ভূমির অধিকার ছাড়েনি বলে মৃত্যুই তার দলিল হয়েছিল

Share this:

সাক্ষাৎকার

 

শুদ্ধস্বর:  আপনি কবিতার মাধ্যমে কী আবিষ্কার করার এবং বোঝানোর চেষ্টা করে থাকেন?

রহমান মুফিজ: এখানে দুটো প্রশ্ন-একটা কবিতায় আমি কী আবিষ্কার করি, আরেকটা কবিতার মধ্য দিয়ে আমি কী বোঝানোর চেষ্টা করি। দুটো প্রশ্নই একটা আরেকটার সম্পূরক আবার দুটো প্রশ্নই আলাদা। কবিতা মূলত আত্মদর্শন। নিজের চিন্তা ও অনুভবকে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে নিজের কাছে ফেরা, নিজেকে গভীরভাবে আবিস্কার করার কাজটাই হয় কবিতায়। আপনি যদি আমার সামনে গোটা পৃথিবীকে দাঁড় করান, তার ইতিহাস-অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যৎ, তার যাতনা, সঙ্কট, সম্ভাবনা বা ইউটোপিয়া-সব কিছুকেই আমি আমার চেতনার রং দিয়েই দেখি। চেতনা গড়ে ওঠে তো ব্যক্তি ও সমাজের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, বোঝাপড়া এবং প্রবহমান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। সে-অভিজ্ঞতার নিরিখ থেকেই পৃথিবী ও তার মানুষকে দেখতে দেখতে নিজেকেই আবিষ্কার করি বারবার। এবং প্রতি কবিতায়, প্রতিবারই একজন নতুন ‘আমি’র সন্ধান পাই। সেই আমি’টা কখনো কখনো চর্বিতচর্বণে ভরপুর খুব বিরক্তিকরও বটে। কবিতায় নিজেকে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক কবিই সম্ভবত তার পৃথিবীকে আবিষ্কারের নেশায় মত্ত হন। কখনো পৃথিবীর মধ্যে নিজেকে খুঁজে বেড়ান, আবার কখনো নিজের মধ্যে পৃথিবীকে খুঁজে বেড়ান। শেষপর্যন্ত দু-পাশে তিনি যা খুঁজে পান তা হচ্ছে-কিছু অনুভূতিতে ভরপুর শব্দ, যা গ্রথিত করে তিনি শেষ পর্যন্ত বোঝাতে চান-তিনি কেবল শরীরে নন ওইসব অনুভূতির শরণেই বেঁচে আছেন বা বেঁচে ছিলেন।

 

শুদ্ধস্বর:  আপনি বর্তমান বিশ্বকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং বর্তমান ঘটনাগুলো আপনাকে লেখার ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখে?

রহমান মুফিজ: কোনো কিছুর ব্যাখ্যা দাঁড় করানো মানেই তো একটা সিদ্ধান্তে যাওয়া। সে-সিদ্ধান্তে যাওয়ার চেয়ে প্রতিমুহূর্তে বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তন ও পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণ করাটাকেই আমি আমার কাজ বলে মনে করি। এসব পর্যবেক্ষণ থেকে নিজের মধ্যে কিছু উলব্ধির জন্ম হয়। সে-উপলব্ধিই আমার চিন্তা ও চেতনাকে একেক সময় একেক চরিত্র দিয়ে যায়। কিন্তু কখনোই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে প্ররোচিত করে না। এমনকি সেটা আপাতঃসিদ্ধান্তেও না।

ধরুন, দুটি মহাযুদ্ধ পেরিয়ে আসা এ-পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো এবং তার শাসকেরা এখনো যুদ্ধের রোগে ভুগছে। যারা ভুগছে না তারাও কোনো-না-কোনোভাবে যুদ্ধপরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে আছে। এরা প্রত্যেকেই মানুষের বীভৎস মৃত্যু, আশ্রয়হীনতা, চরম অবমাননার ইতিহাসই রচনা করে চলেছে। নানা ধরনের ‘শ্রেষ্ঠত্ববাদী’ চিন্তা ও কর্ম এদের পরস্পরের মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ, বিদ্বেষ ছাড়া কিছুই জন্ম দিচ্ছে না। অথচ এরা শান্তি, সৌহার্দ্য ও মানবাধিকারের নামে মিথ্যা ভাষণ দিয়ে চলেছে নান সংঘে। এ তো চরম হতাশার। আবার এর বিপরীতেই অকস্মাৎ গ্রেটা থুনবার্গের মতো একটা পুচকে কিশোরী দাঁড়াচ্ছে বাঘা বাঘা মিথ্যুক রাষ্ট্রপ্রধানদের শাসানোর জন্য। এখানেই আবার আশার বিন্দু জন্ম নিচ্ছে। ফলে আশা-হতাশার প্যারাডক্সের মধ্য দিয়েই পৃথিবীকে উপভোগ করতে হয়, তাকে দেখতে হয়। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, ইয়েমেন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মির, উইঘুর কিম্বা মিয়ানমারে, কিম্বা ইথিওপিয়ায় নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ, অবরোধ, দুর্ভিক্ষ, মৃত্যুবিভীষিকার মুখে দাঁড়নো বা মাতৃভূমি থেকে উন্মূল হওয়া মানুষের কান্নার বিপরীতে আদৌ পৃথিবীতে প্রকৃত মানুষের কোনো স্বস্তি থাকতে পারে কি না। উত্তর হবে, না। আমরা একটা নিরঙ্কুশ অস্বস্তির মধ্যেই পৃথিবীতে বাস করছি। ক্ষমতার কোনো কেন্দ্রই প্রকৃত প্রস্তাবে শান্তি ও মানবিকতার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে না। এজন্য মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে আর লড়াই করতে হবে। যদিও এটা ভিন্ন আলাপ। কথাপ্রসঙ্গেই বলা। আপনি প্রশ্ন করেছেন, বিশ্বে ঘটে-যাওয়া ঘটনাগুলো আমার লেখায় কীভাবে ভূমিকা রাখে।

মূলত আমি যা লিখি তা তো আমার চিন্তাকেই লিখি। প্রতি মুহূর্তের অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আশা-হতাশাকেই তো লিখে চলেছি। পৃথিবীর নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ যেমন আমার মধ্যে এক ধরনের অভিঘাত রেখে যাচ্ছে, আমি আমার লেখায়ও সেই অভিঘাতগুলোকে নানা কায়দায় রেখে যাচ্ছি। কখনো প্রচ্ছন্ন উপমায়, কখনো সরাসরি।

 

শুদ্ধস্বর:  কোন সাহিত্য-ফিকশন বা নন ফিকশন-বা কোন লেখক/লেখকরা আপনার নিজের লেখাকে প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেছেন? কারা এবং কীভাবে?

রহমান মুফিজ: ভিন্ন ভাষার কবিদের মধ্যে বোদলেয়ার, মায়কোভস্কি, মাহমুদ দারবিশ, নাজিম হিকমত দীর্ঘ সময় মনোজগত দখলে রেখেছিল। এরপর তো সবথেকে বেশি প্রভাবিত করেছে পাবলো নেরুদা। তবে পল এলুয়ার, রিলকেও আমাকে ভাবিয়েছে। ফ্রস্ট, র‍্যাঁবো ভীষণ দাপিয়ে বেড়িয়েছে মগজে।   সার্ত্র, কামু এসে অনেক প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়ে গেছে। বুদ্ধ, সক্রেটিস, প্লেটো, হেগেল, মার্কস-এঙ্গেলস দিয়ে গেছে বিশ্ব ও মানবদর্শন এবং ডায়ালেক্টিকস। দস্তয়ভস্কি, চেখভ, গোগল, তলস্তয় পৃথিবীর সরলতাকে চিনিয়েছে এক অনবদ্য সরল ভঙ্গিমায়। বোর্হেস, কাফকা, মার্কেজ যেন ফেলে দিয়ে গেছে একটা অনন্য জাদুর পৃথিবীতে। বিভূতি, মানিক, হাসান আজিজুল চিনিয়েছে স্বভূমির মানুষ। এভাবেই সালোক-সংশ্লেষণের মতো এঁদের আলো নিয়ে বেড়ে চলেছি। আপনি আমাদের মহাভারত, রামায়ণ, এমনকি আমাদের লোকগাথা ও লোকশ্রুতিগুলোও বাদ দিতে পারেন না। আমাদের গানগুলো, লোকজ সুরগুলোও গড়ে তুলেছে আমাদের। এই সময়ের গান ও সুর থেকেও রস নিয়েছি অবারিত। ফলে কোন উপাদান আপনি বাদ দেবেন? কিন্তু ঝোঁক তো বরাবরই কবিতার দিকে। তাই কবিতার কাছেই ফিরেছি বারবার। অনেক পরে এসে হঠাৎ জাপানী হাইকুর খোঁজ পাওয়ার পর আমি রীতিমতো চমৎকৃত হয়েছি। শুধু মুগ্ধ হয়ে হাইকু পড়েছি, পড়েছি কি এখনো পড়ি আর বিস্ময় অনুভব করি। কিন্তু কখনোই হাইকু লেখার চেষ্টা করিনি। আমাদের অনেককেই চেষ্টা করতে দেখেছি যদিও। মূলত জেন ভাবধারার প্রতি কিছুটা উৎসুক্য আছে।

কবিতার ক্ষেত্রে আমি বিশেষ কোনো ফর্মে আটকে থাকার পক্ষপাতি নই। কবিতায় প্রগলভতাও আমাকে আকর্ষণ করে। বিশেষ করে দীর্ঘ কবিতারও পাঠক আমি। দীর্ঘ কবিতায় একটা আলুলায়িত হবার ব্যাপার আছে। একইসঙ্গে সেটা সিরিজ কবিতার ক্ষেত্রেও। ধরুন, দীর্ঘ সময় ধরে আপনি পান করে চলেছেন আর ধীরে ধীরে নেশায় ডুবে যাচ্ছেন। দীর্ঘ কবিতা বা সিরিজ কিবতাগুলো পাঠের ক্ষেত্রে এমনই হয়, আর কি। এটা আপনি ওমর খৈয়াম, রুমিতে পাবেন। মাইকেল মধুসুদনের সনেটেগুচ্ছে পাবেন। রবীন্দ্রনাথেরগীতাঞ্জলিতে, সুধীন্দ্রনাথের অর্কেস্ট্রায়, আল মাহমুদের সোনালি কাবিনে পাবেন, সৈয়দ শামসুল হকের পরানের গহীন ভেতরেপাবেন। এইসব পাঠাভিজ্ঞতা অনুভূতি দ্বারা তো হরহামেশাই তাড়িত হই, প্রভাবিত হই। এর প্রচ্ছন্ন ছাপ আমার লেখায়ও পড়ে। তবে আপনি হয়তো আমার কবিতায় বিশেষভাবে উপরোল্লেখিত কারও প্রভাব খুঁজে পাবেন না যতটা খুঁজে পাবেন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, বিনয় বা নবারুণকে। আর জীবনান্দ তো সর্বগ্রাসী। তাকে খুঁজে পাওয়া এমন কঠিন কিছু নয়। তবে দেখুন, এঁদের কবিতা আমাকে একেকটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছে। একেকটা সময় এবং তার স্বরকে চেনা যায় এদের কাব্য অভিযাত্রার ভেতর দিয়ে। শুধু কবিতা কেন, ভ্যান গঘের যবখেত থেকে সুলতানের ধানখেতের ছবিও তো আমার লেখাকে প্রভাবিত করে। দালির সুররিয়াল ক্যাসভাস থেকে কাহলোর আত্মপ্রতিকৃতি পর্যন্ত কি পৃথিবীর পোর্ট্রেইট আঁকা নেই? আমাদের আত্মপ্রতিকৃতির সন্ধানও কি ওসবে পাই না? এভাবেই আমি তাঁরা হয়ে যাই, তাঁরা আমি হয়ে যায়।

 

শুদ্ধস্বর:  কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার কবিতাকে আকার দেয়?

রহমান মুফিজ: আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ বলতে যা ঘটে তা আমার সমাজ এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে ঘটে। এখানে আমি একেবারেই অন্ত্যজ, প্রান্তিক। বিশ্বের সঙ্গে যা ঘটে তা দূরবর্তী জায়গা থেকে ঘটে। বাংলা ভাষা, চাটি ও রুয়াই ভাষা (বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষা) ছাড়া আমার যোগাযোগের আর কোনো মাধ্যম নেই। ইংরেজি ভাষা, যেটাকে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যম বলা হচ্ছে, তা আমি খুব কমই বুঝি বা জানি। ভিন্ন ভাষার সাহিত্যের রস-আস্বাদনের জন্য আমাকে আশ্রয় নিতে হয় অনুবাদের। ভিন্ন ভাষার বন্ধু আমার নেই বললেই চলে। এটা আমার একটা বিরাট সীমাবদ্ধতা। ফলে এই সীমাবদ্ধতা নিয়েই আমাকে বিশ্বসাহিত্য ও বিশ্বরাজনীতির ছাত্র হতে হয়েছে। তবে বিষয়টা এমন নয় যে, বিশ্বের তাবৎ তথ্য ও জ্ঞান থেকে আমি বিচ্ছিন্ন। উল্লেখযোগ্য সব তথ্য ও জ্ঞানকে আমার ভাষায় অনুদিত রূপে পেতে হয়। এইখানে একটা ক্রাইসিস আছে। এটা কেবল সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঘটছে। অর্থাৎ জ্ঞানের ক্ষেত্রে ঘটছে। তথ্যের ক্ষেত্রে তেমন একটা ঘটছে না। ফলে আমার কবিতায় সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতির প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি থাকলেও বিশ্বের সামগ্রিক জ্ঞান-দর্শনের উপস্থিতির ঘাটতি আছে। এটা সত্য, নিরেট ও দুঃখজনক সত্য। তবে সতীর্থদের সঙ্গে আলাপ বা তাদের সূত্র ধরে যে-জ্ঞানসূত্র আমি খুঁজে পাই, তার কাছে নতজানু হয়ে বসি। এমনকি আমার সমসাময়িক বা আমার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী যেসব মেধাবী কবি বা সাহিত্যিকদের লেখা আমি পাঠ করি তাদের চিন্তা ও প্রকাশ আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করে। আমি তাদের সৃষ্টির কাছেও মাথা নুয়ে দাঁড়াই। এইসব বিচিত্র অনুভব আমার লেখায় বা ভাবনায় এক ধরনের অভিঘাত রেখে যায়। তা আমার কবিতাকে ভিন্ন বা তাৎপর্য কোনো আকার দেয় কি না আমি জানি না, তবে স্বীকার করতে হবে, আমার কবিতায় বিপুল ঘাটতির বিষয়টি স্পষ্ট হবেন পাঠকমাত্রই। এটা আমার একটা বড়ো দুর্বলতার দিক।

 

শুদ্ধস্বর:  আপনার কবিতার বক্তব্য উচ্চারণ করতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?

রহমান মুফিজ: আমি খুবই সরল ভাষার অনুগামী। জ্ঞান বা অনুভবকে জটিল শব্দবন্ধনী ও বাক্যচর্চার মধ্য দিয়ে উপস্থাপনের পক্ষে আমি নই। এমনকি প্রচলিত ব্যাকরণের বৃত্তেও আমি আমার ভাব প্রকাশে আগ্রহী নই। আমার ভাষাকে কোনো প্রাগৈতিহাসিক ও সংস্কারে ন্যুব্জ কাঠামোতে প্রকাশ করতেও আমি সচ্ছন্দ নই। আমি হাইল্লা ও জাইল্লার সন্তান ( চাষা ও জেলের সন্তান)। আমি সবে নাগরিক হয়েছি। মধ্যবিত্ত মনস্তত্বকে পরিগ্রহ করেছি। কিন্তু ভাষার সহজিয়া রূপ ও কাঠামোতেই আমি সচ্ছন্দ। এইভাবে নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশের মধ্য দিয়ে যদি কোনো প্রকাশভঙ্গি দাঁড়িয়ে যায়, যাক। কিন্তু আরোপ করে কোনো ব্যাকরণ নির্মাণ বা ভাষাভঙ্গি তৈরির কোনো অভিসন্ধি আমার নেই। এমনকি নিজস্ব ফর্ম গড়ে তোলার ব্যাপারেও আমি খুব একটা সচেতন আগ্রহ দেখাচ্ছি না আপাতত। তবে হ্যাঁ, নিজের লেখার ভঙ্গিকে বারবারই ভাঙার চেষ্টা করি। এটার মধ্য দিয়েই হয়তো প্রত্যেক লেখক নিজস্ব ফর্ম বা ভাষা গড়ার কাজে ব্যাপৃত হন। এভাবে হলে আমার আপত্তি নেই। এভাবেই আমি অভ্যস্ত।

 

শুদ্ধস্বর:  রাজনৈতিক কবিতা এবং  সাধারণ কবিতার মধ্যে সাহিত্য ও শৈল্পিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব এবং সংহতি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

রহমান মুফিজ: কবিতা তো কবিতাই। সেটা রাজনৈতিক বা সাধারণ কবিতা-যা-ই হোক। প্রথমত, ‘রাজনৈতিক কবিতা’ বলতে যেমন আলাদাকিছু নেই, সাধারণ কবিতা বলতেও আমি আলাদা কিছু ভাবি না। কবিতাকে কবিতা হিসাবেই দেখি। কথা হচ্ছে, আপনি যা বোঝাতে চান বা প্রকাশ করতে চান, সেটা রাজনীতি, প্রেম, সমাজবীক্ষণ বা একেবারে সাধারণ কিছু, হোক সেটা ছোটো ছোটো অনুভূতির বয়ান-যা-ই হোক-তা আপনি অনন্য ও আকর্ষণী ভঙ্গিতে কবিতায় তুলে আনলেন কি-না; সেটা দিন শেষে কবিতা বলে গ্রাহ্য হচ্ছে কি না সেটাই আসল কথা। এখন আপনি কোনটাকে কবিতা বলছেন, কবিতা হিসেবে যা লিখছেন তাকে কবিতা বলবেন কেন? এখানে আমার জবাব হচ্ছে-কবিতায় ভাষার চেয়ে ভাবটাই প্রধান। আবার একদিক থেকে ভাবের চেয়ে ভাষাটাও প্রধান। এই দুইয়ের যুগলবন্দী সাধারণকে ছাড়িয়ে অন্য কোনো মাত্রা অর্থাৎ অসাধারণত্বে পৌঁছাচ্ছে কি-না, সেটাই দেখতে হবে। দেখতে হবে যে লাইনটা পাঠক আবৃত্তি করছে সেই লাইনটা পাঠককে দোলায়িত করছে কি-না। দোলাতে দোলাতে এমন গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে কি-না, যেখানে পাঠক এক সময় বুঝতে পারবেন, এখানে ওই কবিতার লাইন ছাড়া আর কিছু নাই, ওইটাই একটা গহ্বর, যেখানে তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন…।

 

শুদ্ধস্বর:  আপনার কবিতা কি জাতীয় সীমানা অতিক্রম করে বলে আপনার ধারণা? এটি অন্যান্য জাতীয়তা বা ভাষাগোষ্ঠীর কাছে আবেদন রাখতে পারে বলে কি আপনার মনে হয়? তাহলে কীভাবে?

রহমান মুফিজ: কবিতা তো সীমানা মেনে লেখা হয় না। যে কবিতা লাতিনের, চীনের, ইউরোপের, আমেরিকা বা রাশিয়ার, এমনকি যে কবিতায় কঙ্গোর কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের একজন মামুলি মানুষের দুঃখগাথা বা সুখগাথা লিপিবদ্ধ হয়েছে, সে-কবিতা সারা পৃথিবীরই কবিতা। আমিও কবিতা লিখি মানুষের জন্য। সে যে দেশের, যে ভাষার, যে জাতি বা গোষ্ঠীরই হোক না কেন, আমার কবিতার অন্বিষ্ট থাকে মানুষ। কিন্তু সীমানা অতিক্রমণের বিষয়টি যদি এমন হয় যে, আমার কবিতা সর্বত্র পৌঁছাচ্ছে কি-না, তাহলে বলব, এটা একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। আর যদি বলেন আমার কবিতা সীমানানিরপেক্ষ কি-না, তাহলে বলব, পৃথিবীর সব কবিতাই সীমানা অতিক্রমণের যোগ্যতা নিয়ে জন্মায়। আপনি যদি ফরাসি পারফিউম সারাবিশ্বে বাজারজাত করতে পারেন, আর সারা বিশ্ব সে সুগন্ধে বুঁদ হয়ে থাকতে পারে তবে আপনি কবিতাকেও বাজারজাত করতে পারেন অনায়াসে। এবং সে-কবিতা আবেদন রাখতে সক্ষম হবে সর্বত্র।

 

শুদ্ধস্বর:  আপনি কি মনে করেন কবিতার সংক্রাম দিয়ে মানুষের ইতিহাস পালটানো সম্ভব? আপনার জবাবের পক্ষে বলুন।

রহমান মুফিজ: কবিতা দিয়ে মানুষের ইতিহাস পালটানো সম্ভব কি না আমি জানি না। তবে মানুষের ইতিহাসে কবিতা পুনঃপুন তাৎপর্যপূর্ণ স্মারক রেখে যেতে সক্ষম। এটার মধ্য দিয়ে মানুষ তার সমকালীন সভ্যতাকে একটা উচ্চতর পরিচয়ে দাঁড় করাতে পারে। যদিও এর প্রস্তাবনা ‘শ্রেষ্ঠত্ববাদী’ চিন্তাকে কিয়দাংশে প্রশ্রয় দেয় কিন্তু আপনাকে ভাবতে হবে, প্রতিটি সভ্যতার মানুষ তার কীর্তি রেখে যাবে পরের সভ্যতার কাছে। ফলে তাকে যথাসাধ্য শ্রেষ্ঠটাই রেখে যেতে হবে। ভবিষ্যতের নৃবিজ্ঞানের জন্য, সমাজবিজ্ঞানের জন্য এমনকি মনোবিজ্ঞানের জন্যও আপনার মতো ‘আধুনিক’ মানুষকে একটা প্রচেষ্টা তো করে যেতেই হবে। আরেকটি প্রশ্নের উত্তর এখানে দিয়ে রাখা ভালো, সেটা হলো-মানুষ এখনো অব্দি নিজেকে চেনা বা নিজেকে আবিষ্কারের পথটি খুঁজে পায়নি। কবিতা সে-পথটিই খুঁজে দেয়। এর মধ্য দিয়ে মানুষের ইতিহাসের যদি কোনো উল্লেখযোগ্য উৎকর্ষ সাধন সম্ভব হয়, হো, মন্দ কী?

____________________________________

 

 

কবিতা

 

 

বাংলাদেশ

বিয়োগান্ত উপন্যাসের মতো তুমি পড়ে থাকো

নির্জন টেবিলে। তোমাকে পড়ে না কেউ

যারা পড়েছিল তারা আর সংসারে ফেরেনি

অথবা ফিরলেও কেউ কেউ ফিকে দেয়ালের

নিঃশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিজের মুখোমুখি।

যারা তোমার সঙ্কল্প পাড়ি দিয়ে এসেছে

আভূমি বিস্তীর্ণ জন্মবেদনার ডানা-ঝাপটানো

মানচিত্র এঁকেছে পায়ে পায়ে, তারাও এখন

তোমার সংজ্ঞা নিরূপণে ব্যস্ত; আপন

চরিতাভিধানে লিখছে ফাঁপা বীরত্ব, কুৎসিত শ্লাঘা!

আমাদের বয়সে তোমাকে দেখছি পাঁজরে বিদ্ধ

ছুরি নিজের আঁচলে ঢেকে দাঁড়িয়ে আছো

ঊনঘুম নির্মল ফ্যাকাশে হাসির মতো স্নেহ নিয়ে।

 

কালরাত্তিরে আমরা ঠাঁই নেব কই বলতে পারো?

 

 

সাঁওতাল জীবনের প্রতি

(২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জে ভূমি রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত সাঁওতাল নেতা রমেশ টুডু, মঙ্গল মারডি ও শ্যামল হেমব্রমের স্মৃতির উদ্দেশে)

 

পাহাড়ের বুকে একদিন রচনা করেছিলে সবুজের ওড়না

অনাবাদি দ্যাশে ফুটিয়েছিলে প্রথম বিপ্লবের ফুল

তোমাদের হাড়ে-মজ্জায় এখনো লেগে আছে প্রতিরোধের দর্প

এখনো মহুয়ার মাতাল রাত্তিরে গলা খুলে গাও মাটি ও শস্যের গান

এখনো তোমাদের মতোন মাটিকে ভাষা দিতে পারেনি কেউ

মাকে ভালবাসতে শেখেনি কোনো অর্বাচীন।

তোমাদের তামাটে গাত্রে পীড়নের চাবুক এঁকেছে বেগানা সভ্যতা

তোমাদের বাস্তুচ্যুত করে সূর্যের অভিশাপপ্রাপ্ত হয়েছে দুর্বৃত্তরা

ওরা মরছে উন্নয়নের ভাগাড়ে, তোমরা দাঁড়িয়ে আছো মাটির উদ্দাম বুকে

তোমাদের কণ্ঠে উৎসমূলের কোরাস, আদি মানবের হাহাকার

মাদলে-শিঙায় জোছনারাতের নৃত্যে ঝঙ্কৃত হয় সরল আত্মার তৃপ্তি

তোমাদের ধনুকে মৃত্যুবাণ নয়, রচিত হয় মহাজীবনের সংকল্প।

 

মনে নেই আঠারোশ পঞ্চান্ন? ভগনাডিহি থেকে কলকাতার পথে

এঁকেছিলে রক্তের উলকি। তার অক্ষয় পুষ্পশোভা পাচ্ছে সভ্যতার খোঁপায়।

সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব, ফুলু-ঝানু সেদিন গেয়েছিল দুর্বার ঐক্যের স্তোত্র

সমগ্র ভারত কেঁপে উঠেছিল তোমাদের অপ্রতিরোধ্য হুলে।

 

মনে নেই, কটক, মানভূম, ডালভূম, ছোট নাগপুর, পালামৌ, মেদেনীপুর

বাকুড়া বীরভূম-সম্মিলিতে জেগে ওঠেছিল দামিন-ই-কোহ?

এই জনপদে প্রথম গণহত্যার স্মারক বয়ে চল তোমরাই

প্রথম বিদ্রোহের বিদীর্ণ উচ্চারণ তোমাদেরই কণ্ঠে শুনেছে এ-মাটি

এ-ভূমি তোমাদের কাছেই প্রথম শিখেছে সর্বপ্রাণের উচ্চকিত অধিকার।

তোমরাই যুগে যুগে এসেছো লড়াইয়ের দিশা হয়ে।

 

দু-হাজার সাল। আলফ্রেড সরেনকে মনে আছে।

ভূমির অধিকার ছাড়েনি বলে মৃত্যুই তার দলিল হয়েছিল।

তার বোনেরা এখনো ছাড়েনি পথ। রক্তের আল জুড়ে তারা এঁকে চলেছে

প্রতিশোধের নকসিকাঁথা। ভাইয়েরা লড়ছে মাটি ও মায়ের মুক্তির জন্য।

তাদের ধনুকে এখনো সূর্যের তীব্র স্পর্ধা।

 

আজ মহিমাগঞ্জে জ্বলছে আগুন, তোমাদের সন্তানেরা কাঁদছে, নারীরা বিপুল

শোকে বুনছে অন্তিম বসন। সেখানে তাদের পুরুষদের জন্য লিখে রাখছে

শ্রেষ্ঠ লোকগাথাগুলো। লিখে রাখছে আসন্ন লড়াইয়ের আগাম বিজয়মন্ত্র।

 

কমরেড শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মারডি, রমেশ টুডু

তোমাদের বুক আজ বিপন্ন বাংলাদেশ। বেদনাভারে নিমিলিত তোমাদের

চোখ থেকে আমরা কোষ ভরে তুলে নিতে চাই মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের স্বপ্ন।

তোমাদের মৃত্যু আমাদের অপরাহত করে তুলেছে। সমস্ত সংগ্রামে তোমরাই

এখনো অবিকল পুর্বপুরুষ।

 

কথা দিচ্ছি, আগামী সোহরায় আমরা মিলিত হব, বাহা উৎসবে তুমুল নাচব,

চন্দ্রযাপনের রাতে আকাশের দিকে তাক করে ধনুকের দীক্ষা নেব।

একদিন এফোঁড় ওফোঁড় করে দেব বাতিল শাসকের হৃদপিণ্ড।

 

কথা দিচ্ছি, তোমাদের আর হারতে দেব না।

 

 

অনামি কবিতা ৬

কারো পায়ের ইতিহাস জানতে হলে আপনাকে জানতে হবে তার ঘুমহীন রাতগুলোর কথা। অথবা জানতে হবে শেষ ঘুম গিয়েছিল কবে সে। হস্তরেখার মতো ঘুমের ইতিহাসের সঙ্গে মানুষের ভূত-ভবিষ্যতের রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যোগ। পায়েদের ইতিহাসই মূলত মানুষের ইতিহাস।

সব পায়েরই নিজস্ব রীতি আছে। পৃথক অভ্যাসে ওরা বুড়ো হয়। আর কিছু পা ভুলে যায় বুড়ো হওয়া। ক্লান্তি কাছে ঘেঁষে না লাথির ভয়ে। কিছু পা লোল-চর্বিতে নেতিয়ে থাকে। হাইপ্রেসারে কমতে থাকে ভোল্টেজ। এদের সঙ্গে ঘুমের দোস্তি ভাল। ঘুমের পা-গুলো স্বর্গ অব্দি পৌঁছে যায়। তারা মর্ত্যে ধ্বজভঙ্গ রাজনীতিকের মতো কূটচালে বিষিয়ে তোলে পথের নিটোল সংসার।

আর কিছু পা আছে আত্মঘাতি। অভিমানে মচকে বসে থাকে মাঝপথে। যেসব পা কপাল নিয়ে জন্মায় ওরা বঙ্গভবন গণভবন বেশ্যাবাড়ি পর্যন্ত যায়। সংসদে যায়, ওআইসি কমনওয়েলথের মতো তাবড় ক্যাসিনোগুলো দাপিয়ে বেড়ায়। সামন্তীয় পাগুলো এখনো বাইজিখানার হেরেমে আঙুরের ঝুড়ির পাশে মাথা দোলায় রাগ দরবারিতে।

যে-পাগুলো সংখ্যায় কম তারা রোজ মিছিলে যায়। লংমার্চে হাঁটে। মাঝে মাঝে লাথি বসায় দুর্বৃত্তের জুয়ার টেবিলে। কিছু লেফট রাইট করা পা বুটজুতোর দেমাগে মাটিই স্পর্শ করে না। অকারণে ভীষণ চ্যাতে গিয়ে আনাগোনা বাড়িয়ে দেয় লোকালয়ে। যখন শুনবেন মধ্যরাতে শহরের ঘুম উধাও হয়ে যাচ্ছে, টাটকা কিছু পা হঠাৎই নিখোঁজ হচ্ছে তখন বুঝে নেবেন সকলের দিন খারাপ। আপনার কপালও সেইসব পায়েদের ভবিতব্যে আটকে পড়েছে। অথচ আপনি কোনো লজিক ছাড়াই মনে করবেন, আপনার পা দারুণ ভদ্র-সুশীল, সুন্দরতম! ভাববেন, কাঁচা ভেজা দূর্বাঘাসের মাঠ মাড়িয়ে আপনি নির্বিঘ্নে ফিরতে পারবেন এবাদতখানায়!

আপনি আসলে মানুষ নন, আপনি সেই উদ্ভট উট, যার পিঠে চলেছে বিপন্ন স্বদেশ।

 

 

বিষণ্ন বিক্ষোভ

ক্ষুধা মরে গেছে। রহিত হয়েছে অভাবের অভিযোগ

কেবলই প্রাণে বাঁচার যুদ্ধটুকু অবশিষ্ট আছে এখন-

আমাকে জিজ্ঞেস করো না, কেমন আছি আমি

আমাকে কখনোই জিজ্ঞেস করো না আমার দেশ কেমন আছে।

আমরা দেশের বুঝি না কিছুই, কেবল ভোটের ভাগে কপালে ফোটে

ইস্কাপনের পুষ্প। সে-পুষ্পও এখন আড়তদারের গুদামে লুটেরার

ইজ্জত হয়ে জমা হচ্ছে, খুচরো পয়সায় বিকোচ্ছে নিজেকে।

আমরা বুঝি কেবল নিজের ষোল আনা-উপদ্রবহীন কদর্য জীবন

এখানে মৃত্যু পরোয়ানা রাষ্ট্রের হাতে, দেশ কেবলই দোহাই

উন্নয়নের ভ্রুকুটি কেড়ে নিয়েছে আমার ঘুম, স্বপ্ন, এমনকি নির্ঝঞ্ঝাট

সঙ্গম, বিকেলের ব্যালকনি, পরিত্যক্ত অধিকারও।

আমার ললাটে যা দেখছ তার নাম দুর্ভাগ্য কি-না আমি জানি না

জাতিসংঘ তার নাম দিতে পারে শান্তিসরোবর অথবা মধ্য আয়ের তীর্থ

যদিও ওর কথা বিশ্বাস করে আমাদের পোঁদমারা গেছে বহুকাল আগে।

 

তুমি দেখছ একটা বিদীর্ণ বাংলাদেশ, তার বুক থেকে চুইয়ে পড়ছে

অন্ধকারের লালা। অজানা অতল গহ্বর থেকে বলক দিয়ে উঠে আসছে

বিষণ্ন অশ্রুধারা, তুমি তাই দিয়ে আঁকতে পারো বিকল্প পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র।

 

তুমি দ্যাখো বহুগামী কন্যার হাতে দুর্ভাগা পিতার দস্তানা

দ্যাখো, গর্বের স্মারকে লেগেছে ঘাতকের মূত্র।

দ্যাখো, শ্যামল বাংলা কেমন বিচ্ছিরি আতরের গন্ধে মশগুল

দ্যাখো, এ-দেশে কতটা অন্যায্য মনে হয় তোমাকে

দ্যাখো, নিজেকে কতটা অভ্যাগত, উদ্বাস্তু মনে হয় নিজের জন্মভূমিতে।

 

 

রহমান বাড়ি যাও

রহমান, বাড়ি যাবে না?

এভাবে উদোম অন্ধকারে মুখ থুবড়ে

বসে থাকবে আর কতক্ষণ?

এখানে ভীষণ হট্টগোল, সারাই হচ্ছে জং ধরা সন্ধ্যা

ওইদিকে পুলিশের তাড়া, হুইসেলে জবরদস্ত চোটপাট

সরকারি প্রজ্ঞাপনে ঢুকে পড়েছে আস্ত একটা উট

কুঁজ-গণ্ড প্রাণিটার জন্য বানানো হবে নাকি বিস্তীর্ণ মরু

শুনেছ, কারা নাকি হানা দিয়েছে শহরে?

 

নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছ?

মাটিটা অচেনা ঠেকছে? হাওয়াটাও কর্কশ?

তোমার তো অসুবিধে হবার কথা নয়

তুমি তো রোজ পদ্য লিখেছ ষাঁড়ের প্রশস্তি গেয়ে

তুমি তো শান্তির খেদমতগার, আজ তোমার শান্তি উবে গেল তবে!

 

শোনা গেছে, ওদিকে কয়েকটা লাশ পড়ে আছে

টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রী কথা বলছেন চিবিয়ে চিবিয়ে

রাজন্যবর্গ তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন জমজমের জল।

 

রহমান বাড়ি যাও

তোমাদের উনুনে রান্না হচ্ছে আরো আরো শান্তি

তেল-নুন, পঞ্চব্যঞ্জন ঠিক আছে কি না দেখে এসো।

 

 

রহমান বাড়ি যায় না

 

রহমান বাড়ি যাও

এখানে কাদার মতো বার্ধক্য ঘনিয়ে আসে

ইঁদুরকলে আটকে গেছে রাত। সহসা সময়

ফিরবে না অনুকূলে। রক্তজবার হৃদপিণ্ডে যারা

চালিয়েছে ছুরি তারা কারা জানে না শহর।

 

অন্ধকার রমন করে যা পেয়েছ তা দিয়ে

একটা রাস্তা কিনে নাও। দাঁড়ানোর মতো

উদ্বৃত্ত সময় নেই কারো, তুমি কেন অহেতুক

পাহারা দেবে এ-চক্রান্ত, তোমার কিসের ঠ্যাকা?

 

বাড়ি যাও রহমান

এখানে ঘাসের কাছে লেপ্টে থাকে শ্বাস

গোঁ ধরে বিবস্ত্র বসে থাকে মৃত্যু

 

রহমান বাড়ি যাবে না? এভাবে কাটাবে রাত?

 

 

মুখোমুখি ৫

আমার নামে একটা চিঠি এসেছে কাল সকালে। প্রেরকের নাম নেই খামে। সিলছাপ্পরও নেই কোনো পোস্টাপিসের। দরজার নিচ থেকে গলিয়ে দেয়া একটা শাদা স্মৃতির ওপর অপরিচিত অক্ষরে লেখা- ‘প্রিয় মিথ্যুক’।

এই সমরের রাত, গুলি খাওয়া হ্রদ, পরিখার নিচে লিখে চলা নবজাতকের বায়োগ্রাফি, সন্তর্পণে গুটিয়ে নেয়া চুম্বন, অতল নিদ্রার ভেতরে হেঁটে চলা বিষণ্ণ যোদ্ধা-কিছুই কখনো প্রকাশ্য প্রতিমা পায়নি। আমার ঢালু শরীরে সঞ্চারিত ভয় প্রতিদিন উৎসব করেছে নরকে। রোজকার যে-সংখ্যা আমি লুকিয়েছি তার প্রতিশব্দ তো ‘নিরেট হত্যা’। কিন্তু আমি তাকে বলেছি-ভালো, শান্তি ও উন্নয়নের জন্য সব বুলেটই পবিত্র।

যে-প্রার্থনা ও দরুদ প্রিয়তম রাজগৃহের দিকে নিবেদিত হচ্ছে তাকে কেউ প্রেম ভাবছে, ভাবছে ভক্তি। অথচ সেটা কপট স্তুতিতে ভরপুর নিপুণ ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। কেউ লজ্জা ঢাকতে গোটা সংবিধানকে করে তুলছে বিশুদ্ধ বর্ম। প্রত্যেক অবিচারের নাম দিচ্ছে আইন ও ধর্ম।

অথচ, বাউল রণেশ ঠাকুর ভষ্ম উঠানে দাঁড়িয়ে বলছেন-কোনো অভিযোগ নেই কারো প্রতি। তাঁর একতারা, করতাল, পুড়ে যাওয়া গানঘর আমাদের সভ্যতার চিৎকার হয়ে উঠল শেষে। যেমনটা শরিয়ত বয়াতি, রীতা দেওয়ানের কোমরের রজ্জু হয়ে উঠলো শ্বাসটান-ওঠা রাষ্ট্রের নেবুলাইজার। কার্টুনিস্ট কিশোরের হাতকড়াই এখন রাষ্ট্রের সবথেকে বড় ব্যাঙ্গচিত্র-এ-সত্য ঢেকে আমি কি স্বর্গোদ্যান অব্দি পৌঁছুতে পারব?

আচ্ছা, শেখ হাসিনা তাঁর দরজার নিচে কি গতকাল একই চিঠি পেয়েছেন, যেখানে প্রাপকের ঘরে লেখা-প্রিয় মিথ্যুক?

 

 

 

মুখোমুখি ৯

নিজেকে জমা রেখে যাচ্ছি ছোট ছোট জানলায়। কপাটে কপাটে এঁকে দিয়ে যাচ্ছি বাতাসের সঙ্কেত। তোমার কানে পৌঁছুবে কি-না নদীর শিস- জানি না। তবুও কোনো মৃত্যুদৃশ্য থেকে যদি ফনা তোলে সুগন্ধের স্মৃতি, তার কাছে জানতে চেও, সে কখনো আলিঙ্গন করছিলো কি-না নিজের নাম। কখনো পাহাড় থেকে গড়িয়ে হাতির পালের মত নেমেছিল কি-না লোকালয়ে, আর শুধু পিষে মেরেছিলো কি-না দুধের শিশুদের- জিজ্ঞাসা করো। কারণ এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে তুমি ভাল কত্থক নাচতে পারবে। খোঁপায় নির্দ্বিধায় গুঁজতে পারবে হাতির দাঁতের কাঁটা।

তোমাকে বহুবার বলেছি আমার মেরুদণ্ড কুমিরে খেয়েছে, তাই ভালবাসবার মুরদ হারিয়েছি। তবুও এই মিথ্যাকবলিত জনপদে আর একটি প্রলাপও আছে কি-না তোমাকে নেশা ধরাবার জন্য, জেনে নিও।

যে মুখ আমি রেখে যাচ্ছি সুললিত আয়নায়; নির্বন্ধিত এক তলপেটের কাছে- সে মুখ জঘন্য। সে মুখ আনাড়ি গ্রহের কাছে পেয়েছে সন্তের সমাদর। পর্নহাবে অজস্র সঙ্গমের দৃশ্য দেখেও যে মুখ কোনো শীৎকার শেখেনি তার রাষ্ট্রভাবনা প্রধানমন্ত্রীর মতোই নেহাত শিশুতোষ হবে, সে তোমার আগেই জানা উচিত ছিল। এখন আর দুষলে চলবে না। প্রতারিত হতে হতে আমি তো তুমি হয়ে গেছি।

তোমাকে হত্যা করবার জন্য রাতের ঘুম জেরবার করে বারবার জপছি তোমারই চোখের তসবিহ। তোমার দূরাগত হৃদস্পন্দন শুনতে শুনতে আমার চোয়ালে নেমে আসে ভোর, গলায় নেমে আসে রজ্জু, বুক বরাবর অকস্মাৎ বুলেট! আমি গৎবাঁধা বিবৃতি হয়ে পড়ে থাকি শালবনে…

শালবনে আজ আসার কথা নয়। যদি টিভিতে দেখতে পাও অযাচিত কোনো খুনের খবর, চলে এসো। আমি তোমার নেশা টুটিয়ে দেবো! মাইরি বলছি!

 

 

 

 

 

 

About The Author

  • More From This Author:

      None Found

Subscribe to Shuddhashar FreeVoice to receive updates

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!