কবিতা বিষয়ে চিন্তা, অনুধাবন, দর্শন অনুরাগ
প্রতিরাতে ঘুম বন্ধক দিয়ে যে বিস্ময় উৎপন্ন করি তারে কেউ বলেন কবিতা, কেউ বলেন আমার জীবন। আমি বলি অহি।
সারা রাত হয়রান হয়ে দৌড়ের উপর থেকে জ্ঞান ফিরলে কখনো বালিশের নিচে পাই একটি শব্দ, কখনোবা একটি চরণ। কিন্তু ওই আমার সোনার ময়না, ওই আমার কইতর- আমার আরাধনার ফল।তারই জন্য আমি পাগলা দালিকে অনুসরন করি। সাল্ভাদর দালি কি করে অমন অবিশ্বাস্য বিষয় আঁকেন। না না আঁকার আগে তা ধরেন- পাখি ও প্রজাপতি ধরার মত- টেড হিউজের থট ফক্সের মত। কোথায় পান তিনি এসব সাবজেক্ট? আসে তার বরণ ও ব্যবহার। ঘড়ি গলে যায়। মেরিলিন মনরোর ঠোঁটজোড়া সোফা অথবা স্যেটি হয়ে যায়। তার সন্ধান করতে করতে একদিন পেলাম, পড়লাম- তিনি তুমুল আঁকাআঁকির মধ্যে রঙের প্যালেট রেখে হাতে ব্রাশ নিয়ে চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়তেন । ঘুম গভীর হয়ে, দেহ শিথিল হয়ে, হাতের মুঠো ঢিলে হয়ে ব্রাশ প্যালেটে পড়ে ঠুং করে শব্দ হলে তিনি লাফিয়ে উঠে যে স্বপ্ন দেখছিলেন তাই আঁকতে লেগে যেতেন। আমি তিন দশক ধরে তাই করে যাচ্ছি। একটু অন্যভাবে। সমস্ত দিনের শেষে ডানা থেকে তুষারের তুষ ঝরে গেলে রাতে দাঁত ব্রাশ করে, মুখে ময়েশ্চারাইজার মেখে স্বপ্নে অহি পাবার নিমিত্তে বাতি নিভিয়ে বালিশের নিচে কাগজ ও পেন্সিল রেখে রচনা করি আমার বাদলা সিথান।
আমার কোষে কোষে যে নিদ্রাকণা আছে তাদের কাছে আমার ছয় দশকের দাগ, আঘাত ও আগুন রেখে প্রাচীণ পাইথনের মত শিশ্ দিয়ে উঠি। আমি সারারাত সর সরিয়ে চলতে থাকি। বিভিন্ন গর্তে পড়ি আর উঠি। মানুষের, প্রকৃতির, পশুর, জীবনের। তারই মিথষ্ক্রিয়ার অনুরনন অনুবাদ করে যাই শামীম আজাদীয় ভাষায়।
মানুষ গর্তে পড়লে ভাবে, কেন পড়লো? কোন ফাঁক দিয়ে বেয়ে উঠে কতক্ষনে বাইরের পৃথিবীতে যাবে? তর্ক করে কে এই গর্ত করে রেখেছিল, কি ছিল তার উদ্দেশ্য? আমি ভাবি, আরে ভাই বাইরেই তো আছি সারাক্ষন। দৈবাত যখন গাতায় পড়েই গেছি, ইহা একটা ব্যতিক্রম বটে- “অতএব ধরা যাক দু’একটা ঈঁদুর এবার”। আমি তারে উসুল করি। আমি এর কোনাকাচি খুঁজি, নিজে উথাল পাথাল চিত ও উপুত হয়ে দেখি এ গর্তের স্বরূপ। মহা চিন্তায় পড়ে যাই বন্ধুরে।
সে কূরূপ, অরূপ না অপরূপ! সে কি টার্নারের গুহা, না পাহাড়ের পায়ের নিচে জলে পাথরের গ্রোটো, না কেবলি স্বপ্নমোহ। কান পেতে শুনি জল ও হাওয়ার ঘর্ষনে কি গান বাজে। সে যাই হোক। আলো, মাটি, হাওয়া, আর্সেনিক, পারদ বা আবহাওয়া। আমার কি সব নিতে হবে, সে সব আমি জানি। গ্লানির কথা ভাবি না। আমার যে বোধ করার ক্ষমতা ও উপলব্ধির শক্তি আছে এবং আছে তার স্পর্শ-শব্দ- দৃশ্য-গন্ধ-স্বাদ এর নামকরনের সেটাই তো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার।
পুরাতন জ্যোস্নাঘষা ন্যাপথলিনও পাখা মেলে, আমার কফিন কেটে কেটে প্রাণমেরু রেখা প্রাপ্ত হয়, পল্লবে পল্লবে আমার পাথর চোখ খুলে খুলে যায়।
আমার জীবনবহি, কবিতার উঠোন নির্মান করি।
আমি পৃথিবীর গর্তে শুয়ে শুয়ে তাই করি। তাহাজ্জুদ তোরণ পেরিয়ে আলো এসে জ্বলে উঠে আমার শব্দ জরায়ূর ভেতরের কোমল মেদের মত স্তরে স্তরে বসা মেঘ। আমার আকাঙ্খার আয়নায় অন্ধকার দূরে থাক তার কোন অংকূর ও জন্ম নিতে পারে না।
কবিতাক্রিম
যেখানে গাছগুচ্ছ বিরল হয়ে এসেছে
আর মোহনা গিলে ফেলেছে নদীর গভীরতা
যেখানে শীতে জমে যায় জানালা
মানুষের ক্রন্দন শুনে থেমে যায় বর্ষাভরা বাস
কেবল সেখানটায় বসলেই আমি
কবিতা লিখতে পারি।
কিন্তু অতটুকু পথ পেরিয়ে যেতে
নৌকোর বিব্রত বৈঠার মত আমার শব্দরাজি
এদিক সেদিক লটরপটর করে,
ভালো করে সাঁতরাতেও পারে না
হাত থেকে খসা শব্দগুলো ঘুমজলে পড়ে ঘুরতে থাকে
আর আমি ক্যাফিনের কষ খেয়ে খেয়ে সারা রাত জাগি।
তবে কিছুক্ষন পর মাথার কলম সোজা হয়
চিন্তার সালাদে উপ্ত হয় মগজ
আংগুলগুলো কৎকতিয়ে উঠে পড়ে কম্পূটারে।
ঐ বিলুপ্ত মোহনায়ই মানুষের ক্রন্দন
ক্রিস্টাল হয়ে যায়
বৃক্ষরাজি বলতে থাকে তাদের বিরল হবার কষ্ট
বলে, যারা নাই হয়ে গেছে
তারা নাকি আসলে গাছ ছিল না
ছিল অর্ধনারীশ্বর।
কেউ তাদের কোনদিন বুঝার চেষ্টা করেনি বিধায়
নদীতে আত্মহত্যার পর তারা পাথর হয়ে গেছে।
জলের তলদেশে সে নিরেটে
একের উপর অন্য এসে বসতে বসতে
পিরামিডের পাহাড় জন্ম নিয়েছে।
ওখানে আজ আর কোন গভীরতা নেই
পুরাতন মাঝিরা আর যায় না সেখানে।
ঋতুর বিড়ালেরা জমা শীত কামড়ে ধরে থাকে
মড়মড় করে ওঠে জানালার ফ্রেম
কিন্তু কোন উষ্ণতা আনতে পারে না।
তবু আমি ওখানেই যাই
কারন কবিতা গড়া শেষ হলে বুঝি
যা হয়েছে তা দেখতে অত ভাল না হলেও
গায়ে মাখতে কিন্তু পুরাই মাখন।
দর–দস্তুর
আমার কিছু কথা আছে,
তোর বাদল দিনের ব্যালকনির পাশে
বৃষ্টিধোয়া সেই সোনা সোনা কদমের কাছে।
কথা আছে তোর বিকেলের বিদ্যূতহীন তিন ঘন্টা,
জংধরা জেনারেটার, চোখবোঁজা বাতি,
উল্টে রাখা অমর্ত্য সেন, ঘামসিক্ত তোয়ালে
ও তার পাশের সান্ধ্য-অন্ধকারের কাছে।
বেশ কিছু জরুরী কথা আছে-
মরূভূমে উটের গ্রীবার মত জেগে ছিলি যার কাছে,
ময়দান মাড়িয়ে সুগন্ধ ছড়াতে ছড়াতে দৌড়ে যাওয়া হাওয়া
লাল লেইকে বসা তুষার ও এপিং ফরেস্টের
একাকী সেই ম্যাগপাঈ পাখিটির কাছে।
কথা আছে ডকল্যান্ড ডাহুকের সাঁতারের কাছে,
তোর নিজস্ব জিকুজী স্নানাগারের মোমবাতিটা,
না শোনা হ্যারি বেলাফন্টের সংগীত,
মেহগনি কালো আমেরিকানো কফি,
কল্পনা কমিশনের বাতিল মিটিং,
অমূলক অটোগ্রাফ প্রার্থী, চন্দ্রমল্লিকা ব্যুকে
ও কার্নিশের কুহূকিনী কবুতরের কাছে।
কথা আছে।
কিছু কথা আছে
ঢাকার জ্যাম, এডিস আটকানো কর্পূর ধোঁয়া,
মালদ্বীপের মাছের সংসার দেখার টিকিট,
সাগর পাড়ের সেমিনারের স্বল্প পরিচিতা,
খামে পাওয়া খসড়া চিঠি,
ইউনিমার্ট থেকে কেনা চাইনিজ সব্জি,
দুপুরের ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস,
দৃষ্টিগোচর কিছু মুদ্রাদোষ
ও তোর খুলে রাখা রূপার আংটিটির কাছে
কথা আছে।
কথা আছে আগের আলুথালু বেশে
সপ্তাহ শেষে শুধু শুয়ে কাটানো ছুটি,
মুড়িমাখা মধ্যবিত্ত বিকেল,
জয়তুন হাড়ির ফুটন্ত জুঁইফুল ভাত,
টোকা খেলা বোরিক পাউডার মাখা ক্যারম বোর্ড
আর গন্তব্য না জেনে হঠাৎ উঠেপড়া
সেই সরীসৃপ ট্রেনটার কাছে।
আমার আরো কিছু মরিয়া কথা আছে
আমারই কোমরের কোলাজের কাছে
হিম হয়ে যাওয়া হিমালয় প্রশ্নবান,
ক্লিম্টের ছবি থেকে ঝরে যাওয়া কিস্ ও
শয্যাহারা বুর্বক এক শামীমের কাছে ।।
অহি
এক ঘন্টা ধরে স্বপ্নে
সম্পূর্ণ একটি কবিতা লিখে
পরের প্রহরে স্বপ্নের মধ্যেই আরো এক ঘন্টা
সে কবিতাটিই
মুরগী কিংবা ময়ূরের ভেজা পালকে মুছে
ঘুম ভেঙে, চা নিয়ে দেখি
কি আশ্চর্য,
রয়ে গেছে একটু অবশিষ্ট, একি!
ভর্তামাখা নখে লেগে থাকা লবনের মতো
পরিষ্কার হোয়াইট বোর্ডে
আগের ক্লাশের এ্যালজাব্রা সূত্রের মতো
মনে ভেসে আসছে আধা মোছা সেই এক লাইন!
স্বপ্নতো আসলে এক তেলেস্মাতি
তার তাড়াহুড়াও ভীষন শ্লথ
মুরগীর বা ময়ূরের খসা পালকই পাচ্ছিলাম না
পালক ভেজাবার গামলাটিও বার বার ভষ্ম হয়ে যাচ্ছিল
তাই হয়তো, কেবল সেটুকুই মোছা হয় নাই।
বিস্ময়ে বেকুব হয়ে
বেফানা ক্রন্দন করে
চা’য়ের পিরিচ ঠেলে
হারানো কবিতাখানি
ফিরে পেতে
সে অশ্রুভেজা বালিশে
মাথা রেখে পূণর্বার ঘুমোই।
অতিরিক্ত নিদ্রা শেষে
চা নিয়ে উঠে দেখি, একি!
মোছামুছির পর অবশিষ্ট যাহা ছিল,
স্বপ্নে পাওয়া অহি আমার
আর পড়ে নাই।
ফুয়েল
মাঝে মাঝে নিজেকে জীবনের কাঁচামাল মনে হয়
আমি যেন তার র-মেটিরিয়েল;
আমাকে দিয়ে সে রিয়েল এস্টেট, পোল্ট্রি, ফিসারিজ বানায়
আর সে আমারে খালি ব্যবহার করে,
ব্যবহার করে,
ব্যবহার করে…
কখনো নিজেকে জীবনের কয়েদী মনে হয়,
তার অফিসের দপ্তরী মনে হয়।
চেক চেক জামা পরে আমি তার জন্য
ধুলা ঝেড়ে টেবি্ল সাজাই, টিনের টিফিন বাক্স খুলে
বর্তন বসাই, লেবু কেটে দিই অফিস ব্যাল্কনির
স্যার এসে খেয়ে যান
আমি সাদা পাতা সেজে
একটু দূর থেকে তুলে ধরি খুশবুদার পান।
জীবনের অফিসটা খারাপ না
কেবল টেবিল গুছাতে হয় অনেক বার,
পাল্টাতে হয় বালিশের ওয়ার।
পাংখা পরিষ্কার করে হেলানে তোয়ালেটা দিয়ে
বাথরুমে রাখিতে হয় লাইফবয় সাবান।
হেন কালে গগনেতে থাকিলেও চাঁদা
আমার লাগে টর্চ, লাগে চশমা,
হাত কাঁপে বলে লাগে নতুন মানুষের হাত।
আচ্ছা, দপ্তরীরও একটা সম্মান আছে নাকি!
তারও তো ‘ওয়ালাকুম’ বলতে ইচছা করে।
খাটতে খাটতে তারও খড়ম খুলে
‘আর ভাল্লাগে না’ লাগতে পারে নাকি!
নূজ্ঝ নারীদের মত তার আর আঁশটে কাইক্কা মাছ কাটতে,
কাটা ঢেঁড়শের পিছলা ছাড়াতে ইচ্ছে করে না।
আমি জীবনকে বলতে চাই না-
স্যার, আপনিই একক দ্রোণ
আচার্য আমার
আপনিই স্নায়ুপেশী, রামতনু ধনুকের জ্যা
আমার জামার ঝকমকে ঝিণুক বোতাম।
আপনি ছাড়া আর সবই মৃত,
কিংবা আবছা আবছা।
কারন স্যারের পায়েতো লোহার জুতা,
স্যার ও টায়ার্ড।
একদিন মোজা খুলে বসলে দেখেছি
তার ও পায়ে আমার মত জল ভরা বড় বড় ফোস্কা।
তারপরও জীবন-পিপার পাশে মুখ দিয়ে
পিঁপড়া পড়ে আছি
কারণ চারদিকে অসহ্য মৃত্যু নামের বেবুন।
বৈদ্যূতিন মায়া
আমার একটু ছায়া লাগে
সামান্য একটু মায়া লাগে
মটরসুঁটি, নকুল দানা
মাপ নিয়ে নাই মানাচিনা
একটু ছায়া হইলেই হয়-
পাখি কিংবা জলের
অতি সামান্য বলের
হোক সে ছায়া উড়ন্ত
হোক পাখিটি বেজায় ক্লান্ত
থাকলেই হবে তার ডানার ছায়া
নরম রোমের উড়াল মায়া।
তোর বুকে কি তাও নাই
তিল পরিমান, তুঙ্গ ও ছাই!
আমার বুকের মাঝে বিশাল চর
কাটছে সময় বছর বছর
বাতাস বেদম কইছে কথা
বিরল ব্যথা যথা তথা
বলো না ছায়ার রেসিপি কি
রঙ কি তাহার হাকালুকি?
না হয় নে তুই আমারই ছায়া
উপশম আর ঊষার কায়া
এই এখানেই বাদলা বাটে
কিংবা সিলট পাহাড়পাঠে।
একটু খানি আতরও আছে
আমার কোমল কোমর কাছে।
আমার ছায়া রায়া রায়া
আসলে তা তোর স্মৃতিরই মায়া।।
Shamim Azad is a bilingual author and one of the best-known Bengali poets in UK. She has published more than 37 books including novels, collections of poetry, plays, children’s books, and translated books from English and Bengali. Her works have been published, among others, in the New Yorker. She was the first Bangladeshi poet who performed in Edinburgh Fringe Festival 2012. Recently, she finished her residency with A Poet’s Agora in Athens, Greece. She lives in the UK. Email: lekhok@gmail.com