোচ্ছে

 

বুক সেলফ জুড়ে ডাকছে ব্যাঙ

 

 

 

ক্যাপ্টেন   

 

সান্ধ্য বৃষ্টির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে কেউ কালো রং আলকাতরা। টিনের ছাউনি উপচে গলে পরছে রাত

 

পাপোষে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে বর্ষা সংক্রান্ত যোগাসন করছে পুষি

 

উঁচু জানালায় বসে বাড়িটিকে জাহাজ ভাবছি আর নিজেকে সে জাহাজের ক্যাপ্টেন… ভরা আষাঢ় সমুদ্র

 

 

 

উট

ঘাড়গুজে বসে আছে বিষণ্ণতা। কাঁধে উপরে কালো ফিঙেপাখি, ঝগড়া করছে হাওয়ার সঙ্গে। হাওয়াদের অদৃশ্য হাত কোথায় কি করে বসে! হাওয়া সব হাতির দঙ্গল, কে কি-বললো না-বললো কিছু যায় বা আসে না

 

যে আসে সে এক চশমাপরা ধাড়ী উট। তৃতীয়া চাঁদের বাঁকা গ্রীবা। কথা বলে আরবি ভাষায়… আমি যার কিছু বুঝি না

 

 

Masudar Rahman  received postgraduate training in Bangla literature and works as a schoolteacher. He has published several books on poetry.

 

More Posts From this Author:

    None Found

Share this:

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
Translate »
error: Content is protected !!