প্রশ্নোত্তর:
শুদ্ধস্বর: কবিতা লিখতে হবে বা কবিতা লেখার জন্য তাড়না বোধের ব্যাপারটা প্রথম কিভাবে অনুভব (মানসিক অবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবে শের সাথে সংশ্লেষ) করতে শুরু করলেন?
জহির হাসান: এই উত্তরটা অনেক বারই দিছি। আমি লিখালেখিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণি হইতেই আছি। প্রথম যেদিন পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হয়, মনে হইছিল আজ ঈদ, মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। হা হা।
শুদ্ধস্বর:আপনার কবিতার সমসাময়িকতা, রাজনৈতিক বোধ, নিজস্ব ভাষা শৈলির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত ভাবে শুনতে আগ্রহী।
জহির হাসান: আমি নব্বই দশকের সময়সীমার মধ্যে লিখালেখি আরম্ভ করছি। এখনো করতেছি। তো নিজেরে নব্বই দশকের ভিতর আটকাই রাখতে চাই না। আমি যখন লিখি তখন অতীতের সকল লেখকের বয়ান আমার মধ্যে হাজির থাকে। তা হাজির না থাকলে আমার লিখায় আগের চিন্তার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। নতুন চিন্তা না আসলে নতুন ভাষাও আসে না। ফলে নতুন কিছু লিখার সম্ভবনা উধাও হইয়া যাইবে। লিখক তার আগের লিখককুলের চিন্তাভাবনারে কাজে লাগাইবে, ব্যবহার করবে, বাদ দিবে- এইভাবে নতুন বয়ানের জন্ম হয়। এইসব না করলে সাহিত্যের পরিধি বাড়বে কেমনে!
তবে ইমিডিয়েট সময়কাল আশির কবিতার একটা সমালোচনা আমাদের নব্বইয়ের কয়েকজন কবির ভিতর হাজির আছে। আশির প্রভাবশালী কিছু কবির কবিতায় ইউরোপ কেন্দ্রিকতা দেখা দেয়। যেইখানে উল্লেখযোগ্য বাংলামূলক দেশকাল সমাজ মাটির গন্ধ ধরার খায়েস স্বপ্নমাখা রঙধনু তাদের কবিতায় আভা আকারেও আসে নাই।কিছু গভীর আবেগ-অনুভূতি আসছে তা ক্রিশ্চিয়ান স্পিরিটের জায়গা থাকি। ঐসময় ইউরোপীয় অস্তিত্ববাদ ও ফরাসি চিত্রকলা-কবিতায় প্রভাববিস্তারকারী অবচেতনধর্মী কবিতার সেবা তারা করছেন। তাদের কবিতা অনেকটাই ক্লিশে জর্জরিত। আমরা আমাদের চোখ নিজের দিকে ফেরাইতে শুরু করলাম। নিজের ঘর কোনটা বুঝার তাগিদ অনুভব করলাম। উনাদের মতো বিদেশি সাহিত্য বৈদেশিক সাহিত্যকে আত্নস্থ করার দরকার হয় নাই। তবে আমাদের এশিয়ার সাহিত্যকে বুঝার জানার দরকার আগে। বিশেষ করি উর্দু, মালয়লাম, হিন্দী ভাষার সাহিত্য বুঝা জরুরি।
বিদেশি সাহিত্য আমাদের দৃষ্টির প্রসারের জন্য প্রয়োজন, উহা তবে এসেনশিয়াল নহে। বরং বৈদেশিক সাহিত্য পাঠ করিব, আমাদের খেয়ালে রাখিব, তা আমাদের বিনোদনের বস্তু বটে, তাহা আমাদের সাহিত্যের বাতিঘর না। এই জায়গাটা আমাদের বুঝে ছিল। তাই বিশেষ করি আমার কবিতা ও গদ্যকর্ম সেই পজিশনটার একটা হদিস পাইবেন। নিজের শরীরের খবর বেখবর হইলে আপনা আত্মার সৌরভ কেমনে পাইবো।
কোনো লিখকের রাজনৈতিক পার্টিম্যানদের মতো রাজনীতির জ্ঞান দরকার নাই। লিখকের রাজনৈতিক বোধ চিন্তা জরুরি বটে। কারণ একজন লিখকের দেশ এক কথায় মুছিয়া আন্তর্জাতিক বনে যাইতে পারে না! নিজের দেশজাতি কওমের স্বার্থ ইতিহাস বিষয়ে পরিষ্কার বুঝ না থাকলে তার সাহিত্যে মানুষ উধাও হইতে বাধ্য।
নিছক কল্পনা দিয়া সাহিত্যজীবন পার করি দেওয়ার কোনো মানে নাই! দেশে দেশে এক ধর্মগোষ্ঠী আরেক ধর্মগোষ্ঠীরে যুগে যুগে নির্যাতন চালাইতেছে! এইসব নির্যাতন, রাজনৈতিক অধিকার হরণের মতো বিষযয় সংবেদনশীল কবি মাত্রই অবশ্যই এনকাউন্টার করবেন তার বিবিধ লিখায়। কবিদের লিখকদের গজদন্তমিনারে বসিয়া থাকার কাল বহু আগ হইতে শেষ! তবে বিশেষ মতাদর্শে কবি লিখক আত্মাহুতি দিক এ আমার পছন্দ না। কবি শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের মানুষের দেশের পরিবেশের প্রতি ব্যাকুলতা থাকবেই । তারা বিশেষ রাজনৈতিক দলের অধীন চেতনার দাসবৃত্তী করুক তা লজ্জার বটে। যেকোনো স্বৈরাচারিতা, বৈষম্যমূলক অনাচারের প্রতি কবির অনাস্থা প্রতিবাদ তার ভাষার ভিতর জারি থাকবে চিরকাল।
একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়া বাংলাদেশের জন্ম। গত ৫০ বছরে এ দেশের মানুষের ন্যূনতম সাংবিধানিক স্বাধীনতা ও অধিকার, সাম্য ও সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রাতিষ্ঠানিকতার রূপ পায় নাই। একটা উপনিবেশিক শাসনের পর আরেকটা ছদ্ম উপনিবেশিকতার মধ্যে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ এ দেশের নিজস্ব শিল্পের বিকাশের মধ্য দিয়া নিজের পায়ের দাঁড়াইতে চাইছিল। এ দেশের পাটশিল্প, বস্ত্রশিল্পের আজ আর সেই ঐতিহ্য নাই। কৃষিজমি সব কোম্পানি ব্যবসায়ী শ্রেণির হাতে চলি গেছে। ধান তরকারী ফলানোর জায়গাটুকুও চাষাদের কাছে রইবে না। কৃষিভিত্তিক সামাজ আমাদের শক্তির বড় জায়গা ছিল। গত চার-পাঁচ দশকে এদেশ দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের হাত হইতে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী লুটেরা বাহিনীর হাতে চলি গেছে। তাই আজ আমাদের আপনা রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক লড়াই জারি থাকুক। বাংলাদেশকে ভালোবাসার বিকল্প নাই । এই ভালোবাসা জাতীয়তাবাদের উগ্রতা চর্চায় পর্যবসিত না হয় সেই দিকে নজর রাখতে হবে।
আমি গোড়া থাকিই ভাষা প্রশ্নে সোচ্চার ছিলাম। আমি মনে করি চিন্তা ও ভাষা কয়েনের মতো এপিঠ-ওপিঠ। কেউ আগে বা পরে না। ভাব ও ভাষা টুইন চাইল্ড। নিজ চিন্তা ও নিজ ভাষায় গীত গাইলে মোর অন্তর জুড়ায়। পরভাষার প্রতি ভক্তি রহে সদা। নিজ মায়ের কথ্য ভাষাই সাহিত্যের কবিতার ভাষা হই উঠা উচিত। এই গীত বহুদিন ধরি গাইতেছি। আর নিজ একটা ভাষারীতি তৈয়ার হইছে এতাদিনে যাতে ভালোমতো তোতলাইতে পারি, চিন্তা-ভাবনা করতে পারি, একটা ভাষার ঘর যেন মোর রহে চিরকাল, তা যেন ভাঙি না পড়ে কোনো ঝড়ে।
শুদ্ধস্বর: কবিতার শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা ও অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
জহির হাসান: রাজনীতি সচেতন একজন লিখকের চৈতন্যের ভিতর রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্ম সভা করে সদা। রাষ্ট্র , সমাজ ও সাহিত্য কোথাও তারা এক টেবিলে বসি সমঝোতা করে। আবার সমঝোতা ভাঙেও । ধর্মে শ্লীল-অশ্লীলের সীমা নির্ধারিত আছে। সাহিত্য সমাজের বাইরের কিছু না। সাহিত্যের লগে সমাজ ও ধর্মের একটা বুঝা-পড়া থাকে। তাই সাহিত্যে ’অশ্লীল’ জিনিসটা আসে সরাসরি ন্যাংটা না হই উপমা বা আড়াল রচনার মাধ্যমে। দেখবেন লালনের অনেক গানে গুপ্ত কিছু চিন্তা দেহ ও সাধনা বিষয়ে যা রূপকাশ্রয়ে বলা হইছে। সাহিত্য যেহেতু ভাষার কারবার তাই ’অশ্লীল’ জিনিস আর ’শ্লীল’ শব্দ বিষয়ের ধারণারে উল্টাই পাল্টায় দেখতে চায় তাদের সীমানা নতুন মাত্রায় নিতে চায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি সাহিত্য ও সমাজের ধর্মের সাথে একটা বুঝাপড়ায় বিশ্বাসী। সব প্রচলিত চিন্তা-ব্যাধির নিরাময়মূলক সাহিত্য তৈয়ার করার বিষয়ে আমি আগ্রহী ন। গালিরে সাহিত্যের নিশানা বানাইতে চাই না। গালির ব্যবহারেরও একটা স্বাভাবিকতা আছে, সাহিত্যে মানায়ে নেওয়ার নন্দন আছে। তবে তা উপসর্গে পরিণত হইলে চ-বর্গীয় ট্যাগ দেয়া শুরু হইবে। বাড়াবাড়ি জিনিসটাই এক্সট্রিমিজম!
দেহ ও শরীরকে না বুঝিয়া আবালের মতো শরীর নিয়া নাড়াচাড়া ঠিক না। কামকে বুঝার তরিকা আছে। যৌনতা ইউরোপীয় তরিকা। কামের যে ব্যাপকতা ও বহুমাত্রিকতা তা যৌনতার মধ্যে আসি একক অর্থ ধারণ করছে। এইটা বুজতে হবে আমাদের। কাজেই সাহিত্য করতে গেলে শুধু আবেগ-অনুভূতি নিয়াই ঝাপাই পড়লে চলিবে না, বুদ্ধি-জ্ঞানেরও উপস্থিতি লাগবো।
মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণির অনড় ভাষা রুচিতে আঘাত করা বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্যের একটা কাজ বটে। তবে সমাজের একটা কমিউনিটির কাছে যা ’বুলি’ তা আরেক কমিউনিটির কাছে ’গালি’ হিসাবে চর্চা করে। আমাদের পুরানা ঢাকার ভাই-বন্ধুরা তাদের কথ্য ভাষায় অনেকে ভাবে ’গালি’ পাইড়া কথা কয়। আসলে তা একটা স্বাভাবিক কথ্যভাষার উপাদান বটে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পে আপনি এইসব দেখবেন উনি আনছেন। এই গালি সমাজে আছে। সমাজরে গালিমুক্ত করি কারাগার বানানোর দরকার নাই। রাগের মাথায় ভদ্রলোকরাই সবচাইতে বেশি গাল পাড়ে। সেই গাল অগ্নিগিরির অগ্নুৎপাতের মতোই।
যাহোক অনেকে দেখা গেছে ঢালাও ’গালি সাহিত্য ‘ রচতেছেন আমাদের এইখানে। কিন্তু এইটা একটানা চর্চা বাতিকগ্রস্ততা গালিগালাজই হই উঠে। গালিগালাজ সাহিত্য না তা ক্ষোভ পর্যন্তই আটকাই পড়ে। ক্ষোভ-বিক্ষোভকে যুক্তি ও ভাষার জোরালো বয়ানে জোড়া না লাগাইলে তা আকামের জিনিসই রই যাবে।
আমাদের জীবন ও সাহিত্য সমার্থক নহো। জীবন বড় সাহিত্য জীবনের বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ও হেয়ালি কুহেলিমাখা খন্ডপ্রচার। জীবনরে ভাষার চেহারার ভিতর আয়ত্ত করে সাহিত্য। সাহিত্য সংবেদনশীল হৃদয়বৃত্তি ভাষিক বয়ান। এর বাইরেও সাহিত্য হইতে পারে সেই সম্ভবনারে আমি খাটো করি দেখি না। ফলে সাহিত্যে/কবিতায় শ্লীল -অশ্লীলের ব্যবহার পরিপ্রেক্ষিতশূন্য যেন না হয় সেই দিকটাই খেয়াল রাখা দরকার। দিনশেষে ভাবতে হবে আগামীকাল আসবে আজকের দিনটারে সে মুছবে না তবে ঢাকি দিতে পারে। সাহিত্যে তাৎক্ষনিকতার লাভই সবটুকুই না।
শুদ্ধস্বর: বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বাংলা কবিতা নিয়ে আাপনার নিজস্ব মূল্যায়ন/ বিশ্লেষণ জানতে চাই। এটা যেকোনো সময় ধরে হতে পারে, আপনার যেমন ইচ্ছে।
জহির হাসান: আমরা পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য/কবিতা পাঠ করছি বহুতদিনতক। এখন আর তেমন পড়ি না দুএকজন কবির কবিতা ছাড়া। তবে খেয়ালে রাখি। নতুন কবিতা প্রতি আমার অনুগ্রহ-আগ্রহ সবসময়ই রয়।
বাংলা ভাষায় কবিতা লিখা হয় এখনো পশ্চিমবঙ্গে এটা খুব সুসংবাদের কথা। যদি বাংলাভাষা সেইখানে টিকে আগের মতো আমরা পড়বোনে। হিন্দি আর ইংরাজির চাপে তারা বাপদাদার ভাষা হারাই ফলবে একদিন হয়ত। বাংলা ভাষার উপর দিল্লীর একটা ঘৃণা আছে। হিন্দু-জাতীয়তাবাদের উত্থান তাদের তরফ হইতে রুখি না দিলে তাদেরে চ্যাপ্টা করি ফেলবে।
যাহোক পশ্চিমবঙ্গে আজও কিছু ইন্সটিটিউশন টিকি আছে । কিছু মানুষ এখনও জ্ঞানচর্চা, গবেষণা করতেছে। আমাদের বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে তেমন ভালো কোনো ইন্সটিটিউশন নাই। পাশের দেশ বা এশিয়ার আরসব দেশ হইতে শিখার অনেক কিছু আছে।
এইটা আমাদের আত্মসচেতন হই উঠার অংশ। কবিতা শুধু আকাশ হইতে পয়দা হয় না। দেশে বুদ্ধিজীবীদের বড় একটা প্রস্তুতি ও ট্যাডিশন তৈয়ারের জন্য দরকার শক্তিশালী কিছু ইন্সটিটিশন। যেইখানে গবেষণার মান হবে উন্নত। দেশে বিদেশে যেন আমাদেরে গোনায় ধরে।
আজকাল দুই/দশটা ফেসবুক স্টাটাস দিয়াই বুদ্ধিজীবী হইয়া যায় এইদেশে । আবেগভরা টলমল ছেলেমেয়েদের লাইক পাইয়াই তারা তাদের মনোসন্তুষ্টি নিয়া রাতে ঘুম যায়।
তাদের যে একটা শক্ত ইতিহাস জ্ঞানের ভিত্তি দরকার তা তাদের বুঝাই দেয়ার মতো সেরকম রেফার করার মতো দশবিশজন বুদ্ধিজীবী নাই এইদেশে। ফলে শক্ত একটা জেনারেশন তৈয়ার হইতেছে না।
তবে আশার কথা এই যে সেই প্রক্রিয়া পঠন-পাঠন অপ্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের মধ্যে একটা প্রস্তুতি পর্বে আছে বাংলাদেশ। হয়ত খোদা চাইলে কিছু হইতেও পারে এই দেশে।
কবিতা পয়দা হয় যেই পরিপ্রেক্ষিত হইতে তার লগে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমন্ডলের একটা যোগাযোগ আছে বলি আমার আজকাল মনে হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক ইন্টারভেনশন কবিতাতেও দরকার। কবিতার যথার্থ সমালোচনা না হওয়ায় চারদিকে কবিতা নতুন হই উঠতেছে না। ছদ্মমোড়কে পুরাতন কবিদের নতুন নামে হাজির হইতেছে। কবিতার পিছনের চিন্তার একটা দূরবর্তী প্রভাব আছে বলি আমার আজকাল মনে হয়। সৃষ্টির আগেই বোধ হয় নির্মাণের একটা শাসানি কাজ করে।
বাংলাদেশে নব্বই দশক হইতে কবিতার একটা জাগরণ দেখা গেছে। ‘বাংলাদেশের কবিতা’ কেমন? কোনটা বাংলাদেশের কবিতা আর কোনটা পশ্চিমবঙ্গের কবিতা পাশাপাশি রাখি পড়লে সনাক্ত করা আজ আর কঠিন কোনো ব্যাপার ন। কারণ বাংলাদেশের কবিতা দিনে দিনে ভাষায় আবেগে সরলতায় চিন্তার বক্রতায় বাঙালি মুসলমান কওমের চিহ্নমাখা বহুত কবিতা রচিত হই গেছে । দিনে দিনে ভাষা চিন্তায় ও বিচিত্রতায় বাংলাদেশের কবিতা তার যৌবনে আছে। আজ শুধু এইখানে এইটুকুই কইবো।
শুদ্ধস্বর: খুব সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা (যে কোনো বই বা লেখা) নিয়ে কিছু বলুন।
জহির হাসান: বেশ কিছু দিন আমি জাপানের কথা সাহিত্য নিয়া পড়তেছিলাম। বিশেষ করি য়াসুনারি কাওয়াবাতা,কেনজাবুরো ওয়ে, কাজুও ইশিগুরো, হারুকি মুরাকামির লিখা। মুরাকামির লিখা নরওয়েজিয়ান উড দুর্দান্ত একটা উপন্যাস। উপন্যাসটা পড়তে গিয়া থামতে হয় নাই কোথাও। মুরাকামির এইটা বাস্তবভিত্তিক উপন্যাস বলা হয়্ । আর কোনো উপন্যাস উনি বাস্তবতারে অধীনে থাকি এইভাবে লিখেন নাই। নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে উনি লেখেন না। মানে তার টোকিও শহর, তার আমরিকান জ্যাজ মিউজিক, ষাটের দশকের ইউরোপের যত মিউজিক, তার বিষণ্ণতা আক্রান্ত চরিত্র, বাস্তব-অবাস্তবের সীমানা নিরসনের চেষ্টা, যাদুবাস্তবতার প্রক্ষেপ, যৌনতা, আত্মহত্যা, তার আমেরিকান ও ইউরোপী কেন্দ্রিক পশ্চিমা জীবনাকাঙক্ষা ঘুরি ঘুরি আসে তার লিখায়। তার কাব্যিকতা বাক্যের প্যাচে বড়ই আনন্দদায়ক । একটা হুইম তৈয়ার করার ক্ষমতা তার লিখায় আছে। মোট ৮/৯ খান উপন্যাস একটানা পড়লাম। গল্পও পড়লাম বোধ হয় তিনটা কালেশন। মোটকথা একটা দারুন অভিজ্ঞতা। কল্পনার আর জীবন উপলোব্ধি ঋদ্ধ এসব উপন্যাস। তবে বার বার মনে হইছে জাপান কি ভিতরে ভিতরে পুরাই আমরিকা হই গেছে। তার চরিত্ররা নামটা হয়ত জাপানিজ বাট মনটা আমরিকান্। বিশ্ব পাঠকবাজার ধরার খায়েস হয়ত তার বেশি। তাই এই আয়োজন। অথচ কেনজাবুরে ওয়ের উপন্যাস পড়তে গেছি দেখি উল্টা অভিজ্ঞতা হইল। সেই আমরিকান এই জীবনাভিমুখটা বরং রেজিস্ট করতেছেন তিনি তার লিখায়। কাজুও ইশিগুরোও তাই। প্রবাসী ইশিগুরোও শিকড়ের দিকে টান অনুভব করেন। কাওয়াবাতা তো জাপানের জীবনযাপন রীতি আচার তার লিখার ভিতর ডিটেইরল তুলছেন। সব দেশেই মনে হয় সাহিত্যে এইসব ঘটে। কেউ কেউ দেশি বীজ দেশি কাদায় লাগান। আর কেউ বিদেশি চারা দেমি মাটিতে পোতেন। আসলে নিরেট দেশি আর নিরেট বিদেশি কিছু আছে কি না তা আজ কাজের প্রশ্ন?
কবিতা:
ভালা কবিতা
ভালা কবিতা কাউরে লিখতে দেখলে
আমার চক্ষেতে পানি আসে কোন বা মায়ায়!
তারা জোট বান্ধি ফোঁটা হয়।
কে আগে ঝরিবে
কে আগে নামিবে এ ধরায়
দেবদারু ফুলের মতো নিরিবিলি প্রতিযোগিতা লাগায়!
‘তোরা থামবি।’ আমি কই।
ধমকাই ওদেরে
কেউ ভালা কবিতা লিখে কহন জানস তোরা?
কেউ ভালা কবিতা লিখলে
তার কয়দিন পর সে মারা যায়!
তাই বুঝি শেষমেষ সে টিয়া পাখিরে হুদাই
আদর করে অবিরল পাখি ভাবি
লাল মরিচ খাবায় একা একা বিকাল বেলায়!
আকন্দপাতা নিরিবিলি তাকাই রয়
বাতাসের ঘাড়ের উপর দিয়া
কেহ নাই যন ঐদিকে!
একাকী
একটা অদৃশ্য
ব্রিজের উপর নিজেরে ফালাই আসে!
‘আমি’ আর ‘তুমি’
আমরা দুজন দুজনের ব্লটিং পেপার!
ঘনিষ্ট হওয়ামাত্রই আমরা
হারানো নক্ষত্র ফেরত পাবার মতো
নিমিষেই এক অপরের সত্তার অতলসহ চুষি লই!
তখন আমি তোমার জীবন পাই
তখন তুমি আমার জীবন পাও!
তখন কেহ কাউরে মেঠো ইন্দুরের মতো হটাই না!
হায়, আমরা ফের নিজেরে ফের ফেরত পাইতে আহাজারি
করিতে থাকি!
আমরা ফের নিজেরে ব্লট করতে ব্লট করতে ঘনিষ্ট হই!
হাজার বছর ধরি আমরা এই খেল খেলতে রহি!
আমরা ভাবি না যে কেউ উপচায়ে পড়া মওত এই একচেঞ্জ
উপরতলা হইতে কেউ দেখতেছে!
আমরা এবে পুরাই ভুলি গেছি
কে পুরুষ ছিলাম, আকাশ ঝালাই করা নীল বুক!
কে নারী ছিলাম, উড়াশালিকডানাঝাড়া কুয়াশা!
আমাদের আত্মার কিবা মাঠঘাট পরিচয়!
আমাদের মেয়েদিনগুলি কেমন আছিল
আমাদের ছেলে দিনগুলিই বা কারা ছিল!
আমরা মিতবাক, পরে নিমপেঁচামার্কা বিহান আলোর কাছে
আমরা হতবাক হই!
আমরা শুধু এইটুকুই
‘আমি’ আর ‘তুমি’
এই নামে একটু মধুশাইল ধানরঙ হই
আরও কিছুদিন টিকি থাকতে চাইছিলাম!
আমির বিবরণ
ভোর হইল। দেহের বিছানা ছাড়ি
রুহু আমার
জানালারে টা টা দিল!
পোড়াবিন্নি আমাদের মাঠেরে যেইভাবে টা টা দিল!
মড়া নিজেরে ‘আমি’ দাবি করি বসে যদি শেষে!
ডুমুর তলায় ধোয়ানোর আগেই!
অনেক ঘুম অন্ধ চোখে ছিল বুঝি নাই
তাড়াতাড়ি ভাগি
নারকেল গাছের পর দিই
দেবদারুর তল দিই
আচানক হাঁসের দলের সাদা-হলুদ রঙ অবহেলি!
মড়া নিজেরে ‘আমি’ দাবি
করি বসে যদি শেষে!
জহিরের যুদা
সমস্ত চোখের আড়ালে হারাই
পাঁচটা হাঁস সারাদিন ভাসতেছিল কোথার কোথায় –
তারাও ফিরি আসিত যদি!
তাদেরে ভুলি দিকে দিকে না খুঁজি
আকাশের নীলা রং মাখতে গেছে যে জহির
আর যে জহির মেঘের আড়ালে বাঁকা চান্দের হাসি ধরতে গেছে
বাঁশপাতার ফাঁক দিই এক ঝলক
তোমার মুখ দেখলে তো ঐ দুই জহির
চক্কর লাগাইত!
তোমার মুখের উপরই ল্যান্ডিং করিত তক্ষণি!
লজ্জা পাই তারা ভাবত
উড়াউড়ি তো পতঙ্গের ভোল!
তাদেরও যুক্তি আছে
তোমারে পাইলে
হারানো বুঝায়
তোমারে হারাইলে
তোমারে পাওয়া বুঝায়!
কম সাধে কী ঐ হাল
এক জহির
দুয়ে যুদা হইছে!
আবছায়ার তলে
লতাবৎ তোমার গ্রীবাহেতু
বিল্ববনের আলো-ছায়া লড়ে
দেহলতা আড়ে কয়টা ঘোড়া গাড়ি সমেত চিরতরে লুপ্ত হয়
ভাসে মুহুর্মহু রচে দৃশ্য প্রমাদ
উড়লে পাখি ভার্জিন হইতে আসে আকাশ
আমার মওতের সাথে তুমি নয়া দৃশ্য বানাও
মোর জন্মের লগে লগে
তুমি বকুলতলা রচনা করো
ক্ষণিকত্ব বহনে আমি অক্ষম
নদীর এইপাড়ে চোখের তারার মতো
সেতু কাঁপে তাই সেতু কাঁপে
তোমার কাপড় আমারে জড়ায়ে দাও
তোমার দেহলতা আমারে পরায়ে দাও
নিজেরে ফালায়ে মোরে আফসানা কই ডাকো
একবার রাতে একবার বিহানে
একবার কুয়াশার কারবারে
একবার শিশির ঝরার খেলায় কত ভোল
আন্ধা চোখ পইরছেে কাজল!
তুমি কইলে চিরকাল নদী নাম ধরি ছুটে
আমিও কইলাম লহমারা তবু কেন স্থির লাগে হ্যানে!
রাত
রাতের তারা উল্টা আমারে জিগায়
‘তুমি’ কে গো!
সেলাই করে মহাকালরে যেই যেই তারা সারারাত
দখিন আসমানে উলি উঠে তারা!
রাতের নির্জন দিকটা ফেলি
গড়ানো আন্ধার ফেলি
ডানা হারা বিলাপী পাহাড়ের দিকে
ভোরের প্যাঁচা ধায় বন ধঁধুলরে বনে
বলতে বলতে
‘আমি’!
দুর্বোধ্য কিছু জায়গা থাকে কিছুদিন মানুষের শরীরে
তারপর উধাও হয়!
তখন অর্থ পাল্টায়
প্রশ্নও পাল্টায়!
শুধু মনে হয়
‘আমি’
‘তুমি‘
হুদাই কী বাখোয়াজি!
প্যাঁচার মতো রাতরে ফেলি
আমার আর ভাগার জায়গা কনে!
ছিন্ন তারা
১.
খিদা লাগলে তিনজন বিলাই
আসমান চাটতে ছাদে উঠে
আম্মার লেডিস চাদরের ঘিরান ফালায়ে
তাদের লগে
অধিক আকাশের ঘ্রাণ আর বন্দি রঙধনু
ঝাড়া ঘন্টা তিনেক শেয়ার করি গে!
২.
হিজল ডাল ডাক দেয়
আমার নাম ধরি-
দেখি উড়ি গিয়া বসে আমার বদলে
মাছরাঙা, ঠোঁটে সে গর্ত খোড়ে বাতাসের গতরে
যেইখানে জন্মে না কিছু
মরে না কিছু
সোজা কথা এইখানে
কুয়াশা রাজহাঁস হইতে পাকুড়গাছরে পার হয়া
ওহির মতো ঝিমাB ঝিমাB নামে
দিঘির কিনারে কচি পাতারে তিনবার দেখে
তার চোখদুড়ারতে যাতে হুবহু প্রতিসবুজ গড়ায়ে পড়ে,
ঐ নিচা নিচা মেঘ
অন্ধ হওনের আগে !