তুমুল করতালির মতো কথাটি এখন শোনা যায়, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু হলেও ধর্মান্ধ নয়। তো কথা হচ্ছে, এমন একটা, মোহনীয় আর ঘোরপ্যাঁচের কথা দেশের সমস্ত মানুষ না-জানলেও যারা বলেন তারা তাতে বেশ তৃপ্তি পান। একধরনের শারীরবৃত্তীয় সুখও হয়ত পেয়ে থাকেন। এতে আর যাই হোক, কথকের আইডিয়া বা ইচ্ছাটা ভালোই জাহির হয়। এ যারা বলেন বা লিখে জানান তারা মূলত মধ্যবিত্ত, কিন্তু যাদের সম্পর্কে বলেন তারা তো আর সবাই মধ্যবিত্ত নয়। মধ্যবিত্ত হোক আর উচ্চবিত্ত বা অন্ত্যজ শ্রেণীর হোক, ধর্মবিষয়ক এমন কথকতায় আসলে একধরনের কায়দাই প্রকাশ পায়। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কিংবা ব্যক্তির নানাবিধ সম্ভাবনা বা সমস্যা নিয়ে মধ্যবিত্তই ভাবেন, বেশ ভাবেন, ভাবতে ভাবতে হয়ত পেরেশানীতেও পড়েন। এও এক জানার বা বোঝার বিষয় বৈকি। তো, এই যে জানার বা বোঝার বিষয় তাতে তো সমস্যা কিছু নাই, দৃশ্যত মনে হবে অজস্র সমাধানই একসময় আমরা পেয়ে যাব।
মজার কথা হচেছ, মধ্যবিত্তই বলেন আবার মধ্যবিত্ত এ-সব পড়েনও, হা-হুতাশ করেন, চিৎকার করেন, প্রতিবাদ-প্রতিরোধে মিছিলও করেন হয়ত। ধর্মের এই কায়দাটা এখন অধিকাংশ মধ্যবিত্তের চৌহদ্দীতেই শুধু ঘুরঘুর করছে; তাও কিন্তু সঠিক নয়। এ নিয়ে মধ্যবিত্তের ভিতর ঝগড়া-ফ্যাসাদও হয়। মতদ্বৈততা তৈরি হয়। কেউ বলেন, এ ঝুলন্ত শ্রেণীর কথায় কান দিও না, এরা পাজি, এরা ফাঁকিবাজ, ধান্ধাবাজ, আখের গোছানোর এমন বিচ্ছিন্নপিপাসু সংগঠিত শক্তি আর দেখা যায় না। কেউ কেউ জয়ধ্বনির মতো এর প্রতিবাদ জানান, আরে এ কেমন কথা, যাদের খেলাম, পড়লাম; যাদের সাথে জীবনযাপন শেয়ার করলাম তাদের নিয়ে অত বেহিসাবি কথা কেন? কেউ কেউ আগ-বাড়িয়ে আরেকটু উপদেশের মতো ক্রন্দন তৈরি করেন – তাতো হবেই, নিমকহারামী আর কাকে বলে, এ কথাঅলারা তো প্রগতিশীল, এরা নিজেরটা ছাড়া তামাম জগতকে পচা-গান্ধা মনে করে। মধ্যবিত্তকে বকাবাজি করার আগে একটিবার তারা স্মরণও করে না যে এরাও মধ্যবিত্ত। আবার সমাজপ্রগতির চালকরা এর জবাবে হয়ত বলেন – আরে হয় হয়, নিজের শ্রেণী থেকে বার হয়ে আসতে পারলে সবই হয়। জগতের তামাম মোহনীয় কাজ, প্রগতিশীল কর্মধারা তো এদের চেতনপ্রবাহেই সম্পন্ন হয়েছে। খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারলে অনেককিছুই হয়।
এমন যে কথকতার মধ্যবিত্ত তাদের নিয়ে সবচেয়ে নাড়া দেওয়ার মতো প্রবন্ধটি লেখেন আহমদ ছফা। তিনি লিখলেন, ‘বাঙালী মুসলমানের মন’। এ নামেই পরবর্তীসময়ে আমরা একটা প্রবন্ধগ্রন্থও পেলাম। আসলে আমাদের মধ্যবিত্ত যে আচ্ছন্নতায় কেমন বিভোর থাকে তা এতেও কিছুটা বোঝা যায়। এখানে বাঙালি মুসলমান বলতে যাদের বোঝানো হল এরা মূলত বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান। ছফা সাহেব দৃশ্যত আঁটঘাট বেঁধে, স্টাডি করে, পরিকল্পিতভাবে এ প্রবন্ধটি লেখেননি (মানসিকভাবে এর দীর্ঘপ্রস্তুতি যে ছিল তা তো বোঝাই যায়)। বলা যায় একধরনের উত্তেজনা, উতলা মন নিয়েই একরাতের ভিতরই এটি লিখে ফেলেছিলেন। কেন এত উত্তেজনা, কেন এমনতর ভয়ানক চিন্তার প্রসঙ্গ এল? এও এক মজার কিংবা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এটি লেখার পিছনে একটা ঘটনা ঘটেছিল। তখন জিয়াউর রহমানের শাসনকাল। লেখক আহমদ ছফা সেদিন সুহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকালবেলার হাঁটাচলা করছিলেন। হঠাৎই তিনি লক্ষ করলেন লেখক-বুদ্ধিজীবী আবুল ফজল মোটাতাজা উঁচালম্বা ফর্সামতন এক ভদ্রলোকের (এম.এ. তাওয়াব) সাথে বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছেন। আবুল ফজলের মাথায় গোল টুপি। তিনি জানালেন, সিরাত মাহফিলে যোগ দিতে চাচ্ছেন। তা তো হতেই পারে, সেনাশাসনের এক শিক্ষা উপদেষ্টা তো তা করতেই পারেন। কিন্তু নাস্তিকতার আজীবন প্রচারক ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সহসাই কী করে ধর্মকাতর হয়ে গেলেন সেখানেই আহমদ ছফার চরম বিস্ময়ের ব্যাপার। তিনি ধরে নিলেন এখানেই আছে বাঙালি মুসলমানের সঙ্কট, কী যেন আছে যেখানে তাদেরকে এক জায়গায় থাকতে দেয় না। ডানে বা বাঁয়ে হেলে পড়ে। ‘বাঙালী মুসলমানের মন’লেখাটিতে স্পিরিট যেমন আছে নিজেকে প্রকাশিত-বিকশিত এমনকি আগ্রহান্বিত করার কৌশলও আছে। দৃশ্যত কোনো ভয় বা পিছুটান আছে বলে মনে হয় না। তরতর করে লিখে গেছেন। একটা সোসাইটি বিশেষ করে কুসংস্কারমুক্ত মুসলমানের প্রতি তার পক্ষপাত বা কৌতুহলআশ্রিত টানও স্পষ্ট। মূলত কম-জানা, কুসংস্কারে ভরপুর, সোজা কথায় কাঠ-মোল্লাদের বিষয়-আশয় তার লেখার মূল কাঠামো নির্ণয় করেছে। একদিক থেকে এটিতে কুসংস্কারযুক্ত আর কুসংস্কারমুক্ত মুসলমানিত্বের দ্বন্দ্বই প্রাধান্য পেয়েছে। লেখাটিতে এটি স্পষ্ট যে, ধর্মের মৌল-তাড়না বা মূল-আবেদন বা প্রসার নিয়ে তাঁর কোনো বাড়তি কথা বা টেনশন নাই। বিজ্ঞান বা যুক্তি দিয়ে কিছু বাছবিচার করতে চাননি। এও বলা যায়, শুধুমাত্র একজন স্মার্ট, আধুনিক, শিক্ষিত ধর্মকোলাহলেদ্বিধাযুক্ত মানুষের অবজার্ভেশন নিয়ে ধর্মেল বেবাককিছু বোঝা মুশকিল। বাঙালী মুসলমানের মনে আবুল কাশেম ফজলুল হককে আধুনিক মুসলমান বলা হচ্ছে! তার নেতৃত্বে নিখিল প্রজা-সমিতি গঠন করা হয় ১৯২৯ সালে। এখানে দৃশ্যত কংগ্রেসঘেঁষা জাতীয়তাবাদীরা জোট বাধলেও আসলে এটা হয়ে গেল মুসলমানদেরই আরেক প্রতিষ্ঠান। কোনো নেতৃস্থানীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ের কংগ্রেস নেতা এতে যোগদান করেননি। সবাই ছিলেন মুসলিম সামন্ত স্বার্থের ধারক। এরা শেষ পর্যন্ত মুসলীম লিগের সাথে কোনো সংঘাতে না গিয়ে বরং গাঁটছড়া বাঁধে। জমিদারী প্রথার নিঃস্বার্থ বিলোপ বা প্রজার অনুকূলে কাজ করার কথা বললেও মুসলিম জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা পুষ্ট এক সংগঠন হয়। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ঋণ সালিসি বোর্ড গঠন করলেও অন্ত্যজ মুসলমানদের জন্য বড়ো কিছু করেননি। বরং কৃষক-প্রজা সমিতি শেষতক মুসলিম জাতীয়তাবাদ প্রত্যাশী একটা আঞ্চলিক দল হয়ে যায়। তিনিই ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব আনেন। এমনকি তাঁর দলটির ধারাবাহিক বিস্তার এমনই ছিল যে যার সাপোর্টাররা রাজনৈতিকভাবে পকিস্তানঘেঁষা মুসলিম জাগতিক প্রেরণাকে ধারণ করে এবং দলটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান শাসকদলের পক্ষ নেয়। এমনই এক ব্যক্তিত্বকে আহমদ ছফা কেন আধুনিকমনস্ক বলছেন? এমনকি তিনি ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার মূলে না-গিয়ে ধর্মের মৌলতার একধরনের জয়গানও গেয়েছেন। এতে তাঁকে আধুনিক মুসলিম জাগরণের লোক বলাটা খুব একটা অন্যায় হবে কি? মুসলিমদেরকে ভয়ের ভিতর, কুসংস্কারের ভিতর থাকা এক জাতি বলছেন কিন্তু ধর্মের অপরিহার্যতায় তা যে ঘটবেই তা বলার মানসিক তাড়না বা প্রস্তুতি তার ছিল না। তার একধরনের চিত্তব্যাকুলতাময় কোলাহল থাকলেও তাতে ধর্মের গোড়ামির অসারতার ব্যাপারে সন্দেহাতীত কিছু প্রকাশ পায় না। তিনি মনে করেন পাশ্চাত্যে বা স্পেনে একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রাধান্য পেয়েছে, উন্নতর দীপ্ত ধারার সভ্যতা এবং মহীয়ান সংস্কৃতির বাহন হয়েছে, সামাজিক বিপ্লব সাধন করেছে, তেমন প্রাধান্য বা চেতনার বিকাশ ঘটলে তাঁর হয়ত এধরনের প্রবন্ধ লেখার প্রয়োজনই হত না! এ-নিয়ে একধরনের আফসোসও তারও আছে। যারফলে এ লেখায় উতলা মনের পরিচয় আমরা পাই, কিন্তু তা ধর্মানুরাগ মুক্ত নয়। তবে তাতে স্বদেশপ্রীতি যেমন স্পষ্ট তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি একধরনের টানও ভালোই প্রকাশ পেয়েছে। তার মনোযাতনা বা হাহাকার শেষদিকে আরও স্পষ্ট হয়েছে, এখানে কিছু উল্লেখ করাও প্রয়োজন মনে করছি – ‘বাঙালী মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসা ভাসা ভাবে, অনেক কিছুই জানার ভান করে, আসলে তার জানাশোনার পরিধী খুবই সঙ্কুচিত। বাঙালী মুসলমানের মন এখনও একেবারে অপরিণত, সবচেয়ে মজার কথা এ-কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তর চেষ্টা করতে কসুর করে না। যেহেতু আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান এবং প্রসারমান যান্ত্রিক কৃতকৌশল স্বাভাবিকভাবে বিকাশলাভ করছে এবং একাংশ সুফলগুলোও ভোগ করছে, ফলে তার অবস্থা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এঁচড়ে পাকা শিশুর মতো। … সাবালক মন থেকেই উন্নত স্তরের সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ সম্ভব। এই সকল ক্ষেত্রে তার মনের সাবালকত্বের কোনো পরিচয় রাখতে পারেনি।’ এ-ভাবে তিনি নানান কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি থেকেছেন প্রায় শ্রেণী বা কৌশলনিরপেক্ষ মানুষ। বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানের মন কি ছফা ধরতে পারলেন, এ প্রশ্নও করা যায়, বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে বলতে নিয়ে নিজের বস্তুনিষ্ট বিশ্বাসকে কতটুকু ঝালাই করতে পারলেন, সেখানে আবেগের ধরনই-বা কেমন? শেষ পর্যন্ত হয়ত এ কথাও বলা যায়, এটি আসলে বাঙালি মধ্যবিত্তের মনকেই মধ্যবিত্তের মন নিয়ে খণ্ডিত-বিহ্বলতাই প্রতিষ্ঠিত করলেন! শ্রেণী বা ধর্মের ভিতরকার শক্তি বা উচ্ছ্বাস সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা দিলেন না। বলা যায়, একধরনের উপরি-আবেগ নিয়ে বাঙালি মুসলমানকে নির্ণয় করলেন। ধর্মের মৌলস্বরজনিত ব্যাপারটা সযত্নে দেখেননি বা এড়িয়ে গেছেন। এখানে আরও উপেক্ষিত হয়েছে মুসলমান ছাড়া ভিন্ন ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তার প্রেরণাময় টান বা যৌথসম্পর্কের বিষয়টি। বাঙালি মুসলমানের কথা বলতে গিয়ে অন্য সম্প্রদায় মানে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-পাহাড়ি বা সমতলের আদিবাসীদের কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। বাঙালি নানান ধর্মআশ্রিত এক জাতি। বাঙালির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ি-সমতলভূমির আদিবাসী। তাদেরকে বাদ দিয়ে শুধু বাঙালির উৎকণ্ঠা, ভয়, কৌতুহল বা মমতা বিকশিত হতে পারে না। একধরনের চিত্তচাঞ্চল্য বোধ করেন ছফা, তিনি ব্যথিত হন, উত্তেজিত অবস্থাতেই একরাতের ভিতর ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ নামের প্রবন্ধটি লিখে ফেলেন। এই যে লিখে ফেললেন, এখানে যেমন মধ্যচিত্তের অচিন রূপগন্ধময় ইতিবৃত্ত তৈরি হয়, তেমনি মধ্যবিত্তের একটা আচরণকে সমগ্র বাঙালি মুসলমানের উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা হতবিহ্বল করে। মূল কথা হচ্ছে, মধ্যবিত্তের ইতিহাস এমনই হতবিহ্বলতারই ইতিহাস।
এটাই স্বীকৃত কথা যে নবাব সিরাজুদ্দৌলা বিদায় নেওয়ার পরই মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি গড়ে ওঠার এক আলামত লক্ষ করা যায়। আসলে ঠিক তখন এস্টাব্লিস্ট মিড্ল ক্লাশ ছিল না, তবে মধ্যস্বত্বভোগী তো ঠিকই ছিল। প্রাসাদের গভীরে ষড়যন্ত্র ছিল, নবাবের ছন্নছাড়া এলোমেলো জীবন ছিল; তাঁর ছিল নারীদের প্রতি আপত্তিকর-পক্ষপাত। তবে এরচেয়ে বড়ো কথা উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, জগৎ শেঠরা তখন ব্যবসায়ী-সামন্তজন। তারা নবাবের চেয়েও ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির সাথে ব্যবসায়িক স্বার্থ বড়ো মনে করল। আর মীরজাফর তো ক্ষমতার লোভে ইংরেজদের সাথে সন্ধিই করে বসল। তখনও গ্রামে জমিদার শ্রেণী সেভাবে গড়ে ওঠেনি। মূলত গ্রাম্য মাতব্বর বা প্রতিনিধিরা সরকারের এজেন্ট হিসাবে কাজ করত। তবে এ এজেন্টদের প্রতিনিধি থাকত, কখনও কখনও মধ্যস্বত্বভোগী দ্বারাই রাষ্ট্র খাজনা আদায় করত। মুর্শিদকুলি খাঁর রাজত্বকালে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌড়-ঝাপ ছিল সবচেয়ে বেশি। তখন কৃষকের হাতে সম্পত্তি থাকত। সরকারের এই এজেন্টরা ছিল বর্ণহিন্দু। কৃষকরা বিশেষ করে পূর্ববাংলার কৃষকরা প্রায় সবাই তখন মুসলমান। এই যে ক্ষমতার হাতবদল বা রূপবদল হলো, তাতে অন্ত্যজ শ্রেণীর কৃষকের তেমন কোনো পরিবর্তন কিন্তু হয়নি। তবে রাজনীতিক পরিবর্তনে অর্থাৎ ১৭৮৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি যখন দিল্লীর সনদ সরাসরি পেল, তখনই মধ্যস্বত্বভোগী আর অন্ত্যজ কৃষকদেরকে রাজনীতির অংশ করতে লাগল। সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তনটি এল ১৭৯৩ সালে, নতুন ভূমি আইন হলো, জমিদারী প্রথা এল, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামীণ জীবনের অনেক পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। নায়েব, গোমস্তা, মধ্যস্বত্বভোগী, চাকুরে, ব্যবসায়ী, উকিল, মুহুরি, ডাক্তার দেখা যেতে লাগল। এরা সকলেই প্রায় বর্ণহিন্দু এবং এরাই মধ্যবিত্ত।
এই যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি গড়ে উঠল এদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ঠ্য কী? ইতিহাসই-বা কী। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, এ জাতির কোনো ইতিহাস নাই। এ জাতি বলতে তিনি কাদেরকে বুঝিয়েছেন? আর্যহিন্দুর কথাই বলেছেন। তিনি ইংরজদের লেখা ইতিহাসকে বাঙালির ইতিহাস বলতে রাজি নন। আর মুসলমানদের লেখা ইতিহাস মানার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ মুসলমানদের কখনও তিনি বাঙালি বলেননি। আবার আহমদ শরীফ জানাচ্ছেন, বাঙালির ভিতর মিশেছে অষ্ট্রিক-মঙ্গোলিয়-নিগ্র্রো-দ্রাবিড়-আর্য-পাঠান-মোগল-ইংরেজের রক্ত। তিনি জানাচ্ছেন, ৬০% অষ্ট্রেলীয়, ২০% মঙ্গোলীয়, ১৫% নেগ্রিটো আর ৫% ভাগ নানা নরগোষ্ঠীর মানুষ এখানে মিশেছে। নিষাদ, কোল, ভীল, মুণ্ডা, সাঁওতাল, শবর, পুলিন্দ, মালপাহাড়ি প্রভৃতি হচ্ছে অপেক্ষাকৃত স্বল্পসঙ্কর আদি অষ্ট্রিয় বা দ্রাবিড়। আর কিরাত, রাজবংশী, নাগা, মেচ, মিজো, কুকী, চাকমা, আরাকানি – এরা হচ্ছে স্বল্পসঙ্কর মঙ্গোলিয়। তবে আরও পরে কালের প্রবাহে গৌড়, মালব, চৌড়, খশ, হৃন, কুলিক, কর্ণাট, লাট, দ্রাবিড়, মুরণ্ডা, শক, কুশান, ইউচি, আরব, ইরানি, হাবসী, গ্রিক, তুর্কি, আফগান, মুঘল, পর্তুগিজ, গুলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজ রক্ত মিশেছে।
আমরা নিজেদেরকে বরাবরই ঐতিহ্যপিপাসু, অসাম্প্রদায়িক বলাতেও আমাদের মতো এত স্বপ্নবিলাসী কেউ নন। এখানে একটা বিষয় খুব সরাসরিই বোঝা যেতে পারে, অন্ত্যজ শ্রেণীর হিন্দু সম্প্রদায় কেন একবার বৌদ্ধ আবার মুসলমান হচ্ছে? আর এই যে ধর্মান্তর এটাকে আমরা বরাবরই মধ্যবিত্তের কথিত হিসাব-নিকাশে কখনও সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন থেকে মুক্ত-আচরণ, কখনও ধর্মভীরুতার প্রতি পক্ষপাত বলি। আমরা মধ্যচিত্তরা ধর্মের ব্যাপারটা এইটুকু বলেই ক্ষান্ত দিতে চাই যে ধর্ম হচ্ছে একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। এও বলা হয়, ব্যক্তির আচরণ, সরবতা-নীরবতা কেন সরকার বা রাষ্ট্র গ্রহণ করবে-এ তো অন্যায়, ভীষণ অপরাধ! আসল কথা হচ্ছে, আমাদের চেনাজানা প্রায় মধ্যবিত্তই এ-টুকুই জানিয়ে তাদের কর্তব্য, একে কর্তব্য না বলে নিজস্ব হিসাব-কিতাবই বলতে পারি, শেষ করতে চান। কে আর আহমদ শরীফ বা হুমায়ুন আজাদ হতে যাবেন। এত রিস্ক নিলে অস্তিত্বের উপর একটা চোট যে আসতে পারে! এ কালটাই হচ্ছে, কোনোভাবে নিজেদের ভালো-মন্দ দুই-চারটা কথা বলে নিজের বিষয়টা পাকাপোক্ত করার কাল। যারা একসময় ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্র মৈত্রী-ছাত্র ফ্রন্ট-ছাত্র ফেডারেশন বা অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হত, মিছিলে-শ্লোগানে-রক্তে-ঘামে রাজপথ রক্তাক্ত-স্বপ্নময় করত, এরাই এখন সাহিত্যচর্চার নামে, সংস্কৃতির নামে, সমাজসেবার নামে দৈনিক পত্রিকার নানান বান্ধব-সমাবেশ করছে। কলহাস্যময়, হয়ত যন্ত্রণাময় নানান নিরাপদ কাজ চালাচ্ছে। আরেক দল এনজিও’র রূপানলে, অর্থতৃষ্ণায় মুহুর্মুহু সিক্ত হচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে, দেশজ বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান তো একসময় অন্ত্যজ কৃষককুলের সন্তান ছিল। ধর্মীয় ঐতিহ্যে কেন মুসলমান হতে গেল? একধরনের সামাজিক-ব্যক্তিক আচরণ বদল ছাড়া তো এদের অধিকাংশের কিছুই হলো না। পার্থিব সুযোগ-সুবিধা বলতে গেলে কিছুই পায়নি। দৃশ্যত একধরনের সামাজিক-মানসিক প্রশান্তি হয়ত পেল। কারণ এখানে আর যায় হোক, ব্রাহ্মণ্যবাদীতার নিপীড়ন নেই। একধরনের সামাজিক সাম্য দেখা গেল। তবে একটা পরির্তন তাদের হল, এরা অতিমাত্রায় পরকালমুখাপেক্ষী হল, ইহাজাগতিক বহুমাত্রিক বর্ণবহুল হিন্দু-সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গেল। একেশ্বরবাদীতার এক কঠোর জীবন আর সংস্কৃতির ভিতরে তাদের নিমজ্জিত হতে হল। সনাতন হিন্দু ধর্ম ভারতবর্ষের জলবায়ুনদীনালাতপোবনঘেঁষা এক বহুমতের সাংস্কৃতিক বিচরণক্ষেত্র বলা যায়। যার সাথে দেশজ রূপলাবণ্যময় এক গন্ধ আছে। সেমেটিক কালচারে নিমজ্জিত এক ধর্মীয় আবেশে কিন্তু তা আর তার থাকল না। পরনির্ভর, ভিন্নজাতিগোষ্ঠীর এক কালচার তাদেরকে গ্রহণ করতে হল। ধর্মীয় দেশজ মিথ, শক্তি, বহুরূপীতা, নিজস্ব ঐশ্বিক প্রেরণা থেকে দূরের যাত্রী হতে থাকল। একটা চাপিয়ে দেয়া ধর্মজ সংস্কৃতি তাকে বহন করতে হলো।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমরা মধ্যবিত্তরা সামাজিক-রাষ্ট্রীয় আচরণের এই পরিবর্তনকে তেমন কিছুই মনে করি না। ধর্মভীরুতার উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে একধরনের কায়দা তৈরি করি। অল্পকথায় বলা যায়, ধর্ম হচ্ছে চলমান সমাজকাঠামোর এমন এক জীবন ভাবনা যেখানে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ভাববহুল আচরণকে গ্যারান্টি প্রদান করা যায়। ধর্মের ভাবনা কখনও ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে স্থায়ী হতে পারে না। যখনই বলা হয় ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তির লালন-পালনের একটা ব্যবস্থা; এতে এটুকু বোঝা যায়, এ ধারণা প্রচারকারী ধর্ম সম্পর্কে উদাসীনতার আশ্রয় নিয়ে এর দ্বারা কতিপয় কায়দাকে আত্মস্থ করতে চায়। ধর্মের গোড়ামির ইতিহাস সম্প্রদায়কে জারিত-মথিত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। ধর্মের এ-ধরনের বিস্তারে কিঞ্চিৎ প্রগতিশীলতা যে নেই তা কিন্তু নয়। অন্য ধর্মের উপর আধিপত্য-শ্রেষ্ঠত্ব-মাহাত্ম্য জাহির করতে চাইলে সেই ধর্ম আপনাতেই কতিপয় অগ্রসরমান ভাবনা বা জীবনাচার চর্চা করে। একেশ্বরবাদীতার প্রধান আহ্বানই হচ্ছে ঈশ্বরের বাইরে কোনো একক শক্তি নাই। ঈশ্বর সর্বদা এমনই দেয়াল নির্মাণ করতে জানেন যেখানে ধর্মের ভিন্ন আচরণ হবে বেদরকারী। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ধর্ম তো এত নিরীহ নয় যা ব্যক্তিকে ঘিরে চুপচাপ শুয়ে-বসে কালযাপন করবে। ধর্ম তার নিজের গরজেই চোটপাট তৈরি করে। মায়া-মমতা, আদর আপ্যায়নেও নিমগ্ন হয় কখনও কখনও। এর অন্তর্গত শক্তি বা স্পিরিট একধরনের আবেদন তৈরি করে রাখতে চায়। এও জানায়, ইহকাল-পরকালের সুখ বা জীবনাচার কেবল এখানেই আছে। ইসলাম মনে করে, কোনো বিধর্মী কখনও বেহেশতে যাওয়ার কোনো সুযোগই পাবে না। আর সনাতন ধর্মের লোকজন মনে করে পৃথিবীতে একটাই ধর্ম আছে তার নাম সনাতন ধর্ম, এর বাইরে যা আছে এর কোনোটাই প্রকৃত ধর্ম নয়, বিভিন্ন পথ বা মত মাত্র। এমনকি এরা এও বিশ্বাস করে, পৃথিবীতে মানবজাতির আছে ৯২ লক্ষ প্রজাতি। এর ভিতর অল্পকিছু মাত্র ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈশ্ব-নমশূদ্রের অন্তর্ভুক্ত এবং এরা শুদ্ধযোনিজাত। ধাঙ্গঢ়সহ অন্য মতের সবাই পাপযোনিজাত (সম্ভবত ৮৪ লক্ষ প্রজাতি)। তাহলে অতি প্রাথমিক ধারণাতেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায যে, ধর্মের গোড়ামির ভিতরই আছে শ্রেষ্ঠত্বের সারৎসার, কথিত সাম্প্রদায়িকতার উপাদান। আসলে যে-কোনো ধর্মই সর্বদা শ্রেষ্ঠতমত্বের আকাক্সক্ষাপিপাসু। আমরা ধর্মনিরপেক্ষ বলতে যা বোঝাতে চাই তা হলো অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতার চর্চা করা মাত্র। তবে মধ্যবিত্ত যে ধর্মের চর্চা করে থাকে তা কখনও ট্রাডিশনাল ধর্মের পরিপূর্ণ রূপ নয়। এমন কোনো সুযোগও ধর্মের থাকে বলে মনে হয় না। কারণ মধ্যবিত্তের সাথে ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশ জড়িয়ে পড়ে। এর যতই পিছুটান থাক, ব্যক্তির বিকাশ এতে কেনো না কোনো ভাবে ঘটবেই।
ইতোপূর্বে তাও বলা হলো যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির রাষ্ট্রীয় ইচ্ছায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে মধ্যবিত্তের আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। কৃষক তার স্বাধীন ভূমি অধিকার অনেকটাই হারায়। কম্পনি তার খাজনা আদায়কে কার্যকরভাবে ফলপ্রসু করতেই এই ব্যবস্থা নেয়। তবে এখানে এও স্মরণ করতে হয়, এই অঞ্চলের কৃষক মোগল আমলে বিশেষত সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলেই খাজনা সংক্রান্ত নিপীড়ন অধিকহারে ভোগ করে। সুলতানী আমলে বাংলার রাজা থেকে শুরু করে কৃষককুল অনেকটাই স্বাধীনতা পায়। মোগল সাম্রাজ্যে স্থানীয় সামাজিক-রাজনীতিক ব্যবস্থা থেকে অধিকমাত্রয় খাজনা বা নানান সুবিধা দিল্লীর দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বজায় রাখে।
কম্পানি আইনের ফলে কৃষক জমি থেকে তার সেই স্বাধীন অধিকার হারায়। ইংরেজরা নিয়োগ করতে থাকে বড়ো-মাঝারি-ছোট জমিদার। সরকারকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা দিয়ে এরা কৃষকদের কাছ থেকে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা খাজনা হিসাবে আদায় করত। এ কাজে নিয়োগ পায় গোমস্তা, নায়েব, লাঠিয়াল সর্দার। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি তাদের দাপ্তরিক কাজে নানান ধরনের চাকুরির সুযোগ দেয় মধ্যত্তিদের। এদের অনেকেই বর্ণহিন্দু। এ কাজে মুসলমান প্রায় ছিলই না বলা যায়। হিন্দু সম্প্রদায় কম্পানির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফার্সি শিখত। ইংরেজদের হিসাব বা ধারণা মতই সব করত। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, যেহেতু জমিদার শ্রেণীর ম্যাক্সিমামই ছিল বর্ণহিন্দু, কাজেই এরাও বর্ণহিন্দুদেরই নিয়োগ দিত। আর তখন বর্ণ বা ধর্মগত প্রভেদ বা হিংসা-দ্বেষ ছিল আরও বেশি। এমনও শোনা যায়, সেই সময়ের নিুশ্রেণীর হিন্দুদেরকে মন্দিরের আশপাশ ঘেঁষতে দেয়া হতো না। গীতা বা ধর্মগ্রন্থ পড়তে তো পারতই না, এমনকি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ব্রাহ্মণদের পাঠ শুনলেও কানে গরম তেল ঢেলে দেয়া হতো। এমনই হিন্দু যখন যবন হয়ে যেত, আলাদা সংস্কৃতির ধারক হয়ে যেতে লাগল, তাদের প্রতি স্বভাবতই রাগ বা শ্লেষ পোষণ করত এই বর্ণহিন্দু। আবার এলিট সোসাইটির অর্থাৎ আশরাফ শ্রেণীর মুসলমানদের সাথে এই নিুবর্গীয় মুসলমানদের পার্থক্য কম ছিল না। আশরাফ সম্প্রদায়ের অনেকেই হয়ত আরব-তুর্কি-আফগান ছিল কিংবা সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে নানান টাইটেল পেয়ে বা যোগাড় করে অন্ত্যজ মুসলমানদের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি করে রাখত। আশরাফ মুসলমান শ্রেণীটি আবার মুসলমান শাসন অবসানের পর ইংরেজদের সাথেও খুব বেশি যোগাযোগ রাখতে চায়নি। কাফের-নাসারার সংস্কৃতি বলে ইংরেজদের কাছাকাছি আসতে আগ্রহ দেখায়নি। পাশ্চাত্যের কথিত আধুনিক ধ্যান-ধারণাও গ্রহণ করতে পারেনি। যার ফলে মুসলমান কৃষক পরিবার থেকে মধ্যবিত্ত হওয়ার সমস্ত নিশানাই প্রায় রুদ্ধ হয়ে থাকে। এর ফলে ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার দ্বন্দ্বের জায়গাটা হতে থাকে মধ্যবিত্তেরই। এর ফল হিসাবে ভাবনা-চিন্তা আর সামাজিক চিন্তায় ব্যাপাক ফারাক দেখা যায়। হিন্দু সম্প্রদায় শিক্ষায়-পেশায়-চাকুরিসূত্রে অনেকটাই অগ্রগামী হয়ে থাকে। সেই হিসাবে মুসলমান মধ্যবিত্ত অনেকটাই পিছিয়ে পড়তে থাকে। পিছিয়ে থাকে লাইফস্টাইলে-চাকুরিতে, এমনকি সাম্প্রদায়িক ভাবনায়। ধর্মের একটা অবয়বগত পার্থক্যও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ধর্মের অবয়বে গড়ে ওঠা হিন্দুধর্ম কার্যত এক কালচারের নাম। এখানে বহুমত, ভাবনা এমনকি জীবনতৃষ্ণা মিলমিশ খেয়েছে। সামন্ত ধ্যান-ধারণার প্রতি একধরনের মোহাচ্ছন্নতা মুসলমান সম্প্রদায়ে বেশি ছিল। তবে এ অবস্থার যে কোনোই পরিবর্তন হয়নি তা বলা যাবে না। আঠার শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই মুসলমানদের ভিতরও কথিত আধুনিক শিক্ষার প্রতি টান লক্ষ করা যায়। এখানেও দারুণ বৈষম্য ছিল। হিন্দু সম্প্রদায় প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ইংরেজদের কাছ থেকে যত সহযোগিতা পেয়েছে মুসলমানরা এর অনেক কিছুই পায়নি।
তবে এমন জীপনযাপনও ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিতর উপনিবেশবাদী কম্পানির প্রতি বিদ্রোহ-বিদ্বেষ ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে। চাকুরি-সামাজিক ক্রিয়াকলাপে তাদের আধিপত্য বাড়ানোর এক স্পৃহা কার্যকর হতে থাকে। মুসলমান সম্প্রদায়ও শিক্ষায়, চলনে, বলনে অগ্রসর হতে থাকে। এমনকি নওয়াব আবদুল লতিফ ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে (প্রাক্তন হিন্দু কলেজ) মুসলিম ছাত্রদের পড়াশোনা করার অধিকার আদায় করতে পারেন। সামাজিক-রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপট বদলে যেতে থাকে। এরও আগে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ঘটে সিপাহী বিদ্রোহ। এমনই প্রচার পায় যে মুসলিম সৈন্যদের জন্য সরবরাহকৃত বন্দুকের টোটায় শুকরের চর্বি আর হিন্দু সম্প্রদায়ের টোটায় গরুর চর্বি দেয়া হয়েছে। দারুণ বিদ্রোহ দেখা যায় তখন সৈন্যদের ভিতর। মুসলমানের ভিতরে ছিল তীব্র দ্রোহ এমনকি এর রেশও ছিল অনেকদিন। এতে সনাতন হিন্দু দারুণ ক্ষিপ্ত হয়। মুসলমানদের এমন আচরণ তারাও সহ্য করতে পারেনি। এমনকি বিজ্ঞানমনষ্ক-অতি সচেতন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও বলতেন, এটা মুসলমানদের উদ্যত আচরণ, বলতে গেলে মায়ের কোলে শিশু যেমন নিরাপদ থাকে তেমনি ব্রিটিশদের অধীনে আমরা নিরাপদেই আছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গোরা নামের উপন্যাসে এই দ্রোহকে মিউটিনি বলেছেন। তবে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে মুসলমানদের প্রতি উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের পেষণমূলক আচরণ কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারেন। তিনি একসময় স্পষ্টতই বলতেন মুসলিম একটা প্রাবল্যবাদী ধর্ম, এরা অন্যের মতকে নিশ্চেষ্ট করেই সামনে এগোয়। তিনি তো ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গের সরাসরি বিরোধিতাই করেন। এটা ঠিক, বঙ্গভঙ্গ ছিল হিন্দু-মুসলমানকে রাজনৈতিকভাবে আলাদা করার একটা ঔপনিবেশিক কৌশল। তবে এও স্বীকার করতেই হবে, তারও আগে থেকেই মুসলমানদের ভিতর, বিশেষ করে মধ্যবিত্তের ভিতর একদিকে ইংরেজ শাসন, অন্যদিকে বর্ণহিন্দুদের বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্তি চাওয়ার আকাক্সক্ষা বাড়ছিল। সম্প্রদায়ভিত্তিক এ আচরণই ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি কাজে লাগায়। একসময় বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও অধিকাংশ মুসলমানই আলাদা প্রশাসন পাওযার নেশা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। যারফলে এর পর থেকে কখনও মুসলিম লীগ, কখনও কৃষক প্রজা সমিতির পিছ ধরে আলাদা শাসনে থাকার মানসিকতাকে জিইয়ে রাখে। তবে এতে নিুবিত্তের হিন্দু-মুসলমানের ভিতর লোকজ জীবনাচার খুব বেশি আলাদা থাকেনি। ওই যে বলা হচ্ছিল রবিঠাকুরের কথা, এখানে তাঁর হিসাবি আচরণ বেশ কৌতুহলোদ্দীক। বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য অন্যান্য উচ্চমানসম্পন্ন হিন্দু জমিদারদের সাথে রীতিমতো উঠে-পড়ে লাগলেন তিনি। চাঁদা আদায়ে শরীক হলেন, উদাত্ত কণ্ঠে বক্তব্য রাখলেন। তা সেই একবছরই, এরপর আর রাজনীতিতে তাঁকে দেখা যায়নি। তিনি অন্তত এইটুকু বুঝতে পেরেছিলেন, উদীয়মান মুসলিম মধ্যবিত্তকে ক্ষেপিয়ে নিজের অমরত্ব খণ্ডিত করার কোনো মানে হয় না। যারফলে মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থানের সাথে সাথে তার কৌশলী আচরণও বদলাতে থাকে। তিরিশের দশকে শুধু ধর্ম নিয়ে সবকিছু বিচার না করার কথা বলেন। হিন্দু ধর্মের আশ্রয়ে বীভংসতা আর অন্ধতাকে নাস্তিকতার চেয়েও খারাপ বললেন। তবে এ কথা তিনি বলেননি, নাস্তিকতাও সনাতন হিন্দুধর্মের একটা পথ। কেউ নাস্তিক হলেই হিন্দুত্ব থেকে খারিজ হয়ে যান না। এমন চমক আমরা তাঁর লেখায় কখনও কখনও দেখি। এও সত্যি যে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের জন্য, আমাদের সংস্কৃতির জন্য অবশ্যই একজন অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তার কৌশল, হিসাব-কিতাবকে ভুলে গেলে জাতিসত্তার মৌলস্বর যথার্থভাবে নির্মাণ করা যাবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, রবীন্দ্র-সুন্নতে মুগ্ধ হলে কোনোদিন তাঁর মূল প্রবণতাকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। তিনি মূলত নানাবিধ কম্পোজিশনের এক অপার সমুদ্র। তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও সনাতন ধর্মের অনেক আচরণই মানা হয। মূল কথা হচ্ছে, এটাই বারবার ঘুরেফিরে আসে যে, ধর্ম আর ধর্মনির্ভর সম্প্রদায়কে কখনও আলাদা করা যায়নি। আর এ-সব সোজাসাপ্টা বিষয় অস্বীকার করলে ধর্মের মৌল-উপাদানকেই অস্বীকার করা হয়।
যাই হোক, বাঙালি মধ্যবিত্তের উপর ভর করে যে মুসলীম লীগ গঠিত হল ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে, তাই সাংগঠনিকভাবে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে ভোটাভুটিতে জাতিগত আইন পাস করে সেই জাতিগত ব্যাকুলতাকে আরও বাড়িয়ে দেয় সরকার। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সেই আবেগ, ব্যাকুলতা, মনোযাতনা হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ভিতর বর্ধনশীল হয়। একপর্যায়ে মাড়োয়ারি-টাটা-বিড়ালার ব্যবসায়ীরা চাইল রাজনীতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সারা ভারতবর্ষে তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে। অন্যদিকে আদমজী-ইস্পাহানী নিয়ন্ত্রিত মুসলিম লীগ তা কেন মানতে যাবে? তারা তখন ধর্মজ জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তোলে ভারতবর্ষের পশ্চিম ও পূর্ব অংশের উপর আধিপত্য করার নেশায় মত্ত। এখানে আরেকটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে, হিন্দু এলিট সোসাইটির সাথে বৃটিশ উপনিবেশের যেমন স্বার্থগত দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তেমনি উপনিবেশবাদী ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি আর কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সাথে পূর্ববঙ্গে মুসলিম নিয়ন্ত্রিত উঠতি শক্তপোক্ত হতে থাকা মধ্যবিত্তেরও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। প্রসঙ্গত স্মরণ করতে হয়, ফজলুল হক নিয়ন্ত্রিত কৃষক প্রজা পার্টির উত্থান এবং এর বিকাশও অত্যন্ত সরল। এরা দৃশ্যত কংগ্রেসঘেঁষা হলেও বাংলার কৃষককুলের নানাবিধ দাবি-দাওয়া উত্থাপন করায়, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের বিষয়টি জোরেসোরে বলতে থাকায় মুসলিম কৃষকদের ভিতর সংগঠনটি অনেকটা দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উচ্চবর্ণের হিন্দুবহুল কংগ্রেস কখনও জমিদারী প্রথা বিলোপের প্রস্তাব আনেনি। এমনকি মুসলিম লীগের বা কৃষক প্রজা পার্টির এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে। এমনকি এরা সংস্কৃতি রক্ষার নামে, সাহিত্যের কাঠামো, আভিজাত্য নির্মাণের নামে, চলমান বাস্তবতা বজায় রাখার কৌশল নির্মাণ করার নামে, জমিদারি কাঠামো বহাল রাখার প্রস্তাব আনে।
১৯৩৬ সালে যে প্রাদেশিক পরিষদের আইন সভার নির্বাচন হল সেখানে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে এটা প্রায় সুনিশ্চিত হতে থাকে যে মুসলিম জনগোষ্ঠী আলাদা প্রসাশনিক কাঠামো বা ব্যবস্থা করার প্রয়াজনীয়তা বোধ করছে। কাজেই এটা বলা যেতে পারে লাহোর প্রস্তাবটি আগে থেকেই ধীরে ধীরে একটা পরিণতি পেয়ে গিয়েছিল। এর প্রস্তাবক যে আবুল কাশেম ফজলুল হক তো তো ইতোপূর্বে বলাই হয়েছে। ধর্মজ আন্দোলনকে সামগ্রিকভাবে অস্বীকার করা যায় কি? এমনকি চার দশকের মাঝামাঝি সময়ে তেভাগা আন্দোলন যেখানে পরিণত হয়ে পূর্ণাঙ্গ আন্দোলনে রূপ নেয়, যা সম্পূর্ণ প্রগতিবাদী একটা আন্দোলন ছিল, সেখানেও জোতদার-মহাজন আর জমিদাররা একজোট হয়ে এটাকে কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক অবয়ব দিতে পারল। যেখানে ফসলের তিনভাগের দুই ভাগ পাবে আধিয়ার, একভাগ পাবে জমির মালিক; জমির ফসল উঠবে আধিয়ারের গোলায়, জমিতে দখলিস্বত্ব থাকবে আধিয়ারের। বৃহৎ বঙ্গের সেই আমলের ১৭টি জেলায় তা ছড়িয়ে পড়ে। যার নেতৃত্বে ছিল কৃষক সমিতি। এখানে বিষয়টি উল্লেখ করতে হয় যে, বেশির ভাগ কৃষকই ছিল মুসলমান, জমিদার ছিল উচ্চবিত্তের বর্ণহিন্দু। এখানেও লুক্কায়িত সাম্প্রদায়িক বীজ ফণা তোলে! যার ফলে এমনই এক ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামকে হিন্দু জমিদার আর মুসলমান জোতদার-মহাজনরা সাম্প্রদায়িক একটা অবয়ব নির্মাণ করতে পারল! কয়েক জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হল। ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার এমনই এক জটিল অবস্থায় বৃটিশ প্রশাসন পাকিস্তান আর হিন্দুস্থান নামের দুটি দেশ রাজনীতিবিদদের হস্তাস্তর করল। দেশ তো ভাগ হল, বাংলাদেশ মানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলমান খুবই উৎফুল্ল তখন। তাদের এই উৎফুল্লভাবে চরা জমতে, ঘাম-রক্তে ভিজতে খুব সময় লাগেনি। বছর দুয়েক মনে হলো যে এদেশের রাজনীতিবিদরা নিজেদের লোভে সাংগঠনিক অদক্ষতায় সাধারণ জনগণকে ঠিক সন্তুষ্ঠ করতে পারছে না। কিন্তু প্রায়-উপনিবেশ সৃষ্টি করা পাকিস্তানি শাসকরা ভাষার উপর আঘাত করল-অর্থনৈতিক শোষণে জর্জরিত করতে থাকল। সাংস্কৃতিকভাবে, পেশায় করল অবহেলা। বহুলাংশে তা করল ধর্মের নামে। মুসলমানিত্বের নামে। এর ভিতর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ দানা বাঁধছে। এদেশিয় মধ্যবিত্ত আরও মাথাচাড়া দিচ্ছে। এই অবস্থায় এদেশের সমতলবাসী বুঝতে থাকল ভাষাভিত্তিক বাঙালিত্বের জাগরণ ছাড়া মুক্তি নেই। ভাষাকে, দেশকে, দেশের মানুষকে এক দাবির আওতায় আনা দরকার। এটা বলা যায়, পাকিস্তানী আমলেই বাঙালি মুসলমানও বুঝতে থাকল ভাষাভিত্তিক ঐক্য দরকার। এর আগে বাঙালিত্বের ব্যাপারটা যে তীব্র ছিল না, তা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এমনকি শরৎচন্দ্র পাঠ করলেও বোঝা যায়। বাঙালিত্বকে বঙ্কিমচন্দ্র বরাবরই আর্যরক্তের সাথে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন। উনিশ শতকেও বাঙালি মুসলমানদের ভিতর বাঙালিত্ব আবিষ্কারের মতো সামাজিক ভিত্তি যে ছিল না সেটা তো শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তেও পাওয়া যায়। তখনও এই পাড়ার বাঙালির সাথে ওই পাড়ার মুসলমানদের ফুটবল ম্যাচ হত। শরৎচন্দ্র নিশ্চয়ই ধর্মীয় কোনো আবহ থেকে কথাটি বলেননি, সামাজিক বিন্যাস বা আচরণই এমনটি ছিল। পশ্চিমবঙ্গে সেই প্রবহমানতা এখনও আছে। দুর্গা পূজাকে সবসময় বলা হয় বাঙালির শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব। ওরা কখনও বলে না এটি হিন্দু বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। বরং এরা ভুলেই যায় যে সেখানেও মুসলমান, শিখ, জৈন, খিষ্টান, বৌদ্ধদের বাস আছে।
এদেশের ছাত্র-জনতা তখন মিলিটারিঘেঁষা পাকিস্তানি শাসকদের জোকের-মতো-রক্ত-চুষে-নেয়ার ব্যাপার জেনে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের সাথে গ্রাম-গঞ্জের অতি সাধারণ মানুষও তীব্র-তীক্ষ্ন নেশায় সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তি চায়। ৭০-এর নিবাচনে এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তির দাবি আরও স্পষ্ট হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক, আর্মি, এলিট সোসাইটি তা মানবে কেন? এ অঞ্চলের মানুষজন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তির নেশায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করল। জাতিগত ইতিহাসের এমন একপর্যায় এটি যেখানে সাধারণ জনতা উঠতি মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের রাজনীতিক নেতৃত্বকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে এল। প্রাণপণ যুদ্ধ করল হানাদার পাক বাহিনী, এদেশিয় রাজাকার-আল, বদর-আল শামসদের বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হলো। ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি হল নিষিদ্ধ। একশ্রেণীর মধ্যবিত্ত স্বাধীন দেশে স্বাধীন ধাঁচে লুটপাট শুরু করল। আরেক ধরনের মধ্যবিত্ত হলো আশাহত। আরেক যুদ্ধে অংশ নিল এরা; দেশটাকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত করার যুদ্ধ। অতি দ্রুত বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির উত্থান ঘটল। আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির প্রতি মধ্যবিত্ত এমনকি অতি সাধারণ জনতা একাত্ম হতে থাকল। একদিকে দেশগড়ার কথা, অন্যদিকে মধ্যবিত্তের লুন্ঠণজীবীতা, আরেকদিকে অতি বাম রাজনীতির দ্রুত উত্থান সারাদেশটায় এক অচল ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হল। অন্যদিকে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও সাধারণ ক্ষমার আওতায় স্বাধীনতা যুদ্ধের অধিকাংশ অপশক্তি স্বাধীন দেশের স্বাধীন আলো-বাতাস খাওয়ার সুযোগ পেল। মসজিদ-মাদ্রাসা, অন্যসব ধর্ম-প্রতিষ্ঠান ঘিরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবস্থান ভিতরে ভিতরে দৃঢ় হতে থাকল। এমনই অরাজক অবস্থায় পচাত্তরের ১৫ই অগাস্টের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ঘটে গেল। শেখ মুজিবসহ তাঁর আত্মীয় পরিজন নিহত হলেন। দেশ ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার দিকে আরও হেলতে লাগল।
সামরিক-বেসামরিক-একদলীয়-বহুদলীয় গণতন্ত্র পেরিয়ে আমাদের এই বাংলাদেশে এক শাসন নামে – রক্ত-পুঁজ-লাম্পট্যময় সেই শাসন, যার নাম এরশাদের স্বৈরশাসন। জীবনে, রাজনীতিতে, সমাজে, রাষ্ট্রে, এমন কোথাও নাই যেখানে এ শাসনের নগ্ন ছোঁয়া লাগেনি। একসময় মিলিটারির দুপদাপে ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতা আর তরতাজা হতে থাকল। রাষ্ট্রধর্ম হলো ইসলাম। রেডক্রস সোসাইটি হয়ে গেল রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি। ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির বা অর্জনের জন্য পাওয়া গেল হিন্দু-বৌদ্ধ-খিষ্টান সংঘ। তবে তখন শহুরে মধ্যবিত্ত ছিল দারুণ ক্ষেপাটে, তুমুল শ্লোগানমুখর। শহরে, এমনকি গ্রামে-গঞ্জে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। একসময় স্বৈরশাসন বিদায় নেয়। সংসদীয় নির্বাচন হয়, সরকার বদল হয়, নিয়মও কিছু বদলায়। কিন্তু রাষ্ট্র থেকে স্বৈরাচারের অপছায়া নোংরা গন্ধ নিয়ে বহমান থাকে।
তবে এখন আর সেই মধ্যবিত্ত নেই, সাংস্কৃতিকভাবে সেই তেজ যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে কেবলই। ইতিহাসও যেন তাদের উপর থেকে সেই স্পৃহা ম্রিয়মাণ করে দিচ্ছে। সেই স্বৈরশাসন বিদায় বিদায় নিলেও এর সাংস্কৃতিক-জাগতিক কৌশল যেন রয়েই গেল। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অনেকেই এমন কায়দা প্রয়োগ করে যেন এরশাদের আগে বা পরে কোনো অপশাসন ছিল না। মেন্দামার্কা মধ্যবিত্তের এ এক সুবিধাই হল, স্বৈরাচারের একটা চিরকালীন চরিত্র ও গালি পয়দা করে নিতে পারল।
শঙ্কর বাঙালি জাতি বহুবিধ সাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার দিকে গেছে। টানাপড়েন, পিছুটান, অগ্রটান, মধ্যটান ইত্যাকার নানাবিধ আচরণে নিজেদের জড়িত করেছে এবং এখনও তা করছে। যে আহমদ ছফা ধর্মে জিগির তোলা আবুল ফজলকে দেখে চমকে গেলেন, আমরা কতিপয় হতবিহ্বল পাঠক বা দর্শক আরেক সময়ে আবারও চমকে গেলাম। দেখা গেল, ছফা ইসলামি জীবনকে নিপুণভাবে বোঝার গল্পে নিজেই মিলাদ মাহফিলে চলে যাচ্ছেন, মোল্লা-মুসল্লিদের সাথে একেশ্বরবাদী সমাজবাদ কায়েমের আকার-ইঙ্গিত তৈরি করছেন। আমরা আরও পূর্বের ইতিহাসে নিমগ্ন হতে পারি যেখানে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে নিমগ্ন হচ্ছেন। একেশ্বরবাদীদের ঈশ্বরের আদলে ব্রহ্মের ধারণা আনার পারিবারিক বা সামাজিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখছেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরাবাড়ি থেকে প্রতীমা বিদায় নিচ্ছে। এও হচ্ছে ইউরোপীয় আধুনিকতা নির্মাণের আরেক কৌশল। আসলে মধ্যবিত্ত তার অনেক কাজই মেধার স্ফূরণ ঘটিয়ে করে। প্রশাসনের কাছাকাছি থেকে নিজেদের কাজটা আদায় করে নেয়। বঙ্গদেশের মধ্যবিত্ত আলাদা তো কিছু নয়। ব্রিটিশ আমলে বর্ণহিন্দুর উচ্চমধ্যবিত্ত, সাধারণ মধ্যবিত্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি থেকে নিজেদের কাজটা আদায় করছিল। লোকজীবনের অন্ত্যজ শ্রেণী এ-সব টেরও পাচ্ছে না। মুসলমান মধ্যবিত্ত নিজেদেরকে গুছিয়ে নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হল। এমনিভাবে নানান পর্যায়ে মধ্যবিত্ত নিজেদের কাজটা করে নেয়। সমস্ত কাজ মধ্যবিত্তের ধ্যান-ধারণা পুষ্ট হলেও মাঠে-ময়দানে নেমে যায় বা নামিয়ে দেয়া হয় অন্ত্যজ শ্রেণীকে। বুর্জোয়া রাজনীতিতে সমাজে বা রাষ্ট্রে বড়ো কোনো পরিবর্তন হলেও এবং তাতে নিুবর্গীয় মানুষজন যুক্ত হলেও তার রেজাল্ট সাধারণত পায় মধ্যবিত্তই। এমনকি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও চতুর মধ্যবিত্তের ইশারায় হলেও মাঠে দেখা যায় অবুঝ বা লুম্পেন অন্ত্যজ শ্রেণীকেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষ অধিক হারে যোগ দিলেও জাগতিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত ব্যবসা ভালোই চেনে। নিজেকে নিয়ে, পরকে খাটিয়ে, ইতিহাস, ঐতিহ্য, অভ্যুত্থান, আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, এমনকি মুগ্ধতা-প্রেম-স্নেহ নিয়েও বাণিজ্য করতে জানে। একহিসাবে মধ্যবিত্তের ইতিহাস বাণিজ্যেরই ইতিহাস। বিহ্বলতাও বাণিজ্যময়তার সারৎসার থেকেই পয়দা হতে পারে। এতকিছু নেতিবাচক কথকতার মাঝে ইতিবাচক ইতিহাসও যুক্ত হয় নিশ্চয়ই – তেজোদীপ্ত, প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত অসীম ত্যাগ, লাঞ্ছনাও সহ্য করেছে বা এখনও করছে।
এখন মধ্যবিত্তের অবস্থা কি? তার সঠিক কথকতা নির্ণয় করা খুব মুশকিল। তবে গড়পরতা ধরনে এমন বলা যায় যে, এত এলোমেলো, আখের গোছানোর নিশানা সম্পন্ন মধ্যবিত্ত ইতোপূর্বে দেখা গেছে বলে তো মনে হয় না। গ্লোবালাইজেশন, এনজিও, ক্যাবল নেটওয়ার্ক আর ইন্টারনেটের মায়া-মহব্বতে আটকা পড়ে অনেক মধ্যবিত্ত ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার আরও কাছাকাছি আসছে। হয়ত তালেবানী জোশে নিমগ্ন থাকছে কেউ। কেবলই অন্ধাকারের গভীরের তীক্ষ্ন অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে যাচ্ছে এরা। এই অবস্থা আর কতদিন চলবে? এটা বলা খুব মুশকিল। রাষ্ট্রের এ চরিত্র রেখে, সংবিধানের চলমান রূপ বজায় রেখে ধর্মান্ধ বা ধর্মভীরুতার কোনো পরিবর্তন হবে কি? যুক্তি আর বিজ্ঞানমনষ্কতা ছাড়া এ অন্ধতা বা ভীরুতা দূর করা একেবারেই সম্ভব নয়। এ কথা বলা যায়, ধর্মভিত্তিক অশুভ প্রয়াসকে রুখতে হলে প্রগতিশীল সুস্থ শক্তির উত্থান জরুরি।
সূত্র: কথাশিল্পের জল-হাওয়া (ফ্রেব্রুয়ারি ২০১৩, শুদ্ধস্বর)
Kamruzzaman Jahangir (31 January 1963 – 7 March 2015) was a novelist and literary critic. His many publications include five novels, five short stories, four literary criticism & prose, and a collection of interviews. He was also the editor of little magazine Kotha.
More Posts From this Author:
- None Found