English Synopsis
Blasphemy is generally defined as the act or offense of speaking sacrilegiously about God or sacred things. The origin of Blasphemy law is in Europe. Kings were considered as the ambassador of God, and law was established to control protest against them. This law exists in 77 countries of the world. Many philosophers and scientist became the victims of this law. The most remembered names of victims are Socrates, Galileo, and Bruno. Over the years, politicians and national rulers use religion as a weapon to exploit others.
In the Indian subcontinent, the foundation of religion-based politics was laid by the bourgeoisie like Muhammad Ali Jinnah. Even though secularism is one of the main foundations of the Constitution of Bangladesh of 1972, the history of blasphemy from the birth of Bangladesh till now is quite long and painful. Humayun Azad’s book Nari and Taslima Nasrin’s novel Lajja were attacked by extremist religious ideologues and banned in Bangladesh. Numerous bloggers, including Avijit Roy, Rajib were killed, and many bloggers were forced to leave the country. In 2008, the government formulated women’s policy in a new way, and the policy has been criticized by conservative people of Bangladesh because the language of the policy has hurt the religious feelings. Religious political parties hold extremist protest and rallies against atheists and feminists. Alongside extremists, progressive civil society raised questions against the novel Pak sar zameen shad bad by Humayun Azad. The use of language in this novel was condemned more than the subject matter by semi-conservatives, civilized intellectual class, and a large group of literary critics. When protest do not work, anarchy appears in politics. When describing the most humiliating situations, writers and artists also become anarchists. In 1906, while writing about confined women society, Begum Rokeya critiqued religion and patriarchy clearly and with determination. Gora is the only well-planned and successful novel of Rabindranath Tagore. The characters of this novel argued about country, nationality, religion, and political relations among themselves. Rabindranath prioritized religious feelings over religious belief.
গ্রিক শব্দ ‘ব্লাসফেমেন’ থেকে ব্লাসফেমি শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ ধর্ম নিন্দা বা ঈশ্বর নিন্দা। যদিও কারো ওপর অপবাদ বা কলঙ্ক আরোপ করাটাও এর আওতাভুক্ত হয় তারপরও ব্লাসফেমি বলতে প্রধানত ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অবমাননাকেই বোঝায়।
ব্লাসফেমি আইনের উৎপত্তি হয়েছিল ইউরোপে। তখন রাজা বাদশাগণ জনগণের কাছে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপিত হতেন মানুষ যাতে ঈশ্বরের প্রতিনিধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে না পারে সেজন্য ব্লাসফেমি নামক আইনের উৎপত্তি হয়েছিল। বর্তমানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সোমালিয়াসহ এই ৭৭টি দেশে আইন বলবৎ রয়েছে।
ব্লাসফেমি আইনের ইতিহাস কি মানব সভ্যতার সমান বয়সী? ১৫৪৩ সালে পোলিশ বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস মারা যান। যিনি প্রথম দাবি করেছিলেন সূর্য না, পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। বাইবেলের বিপরীত কথা বলার জন্য গীর্জার পাদ্রিরা তার বই ‘রেভোল্যুশনাস’ নিষিদ্ধ করেছিল। এরপর ইতালির বিজ্ঞানী ব্রুনো এই অপ্রকাশিত সত্যকে পুনরাবিষ্কার করতে গেলে তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। পোপের নির্দেশে ইউরোপের কোন দেশেই তাকে থাকতে দেয়া হয় না। অবশেষে ১৫৯২ সাল থেকে টানা আট বছর নির্যাতন করে, বন্দী রেখে, সবশেষে বিচারের নামে আগুনে পুড়িয়ে তাকে মারা হয়। গ্যালিলিও, সক্রেটিসসহ যুগে যুগে অসংখ্য সভ্যতার অগ্রগতির ধারক ও বাহকদের এভাবেই ব্লাসফেমি আইনের শিকার হতে হয়েছে। সালমান রুশদী ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক। তাঁর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ গ্রন্থটি ১৯৮৯ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তার মৃত্যদণ্ড- দাবি করে ইরানের আয়াতুল্লাহ্ খোমেনী সরকার।
ধর্মের সাথে বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকেরা ধর্মকে সাথে রাখেন সংখ্যাগরিষ্ঠের দুর্বলতাকে ব্যবহার করতে, মর্যাদা দিতে নয়।
ধর্ম-গোত্র জাতি বা গোষ্ঠীগত অবমাননাকে, যদি ব্লাসফেমি বলে ধরা হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন যাগে, ধর্মীয় অনুভূতি আসলে কী? এর কোনো নিদিষ্ট মাপকাঠি আছে কি? দেশ-কাল-পাত্র ভেদে এই অনুভব কি একই মাত্রায় কার্যকর থাকে?
অধ্যাপক কাবেরী গায়েন নারীনীতি বাস্তবায়নে ওলামা মাশায়েখদের বিরোধিতার পেছনে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি ভীতি, অস্বীকৃতি এবং অবজ্ঞাকে দেখতে পান।
অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত মৌলবাদ ও জঙ্গি সন্ত্রাসের পেছনে সমাজে বিদ্যমান শ্রেণীবৈষম্য এবং প্রকট দারিদ্রকে দেখতে পান।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিশ্লেষণে জানা যায় ব্রিটিশদের ডিভাইড এ্যান্ড রুল নীতি এক দিকে পুষ্ট করেছে হিন্দু জাতীয়বাদীর রাম রাজত্বের স্বপ্নকে, অপর দিকে মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের জন্য খোলাফায়ে রাশেদীনের স্বপ্ন। গান্ধী নিজে অসাম্প্রদায়িক, ভারতবর্ষের মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা হয়েও ধর্মের সাথে রাজনীতিকে এক করে দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাজনকারী গোষ্ঠীকে সহায়তা করে গেছেন অবচেতন ভাবে। তিনি প্রাণও দিয়েছেন সেই সাম্প্রাদায়িক শক্তির হাতেই।
আবার পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যক্তিজীবনে চাল-চলনে ব্রিটিশ-সংস্কৃতি অনুসরণ করতেন। শুরুর দিকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পক্ষেও ছিলেন। কিন্তু দ্বিজাতিতত্বের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সূচনাও তিনিই করেছিলেন। পেছনে ছিল ত্রিধাবিভক্ত ভারতবর্ষের উত্তর-ঔপনিবেশিক রাজত্ব কায়েমের স্বার্থবাদী ঘৃণ্য চক্রান্ত। এভাবেই বুর্জোয়াদের হাতেই মূলত ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়, যেখানে ধর্ম বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা থাকে কেবলি হাতিয়ার রুপে ব্যবহারে।
বাংলাদেশে ব্লাসফেমি প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে এ যাবৎ কালের ব্লাসফেমির ইতিহাসে বেশ দীর্ঘ এবং বেদনাদায়ক। ১৯৭৪ সালে কবিতায় ধর্ম অবমাননার অপবাদে কবি দাউদ হায়দারকে জোরকরে দেশ থেকে বের করে দেয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্লাসফেমি চর্চা শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে মৌলভিবাজারের কমলগণ্জ উপজেলার ছাতকছড়া গ্রামে নুরজাহানকে ১০১টি পাথর ছুঁড়ে নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশে সামাজিক ব্লাসফেমির একটি অন্যতম উদাহরণ। নুরজাহান পরবর্তীতে অপমানে ও লজ্জায় আত্মহত্যা করেছিলো। বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে হুমায়ন আজাদের গবেষণা প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘নারী’, একুশে বই মেলায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অশ্লীলতা এবং ধর্ম নিয়ে সমালোচনার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয় পরবর্তী সময়ে তার ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৩) উপন্যাসটি নিষিদ্ধকরার জন্য জোর দাবি জানায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো । উগ্রবাদী ধর্মীয় মতাবলম্বীদের আক্রমনের শিকার হয়ে ২০০৪ তিনি মারা যান। নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরীনের ‘লজ্জা’ উপন্যাসটিও একইভাবে উগ্রবাদী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে নিষিদ্ধ হয় । সঙ্গে লেখককে হত্যার হুমকিও দেয়া হয় এবং তার মাথার দাম ঘোষণা করা হয় । এমতাবস্থায় তসলিমা নাসরিনকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্যকরা হয়।
বই এবং লেখকের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে নিয়মিত ভাবে আক্রান্ত হতে থাকেন প্রকাশকেরা। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ একুশে গ্রন্থমেলায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন বই প্রকাশ করার জন্য ২০১৫ সালে রোদেলা প্রকাশনী, ২০১৬ তে ব-দ্বীপ প্রকাশনী স্টল বন্ধ করে দেয় । এর পর মেলার কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর সামগ্রিকভাবে নজর রেখে চলেছে এমন গ্রন্থ যাতে প্রকাশ না হতে পারে সেই বিষয়ে । রোদেলা প্রকাশনী স্টল বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে সমাবেশ ও কর্মসূচী ঘোষণা করায় শ্রাবন প্রকাশনীকেও ঐ বছর নিষিদ্ধ করা হয় । ব্লগার অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালে । অভিজিৎ রায়ের ও অন্যান্য মুক্তচিন্তার বই প্রকাশের অপবাদে জাগৃতি ও শুদ্ধস্বরের উপর আক্রমণ করা হয়। জাগৃতির প্রকাশক দীপন নিহত হন এবং শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহত অবস্থায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তারপর একের পর এক রাজীব , নিলয়, ওয়াশিকুর বাবু সহ অসংখ্য ব্লগারকে হত্যা,হত্যার প্রচেষ্টা এবং হত্যার হুমকি দেয়া হয়। দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় অনেককেই ।
বাংলাদেশে ব্লাসফেমি আইন
বাংলাদেশে দণ্ড-বিধি আইনের ২৯৫ ক ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশের যে কোন নাগরিকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অসদুদ্দেশ্যে লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য দ্বারা দৃশ্যমান অঙ্গভঙ্গি দ্বারা সংশ্লিষ্ট ধর্মটিকে বা কারো ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অবমাননা করে বা করার চেষ্টা করে, সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিকে দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড- অথবা অর্থদণ্ড- কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালের মূল আইনে এ ধারাটি ছিল না। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে এ ধারাটি যুক্ত হয়।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সংবাদপত্র যদি রাষ্ট্রবিরোধী কোনকিছু বা এমন কিছু প্রকাশ করে যা নাগরিকদের মধ্যে শক্রতা ও ঘৃণা তৈরিতে উস্কানি দেয় কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানে, সে ক্ষেত্রে সরকার ইচ্ছা করলে ঐ সংবাদপত্রের সংশ্লিষ্ট কপিগুলো বাজেয়াপ্ত করতে পারে।
২০০৬ সালে প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ইলেকট্রনিক ফরমে কেউ যদি এমন কিছু প্রকাশ করে যাতে কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয় তাহলে ঐ ব্যক্তির অনধিক দশ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ধর্ম অবমাননা সম্পর্ক কোরান শরীফে যা বলা হয়েছে-
১. নিঃসন্দেহে যারা আল্লাহ ও তার রসূলকে কষ্ট দেয়, -আল্লাহ্ তাদেরকে পার্থিব জীবনে এবং পরকালে অভিশাপ দেন, এবং তাদের জন্য অবমাননাকর শাস্তি প্রস্তত করে রেখেছেন। যদি এই প্রতারকেরা আর ঐসব লোকেরা যাদের অন্তরে কলুষতা আছে, এবং ঐ সকল লোকেরা যারা শহরে মিথ্যা সংবাদ রটিয়ে থাকে তারা,(তাদের এসব কাজ থেকে) বিরত না হয়, তাহলে আমি অবশ্যই আপনাকে তাদের উপর শক্তিশালি করে দেবো, এরপর তারা শহরে আপনার কাছে অতি অল্পকালই অবস্থান করতে পারবে; তারা তাদের নিজেদেরকে অভিশপ্ত অবস্থায় পাবে। যেখানে তাদেরকে আটক করা হবে এবং মারধর করা হবে।
[কুরআন ৩৩:৫৭- ৬১]২. যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা তাদের হাত-পা-সমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেয়া হবে অথবা তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।
[কুরআন ৫:৩৩-৩৪]
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম প্রসঙ্গ
১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধানে চারটি প্রধান মূল ভিত্তির মধ্যে একটি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা সরিয়ে ‘বিসমিল্লাহির রহমানুর রাহিম’ এবং “পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ উপর” যোগ করেন পঞ্চম সংশোধিনীর দ্বারা। ১৯৮৮ সালে এইচ এম এরশাদ অষ্টম সংশোধনীর মারফত সংবিধানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে যোগ করেন। ২০১০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সংবিধানের একটি মূল মতবাদ হিসেবে পুনস্থাপন করে। তবে ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে বহাল থাকে। এভাবে সাংবিধানিকভাবে অস্পষ্টতার একটা জায়গা থেকে যায় , যাকেস্ববিরোধিতাও আখ্যা দেয়া যায়। কারণ ২ (ক) অনুচ্ছেদে আবার বলা আছে -প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ আন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সম মর্যাদা ও সম অধিকার নিশ্চিত করিবেন। ১৯৮৮ তে অষ্টম সংশোধনীর এবং ২০০১ এ সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা শুরু হয় এবং ধারাবাহিকভাবে ধর্মীয় উৎসবের আগে শুরু হয় মূর্তিভাঙ্গার মত বিদ্বেষমূলক ঘৃণিত কাজ।
নারীনীতি প্রণয়নে ব্যর্থতা প্রসঙ্গে ব্লাসফেমি
১৯৯৭ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সরকার নারীনীতি ঘোষণা করে। কিন্তু পরবর্তী সরকার ২০০৪ সালে এটাকে পরিবর্তন করে পুনঃপ্রণয়ন করে যেটি মূলনীতি থেকে অনেকখানি সরে আসে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুনভাবে নারীনীতি বিষয়ে ঘোষিত হয় তা প্রবল সমালোচনার সম্মুখীন হয় রক্ষণশীল জনতা ও ওলামা-মাশায়েখদের তরফ থেকে। সম্পদ ও উত্তরাধিকার বন্টনে ইসলামে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার বিষয়টিকে তারা কোরান শরীফের অনুসারে বাতিল করে দেয়ার দাবি করেন। শুধু তাই নয়, নারীনীতির ‘ভাষা’ ব্যবহারসহ এমন অনেক বিষয়ে তারা প্রশ্ন তোলেন যেখানে তাদের ধর্মীয় অনুভূতি আহত হওয়ার দাবি তোলেন। তারা বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার বক্তব্য নারী স্বাধীনতার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ৯০ শতাংশ মানুষের মালিক আল্লাহ ও তার নবীর কোন বক্তব্য এতে নেই, বিশ্বময় অনেকগুলো নারীর স্বাধীনতা ও সম অধিকারের সম্মেলনের কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু শেষ নবীর বিদায়ী ভাষণে নারী পুরুষের এবং পুরুষের প্রতি নারীর দায়িত্ব ও অধিকার বিষয়ক একটি কথাও নেই এতে। রাষ্ট্রীয় সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের উল্লেখ করা হয়েছে অথচ আল কুরআন এবং সুন্নাতে রাসুল সে ইসলাম ও মুসলমানের সংবিধান এর কোন উল্লেখ নেই। এ নীতিতে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি কৃষি, প্রশাসন, সৈনিক-পুলিশ, নির্মাণ শ্রমিক বিদেশে প্রেরণসহ নারীর অনেক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। অথচ নারীকে একজন আদর্শ না হওয়ার, আদর্শ গৃহিণী হওয়ার কথা কোথাও বলা হয়নি। বলা হয়নি নারীর দেহ ব্যবসা, ব্যবসায়ের পণ্য হিসেবে ব্যবহারের বিপাকে একটি কথাও। ধর্মকর্ম পালনের কথা বলার তো চিন্তাই করা যায় না। নারীকে পুরুষের চেয়ে অধিক মাত্রায় খেলাধূলা-বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মে অংশ নিতে বলা হয়েছে।”
তারা পরিষ্কার ভাষাতেই দাবি জানান, সংবিধানে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান ও অংশগ্রহণ থাকবে তবে তা অবশ্যই হতে হবে পুরুষের নেতৃত্বে। অথচ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ নারী নেতৃত্ব বিদ্যমান। কাজেই ‘ধর্মীয় অনুভূতি’ বিষয়টি কতটা আপেক্ষিক এবং অর্থনীতির মানদণ্ডের উপর নির্ভরশীল তা একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাচ্ছে। ২০০৪ সালে উত্তরাধিকার, সম্পদ ও ভূমির ওপর নারীর সমান অধিকারের বিষয়টি বাদ দিয়ে নারীনীতি ঘোষিত হলে তা নিয়ে কোন তরফ থেকেই আন্দোলন বা প্রতিবাদ উত্থাপিত হয় না। ২০১১ সালে উপরোল্লেখিত বিচ্যুতি সমূহ উল্লেখ করে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো পথে নামে। অথচ নানাভাবেই বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় বিধানের রিফর্মেশন ঘটেছে সময়ে দাবিতে। ১৯৬১ সালের আইন অনুযায়ী সালিশ পরিষদের সম্মতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে জেল জরিমানা হওয়ার কথা। অথচ ধর্মীয় বিধি অনুসারে চারজন স্ত্রী পর্যন্ত রাখা জায়েজ আছে। ধর্মে মৌখিক তালাকের সুযোগ দেয়া থাকলেও ৮ নং ধারায় স্বামীর মত স্ত্রীকেও তালাক দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। হিল্লা বিয়েকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করলেও কমপক্ষে তিনবার তালাকজনিত জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে অনুমতি দেয়া হয়নি।
২০১১ সালে নারীনীতিতে ঘোষিত সত্যিকার অর্থে নারীকে তার স্বাধীন পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্বের প্রতিষ্ঠা দেয়ার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধাগুলোতে সমতা আনার লক্ষ্য ছিল। সমস্যা মূলত সেখানেই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীকে সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়নের পথে মূল বাধা দূর করে দেবে। এই বিষয়টি ব্লাসফেমি বা অনুভূতিতে আঘাত পাওয়া বিষয়ের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত না হলেও বৃহৎ পরিসরে পরোক্ষ অথচ জোরালো প্রতিক্রিয়াশীলতার উদাহরণ। কারণ ঐ নীতিসমূহের প্রতিফলন ঘটলে আজকের বাংলাদেশের চেহারা অন্যরকম হতো নিঃসন্দেহে। নারীর ক্ষমতায়নের পথটি অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত হতো হয়তো।
ব্লাসফেমি বিষয়ে ভাষা ও সমাজ মনস্তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা
বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদ ও নারীবাদী তত্ত্বের দার্শনিক দিকটি সাধারণ্যে সম্পূর্ণভাবে উপক্ষো করা হয়। এর ফলস্বরূপ লেখক হুমায়ুন আজাদ এবং তাসলিমা নাসরীনকে বিশেষভাবে মূল্য দিতে হয়েছে।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময়ে এই দুই মতবাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থায় প্রতিবাদ,মিছিল করলেও বিষয়টি চরম আকার লাভ করে তসলিমা নাসরীনের ‘লজ্জা’ এবং হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ -উপন্যাস দুটোকে কেন্দ্র করে। যেখানে বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের সদস্যদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী ধর্ষণকারী হিসেবে তুলে ধরা হয়।
হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসটি নিয়ে খোদ প্রগতিশীল সুশীল সমাজও প্রশ্ন তোলেন এর সাহিত্য মান সম্পর্কে। বিষয়ানুগ হওয়ায় এই উপন্যাসের ভাষা ব্যবহার যথারীতি নিষ্টুর ধরণের কদর্য।
সাহিত্য মান কিংবা শ্লীলতা-অশ্লীলতার মাপকাঠির বিষয়টি এখানে প্রাসঙ্গিক না হলেও ভাষার সমাজ মনস্তত্ত্ব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অনুভূতিও গুরুত্বপূর্ণ বৈকি।
কতিপয় উদ্বৃতি তুলে ধরা যাক-
১. জিহাদিদের আমি যতই দেখি ততোই বিস্মিত হই। ছহবত করার সময় ওরা ছুরির মতো ধারালো আর নিষ্টুর, ছহবতের সময় ওরা লোহার মতো শক্ত, শক্ত হতেও সময় নেয় না, ক্ষরণের সময় নেয় না, আবার শক্ত হয়, বিছমিল্লাহ বলে আবার শুরু করে।
(পৃ. ২৯৪/উপন্যাস সমগ্র)
২. ‘আল্লায় না কইছে একটা বীজও নষ্ট অইতে দেওন যাইব না? প্রত্যেকটা বীজ থিকা মমিন মুছলমান বানাইতে হইব, যাতে জীবন ভইরা জিহাদ করতে পারে?
(পৃ. ২৯৩/উপন্যাস সমগ্র)
৩. আমার জিহাদিরা মালাউন পাড়ায়ই হুর লাভ করে গাফরুর রাহিম এত হুর যে জিহাদিদের জন্য পাঠিয়েছিলেন তা আমি ভাবতে পারিনি। মালাউন পাড়াগুলো নানা রকম হুরের পল্লী ওগুলো হুরস্বর্গ। যারা আল্লার কাজ করে আল্লা তাদের তৌফিক দান করেন; কিন্তু এতো তৌফিক দেবেন ভাবিনি।
(পৃ. ২৭৩/ঐ)
বাংলাদেশের আধা রক্ষণশীল সমাজ, সুশীল বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, সাহিত্য সমালোচক গোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ এই উপন্যাসের বিষয়ের চাইতে ভাষার প্রয়োগকে তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে থাকেন।
ধর্মীয় মৌলবাদের উগ্র বিধ্বংসী চেহারাকে যথাযথ রূপে তুলে ধরতে গেলে তার ভাষিক প্রকাশও কি এরকমই উগ্র আর নগ্ন হওয়া উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে ‘ব্লাসফেমি’ বা অনুভূতিতে আঘাত এবং তৎপরবর্তী দণ্ডাআগ্গা বিষয়ক আলোচনাও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। বিতর্কের সুযোগ দেয়াটাও অবশ্য ‘অনুভূতির’সাথে সম্পর্কিত । অথচ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে, রাজনীতির মাঠে ময়দানে প্রতিবাদ যখন সুস্থভাবে সুষ্ঠুফলাফল বয়ে আনতে না পারে তখনই যুগে যুগে রাজনীতিতে এনার্কিজমের আবির্ভাব ঘটেছে।
রাষ্ট্রের চরম বিপর্যয় বিশৃঙ্খলার মুহূর্তে মানবতার সর্বোচ্চ অবমাননাকর পরিস্থিতি বর্ণনায় লেখক-শিল্পীরাও যুগে যুগে নৈরাজ্যবাদী হয়ে উঠেছেন। আবার একই সঙ্গে জন অনুভূতির কথা মাথায় রেখে সত্য প্রকাশে নির্বিশেষ নৈরাজ্যবাদকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন দেন না যুক্তিবাদী সুশীল সমাজও। কারণ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের শৃঙ্খলাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বটে। তবুও যখন এতদঞ্চলে রোকেয়ার পর নারীবাদী চিন্তার বিকাশে দীর্ঘ বিরতি পড়ে,তসলিমা নাসরীন অত্র দেশে নারীবাদের প্রবক্তা হয়েও দিকভ্রান্ত হয়ে যান তখন এই জন অনুভূতির প্রতি নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস ব্যাখ্যা জরুরি হয়ে পড়ে।
নীরদ সি চৌধুরীর ভাষ্য মতে, শিল্প হচ্ছে সত্যের ট্রান্সফরমেশন, সরাসরি সত্যের রূপায়ণ নয়। রাষ্ট্র নয়, একটি দেশের সামাজিক ইতিহাসের ধারাবাহিকতাই বলতে পারে এই সময়ে তার কোনটি প্রয়োজন সত্য নাকি সত্যের ট্রান্সফরমেশন।
মনে রাখতে হবে, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৯০৭ সালে অবরুদ্ধ নারী সমাজের উদ্দেশ্যে লিখতে গিয়ে প্রথমেই ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রকে যুগপৎ আঘাত করেছিলেন স্পষ্ট ভাষায় এবং দৃঢ়চিত্তে।
১. যখনই কোন ভগিনী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।
২. আমাদিগকে প্রতারণা করিবার নিমিত্ত পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।
৩. ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ রমনীর উপরে প্রভুত্ব করিতেছেন।
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পরবর্তী সংস্করণে এই বিতর্কিত বক্তব্যসমূহ সেকালে অপসৃত হয়। তাতে রোকেয়ার স্কুল এবং শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। কিন্তু নারীমুক্তি তথা জনগোষ্ঠীর সত্যিকার জাগরণের পথ সুদূরপরাহতই থেকে যায়। কেননা, রোকেয়া, হুমায়ুন আজাদ কিংবা তসলিমা নাসরীনের সমাজ পরিবর্তন সম্পর্কিত ভাবনাসমূহকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সমালোচনা করবার মঞ্চটিওএই সব নিষিদ্ধকরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত হতে পারে নি।
‘গোষ্ঠী’ অনুভূতির রবীন্দ্র-ব্যাখ্যা
‘গোরা’ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের সম্ভবত একমাত্র সুপরিকল্পিত সফল উপন্যাস। তিনি হিন্দু আর ব্রাহ্ম সমাজকে দুই প্রান্তে রেখে ছক কেটে দাবার গুটির মত সমানভাবে দু’দিকে চরিত্রগুলোকে সাজিয়ে বানিয়েছেন। বাইরে থেকে এক দলকে সাদা আর অন্য দলকে কালো রঙ দেখালেও অন্তর্গত চারিত্র্যে, বৈশিষ্টে সমানভাবে বিপরীত। যেমন -একই চরিত্রের ব্রাহ্ম রূপ হলো পরেশবাবু, সনাতন হিন্দু রূপটি আনন্দময়ীর। বিপরীত সমাজে অবস্থান করেও তারা দুজনই মঙ্গল বার্তার ধারক। ওদিকে ব্রাহ্ম বরদাসুন্দরী এবং হিন্দু হরিমোহিনী দুজন দুদিকে থেকে সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা, ব্যক্তিস্বার্থের প্রতীক। তারা নিজেকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করতে গিয়ে অপরের প্রতি ঘৃণা, আর কুৎসা ছড়ান। তাদের মতোই আরো দুটি চরিত্র হারানবাবু এবং শঙ্কর দয়াল। ধর্ম বা মত মনুষ্যত্বের চাইতে অনেক অনেক বড় আর শক্তিশালী এদের কাছে। ‘গোরা’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো বিশাল উপন্যাস জুড়ে দেশ, জাতীয়তা, ধর্ম এবং এই সবগুলো বিষয়ের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে তর্ক করে। তর্কের মাঝে মাঝে সুর ভেসে আসে, যা একান্তই রবীন্দ্রনাথের। “ব্রাহ্মই বা কে আর হিন্দুই বা কে। মানুষের হৃদয়ের তো কোন জাত নেই।” হিন্দু ধর্মাবলম্বী আনন্দময়ীর ভাষ্যে মানবতাবাদের আভাস মেলে। আবার উগ্র ধর্মবাদী গোরা বলে-
“মানুষের পরিবর্তন মনুষ্যত্বের পথেই ঘটে, কিন্তু মানুষ তো হঠাৎ কুকুর বেড়াল হয় না। ভারতবর্ষের পরিবর্তন ভারতবর্ষের পথেই হওয়া চাই, হঠাৎ ইংরাজি ইতিহাসের পথ ধরলে আগাগোড়া সমস্ত পথ নিরর্থক হয়ে যাবে।”অর্থাৎ পরেশবাবুর নাস্তিকতা আর আনন্দময়ীর মানবতাবাদ এক সূত্রে গাঁথা, তা হলো মানবতার জয়। আবার গোরা ধর্মকে আঁকড়ে ধরলেও তার মূল গন্তব্য স্বদেশ, দেশের মানুষ, দেশপ্রেম অর্থাৎ দেশের মঙ্গল।
‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ক গোরা তার প্রেমিকা সুচরিতাকে বলেছিল, আমি ঠাকুরকে ভক্তি করি কিনা বলতে পারিনে, কিন্তু আমি আমার দেশের ভক্তিকে ভক্তি করি। এতকাল ধরে সমস্ত দেশের পূজা যেখানে পৌঁছেছে আমার কাছে সে পূজনীয়। আমি কোনমতেই খ্রিস্টান মিশনারির মতো সেখানে বিষদৃষ্টিপাত করতে পারিনে।
রবীন্দ্রনাথও ধর্ম বিশ্বাসের চাইতে ধর্ম বিশ্বাসের অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন সর্বদা। ‘গোরা’ উপন্যাসে দেখা যায়, দ্বন্দ্ব বিদীর্ণ ব্রাহ্ম সমাজ আর হিন্দু সমাজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রকট ঘৃণার চেহারা নিয়ে। সেখানে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েও আনন্দময়ী সহনশীলতা আর উদারতার উদাহরণ হতে পারেন। আবার প্রথাবদ্ব সমাজ ভেঙে বেরিয়ে পড়া ব্রাহ্ম সমাজেও আছে হারানবাবু আর বরদাসুন্দরীর মত সংকীর্ণচিত্ত মানুষেরা। যারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারে ধর্মান্ধতার বিপরীতে মতান্ধতার জন্ম দেয়। ফলাফল একই পাকচক্রে ঘুরপাক খাওয়া।
মতবাদও ধর্মের মতোই সংকীর্ণতা আর কূপমণ্ডূকতায় আক্রান্ত হয়ে উঠতে পারে। যে কোন মতের প্রচারণার ফলাফল যদি হয় মানবগোষ্ঠীতে (তা যতই ক্ষুদ্র আয়তনের হোক না কেন) ঘৃণা আর বিদ্বেষ প্রচার, ক্রমাগত বিদ্বেষ প্রচারণার ফলে ঐ জনগোষ্ঠী যদি প্রতিহিংসাপরায়ণ আর ক্রমেই প্রতিশোধকামিতায় হিংস্র হয়ে ওঠে তবে সেই দায় উক্ত মতাবলম্বীদের উপর বর্তায় বৈ কি।
উপন্যাসের আলোকিত চরিত্র পরেশবাবু ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি যে কোন কাজের ফলাফল হিসেবে ব্যক্তির মঙ্গল হচ্ছে কিনা ভাবেন। তার ভাষ্য মতে-
‘মানুষকেই সমাজের খাতিরে সংকুচিত হয়ে থাকতে হবে একথা কখনোই ঠিক নয় -সমাজকেই মানুষের খাতিরে নিজেকে কেবলই প্রশস্ত করে তুলতে হবে।’
কিন্তু গোরা ব্যক্তির চাইতে সমষ্টির বৃহত্তর মঙ্গলের কথা ভাবে। পথ আলাদা হলেও গন্তব্য তাদের এক।
ইংরেজি Patriotism যে অর্থে দেশপ্রেম না হয়ে ‘দেশত্ববাদ’ হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন এমা গোল্ডম্যান। তার মতে দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষের প্রতি, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি প্রেম, একটা আত্মিক টান। কিন্তু রাষ্ট্র উৎপাদিত দেশ প্রেমে এই আত্মিক টানের চেয়ে পরজাতির প্রতি অর্থাৎ অন্য দেশের প্রতি ঘৃণা, তাদের সাথে প্রতিযোগিতা।এবং তাদেরকে নিচু এবং তাদের চাইতে নিজেদের উন্নত বলে আত্মশ্লাঘায় ভোগার একটা প্রবণতা প্রকটভাবে দেখা যায়। তাই এটা শুধু দেশপ্রেম থাকে না, মতাদর্শে পরিণত হয়। মতাদর্শ মানেই কর্তৃত্বতন্ত্র।
একই কথা আসলে ধর্মের জন্যও প্রযোজ্য। স্ব-শ্রেণীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে অপরের প্রতি ঘৃণা বর্ধমান হলে তা ব্রাহ্ম ধর্মের মতো কিংবা সমাজতন্ত্রের মতো পথ হারিয়ে ফেলে।
‘গোরা’ উপন্যাসের ভাবার্থও ঠিক সেলিম রেজা নিউটনের বক্তব্যের অনুরূপ:
“মতাদর্শই সব সময়ই মানুষের চেয়ে বড় মনে করে নিজেকে। ‘মানুষ’ বলতে মতাদর্শ কখনো তাজা রক্তমাংসের ব্যক্তি মানুষকে বোঝেনা। মানুষ বলতে মতাদর্শ বোঝে একটা বিমূর্ত ধারণাকে।
কারণটা হলো এই মুহূর্তে প্রাণবন্ত মানুষকে খুন না করে তার ওপর দমন পীড়ন জোরজবরদস্তি না করে কোন মতাদর্শই নিজকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।
মতাদর্শ এসব জেল জুলুম-খুন খারাবি করে বিমূর্ত ভবিষ্যত্বের ‘শুভ ও সুন্দর মানব সমাজ’ প্রতিষ্ঠার নামে।
সরাসরি ব্লাসফেমি আইন বলতে বর্তমানে বাংলাদেশে কোন আইন প্রচলিত নেই। সরকার প্রধানও এ বিষয়ে বিবিসিকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, এ বিশেষ ক্ষমতা আইন সহ আরো বেশ কিছু আইনের ধারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে এবং ফলপ্রসূভাবে তার প্রয়োগও ঘটে চলেছে। কিন্তু তারপরও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ এই বিষয়ে সরাসরি আইনের দাবিতে অটল রয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতি বনাম বাক স্বাধীনতার এই অসম লড়াই জনগোষ্ঠীর জন্য কখনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। দুই পক্ষই হয়তো এ বিষয়ে জ্ঞানপাপী যে, এসব কিছুই বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ বিশেষ। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে ভঙ্গুর করে রাখতে মুনাফালোভী সাম্রাজ্যবাদ সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদকে জঙ্গী সন্ত্রাসে রূপান্তর করতে তৎপর। স্বার্থোদ্ধার শেষে আবার তাদেরই সৃষ্ট তালেবানিজম, আল কায়েদা, আইএসকে তারা শক্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম এবং তালেবান নেতা বিন লাদেন গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছে। মুশকিল হচ্ছে, ব্যধিই যেহেতু সংক্রামক তাই বাংলাদেশের মত দারিদ্যপীড়িত দেশেরও ভাইরাসের সংক্রমনের মত দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে ধর্মের আবরণে বিভ্রান্তিকর ভুল শিক্ষা। তাই স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগের মানচিত্রের সাথে বর্তমান বাংলাদেশের অনেক দূরত্ব। চেহারা ক্রমশ ভয়ংকর রূপ লাভ করছে। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়? নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা কোন বার্তা রেখে যাচ্ছি? জ্ঞানের প্রধান পথ বিতর্ক, ক্রমাগত প্রশ্ন উত্থাপন -সেই পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বাংলাদেশের যে-কোন জেলায়, উপজেলায়, অজ পাড়াগাঁয় ছোট্ট কোন জরীপ কাজ চালানো হোক তরুণ প্রজন্মের ভাবনা নিয়ে। চমকে যেতে হবে। শিক্ষার প্রসার ঘটছে, নাকি কুশিক্ষার? নারী নিপীড়ণ কেন শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বিগত কয়েক দশকে, কেন সাম্প্রদায়িকতার বেঘোর অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে চারদিক সব প্রশ্নের উত্তর মিলে যাবে। এই দারিদ্যপীড়িত, দুর্নীতিগ্রস্ত, অশিক্ষা-কুশিক্ষা-কুসংস্কার পীড়িত জনপদে তবে আলো আসবে কোন পথে? মুক্তবুদ্ধির চর্চা ব্যতীত কোন জাতি পেরেছে এগিয়ে যেতে?
বরং ‘গোরা’ উপন্যাসের পরেশবাবুর সাথে সুর মিলিয়ে শেষ করা যাক-
“আমি ইশ্বরের কাছে সর্বদাই এই প্রার্থনা করি যে, ব্রাহ্মের সভাতেই হোক আর হিন্দুর চণ্ডীমণ্ডপেই হোক আমি যেন সত্যকে সর্বত্রই নতশিরে অতি সহজেই বিনা বিদ্রোহে প্রণাম করতে পারি -বাইরের কোন বাধা আমাকে যেন আটকে রাখতে না পারে।”
সহায়ক গ্রন্থ:
১.রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসসমগ্র
২.রোকেয়া রচনাবলী,বাংলা একাডেমি
৩.হুমায়ুন আজাদ উপন্যাসসমগ্র(৩য় খন্ড),আগামী প্রকাশনী
৪. আবুল বারকাত, বাংলাদেশে মৌলবাদঃজঙ্গীবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্দর বাহির,
মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা
৫.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী,রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির সামাজিকতা,চন্দ্রাবতী প্রকাশনী
৬.সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, জাতীয়তাবাদ,সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি,সংহতি প্রকাশনী
৭.রোকন রকি,দেশাত্ববাদঃরাষ্ট্র কর্তৃত্বের মতাদর্শিক দ্বেষপ্রেম(অনুবাদ),দ্যু প্রকাশনী