অনুবাদকের ভূমিকা: প্রখ্যাত সাবলটার্নিস্ট ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী আমাদের কাছে খুবই পরিচিত এক নাম। বিশেষত তাঁর ‘প্রভিন্সিয়ালাইজিং ইউরোপ’ দুনিয়াজুড়ে বহুল পঠিত ও আলোচিত গ্রন্থ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে লরেন্স এ কিম্পটন ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর। ২০১৪ সালে তিনি লাভ করেন টয়েনবি পুরষ্কার।
২০১৫ সালে যদুনাথ সরকারকে নিয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘দ্যা কলিং অফ হিস্টরি: স্যার যদুনাথ সরকার এন্ড হিজ এম্পায়ার অফ ট্রুথ’ নামক গ্রন্থ।
ভারতে ইতিহাসচর্চার অগ্রদূত যদুনাথ সরকার ১৮৭০ সালে বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ বলেছেন, যদুনাথ ‘সম্ভবত তাঁর প্রজন্মের সবচাইতে মহান ভারতীয় ইতিহাসবিদ’। ১৯২৬ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর যদুনাথ দুই বছরের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯২৯ সালে তিনি নাইট উপাধিতে ভূষিত হোন। এবং প্রথম ভারতীয় হিসাবে আমেরিকান হিস্টোরিক্যাল এসোসিয়েশনের সম্মানিত সদস্য হোন। যদুনাথ তাঁর জীবদ্দশায় বাঙলা ও ইংরেজিতে দুই হাতে লিখেছেন; তাঁর প্রকাশিত বই ও প্রবন্ধের সংখ্যা বিস্তর। আওরঙ্গজেব ও শিবাজিকে নিয়ে তাঁর রচনা এই দুই চরিত্র সম্পর্কে ভারতীয়দের বোঝাপড়া তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু পরবর্তীতে উত্তর-উপনিবেশিক ইতিহাসবিদদের কাছে তিনি অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। তাঁকে বরং ‘সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদ’ হিসাবে অনেকেই মনে রাখেন।
কিন্তু দীপেশ চক্রবর্তী যদুনাথের বায়োগ্রাফি রচনা করেননি। ইতিহাসের একটা বিশেষ সময়ে যদুনাথের সাথে মহারাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ গোবিন্দ সখারামের যে চিঠি চালাচালি হয়েছিল সেগুলোকে উপজীব্য করে দীপেশ যদুনাথের চিন্তাপদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন; এর মাধ্যমে আসলে তিনি ভারতীয় ইতিহাসের ‘ইতিহাস’ আলোচনা করেছেন। ‘History in India has been driven by identity’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছিল ২০১৬ সালে, স্ক্রল.ইন-এ। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন শোয়াইব দানিয়েল। সাক্ষাৎকারে দীপেশ তাঁর ‘দ্যা কলিং অফ হিস্টরি’ নিয়েই বাৎচিত করেছেন। কেনো তিনি এই সময়ে যদুনাথকে নিয়ে কাজ করতে গেলেন, যদুনাথের কোন দিকটা আসলে বর্তমানের জন্য প্রাসঙ্গিক- এসব নিয়েই আলোচনা করেছেন।
অনুবাদক: সহুল আহমদ
প্রশ্ন: আপনি কেনো এই বই লিখলেন? কী আপনাকে যদুনাথ সরকারের কাছে নিয়ে গেলো?
দীপেশ চক্রবর্তী: আসলে অনেকগুলো কারণ ছিল। তন্মধ্যে একটা কারণ ছিল আকস্মিক এক ঘটনা; যদুনাথ এবং মহারাষ্ট্রের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ গোবিন্দ সখারাম সরদেশাইর মধ্যকার চিঠিপত্রের কিছু অংশবিশেষ ঘটনাক্রমে আমার হাতে এসে পড়ে। ঐতিহাসিক গবেষণা, ঐতিহাসিক সত্যের অর্থ, ভালো ঐতিহাসিক উৎস কী, কোনটা ফার্স্ট-হ্যান্ড বিবরণী হবে, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ বনাম পুরনো সেকেন্ডারি বিবরণের যোগ্যতা, এবং ইতিহাসের সাথে পরিচয়ের, ইতিহাসের সাথে সত্যের সম্পর্ক- এইসবই ছিল চিঠিগুলোর বিষয়বস্তু। এবং চিঠিগুলো আমার কাছে চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছিল; চমকপ্রদ মনে হয়েছিল এই কারণে যে, ওঁনারা উপনিবেশিক শাসনের শেষ বেলাতে এসে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক করছেন, মানে ১৯০৪ সালে যখন তারা একত্রে কাজ করা শুরু করলেন তখন থেকে একেবারে ১৯৫৮ সালে যদুনাথের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
এবং আমার অন্যান্য কারণগুলো ছিল খুবই একাডেমিক। ইতিহাসবিদরা এই ব্যক্তিদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছেন। যদুনাথ একজন বিস্মৃত ব্যক্তি হয়ে গিয়েছেন, জ্ঞানজগতের অনেকেই তাকে সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদ মনে করেন। শিবাজী সংক্রান্ত ঐতিহাসিক বিবরণের জন্য মারাঠারা তাঁকে মুসলমানপন্থী বলে মনে করেন, অন্যদিকে মুসলমানরা তাকে হিন্দুপন্থী বলে মনে করেন। অবশ্য তিনি দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার মুসলমানদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন যাকে আমরা বর্তমানে সাম্প্রদায়িক বলে বিবেচনা করতে পারি।
সাম্প্রদায়িক মন্তব্যগুলো কী ছিল?
দী.চ: তিনি মনে করতেন, পূর্ব পাকিস্তান বাঙালি হিন্দুদেরকে হারিয়ে ভয়ানকভাবে পরাস্ত হবে, কারণ হিন্দুরা ছিলেন শিক্ষিত শ্রেণি। তারা তাদের প্রতিভাবান ‘ইহুদি’দের বের করে দিচ্ছে- অনেকটা এরকম আর কি। এবং এই যে অনুমান, পূর্ব বাংলার মুসলমানরা বাঙালি হিন্দুদের ছাড়া সফল হবেন না, এর মধ্য দিয়ে যদুনাথের পক্ষপাতিত্ব প্রকাশিত হয়। এটা সত্য যে, কিছু সময়ের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে ভালো শিক্ষক এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের ঘাটতির ফলে ভুগতে হয়েছিল, কিন্ত তারা ধীরে ধীরে এটা পূরণ করে ফেলেছিল। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি বাঙলা ভাগ দূর্ভাগ্যজনক ছিল, কিন্তু যখন হিন্দু মহাসভা ভাগের দাবি করছিল তখন যদুনাথ তাদের সাথে মিত্রতা করেন। এবং আপনাকে এও মনে রাখতে হবে, তাঁর ছেলে ১৯৪৬-৪৭ এর কলকাতা দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলেন; ধর্মতলায় ট্রাম থেকে নামার সময় এক মুসলমান ব্যক্তির ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে পরে হাসপাতালে মারা যান। ফলে তাঁর ক্ষেত্রে বাঙলার হিন্দু-মুসলমান সঙ্কটের একটা ব্যক্তিগত মাত্রাও ছিল।
আমি যে চিঠিপত্রগুলোর কথা উল্লেখ করছিলাম সেগুলো চিত্তাকর্ষক, এবং এগুলো যদুনাথকে একজন দুর্দান্ত চরিত্র হিসেবে হাজির করে। কিন্তু আমি যখন অতীতে ফিরে তাকাই এবং ভাবি যে, কোন জিনিসটা [ইন্টেলেকচুয়ালি] আমাকে এই প্রকল্পের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল, বর্তমানের পরিভাষায়, তাহলে তা হচ্ছে পরিচয় ও ইতিহাসের সম্পর্ক ঠাওর করার ক্ষেত্রে যদুনাথের ব্যর্থতা; মানুষ এমন একটা অতীত চাইতে পারে যার জন্য সে গর্ববোধ করতে পারে (বিশেষত দলিত বা অন্যান্যরা, যাদেরকে বলা হয়েছিল তারা তাদের অতীতের জন্য নিম্নতর বা অধস্থন ছিল)। এটা যদুনাথ বুঝতে পারেননি। অন্যদিকে, তিনি যার জন্য সংগ্রাম করেছিল সেটাও আজকের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতীত সম্পর্কে কোনটা ফ্যাকচুয়াল ট্রুথ সে বিষয়ে যৌক্তিক তর্ক-বিতর্কের পরিসরের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছিলেন। কারণ কখনো কখনো আমাদের পরিচয়কে মহিমান্বিত করে এমন ‘অতীত’ সন্ধানের কোলাহলে আমরা কেবল নন-ফ্যাকচুয়াল বা ফ্যকচুয়ালি মিথ্যে বক্তব্যই প্রদান করি না- যেমন হিন্দুরা বিমান আবিষ্কার করেছিল- পাশাপাশি এগুলোকে ফ্যাক্ট বলেও দাবি করি। যদুনাথ সরকার বুঝতে পেরেছিলেন যে, ফ্যাক্টস সর্বদা দেয়া থাকে না, এগুলোকে যুক্তির সাহায্যে বের করে নিয়ে আসতে হয়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই তথ্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন যুক্তি [লজিক], প্রমাণ ও সিদ্ধান্তের প্রয়োগ। এবং তিনি সেই পরিসরটার [স্পেস] জন্য লড়াই করেছিলেন। এবং আমি মনে করি তাঁর এই সিলসিলা স্মরণযোগ্য।
আপনি খুবই আকর্ষণীয় একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন: যদুনাথ ইতিহাস-রচনায় পরিচয়ের টানটা বুঝতে পারেননি। শিবাজীকে বীর হিসেবে ভূষিত করা হবে কিনা এই নিয়ে বহু মারাঠা ইতিহাসবিদের সাথে তার তীব্র বিতর্ক হয়েছিল, এমনকি ১৬ শতকের যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে নিয়েও বাংলার ইতিহাসবিদের সাথে [তাঁর] বিতর্ক হয়েছিল-যার কিনা মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি রয়েছে- এই আখ্যানের সাথে যদুনাথ দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। সেই লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি কি বর্তমানের ভারতেও আপনি দেখতে পান না?
দী.চ: ভারতে ইতিহাস-রচনা প্রধানত পরিচয়বাদী রাজনীতি দ্বারাই চালিত হয়েছে, তা নিচু বা উঁচু জাত বা হিন্দু বা মুসলমান যাই হোক না কেন। এবং যদুনাথও এর চাপ অনুভব করছিলেন। তিনি বুঝতে পারেননি যে, এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা হতে যাচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মাত্র একটা মুহূর্ত এসেছিল যখন ভারতের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ জাতীয় আর্কাইভের প্রথম ডিরেক্টর সুরেন্দ্রনাথ সেনকে একটি নির্দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের ইতিহাস লেখার জন্য বলেছিলেন। আজাদ সেনকে বলেছিলেন যে, এখন যেহেতু ব্রিটিশরা বিদায় নিয়েছে, ভারতও স্বাধীন হয়ে গিয়েছে, সেহেতু পক্ষপাতমূলক বা দলীয় চেতনা বশবর্তী হয়ে এই ইতিহাস লেখার আর জরুরত নেই। ভারতীয় বা জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির গ্রহণের দরকার নেই, তিনি নিরপেক্ষভাবেই লিখতে পারেন। কিন্ত মুহূর্তটা এক নিমিষেই উধাও হয়ে যায়।
কারণ আমাদের গণতন্ত্রের যে গতিপথ, ধরা যাক, ১৯৭০ এর পর থেকে বিভিন্ন প্রান্তিক গোষ্ঠী, নিম্ন বর্ণ ও অন্যান্য নিপীড়ত সম্প্রদায়ের নেতাদের হাতে প্রচুর রাজনৈতিক ক্ষমতা জমা হয়েছে। এটি আবারো পরিচয়ের সাথে অতীতের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নগুলোকে হাজির করেছে। যেমন মায়াবতীর রাজনীতি ও যে ধরণের ইতিহাস তিনি প্রচার করেছিলেন সে বিষয়ে বদ্রি নারায়নের কাজ দলিতদের দাবিকে দৃঢ় করেছিল। যেমন ঝালকারি বাঈ এর মতো ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে বলা হয় যে, ঝালকারি বাঈ ঝাঁসির রানীর চেয়েও বেশি লড়াই করেছিলেন। এমনকি কখনো কখনো তারা অনৈতিহাসিক চরিত্রের মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। যদুনাথ বুঝতে পারেননি যে এর একটা বৈধ দিক রয়েছে। কিন্ত এটা সমস্যাজনক হয়ে পড়ে তখনই যখন আপনি ‘কাঙ্ক্ষিত’ অতীতের এই বৈধ দাবিকে ইতিহাসবিদ্যার আলঙ্করিক চালচলন দিয়ে ন্যায়সঙ্গত [জাস্টিফাই] করতে চান। আমরা যখন “ঐতিহাসিক ফ্যাক্টস” হিসেবে দাবি করার ক্ষেত্রে এই সমস্ত বিকল্প অতীতকে আর্কাইভাল গবেষণার প্রমাণ-সাপেক্ষ করে তুলতে চাইবো, কেবল তখনই যদুনাথের সংগ্রাম আমাদের সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।
কিন্ত, অন্যদিকে যদুনাথ যা বুঝতে পারেননি তা হচ্ছে, বহুধরণের অতীত রয়েছে এবং লোকেদের অধিকার রয়েছে এমনসব অতীত নিয়ে কথা বলার যে অতীত ইতিহাসবিদদের অতীত নাও হতে পারে, বরঞ্চ এমন অতীত যা তাদের নিজেদের সম্পর্কে ইতিবাচক বোধ তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে তাদের যাদেরকে বলা হয়েছিল যে বর্তমান দুর্দশার জন্য তাদের অতীত দায়ী। যেমন উঁচুজাতেরা নিচু জাতদের বর্তমান অবস্থার ন্যায্যতা প্রদান করে এই বলে যে, নিচু জাতেরা পূর্বজন্মে পাপ করেছিলেন। এই চিন্তাটা একসময় দুনিয়াজুড়ে খুব চাউর ছিল, নিম্নবর্গের অতীতই তাদের বর্তমান দুরাবস্থার জন্য দায়ী। ব্রিটিশরা সবসময় দাবি করেছে যে, তারা ভারত শাসন করেছেন কারণ ভারতীয়রা দুর্বল এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত ছিল। এই অভিযোগের প্রতিক্রিয়াতেই অনেক জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমাণ করা যে, আমরা শক্তিশালী ছিলাম এবং বিভক্ত ছিলাম না। যদুনাথ এই প্রক্রিয়াকে গণতন্ত্রকরণের [democratisation] প্রক্রিয়া হিসেবে বুঝতে পারেননি। কিন্ত অন্যদিকে, যদি আপনার এমন একটা গণতন্ত্র থাকে যেখানে ফ্যাক্টস অথবা ফ্যক্ট-ভিত্তিক যুক্তিতর্কের জন্য সংগ্রাম অনুপস্থিত, সেখানে গণতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আপনার যৌক্তিক তর্কবিতর্কের পরিসরও থাকা দরকার। সুতরাং এই প্রশ্নে আমি স্যার যদুনাথের ইতিবাচক সিলসিলাটিকে দেখতে পাই।
আপনি বলছেন যে, ভারতে পরিচয়বাদী রাজনীতির একটা পুনরুত্থান ঘটেছে। তদপুরি, আপনার বহু সমালোচক বলছেন, একাডেমিয়ার ওপর হিন্দুত্বের চাপ এবং যদুনাথের ‘সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদ’ হিসাবে খ্যাতি থাকার কারণে আপনার বইটা সময়োপযোগী [মিসটাইমড] হয়নি। এর প্রতিক্রিয়ায় আপনি কী বলবেন?
দী.চ: আমি মনে করি হিন্দুত্ব নিজেদের নন-ফ্যাকচুয়াল হিসেবে হাজির করছে। ফলে আপনি যদি বলেন আমরা বিমান আবিষ্কার করেছি বা মহাভারতে অ্যাটম বোমা রয়েছে, সেটা নন-ফ্যাকচুয়াল। অমর্ত্য সেন ইতোমধ্যে এই দিকটা দেখিয়েছেন। হিন্দু মহিমার জন্য আপনি যা-ই দাবি করেন না কেন সেটাকে প্রমাণযোগ্য ফ্যাকচুয়াল দাবি হতে হবে, এবং এজন্যই যদুনাথ সরকার হাজির হচ্ছেন।
মহিমা দাবি করা কোনো একটি গোষ্ঠীর একচেটিয়া অধিকার নয়। উঁচু জাতের হিন্দুরাও এটা করতে পারেন। কিছু কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ‘দেখুন, দুনিয়া আমাকে পর্যাপ্ত সম্মান দিচ্ছে না’ বলাটা বৈধ হতে পারে। কারণ এটা উপলব্ধির বিষয়। আপনি চিন্তা করতেই পারেন যে, হিন্দুদেরকে দুর্বল হিসেবে দেখা হয়েছে, ফলে এখন তাদের শক্তিশালী অতীতের দিকে নজর দিতে হবে। কিন্ত আপনি যদি ইতিহাসবিদ্যার পদ্ধতি প্রয়োগ করে অতীত সম্পর্কিত ননফ্যাকচুয়াল দাবীকে ন্যায়সঙ্গত করতে চান, তাহলে আমি মনে করি একজন যদুনাথ সরকার এসকল হিন্দু দাবিকে ততটাই নাকচ করবেন [যেমনটা প্রতাপাদিত্যের ক্ষেত্রে করেছিলেন], ঠিক যতটা করবেন অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে আগত এমন ননফ্যাকচুয়াল দাবিকে।
সুতরাং আবারো বলছি, বৈচিত্র্য, পরিচয়, কোনো একটা নির্দিষ্ট অতীতের জরুরতের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে যদুনাথ তা বুঝতে পারেননি।কিন্ত আপনাকে মনে রাখতে হবে যে কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই এটা বৈশ্বিক উপলব্ধিতে পরিণত হয়, যখন কিনা যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর ইতিহাস, উত্তর আমেরিকা ও অন্যান্য স্থানে আদিবাসী ইতিহাস বিকাশ লাভ করেছিল।
ফলে যদুনাথ বুঝতে পারেননি যে তিনি যে মারাঠা ইতিহাসবিদদের সাথে লড়ছেন তারা আসলে আশু ভবিষ্যতের কিছু নমুনা উপস্থাপন করছিলেন। দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাক্টসের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। এমনকি যখন ১৯৮০’র দশকে আমাদের মতো পেশাদার ইতিহাসবিদরা তর্কবিতর্ক করছিলেন, মানে সাবলটার্ন স্টাডিজ বনাম ক্যামব্রিজ ইতিহাসপদ্ধতি বনাম জেএনইউ ইতিহাসপদ্ধতি (জেএনইউ ইতিহাসপদ্ধতিকে আমরা মার্ক্সবাদী-জাতীয়তাবাদী ইতিহাসপদ্ধতি বলতাম), তখনও তর্কটা ছিল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। আমরা কদাচিৎ ফ্যাক্ট প্রশ্নে তর্ক করেছি, হয় ফ্যক্টগুলো আর্কাইভে রেডিমেড ছিল, অথবা এগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হতো। যদুনাথ যে ধরনের প্রশ্নের প্রতি আগ্রহী ছিলেন সেটা পেশাদার ইতিহাসবিদরা প্রায় ভুলে গিয়েছেন। যদুনাথের মতে, আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতে পারেন যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার ফ্যাক্টগুলো সঠিক। এবং ফ্যাক্টগুলো কেবল অবধারিতভাবে দেয়া থাকবে না, সেগুলো আপনাকে গবেষণা করে বের করতে হবে। এবং মুঘল আমলের জন্য এগুলো ছিল আসল প্রশ্ন। কোথায় যুদ্ধটা সংঘটিত হয়েছে? কোন গ্রামে? একই নামে বহু গ্রাম ছিল। সেনারা কতক্ষণ যাত্রা করেছে? যদুনাথ মানচিত্র ব্যবহার করতেন, যুদ্ধের বৃত্তান্ত জানতে তিনি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে চলে যেতেন। নির্ভুলতার প্রতি এই ধরনের নিষ্ঠা বর্তমানে অনুপস্থিত। আমরা ই এইচ কার পড়ে বেড়ে উঠেছি, যিনি ১৯৫৮ সালে বলেছিলেন যে, আমাদের নির্ভুলতার পূজা করতে হবে না। কিন্ত যদুনাথের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল নির্ভুলতা। এই সিলসিলাটাকেই আমাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে, কারণ ভারতের গণতন্ত্রে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যুক্তিসহকারে ফ্যাক্টস নিয়ে আলাপ-আলোচনার পরিসরটা খারিজ করে দেয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, ৭০ দশকের পর থেকে বৈশ্বিক ঐতিহাসিক ধারাটা টেস্টিমনি বা সাক্ষ্যকে ইতিহাস হিসেবে মূল্যায়ন করছে। এবং যদুনাথ আমাদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ইতিহাসবিদরা আসলে ইতিহাস লেখেন সাক্ষ্যগুলোকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে।
মারাঠা ইতিহাস লেখার সময় কি যদুনাথ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন? এমন কোনো মহারাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ কি ছিলেন যারা বলেছিলেন, আপনি বাঙালি, আপনি ‘আমাদের ইতিহাস’ লিখতে পারেন না?
দী.চ: অবশ্যই, তিনি এমন প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন। আসলে এমন প্রতিক্রিয়ার অভাব ছিল না। তাকে বাঙালি অনধিকারচর্চাকারী হিসেবে দেখা হয়েছিল। এই নিয়ে মজার একটা কাহিনী আছে। উত্তর ভারতে, হিন্দি-উর্দুতে ‘জী’ হচ্ছে সম্মানসূচক সম্বোধন ; যেখানে মারাঠিতে ‘রাও’ হচ্ছে সম্মানসূচক। ফলে ‘শিবাজী রাও ভোঁসলে’।
মুঘল লিপিকাররা যখন উত্তর ভারত থেকে ফার্সিতে শিবাজী নামটা নিলেন তারা ‘জী’ বাদ দিলেন, ভাবলেন যে এটা হিন্দুস্তানি সম্মানসূচক, তাঁর নামের অংশ নয়। এবং যদুনাথ যেহেতু ফার্সি উৎস নিয়ে কাজ করেছিলেন, তিনিও ‘শিবা’ ব্যবহার করেন। এটা মারাঠাদের ভীষণ নাখোশ করেছিল, তারা ভেবেছিলেন যে তাদের শ্রদ্ধেয় বীরকে অপমান করা হয়েছে। ফলে একজন ক্ষুদ্ধ মারাঠি সমালোচক যদুনাথকে লিখলেন, আপনার নামের ‘নাথ’ ফেলে দিয়ে যদি কেবল ‘যদু’ বলে ডাকি, তখন আপনার কেমন লাগবে?’
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সম্পর্কে যদুনাথের কিছু খুবই ইতিবাচক ধারণা ছিল। এবং আপনি বলছেন যে, এগুলোকে ‘ভুল বোঝা’ হয়েছে। এর মানে কী?
দী.চ: তিনি ভেবেছিলেন যে, যেহেতু মুসলমানরা, মানে মুঘলরা ভারতকে আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করার সুযোগটি হাতছাড়া করে ফেলেছেন – যার জন্য তিনি আওরঙ্গজেবের ইসলামিক গোঁড়ামিকে দোষ দিতেন- সেহেতু এই দায়িত্বটা এবার বর্তেছে ব্রিটিশদের হাতে। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে, প্রতিটি দেশের ঐতিহাসিক গন্তব্য হচ্ছে আধুনিক হওয়া, বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া এবং একটি জাতি-রাষ্ট্র হওয়া। তিনি মনে করতেন যে, যদি আওরঙ্গজেব আরো কৌতূহলী হতেন, তাহলে পূর্বের মুঘলরা, যারা কিনা ভারতকে একটা কেন্দ্রীয় প্রশাসনে একীভূত করতে পেরেছিলেন, তাদের সাথে যোগ করে তিনি আরো সমৃদ্ধি ঘটাতে পারতেন। যদুনাথ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মুঘল দরবার ইউরোপীয় বই দেখেছে, অথচ একটা লিথোগ্রাফিক পাথরও আমদানি করেনি। সুতরাং মুদ্রণ এবং আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার ব্যাপারে মুঘলদের কৌতুহলের অভাব নিয়ে তিনি অত্যন্ত হতাশ বোধ করতেন। ভারতে ব্রিটিশদের জরুরতের ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন, সুতরাং তিনি মনে করতেন ভারতে ব্রিটিশ শাসন নিয়তির অংশই ছিল। তাঁর আফসোস ছিল, দুইটা বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটিশকে তাদের কার্য সমাধা করার পূর্বে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এই কারণে যখন সাপ্রু ১৯৪৫ সালে তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কখন ভারতীয়দের ভোটাধিকার পাওয়া উচিৎ’, তখন যদুনাথ জবাব দিয়েছিলেন, ‘১৯৯৫ এর আগে নয়’।
তিনি কেবল একাই এমন চিন্তা করেননি। সে সময়ে বহুজনই এমনটা ভাবতেন। গান্ধী নিজেই তো ১৯১৫-১৬ পর্যন্ত সাম্রাজ্যের গর্বিত ও অনুগত প্রজা ছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, যদুনাথ সরকার তার এমন দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই গান্ধী এবং গান্ধীর গণ-রাজনীতি যা কিনা ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছে তা পছন্দ করতেন না। তিনি একবার গান্ধীকে ‘ব্রিটিশদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মত্ত গুজরাটি বানিয়ার এক উন্মাদ সন্তান’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। ফলে আমি যদুনাথকে একজন জাতীয়তাবাদীই বলবো, তবে সেটা উপনিবেশ-বিরোধী ধরনের নয়; জাতীয়তাবাদ উপনিবেশ-বিরোধী হওয়ার পর বহুজন তাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অনুগত প্রজা বলে অভিযুক্ত করেছিলেন।
Sohul Ahmed, activist, and author. Topics of interest are politics, history, liberation war, and genocide. Published Books: Muktijuddhe Dhormer Opobabohar (2017), Somoyer Bebyocched (2019), and Zahir Raihan: Muktijuddho O Rajnoitik Vabna (2020)