ভাঙারপুল বৃত্তান্ত
জয়নব কবে বিলেত নামক এই আজব দেশটাতে এসে পা রেখেছিল, আজও ভোলেনি। গ্রামের শেষ সীমানায় পার্শ্ববর্তী দেশের নদী ঘেঁষে ছিল তাদের বাড়িটা। দুই বেনী দুলিয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে স্কুল পার করে, কলেজে উঠতেই বাবার ইচ্ছেতে বিয়েটা হয়ে গেল। অথচ পাথুরে নদীর অবিরাম ছন্দময় স্রোতের অবগাহনে জীবনটা যেন প্রতিদিন রচিত, এক একটা নৈসর্গিক কবিতার মতো যাপন করছিল জয়নব। গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম শ্রেণিতে মেট্রিক পাশ করে, মাইলকয়েক দূরের কলেজে ভর্তি হলো ওরা কয়েকজন বান্ধবী। সবার রেজাল্ট খুব ভালো ছিল। সে বছর স্কুল থেকে ওদের সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। মা আবেগে আপ্লুত হয়ে মাথা উঁচু করে বলেছিলেন, একদিন আমার মাইয়্যা ডাক্তার অইব। গাঁওয়ের মাইনষের সেবা করব। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান বাবা, কপাল কুঁচকে, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, মাইয়া মাইনষের বেশি ফালানি বালা না। বেশি বেশি বাইড় না। বান্ধা গরু ছাড়া পড়লে অনাথ অইয়া যাইব। পরবর্তীতে জয়নবের আকুতি জেদে তাকে কলেজে ভর্তি করাতে বাধ্য হন বাবা। কিন্তু পুরুষ বাবার মনে ছিল অন্য উদ্দেশ্য; অথচ মেয়ে তখন ভবিষ্যতে ডাক্তার হবার স্বপ্নে বিভোর। একদিন মধ্য দুপুরে বাবার পছন্দের অচেনা এক পুরুষের হাত ধরে জয়নবের স্বপ্ন শেষপর্যন্ত বিলাতের ‘ডলস হাউস’ এ বন্দি হয়। বাড়ি ছেড়ে এ দেশে পাড়ি দেয়ার সেই পথহাঁটা পথ আজও জয়নবকে উদাসী স্মৃতিজাগানিয়া স্মৃতিতে আচ্ছন্ন করে রাখে। মেঠোপথ অতিক্রম করে, স্বামী নামক পুরুষটার হাত ধরে ভাঙারপুলটা সতর্কভাবে পার হয়ে, তারপর সদর রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে দূরপাল্লার বাসে চড়ে ওরা শহরে আসে। মুড়ির টিন বাস রাস্তায় থেমে থেমে যাত্রী নিচ্ছে, তারপর ঘটঘট করে চলা শুরু করছে। এরমধ্যে হেলপারের সজোরে বাসের গায়ে থাপ্পড় মারা মনে পড়তে আজ মনে হয়, ভাগ্য যেন বারবার জয়নবের গালেই চড় মারছিল, ও বুঝতে পারেনি। এত সরল জীবন কাটানো মেয়েটার পক্ষে বোঝার কি কোনো উপায় ছিল?
স্বামী নামক পুরুষটার সঙ্গে শহরে একটা বাড়িতে এসেছিল। সাদা এক বিশাল বাড়ি। বাড়ির কর্তা মধ্যবয়স্ক সাদা মানুষটাকে দেখে কেমন এক সমীহভাবে মনটা নতজানু হয়ে গিয়েছিল। ওদের দু’জনকে চকচকে কাপ-পিরিচে চা-নাস্তা খাইয়ে, তারপর দু’জনের টিপসই নিয়ে, সোনার হরিণ ‘সবুজ পাসপোর্ট’ আর একটা চিঠি ওর স্বামীর হাতে ধরিয়ে দেন। উনাকে সালাম করে বের হবার সময়, উনি মৃদু হেসে বলছিলেন, কোনো চিন্তা কোরো না, আমি সব ঠিকঠাক করে রেখেছি। আমার এই চিঠিটা দেখাবে। কাল রাতে তোমাদের লন্ডনের ফ্লাইট। লন্ডন নামটা শুনতেই জয়নবের দেহ-মনে কেমন যেন এক ভয় আর রোমাঞ্চ জেগে, পরক্ষণে শিহরন নাই হয়ে শুধু ভয়টা বুকের ভেতর জাপটে থাকে। এই ভয় আজ ওর জীবনের নিত্যসঙ্গী, শুধু চেহারা বদলে গেছে কিন্তু ভয় আরও নির্মমভাবে ওর শ্বাসনালি খামচে ধরে আছে!
ঐ সময় বিষাদাচ্ছন্ন বিমিশ্র একঝাঁক শঙ্কা কালো মেঘের মতো ওর সমস্ত অন্তরাত্মাকে জাপটে ধরেছিল। কেমন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। গায়ের মাটির সেই সোদা গন্ধ, বাতাসে মানুষের শরীরী সুবাস, মায়ের দেহের দুধমাখা সৌরভ, মোলায়েম স্পর্শ, বান্ধবীদের চঞ্চল ঘামার্ত হাতের কোমল বন্ধন, চুলের সুগন্ধী তেলের ঘ্রাণ আরও কত অনুভূতি সব, সব পেছনে ফেলে, দম বন্ধ করা কারেন্টের এক বাক্সে চড়ে এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করে স্বামী নামক মানুষটার পেছনে পেছনে শেষ না হওয়া পথ হেঁটে হেঁটে, মন খারাপ করা কুয়াশার এক দেশে। যেদিন ঘর ছেড়েছে, দেখেছে সবার চোখে জল আর হাসি একাকার হয়ে কিম্ভূতকিমাকার এক অবস্থা। জয়নব নিজেও কেমন হতভম্ব এক মন নিয়ে, কল দেওয়া মেশিনের মতো সব সামটে বাসে উঠেছিল।
এখনও নিঃসঙ্গ সময়ে শুনতে পায়, জোনাকি পোকার মতো অন্ধকারে আলোর পথিক হয়ে, কানের কাছে অবিরত গুনগুন সেই ছন্দ সম্মোহন, নাকি সুরের কান্না, দুঃখ-হাসিতে মাখামাখি স্বজনদের প্রিয় সব মুখ, মমতা মাখানো সাদাসিধে, অগোছালো সব কথাবার্তায় মায়াবী গুঞ্জন-
বিলাতে যাইতাছো, কী কপাল তোমার! আমরারে ভুইলো না কিন্তু। চিঠি-পত্তর দিও। মেমসাহেব গো ছবি পাঠাইও। তোমরার ছবিও দিও। আমরারে মনে রাখিও…।
দরজা বন্ধ হবার শব্দে জয়নবের সব স্মৃতি এক নিমিষে বিস্মৃতি হয়ে যায়। মূর্তিমান বাস্তব সামনে দাঁড়িয়ে। সাদা জোব্বায় সারা শরীরটা ঢেকে মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বরফের সন্ত্রাসে তটস্থ গোটা শহরটা। এই দিনগুলোতে লোকজন দরকারি কাজ ছাড়া ঘর-বাহির কম করে। অথচ লোকটার ভীমরতি যায় না। বরফ ভেঙে, ঠাণ্ডার সঙ্গে লড়ে, মসজিদে যেতেই হবে। জয়নব বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত, খোদার ঘর সর্বত্র, মসজিদে গিয়েই নামাজ পড়তেই হবে এমন কোনো কথা নেই। মানুষটার মুখে কোনো রা নেই, মসজিদে যাওয়ারও কোনো বার নেই। বরফের এই মরশুমে মানুষটা বাইরে গেলেই জয়নবের ভেতরটাতে ভয় ঘাপটি মেরে বসে থাকে। যদি কোনো অঘটন ঘটে! দেখভাল তো তাকেই করতে হবে। মনে মনে বলে, পুরুষ মানুষের জন্য স্ত্রী পরম ধন, যার আছে এই ধন! ঐদিন ওদের প্রতিবেশী, এক বয়স্ক ভদ্রলোক ব্ল্যাক আইসে স্লিপ কেটে কী ভয়ঙ্কর অবস্থায় না পড়েছিল! খবরটা তাৎক্ষণিক শুনে নিদারুণ বিরক্তি নিয়ে জয়নব ভাবছিল, কী কারণে যে এই বৈরী সময় বয়স্ক মানুষটা একাকী বের হয়েছিল?! পরে জেনেছে, ঘরে খাবার ছিল না, ভেবেছিল আশেপাশের অফ লাইসেন্সের শপ থেকে কিছু বাজার করে আনবে, কিন্তু শূন্য হাতে যেতে হয়েছে হাসপাতালে। ইশ! ভদ্রলোক কী অবস্থায় জানি আছেন? অথচ, উনার উপযুক্ত দুটি মেয়ে আছে ঘরে! তারা নিজেদের জীবন নিয়ে মহাব্যস্ত। ঘরে আসা-যাওয়ার ঠিক-ঠিকানা নেই। বাপের কোনো খবর নেয় না। জয়নব গ্রামে ফিরে যায়, ওদের পাশের ঘর মোয়াজ্জেম ভাই, বিয়ের পর বুড়ো মা-বাবাকে ফেলে আলাদা হয়ে যায়। বাপটা একরাতের কালো জ্বরে মরে গেল। আর মায়ের অবস্থা শেষ দেখে এসেছিল ‘ইন্দির ঠাকুরণ’ এর মতো। উফ্, কী দুর্দশাই না হয়েছিল বৃদ্ধ মা-বাবার! আহা, কে জানে মা এতদিন বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন? কে জানে?!
মা-বাবার কর্তব্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উপযুক্ত ছেলে বৌ নিয়ে পৃথক হয়ে গেল, অথচ জয়নব বিলেতের উপযুক্ত দুই মেয়ের কথা ভেবে বিতৃষ্ণায় জর্জরিত হচ্ছে!
আঠারো বছর বয়সটা এদেশের ছেলেমেয়েদের জন্য মুক্তির হাওয়া নিয়ে আসে। জয়নব মনে মনে আওরায় সুকান্তের ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতাটি। স্কুলে থাকতে কী চমৎকার আবৃত্তি করত সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনত! কিন্তু এদেশের আঠারো বছর বয়সের সঙ্গে সুকান্তের আঠারো বছর বয়স কত ব্যবধান! যেন দৃশ্যমান দুটো ব্রিজের মধ্যখানে অদৃশ্য এক ভাঙন, সতর্ক না হলেই এই মনুষ্য দেহটা ধসে পড়বে এক নিমিষে! হঠাৎ জয়নব আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে ওঠে। ভেতরটা ব্যথায়, শঙ্কায় হিম হয়ে যায়। দুটো মুখ স্পষ্ট হতে হতে কেমন ঝাপসা হয়ে বরফাচ্ছন্ন শহরের কোথায় কোথায় মিলিয়ে যায়, জয়নব হন্যে হয়ে খুঁজে, কাতর হয়ে ডাকে তাদের। কেউ কোথাও নেই! এ এক গজবি যন্ত্রণা ধরেও না, ছাড়েও না। অসহনীয় ব্যথায় বিকৃত দেহ-মন নিয়ে জয়নব এই বিদেশে বিভূঁইয়ে বসতি গড়ার দিনগুলোতে ফিরে যায়। ঐ অবয়বদ্বয়ের বর্তমান স্থলে জোর করে ঢুকিয়ে দেয় ওদের দু’জনের অতীত।
জয়নব এই শহরটা নাম দিয়েছে ‘আগন্তুক শহর’। যখন প্রথম এলো আশপাশটায় সব অপরিচিত, শহরটাই অজানা, অচেনা। বাসে ট্রেনে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। পারতপক্ষে মুখের দিকেও তাকায় না, এটা নাকি অভদ্রতা। জয়নব ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বিড় বিড় করে বলে, ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে ওরা যা করে বেড়ায়, ওটা কী তবে ভদ্রতা? প্রথম দিকে ওরা দুজনেই অনেক কষ্ট করেছে, আসলে এখনও ঐ কষ্টটাই করে যাচ্ছে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থায়ী দুশ্চিন্তা। আর দেখেও না দেখার ভান করা, বোবা হয়ে চোখ বন্ধ করে চলা।
তারা যখন প্রথম এলো, ঐ সময়টা সরকার বেকার ভাতা দিত। মানুষটার কথা হলো আমার হাত-পা আছে, ভিক্ষা কেন নেব? তাহলে তো দেশেই ভিক্ষা করে খেতে পারতাম। সেই সময়টাতে বাঙালি রেস্টুরেন্ট, টেইকওয়ের অভাব ছিল না। বাঙালিরা একচেটিয়া রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করছিল। মানুষটার কাজ জোগাড় করতে বেগ পেতে হলো না। কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে উঠতে খানিকটা সময় লাগল। মাঝে মাঝে এসে বলত এই থালা-বাসন ধোয়া, বয়গিরি করা ভালো লাগে না জয়নব। তারপর একদিন এসে নিজেই আবার বলল, এদেশে কাজের ক্ষেত্রে উঁচু-নিচু বলে কিছু নেই তবে আমার এত সংকোচ কেন রে বাবা? সেইদিন থেকে আর কোনোদিন কোনো অভিযোগ করেনি। ঠাণ্ডার দেশে আসার সময় মানুষটার বেড়ে ওঠা বয়সী সময়ের সঙ্গী পাজামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে স্যুট পরে প্লেনে চড়তে হয়েছিল। জয়নবও একসময় শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ ধরেছে। মানুষটার মতো প্যান্টও পড়া শুরু করল কামিজ আর বুট জুতার সঙ্গে। কারণ শাড়ির ভেতরে উলের পাজামা, মোজা আর বাইরে লম্বা কোট পরেও শীতের হুল ফোটানো আটকানো যেত না। দুটো মেয়ে একটা ছেলের জন্ম হয়েছে এ দেশেই। সন্তান জন্মের পরের দিনই ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন, হাঁটাচলা করো, দ্রুত সুস্থ হবে। আর ওর তো না ফিরে উপায় ছিল না। বাঙালি পুরুষ স্বামী, স্ত্রীর সঙ্গে গেরস্থালি সামলাতে তখনও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। সদ্য নাড়ি কাটার শারীরিক যন্ত্রণা, আর নাড়িছেঁড়া ধন-প্রাপ্তির অফুরন্ত স্বপ্ন সাথে করে ঘরে ফিরে জয়নব। সদ্যোজাত সন্তানকে বুকে চেপে যখন গাড়ির কাচ অতিক্রম করে অন্যমনস্ক মন এলোমেলো দৃষ্টি চারপাশে বোহেমিয়ান পথিকের মতো পথ পার হচ্ছিল, তখন জয়নবের মনে হয়েছিল, সদ্য পরিচিত শহরটা যেন বাচালের অনবরত কথার মতো ব্যস্ত অথচ শব্দহীন!
কী কষ্ট করেই না তিনটা বাচ্চাকে বড় করেছে! কিন্তু মানুষ হলো কই? ছোটবেলা বাবা তিনটা বাচ্চাকে নিজে কোরান শরিফ পড়ানো ধরিয়েছে, শেষে বাবাও সময় দিতে পারল না তারাও পড়ার অপেক্ষা না করেই ছেড়ে দিল। কখন যে ওরা বাংলা ভাষায় কথা বলা ত্যাগ করল মা-বাবা কেউ টের পায়নি। যখন বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল পিতৃপুরুষের, মাতৃভূমির সঙ্গে, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সন্তানদের সংযোগের সেতুটা নির্মাণ করে দেয়া, সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে দেশে আনতে পারেনি অর্থের অভাবে। কিন্তু দেশের মানুষ ভাবে বিলেতে গাছ থেকে টাকা ঝরে। একটা সময় ওরাও হলিডে-তে বিলেতে থেকে সরাসরি গ্রামে গিয়ে থাকতে চাইলো না। জোরাজুরি করে কাজ হলো না। মা-বাবাও আর গেল না, হাল ছেড়ে দিল। বাস্তবতার কাছে জীবনের অনেক অনিবার্য দাবি ক্রমশ মার খেতে লাগল। শেষ মারটা যেন এসে পড়ল মা-বাবার দায়িত্ববোধের উপর।
মা-বাবা মাঝে মাঝে গ্রামের কথা বলতেন। দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা, খালা, ফুফুদের, গাঁয়ের মানুষের গল্প বলতেন, বাচ্চারা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনত। হয়তো তাদের কাছে রূপকথার কাহিনির মতো রোমাঞ্চকর মনে হতো! যে কল্প-গল্প কৌতূহল জাগায় কিন্তু ভেতরে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কাঁচা মাটির পিচ্ছিল মেঠোপথ তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত নয় বরং এই পিচঢালা পথেই তারা অভ্যস্ত। তাই ভিটেমাটির কাহিনি গাল-গল্পেই আবদ্ধ রইল, পাখা আর মেলল না। তারপর ব্যস্ততার ভিড়ে মা-বাবা পূর্বপুরুষদের কথা বলা ছেড়ে দিল, ওরাও ভুলে গেল। একেবারে সব ভুলে গেল! মা-বাবা কী তবে মনে মনে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন? এই নিঃসঙ্গ শীতল দুপুরে একেলা জয়নবের মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হয়ে প্রশ্ন খোঁচাতে থাকে, ভাঙারপুলটা কেন কিছুতেই জোড়া লাগল না? ও তো স্বামীর হাতটা ধরে সাবধানেই পার হয়েছিল। তারপর একসঙ্গে দু’জন লন্ডন ব্রিজে হাঁটতেও অভ্যস্ত হয়ে গেল। ওদের কী চেষ্টা কম ছিল? কে জানে? হয়তো চেষ্টায় ভুল ছিল? কে জানে কী ছিল? চমকে ওঠে জয়নব, বেঁচে থাকার জন্য পশ্চিমা বাতাসে তারা নিজেদের মিলিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু যে আলো-বাতাসে তার সন্তানদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, একটু একটু করে তাদের বোধের পৃথিবীর সৃষ্টি, সেখানে কী মা-বাবা হিসাবে তারা নিজেদের পৃথিবীকে মেলানোর চেষ্টা করেছিল? না, করেনি। কেবল বিচিত্র শঙ্কা, কৌতূহল নিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরেছিল কী এক জুজুর ভয়ে খোলা মন নিয়ে প্রসারিত দৃষ্টি দিয়ে দেখারও চেষ্টা করেনি! বোঝারও চেষ্টা করেননি! শুধু বার বার অস্বীকার করতে চাচ্ছে তাদের জন্মগত পৃথিবীর জীবনবাস্তবতাকে। এ দায় কার মা-বাবার? সন্তানের নাকি সমাজের?
মেজো মেয়েটা বরাবরই ঘাড়তেড়া। যেটা জেদ করে সেটাই হওয়া চাই। কাউন্সিলিং করালে সাইকোলজিস্ট বললেন ওকে মানসিক চাপ দেবেন না, মেয়েকে হারাবেন। জয়নব ভাবে এই বয়সে মা-বাবা-বড়ভাই, ওদেরকে কত শাসন করেছে, মারও খেয়েছে কত! কিন্তু ওরা তো তাদের ছেড়ে কোথাও যায়নি। তবে এদের কী সমস্যা? এরা আসলে কীসের স্বাধীনতা চায়?
একদিন মেজোটার বাপের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে বাবা ওকে একটা চড় মেরেছিল। হাত নামানোর আগেই পুলিশ এসে হাজির। মেয়েটাকে ফস্টার হলে নিয়ে গেল। সেদিন মায়ের সে কী কান্না! মানুষ মরে গেলেও মানুষ এমন করে কাঁদে না! কিন্তু বাপ যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটা ফস্টার হল থেকে আর ঘরে ফিরেনি, নতুন ঠিকানায় গেছে। এখন তার বয়স আঠারো। মা নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে আত্মজার নাম রেখেছিল, ‘জয়তুন’। মেয়ে গুগলে সার্চ করে দেখেছে ‘জয়তুন’ একটি বেহেশতি ফলের নাম। মানুষের নাম কেন আবার ফলের নামে হবে? সে নাম পাল্টিয়ে রেখেছে ‘জয়া’। সেখানে ঘটা করে জন্মদিন পালন করে, ওদের জন্য কেক নিয়ে এসেছিল। মা মেয়ের খুব কাছে দাঁড়িয়েও জড়িয়ে ধরতে পারে না। কেমন এক তীব্র যন্ত্রণা, অস্বস্তি ওকে কাবু করে ফেলেছিল। ছোটোটা বোনকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। মেজোটা যেন আরোপিত প্রগলভ হয়ে একা একা অনেক কথায় মুখর থেকে, তারপর গুডনাইট বলে বের হয়ে গেল। মেয়ে যতক্ষণ ঘরে ছিল, বাবা ঘরে ফেরেননি। একটা সময় জয়নবের ভেতরটাও কেমন নির্লিপ্ত বিষাদে অসহায়ত্বে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। জয়নব ঘরের কাজে বিশৃঙ্খলভাবে ডুবে গেল।
সন্তানদের কাছ থেকে মা-বাবা হবার শাস্তি পাবার পর জয়নব জেনেছে এখানে ‘এডাল্ট’ শব্দটা বড্ড দামি। ছেলেমেয়েদের জন্য গুপ্তধন পাবার মতো। দেশে ছোটবেলা জাঁকজমক করে জন্মদিন পালন করা হয় আর এখানে আঠারো বছর বয়সটা। মেজো মেয়েটা নতুন ঠিকানায় যাবার পর নাইজেরিয়ান এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে ছাড়াই একসঙ্গে থাকে। শুনেছে একটা বাচ্চাও নাকি হয়েছে। বাপের সামনে মেয়ের নাম উচ্চারণ করলে, মানুষটা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যান। জয়নব ভয়ে চুপ থাকে। সব কথা, বাক্সবন্দি করে বুকে চেপে রাখে। কষ্ট হয় তবুও কাউকে বলে না। কাকে বলবে? যাকে বলবে সেই-ই সামনে উহ্ আঃ করবে আর পেছনে গসিপ করার উপকরণ পাওয়াতে পুলকিত হবে।
ছোট মেয়েটা মা-বাবার মন রাখতেই যে হিজাব পড়ত, জয়নব অনেক আগেই টের পেয়েছে। কারণ হিজাবের সঙ্গে পোশাকের কোনো মিল নেই। এদেশে ছেলেমেয়েদের জন্ম দেয়া যায় কিন্তু কিছু বলা যায় না। আওয়াজ করলেই বিকট শব্দে ট্রিপল ওয়ান বেজে ওঠে। আজ এক সপ্তাহ ধরে মেয়ে স্কুলে যায় না। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। স্কুল থেকে চিঠি এসেছে, কর্তৃপক্ষ পেরেন্টসদেরকে ডেকেছে, জয়নবকে একাই এই ঝামেলা সামাল দিতে হয়, বরাবরই দিচ্ছে। মেয়ে স্কুলে বুলিংয়ের শিকার। একদল ছেলেমেয়ে স্কুলে ওকে ব্রাউন এশিয়ান বলে কটাক্ষ করে। ও সহ্য করেছে কিন্তু একদিন ওর হিজাব টান দিয়ে খুলে ফেললে, এরপর থেকে সে স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সমস্যার সমাধান হলেও বাসায় এসে মাকে বলেছে, সে পড়াশোনা করবে না। স্কুল থেকে তাকে কাউন্সিলিং করা হয়েছে। সাইকোলোজিস্ট ঐ একই কথা বললেন, ওর মনের উপর চাপ দিবেন না। ওর চিন্তার স্বাধীনতাকে, ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিন। তা না হলে হিতে বিপরীত হবে। মেয়েদের নিয়ে যখন জয়নব দিশাহারা তখন ছেলেটা যেন লন্ডন ব্রিজের মূল্যবোধ আঁকড়ে ভাঙারপুলের অবশিষ্টাংশ হয়ে মা-বাবার মধ্যখানে ঝুলে আছে। বাবা যে রেস্টুরেন্টে কাজ ধরেছিল, এত বছর ধরে সেখানেই আছেন। মানুষটা এখন কোনো পরিস্থিতিই মানতে রাজি নন। উট যেমন বালুর মধ্যে মুখ গুঁজে ভাবে, আমাকে কেউ দেখছে না, মানুষটারও তেমনি অবস্থা। মেয়েদের বাস্তবতা সে মানতে রাজি নন, স্রেফে এড়িয়ে নিজের মতো বেঁচে আছেন, কাজ, মসজিদ আর চারটা খাওয়া, ঘুম এই তার জীবন। এতটা বছরে তাদের নিজস্ব এক সোসাইটিও তৈরি হয়েছে কিন্তু মানুষটা সবকিছু থেকে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিয়েছেন। ভাঙার পুলের সেই নিরুপায় জয়নব, লন্ডন ব্রিজের কোনাটা ধরে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে এখনও ঝুলে আছে।
ঐদিন কাজ শেষে ফেরার পথে ছোট মেয়েটাকে দেখে চমকে ওঠে জয়নব। মা প্রথমে জোর করে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন এটা তার মেয়ে না। চোখের দেখার ভুল। মন ভুল করতে পারে, ভুল ভাবতে পারে কিন্তু চোখ তো আর ভুল করে না! লম্বা চুলওয়ালা, সারা শরীরে উল্কি আঁকা, সেন্ডো গেঞ্জি পরা ইংরেজ এক ছেলের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে মেয়েটা। ছেলেটা জয়নবের মেয়েটার অপুষ্ট ছোট্ট কোমরটা সাপের মতন পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে। ভয়ে হতবিহ্বল মা ভাবেন, উফ্ আমার মেয়ের দেহে কী তবে সাপের বিষ ছড়িয়ে গেছে! মেয়েটার নিকষ কালো চুলগুলোতে লালচে রঙ ধরেছে। বসন্ত ঋতুতে পাতা ঝরার মতো ওর মেয়েটার হিজাবহীন মাথার চুলগুলোও যেন ঝরে পড়ছে! ইংরেজ ছেলেটার গায়ের রঙের মতো মা যেন দেখছে মেয়েটার চুলহীন সাদা মাথা, কী এক ভয় ব্যথায় কাতর হয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকে, স্বামীর মতো সেও উট হয়ে বালুতে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। খোদা, দোহাই তোমার! এ বিশ্ব সংসারের কেউ যেন আমাকে না দেখে! ঘর থেকে জীবন থেকে পালানো এক উদ্ভ্রান্ত নারী যেন সে, নিরুপায় হয়ে পাগলের মতো ঘরে ফিরে কাঁধের সব বোঝা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে, সজোরে দরোজাটা বন্ধ করে দেয়। না, ওকে যেন কেউ আর না দ্যাখে, ও কাউকে দেখতে চায় না, কাউকে না! একদম না! জয়নবের সারাটা দেহ-মন কী এক ভয় আর যন্ত্রণায় থর থর করে কাঁপছে। একটা সময় সব ভয়, সব যন্ত্রণা নির্মম বিতৃষ্ণায় ওকে মূক করে দেয়। মুখের ভাষাকে মনের ভাষা কঠিনভাবে গলা টিপে ধরেছে। অদ্ভুত তিক্ততায় নেশাগ্রস্তের মতো বুঁদ হয়ে জয়নব মানুষটার কথা ভাবতেই অস্থির হয়ে ওঠে। না না ওকে আর কোনো কষ্ট কিছুতেই দেয়া যাবে না। কিছুতেই কিছু জানানো যাবে না, ওর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। এই শরীর নিয়ে রোজ কাজ করতে যায় মানুষটা, এসব জানলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। মানুষটা জায়গায় মরে যাবে। কিন্তু কতদিন লুকিয়ে রাখবে? এদেশে ডাক্তার দেখানো বিড়ম্বনার কথা মনে হলে শরীর শিউরে ওঠে।
বাইরে বসন্তের বাজারে পুষ্পের নিলাম উঠেছে; আর জয়নবের হৃৎপিণ্ডে সব হারানোর মাতম! দলে দলে নারী-পুরুষ স্বল্প বাসনা হয়ে রোদে শরীর তাতাচ্ছে। বরফের দেশে নাকি ভিটামিন ‘ডি’ এর ঘাটতি তাই এত আয়োজন। জয়নব গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। তবে কী মা-বাবা হিসাবে ওদের কোনো ঘাটতি ছিল? বিপর্যস্ত মা ভাবেন, তবে কী সন্তানদের দেহে ভিটামিনের ঘাটতি হতে দিয়েছিলেন? না তো, দেননি তো! ওর তো মনে পড়ে না, কোনো বড় অসুখ কখনও ওদের হয়েছিল? কই না তো, হয়নি তো! তাহলে এ কোন গভীর অসুখে আজ এরা সংক্রামিত হলো? কীভাবে? অসহনীয় বেদনা স্থিত হলে, বিষণ্ন জয়নব বিড় বিড় করে আত্মকথনে ডুবে যায়, ভাঙারপুল আর লন্ডন ব্রিজের মধ্যখানের দূরত্ব আমরা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে নিয়েছি ঠিকই কিন্তু একচক্ষু হরিণের দৃষ্টি নিয়ে ওদের জন্মগত জগতটাকে দেখছি বারবার। কিছুতেই কিছুই প্রসারিত করতে পারছি না, পারি নাই। হাত বাড়িয়ে ধরব কেমন করে? মিলিয়ে নেয়া তো দূরের কথা! জয়নব স্বচ্ছ কাচ ভেদ করে দৃষ্টি শূন্যে ঝুলিয়ে রাখে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে, শরীর নিথর হয়ে গেছে কিন্তু মনটা তো মরছে না। কেন মরছে না? ওর শ্বাস চেপে ধরছে বারবার কিন্তু মারছে না, মরতেও দিচ্ছে না।
বসন্তকালে হঠাৎ রাতের অন্ধকারকে ছাপিয়ে সুচের ফোটার মতো তীক্ষ্ণ তুষার বর্ষণে বাহিরটা সাদা হয়ে আছে। চারপাশ কবরের মতো নিস্তব্ধ। এই নিঃশব্দতা এ দেশে নতুন কিছু না। মানুষের যাপিত জীবনের সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক এই নীরবতার। কিন্তু এ স্তব্ধতা আজ অশরীরী আততায়ীর মতো জয়নবের চারপাশটা ত্রাস হয়ে গ্রাস করে রেখেছে! কারণ মেয়েটা এই প্রথম আজ রাতে ঘরে ফেরেনি। মা আজই প্রথম আত্মজাকে নতুন রূপে আবিষ্কার করেছেন। জয়নবের জীবনে খুব দ্রুত অনেক নতুন নতুন অঘটন ঘটে যাচ্ছে। ও কোনো কিছুই নিজের কাছে রাখতে পারছে না। এ সংসার, সন্তান, স্বামী এ জীবন অ্যামিবার মতো এবড়ো-থেবড়োভাবে, অবাধ্যভাবে হাতের আঙ্গুলের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে গলে, ঝুলে, ছিটকে পড়ে যাচ্ছে! ও কী তবে হাল ছেড়ে দিচ্ছে? ও আসলে জানে না কী ধরছে? কী ছাড়ছে?
মানুষটা এশার নামাজ পড়ে ঘরে ফিরেছে। খাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলল, খিদে নেই। মেয়ের ঘরে না ফেরা নিয়ে জয়নবের বিস্ময় কেটে, ভয় জাপটে ধরে। উদ্ভ্রান্ত মন নিয়ে চমকে ওঠে সে, যখন দেখে এ ভয় আত্মজার জন্য নয় বরং স্বামীর জন্য। এই বিশ্ব সংসারে স্বামী-স্ত্রী ওরা দু’জন, দু’জনকে আঁকড়ে বেঁচে আছে। ভাঙারপুলের যে জায়গাটা সতর্কভাবে পার হয়ে ভেবেছিল পথ হাঁটা শুরু করেছে আসলে সেই পথ হাঁটা ওরা শুরুই করেনি! বাধাহীন চোখের জলে পালকের অস্বস্তিকর বালিশ ভিজে একাকার, জয়নব মোছে না। শুধু মানুষটার পাশে মরার মত কাঠ হয়ে পড়ে থাকে। যেন তার নিঃশ্বাসের শব্দেও মানুষটা জেগে না ওঠে।
পরস্পরের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে থাকা মা-বাবা নিজেরাও জানেন না তারা কি ঘুমিয়ে আছেন নাকি জেগে? নির্ঘুম ঘুমন্ত দেহমন নিয়ে মা-বাবা স্বপ্ন দেখেন, ভাঙারপুলে ফেরার জন্য তারা পথে বের হয়েছেন, কিন্তু ঐ মুহূর্তেই সেই চরম দুঃসংবাদ এলো, লন্ডন ব্রিজ ভেঙে পড়েছে!
প্রশ্নোত্তর
শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?
নিলুফা আক্তার: গল্প লেখার ব্যাপারে আমার তাড়নার জায়গা ‘রক্ত, মাংস, হাড়, মেদ, মজ্জা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, লোভ, কাম, হিংসাসমেত গোটা মানুষ’। মানুষ আমি মানুষের ভেতরের মানুষটাকে হন্যে হয়ে খুঁজি, তারপর লেখক আমি গল্পের দেহে তার অবয়বটা জুড়ে দেই। আমার তাড়না, মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু তাই মানুষ। লেখক আমার কাছে মানুষের সব রূপই পরম আরাধ্য চরম ঔৎসুক্য জাগানো এক অনুভব, উপলব্ধি অভিজ্ঞতার তীর্থস্থান।
প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা তাকে কর্মপথ ও পন্থার দিকে ধাবিত করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমার জন্মগত সহজাত প্রবণতা ছিল খোলা মন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং সংবেদনশীল বোধ নিয়ে চারপাশটা দেখা। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেহেতু সৃষ্টিশীলতার আকর, ওটা আমার ভেতরে আগে থেকেই প্রোথিত ছিল, চারপাশের ঘটনা কেবল কোনো ক্ষেত্রে আপনার কলম জেগে উঠবে? ঐ জায়গাটা উসকে দেয়। তাই কবিতা, গল্প, উপন্যাস সবই আমার কলমে উঠে আসে। ঘটনা, উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা যাই-ই বলি না কেন, তা কতটা তীক্ষ্ণভাবে আমাকে আলোড়িত করেছে, খোঁচা দিয়েছে, কতটা গভীর ও তীব্রভাবে আমি একে আত্মস্থ করেছি তার উপর নির্ভর করে এই শিল্প- গল্প, কবিতা না উপন্যাস হয়ে উঠবে। তবে অঘটন-ঘটনের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক অনুভূতি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে ধরে রাখার জন্য নিঃসন্দেহে গল্প জনপ্রিয় ও শক্তিশালী মাধ্যম।
শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?
নিলুফা আক্তার: লেখক হিসাবে আমার উপলব্ধি হলো, লেখকগণ কোনো না কোনোভাবে শিকারি, তাঁদের ভাবনার জগৎই তাঁকে নিজেরই অজান্তে-জানতে শিকারি করে তোলে। বিষয়টিকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখি। সুতরাং ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতার চেয়ে এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো, লেখক তার দেখা-অদেখা, জানা-অজানা, শোনা না শোনার এই বিচিত্র পৃথিবীকে কতটুকু অনুভব, অনুধাবন, গ্রহণ, নির্মাণ, বিনির্মাণ করতে পেরেছেন। ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতাও একেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যখন অভিজ্ঞতালব্ধ কোনো বিষয় বা ঘটনা আপনার চেতনাকে নাড়িযে দিয়ে যাবে। শুদ্ধস্বর এ প্রকাশিত এই গল্পটি সেই অভিজ্ঞতার বিনির্মাণ বলতে পারেন।
শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।
নিলুফা আক্তার: অবশ্যই রয়েছে। রাজনৈতিক বাস্তবতা ব্যক্তি এবং সৃষ্টি উভয়ের উপর কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলবেই। একজন শ্রমিক যখন নুন আনতে পান্তা ফুরালে বাজারদর এবং নিজের জীবন নিয়ে কথা বলেন। তখন আসলে মাঠপর্যায়ে সবচেয়ে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি তিনিই চিহ্নিত হন। সুতরাং একজন সাধারণ ব্যক্তিও কিন্তু গোচরে-অগোচরে তার সমকালকে এড়াতে পারে না। আর লেখক তো সৃষ্টি তথা মানুষ-জীবনের কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু লেখকও একজন ব্যক্তি, সাংসারিক, সামাজিক মানুষ। তাই সমকাল বা যেকোনো কালের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে সে কলম ধরবে কি না এটা তার একান্ত নিজস্ব বিষয়। সামাজিক মানুষ হিসাবে সাধারণ ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করতে না পারলে, তাঁর লেখক সত্তা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়; তেমনি সমকালের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে শব্দে মূর্ত করা তার জন্য অনেকটা আরোপিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর শিল্প প্রতিভার গুণে সেই লেখনীতে স্বচ্ছতা আসতে পারে, কিন্তু স্পষ্টতা নয়। সৃষ্টিটা তখন লুকোচুরির পর্যায়ে পড়ে যায়। কারণ স্পষ্টতার সঙ্গে সততা ও সাহস সরাসরি সম্পৃক্ত। আসলে সততা, সাহস, দায়বদ্ধতা এই শব্দগুলো পরস্পরের পরিপূরক। যেমন ধরুন, শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসটির কথা বলব, তাঁর কলমের সততা, সাহস, স্পষ্টতা, দায়বদ্ধতা পাঠক আমি নির্মমভাবে উপলব্ধি করি। যদিও মুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে অনিবার্য অধ্যায় হয়ে বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বের লেখকের কলমে মূর্ত হয়ে আছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও হয়েছে, হচ্ছে, পাঠক নানাভাবে মূল্যায়নও করছে ।
শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
নিলুফা আক্তার: একটি গল্পকে আনা কঠিন। কারণ ভালোলাগা, ভালোবাসায়, উপলব্ধিতে, অভিজ্ঞতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকার তালিকায় অনেক গল্প আছে। তবুও প্রশ্নের চাহিদাকে মাথায় রেখে, দুটি গল্পের দেহে কীভাবে একটি গল্প প্রাণ হয়ে জেগে আছে, তেমন একটি কাহিনির কথা বলছি। মানুষ এই একই শিরোনামে বনফুল এবং হুমায়ুন আজাদ দু’জনেই গল্প লিখেছেন, রক্ত-মাংস-মেদ-মজ্জার ‘মানুষ’ অস্তিত্বের অদ্ভুত মেলবন্ধনে সৃষ্টি এই দুটি গল্প। কিন্তু অনায়াসে গল্প দুটিকে একটি গল্পের নির্যাস হিসাবে গ্রহণ করা যায়।
বনফুলের গল্পের মূলে বলেছেন, ‘এত বড় অবিচারে এতটুকু বিচলিত হইলাম না। উপরন্তু খুশি হইলাম।’
হুমায়ুন আজাদ শেষ টেনেছেন এই বলে, ‘মানুষ তো’।
দু’জন গল্পকারের গল্প লেখার স্টাইল পৃথক এবং সময়ের ব্যবধান প্রায় দুই যুগ অথচ ভাবনায়, অভিজ্ঞতায় মানুষের চেহারা কিন্তু একই আছে, এতটুকু বদলায়নি। কী নির্মম! কী কঠিন সত্য! কী নির্মোহ করে সৃজন ও উপস্থাপন! এই গল্পদ্বয় আমাকে বারবার মানুষের প্রকৃতি ও প্রতিকৃতি অন্বেষণে তাড়িত করে।
শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
নিলুফা আক্তার: আমার গল্পের স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা হলো, আঙ্গিক, ভাষা, ব্যাকরণগত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়াস তার একদম স্বভাবজাত। এই স্বপ্রণোদিত অভ্যাসকে গল্পকার আমি সচেতনভাবে প্রয়োগের চেষ্টা করি। আর হ্যাঁ, কাঠামো ভাঙা-গড়া, একদম নিজস্ব ফর্ম নির্মাণ, ব্যাকরণের সনাতন রীতি ভেঙে দেয়া এই বিষয়গুলো আমার কাছে যেমন ধরুন কৌতূহলোদ্দীপক, আনন্দগ্রাহী; ঠিক তেমনি ভীষণ চ্যালেঞ্জিংও বটে। এই দুঃসাহসিক কাজটি আমি করেছিলাম আমার প্রথম উপন্যাস অতলান্ত খোঁজ -এ। তিনশত চৌদ্দ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি প্রথম আমি লিখি নানা চরিত্রের নানা নামের সমাহারে। তারপর হঠাৎ একদিন ভাবলাম, আচ্ছা দেখি তো, সবগুলো চরিত্রের নাম, স্থান এসব মুছে দেই, দেখি না কী হয়?
ব্যাকরণের শাশ্বত স্ট্রাকচার পরিবর্তন ও নব-রূপায়ন নিয়েও অনেক কাজ করেছি উপন্যাসটাতে। দ্বিতীয় উপন্যাস খণ্ডিত জীবন এবং তাহাদের কথা এ-ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি। পাঠক, সমালোচকগণের পাঠানুভূতি, পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় আমার ধারণা চ্যালেঞ্জিংয়ে আমি পরাজিত হইনি।
শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?
নিলুফা আক্তার: গল্প এখন আর সনাতন কাঠামোতে বন্দি নেই। এই নিয়মের বেড়ি অবমুক্ত করে গল্প নিয়ে খেলার শক্তিমান কারিগরদের অন্যতম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। তিনি অজান্তে, সমাধান গল্পের পাশাপাশি সৃষ্টি করেছেন অর্জুনমণ্ডল, গণেশ জননী’র মতো গল্প আবার নির্মাণ করেছেন বাংলা সাহিত্যের গল্পের বাঁকবদলের গল্প নিমগাছ। পথের পাঁচালীর মতো নিমগাছ একবারই সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথের শাস্তি, স্ত্রীর পত্র, ইত্যাদিসহ ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্ত, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, কল্লোল লেখকগোষ্ঠী, পরবর্তীকালের হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, শহীদুল জহির, আহমদ বশির, নাসরীন জাহান প্রমুখেরও নির্মাণের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে অনন্যতায় একক হিসাবে উল্লেখ করার মতো অনেক গল্প আছে। একদম ছোট প্রশ্নের এতবড় প্রাক-বয়ানের কারণ হচ্ছে, একজন পাঠক, সমালোচক গল্পকার হিসাবে সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান অন্বেষণ। আমার কাছে অন্যতম মূল উপাদান হলো, রস এবং কাহিনি বা বিষয় উপস্থাপন কৌশল। নানা রস-এর যথোপযুক্ত প্রয়োগ পাঠকের চিত্তকে বিচিত্র অনুভবের স্রোতে ভাসিয়ে রাখে। কাহিনি, ভাষা বিন্যাস, আঙ্গিক তথা গোটা গল্পের শরীরেই এক বা একাধিক ‘রস’ লীন হয়ে থাকে। বিষয়কে ঋদ্ধ-সিদ্ধ করতে এই রস নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করে। আর উপস্থাপনের কৌশল বা পরিবেশন রীতির চমৎকারিত্বের উপর নির্ভর করবে, গল্পটা পাঠকের চৈতন্যে কতটা নাড়া দিবে, পাঠকের মনের দরজা কতটা খুলবে আর মননে আদৌ স্থায়ী হবে কি হবে না! যেমন শাস্তি গল্পের ’চন্দরা কহিল, মরণ!’ অথবা চোর গল্পের ’জগতে চোর নয় কে? সবাই চুরি করে!’, কিংবা আত্মজা ও একটি করবী গাছ এর ’এ্যাহন তুমি কাঁদিতেছ? এ্যাহন তুমি কাঁদিতেছ? এ্যাহন কাঁদিতেছ তুমি?’ নানাভাবে পাঠক আমাকে ভাবায়!
শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
নিলুফা আক্তার: রাজনীতি শব্দটার প্রথম বীজ রোপিত থাকে পরিবারে, তারপর সমাজ হয়ে রাষ্ট্রে পৌঁছায়। সুতরাং লেখক যেহেতু পরিবার সমাজের বাইরের কেউ নন, সেহেতু এই বোধ নিয়ে তো তিনি বেড়েই ওঠেন। যেমন শিশুরা ভাগ হয়ে যায় লিঙ্গান্তরে। একজন মেয়ে শিশুর হাতে পুতুল আর ঘরকন্নার সরঞ্জাম খেলনা হিসাবে ধরিয়ে দিয়ে আসলে চার দেয়ালের প্রকোষ্ঠের অভ্যাস আর গুরুত্ব তার মন মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের একরাত্রি গল্পে শিশু ’সুরবালা’ চরিত্রের মাধ্যমে কী অসাধারণভাবে এই রাজনীতির ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে আছে!
অন্যদিকে ছেলে শিশুর হাতে তুলে দেয়া হয় গাড়ি, ফুটবল, খেলনা পিস্তল ইত্যাদি। এটি হয়ে ওঠে তার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার, বীরত্ব প্রদর্শন এবং মুক্তির প্রাথমিক পাঠ। এভাবে সমাজের সূক্ষ্ণ রাজনীতি লিঙ্গান্তরে বিভক্ত করে নারী আর পুরুষ নামক শ্রেণি তৈরি করে। একজন লেখকও নারীশিশু বা পুরুষশিশু থেকে নারী বা পুরুষ হয়ে উঠেছেন। সুতরাং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে রাজনীতি সচেতন হওয়া একজন ব্যক্তি তথা লেখকের জন্য আবশ্যক। নিজ প্রেক্ষাপট থেকে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করার স্পষ্টতার উপর ব্যক্তি লেখক এবং মানুষ হিসাবে তার অবস্থান তৈরি হয়। সুতরাং লেখক মাত্রই রাজনৈতিকবোধ সম্পন্ন হওয়া এবং লেখায় তাঁর স্পষ্ট প্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ।
শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন!
নিলুফা আক্তার: এই মুহূর্তে আমি গল্পের পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করছি। স্বভাবে আমি ‘কচ্ছপ’ আমার কোনো তাড়া নেই, আবার আমি ’দলছুট’ মানুষও। গল্পের প্লটভাবনা, বিষয়, স্ট্রাকচার, ভাষারীতি নানা দিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নির্মিত গল্পের দেহ-আত্মা বিনির্মাণে নিমগ্ন আমি, পাঠকের সামনে নতুন কিছু পরিবেশনের প্রত্যয় ও প্রয়াস নিয়ে গল্পের পাণ্ডুলিপি মুদ্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি। একই সঙ্গে এই বছর একটি উপন্যাসের কাজ শুরুর প্রক্রিয়াতেও আছি। আমি উপন্যাসের শুরুটা নিয়ে ভাবি, শুরুটা শুরু করে রেখেছি, গল্পের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত হলে, উপন্যাসের পথ হাঁটা শুরু হবে। আগে থেকে কাহিনি, প্লট, ভাষারীতি ইত্যাদি নিয়ে আমি ভাবি না, আসলে আমাকে ভাবতে হয় না। যখন কলম ধরি, সে তার মতো চলতে থাকে। নানা কিছু নানাভাবে এসে একে-অন্যের পিঠে হুমড়ি খেয়ে যেন পড়তে থাকে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! মানুষ আমি যখন, লেখক আমার মুখোমুখি হই তখন মাঝে মাঝে খুব বিস্মিত হই। এই দুটি সত্তা যে একদম পৃথক স্পষ্টভাবে অনুভব করি। মানুষের জাগতিক-আধ্যাত্বিক জীবনকে অতিক্রম করে কিংবা বলা যায় বাইরে লেখকের যে নিজস্ব জগত আছে, যে জগতে সে একক অধীশ্বর এই বোধটুকু আমি ভীষণ অনুভব করি এবং উপভোগও করি বটে।