মরণোত্তর মৃত্যুদিবস ও নৌকাকাণ্ড

Share this:

মরণোত্তর মৃত্যুদিবস নৌকাকাণ্ড

 

মানুষ মৃতদেহ থেকে কদাচিৎ দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করে।

জুতো খুলে রকার-এ দোল খেতে-খেতে মনে হতেই পারে— উত্তেজিত হওয়ার উপাদান চারপাশে কী কম? —আর কেন মৃতদেহের গল্পই আমাদের জানতে হবে সবাইকে? —আমাদের ভ্রমন আছে, উত্তম সঙ্গ-আড্ডা আছে, সুপর্যাপ্ত শান্তি-স্বাধীনতা, চোখের জল, স্বচ্ছ ভূদৃশ্য, অলংকারশাস্ত্র আছে, নুডুলস স্যুপ আছে, আর আছে কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়ার সবুজ-সূক্ষ্ণ আনন্দ। আমাদের সময় ক্ষীণ হয়ে আসছে— অচ্ছ্যুত-কঙ্কাল-অক্ষরের কাগজ সবিস্তারে পাঠ করার অবকাশ এখন কম। কেউ টেক্সট করেছেন— এই লেখাটি আমি কখনো পড়তে চাইনি। …কেউ জানিয়েছেন, হয়তো এই ছাইভস্ম লেখাটির জন্যই অপেক্ষা করেছি। অন্য এক ভাষ্যে : …এই লেখাটি আগামী শীতে পাঠ করতে চাই। কারণ, লেখার পৃষ্ঠা, অনুভব হয়েছিল আয়না-সদৃশ— তুমি, আমি, এবং আমাদের মুখমণ্ডল ঐ আয়নার প্রতিফলিত হয়। …এই লেখাটিই খুঁজছি, কারণ এ বিষয়েই এখন আমি কাজ করছি। অথবা স্থির হই— এই লেখাটি পাঠ করব, করোনা-বিঘটন সমাপ্তির পর একখণ্ড নৌকাকাণ্ড ও মরণোত্তর জলকাহিনি হিসেবে। এমন কী হতে পারে, এর প্রথম বাক্য সামান্য উৎসাহ তৈরি করলেও, পরবর্তী বাক্যসমূহ এত হতাশ করে যে— বুক সেল্ফের গভীর কাটাছেঁড়া-ময়লার ভেতর ঘৃণা ও প্রত্যাশাসহ তক্ষুনি জলন্ত আগুনের গন্ধ মনে রেখে ছুঁড়ে দিলাম? […মানুষ মৃতদেহ থেকে কদাচিৎ দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করে।] মানুষ ভবিষ্যৎ, অতীত ও নীরবতা বিষয়ে নিচু গলায় কথা বলে। মানুষ নথিপত্রের সংকেত-লিপি খোঁজে, প্রণোদিত হয় এবং আবারও নিরুপায় হয়ে ভবিষ্যৎ শব্দটি উচ্চারণ করে গভীর তৃষ্ণায় : ফলে ভবিষ্যৎ শব্দটি অতীত হয় এবং অচিরেই নীরবতা ধ্বংস হয়। তোমাদের নীরব-অতীত পাড়াগাঁয়ে, পূর্বকথিত মৃতদেহ তৈরির আগে, ধরা যাক স্বল্প-পরিচিত লোকটির নাম নজিবর রহমান— নজিবর রহমানের নিকট আত্মীয় কেউ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করতেন, কিন্তু মিষ্টান্ন-বাণিজ্য ক্ষীণ হওয়ায় তিনি গ্রামে ফিরে যান, অথবা জীবন-জীবিকার প্রহারে নৌকা হয়ে, কমিউটার ট্রেন হয়ে, আমৃত্যু শহর-গাঁ করেন— আর এই পরিবারের দূরবর্তী কেউ, যার নাম হয়— মোমেনা খাতুন, যিনি অনেক দিন পর ২০ জুন, ২০২০ কোভিড-১৯ নামক বিপুল এক বৈশ্বিক-অদৃশ্য-বিচূর্ণন প্রক্রিয়ায় বিচেতন হন এবং মৃত্যু নামক বিচ্ছিত্তি গ্রহণ করেন। জনাব নজিবর রহমান, এই পরিবারে প্রথম একটি গ্রন্থ রচনা করেন নৌকা বিষয়ে— তিনি মেয়েটিকে চিনতেন, কিছুদিন তার গৃহে আশ্রিতা ছিল; এর অর্থ এই নয় যে, এই মেয়েটিও লিখতে অনুপ্রাণিত হলো; মেয়েটি তাদের জন্য দুপুরের খাবার প্রস্তুত করত এবং একবার সদ্য প্রস্তুতকৃত কফি নৌকা-বিষয়ক পাণ্ডুলিপির ২২ নং পৃষ্ঠায় ছিঁটকে ফেলে আচমকা— সেদিন ছিল ২২শে জুন ১৯১৭; …মেয়েটির মৃত্যু হয় ২২শে জুন ২০২০! এটি কোনো নালিশ নয়— আর কে না জানে, কোনো সকাল-দুপুর আগের সকাল দুপুরের মতো হয় না, চোখের দৃষ্টিও একই রকম হয় না, …কোনো কিছুই দ্বিতীয়বার হয় না; তোমরা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, আসলে এক অপ্রয়োজনীয় ভয়ের সাথেই বসবাস করছিলে। মেয়েটি ১৯১৭-এর জুলাই-আগস্ট, নজিবর রহমানের গৃহত্যাগ করে, অথবা গার্হস্থ্য-সন্দিগ্ধতা তাকে গৃহচ্যুত করে; মেয়েটি ২২, আলমগঞ্জ লেন থেকে একটি গ্রন্থ ক্রয় করে এবং চাকরির পরীক্ষায় প্রস্তুতির সূত্রে অবহিত হয়— গার্মেন্টসের সেকশান প্রধানত তিনটি— কাটিং, সুইং ও ফিনিসিং। মেয়েটি এখানে নাম অন্তর্ভুক্ত করে এবং ওভার লক মেশিনে প্রতি ইঞ্চি সেলাইয়ে কী পরিমাণ সুতা লাগে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করে। মেয়েটি একদিন, ফেব্রুয়ারি শেষ-শেষ, ২০২০ সাল— …সূর্য দেখার মতো জনৈক বায়ার-এর সুগন্ধ ত্বক এবং ত্বক ছিন্ন করে ভেসে ওঠা সুঘ্রাণ দেখতে দেখতে কতিপয় পাইলট-সার্টের ছবি বিস্মৃত হয়। এরকম মুহূর্তে কোয়ালিটি কন্ট্রোল দপ্তর থেকে সে বকুনি খায়, আর হঠাৎ-ই শোনে— সন্ধ্যা-সন্ধ্যায় সব গার্মেন্টস অদৃশ্য এক বৈশ্বিক মারীর সম্ভাবনায় বন্ধ ঘোষিত হয়েছে। মেয়েটি গৃহ-অভিমুখি হয়, স্বেচ্ছা অন্তরীণ হয় কিছুকাল, তারপর চাকরি রক্ষার্থে বাধ্যতামূলক ফিরে আসে, পুলিশি তাণ্ডবে গার্মেন্টসের দোরগোড়া থেকে আবার উন্মূল হয়, গৃহ-অভিমুখি হয় নবপর্যায়ে, আবার ফিরে আসে…; তারপর ঘরে-বাইরের অতল-মিথষ্ক্রিয়ায় সে জ্বর-জ্বর ঘোরের ভেতর, নিশ্বাস ক্ষীণ হতে-হতে প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে চিরকালের মতো এবং দ্রুত নিক্ষিপ্ত হয় ২২শে জুন ২০২০-এর গরম-ভ্যাপসা বিষ্টি-বিষ্টি এক দমবন্ধ ঘূর্ণিপাকে। তোমাদের গাঁ-ঘরের মানুষেরা এই প্রকার মৃতদেহ থেকে কদাচিৎ দৃষ্টি বিচ্ছিন্ন করে; প্রকারন্তরে অসময়-মৃত্যুর আলিঙ্গনে মোড়ানো এই দেহ আমাদের ভেতর অতিশয় এক অলাতচক্রের অঙ্গার ছড়িয়ে প্রশস্ত দুঃখী-চোখ খুলে রাখে নিশ্চিন্তে। আমাদের অভ্যাসের শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ে ঘাড়ের উপর; অনুভব হয়— বিন্দুবিন্দু ঘাম, সহজপাঠ্য-শিলালিপি, দুর্বোধ্য জীবন ও নীরবতার সারাংশ। অ-শরণা মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে নজিবর রহমান ভাবলেন, এটা ছিল অলিখিত এক ক্ষণস্থায়ী মর্মন্তুদ বিয়োগ কাহিনিই বটে! আমরা কি তবে দিনশেষে, অচেনা বৃক্ষের অচেনা ছায়া হয়ে, ক্ষুধা-তৃষ্ণার প্রতীক্ষা পেরিয়ে নিপুণ-নির্ধারিত এক সমাপণ মাত্র? লোকটি পাখা ঝাপটায়, স্মৃতি ঝাকায় এবং পতপত কাঁপতে থাকে— মৃত বেড়ালকে শাস্তি দিয়ে কী লাভ? …কোনোকিছুই তো নেই আগের মতো। কফির দাগপড়া পাণ্ডুলিপির ২২ নং পৃষ্ঠায় সে দৃষ্টি ঘষে— পদধ্বনি শোনার মতো। কোথাও কি লুকিয়ে ছিলাম আমরা? কেন এতসব অজ্ঞাতবাস? চারপাশে এত এত বৃত্তান্ত, অগ্নিস্রোত, মর্মবেদনা এবং বীভৎস ধারাবিবরণী— কিন্তু সংকীর্ণ আকাঙ্ক্ষায়-কৌতূহলে, স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় নৌকা-বিষয়ক একটি অনুদ্দিষ্ট-নিরর্থ গ্রন্থ-রচনায় কেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠি? পরাজিত মনের প্রদাহ এড়াতে আমি তবে অত্যধিক কিছু আশা করে ছিলাম? নিজের জন্য অদৃশ্য হওয়া— কৌশলটি খুব খারাপ নয়। নৌকা সম্পর্কিত লেখক নজিবর রহমান মৃতদেহ চাক্ষুষের মতো গ্রন্থের পৃষ্ঠা উল্টায়— …এই বই নির্মাণে, রপ্তানিযোগ্য পোশাকের গায়ে প্রতিস্থাপিত মেইন লেবেল ও সাব-লেবেল পৃথককারী একদা গৃহপরিচারিকা-কন্যার অদৃশ্য নিশ্বাস ও আঙুল ছুঁয়ে আছে। অনেকদিন আগে যখন সে গৃহপরিচারিকা— খাদ্য প্রস্তুতিতে বিভ্রাট প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহিণীর লাগাতার বকুনিতে যখন আত্মহননের ইচ্ছে প্রকাশ করে, তখন নজিবর রহমান, এক আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে, তার মাথায় হাত রাখে মৃদু-প্রসন্ন-সংবেদনশীলতায়। সামান্য নরম হয়ে যাওয়া শাড়ি পরিহিত মেয়েটি পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ ছড়িয়ে দাঁড়ায় : তার আঙুল এবং আমাদের আঙুল মাতৃভাষা লোভী হয়ে উঠে; আঙুল শিরা-উপশিরার মতো নদীমাতৃক হয়, তারপর তারা বৃক্ষ শাখা হয়, ছায়ামূর্তি হয়, মানব-সন্তান হয় এবং ভাষা-অস্পষ্ট লেখক হয়; শরীরে-গলায়-পিঠে-চিবুকে আঙুল বুলিয়ে এবার তারা প্রলয়কালের আলপথ বেয়ে গোপন স্থগিতাদেশ লেখে— ফলশ্রুতিতে রচিত হয়, কতিপয় দুঃখের কথা, বাবার অপমৃত্যুর কথা, ইংরেজি মাস্টারের সঙ্গে কানাইবাবুর স্ত্রী-পলায়নের ইতিবৃত্ত ও হঠাৎ আঙুল কেটে রক্ত বেরুনোর কথা। নজিবর রহমান নৌকা-বই তৈরির সময়, আজ এই হঠাৎ অখণ্ড শোকদিবসের কিনারায় দাঁড়িয়ে ভাবছিল— মোমেনা খাতুন নামে সদ্যমৃত মেয়েটির কতিপয় দৃশ্যাবলি অগোচরে অতল-নিরাময় হিসেবে সেদিন সে এত অনুকূল উপযুক্তিতে গ্রহণ করেছিল কেন? নৌকা বিষয়ক পাণ্ডুলিপির ২২নং পৃষ্ঠায় মেয়েটি কালো-কফির দাগ ঘষে দিলেও, হতে পারে কিছুকিছু রেফারেন্স বই ওর ঈষৎ নরম-পাড়ের শাড়ি ঘষে ময়লা মুক্ত করেছিল। হতে পারে তীব্র শৈত্যপ্রবাহের কয়েকটি দিন স্নানের জল গরম করে দিয়েছিল। অথবা উড়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির সোনালি ডালার চিল-প্রকল্প স্থগিত পূর্বক পৃষ্ঠাসমূহ সংরক্ষণ করেছিল বন্ধ-টেবিল ওয়াচ-এ তৈরি পেপার ওয়েটে; আর কখনো কখনো শুধুই দাঁড়িয়ে থাকত শুভাকাঙ্ক্ষার দূর কল্পলোকে— কুয়াশা, অশ্রুজল ও নিচু জাতের গন্ধ নিয়ে। নিচু জাতের মেয়েরা কি বৃক্ষ ও আকাশ জুড়ে গরম ভাতের মায়া ছড়িয়ে কথা বলতে সক্ষম? […ক্যান সাব অল্টার্ন স্পিক?] নিচু জাতের মেয়েরা পানপরাগের খালি কৌটা ওয়েস্টবিনে ফেলার সময় বইয়ের অক্ষর বুঝতে পারে? নজিবর রহমান লিখতে লিখতে কখনো ঘুমায়। নৌকা বিষয়ক অক্ষরপুঞ্জি নিদ্রাচালিত পারিবারিক ধুলোবালিতে স্কুলব্যাগ গোছায়, হিংস্র হয় এবং মাতাল হয়। নৌকার অক্ষর সমূহ নৈর্ঋত পেরিয়ে রেস্তোরাঁয় যায়, তুলসিপাতা চিবোয়, বাস ভর্তি বালক-বালিকা হয়, পৃথিবীহীন হয় এবং নেচেনেচে ফড়িং ধরে। নজিবর রহমান নৌকার প্রকারভেদ করে এবং একটি মেয়ে কীভাবে যুগপৎ সাধারণ ও অসাধারণ হয়— তার ঠিকুজি খুঁজতে হন্যে হয়। দেখা গেল : সাবানজলে নতুন কাপড় এবং পুরনো কাপড় গলাগলি হয়ে অনেকখানি রঙ আদান প্রদান করায়, গৃহপরিচারিকা আবার একদিন জ্ঞানশূন্য ক্রুদ্ধতার ভেতর আটক হয়েছে। মেয়েটি কি ক্ষমতার ভাষা বুঝতে পারে? নৌকার পাণ্ডুলিপি থেকে অব্যবহৃত ঝর্ণা কলম গড়িয়ে গড়িয়ে স্থির হয় অপর বইয়ের গায়ে— সাধারণ ও অসাধারণ মেয়ে বুঝবার কোনো স্থির-ছলনাহীন মাপকাঠি জানা আছে তোমাদের? তোমাকেই জিজ্ঞেস করি— একজন কি দুটি মানুষকে একসঙ্গে ভালোবাসতে পারে? একত্রে দুজনকে ধাক্কা দিতে পারে? বা দুজনের সঙ্গেই একত্রে শত্রুতা উদযাপন করতে? প্রবল জ্বরে শয্যাশায়ী হলে, কেউ যদি অ্যানালজেসিক খুলে দেয়, সে কি অসাধারণ মেয়ে হয়? অসাধারণ মেয়েরা [আমাদের স্বার্থে বলি] অপরের জন্য মৃত্যুবরণ করে, নিঃসঙ্গ হয় এবং খুন হয়? অসাধারণ মেয়েরা সারাদিন চুলার পাশে ছাই হয় এবং আগুন স্নানে লিপ্ত থাকে। অসাধারণ মেয়েরা খাদ্য ও স্নানের চিরায়ত শুদ্ধ সময় নিয়ে কর্তাদের সামনে তর্ক করে না। অসাধারণ মেয়েরা বাপের-মায়ের ওষুধ সংগ্রহের জন্য যেকোনো নিষিদ্ধ হোটেলে রাত্রিযাপন করে ভোর-ভোর ঘরে ফেরে। অসাধারণ মেয়েরা ঘরে ফেরে, শরীরে আঘাতের চিহ্ন আঁকে, বাসন মাজে, রুটি বানায়, মশারি গোছায় এবং রান্নাঘরের ঝুল কালি মোছে পুরনো পেটিকোটে। বলা যায়— ২০শে জুন ২০২০-এ উৎপাদিত— একদা গৃহচ্যুত পরিচারিকার অপ্রস্তুত মৃত্যু সংবাদ অবহিত হয়ে নৌকা বিষয়ক গ্রন্থ প্রণেতা নজিবর রহমান, অনেক বছর আগের কতিপয় গোধূলি-দিন-রাতে এইভাবে সমর্পিত হয়েছিল। গতজীবনে অকিঞ্চিৎ এই বই লেখার জন্য কত রাত বাড়ি ফিরিনি, পত্রিকায় সামান্য একটি মফস্বল সংবাদ প্রেরণের জন্য শিশুপুত্র হত্যাকারী সদ্যধৃত মায়ের আদল দেখতে থানার সামনে দাঁড়িয়েছি, দিঘীর জল দেখেছি, খড়কুটো যোগাড় করেছি, শাপ-শাপান্ত করেছি, প্রতিপক্ষ হয়েছি, তিস্তা-গঙ্গা করেছি, প্রহসন করেছি, সাইকেল চড়েছি, আর একটি গরিব মেয়েকে নিবর্তন থেকে রক্ষা করার জন্য ভ্রষ্ট প্রমাণিত হয়েছি— …এর অর্থ শরীরে-বুকে বিবিধ আঘাত ও ব্যথার জগত; ব্যথায়-আঘাতে গলায় কালশিটে দাগ পড়ে এবং চোখের নিচে সাতটি দীর্ঘ-মলিন-নির্বান্ধব সেলাই। নৌকা বিষয়ক বই আড়াল করে, কখনো কি গরিবের ঈশ্বর নিয়ে জার্নাল করার বুদ্ধি এসেছিল? চোখের নিচে সেলাইয়ের আত্মবিশ্বাসী দাগ নিয়ে, মনে হয়েছিল— স্বর্গরাজ্য একটি মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে— ছোট ছোট মিথ্যা, ছোট ছোট ঘর এবং ছাদ— ছাদের দুইপাশ দিয়ে দুই মিথ্যা— সাদা মিথ্যা এবং কালো মিথ্যা! [তুমি দার্শনিক হওয়ার লোভে পড়েছ— …এনাফ ফিলোসোফাইজিং…; খেয়াল কর যেন ঠান্ডায় না পড়ো]।

এরকম, এক শীত-শীত ঠান্ডায় গরিব মেয়েটি, গরিবের ঈশ্বর খোঁজার জন্য, গার্মেন্টস প্রশিক্ষণে নাম অন্তর্ভুক্ত করে, পুরনো শাড়ি-ব্যাগে টুকিটাকি জড়ো করে এবং পরিত্যক্ত স্টেডিয়ামের গা-ঘেঁষে টেনিস কোর্ট পেরিয়ে নতুন ঘর-বাড়িতে পৌঁছায়। অপর মানুষের এই প্রকার গৃহত্যাগ পর্যবেক্ষণ শেষে, নজিবর রহমান, জানালা বন্ধের সময় দূরের জামরুল গাছে মৌচাক আন্দাজ করল। কলতলা থেকে কথা আসে— এই কয়টা থালা বাসন নিজেরা মাজতে পারো না? নজিবর রহমান, মিছেমিছি টর্চ ঠিক করে, বিনুনি খুলতে দেখে মেয়ের, আর ছিপছিপে ঘাসের ভেতর ফড়িং ও বিধবা রেনু কাকির সাদা শাড়ির মেঘ দেখে অন্য উপকথায় জড়িয়ে যায়; হয়তো বলে, জানেন তো, সময় হলো তিনরকম— বেলা-অবেলা-কালবেলা! জগৎ-প্রান্তর জুড়ে কত বৃহৎ আকাশ, মাটি, পাহাড়, নদী— …আর কী তীব্র ক্ষুদ্র হয়ে বেঁচে থাকা। নৌকা বিষয়ক গ্রন্থ প্রণেতা নজিবর রহমান, লেখার কালে— নদীর ভেতর জ্যোৎস্না, দূর প্রতিবেশীর গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানে সমবেত ছায়াচ্ছন্ন-মদ্দা সমষ্টি, উদ্ভট্টি আলোকসামান্য ছোট ষড়যন্ত্র, এবং ব্রাহ্ম-মুহূর্ত উদযাপন দেখে বেলা-অবেলা-কালবেলার স্রোতে— লোকেরা নদীর মাঝখানে মদের বোতল খুলছে, শাড়ি-ব্লাউজের সেফটিপিন খুলে কেউ ডুব দিচ্ছে, অন্য নৌকায় বিচুলি আর নৌকার পাড় জুড়ে সীমান্ত রক্ষীদের তীব্র আলো। কে জানে, এইরকম কতিপয় নদী এবং নৌকার ছবিসমূহ সংগ্রহ করেই নজিবর রহমান হয়তো নৌকা বিষয়ক গ্রন্থ সৃষ্টির দখলি স্বত্বে আগ্রহশীল হয়— বলা যায় এই প্রকার অন্যমনস্কতা ও ভাবুকতায়— এক ফাঁকে হয়তো ধানের ক্ষেত দেখে, স্রোতে ডুবে যাওয়া ভাতের হাঁড়ি দেখে, নিজেকে ক্ষুধার্ত করে এবং শেষমেষ তৈরি করে এক নির্জন লেখার টেবিল— যে টেবিলে কালো কফি স্থাপনের সময় নৌকা বিষয়ক ম্যানুস্ক্রিপ্টের ২২নং পৃষ্ঠায় বাদামি দাগ ছড়িয়ে দেয় অকালমৃত সেই গৃহপারিচারিকা। নজিবর রহমান সামান্য ময়লা হয়ে যাওয়া ম্যানুস্ক্রিপ্টের, অনন্ত-কালক্রম পর্যবেক্ষণের অনুমতি পাঠায় নিজের কাছে। [ঈশ্বর তার মনস্কামনা পূর্ণ করে] : …অনেক দিন অবধি সকল জ্ঞান গোপন করে, একটি নির্মিয়মাণ গ্রন্থের সম্মানে আরোগ্যহীন-জনশূন্য কাগজ-কলমে আয়ুষ্কাল ক্ষয় করতে হয়েছে : …একবারই বেপরোয়া হয়েছিলাম টানা চারদিন। তারপর নিজের দোষে, নিজের মুদ্রাদোষে অনন্যোপায় হয়ে নজিবর রহমান নৌকা-রচনা লিখে চলে। …নৌকার সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত থাকে— নৌকার চালক, নৌকার মালিক, ঠিকাদার, মাঝি ইত্যাদি; সব নৌকার নাম তুমি জানো না। বরিশালের নৌকা, কুমিল্লার নৌকা এবং ময়মনসিংহের নৌকা এক নয়। ঢাকার নৌকাও আলাদা নামের— ঘাসি/ কোশা/ রপ্তানি/ : কোনো নৌকায় ফল, কোনো নৌকায় পাট, ধান, কৃষি সরঞ্জাম, …আবার বালি বহনের নৌকা খানিকটা আলাদা বটে। নদী এবং নৌকা, ধরা যাক— এইভাবে অন্তত এক অপ্রবীণ-অনাদি ছবি নির্মাণ করে একদিন এবং জলের শরীরে তা প্রক্ষেপণ করে : পাল তুলে যাওয়া নৌকার নাম দিন, জালি। লবনপূর্ণ এই নৌকাটি দেখবেন কক্সবাজারে। এই নৌকাটির গলুই এবং হাল চামচের মতো। আপনাদের পাশের ঘাটে নৌকা থেকে কাঠ সরানো হচ্ছে। নৌকায় মাটির হাড়িও অনেক সময় বহন করা হয়। ডুবে-ডুবে বালি তোলা হয়, …এরকম নৌকা চোখে পড়েছে কখনো? দেখবেন নৌকার ভেতর অন্য এক বিপুল বাজার-ব্যবস্থা লুকিয়ে থাকে। যদি এই নৌকাটি পাট বহন করে, তবে আপনি পাবেন— মাঝি, ফড়িয়া, বেপারী, আড়তদার এবং পাটকলের এজেন্ট; যদি নৌকাটি ইটভাটার কাজে ব্যবহৃত হয়— তবে নৌকায় কখনো মাটি, কখনো কয়লা, কখনো ফার্নেসওয়েল, কখনো জ্বালানি কাঠ বহন করা হয়। বলা যায়— নৌকা বর্ণনা এইভাবে আবশ্যক-অনাবশ্যক ভবিতব্যের দিকে ধাবিত হয়, ভেতর-বাইরে সমান্তরাল হয়, সংকুচিত হয়, পরিব্যাপ্ত হয়, কৃশ হয় এবং চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। নৌকা বর্ণনা শেষ হলে, নজিবর রহমান অতঃপর জলের স্তর ক্ষীণ হওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে একটি পরিচ্ছেদ লেখে— পত্রিকা অফিস এবং বিআইডব্লুটিএ তার বক্তব্যের সাক্ষ্যদাতা হয় : …নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া, রাজশাহীর প্রায় চার লাখ একর জমিতে বর্তমানে বোরো ও গম চাষের অনুপুযুক্ত হয়ে পড়েছে, …পদ্মার সকল শাখা এখন জলশূন্য। ড্রেজিং কি সমাধান? নজিবর রহমান লেখে, অন্তত ছয় ফিট গভীরতা চাই সর্বত্র— ঢাকা-বরিশাল-চাঁদপুর-আড়িয়ালখাঁ/ খুলনা-কালিগঞ্জ সীমান্ত/ নারায়ণগঞ্জ-লাখপুর/ চাঁদপুর-আরিচা/ আরিচা-বাহাদুরাবাদ/ চাঁদপুর-ভৈরব/ ভৈরব-ছাতক/ ভৈরব-ফেঞ্চুগঞ্জ /কুষ্টিয়া-খুলনা— …এই বিস্তীর্ণ জলরাশি সচল রাখার দায় কার? অন্তত ৫৮টি নদীর উৎসমুখ ভারত-বাংলাদেশের জন্য অভিন্ন! আমাদের নৌকাসমূহ উজান-ভাটিতে চলাচলের সুবিধা বারোমাস সমানভাবে পায় না : যেমন— আশ্বিনে উজানযাত্রা কষ্টকর, ভাটাতে যাওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ; অগ্রহায়ণে উজানে অসুবিধা, ভাটিতে সুবিধে; বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যে উজানযাত্রা মধ্যম মানের, ভাটিতে কষ্ট তীব্রতর; পৌষ থেকে চৈত্র উজান-ভাটি, দুইটিই সুবিধাজনক। আবার আষাঢ়-শ্রাবণ, পুরো মাসই নৌকা ভাসান অনেক সহজ। নজিবর রহমান বিশেষজ্ঞদের বই থেকে সমাধান লেখার চেষ্টা করে : ছোট নোটস্ ছিল, খুঁজে পেতে অসুবিধে হচ্ছে; স্বরূপকাঠিতে ৫০০ মণী নৌকা তৈরিতে কাঠের পরিমাণ কত ছিল? অকালমৃত গৃহপরিচারিকা, অনেকদিন আগে ওয়েস্টবিন থেকে রকমারি নৌকার একটি-দুটি উড়ে যাওয়া ফটোগ্রাফ কুড়িয়ে নজিবুর রহমানকে চমৎকৃত করে— বাঘাবাড়ি, কাপাসিয়া এবং বেড়া থেকে সংগৃহীত নৌকার ছবি : একটি ছবির পেছনে পেন্সিলে আলতো লেখা— স্বরূপকাঠিতে তৈরি নৌকার বিবরণ।

নদী-বিষয়ক এই পাণ্ডুলিপি স্পর্শে নজিবর রহমান কখনো, এজন্যও বাড়তি সময় সঞ্চয় করে— ২০শে জুন, ২০২০-এ অকালমৃত গৃহপরিচারিকাকে ভেবে। এই বাবু শহরে লোকেরা— গেঞ্জি খুলে, বাথরুমে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ হয়ে সাবান মাখে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিবিধ আলকাতরার রঙ-তামাশা মাখে এবং বাড়িওয়ালাকে গালি দেয়, সঠিক সময় জল সরবরাহ না করার জন্য। মাঝরাতে ছটফট করে— কে-কার পাশে শোবে; অন্য মানুষের পেট নিয়ে ইয়ার্কি করে বিস্তর, আর অবিবাহিত শ্যালিকার হঠাৎ পেট নিয়ে সম্মিলিত ভয় পায়। বাবু শহরে লোকেরা মাতাল হয়, চাঁদ দেখে, স্নান করে এবং ড্রাংক হয়ে অচেনা মেয়ের কাঁধে হাত রাখে। লোকেদের পুরুষযন্ত্র সচল হয়, উত্তেজক গালাগালি করে জিপারের আড়াল থেকে, আর ফোক সং গাইবে যে কন্যাটি তার আগুনে-সরীসৃপ ভঙ্গি দেখে অপেক্ষমাণ অন্ধকারের জন্য ছোট ষড়যন্ত্র করে প্রায়শ— এসব লীলা-নৈপুণ্যে দেখা যাবে, হয়তো সারা সকাল সে ছিল বেজায় সৎ, কিন্তু সাঁঝবাতির পর থেকেই তার চোখ বদল হতে থাকে— এই মেয়েটি কার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যায় রে? তারপর আবার সেই ভুল-ভুল খুনসুঁটি— কতকাল তোমার স্নান করা চুলের গন্ধ পায়নি, …এই দেখ চোখের ভেতর জল জমা হচ্ছে। নজিবর রহমানের ধূসর জলে চোখ কলরব করে; স্বর হয়— স্থির, স্বজ্ঞাময়, অপ্রসন্ন ও ভাসমান। সারাদিন-সারারাত ছায়া আসে এবং অবিরত স্বপ্নের প্রতিরূপ প্লাবিত হয়— নিভুনিভু চোখে সে মুখোশ পরে, স্কুলে যায়, হাসপাতালে যায়, ওজনহীন মেঘ হয়, ছায়া আঁকে, মৃতবৎ শান্ত-শীতল হয় জলের স্রোতে এবং প্লাবিত হয় অদ্ভুত স্বাতন্ত্র্যে।

এই প্রকার স্মৃতিলেখ তৈরির আগে, সহজেই অনুমেয়— নজিবর রহমানের পাণ্ডুলিপিতে কালো কফির সীলমোহর তৈরির আগে, তার দূর আত্মীয়া— একদা গৃহপরিচারিকা মোমেনা খাতুনের অন্য এক পরিবৃত্ত, অন্য এক পরিব্রাজন ও পরিলেখ সঞ্চয়ে ছিল। হাতে কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে পুনশ্চ ভাবুন… গরিব মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী, যিনি শহর থেকে নিখোঁজ হন— তিনি নজিবর রহমান অথবা মোমেনা খাতুনের আত্নীয়, নাকি এই আত্নীয়তার প্রতিভা, রডেনড্রনগুচ্ছ হয়ে, প্যান অপটিকান তত্ত্ব হয়ে, উন্নয়নের সংজ্ঞা হয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে মুচি ডোম-চামার হয়ে অবশেষে নির্বংশ ও নির্বিষ হয়ে পড়ে। মোমেনা খাতুন যখন গৃহপরিচারিকা নয়, তখনও গার্মেন্টস প্রশিক্ষণে অর্ন্তভুক্ত হয়নি, শহরমুখো হয়নি… সকল মানবাধিকার চূর্ণ করে অপর মানবকূলের মতো তার জীবনও প্রতিষ্ঠা পায়, কলহাস্যময় হয়, হয় পুষ্পবৎ; তারপর রুক্ষ ছায়ার ধারাবর্ষণে জীবন ছিন্নভিন্ন হয়, জীবন পরীক্ষিত হয় এবং পুনর্নির্মিত হয়। মোমেনা খাতুন, মোমেনা খাতুনের বাবা-মা, আত্মীয়কূল— সবাই অক্ষরজ্ঞান-রহিত হয়ে তীব্র অন্নচিন্তায়… সকালবেলা জাগে, ঠোঙা বানায়, টিভি দেখে, শ্যাম্পু কেনে, বাসন মাজে, রুটি কেনে, হাইওয়ে মাড়ায়, যৌনসঙ্গম করে, ঝগড়া করে, আর হয়ে ওঠে কচুপাতার ওপর জমে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলবিন্দু ও দণ্ডাধীন আত্মক্ষয়ী-ক্রন্দসী।

[আপনি যা বললেন, তা সব কর্জকরা ধারণা; প্রতিনিধিত্বশীল কথা বলুন…]! মোমেনা খাতুন এবং মোমেনা খাতুনের অপর আত্মীয়কূল এবং প্রতিবেশীদের জীবন— তাদের আলাদা ঘর বাড়ি বটে, কিন্তু প্রায়শ তারা প্রাচীন এক অভিসম্পাতে একক পরিসর হয়ে ওঠে; যেমন, এইসব ঘর-বাড়িতে শিশুর জন্মলাভ উৎসবের মতো এবং পরক্ষণেই ক্ষুধার্ত হওয়ার ভয়। কখনো ভয় আসে নিষিদ্ধ গর্ভবতীর অনুষঙ্গে— ঘটনাটি বলি : একবার কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাচ্ছে না, এই শিশুটি তোমার পলাতক ভাইয়ের! শিশুর বিকাশ রোধ করার জন্য, তোমাদের মুখরক্ষা করার জন্য, লাল মরিচের গুঁড়া এবং ছয়টি লেবুর রস একত্রে পান করি। সুখ্যাত গুণিনের পরামর্শে তাৎক্ষণিক গর্ভপাতের জন্য জীবন্ত তামাক পাতা খাই… তীব্র বমি, যেন শেকড়সমেত বৃক্ষ উৎপাটন হবে। তাবিজ নিই, …আর জানাজানি বাড়তে থাকে। আমি লুকাই; একদিন তীব্র ব্যথা, সকাল থেকেই ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছে তলপেট জুড়ে। দেয়াল চেপে দাঁড়াই। শিশুর পা বেরিয়েছে প্রথম। আমি চুল ছিঁড়ছি— ভয়ে-অসহায় হয়ে, আর গোঙানি। এর পরে অপর পা, মাথা এবং গর্ভফুল : …একটি ধবধবে মৃতশিশু। কেউ রক্ত মুছিয়ে দেয়। আমি তোয়ালে জড়িয়ে ঐ মৃতমানব শিশুকে নদীতে ভাসিয়ে দেই। আমার কোনো উপায় সেদিন জানা ছিল না। ভয় আড়াল হলে খেয়াল করো— ইজারাদারের জলাশয়ের পাড়ে, মেয়েটির আত্মীয়কূল অনানুষ্ঠানিক পেশার সুবাদে, দলবদ্ধ চা খায় কখনো দীঘি-পুষ্করিণীতে চুন ছড়ানোর কালে অথবা মৎস শিকারের আগে পরে। জলে কুমির ডাঙায় বাঘ, গভীর জলের মাছ, তেলে জলে মিশ খায় না ইত্যাদি প্রবাদ মিলিয়ে তারা কখনো গল্পগাছা শোনায়। বিকেল-সন্ধ্যায় তাদের প্রপিতামহরা নদের চাঁদের মুখে মহুয়ার প্রত্যুত্তর সাজায়… কোথায় পাব কলসি কইন্যা কোথায় পাব দড়ি। তুমি হও গহীন গাঙ আমি ডুব্যা মরি। …প্রতিবেশীদের গল্পে উঠোন জুড়ে চাঁদ ঝিকমিক করে। কেউ তখন হাতিডুবা দীঘির গল্প বলে : অনেককাল আগে এক রাজার হাতি এই পুকুরে ডুবে যায়। ধীরে-ধীরে গল্প ছড়ায়— এই ঘাটে আরও বহুকাল আগে সহমরণ হতো। একবার কোথায় দীঘি কাটা হলো উত্তর-দক্ষিণে, …কোনোভাবেই জল আসে না। মৌলানা আতাউল্লা আসেন সাতজন সেবক নিয়ে। পুকুর ঘুরিয়ে দিলেন পূর্ব-পশ্চিমে, …আর থৈথৈ পানি। বুড়ো দেওয়ান সাহেবের পুষ্করিণীতে, যদি তোমাকে কুত্তা-বিড়াল কামড়ায়, তবে স্নান করবা। নাপিত বাড়ি নিশ্চয় চেনা আছে? তেনারা এখন কেউ নাপিত নয়— ডাক্তার, টিচার, পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার; এই বাড়ির গল্পটা শুনেছি মায়ের ছোট ফুপুর কাছ থেকে— বৈশাখ মাস। দুপুর, খাঁ খাঁ রোদে নাপিত যাচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে এক গাছের নিচে বিশ্রাম নেয়। সেখানে এক বয়স্ক লোক বসে আছেন আগেভাগেই… আমারে একটু কামিয়ে দাও ভাই। নাপিত বলে, জল পাব কোথায়, আমার কাছে যে জল নেই, …কাছে-পিঠে খাল-বিলও নেই! জলের চিন্তা নেই, তোমার পাত্রটা দাও— লোকটি বাটি নিয়ে হাত বাড়ায়, হাত বাড়তে-বাড়তে অনেক দূরের বিল অবধি পৌঁছে যায় এবং জলভর্তি হয়ে বাটি আবার নাপিতের হাতে পৌঁছায়। নাপিত যত্ন করে দাড়ি কামিয়ে, বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে চারুদর্শন লোকটিকে গড় হয়ে প্রণাম করে; তুই কি বর চাস? সে বলল আমাকে এমন বর দিন যেন কাউকে ক্ষুর-কাঁচি ধরতে না হয়, আর যেন ভাতের অভাব না হয়; সেই থেকে নাপিত বাড়ির উন্নতি— সবাই এখন ডাক্তার, টিচার, পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার…।

বলাবাহুল্য— নাপিত বাড়ির শনৈঃশনৈঃ উন্নয়ন এলেও, গাঁয়ের আর-আর মানুষের অভাব এবং চাকরিহীনতা হয় নিত্যদিনের ঘটনা। স্মরণ হয়— নাপিত বাড়ির মধুশ্রী চিরকালের মতো কলকাতা শহরে নিখোঁজ হওয়ার আগে, গোপনে পরস্পর গঙ্গাজল ছড়িয়ে মিষ্টিমুখ করে মোমেনা খাতুনের সই হয়েছিল… দেখা হলে, একে-অপরকে বলত গঙ্গাজল। গঙ্গাজল নামক দুই সখী প্রাচীন বৃক্ষের গায়ে নাম লেখে— মধুশ্রী + মোমেনা; বৃক্ষ বিকশিত হয় এবং দুই সখী ক্রমশ বৃক্ষের বাকল জুড়ে উদ্ভাসিত হয়… উদ্ভাসিত অক্ষরসমূহ জলজ হয়, ম্রিয়মাণ হয় এবং একদিন দ্রুত আবিষ্কৃত হয়— মধুশ্রী ও মোমেনা এখন বিযুক্ত দেশ-গাঁয়ের মানুষ বটে! বৃক্ষের শরীরে প্রতিস্থাপিত অক্ষরসমূহ মোমেনা খাতুন কান্নায় দ্রবীভূত হয়ে স্পর্শ করে এবং অচিরেই জাতপাতের ব্যবধান, অন্তঃস্থলের রক্তক্ষরণ ও আত্মীয়তার বিধি-নিষেধ নিংড়ে নিখোঁজ গঙ্গাজল-সখী মধুশ্রীর অন্তর্ধান পর্ব উন্মোচনের সুযোগ খুঁজতে বসে। লোকসকল আড়ম্বরহীন স্বচ্ছ-স্বচ্ছল কণ্ঠে শোনায়— মধুশ্রী জলচৌকিপাতা ঘরদোর, স্কুলব্যাগ, আলপথ, আলু চাষিদের ভোরবেলা ও শাড়ির রঙের মতো ধানক্ষেত পরিত্যাগ করে একটি রোগা শরীর নিয়ে, কোনো এক গোপন সন্ধ্যারাতে, কিছুমাত্র অবহিত না করেই, বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রতিবেশী-দেশে উদ্বাস্তু হয়ে যায় জিন্স-টপ পরিহিত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাদাম চিবুনোর মহড়ায়। দুপুরবেলা মধুশ্রী হয়তো আগুন-লাগা সাঁকো দেখে, কলকাতার রাস্তায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে সদ্য প্রস্তুতকৃত ডেডবডির প্রযত্নে সাদা খই উড়তে দেখে, আর কী চমৎকার কালচারাল কলেজ স্ট্রিট! মধুশ্রীদের আমলেই চিঠি যুগ শেষ হয়ে যায়; ফলে মধুশ্রী ও মোমেনা খাতুন নামক এক জোড়া গঙ্গাজল অচিরেই ট্রেন-নৌকা হয়ে শত শত অন্ধ-বালকের গান শোনে নিরুপায়— ল্যায়লা ও ল্যায়লা/….মেরা জীবন কোরা কাগজ…! কলকাতা শহরের আগুন লাগা মারুতিময় সড়ক থেকে ভেসে আসা এই গান নিশ্চয় মোমেনা খাতুন শুনতে পায় না। তার ভাগ্য নাপিত বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতো উজ্জল নয়। মোমেনা খাতুন, তার অপর আত্মীয়বর্গ এবং পাড়ার আর আর সবাই তীব্র ধ্বস্ত, খণ্ডিত এবং অনাহারী। তাদের জমিতে কেউ ইনজাংশান করায় ধানের মওসুমে ঘরে ধান তোলা যাবে না— কারণ সেকান্দার আলীর লাঠিয়াল বাহিনী উপস্থিত। প্রায়শ তাদের ছাগল-হাঁস-মুরগি চুরি হয়। কখনো নদী-পুকুরের পানি খাওয়া হয় সরাসরি, কখনো ফিটকারি; ডায়রিয়া হলে, মুদি দোকানদারকে অগ্রিম অনুরোধ করা হয়, ঔষধ রাখার জন্য। সাহায্য সংস্থার উন্নয়ন— তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নলকূপ বসানো হয় জোতদারের দরজায়; আমরা পানি আনতে যাই, কিন্তু নলকূপে তালা লাগিয়ে রাখা হয়। দুই একর জমি চাষ করি গেল বছর : ধান হলো ২২ থেকে ২০ মণ; মালিক পায় অর্ধেক, অবশিষ্ট ধানে কোনোরকম দু’মাসের খোরাক হয়। ওদের কাছ থেকে ঋণ নিই। ধান শেষ হলে মাছ ধরি নদীতে। মাছধরা শেষ হয়, বীজ করা শুরু করি। বীজ করতে যেয়ে পায়ে ঘা হয়, ফিটকারির চাকা পানিতে গুলিয়ে প্রথমে পা ধুয়ে নিই। তারপর চুন-পানিতে গুলিয়ে সেই পানি সারারাত পায়ে দিয়ে রাখি। পা একটু শুকনা হয়, তারপর ফের বীজতলায়। জমি করি আমরা, আর জোতদার পায় ডিসিআর। উন্নয়নের দ্যুতিচিহ্ন কিংবা ভীষণমূর্তি প্রসন্নমনে দেখার জন্য আমাদের এখানে কখনো প্রকল্পের লোকজন আসে, সরকারের গাড়ি আসে, ইউনিসেফের জিপ আসে; প্রজেক্ট অফিসার গ্রুপ তৈরি করে এবং আমরা ভিক্ষাপাত্র ফেলে, পরমান্নের আশায় একনিষ্ঠ বিরামহীন মন্ত্রোচ্চারণে কাজ শিখি— তাঁতবোনা, জামা-সেলাই, রুটি-বিস্কুট, পোলট্রি, মোমবাতি, বাঁশ-বেতের কাজ, ধূপকাঠি, বই বাঁধাই ইত্যাদি; বই বাঁধানোর মেশিন দেখে আমাদের ভয় হয়েছিল… বইয়ের ধারগুলো সমানভাবে কাটতে যেয়ে আঙুল না নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রজেক্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে মোমেনা খাতুনের আত্মীয়বর্গ তর্ক করে… আমাদের গ্রুপের জিনিসপত্র উই এবং ইঁদুর কেটে দিচ্ছে, একটা ট্রাঙ্ক বা আলমারি পাঠানো দরকার। প্রজেক্টের আলমারি সঠিক সময়ে পৌঁছতে পৌঁছতে মোমেনা খাতুনের পাড়া-গাঁয়ে সবুজ বৃষ্টি নামে, ড্রপ-আউট ছড়ায় এবং ক্ষেত-খামার ছুঁয়ে মানুষের ক্ষুধা ও পদাহত কুকুরের কান্না হয় অধিকতর জটিল, কুৎসিত, ভীতিমুগ্ধ ও প্রসারিত। মোমেনা খাতুনের আত্মীয়-স্বজন জঠরচক্রে বন্দি হয় এবং আর্তরব ছড়ায়। মানুষ ক্রন্দসী হয়, পথচারিণী হয় এবং আত্মীয় সভাচূর্ণ করে হীনবল হয়। লোকেদের শস্যঋণ ক্রমশ বদলায় এবং ভারি হয়— চাষের ঋণ, সমিতির ঋণ, ব্যাংকের ঋণ, মহাজনের ঋণ হয়ে আবর্তিত হয়। একবার অবিরাম পুড়ে যাওয়া মে মাসের ৮ তারিখ, ঘরের জ্যেষ্ঠ জন— লাগাতার অভুক্ত হয়ে, অর্ধভুক্ত হয়ে, কর্মহীন হয়ে শহরে যায়… ৯ই মে মোমেনার মতো বয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রীর বিয়ে; লোকটি শহর থেকে ফিরেই সমিতির সুবৃহৎ ঋণচক্রকে কোমলঋজু আঙুলে পরাজিত করার জন্য বোধিচিত্তের শান্ত দোলাচাল ও বৈরীতায় উদ্বন্ধনে জড়ায়। বিয়ে পিছায়-পিছায় না; বিয়ের আচারাদি সুসমাধার জন্য লাঞ্ছিত লাশ, কাটা-ছেঁড়া লাশ, হত্যা হয়ে যাওয়া লাশ… মানব দায়িত্বের শেষ অংশ হিসেবে মর্গে শুয়ে থেকে কালক্ষেপণ করে। অনেক পরে যখন লাশ গৃহ-অভিমুখী, তখন পথের একপ্রান্তে নববিবাহিত-দম্পতির সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়… লোকেরা পথের রুক্ষবেশ ভুলে, ধুলোতে মাথা ঠুকে, শরীরের-হাড়ের ক্ষতচিহ্ন আড়াল করে, অবসন্ন-নতমুখে বুনো ঝোঁপের ভেতর লুকোয় যেন কন্যাদানের আর্শীবাদ মুহূর্তে মন্দ ছোঁয়াছুঁয়ি এড়ানো যায়। লোকেরা সভা করে বেঁচে থাকার জন্য; আর স্মৃতির আকাশ ভাঙা অন্ধকারে তৎক্ষণাৎ কাউকে কোথাও আগুনে পুড়তে দেখে; আর দেখ, ‘বীজধান এজেন্সির দপ্তর ঘেরাও হয়েছে’— এই অজুহাতে অতর্কিতে স্বরাষ্ট্র-বিভাগের শান্তি-কাঙ্ক্ষী গুলি এবং একজন দু’জন রূপান্তরিত-নিশ্চল মানবমূর্তিকে দু’এক লক্ষ টাকার রাজকীয়-উদাসীন ক্ষতিপূরণ, কিংবা আমাদের বিস্তর কথোপকথন এবং নিছক মানব প্রেমবন্দনা।

যৎসামান্য এই ক্ষতিপূরণের জন্য জীবন নামক অনন্ত ক্ষমাহীন ক্ষতচিহ্ন আড়াল করে, লাগাতার বিধবা হওয়া সমীচীন মনে হয় না— অভাবদীর্ণ গ্রামবাসীর। সুবৃহৎ অন্ধকারের সমাপ্তি রেখায় ছোটছোট হিসেব লেখা হয় মস্তিষ্ক জুড়ে… ঘাস ছাটার খরচ + ট্রাক্টর চাষ + মইচাষ + বীজধানের দাম + ধানরোপণ + সার + ধান কেনা + ধান মাড়াই…? তারপর সেচের জল? ততদিনে লোকেদের জমি নিশ্চেতন হয়, খাসজমি হয় এবং এক গূঢ় সংকেতে অনিবার্যভাবে তারা উদ্বাস্তু হয় খাসজমি থেকে। ইউনিসেফের কাগজে এদের রক্তশূন্যতা চিহ্নিত করা হয়। তেজস্বী মধ্যাহ্নের প্রশ্বাসে ঘর-সংসার আরও অভাবদীর্ণ হয়, শীর্ণ হয়, নির্বল হয়, অখণ্ড উদাসীনতায় তাদের লাগাতার সন্তান উৎপাদিত হয় এবং গৃহস্থ বাড়িতে প্রায়শ অস্পষ্ট-অনির্ণীত কালব্যাপী তারা অনন্ত মুণ্ডিতমস্তক চাকরে রূপান্তরিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে এদের সরকারি আইডি মিশে যায় আকাশ রাজ্যের আনন্দমহলে […কার্তিক মাসে নুন মেশানো ভাত আসে/ আসে না!] এরা দাদন নেয়, খাদ্যের বিনিময়ে ক্ষয়স্নাত-উন্নয়নের রাস্তা বানায়, …এমব্রয়ডারি কাজ শেখে, খেজুরপাতার ঝুড়ি বানায়, বাঁশের ঝুড়ি বানায়, ভিক্ষে করে, বাস্তুজমি হারায়, রক্তবমি করে এবং গালমন্দ শোনে— এতবড় গতর কাম-কাজ করবি, …রোজগার করবি… খালি সাহায্য দাও-সাহায্য দাও…! মানুষের এই অনাহার-প্রক্রিয়া আরও সঠিক বুঝবার জন্য, মধুশ্রী নামক একদা সই অথবা গঙ্গাজল কর্তৃক উপহারে পাওয়া গ্রন্থ থেকে মোমেনা খাতুনকে পাঠ করতে বলা যায় : …মোমেনা খাতুন বঙ্কিমচন্দ্রের পাগড়ি থেকে মাকড়সার মমি পরিচ্ছন্ন করে খাদ্য সংকটের অংশটি ময়ূরের পালক দিয়ে চিহ্নিত করে। অনুমান হয় এই বর্ণনা ‘আনন্দমঠ’-এর; ‘…ফসল ভাল হয় নাই, সুতরাং …চাল কিছু মহার্ঘ্য হইল— লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজত্ব কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। …লোকে প্রথমে ভিক্ষা করিতে আরম্ভ করিল। তারপর কে ভিক্ষা দেয়! …উপহাস করিতে আরম্ভ করিল। তারপর রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গরু বেচিল, লাঙল জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল। জোতজমি বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী, কে কিনে! খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল, ইতর ও বন্যের কুক্কুর, ইন্দুর, বিড়াল খাইতে লাগিল। যাহারা পালাইল, তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল। যাহারা পালাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল’।

অজ্ঞাতবাসের আগে, অনিঃশেষ ঘনায়মান ঝরাপাতার আগে— সে বহুদিনের কথা, মোমেনা খাতুনের গ্রাম জুড়ে এই প্রকার অনাত্মীয়প্রলয় মিশে থাকে। লোকেরা তারপর অতি-প্রত্যুষ মায়াব্রত-জন্মবন্ধন অন্যত্র সঞ্চয় করে একদিন স্তূপকৃত বাঁশ পাতায় শব্দ তুলতে তুলতে শুষ্ককণ্ঠে হাঁটে, …যেন বন্ধনহীন মুক্তির পথেই হেঁটে চলেছে। কতিপয় নামহীন নদীর ধার, পাখির নীরবতা, আমাদের কাতর-ক্ষয়প্রাপ্ত মন— পশ্চাতে-সমুখে রেখে, বিষণ্ন মৃত্তিকা ছুঁয়ে, দুধের আড়ৎ পেরিয়ে উৎচ্ছন্নে যাওয়া লোকসকল তুমুল ঘণ্ঠাধ্বনির মতো পৌঁছে যায় নগর-পৌরসভার ছায়াছায়া ডুমুর-গড়িয়ে যাওয়া অসচ্ছ্বল-লক্ষ্মীছাড়া বারান্দায়।

[‘গাছ তুলে অন্য জায়গায় লাগালে, বাপু ইহজীবনে শেকড় গজায় না আর’…/ ‘হত্যা ছাড়া পরবর্তী অতিশয় দুঃসহ ঘটনা, শোকবিহ্বল ঘটনা— তোমাকে বাস্তুচ্যুত করা’।] অভাবদীর্ণ নিস্তরঙ্গ চেনা এই গ্রামজীবনে, ততদিনে আরও সব অকারণ দুঃসময় অতর্কিতে আছড়ে পড়ে। দীর্ঘায়িত ক্রন্দনের মতো সেই এবড়ো-থেবড়ো ঘর-দুয়ার, কাছারি, ধান-শস্য ও ক্ষমাহীন হাড়-মাংসের সংসারে— …আর কীভাবে ফেরা যায়? অন্ধ ফুফু হাত-মুখ স্পর্শ করে— তোরাই তো আমার চোখ! …বৃষ্টি আসছেরে। শুকনো কাপড় তুলে ফেল। পায়রা নামছে, পিছল মাটি থেকে দুর্গন্ধ, ভিজে খড়, হিমশীতল শ্যাওলার কণা নখে, …বিবমিশা, …আর ইট ফেলে-ফেলে পৌরসভার পরিত্যক্ত দালান এবং ফুটপাত দখল। এর অর্থ— আমাদের সমুদয় অমৃতসভা নিশ্চিহ্ন হচ্ছে ধীরে ধীরে। অভাবদীর্ণ-নিস্তরঙ্গ সেই গ্রাম্য জীবনে… ধরা যাক, লাগাতার কতিপয় জন্মান্ধ-আর্তরব প্রতিষ্ঠা পায়, উদ্বাস্তু হওয়ার আরও খানিকটা আগে। হয়তো এই প্রকার কুশাসন মোমেনাদের গ্রামে নয়, মোমেনাদের গ্রাম হয়ে আরও দূর সংসার-পাতালে, আরও ধূসর-খর্বকায় শেষতম মশালের আর্তনাদ ছুঁইছুঁই পদচিহ্নের রাজ্যে পৌঁছায়। এরকম সন্ধ্যা নেমে আসা প্লাবনভূমিতে মানুষ ভাসমান হয়, মলিন হয়, আর তাদের তাবৎ মধুক্ষরণ বাক্যরাশি নিশ্চেষ্ট হয়, নিশুতি হয় এবং খোলা আকাশ প্রান্তে কেবলই নির্মিয়মাণ ভৌতিক বৃক্ষরাজি ও অবিরাম ছায়ামূর্তি হয়। এবার মোমেনাদের জন্ম-জন্মান্তের দীর্ঘ ক্রন্দনের মতো প্রাক্তন গ্রাম-পৃথিবীতে— অনিন্দ্যসুন্দর উন্নয়ন শোভা-বর্ধনের জন্য অপার্থিব দেয়াল গেঁথে, ভেতরে কৃত্রিম ডাইনোসর এবং বাঘ রাখা হয়— থিম-বাগান প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। বলাবাহুল্য, ভূমি আক্রমণের অপব্যাখ্যায়, জ্বালাময় একপ্রকার ক্রোধ ও মৃত্যু-সংযুক্তিতে নাকাল— রক্ষাকবচহীন এই লোকদের স্মৃতিচিত্রময় ক্ষুদ্রাকায় কিচেন-গার্ডেনের বহুবিধ সমষ্টি বিসর্জিত হয় এই বালি সিমেন্টের ডাইনোসোর ও বাঘের নকল থাবায়… কারণ একনিষ্ঠ মন্ত্রোচ্চারণে, থিম-বাগানের পাশাপাশি এখানে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে অনন্ত নক্ষত্রের মতো এক থার্মাল পাওয়ার। বিদ্ব্যৎসমাজে অভিজ্ঞান হয়— আলো উৎপাদনের যুদ্ধস্রোতে প্রতিদিন ছয় মিলিয়ন ছাইভস্ম আসবে আমাদের উঠোনে। ভূমি অধিগ্রহণে বাধা আসায় পুলিশ অনেকগুলো মামলা দায়ের করেছে ইতোমধ্যে। দেখা যাবে— উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নদীর ঐ প্রান্তে কোথাও বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে। নিমার্ণ হচ্ছে ইকোপার্ক, পার্টি সেন্টার অথবা পিকনিক স্পট। ফলে জমির বদলে জমি চাই… এই শব্দরাশি অচিরেই ভূতলে পথ হারায় এবং সত্তরোর্ধ্ব এবাদউদ্দিন প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যে, অভুক্ত ও তৃষ্ণার্ত কাল পাড়ি দিতে-দিতে দিক চিহ্নহীন হয়ে জেলা প্রশাসকের সামনে বিষপানে আত্মহননের পথ উন্মুক্ত করে নিশ্চিন্তে। স্মরণ করুন— উন্নয়নজনিত রিফিউজি হওয়ার কালে, সে বছরইে এক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান এলো গ্রামে… যেহেতু তোমাদেরকে গৃহত্যাগী হতে হবে, অন্তত বেঁচেবর্তে থাকার জন্য, এক্ষনি সঞ্চয় কর, …পাঁচ বছরেই দ্বিগুণ; একমাসের মাথায় পঁচিশ লাখ টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠান নিখোঁজ! লোকেরা কপর্দকহীন হওয়ার ভেলকিবাজিতে হতবিহ্বল হয় এবং লাগাতার হুমকির সম্মুখিন হয়— গ্রাম ছেঁড়ে যাও : হাইওয়ে হয়ে, বাঁধ হয়ে, বিদ্যুৎ হয়ে, নতুন এয়ারপোর্ট হবে, রপ্তানি বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প হবে, আর হবে তেজস্বী প্রতিভাবান এক বিস্তারিত সেনা-ছাউনি! প্রায় অন্তঃপুরিকা-স্ত্রী অধুনা দূরের কনস্ট্রাকশন ফার্মের মেসে গৃহপারিচারিকা হওয়ায় বাস্তুচ্যুত মুহম্মদ মহসিন লজ্জায়-ক্রোধে নিজেকে দগ্ধীভূত করে। অপর হীনজন্ম-প্রতিবেশী দবির মৃধা, কন্যাকে— মুম্বাই-কলকাতার নিষিদ্ধ লাল অঞ্চলে চূর্ণ করার জন্য, পরিবারের বাকি পাঁচজনের খাদ্য হবে দিন পাঁচেকের— সেই লোভে-ভয়ে উন্মাদের মতো অর্থ গ্রহণ করে, অচেনা এক আপাত মধুক্ষরা জিন্স টি-শার্ট পরিহিত, পৃথুল মধ্যবয়সীর হাত থেকে। উদ্বাস্তু লোকেরা ভেবে ভেবে— বহনকৃত পুরনো ভারগ্রস্ত বিছানা বালিশ পুড়িয়ে দেয়, মোটর গ্যারেজের আঁধার-বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে নাগরিক হওয়ার শপথবাক্য পাঠ করে এবং শুদ্ধ অন্ধকার গায়ে মাখে। লোকেরা ক্লান্ত হয়, নিরুদ্বিগ্ন হয়, নতুন সম্ভাব্য এয়ায়পোর্ট-বাঁধ ও বিদ্যুত কেন্দ্রের সারিসারি কাল্পনিক অদৃশ্য আলোয় মুখ দেখে ভাঙা আয়নায় এবং অখণ্ড এক শোকদিবসের কিনারায় নতুন চিরনতুন কতিপয় দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হয়। পাড়ায় পোষা একটি কুকুর ছিল তাদের অনন্তদিনের… লোকেরা চূড়ান্ত অজ্ঞাতবাসের আগে, খেয়াল করে— রুটি ছিনতাই নিয়ে দুটি প্রাণী… দ্বিপদ বনাম চতুষ্পদ, সমবেত মানুষের করতালিতে সাধ্যাতীত এক লড়াই শুরু করেছে; পোষা কুকুর রুটির অপেক্ষায় দ্বিপদ-জন্তুর শত্রু হয়, বিবশ হয় এবং পুরনো মানুষ-বন্ধুকে সকল গৌরবময় শপথবাক্য বিস্মৃত হয়ে কামড়ে দেয়— লোকটি অরক্ষিত শরীরে ক্ষত নিয়ে, ক্ষুধা নিয়ে, ভয় নিয়ে, অচেতন হতে-হতে পঞ্চম দিবসে অবশেষে প্রদোষকালের জনহীন তীরে জলাতঙ্কের আবহ তৈরির আগেই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে। বলা যায়, নতুন নতুন মৃতদেহ এইভাবে অগাধরাত্রির দিকে প্রবাহিত হলে জনবসতি ক্রমশ একলা হয়, নীরব হয়, উদাস হয় এবং তাদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ হয় কেবলমাত্র জলের অক্ষরে। উৎপাটন-যজ্ঞ এই প্রকার সুপ্রচুর মসৃণ হওয়ায় প্রজেক্ট অফিসারের মুখমণ্ডল শান্ত এবং আনন্দঘন এবেলা; লোকেরা যখন গৃহত্যাগী হচ্ছে, বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে প্রজেক্ট অফিসের খোলা বারান্দায় মিষ্টান্ন বিতরণ ও যৎকিঞ্চিৎ ফলাহারের ব্যবস্থা হয়। উন্মূল মানুষ নক্ষত্রের ছায়ায়, অন্ধকারে, মৃত্তিকার কোমল মনের ভেতর সভয়ে হাঁটে… অবলোকন করে বিপুল তরঙ্গ, বাতাসে শোকগাথা ছড়ায়, মৃতদেহের সৎকার সম্পন্ন করে, আর হঠাৎ-ই মনে দাবানল ছড়িয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা তথা আধিপত্যমূলক বকব্রতী উন্নয়ন-পর্ষদকে মৃদু উত্যক্ত করে— ফলে গুলি হয় অচেনা এক আঁধার নিরাপদ জায়গা থেকে; এই অজ্ঞাত গুলিবর্ষণ তথা ‘বাঁধ বনাম বিশুদ্ধ পানি’ নিয়ে— রাতভর দলীয় ও নির্দলীয় সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবির ভেতর বেসুরো-অব্যাকুল-বিবশ তর্ক হয় মধ্যরাতের ঘুমক্লান্ত টেলিভিশনে; আর লোকেরা ভাবে— জমি এত গুরুত্বপুর্ণ কেন মানুষের কাছে? ডুবে যাওয়া এইসব অতিধীর নিদারুণ ক্ষতচিহ্ন, অবিরল ঘনহরিৎবর্ণ পরিহাস এবং অশান্ত মনের প্রভা নিয়ে… মোমেনা খাতুন ও তার দূর-নিকট উন্মূল আত্মীয়সভা জীবিকার সুতীক্ষ্ণ প্রহারে অবশেষে ঝলসে ওঠে, ভিক্ষাপাত্র জমায় এবং প্রাচীন গুহাচিত্রের দিকে ছিন্নদেহ বহনের কালে রাতের আকাশ জুড়ে কম্পিত হস্তাক্ষর পাঠায় অথবা নির্মাণ করে এক গোপন মরণলেখ।

মোমেনা খাতুন, সামান্য এই জীবনের অংশবিশেষসহ, ক্রন্দসী হয়, সুদীর্ঘ অপেক্ষা করে এবং কাদাজল রেললাইন পেরিয়ে… নৌকা বিষয়ক লেখক নজিবর রহমানের গৃহে সাময়িক অবস্থান করার অনুমতি পায় এবং অজান্তেই পাণ্ডুলিপির ২২নং পৃষ্ঠায় কালো কফির সীলমোহর অঙ্কনে সক্ষমতা প্রকাশ করে। কাজের ফাঁকে কখনো অচিন শোকগাথা প্রবাহিত হলে, নারিকেল-দড়িতে বাঁধা বাঁশের কঞ্চির একটি প্রাচীন ভগ্নপ্রায় তোরণ কেন প্রতিদিন মস্তিষ্ক ও বুকের ভেতর প্রহরীর মতো দাঁড়ায়? মোমেনা খাতুন তার তুলনাহীন ম্লানতায় এই দৃশ্যজগৎ অবলোকনের চেষ্টা করে। মোমেনা খাতুন অগম্য সেই ধ্বংসাবশেষ ভেবে উদ্বিগ্ন হয়, সান্ত্বনা বাক্য খোঁজে এবং থমকে দাঁড়ায়, অথবা মনের পথে-পথে হাঁটে— ঘন সবুজ আগাছা, কাঁটা ঝোঁপ, ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা, পাতা মাড়াবার শব্দ আর অযোগ্য-অসমতল সেই রাস্তা বিবিধ মানবজমিন হয়ে পৌঁছে গেছে গ্রামের পরিত্যক্ত রেল স্টেশনে। স্থির এক ট্রেনের জানালা গলিয়ে দেখা গেল… জন্মান্ধ অন্ধরা ট্রেনের কামরায় ভিক্ষা করে আর কামরা বদল হতে-হতে ক্লান্তিতে অবশেষে হাতের সাদা লাঠিকে করে চিরন্তন শয়নযান।

এরকম অটুট নিদ্রার ভেতর বাক্যালাপ হয়,…পানি খাবি : অটুট নিদ্রার ভেতর গা পুড়ে যায়, পাতা উড়ে, গঙ্গাজল-সই মধুশ্রীর আনন্দ মঠ-এর লণ্ডভণ্ড পৃষ্ঠা কাঁপে, হেঁটে হেঁটে আয়ুষ্কাল আসে, বৃক্ষশাখা আসে, করুণাধারা আসে, বইয়ের ধুলো আসে, আর আসে এক জনশূন্য আরোগ্যহীন আরোগ্যের পথ। হয়তো খেলাশেষের অবশিষ্ট ধুলোবালিতে নির্মাণ হয় আমাদের সুদীর্ঘ প্রশ্বাস, সাদা-কালো আলোকচিত্র এবং মধুর-নির্জনতম পরাজয়। কে ঘুম পাড়ানি মাঝির গান শোনাবে? মৌন-দিগম্বর-অবশিষ্ট পথ থেকে যায় আমাদের অগোচরে… আমরা কথা বলি, আর আমাদের সঙ্গে কথা হয় : …এত তীব্র ঘণ্টাধ্বনির ভেতর কীসের স্বপ্ন দেখ? ভাতের। ভাত বুঝতে পারো আঁধার চোখ দিয়ে? পারি। ভাতের আগুন-গন্ধ… অতীত, বারুদ, ব্যারিকেড ও আস্থাজ্ঞাপন ভাষা হয়ে হাতের ভেতর চক্ষু প্রতিষ্ঠা করে। …তুমি মর নাই? মরি না কেন? সেইতো …মরণ হয় না ক্যান…! আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে, কারা যেন আজও ভাত রাঁধে নদীর ভেতর ডুবে যাওয়া আকাশের কোলঘেঁষে। মোমেনা খাতুনের ভাসমান অতীত গাঁয়ের লোকসকল শহর প্রান্তর আলো-ছায়ায়, ফুটপাতে, মাঠে, নদীর পাড়ে— এইভাবে কখনো শূন্যস্থান পূরণ করে বৃষ্টি পতনের মতো এবং সেইসব ভেজা বৃক্ষশাখা দেখতে দেখতে আত্মবিস্মৃত হয়, …হয়তো বসন্তদিনের অপেক্ষাতেই দীর্ঘক্ষণ বৃক্ষশাখা দেখে এবং ঝুপড়ির প্লাস্টিক-ছাদে ঝুলে থাকা নাগরিক বাদুড় ও পেঁচার সঙ্গে ভাব করে। নিশাচার জীবকূলের সঙ্গে এবার ভাব বিনিময় হয়, দৃষ্টিগোচর হয় এবং কথা হয় মস্তিষ্কে অনর্গল : …বীজ ধান ফেলার কথা, খেয়ে ফেললাম; অর্থাৎ শপথবাক্য নিশ্চিহ্ন হলো; বিবিধ অভিশাপে সর্বশরীর জ্বলে, ভিজে যায় এবং ঘনঘোর সংঘর্ষ ছড়ায়। ঘনহরিৎবর্ণ পাতা খসে পড়ে এবং ভিক্ষাপাত্র থেকে শূন্যে অস্ত্রশালার প্রতিধ্বনি হয়। লোকেদের মৃতদেহ অগাধ রাত্রির পথে ভেসে উঠলে তীব্র ক্ষোভ হয়, …ক্ষুধা হয়। ক্ষুধার অশেষ ঘনছায়া নিবারণের জন্য এবার মৃত্যুমথিত কীটলোক থেকে চূর্ণবিচূর্ণ-ম্লান বাক্যস্রোত মেঘাবৃত সংখ্যাহীন চিহ্ন আঁকে মস্তিষ্কে : সেই এক অসাড়-অর্থঘ্ন কাল হয় ক্রমশ অহিতকর ও নিস্পৃহ— শাকপাতা গাছের শিকড় চিবুনো শুরু হয় অলক্ষ্মীর দশায় এবং অন্নাভাবে। পুকুরে নেমে কাদা ঘাঁটাই সার…; মানুষ গাঁয়ে থাকে না। শহরে আসে। ভনভন মাছি, আর অচিরেই উন্নয়ন নগরের ফুটপাতে পুলিৎজার জয়ের সেরা সাদা-কালো ফটোগ্রাফ হয়ে ওঠে… ‘ঘুমন্ত মায়ের কোলে মৃত শিশু’ …বলা যায়— লোকসকল এইভাবে অবিরাম অঘটন ঘটায়, অবিরাম হস্তপদ চালনা করে এবং মেগাসিটির বাকরুদ্ধ রচনাশৈলীতে মাগীর দালাল হয়, দেশি মদ বিক্রি করে, দিনমজুর হয়, বাবুর্চি হয়, গুন্ডা হয়, পকেটমার হয়, রিকশাওয়ালা হয় এবং সুসভ্য ক্ষমতাপূর্ণ দলের অন্ধকার-কুয়াশাচ্ছন্ন-গুপ্ত হিটম্যান সাজে। …আপনার জানা আছে, এত মানুষ শহরে আসে কেন প্রতিরোজ? গ্রাম-ঘরে কী অনাবিল আকাশ, মেঠোপথ, আদিগন্ত ধানক্ষেত? সব ছেড়ে এরা আসে শহরে। আসে বীভৎস মজার আকর্ষণে! এ দিকটায় দাঁড়ান— আপনাকে ইন্সট্যান্ট কাজের সন্ধান দিই, …থ্রি ইন ওয়ান : একটু ভালো গতর এবং যুবতি হওয়া চাই— ভিক্ষে করুন, চাকরগিরি করুন এবং বেশ্যা হন! ভোরে ঝাঁট দিন ঝুপড়ি সংলগ্ন কতিপয় দোকান-হোটেল, ঘর মুছে দিন এক-দু’জনের, তারপর ভিক্ষে শুরু করুন। দুপুরে কোথাও বাসন মেজে আসুন; যদি গৃহকর্তার ঝলমলে লিবিডো-উদ্ভাসিত রাজপুত্তুর থাকে বা গৃহকর্তা নিজেই যদি ভায়াগ্রা-পীড়িত হয়, তাহলে ঐ দুপুরেই যৎকিঞ্চিৎ ছোঁয়া-ছুঁয়ি, এতেও অর্থাগম আছে নিষ্কণ্টক ও সাবলীল। আর যদি-বা রাতে দেহ মেলে দিন, খদ্দেরের হাতেও দেয়া যায়, তাতে হবে নগদ পয়সা। মানুষের এই প্রকার বীভৎস মজা, মোমেনা খাতুনের আত্মীয়সভায় আরও বিস্তৃত প্রলয়কাল রচনা করে ও প্রায়শ হিম করা প্রতিধ্বনি আনে; লোকেরা ও নারী পুরুষেরা জীবিকার অত্যুগ্র প্রহারে নগরীর ক্ষীণকায় গলি খোঁজে লোহা-লক্কর, ছেঁড়া জুতা, মুরগির পালক, ডাবের খোলা, পোড়া কয়লা ইত্যাদি বিক্রি করার কলাকৌশল শেখে। রাস্তায়-ফুটপাতে সরকারি উন্নয়নমূলক গর্ত খোঁড়ার সহযোগী হয়, কখনো রক্ত বেচে এবং লিঙ্গ মোটা তাজাকরণ ও বন্ধ্যা-নারীদের চিকিৎসা সম্পর্কিত উর্বর-পোস্টার মারে। পোস্টার মারলে খাবার জোটে, পয়সাও জোটে। ঐ পয়সায় আপনি আয়েশ করে ফুটপাত দেখুন : শাড়ি, টিপ, লিপস্টিক, চিকেন রোল, পরোটা, সন্দেশ, সিগারেট, পর্নোগ্রাফি, স্যান্ডউইচ, ডিম সিদ্ধ, কন্ডোম, জুতো, লিটল ম্যাগাজিন, কী নয়, …আমরা শুনতাম বাঘের দুধ, এখন শুনি সাপের দুধও পাওয়া যায়! মোমেনা খাতুন রাস্তা জুড়ে অদৃশ্য সাপের দুধ ভাবতে চায় না; খোলা আকাশ জুড়ে গাঁয়ের ছায়ামূর্তিদের সংকট দেখে, মধুক্ষরণ কথা শোনে— মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে এবং ভৌতিক বৃক্ষরাজিকে সাক্ষী মেনে অবিরাম ছুটতে থাকে, অথবা কখনো কেবলই বৃক্ষশাখার দিকে চেয়ে থাকে এবং আত্মবিস্মৃত হয়… আমাদের কদাচিৎ বসন্তদিন আসে!

আমাদের কণ্ঠস্বর, হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্কে সদা মেঘের ঘনঘটা হয়। মোমেনা খাতুন হয় অচেনা, ক্ষুদ্র ও সুপ্রাচীন এক স্মৃতিচিহ্ন— সকাল-সন্ধ্যায় সে পৌরসভার গার্বেজ ভ্যান দেখে, আগুন রঙের শাড়ি সামলায়, মৃত্যু তিথি দেখে এবং বিপুল ভাগ্যদোষে খুঁজে বেড়ায় নিত্যকাল, কালস্রোত এবং বেলা-অবেলা-কালবেলা! নৌকা সম্পর্কিত লেখক নজিবর রহমান, একদিন দিগন্তব্যাপী এই নীরবতার কালে কঠোর কৃপা বর্ষণ করে এবং কিয়ৎকাল তার অন্নচিন্তা দূর করে। মোমেনা খাতুন ভরা সংসারে ঘুমায়, বেঞ্চের ধারে দাঁড়ায়, পাণ্ডুলিপির ময়লা ঘষে, মূক হয়, বধির হয়, প্রহর গণনাকারী হয় এবং সকল নিশ্বাস প্রশ্বাসে মরণের সুগন্ধ আঁচ করে। মোমেনা খাতুন এক ফাঁকে নগরের আত্মক্ষয়ী নৃত্যকলা দেখে, নজিবর-দম্পতির বিবিধ দৃশ্যের সাক্ষী হয়, ভিজে গামছা মেলে দেয়, জানালা দিয়ে দি গ্রেট সাইকেল স্টোর্স দেখে, গুয়ে মাখামাখি সারিবদ্ধ খবরের কাগজ দেখে আর অচেনা হতে হতে ভাবে— ভেজা ঘাস-কুয়াশা-পাড় ভাঙা নদীর জীবন আর কোনোদিন স্পর্শ করার সুযোগ তার হবে না। বহুপূর্বে শোকে মুহ্যমান হয়েছিল, এমন কয়েকজনের নাম স্মরণ হচ্ছে— নিজের মৃত্যুদণ্ডের নিচে দাঁড়িয়ে শস্যহীন মাঠে তারা কাবাডি খেলেছিল। মোমেনা খাতুন একটি পাথরের ঘরে একলা বসে শালিক পাখি দেখে এবং ঘাসফুল বৃদ্ধির দীর্ঘায়িত ক্রন্দন শোনে। শালিক পাখির সঙ্গে তার বাক্যালাপ হয়, হয় না। একপ্রকার শূন্যতা ভীষণমূর্ত হয়ে, দ্যুতিচিহ্ন হয়ে তাকে অতিধীরে অজস্র অসুন্দর কথা বলে; মোমেনা খাতুন, রূপান্তরিত নীরবতার রাজ্যে গৃহস্থের গোচরে এবং অগোচরে, কোনো এক মধ্যাহ্নে সবুজ-উজ্জল-মুখর পাতাসমূহ মাড়িয়ে, অবশেষে নতমস্তকে জনৈক সুলতান আহমেদের সান্ন্যিধ্যে উচ্চতর গার্মেন্টস প্রশিক্ষণে নাম অর্ন্তভুক্ত করে।

গার্মেন্টসের ক্ষমাহীন বারান্দায়, ঘরে এবং সুবৃহৎ ফ্লোরে কোমর, পুট, কলারের মাথা ও কলারের উচ্চতা রপ্ত করে মোমেনা খাতুন। মোমেনা খাতুন চিনতে শেখে— হেলপার, লাইন চিফ, লাইন সুপারভাইজার ও কোয়ালিটি কন্ট্রোলার। মোমেনা খাতুনের হস্তাক্ষর সুন্দর এই অজুহাতে তাকে রিপোর্ট কপি করার নির্দেশ দেয় কোয়ালিটি কন্ট্রোলার; মোমেনা খাতুন লিখতে শুরু করে : অদ্য ০১/০৩/২০১৯ ইং তারিখে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিয়েছে তাহার বিবরণ নিম্নে দেওয়া হইল :

প্রত্যেক লাইনের পকেটের প্লেট ছোট বড় হইতেছে এবং প্রত্যেক লাইনের পকেট আপডাউন হইতেছে। লাইন চিপকে বলা সত্ত্বেও তাহারা কোনো কর্ণপাত করিতেছেন না। মাঝে মাঝে বাটনের সেলাই এক পার্শ্বে পড়ে না। ফ্রন্ট ইয়োকের সেলাই ঠিক হইতাছে না। পকেটের সেলাই বেশিরভাগ অল্টার হইতেছে। ফিনিশিং সেকশন এ দেখা যাইতেছে যে ময়লা ও সুতাসহ মাল পলিব্যাগ হইতাছে। তাই ভবিষ্যতে এইভাবে ময়লা ও সুতাসহ মাল যাহাতে আর পলি না হয় তাহার ব্যবস্থা গ্রহণে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি একান্ত কাম্য।…

পুনশ্চ : অদ্য ০৫/০৩/২০১৯ ইং তারিখে যে সমস্ত সমস্যা দেখা দিয়াছে তাহার বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল :

বিগত ০১/০৩/২০১৯ ইং তারিখে আমি কোয়ালিটি কন্ট্রোলার হিসেবে জয়েন করার পর থেকে লাইনে যে সমস্ত কাজকর্ম হইতেছে তা থেকে দেখা যায় ৩০% সাট স্পট হইতেছে। এর একমাত্র কারণ প্রতিদিন লাইনে টিফিন খাওয়ার সময় খাদ্য থেকে যায়। এইভাবে যদি সাটগুলি স্পট হয় তাহা হইলে শিপম্যান দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নহে। কাজেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। নিবেদক : কোয়ালিটি কন্ট্রোলার।

মোমেনা খাতুন এইভাবে কখনো লেখক হয়, কখনো চকবাটন-এর বৈশিষ্ট্য শেখে, কখনো অবসন্ন হয়, উন্মত্ত হয় এবং স্মৃতির আকাশ ভাঙা রূপ পর্যবেক্ষণে অন্ধকারে সহসা কান্না করে। আর অজানা এক গভীর শ্বাস গোপনে অঙ্কুরিত হয় এবং সঞ্চারিত হয় অন্তরীক্ষে ও সুবৃহৎ জনপদে : অভাবদীর্ণ, নিস্তরঙ্গ একটি গ্রাম্য জীবন, একটি দুঃসময় অতর্কিতে আছড়ে পড়ে। ঘুমের কিনারা ঘেঁষে কেউ কথা বলে— দণ্ডিত অবস্থায় যা আপনার অভিজ্ঞতার অর্ন্তগত নয়, তা স্মৃতিধার্য হয় কীভাবে? পরমাশ্চর্য নিদ্রা আর পরমাশ্চর্য জাগরণের ভেতর কী সুন্দর দেখাচ্ছে মানুষটাকে। আমরা বুঝি আলোচনার সেই পুরনো অংশেই দাঁড়িয়ে আছি। আপনাকে কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক বোধ হচ্ছে। কখনো কি মনে হয়েছে আপনার আচরণ অনৈতিক? অটুট নিদ্রার ভেতর কেউ-কেউ প্রায়শ জগৎ-সংসার পরিভ্রমন করে : কিছু বাক্যালাপ গহ্বরে পড়ে, কিছু মৌন হয় এবং কিছু সুনিশ্চিত ভাবে হয় মারণাস্ত্র। নিশানায় কোনো ভুল ছিল না আমার! মোমেনা খাতুন ঘুমচোখে কুন্ঠিত হয় এবং শীতল হয়, …সাজানো অক্ষর বানান করে : ডাব্লিউডাব্লিউসি; …ওয়াকার্স ওয়েলফেয়ার কমিটির মিটিং। হাতে ডাব্লিউডাব্লিউসি-এর কাপড় বাঁধা। …আমাদের ইনক্রিমিন্ট ৫%, অন্যদের ১০%; …সভায় মৃদু তর্ক হয়; নারী-পুরুষ একই মান, একই বেতন এক সমান— এইরকম এক স্লোগান লিখে কেউ সমুখে দাঁড়ায়। কাঠমিস্ত্রি ফজলে আলী টেবিল মেরামতের সময় রডের সাহায্যে টেবিলে আঘাত করে এবং সহসা শর্ট-সার্কিট হয়। শর্ট-সার্কিট অর্থ— আগুনে মৃত্যুবরণ ও প্রত্যেকটি নিহত পরিবারে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি। …গত ৩০শে সেপ্টেম্বর, রিয়াজ গার্মেন্টস থেকে কাজ শেষে ফেরার কালে বরিশুর গ্রামের একটি ছাপড়া ঘরে রেহানা বেগমকে ধর্ষণ করা হয়। মামলা নং নারী নির্যাতন আইন ৪(গ) ধারা, ২(১০) ৯৩। …শনিবার ৫ই আগস্ট লুসাকা গার্মেন্টসে আবার অগ্নিকাণ্ড; যে ৯ জন মারা গেছে তার মধ্যে পাঁচজন কিশোর এবং চারজন কিশোরী। পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতালে এসে মারা যায় অপর এক গার্মেন্টস শ্রমিক। এইসব উপহাস, পুরাতন ছবি ও বিশৃঙ্খলতার কথা ধূর্ত-উদার-ভদ্র মালিকপক্ষের কাছে নিবেদিত হলে পরদিন সকাল-দুপুর গার্মেন্টস প্রাঙ্গণে যুদ্ধ হয়, গুলি হয়, অগ্নিসংঘাত হয়, ধ্বস নামে এবং পোড়া-মানুষ ও ক্ষতবিক্ষত মানুষ জমায়েত হয়ে দীর্ঘ এক মরণলেখ তৈরি করে। আপনারা কি আমাদের কথা শুনবেন? আমরা ভারমুক্ত হতে চাই। মিরপুর-শেওড়াপাড়ার রাস্তা বন্ধ করার দায় শুধু আমাদের না— ১৭-১৮ বছরের সালমার অকাল মৃত্যু কেন হবে? …এরা আমাদের ভাবে অসহায় মেয়ে মানুষ। আমরা তো ভালোভাবে ভালো পরিবেশে ভাড়া থাকতে পারি না। একটা গার্মেন্টস শ্রমিক যখন মা হয়, মাতৃত্বে যায়. তখন তার তিন মাসের ছুটি দরকার হয়। এরা সেই ছুটির পয়সাটা পর্যন্ত দেয় না, এবং সেই মায়েরাই রিজাইন মাসের বেতনটা ঠিকমতো পায় না। আমি অনেকদিন বিনা দোষে সুপারভাইজারের লাথি ও চড়-থাপ্পর খাইছি। এগুলো কি ঠিক? আমরা তো বাংলাদেশেরই মানুষ, আপনাদেরই ভাই বা বোন কেউ। আমাদের দাবিটা মানেন না কেন? …৩০শে ডিসেম্বর সবার মতো নাইট করে অসুস্থ হয়ে পড়ে সালমা। ২০০৬ সালের চালের সর্বনিম্ন দাম অনুযায়ী শ্রমিকেরা যদি ৫ মন চাল ন্যূনতম মজুরি হিসেবে দাবি করত তাহলে টাকার অঙ্কে তা হতো ৪৬০০। তাহলে বর্তমান দাম অনুসারে, আপনারা কি আমাদের সঠিক বেতন-ভাতা দিয়েছেন? …ওভারটাইম পাঁচ ঘণ্টা করলে টাকা দেয় ২ ঘণ্টার। একবার প্রতিবাদ করার কারণে এক শ্রমিকের চোখ তুইল্লা নিছিল মালিকরা। …আজ কত বছর থেইক্যা আমরা কাম করি গার্মেন্টসে। মায়ে রান্নার কাম করে মেসে। আব্বা তরকারি বিক্রি করে। ভোর ৪টায় উঠি, রাত ৮টায় বাসায় আসি, রান্নাবান্না খাইতে খাইতে রাত ১২টা বাইজা যায়। বারোটা বাজে ঘুমাই আবার ভোর ৪টায় উঠি, দেখি চুলা খালি নাই। আমাগো বাড়িতে ১১টা ভাড়াটিয়া, তিনটা চুলা, লাইন ধইরা রান্না করতে হয়। আবার বাড়িওয়ালা অনেক সময় পানি আর ইলেকট্রিক লাইন বন্ধ কইরা দেয়, বিল বেশি আসে বইলা। গোসল না কইরাও অনেক সময় দৌড় দেওন লাগে। যখন হেল্পার ছিলাম, তখন কার্ড নিয়ে গার্মেন্টস-এর বাথরুমে যাইতে হতো। কইতো, ৫ মিনিটের বেশি থাকতে পারবা না। অনেকে অসুস্থ হইলে ভাবত, বাথরুমে যাইয়া একটু জিরাইয়া আসি। কিন্তু পারত না। আবার অনেকে কাজ জইমা যাওয়ার ভয়ে বাথরুমে যায় না। কাজ জমলে বকা শুনতে হয়। এছাড়াও তো মেয়েদের অনেক সমস্যা থাকে। যদি কেউ বলে স্যার আমার সমস্যা, তখন বলে, কী সমস্য? তখন তো আর পুরুষরে বলা যায় না, কীসের সমস্য। তখন বলে প্যাট ব্যথা করে। কীসের প্যাট ব্যথা! প্যাট ব্যথা, চ্যাডের ব্যথা অফিসে চলে না। যাও কাজ কর গা। …ছুটি চাইলে, ছুটি দেয় না। একবার আমাদের ফ্লোরে সবাই নাইট করার পরের দিন। আমি মেশিন চালাচ্ছি, আমার পাশে হেলপার, মেয়েটির নাম সফুরা। সে ফ্লোরে কাজ করছিল। কাজ করতে করতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, আমি খেয়াল করি নাই। হেলপার মেয়েটি যে ঘুমাচ্ছে, এটা পিএম স্যার দেখে ফেলে। তারপরই আমাকে আর সেই মেয়েকে খুব মারে বেত দিয়ে। আমি কেন দেখলাম না যে মেয়েটা ঘুমাচ্ছে, এইজন্য আমাকে মারল। আমার দুই হাতে কালশিটা পড়ে গেছিল। আমি ঘরে ফিরি। আমার সাথী ভাড়াটিয়া, ওর নাম জ্যোস্না— ঘর ভাড়া না দিয়ে পালিয়ে গেছে বুঝতে পারছিলাম। ছয়দিন খোঁজ নাই; বিছানাপত্র ডেকচি-পাতিল আছে… এইসব বিক্রি করলে কয় টাকা পাই? বাড়ি ভাড়ার কথা ভাবতে ভাবতে আবার ফ্যাক্টরিতে যাই। সেইদিন প্রবল শব্দ হয় হঠাৎ। সমস্ত ফ্লোরে ধোঁয়া এবং আগুন। সিঁড়ি খুঁজি। সিঁড়ি পাই না। কখন নিচে নামি জানি না। আবার আগুনে বিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ জন মানুষ পুড়ে যায়। দেখি, অর্ধচেতন অবস্থায় নামার সময় শরীরের চামড়া ঘষে যেয়ে রক্ত ঝরছে কেবল। মনে হয় মৃত মানুষের শরীর ও শিপমেন্টের পোড়া কাপড় ওজনহীন ঝুলে আছে এবং অবশিষ্ট মানুষেরা মৃতবৎ শান্ত-শীতল ও সংকুচিত। আর চারপাশে কাপড় পোড়ার গন্ধ, মানুষেরা চামড়া-পোড়ার গন্ধ এবং মৃত-ক্ষ্যাপাটে-ভাসমান অগ্নিশুদ্ধি ও যজ্ঞকুণ্ড। নাইট করানোর পরদিন ছুটি দেয়ার নিয়ম থাকলেও আমরা পরদিন রাত ১১টা পর্যন্ত ডিউটি করছি; গুছাইতে গুছাইতে ১২টা; এই রাত ১২টা বাজে, আমরা কেমনে যামু? তিনারা বলেন— মন চাইলে চাকরি করবা মন না চাইলে যাইবাগা। রাত হইবই, কাজ চলবই। ছেলেরা-মাস্তানরা রাস্তা আটকায়। কয়, বেতন পাইছস, টাকা দিয়া যা। পুলিশ আটকায়— এত রাতে কইত থ্যাকা আইছস? এমডিকে জানাইলাম আমাদের সমস্য। এমডি আমাকে জিজ্ঞাস করল, আমি কোন সেকশানে কাজ করি। আমি কইলাম; পরের দিন সকালে ফ্যাক্টরিতে যাইয়া দেখি আমারে ঢুকতে দেয় না। বলে তোমার চাকরি নাই।

লোকেদের প্রতীতি হয়— সব মানুষ সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্বেচ্ছায় আগুনে এবং জলে ঝাঁপ দেয় না। অনেকেই বেঁচে থাকে। অদৃশ্য হয়ে বেঁচে থাকে এবং ক্রমেক্রমে পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের পরিধি বিস্তৃত করে চূড়ান্ত বিনাশকালের জন্য অপেক্ষারত হয়। তারা খসে পড়া পালকের মতো ভাসে এবং দেওয়াল ধরে-ধরে নিজের ঘরে ফেরে, তারা অন্ধকারের পৃথক-পৃথক যূথবদ্ধ কুণ্ডলী এড়িয়ে উদ্বেগ সংবরণ করে এবং কোথাও ভগ্ন নৌকায় বসে থাকে অধোমুখে… যেন জল থেকে উঠে আসা এক অচিন নরমুণ্ড জলে ফিরে গেছে এইমাত্র।

হ্যাপি গার্মেন্টস-এর তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুন, শিপমেন্টের পর সামান্য অবসর— এরকম কালে, যখন সে বসেছিল অধোমুখে, শুনতে পায় গার্মেন্টস বন্ধ ঘোষিত হয়েছে, সম্ভাব্য এক মারণ-ব্যাধির ভয়ে। সে এবং অপর কর্মীরা উদ্বেগ সংবরণ করে— যে চীন দেশের বিবিধ মেশিন তাদের ফ্লোর জুড়ে, সেখান থেকে অদৃশ্য অসুখ ছড়িয়ে যাচ্ছে, নতুন বছরের প্রাক্কালে। তারা গার্মেন্টস ত্যাগ করে গৃহ-অভিমুখী হয় এবং মুহূর্তের প্রজ্ঞাপনে চাকরি রক্ষার্থে শত-শত মাইল পথ হেঁটে আবার চাকরিস্থলে ফিরতে বাধ্য হয়; তারপর আবার পুলিশি-নিবর্তনের মুখে গৃহযাত্রা— এই অশ্লীল-বাধ্যতামূলক হাঁটাপথে, লোকেরা এবং মোমেনা খাতুন… অনুমান হয়, নিষিদ্ধ সেই অসুখের সক্রিয়-ছোঁয়া পায়। মোমেনা খাতুন বিচ্ছিন্ন হয়। একদা পরিত্যক্ত ঘরবাড়ির অপেক্ষাকৃত অধিক অগোছালো ঘরের ভেতর তার নির্জন-আশ্রয় চিহ্নিত হয়। জ্বর বাড়ে, জ্ঞান শূন্যতার মেঘছায়া, ঘ্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে, আর শ্বাসকষ্ট! মোমেনা খাতুন হাসপাতালে পৌঁছয়, পৌঁছয় না; লম্বা কিউ পাড়ি দিয়ে পরীক্ষা করে এবং অক্সিজেন টেন্ট-এ সমপির্ত হয় দ্রুত। কবে নৌকা বিষয়ক এক গ্রন্থের ২২নং পৃষ্ঠায় কালো কফির সীলমোহর তৈরি করেছিল, নজিবর রহমানের প্রযত্নে— সেই ছায়াছায়া কথোপকথন মনে এলো। দলবদ্ধ হয়ে শহর মুখো হয়, শহর-গাঁ করে… এরকম লোকসকলের মুখ ভাসে। নিশ্বাস বিভ্রাটে তার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়, …হাসপাতালের নিভুনিভু বিছানা এবং চাদর জুড়ে হ্যাপি গার্মেন্টসের গুচ্ছ বাটন-আই— বাটন তিন প্রকার, যথা— ওয়ান আই [১টি মাত্র ছিদ্র থাকে] : টু আই [২টি ছিদ্র থাকে] : আর ফোর বাটন [ছিদ্র থাকে ৪ টি]। মোমেনা খাতুন বদল করে-করে ১টি ২টি ও ৪টি বাটন আই দিয়ে মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বিদ্রোহ এবং নিঃসঙ্গতা কালের প্রেম বিষয়ে পুরনো পাঠ্যভ্যাস নিয়ে বৈরীতা ও দোলাচলে আটক হয়। দেখে— …পায়ের নিচে জল, একটি নদীর মতো, …পৃথিবী পেরিয়ে ভূ-গর্ভস্থ প্রতিবেশ ছেড়ে অপর জগতে পৌঁছানোর উপায় যেন; কোথায় যেন মৃত মানুষের দীর্ঘ পঙক্তি, সবার মুখে খেয়া পারাপারের রৌপ্য-মুদ্রা; একজন মাঝি, যার চোখে জ্বর এবং বাদামি-সবুজ! নদীর ভেতর কুয়াশা, আঁধার, হাড়, ভাঙা পুতুল এবং মরা মাছ। লোকেরা বলে, তারা আমাকে ভালোবাসে; আমি কান্না করি— মোমেনা খাতুন অচেনা বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাটন আই গণনার সময় ফিসফিস করে : আমার হাত-কনুই জাপ্টে আপনারা জগৎ-সংসারের বৈতরণী পার করবেন… এরকমই প্রতিজ্ঞা। আমার এখন প্রভূত আনন্দ। এই কথা আমার মুখমণ্ডল, আমার হৃদয় এবং ইন্দ্রিয়গুচ্ছ শুনলেও, আমার আত্মা এখনো বুঝতে পারেনি। মহান বিকেল-সন্ধ্যা ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে; হাসপাতাল-বিছানা থেকে আমি কি ঘরে ফিরছি? দ্বিধান্বিত পায়ে, গাছের গুড়িতে ঠেস দিয়ে, বাড়ি ফেরার পথে হাঁটছি।

সেই একই পথ, যে পথে বহুকাল আগের এক সকালে আমরা সমবেত যাত্রা উদ্বোধন করি। মোমেনা খাতুনের গলায় নিঃসঙ্গ-মৃত্যু-গাথা সরব হয় এবং সুরেলা হয়— অবাক বিস্ময়ে আমি আকাশ, গ্রামের ঘরবাড়ি, নদী, নৌকা দেখছি; আর সবাইকে এদের নাম জিজ্ঞেস করব, কারণ আমি সব নাম ভুলে গেছি। বিছানার কিনার ঘেঁষে বসব… আপনারা আমার নাম জিজ্ঞেস করবেন, আমার কথা বিশ্বাস করবেন, আর আমি আবার কান্নায় ভেঙে পড়ব। আপনাদের আনন্দ আমাকে সংক্রমিত করছে— বলুন তো জীবনে ফলবান হওয়ার ব্যাখ্যা কী? নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার অর্থ— আমি হারিয়ে যাব? প্রতিদিন আমার কপাল এবং বুকে এত আলো প্রক্ষেপণের কারণ কী, যদি আপনারা আমার খবর আদান-প্রদানেই অনাগ্রহী হয়ে পড়েন? মোমেনা খাতুন মৃত্যুমথিত অরক্ষিত মেঘ প্রদেশ থেকে কথা বলে : মৃত্যু আমার কাছে… ভয়ে-ভয়ে এবং সাহসে বলি : শীতল কিংবা প্রেমহীন নয়…! সাহস ছড়িয়ে বলি— মৃত্যু আমার ভেতর উত্তাপ ছড়াতে বসেছে। সঠিক কথাটা বোধ করি এখনো বলা হয়নি; আমার সত্যিই তীব্র ভয় করছে— প্রভু আপনি ভালোবাসা দিন, …মৃত্যু শেষমেষ দুঃসহ-ভয়ঙ্কর একটি তেতো ঘটনা; এ যাত্রা আমার হাড়, মুখমণ্ডল, জিহ্বা ক্রমশ দুর্বল, ক্ষীণ ও ঝলসে পড়া। লোকেরা আমার মস্তিষ্কের এবং হৃৎপিণ্ডের সকল বৈদ্যুতিক সক্রিয়তা ক্ষীণ হয়ে আসায় বেঁচে থাকার শেষ ইঙ্গিত খুঁজছে। লোকেরা হাসপাতালের প্রকৃতিবাদী তথা ইকো-ফ্রেন্ডলি টেলিভিশনে, এক প্রাচীন হাতির মৃত্যু-প্রতীক্ষা উপভোগ করছে গভীর ধ্যানমগ্নতায়… হাতিদের শোভাযাত্রা স্তব্ধ হয়ে গেছে; একটি মাঠের ভেতর প্রাচীন মৃত হাতিদের নির্মম সাদা কঙ্কাল রাশি; …এবার সর্বাপেক্ষা প্রবীণ হাতি, স্বনির্ধারিত মরণ-প্রজ্ঞাপন প্রতিপালনের জন্য সেই মাঠে খাদ্য-জল পরিত্যাগ করে নিঃসঙ্গ মৃত্যু পথযাত্রী হচ্ছে। মেয়েটি শুনল, কেউ শেখাল মোমেনা খাতুনকে— আত্মা কখনো বাদুড়ের রূপ নেয়; …দেখল সামনের গাছে, একটি মাত্র পাতা— রঙ বদল হচ্ছে, …হলুদ, মৃত্যুর রঙ; একটি হলুদ পাতা, মৃত্যুর রঙ হয়ে, আকাশ ছুঁয়ে আছে… আকাশ অর্থ মেঘ। বিস্তর জায়গা জুড়ে কেবল মেঘ। আমরা যেন একটি নৌকায়। আমাদের নৌকার দিকে আরেকটি নৌকা এত দ্রুত ছুটে আসছে— আঘাত হলেই সলিল সমাধি। আমরা চিৎকার করি— বিষয়টি ভুল হলো, ধেয়ে আসা নৌকায় তখন কেউ ছিল না, স্রোতের তোড়েই নৌকাটি অপরপ্রান্ত থেকে ধেয়ে আসছিল। মোমেনা খাতুন হাসপাতালের মুমূর্ষু অক্সিজেনে সাঁতার দিতে দিতে নিবুনিবু চোখে, এই প্রকার বিপন্ন-বিস্ময় চিহ্নিত করে এবং আবারও মেঘ রাজ্যে দ্রবীভূত হয়… দেখুন, সকল জায়গায় কেবল মেঘ, হাসপাতালের এই কাগজের ভেতরেও মেঘ : মেঘ ছাড়া বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টি বিনা বৃক্ষ বাঁচে না, আর বৃক্ষ ছাড়া কাগজ তৈরি হয় না। কাগজ এবং মেঘের এই ব্যক্তিগত ভ্রমন বৃত্তান্তের ভেতর মোমেনা খাতুনের নিশ্বাস ঘন হয়। অক্সিজেন টেন্ট সরে যাচ্ছে, অথবা আমাদের নিশ্বাস ও তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোমেনা খাতুন শরীর ও সত্তা শান্ত করার কারিগরি বিদ্যা শেখে। নিজেকে জলের ভেতর প্রতিফলিত দেখে। নিশ্বাস ভারি হচ্ছে, দ্রুত হচ্ছে, শান্ত হচ্ছে, অবসন্ন হচ্ছে… আর মোমেনা খাতুন তার নিশ্বাস অনুসরণ করতে করতে, মৃদু হাসি ছড়িয়ে মেঘ ও নৌকার দিকে চোখ মেলে, শান্ত শীতল হয়, শব্দহীন হয়… আর আকস্মিক শব্দহীন দ্রুতিতে ওজনহীন মেঘের মতো ঝুলে থাকে দিগন্তের আরও বহুদূরের এক জলাময় তুষারমণ্ডলে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করে। লোকসকল যদিও-বা গল্প গাছা ছড়ায়, তৈরি করে ভাবানুষঙ্গের বিবিধ স্বয়ংক্রিয় প্রকাশ, তৈরি করে অসংখ্য পাঠ থেকে পাঠান্তর, কিন্তু বিষয়টি এমনতর কদাচিৎ হয়… যখন মোমেনা খাতুনের আত্মা বাদুড় হয় এবং ভূ-গর্ভস্থ প্রাচীন নদীতে, জিহ্বায় রুপালি মুদ্রাসহ সে নৌকা আহরণ করেছে। বরঞ্চ প্রতীতি হয় যে— চীন দেশের জিপার, লেবেল কাটিং, পকেট ক্রিজিং মেশিন ইত্যাদির আহ্লাদে জীবনযাপন অবারিত হলেও একদিন নববর্ষের উৎসবে, ঐ চীন দেশ থেকেই একটি গোপন-হিংস্র-বিমাতা আতঙ্ক অগাধ শুঁড় দোলাতে-দোলাতে হ্যাপি-গার্মেন্টসের তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুনের শ্বাসনালিতে আশ্রয় নেয়। খবরে প্রকাশ পায়— মোমেনা খাতুন ভয় পায়, অনাথ হয়, স্তব্ধ হয়, অনিশ্চয়তায় ক্ষণিক হাহাকার করে এবং রূপান্তরিত হতে হতে ২২শে জুন ২০২০-এ ধ্রুব সমাপ্তির পথে নদী হওয়ার সম্ভাবনা ছড়ায়। গৃহচারী মানুষ, মোমেনা খাতুনের গ্রাম-প্রান্তর এবং দুগ্ধবতী গাভীর পালকবর্গ, মোমেনা খাতুনের মৃতদেহ যখন গ্রামের পথে— ‘মোমেনা খাতুনের শরীর নবনব লাগাতার মৃত্যুর উৎস’… এই উল্লাসে সকল সৎকারপর্বে বিরুদ্ধাচারী হয়, সংঘর্ষ ছড়ায় এবং এক স্তব্ধ-শূন্যতা প্রতিষ্ঠিত করে। অবিমিশ্র হাহাকারে মোমেনা খাতুনের বাবা, রাশিরাশি ছুটন্ত হাত এবং মৌন গর্জনে, চারপাশ শত্রুপক্ষের শিবির— এই বিবেচনায় অশ্রুপাত করে— …তাহলে কন্যা আমার মাটি পাবে না, হায় আল্লাহ খোদা, এত যাতনার মৃত্যুর পর… কব্বোরও জুটবে না? প্রহরীদের অজ্ঞাতে, আত্মরক্ষার জন্য পিতা এবং মৃতকন্যা কোনো এক সাজঘরের পেছনে যায়, অন্ধকার খোঁজে এবং কবর খোঁড়ার সুনির্দিষ্ট যোগ্য জমি বরাদ্দ না পেয়ে উদ্বোধন করে শান্ত-নির্জন-নিশ্চল এক নৌকাকাণ্ড— পিতা ও কন্যা জলে ভাসে, পিতা কন্যার মরদেহ আগলায়, বুকের ভেতর চিৎকার করে, শৃগাল হাঁটতে দেখে এবং পলাতক হয় নৌকার আঁধার-ছায়ায়। নৌকার চিরস্থায়ী ভ্রমন বৃত্তান্তে এবার দেখা যাবে— কোথাও বসতি, কোথাও অযোগ্য-অসমতল কাঁটাঝোঁপ আগাছা, উঁচু ডাব গাছ এবং ক্ষণে-ক্ষণে প্রগাঢ় নিশ্চল মানবমূর্তি, যেন পাড়া গাঁয়ের মোমেনা খাতুন কবরস্থ হয়ে কোনোভাবেই চীন প্রবাসী সেই মৃত্যুবীজ রোপণের সুযোগ না পায় মাটিতে। লোকেরা শক্তিমান রক্ষীর মতো নৌকা এবং নদীর পাড় ছুঁয়ে হাঁটে, একটি-দুটি প্রশ্ন করে, কোথাও দাঁড়ায়, নিষ্ক্রান্ত হয় এবং লাঠি ঘষে-ঘষে সোচ্চার হয়… মোমেনা খাতুনের মৃত-জীবন এখন মেঘাবৃত বটে, কোনোভাবেই মাটিতে গড়িয়ে পড়ার অনুমতি নেই। লোকেদের শপথ বাক্য এবং প্রশ্ন সকল আরও সুদীর্ঘ আয়ুষ্কালের অধিকারী হয়, ঘণ্টাধ্বনি শোনায় এবং মূর্তি হয়ে, প্রহরী হয়ে নৌকাকাণ্ড প্রদক্ষিণ করে। মোমেনা খাতুনের শান্ত রক্তস্রোত সূক্ষ্ণ ও বিকট আকার হয়ে, সর্বকালের অজানা ক্ষতস্থানসমূহ স্পর্শ করার প্রস্তুতি নেয়… লোকেরা নিশ্চিত হয়, মোমেনা খাতুন নামক একখণ্ড পিপাসার্ত পাথর-শরীর কালো রক্ত হয়ে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে বর্ষার গাঢ় অন্তিম স্রোতে। হ্যাপি গার্মেন্টসের তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুন মলিন মৃতবস্ত্রে শায়িত হয়ে আত্মবিস্মৃত বৃক্ষশাখার পানে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকে, বৃষ্টির ফোঁটার মতো টুকরো হয়; আর বিবিধ ইঙ্গিতে বাকরুদ্ধ দুঃখ-দুদর্শার এই সুর বিনিময় করে তার হীনজন্ম-বাবা— কোথাও যেন ভূমিকম্প, কোথাও মেঘ, কোথাও ছায়ামূর্তি… আর এইসব প্রকম্পন, সরীসৃপ ও আগুনের হল্কা হয়ে অতঃপর শূন্যে ভাসমান হয়, অশ্রুসজল হয় এবং চুঁইয়ে পড়া নররক্ত ও কাদার ভেতর আশ্চর্য শীতলতা ধারণ করে।

পুরনো প্রাচীন নৌকাকাণ্ডের সূত্রে এবার উন্মাদ মৃত্তিকা ধারাস্নান গড়ে, বৃষ্টি পতনের মতো কাঁপে এবং মোমেনা খাতুনের বিদায় গৌরব লেখে, ধেয়ে আসা ছায়ামূর্তিদের সাক্ষী মেনে : …তোমাদের অবগতির জন্য বলি, বহুকাল আগে সব ছিল জল। কী গভীর অতলান্ত জলরাশি : এক বিশাল সরীসৃপ ভেসে বেড়ায় সেখানে, তার বিশ্রামের প্রয়োজনে সে একদিন হেঁকে বলল, একটা প্রবালদ্বীপ উঠে আসুক। …সেই থেকে ডাঙ্গার সৃষ্টি হলো। এরকম ভাবে এক শামান অনন্ত জলরাশির ওপর দিকে লালবুকওয়ালা পাখির সঙ্গে উড়ে যাচ্ছিল। বিশ্রামের জন্য মাটি খুঁড়তে বলে। প্রথমবার সফল হয় না পাখিটি। অবশেষে তৃতীয় বারের চেষ্টায় ঠোঁটে করে তুলে এনেছিল কাদামাটি, আর সেই হলো আদিম স্থলভাগ। তোমাদের প্রতীতি হয়… পরমেশ্বর থেকে প্রকৃত আকাশ উৎপন্ন হয়। আকাশ থেকে বায়ু। বায়ু থেকে অগ্নি। অগ্নি থেকে জল। জল থেকে পৃথিবী। পৃথিবী থেকে সর্ববিধ শস্য-বৃক্ষ। ঔষধি বৃক্ষ থেকে অন্ন। সেই অন্ন শুক্র শোণিত রূপে উৎপাদন করে জীব-শরীর। কিন্তু লোকেরা মোমেনা খাতুনের নৌকাযাত্রা দেখে, ভেঙে পড়া আকাশ দেখে এবং সেই দুঃখের ভেতর সান্ত্বনা বাক্য লেখে— …নদীতে নদীতে দেখা হয়, তবু বোনে বোনে দেখা হয় না! লোকেরা সুর নির্মাণ করে— …জলে খেল, জলে খেল, জলে তুমার কে আছে? ভালো কইরে ভাইবে দেখ, জলের মাঝে ঘর আছে— ইতোপূর্বে এইসব সুর এবং মৃত গায়কদের কথা জানা গেলেও, একযোগে আকাশ পানে চেয়ে থাকা মানবকূল, মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ার ছবি আন্দাজ করে এই প্রথম— …আর ভাবে এই তীব্র কূলপ্লাবিত জলে একটি নৌকা এবং নৌকার ভেতর শায়িত মানবজমিনের কী গতি হবে? নৌকার ভেতর শায়িত হ্যাপি গার্মেন্টসের মোমেনা খাতুন এবং তার বাবা, বাধ্যতামূলক মৃত্যুবীজ প্রতিস্থাপনের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য, জলের চেয়েও ক্লান্ত তাদের শরীর— জলের মৌন গর্জনে সমর্পিত করে। নৌকা এগোয়, স্তব্ধ হয়, প্রবাহমান হয়, আর বিস্ময়-বিপন্ন বাবা… মরদেহ ফিরিয়ে আনার ভিক্ষাপাত্র নিয়ে অশ্রু আড়াল করে এবং অন্ধকার-কাদায় তৈরি মূর্তির মতো কন্যার শয্যাপ্রান্তে বসে থাকে রোদনহীন। সারাদিনব্যাপী গ্রাম ও স্বরাষ্ট্র-বিভাগে অসিচালনা শেষে তার দেহ ও মন অবসন্ন— লোকটি আত্মরক্ষার উপায় খোঁজে, দিব্যমূর্তি ধারণকারী কাউকে অন্ধকারে মিশে যেতে দেখ, আর কন্যার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে : অমি বৃদ্ধ, জননী আমার— প্রত্যাশাহীন এবং অপেক্ষারত আমার নিজের মৃত্যুর জন্য। লোকটি নতজানু হয় এবং মৃতদেহ মুড়িয়ে রাখা কাপড় চুম্বন করে, অশ্রুপাত করে এবং বিগত-সমাগত সময়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। উৎসর্গকৃত নৌকা সাড়া না দিয়ে পারে না; জলের বজ্রকঠিন খেলাধুলার ভেতর আত্মগোপন করে একবার, আর একবার লোকসকলের মুখের দিকে গলুই ঘোরায়, …যেন জল ক্রমশ ভাষা হয়ে আসে! জলের ভেতর গ্রামের নাম প্রতিফলিত হয়— মুংলী, বনকিশোর, চাঁদনগর, জোতকার্ত্তিক, বৈদ্যনাথতলা…! তারপর বড় নদী ছোট-নদী শাখা-নদী হয়ে মরদেহ বহনকারী নৌকা ক্রমশ সোনার তরী হয়। জলের ভেতর থেকে কেউ কথা বলে। অথবা আপনমনে কণ্ঠস্বর জ্বলে-নিভে : …এই তিনটি ব্রিজ, …আড়ানী, মালঞ্চী এবং বড়াল। পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের গা-ভেসে তুমি চলেছ এখন। অন্তত ১৩০ বছর আগে এই পাড়ে রেশমকুঠি ছিল। কনস্টেবল নং ১২৮২, মো. রইসউদ্দিনকে, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১, দুপুর সাড়ে এগারোটায় হত্যা করা হয় এই নদীর পাড়ে। নৌকা যাচ্ছে মুংলী বাজার বরাবর, ৯০ বিঘা আয়তনের লক্ষ্মীপুর আমবাগানের কথা জানা আছে? তুমি যদি রস্তমপুর ব্রীজ ছুঁইছুঁই হও, এখানে নদী থেকে একটি খাল বেরিয়ে গেছে— খালপাড়ে কুঠিবাড়ি ছিল, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সম্পত্তি। তোমাদের নৌকা ফুলতলা শ্মশানঘাট ছুঁয়ে গেল। এই জলস্রোত ছুঁয়ে কাদিরাবাদ সেনানিবাস এলাকায় পৌঁছানো যায়। এই নদী যখন প্রমত্তা ছিল, তখন পাট বোঝাই একটি নৌকা ডুবে যায়। বর্তমান তিরাইল হাইস্কুলের মাঠটি সম্পূর্ণই ছিল নদীর অংশ। বলা যায়, নৌকা ক্রমশ এইভাবে এগোয় এবং দিগন্তব্যাপী নীরবতার আদিম কণ্ঠস্বর পুনরাবিষ্কার করে। ঝলসে ওঠা মানুষেরা পাড় থেকে নৌকাকাণ্ড দেখে— নৌকা এইপ্রকার অক্লান্ত মরণযাত্রায় কখনো গতিহারা হয়, দক্ষিণ পূর্বমুখী হয়ে বড় একটি বিলে পড়ে। বিল থেকে বেরিয়ে আবার বড় গাঙ; তারপর মিশে যায় আরও দূরে। …ক্রমেক্রমে স্থির হয়— মোমেনা খাতুনের মরদেহ এইভাবে শত যোজনব্যাপী বৃষ্টি ধারায়, দুপুর-মধ্যাহ্ন-রাত হয়ে, ভৌতিক বাগান ঘেঁষে, ঘুরেঘুরে অত্যাশ্চর্য পথ হাঁটে; লোকেরা বাঁশচেরা বেঞ্চির ধারে দাঁড়ায়, প্রহর গণনা করে, বারবার ঝলসে ওঠে— আর সহসা মোমেনা খাতুনকে আশ্রম কন্যা ভেবে মরণের সুগন্ধ আঁচ করার কৌশল রপ্ত করে। তাদের ক্ষুধার বৃত্তাকার থালা শুষ্ক হয়, নিদ্রামগ্ন হয় এবং উল্লাস-আতঙ্কের কাহিনি ছড়ায় তারা অবিকল এইভাবে। নৌকা নামক জলযান ধীরে-ধীরে কীভাবে কুহক নিদ্রার শোভা হয়, অহর্নিশ কীভাবে কটাক্ষ ছড়ায়, চক্ষুকর্ণহীন হয়, উপবাস করে… সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্যকথা বলার গন্তব্যে ধাবিত হয় ক্রমশ। মোমেনা খাতুনের অবগুণ্ঠন দিব্যস্নান শেষে, তখন আরও দূরদেশে, আরও দূর নীরবতায় মিশে যাওয়ার আয়োজন নেয়। লোকেরা অপেক্ষায় অপেক্ষায় গৃহমুখী হয়, গৃহবিবাগী হয় এবং পুনর্বার গূঢ় জন্মান্তর-রহস্যে… কপর্দকহীন হয় ও শব্দহীন দুলে ওঠে। বাঁশপাতার স্তূপ মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দ হয় গ্রামবাসীদের পায়ে। [আপনি কি লক্ষ করলেন, আমরা দুজন ব্যতীত এখানে আর কেউ, নৌকা-জল ছুঁয়ে নেই : বাবা আপনি কি উদ্বিগ্ন! নদীতে কী বাতাস! বাতাস বইছে? আপনাদের আলোচনার কিছু-কিছু অংশ ভেসে আসছিল, প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম স্মৃতি ভারাক্রান্ত হয়ে। বোঝাতে পারলাম না। আমি মর্মার্থ স্পর্শ করতে চাই না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে চাই সময়ের গা-ঘেঁষে। আপনারা সবাই নিরাময়ের পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন। আমি হাঁটলাম ধ্বংসের পথে… ধ্বংসের ক্ষুধা অসীম-অশেষ; আপন অন্তরে শোকের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলেন কখনো? আমরা এখন মাত্র দুইজন। কী হাস্যকর! আমি যে আপনাদের আর কেউ নই, আমি যে আর ভূ-পৃথিবীতে নেই… এই সহজ কথাটা কেন যে বারবার বিস্মৃত হই? আপনারা ভারমুক্ত হতে চাইছেন? সেই গোড়ার বিনির্মিত নির্মাণ-পর্ব থেকেই একটা জল বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনছি আমার মৃত কশেরুকা ছুঁয়ে। এইভাবে বাক্যালাপের কোনো অস্বিত্ব আছে? ভাষা একটি শরীর, একটি জীবদেহ বটে— আর এই জীবের আবাস হলো যুগপৎ ব্যক্ত হওয়া এবং অব্যক্ত থাকা। ফিরে যাব তাহলে? কোথায় ফিরে যাব? না কোথাও নয়! বাবা, আপনি বলছেন— স্মৃতি বিচলিত করছে; আমি বললাম, এসব স্মৃতি নয়, অন্যকিছু, …অনন্য প্রলয়, দৈত্যপুরী ও পোড়াঘাসের প্রান্তর। আপনি কি জানেন, বাবা, আমরা এই ভরা বর্ষার নদীতে এখন মাত্র দুজন? আপনাকে অন্যমনস্ক বোধ হচ্ছে। আমার এই নীরবতা মৃত-যোদ্ধার, …আমি স্বয়ং মৃত্যুবান; আর কী আশ্চর্য, নৌকা থেকে বেরিয়ে স্থলদেশে পদার্পণ করার সামান্য কয়েক হাত মাটি আমার জন্য অবশিষ্ট নেই! যে কজন মানুষ অধোমুখ হয়ে, আমার পা ছুঁয়ে কাঁধ ছুঁয়ে নখ ছুঁয়ে— আমার জীবনের মধ্যপথ দিয়ে হেঁটেছিল, তাদেরকে স্মরণ করেছি কখনো। বাবা, আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, আমরা মাত্র দুজন?]— …জলের শব্দে এই প্রকার আঁধার-সর্বনাশী ভাষা নৌকার গলুই হয়ে পুরো পাতাটন যেন দখল করে ফেলেছে। হ্যাপি গার্মেন্টসের তরুণ কর্মী মোমেনা খাতুন নিদ্রাচালিত নৌকায় বিছানা গুটিয়ে কখনো এইভাবে ক্লান্ত দেবদূত হয় এবং আকাশ-পাতাল ভাবনার ভেতর জনশূন্য-বাবার শরীর-মুণ্ডু ও নিশ্বাসে অদ্ভুত প্রকম্পন ছড়ায়। বাবা শান্ত হয়। শান্ত হতে শেখে। আয়ুষ্কাল বিষয়ে নির্বান্ধব হয়। হাড়-হিম করা প্রতিধ্বনি শোনে নদীর তীব্র স্রোতে। যমদূতের সরীসৃপ হাত আন্দাজ করে গায়ে, আর তীব্র গন্ধ, গুচ্ছের বকুলগন্ধ! মুণ্ডু জলে গড়িয়ে পড়ার ধুপধুপ শব্দ… অসংখ্য হাত-পা যমদূতের বকুলগন্ধ ও সরীসৃপ হয়ে, কিলবিল করে, আর আগুনের হল্কা ছড়ায়— যেন কোনোভাবেই আর রক্ষা নেই!

নিভৃতির খুব প্রয়োজন— বাবা ভৌতিক বৃক্ষরাজির দিকে চেয়ে ভাবল। ভাবল— তুমি সামান্য এক ছায়া মানুষ, …দুঃখ-দুর্দশার সুর বিনিময় করাই তোমার চলাফেরার প্রধান আলপথ। খানিকটা অনুমতি চাই বিশ্রামের জন্য, আমার শরীর এখন হীনবল! […বহু বছর আগে রাউতারা’র এই ঘাটে আপনাদের রবি ঠাকুর বজরা ভিড়িয়ে আসা যাওয়া করতেন প্রায়শ]। রবি ঠাকুরের সম্মানে, আসুন আষাঢ় মাসের প্রারম্ভে, এই ঘাট থেকেই হিমশীতল মোমেনা খাতুনকে ভালোবেসে নিদ্রাচালিত নৌকায় একক বিসর্জন দিই। মোমেনা খাতুন মৃত্যুবান হয়ে, মৃত্যুবীজ হয়ে, কালবিলম্ব না করে অচেতন অনন্ত বর্ষণ ধারায় সিক্ত হতে-হতে, নির্জন এককের গান হয়ে, এবার অতীব-গোপন এক সূর্যস্নানের স্বপ্নে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। লোকসকল আবিষ্কার করে— জলের চেয়েও ক্লান্ত তার দেহের ওপর অপার উজ্জ্বলতম আলোক রশ্মি; আর ঘুম ফুরিয়ে যাওয়া তার শরীর বীরগতি প্রাপ্ত হয়ে অন্তরের অগাধ রাত্রির পানে ধাবিত; এবার দেখা যাবে ধরিত্রীর শেষ ক্রোশ, কুয়াশার কাছে গচ্ছিত পেয়ারাতলার অনন্ত পৃথিবী, বটবৃক্ষের ছেঁড়া মলিন ছায়া, ব্রহ্মাণ্ডের মতো আকাশ, আকাশের মতো সমুদ্র এবং সমুদ্রের মতো নদী। বলা যায়— এই ভাবেই সহস্র নতুনতর মৃতদেহ অন্তরের অগাধ রাত্রির পানে একদিন যাত্রা করে এবং অনন্তকাল আমাদের অশান্ত মনের প্রভা হয় বিদ্যুৎ-স্পৃষ্ট নীরবতায়।

 

 

প্রশ্নোত্তর

শুদ্ধস্বর: গল্প লেখার ব্যাপারে আপনার তাড়নার জায়গাটা কোথায়? অর্থাৎ কোন বিষয় এবং ঘটনাগুলো আপনাকে গল্প লেখার জগতে পৌঁছে দিলো?

মামুন হুসাইন: নিজের সম্পর্কে বলা, যেন-বা খানিকটা নিজেকেই আড়াল করা। কেউ যখন শুনি— আমার অক্ষম-অকার্যকর-পুস্তিকা, ক্রোধে- বিরক্তিতে-অবজ্ঞায়-ভালোবেসে পড়ে ফেলেছে— তখন মনে হয়, তাকে খানিকটা চিনতে পারছি। তুমি গল্পের কথা তুলেছ— তাহলে আমার দু-চারটি অপাংক্তেও উপন্যাস/অপন্যাস বা গদ্য রচনার নেপথ্য তাড়না কি আলাদা? আমি নিজেও সঠিক জানি না।
মালার্মের একটি বীজমন্ত্র ছিল : সবকিছু শেষ হয় একটি বইয়ে। বোর্হেস বলতেন, উপন্যাস, গল্প কবিতা— সবকিছুরই মৃত্যু হয়, কিন্তু কাহিনির মৃত্যু হয় না। তুমি মানবে, আমাদের একদা যৌথগ্রন্থ পাঠ, তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া, শাহবাগে তোমার গ্রন্থ নির্মাণ-কারখানা এবং সেই সব গ্রন্থের ভেতর বিশুদ্ধ-আগুন-বারুদ প্রতিস্থাপিত হওয়ার জন্য তোমার বাধ্যতামূলক শাস্তি গ্রহণ, উদ্বাস্তুকরণ, হত্যাযজ্ঞ এবং রক্তপাত— আমাদের কালের এক কাহিনিই বটে। পাশাপাশি, আমাদের কৈশোর-যৌবনের লাগাতার সামরিক অভ্যুত্থান, ধর্মময় হননপর্ব, যত্রতত্র বোমা-বৃষ্টি, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রস্তুত নব্য লুটেরা, প্রাকৃতিক গ্যাস লুণ্ঠনে তৎপর বহু জাতিক সুবচনী-বিশেষজ্ঞ, তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি বিবিধ ঘটনার অপার বিস্তার– যা আমাদেরকে লাগাতার তাড়না করে অথবা নিক্ষিপ্ত করে রাষ্ট্রব্যবস্থার চোলাই-ওয়ার্কশপে। বলা যায় এই প্রকার অজস্র কাহিনির নেপথ্য— আমাদের জ্ঞান, স্মৃতি, অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার মধ্যে আমাদেরকে আক্রান্ত করে, দ্রবীভূত করে এবং যুক্ত-বিযুক্তির মিথস্ক্রিয়ায় জারিত করে। হয়তো একেই অন্য অর্থে বলব আমার তাড়না বা ইচ্ছার স্বাধীনতা। অথবা সকল লেখাই শেষ পর্যন্ত, তাই না বাস্তব, না কল্পনা—- অপরূপ ভয়ংকর বিপুল এক ইচ্ছার স্বাধীনতা মাত্র। আবার আমাদের জীবদ্দশাতেই সৃজনকৃত চতুর্পাশের মৃত্যুর মিছিল, শোকের ঐকতান, ও ধ্বংসের-ধ্বংস দেখতে দেখতে নির্মাণ হয় গ্লোবাল-গ্লোকাল এক মৃত্যুর পানশালা। মানুষের প্রধান বেদনা, মানুষের একটি শিশুকাল ছিল। এই হত্যা হয়ে যাওয়া শিশু কালের একটি তাড়নার গল্প শোনাই: লুইসক্যারলের। যেখানে এ্যালিস বেজায় ভীত। বইটি বন্ধ করে খুললেই যদি সব অক্ষর মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়! এইভাবে প্রতিবার বই স্পর্শের তাড়না তাকে নতুন নতুন বইয়ের ইশারা পাঠায়। কী এক তাড়নায় সন্দীপন চেয়েছিলেন, মৃত্যুর পর বালিশের নিচে থাকবে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। এই ধারাবাহিকতায়, খোলনলচে আমূল বদলে যাওয়ার জগৎখ্যাত এষণার কথা স্মরণে আছে? তুখোড় মল্লবীর প্লাতো শুরুতে চাইছেন, রাজনীতি করবেন আর নাটক রচনা করবেন। কিন্তু সোক্রাতেসের বক্তৃতা শোনার পর নাটকের গ্রন্থ আগুনে বিসর্জন দিয়ে তিনি স্থির করলেন— সোক্রাতেসের তাবৎ শিক্ষা ও দর্শন-ভাষ্য সংলাপের মাধ্যমে নিবেদন করবেন পৃথিবীকে।
কখনো কখনো এমন হয়েছে গপ্প-উপন্যাস- প্রবন্ধের বাইরে, একটি গানের শব্দ-গন্ধ কেবল তাড়া করে ফিরছে। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় ডোম বৈজু ঘুরে ঘুরে রামপ্রসাদী গাইছে— যে দেশে রজনী নাই / সেই দেশের এক লোক পেয়েছি… আমার কিবা দিবা কিবা সন্ধ্যা, মা সন্ধ্যাকে বন্ধ্যা করেছি / এবার ঘুম ছুটেছে আর কি ঘুমাই/ যার ঘুম আমি তারে দিয়ে ঘুমেরে ঘুম পাড়ায়েছি….।
এমন হয়, এই সংগীত শুনতে শুনতে, চোখে নতুন দৃশ্যমালা ও নতুন কাহিনি নাছোড় হয়েছে— অর্থাৎ সংগীত যদি, মোটা দাগে, ‘কর্ণ’ নামক ইন্দ্রের অধীনস্থ সাব্যস্ত করি—- ভাসমান দৃশ্যপট, ‘চক্ষু’ নামক ইন্দ্রিয়ের নতুন বিস্তার বটে। এই গবেষণার তাড়নায় জিজ্ঞেস করা যায়, বধির ও অন্ধ মানুষ কীভাবে তাহলে ক্রমাগত সৃষ্টিশীল হন। বৃন্দাবনি সারঙ্গ, এই নামে একটি রাগ আছে শুনেছ তো বটেই। এটি নিছক একটি রাগ হিসাবে আমার তোমার কাছে মনে এলেও, নেপথ্যে ছিল অন্য এক বিশেষ নির্মাণ কাহিনি। ‘তাড়না’ বোঝাতে যেয়েই বলছি : সুধীর কাক্কার নামক মনঃসমীক্ষক একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, দ্যা অ্যাসেটিক অফ ডিজায়ের— মোটা দাগে, এটি বাৎসায়ন জীবনী। দেখবে নানান ঘটনা প্রবাহের পর ‘বিরুদ্ধ কামসূত্র’ এর প্রসঙ্গ আসছে—- বাৎসায়ন জীবনের শেষ প্রান্তে তর্কে বিতর্কে বিক্ষিপ্ত হয়ে মূল কামসূত্রের আরেকটি পাঠ নির্মাণ করার তাড়না বোধ করেন। নাম হলো ‘বিরুদ্ধ কামসূত্র’—- কিন্তু তিনি চাইছেন এই পুস্তকটির লেখক হবে বৃন্দাবনীর পুত্র পুরুষোত্তম। নিজের লেখা ‘বিলুপ্ত কামসূত্র’ পুঁথিটি এরপর বৃন্দাবনীকে দিয়ে গঙ্গার জলে লীন হয়ে গেলেন। এদিকে পুরুষোত্তম একদিন বারানসী রাজসভায় এই গ্রন্থ পাঠ করলে, সমস্ত পণ্ডিতেরা বলাবলি শুরু করল এই লেখায় উপকরণ ওর বারাংগনা-মায়ের কারণেই সম্ভব হয়েছে। মা-বৃন্দাবনী, অবমাননায়-বেদনায় যখন অশ্রু সজল হয়েছেন—- তখন মাতা-পুত্র  স্থির হন— বাৎসায়নকৃত এই পুস্তক তারা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিবেন। পুঁথি যখন ভেসে যাচ্ছে, পুত্র বলেন, মা আমি তোমার জন্য গভীর এক অমরত্ব নির্মাণ করেছি— একটি রাগ নির্মাণ করেছি, যার নাম বৃন্দাবনী সারঙ্গ।
এখন সৃষ্টির এই প্রকার ‘তাড়না’ তুমি আমি কি আমাদের মলিন পাঠ এবং স্মৃতিতে কখনো ধারণ করি না? নাকি তুমি বলবে ‘গান’ মনে থাকে আর ‘বই’ মনে রাখতে হয়। বোঝার চেষ্টা করেছি, জয়েস কোন তাড়নায় ‘ইউলিসিস’ লিখতে চাইছেন ১৮ প্রকার ভিন্ন প্রেক্ষিত থেকে? রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বোন’ উপন্যাস শেষ হচ্ছে ৩৮ পৃষ্ঠায় আর ‘নষ্টনীড়’ গল্প লিখছেন ৪১ পৃষ্ঠাব্যাপী। নিশ্চয়ই তাড়নার তফাৎ হয়েছে। নিশ্চয়ই পৃথক পৃথক তাড়ানোর জন্য চেনা মানুষটি বলছেন–একটি অনিরীক্ষিত জীবন বাঁচার যোগ্য নয় অথবা আমার জীবনী আমার বাণী! পাস্তারনাকের বিবেচনায় মানুষ অন্তত তিনবার দিব্য উপস্থিতি (ডিভাইন প্রেজেন্স) অনুভব করে— মহৎ শিল্পকর্মের প্রতি ভালোবাসা, নারীর প্রতি প্রেম এবং স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা। কেউ অবশ্য ‘প্রকৃতি প্রেম’ এর কথা বলেছেন, বলেছেন জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা ও জীবনের সরলতার কথা; যেমন থরো বলতেন, বছরে মাত্র দুই সপ্তাহ পরিশ্রম করে, বাকি মাসের সংস্থান করতে পারে মানুষ অনায়াসে! লেখক হওয়ার তাড়নায় কনরার্ড ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’ লেখার সময় বন্ধু এডওয়ার্ড গার্নেটকে লিখছেন : আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে ।…আমি আমার লেখার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছি না। চারপাশে কেবল অন্ধকার।
‘মাদাম বোভারি’ লিখতে লিখতে ফ্লবেয়র আক্ষেপ করছেন— এক মাসে মাত্র কুড়ি পৃষ্ঠা লিখতে পেরেছি, সেটিও প্রতিদিন সাত ঘণ্টা পরিশ্রম করে। কথিত আছে, প্লেটো রিপাবলিক এর ভূমিকা লিখেছেন অন্তত সাতবার।
হেমিংওয়ে  বলতেন— লিখতে চাও, তাহলে টাইপ রাইটারে তোমার রক্তপাত ঘটাও!
লেখা একটি কাজ, লেখা একটি থেরাপি, লিখে আমি আমার রক্ত মোক্ষণ করি, রক্ত বিশুদ্ধ করি, লিখে আমি আমার গ্লানি ও আত্ম-অবমাননা এড়াতে পারি— লেখায় ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের অশুভ আচরণ, কর্তৃত্ব ও হিংস্রতার মাপযোখ নির্ণয় করি—- ঘোষণা দিয়ে এইসব মন্ত্র-বাক্য উচ্চারণ আমার মতো অর্বাচীন নামহীন গোত্রহীন মানুষের পক্ষে আদিখ্যেতাই বটে! বলা যায় অসম্মানিত-নিগৃহীত এক মানুষ— তার সামান্য কল্পনা এবং যৎকিঞ্চিৎ পাঠের স্মৃতি মিলিয়ে তার কালের অল্প-বিস্তর কাহিনি নির্মাণের একটি অক্ষম তাড়নাবোধ করেছিল, ‘লেখা’ নামক ঘোরতর এক অনিরাময়যোগ্য অসুস্থতার সুবাদে। ভাসাভাসা যে দুই একটি জ্ঞান-গরিমার কথা জোগাড় করেছি—-
মনীষীরা ধমকে দেন, তুমি সব কথা জানিয়ে দেয়ার অর্থ তোমার অর্জিত-জ্ঞান-ভাবনাকে তুমি কখনো ভালোবাসোনি।
অতএব আমার বুদ্ধিহীনতার জন্য তোমার প্রশ্নের প্রাসঙ্গিক জবাব হয়ে গেল এলেবেলে ও মূর্খতায় আকীর্ণ। ব্যক্তিগত মলিন পাঠে বুঝতে পেরেছি, শব্দ যেমন ‘ব্রহ্ম’ শব্দ তেমনি ‘ক্রিয়া’ও বটে। কিছু কিছু মানুষ হয়– লোগোফিলিক, বিবলিওফিলিক অথবা ফ্লবেয়ারের মতো তাঁদের কাছে লেখা, এক এবং অদ্বিতীয় ‘শব্দ’ খোঁজার জন্য রক্তপাত–যা ফরাসি ভাষায়, ‘মোস্ট জাস্টি’। এই প্রসঙ্গেই শব্দ নিয়ে আরেকটি ‘খেলার প্রতিভা’ রচনা করি : ফরাসি ভাষায় ‘রচনা’ কর্মের নাম যখন Essai, তার প্রতিশব্দ ইংরেজিতে trial/test—অর্থাৎ প্রত্যেকটি লেখায় উদ্ভাবিত হয় আসলে এক একটি আত্মপরীক্ষা। অচিরেই আবিষ্কৃত হয় আমাদের সকল লেখায়— যে লেখে, সে আমি নই। বিনয় মজুমদার বলতেন, আমার সৃষ্টিরা আজ কাগজের ভগ্নাংশ নিহিত। শেষ বিচারে, আমার ভুলভাল লেখা ‘তাড়না’ বলতে পারো—- এইসব উড়ে আসা উজ্জ্বল-ভরপুর-মহার্ঘ্য বীজমন্ত্রের টিকাটিপ্পনি মাত্র। অথবা ঘুনপোকার কাছে নিবেদিত ভগ্নাংশের কিয়দংশ, যা ভেসে যায় কালের জলস্রোতে পঞ্চভূতি লীন হওয়ার পরিকল্পনায়।

শুদ্ধস্বর: কীভাবে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং অভিজ্ঞতা আপনার গল্পকে আকার দেয়?

মামুন হুসাইন: তোমার তো জানাই আছে, আমার বংশ-কৌলিন্য বলে কিছু নেই। একদা নদীয়া অন্তর্ভুক্ত একটি ছোট্ট মফস্বল শহরে আমার বেড়ে ওঠা। এমন নয় যে, ঠাকুরবাড়ির মতো প্রত্যেকটি ঘরে সাহিত্য-সংগীত-চিত্র ও নাট্যের তীব্র ঘনঘটা, আমি কেবল অবগাহন করছি। আমাদের শহরের বড় সুনাম এই যে— এই পথে কথাকোবিদ রবীন্দ্রনাথ, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রসহ আরও আরও ইতিহাসখ্যাত মানুষ একদিন হেঁটে গেছেন; আমি তাঁদের সেই পদচিহ্নের গতিমুখ চিনতে পারি। শহরে যারা সাহিত্যের প্রধান অধিপতি ছিলেন— বিভিন্ন খ্যাতিমান দিনে গান-বাদ্য করতেন, আলোচনা করতেন, আমার ব্যক্তিত্বহীনতা কখনো সেখানে পৌঁছতে দেয়নি। বাবার অকাল মৃত্যু একটি ঘটনা বটে; বাবার বইয়ের উত্তরাধিকার ঝাড়ামোছা করতে করতে, তেলাপোকার ওড়াউড়ি দেখতে-দেখতে, আমার একাকিত্ব উদযাপন করে গেছি সমস্ত শৈশব-কৈশোর। ব্যক্তিগত যোগাযোগ যদি বলো, এটি অনেক পরের ঘটনা। কেবল দুই এক ছত্র লিখছি সেই সুবাদে আমাকে চিনতেন অগ্রজদের মধ্যে হাসান আজিজুল হক, ইলিয়াস, মোহাম্মদ রফিক, মঞ্জু সরকার ও সুশান্ত সরকার। হাসান-ইলিয়াস-কায়েস, এঁরা সবাই এখন অনন্ত মৃত্যুলোকে। ফলে সাহিত্যের সম্মানিত কোনো অধিপতির সঙ্গে আমার আর নতুন সখ্য হয় না। যদি ব্যক্তিগত যোগাযোগের কথা বল তাহলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার ক্যাম্পাসে, আমার একদা বন্ধুবলয় আছে, এই মুহূর্তে তারা আমার সমসাময়িক। একইসঙ্গে আমার কয়েকজন অনুজপ্রতিম একটি আত্মীয় সভা গড়েছেন, সুযোগমতো আমার সঙ্গে কথা বলেন, কখনো চা খাওয়ার নির্দেশ পাঠান, তাদের সঙ্গেই মাঝে মধ্যে পথ হাঁটার অভিজ্ঞতা হয় ইদানীং। সুবিখ্যাত লেখক চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ, লেখার উৎকর্ষ বাড়ে কিনা, লেখার কলকব্জা চিনতে সহায়তা দেয় কিনা, তার সবিশেষ প্রমাণ, আমি আমার ক্ষেত্রে বুঝতে পারিনি অদ্যাবধি। তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের যে তৃষ্ণা এবং আনন্দ, তা অনুভব করেছি প্রতিমুহূর্তে। কায়েস ভাইয়ের গৃহে যাওয়ার সুযোগ না হলেও, আমরা অনেকদিন একত্রে রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়েছি এবং চিঠিপত্র লিখেছি বারকয়েক। আশি সালের গোড়া থেকে তাঁদের মৃত্যু অবধি হাসান-ইলিয়াসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সাহিত্য ইত্যাদির বাইরে যোগাযোগের আরেকটি উপলক্ষ ছিল, তাঁদের অসুখ-বিসুখ এবং ওষুধপত্রের নাম ঠিকানা বলাবলি। দেশভাগ, রাঢ়বঙ্গ, লেখকের দায় ইত্যাদি মিলিয়ে অপরূপ বচন নির্মাণ করতে সমর্থ্য ছিলেন হাসান। আর ইলিয়াসের ছিল আশ্চর্য এক সহজ ভঙ্গি। এরকম নির্লোভ মানুষ আমার আর দেখা হয় না সহসা। সাহিত্য ছাড়া অনর্গল জগৎ-সংসারের তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যেত অনায়াসে। তাঁর প্রয়াণ আক্ষরিক অর্থেই ব্যক্তিগত ক্ষতি বলে প্রতীয়মান হয় আমার কাছে। এই বিদ্বৎসমাজের বাইরে এখন যদি পেছন ফিরে দেখি—- তবে জীবনযাপন, চাকরি সূত্রে আমাকে এক বিপুল ‘মনুষ্য স্নান’ এ লিপ্ত থাকতে হয় বা লিপ্ত থেকেছি হর-রোজ। লেখার কুশীলবদের অনেকের ভেতর সেই ছায়া মানুষেরা কখনো অজান্তে প্রবিষ্ট হয়ে গেছে হয়তো বা। শৈশব-কৈশোরের ঘটনাপঞ্জি অন্য লেখায়-বক্তব্য জানিয়েছি ইতোপূর্বে। ফলে পুনরাবৃত্তি না করি। যোগাযোগ-অভিজ্ঞতা মিলিয়ে তুমি যে প্রশ্ন করেছো, তার জবাবে বলি— শুধু লেখক নয় যেকোনো মানুষের চিন্তা জগতেই, জীবনযাপনের সূত্রে সঞ্চয় হতে থাকে অজস্র ছবি, শব্দ এবং অনুভব— সেখান থেকেই আমাদের বিশ্বাসের জগৎ তৈরি হয় অথবা নির্মাণ হয় আমাদের সিদ্ধান্ত, আমাদের যুক্তি-তক্ক-গপ্পো, আনন্দ, আলস্য, আকাঙ্ক্ষা ও ইচ্ছে। মনীষীরা অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলবেন, ফেনোমেনোলজি ও এপিস্টেমলজির কথা। কখনো দেখবে, আমাদের মধ্যে অনুভবের জোয়ার আসে, কখনো জগত সংসারের কিছু ঘটনা—যেমন ধর্মান্তর, যুদ্ধে অংশগ্রহণ, শিশু ধরন ইত্যাদি আমাদের অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ করে, অথবা অলক্ষে পরিবর্তন করতে শুরু করে আমাদের দেখার জগৎ। কখনো এমন হয়— একেবারে অচেনা কিছু অভিজ্ঞতার মধ্যে আমরা প্রবিষ্ট হই, তীব্র ধর্মীয় আচ্ছন্নতা, কখনো প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি, কখনো যেন শরীর থেকে আমি আলাদা প্রক্ষিপ্ত হয়েছি অথবা তুমি গেছো সাইকোটিক কিংবা সাইকেডেলিক কোনো অভিজ্ঞতার ভেতর। এরকম মুহূর্তেই একক মানুষ অনুভব করে, তার ভেতর আরও অজস্র মানুষের নিঃশব্দ-প্রকাশ্য বিচরণ। এভাবেই অপর মানুষের দিনযাপন, অপর মানুষের অভিজ্ঞতা খানিকটা-খানিকটা পৃথিবীর সকল প্রান্তের মনুষ্য প্রজাতির অংশবিশেষ হয়ে দাঁড়ায় অজান্তে। জীবনের কিনার ঘেঁষে হাঁটার মুহূর্তে, মানুষ হঠাৎ প্রশ্নবিদ্ধ হয়—আসলে সে কে? মানুষ ‘জীবন-জীবিকা’ এই শব্দ বন্ধন একত্রে উচ্চারণ করলেও, এক সময় বুঝতে শিখে ‘জীবন’ যদি লক্ষ্য হয় ‘জীবিকা’ একটি উপায় মাত্র। মানুষ জানতে পায়—চার্চিল, তাঁর রাষ্ট্রনায়ক জীবনের ফাঁকেও গ্রন্থ রচনা করেছেন, আর ছবি আঁকছেন প্রতি রবিবার। মানুষ চেখভের ‘আঙ্কেল ব্রানিয়া’ নাটকে দেখে— প্রতিভাহীন একজন মানুষের সাহিত্যিক হওয়ার কী ‘দুঃসহ নিষ্ফল প্রতীজ্ঞা’! মানুষ দেখে আকাশ ছোঁয়া বুদ্ধিজীবীর সর্ব নিকৃষ্ট নৈতিকতা। মানুষ ফরাসি মঁতাইকে চিনতে পারে; সমস্ত জীবনবিদ্যা চর্চার পরেও, তার গলায় মেডেল, মেডেলের উপর খোদাই করা, আমি কতটুকু জানি! মানুষ শেখে, আত্ম দীপো ভব— তুমি নিজেই নিজের পথপ্রদর্শক হও। মানুষ দেখে শোপেনহাওয়ার বার্লিনের রেস্তোরাঁয়— একটি সোনার মোহর প্রতিদিন টেবিলে রাখেন, যে ব্যক্তি ঘোড়া, মহিলা আর টাকা-পয়সার বাইরে কথা বলবে—তাকেই এই মোহরটি দিবেন তিনি। কিন্তু কোনোদিনই সেই প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় না। মানুষ দেখে, স্পিনোজা মাত্র ৩০০টি বই পড়েছেন। আবার এই মানুষই প্ররোচিত হচ্ছে—হাতের তালুতে যদি মানব সমাজের তিন হাজার বছরের ইতিহাস না থাকে, তবে তুমি চিন্তায় নিতান্তই দরিদ্র। বলতে পারো, আমি আমার এই দরিদ্র অভিজ্ঞতাই হয়তো বহন করে চলেছি অনন্ত। নিজের খুঁত আড়াল করার জন্য ভুলভাল স্কুল বারান্দায় দাঁড়াই—গোর্কি হাত দিয়ে দেখায়—কোটিপতিদের পকেটের ঝুল এতই বড় যে, তার ভেতর চার্চ, সেনেট ভবন, এবং প্রয়োজনীয় সবকিছু অনায়াসেই ধরে যায়। বন্ধুদের চোখ দিয়ে মৃত মানিক বাড়ুয্যেকে দেখি; একটি চোখ খোলা, একটি বন্ধ। গোপাল হালদার দেখাচ্ছেন, ফুলের ভারে দামি পালঙ্কের একটি পায়ে ফাটল ধরেছে। দেখি দূরে হেঁটে চলেছেন রাঢ় অঞ্চলের ক্ষত্রিয় জমিদার বংশের সন্তান, কংগ্রেসের ভলেন্টিয়ার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে। দেখি টংক বিদ্রোহের মনি সিংহকে; মা জিজ্ঞেস করছেন, এই যে আত্মীয়-স্বজনের লগে তুমি বিরুদ্ধাচরণ করতাসো, এইটা কি ভালো হইতাসে? দেখি ইলিয়াসের মতো, ১৮৯১ এর ২০এ মে, কর্কট রোগ আক্রান্ত র‌্যাঁবোর পা কাটা পড়ছে। দেখি র‌্যাঁবোর বিনা টিকিটে রেলভ্রমন অনুষ্ঠান। দেখি মৃত্যুর জন্য একেবারে মানানসই হয়ে পড়েছেন সর্বজন মান্য নিটসে; অসংলগ্ন কথাবার্তা আর বই চোখের সামনে ধরেছেন উল্টো করে। অথচ একদিন সহিসের চাবুক যখন ঘোড়ার পিঠ কামড়ে ধরছে, তখন কান্না বিগলিত হয়েছেন, এই আপাত: আত্মবিচ্ছেদি মানুষটি। এরকম উত্তাল ঝঞ্ঝার কালে বন্ধুদের অভিজ্ঞতা আঁজল পেতে গ্রহণ করি। তুমি জানবে, কিয়ের্কেগাদ ছিলেন একজন কোপেনহেগেন-সোক্রাতেস, আর সোক্রাতেস ছিলেন আথেনীয়-কিয়ের্কেগাদ। আমরা হাঁটি এবং সঞ্চয় করি পৃথিবীর এইসব মনে মানিক্য অভিজ্ঞতা; অথবা একদিন অভিজ্ঞান হয় জগৎ সংসার পরিভ্রমন একপ্রকার শিল্পই বটে। বন্ধুরা বলেন হাঁটা হলো দার্শনিক হাতিয়ার। ‘কারু বাসনা’ এবং ‘মাল্যবান’ এর নেপথ্যে জীবনানন্দের মনঃশারীরিক ভ্রমন দেখে থমকে দাঁড়াই। আমাদের অভিজ্ঞতায় আসে—জীবন হচ্ছে, শোপেন হাওয়রের ভাষায় ‘মিসলিশে জাশে’— ‘বেয়াড়া বিষয়’—এই ঘোরতর অবাধ্যতা পোষ মানাতেই আমাদের কাউকে কাউকে সারাজীবন অতিবাহিত করতে হয়। তলস্তয়ের বেজকুভ ‘ওয়ার এন্ড পিস’ এ প্রশ্ন তুলেছেন; তার জিজ্ঞাসা আমাদের জিজ্ঞাসাও বটে—–তাহলে ভালো মন্দ কী? বেঁচে থাকা কেন? কেন বেঁচে আছি? জীবন এবং মৃত্যু শেষপর্যন্ত কি কথা বলে? মৃত্যুর তিন দিন আগে ১৯৫০ এর শেষ অক্টোবর ধারাগিরি পাহাড়ে চড়ে হঠাৎ বিভূতিভূষণ মুখ ঢেকে বসে পড়েন; সামনে একটি মৃতদেহ এবং খাটিয়ায় শোওয়া মৃতদেহটি তাঁর নিজের। এর তিনদিন পরেই বিভূতিভূষণের মৃত্যু। বিভূতিভূষণের প্রিয় গান বাজে দূরে কোথাও; হরি দুঃখ দাও যে জনারে…।. আমরা হেঁটে হেঁটে আনাতড়খড়ের দুর্বার উচ্ছল বিস্ময় জাগানিয়া মুগ্ধতার পাশাপাশি, ওকাম্পের প্রশান্ত মুগ্ধতাবোধ পাঠ করি নিজেদের অভিজ্ঞতায়। পাঠ করি রবীন্দ্রনাথের ঋষি ভাবনা এক ঝলক: মানুষের মধ্যে থাকে দুটো পাখি; একটি ভোগী, অন্যটি দ্রষ্টা। অনুভব হয়, জীবন প্রতিদিনকার দ্রোহ আর সমর্পণের দোলন ছাড়া কিছুই নয়। এক জন্মেই আমাদের আরও অধিক সংখ্যক জন্ম ঘটে, যা আমাদের আকুল ইচ্ছে-বাসনাকে রূপদান করার প্রয়াস পায়। ভেবে ভেবে কখনো ‘মানব বৃক্ষ’ হই—- ওভিদের ফিলোমন ও বাউসিজ, যেভাবে দেবতার আশীর্বাদে বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছিল। নাকি আমাদের অভিমুখ গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে উল্লেখিত সেই জীবন—বৃক্ষ যার উপরের দিকে আর পাতাগুলো নিচের দিকে; যখন পাতা হচ্ছে জ্ঞান আর জগৎ বৃক্ষ আসলে আমাদের সংসার। জীবনানন্দ ‘মাল্যবান’ উপন্যাসে লিখছেন–‘শূন্যতা ও হাহাকার বিঁধছে মাল্যবানকে। মরণ  স্নায়ুকে।’ এই ‘মরণ স্নায়ু’ শব্দটি আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে– আমি কি কেবলই আমার পাপ নিয়ে ভাবছি, নাকি আমার অন্তর্গত যুক্তি বুদ্ধি নিয়ে? অনুভব করি, এই প্রকার পরিব্রাজনাই একদিন আমাকে মনস্বী ব্যক্তিদের ভাঁড়ার থেকে যৎকিঞ্চিত অভিজ্ঞতা দান করে। যে জন্য আমার, আমাদের সকল সৃজন প্রক্রিয়াই হয়ে ওঠে এক প্রকার পরিগ্রহণ, সংযুক্তায়ন ও মানস ভ্রমন।

শুদ্ধস্বর: আপনি কি মনে করেন সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাব কথাসাহিত্যের উপর রয়েছে বা থাকা উচিত? আপনার অভিজ্ঞতা এবং পঠনপাঠনের আলোকে বলুন।

মামুন হুসাইন: দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জীবদ্দশায় ধারাবাহিক রিপোর্টাজ লিখতেন; সেইসব লেখা সজ্জিত ছিল বড় এক কালো কাপড়ের ব্যাগে। মৃত্যুর পর রিপোর্টাজ খুঁজতে যেয়ে দেখা গেল ব্যাগে রয়ে গেছে—বিবিধ প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, বিক্ষিপ্ত নোট, ঠিকানা লেখার খাতা, অসমাপ্ত রসিদ বই ইত্যাদিসহ যাবতীয় লেখার এক পর্বত যেন। সাহিত্যের আঁধার আমার কাছে এমনি এক আশ্চর্য কালো ব্যাগ বটে, দূর ভ্রমনের হোল্ডলও বলতে পার–মনুষ্য সংক্রান্ত হেন বিষয় নেই, যা এই আশ্চর্য গোপন আর্কাইভে রাখা যায়নি। আলোর অধিক অন্ধকার, এই কথাটি শেখার পর, সাহিত্য ও রাজনীতির গলিঘোঁজ নিরিখের কালে অবাক হয়ে একদিন দেখি : সরাসরি দলের সদস্যপদ নিয়ে মানিক ব্রাত্যজন হয়ে গেছেন। আবার বহু মানুষ আছেন, সদস্য পদ ছাড়াই শক্তিশালী রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন অনায়াসে। রাজনীতি যদি মানুষের সংস্কৃতির একটি অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়, প্রধান অবলোকনের উপায় হয়, তাহলে যেকোনো সংবেদী মানুষই সমাজের-রাষ্ট্রের অব্যবস্থায় আক্রান্ত হন। আরিস্ততল বলতেন, মানুষ শেষ বিচারে রাজনৈতিক জন্তু বিশেষ; কারণ তার কথা বলার ক্ষমতা আছে এবং যুক্তি নির্মাণে সক্ষম। মাওসেতুং বলতেন, রাজনীতি হচ্ছে রক্তপাতহীন যুদ্ধ আর যুদ্ধ হচ্ছে রক্তপাতময় রাজনীতি। সাহিত্যের ব্যবহার নিয়ে কালভিনোর একটি লেখা আছে : সাহিত্য রাজনীতির জন্য বড়ই প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে ভাষাহীনকে যখন তা স্বর দান করে; রাজনৈতিক ভাষ্যে যারা ইতোমধ্যেই নামহীন-গোত্রহীন তাদেরকে নামকরণ করে সাহিত্য; সাহিত্য এমন একটি শ্রবণ যন্ত্র, যা রাজনীতি থেকেও প্রখর। সাহিত্য এমন এক চক্ষুষ্মান, যা রাজনৈতিক পরিসীমার বাইরে সকল কিছুকে দেখতে পায় আরও স্বচ্ছ ও পষ্ট। বালজাক যখন ‘কমেডি হিউম্যান’ লিখছেন তখন বলছেন— আমি ইতিহাস লিখে ফরাসি সমাজের সচিব হতে চায়, যে ইতিহাস ঐতিহাসিকেরা অস্বীকার করেছেন। ১৮২৫ শে রচিত ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’ শত-হাজার দাসের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে। আবার বিপরীত মেরুতে—রাজনৈতিক ডামাডোলে জার্মানির পক্ষে মতামত প্রকাশ করেছেন নুয়েট হামসুন। আর ফ্যাসিবাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এজরা পাউন্ডের মতো মনীষা। আবার এই ভারতবর্ষ থেকে, ইউরোপের শ্রেষ্ঠ মনীষার পাশাপাশি মুলক রাজ আনন্দ গেছেন স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। ইতিহাসে অন্তত দুই প্রধান বিপ্লব— ফরাসি এবং রুশ বিপ্লবের কালে সাহিত্য রাজশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তীব্র সচেতনায়। আমাদের সাহিত্যে মাইকেল, দীনবন্ধু, মীর মশারফ তাঁদের লেখায় যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছেন, তা পেয়েছে সবার মান্যতা। বঙ্গভঙ্গ পর্বে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান এবং পরবর্তীতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি বর্জন তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ। স্মরণ হয় নজরুল ধুমকেতুর সম্পাদকীয়তে লিখছেন— স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। রাজনৈতিক বক্তব্যের আঁচ আমরা ‘ঘরে-বাইরে, ‘চার অধ্যায়’, ‘পথের দাবি’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ইত্যাদিতে অনায়াসে পাঠ করতে পারি। মুনির চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে একটি সংলাপ ছিল– শহীদদের আত্মা বলছে, আমরা কবরে যাব না। আমাদের কালে বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে তোমারও মনে পড়বে খ্যাতিমান রাজনৈতিক উপন্যাসের তালিকায় আমরা পেতাম অরওয়েলের 1984, রবার্ট পেনের all the kings man, হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড জোসেফ হিলারের, ক্যাচ ২২, ব্লাড বাডরির ফারেনহাইট ৪৫১, গোল্ডিং এর লর্ড অফ ফ্লাইজ, হারপার লি’র  টু কিলিং আ মোকিং বার্ড ইত্যাদি। যুক্ত হতো টমাস মুরের utopia, ভলতেয়ারের কাদিদ, জোনাথন সুইফট, এর গালিভার্স ট্রাভেল কিংবা স্টেইন বেকের গ্ৰেপ অফ রেথ এবং সাম্প্রতিককালের দ্য হ্যান্ড মেড্স টেইল, মার্গারেট অ্যাট উডের।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়— কালো লেখক এবং সাদা প্রকাশকের রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ায় রিচার্ড রাইট তার ‘নেটিভসান’এর অনেকগুলো দৃশ্যপট মুছে দিতে বাধ্য হন। সম্পাদকের অনুরোধে টনি মরিসন তার যে অংশটুকুতে বর্ণবাদ সংক্রান্ত ভুক্তি ছিল তা নিশ্চিহ্ন করতে বাধ্য হন। মবি ডিক’র ব্রিটিশ সংস্করণ, অনুমতি ছাড়াই ঘষামাজা হয় প্রকাশকের রাজনৈতিক অভিলাস চরিতার্থের জন্য। ভাষার কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলতে বলতে, নগুগু ঘানার যে বিশাল জনগোষ্ঠী না লিখে ভাব প্রকাশ করছে, সঙ্গিত, নৃত্য এবং প্রবাদ প্রবচনে—তার নাম লিটারেচারের আদলে দিয়েছেন ওরাটার(orature)। পশ্চিমের সাহিত্যতত্ত্ব, তাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ে এই ধারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। স্মরণে আসে, অ্যাচিবির ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’—-যেখানে ইবো সম্প্রদায়, দৈনন্দিন এর ব্যবহৃত ‘শব্দ” খাদ্যের মতো গ্রহণ করছেন ‘প্রবাদ ‘নামক পাম ওয়েল দিয়ে। ভাষার পেছনের এই রাজনীতি লেখার গতিমুখকেও নানান পথে ধাবিত করে বটে।
রাজনৈতিক উপন্যাসের তালিকায় এই মুহূর্তে আহমেদ ছফার ‘ওঙ্কার’। মনে পড়ছে ইলিয়াসের দুটি উপন্যাস তো বটেই; সেই সাথে ভারতবর্ষের দাঙ্গা ও দেশভাগ নিয়ে উভয় বাংলার আরও সব উজ্জ্বল গ্রন্থের কথা স্মরণ করা যায় অনায়াসে।
সবিনয়ে জানাই, আমার ‘নিক্রোপোলিস’ এবং ‘স্বাধীন অন্ধকার’ উপন্যাসে আমার কালের রাজনৈতিক গতিবিধির একটি ইশারা নির্মাণের চেষ্টা করেছি। মনে পড়ছে হুমায়ুন আজাদের ‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’ বা ‘৫৬ হাজার বর্গমাইল’—-যার ভয়াবহ পরিণতি হয় ২০০৪ এর সাতাশে ফেব্রুয়ারি, যখন তাঁকে হত্যা করা হয়। এলিওট ১৯৩৫-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন, ‘সাহিত্য ও ধর্ম’ বিষয়ে—সাহিত্যের আলোচনা ধর্ম ও নৈতিকতার আলোচনা ছাড়া কখনোই পূর্ণতা পায় না। অথচ এই আলোচনার রেশে হত্যা হয় মুক্তচিন্তক অভিজিৎ রায়; সেই একই ফেব্রুয়ারি—-২৬ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৫; হত্যার দায় স্বীকার করে আনসার উল্লাহ বাংলা। ২০১৫ তেই আবার হত্যা হয়েছে ওয়াসিকুর রহমান, অনন্তবিজয় দাস, নিলয় নীল এবং দীপন। আমরা দেখি রাজনৈতিক লেখার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ চৌধুরীকেও একদা তীব্রভাবে আক্রমণ করা হয়। ক্রমাগত নজরদারি এবং হত্যার মুখে নাকাল হতে হতে তাঁকে বাধ্যতামূলক দেশত্যাগী হতে হয় ২০১৬ এর জানুয়ারি। আমাদের কালেই প্রমাণ হয়, রাষ্ট্র নিজেই এক সন্ত্রাস, তলস্তয়ের উচ্চারণে, গভমেন্ট ইজ ভায়োলেন্স! ইতিহাসের এই ট্রাজিক উল্লাস উদযাপনের কালে, জীবন যদি আশীর্বাদ হয়, তাহলে স্বাধীন চিন্তা বয়ানের সঠিক রক্ষাকবচ, করণ কৌশল আমি কখনো কখনো ভেবেছি বৈকি—গ্রন্থ নির্মাণ, নাকি মাঝেমধ্যেই পূর্ব ঘোষিত হত্যার পঙক্তিতে নাম অন্তর্ভুক্ত করা? লোরকা তাঁর ‘দুয়েন্দে তত্ত্ব’ বর্ণনার কালে বলছেন—স্পেনে একজন মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পর অধিকতর জীবিত,…দুয়েন্দে ততক্ষণ আসে না যতক্ষণ সে না দেখে মৃত্যুর সম্ভাবনা, যতক্ষণ সে না জানে মৃত্যু বাড়িতে হানা দেবে। ব্রেকফাস্ট গ্রুপের কবি শেমাস হীনিকে কেউ অভিনন্দন করছেন, রাজনীতি নিয়ে কবিতা লেখার জন্য। আবার কেউ তাঁকে সুবিধাবাদী বলে গালমন্দ করছেন কারণ তিনি সরাসরি ‘আই আর এ’র সমর্থন করছেন না। হীনির মা হীনিকে ছোটবেলায় গুরু মন্ত্র দান করেছিলেন—‘হোয়াট ইউভার ইউ সে, সে নাথিং।
বলতে কি আমাদের এই হত্যা উপত্যকার দেশে রাজনীতি এবং রাজনীতির এইসব বিবিধ অভিঘাত মাথায় নিয়েই কথাসাহিত্যিক কেন, যেকোনো সংবেদী মানুষের প্রায় ‘নেয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স’ উদযাপিত হচ্ছে পৃথিবীর সকল প্রান্তে; কারণ বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ। 1984 এ ওরঅয়েল তীব্রশ্লেষে বিশ্লেষণ করেছেন— ইগনোরেন্স ইজ স্ট্রেন্থ, ফ্রিডম ইজ স্লেভারি, ওয়ার ইজ পিস! অতএব কান্টের ভাষায় sapare aude—dare to know, জানার সাহস!—-পৃথিবীর সব মানুষেরই এই এক মৌল ধানের চর্চা চাই। বঙ্কিমচন্দ্র বলতেন—লিখে যদি মানুষের মঙ্গল সাধন হয়, তবেই লিখুন,….অন্যথায় আমাদেরকে, যাত্রাওয়ালা নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে। বুঝতে পারি, আমার সামান্য আজগুবি লেখা—যে পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে, যে পৃথিবীতে শনৈঃশনৈঃ বৃদ্ধি পায় যুদ্ধ নামক অমর শিল্প– সেখানে কিছু মাত্র দাগ কাটতে সমর্থ হয়নি। সবচেয়ে রাজনীতি মনস্ক কথাসাহিত্যিক এইভাবেই তার সফল-ব্যর্থতা আবিষ্কার করতে সমর্থ্য হন তার জীবদ্দশাতেই।

শুদ্ধস্বর: এমন একটি ছোটোগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।

মামুন হুসাইন: ডারউইনের তৃতীয় শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল, দ্যা এক্সপ্রেশন অফ দ্যা ইমোশনস ইন ম্যান এন্ড এনিমেলস— সেখানে কান্নাকাটি ব্যতিরেকে তিনি ছয় প্রকারের আবেগের কথা উল্লেখ করেছেন :  সুখানুভব, বেদনা, ভয়, ক্রোধ, বিস্ময় এবং বিতৃষ্ণা। তুমি অবশ্য ঝোঁক দিয়ে ‘কান্না’র কথা বলেছ; আবার জানতে চেয়েছ ‘চিন্তা ও বোধ’কে আলোড়ন করার অনুসঙ্গ। আমি কান্না বিষয় একটি গদ্য লিখেছিলাম– ‘আর চোখে জল’; ‘কথা ইশারা’ গ্রন্থে আছে, তোমার চোখে পড়েছে কি? এ্যালিসের কথা স্মরণে আসে—বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘দা পুল অফ টিয়ার’—-কেক খাওয়ার পর এ্যালিস ৯ ফুট লম্বা হয়। তারপর দরজা দিয়ে বেরুতে না পেরে, ভয়ে দুঃখে কান্না বিগলিত হয়। কান্না জমতে জমতে জলাশয় হয় এবং সেই জলাশয় সে পাড়ি দেয়। কান্না আমার কাছে সে অর্থে একপ্রকার ‘শব্দ’ যা লিখিত হয়। এবং এটি ক্যাথারসিসও বটে, যা আমাদেরকে বিশোধন করে। ‘রিপ ভ্যান উইংকেল’ খ্যাত আমেরিকার লেখক ওয়াশিংটন আর্ভিং বলতেন—কান্নায় একপ্রকার পবিত্রতা থাকে। এটি কোনো দুর্বলতা নয়, শক্তির প্রকাশ। ১০ হাজার জিহবার চেয়েও কান্নার বক্তব্য হয় অধিক প্রাঞ্জল ও স্পষ্ট। একটি দলছুট কথা বলি,—মারিনা আবরামোভীকের পারফরম্যান্স সরাসরি দেখিনি; আলোচনায় পড়েছি এবং ভিডিও ক্লিপস দেখেছি : কান্না উদ্রেককারী তীব্র বেদনা, শ্রম এবং একাকিত্ব মিশিয়ে উপস্থাপনা। একটি উপস্থাপনাতে দেখছি টানা ১২ দিন খোলা মঞ্চে অভুক্ত হয়ে আছেন। দেখছি মোমায় (MOMA) টানা তিন মাস, প্রতিদিন ৮ ঘণ্টাব্যাপী ৭৫০ ঘন্টা চেয়ারে বসে আছেন নীরব। ‘নৈঃশব্দ্য’ কি তাহলে অপর একটি ভাষা! অপ্রাসঙ্গিক হলো কিনা কে জানে— কথাগুলো বলছি কান্নার রকমফের বোঝাতে এবং মানুষ কত বিপজ্জনকভাবে কান্নার শিল্প নির্মাণ করে তার সামান্য ইশারা দেওয়া।
তুমি অবশ্য একক গল্পের নিরিখেই কান্নার স্বরূপ খোঁজার হোমওয়ার্ক দিয়েছো— এটি যথাযথ পালন সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘গল্প পোষ্য মানুষ’ শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় গল্প খোঁজেন তা তো নয়, নিজেদের জীবন কি তাদের কম অশ্রুময়? আমার বাবার অকাল মৃত্যু হয়, যখন আমার বয়স সাকুল্যে সাত; কেউ একজন ভিড়ের ভেতর আমাকে কাঁধে নেয়—- তোমার বাবাকে শেষবারের মতো দেখো; কবরের ভেতর ঝুপ ঝুপ ঝরে পড়া মাটিতে বাবার আবছায়া মুখ জুড়ে ইতস্তত কর্পূরের শোভা এবং কাফনের উজ্জ্বল সাদা রং ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। মৃদু আতর, লোবান ও গোলাপজলের ঘ্রাণে দম বন্ধ হতে হতে কান্নার শক্তি গলার ভেতর আটক হয়ে আমাকে ঠেলে দেয় চির বিস্মৃতির যুগে।
৯০ দশকে চাকরি করতে গেছি পূর্ববঙ্গের এক মফস্বল শহরে, যেখানে পৌঁছতে দেশের সকল যানবাহনের আশ্রয় নিতে হতো। এখানে দুটি ঘটনা এখনো অশ্রু সজল করে— প্রথমটি : আমার হাসপাতালে সেদিন লোডশেডিং। হাসপাতালের দেয়াল ঘেঁষে শ্মশান। সন্ধ্যায় পুড়ে যাওয়া লাশের ছাইভস্ম মাঝেমধ্যে ঘরে, বারান্দায়, ছাদে উড়ে উড়ে আসছে‌। তারা ভরা আকাশের নিচে, খোলা ছাদে আমি, আমার এক সহকর্মী এবং আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠা রাঁধুনি অন্ধকার উদযাপন করছি। রাঁধুনি সামান্য আড়াল পেয়ে, স্বামীর কথা বলতে শুরু করেন— বিয়ের পর মাথায় তার এত দীর্ঘ চুল যে, স্বামী তাকে পিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে নিজ হাতে তেল দিয়ে দিতেন। লোকটি যখন ভাত খেতেন সেই ভাতের ঢিবিতে দাঁড়িয়ে টাঙ্গাইল শহর দেখা যেত। তারপর তার অকাল মৃত্যু হয় এবং তিনি একা হন; বোঝা হয়ে যান তার নিজের সন্তান সন্তদির কাছে। সামান্য এইগল্প বলতে বলতে ফুঁপাতে শুরু করেন। তারার আলো এবং রাতের আঁধারে তার কান্না আমাকে সংক্রমিত করে। দ্বিতীয় ঘটনা : এক বিকেল-সন্ধ্যায় আমি সর্পাহত হই। তখন মানুষের ভালোবাসা বিজড়িত নির্দেশ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা স্থগিত করে, এবং পুরো গ্রাম আমার জন্য পালা করে ওঝা ও গুণিন জোগাড়ে শশব্যস্ত হয়। সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ, যার দোকানে আমি চা খাই নিত্য, তিনি বর্ষার নদী সাঁতরে এক গুণিনের বাড়ি পৌঁছান। এই গুণিনের চিকিৎসা তৎপরতার প্রথম ধাপ, বার্তাবাহককে তীব্র চপেটাঘাত করা অর্থাৎ চপেটাঘাতে বিষ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে আটক হয়ে গেল! এই গুণিন যখন আসেন, তখন আমার এই পরমহিতৈষী আমাকে ঝাপটে কান্নায় ভেঙে পড়েন; পাঞ্জাবির পকেটে সংরক্ষিত কাঁচামরিচ বের করে তারপর চিবুতে দেন— ঝাল না মিষ্টি? এর অর্থ বিষ অথবা বিষহীনতা! কাঁচামরিচ চিবুতে চিবুতে দুই অসম বয়সের মানুষ ক্রমাগত আর্দ্র হই; গল্পটি আমি আজও ভুলতে পারিনি। কিন্তু তুমি তো আসলে আমার কোনো ব্যক্তিগত এ্যানেকডট্স জানতে চাওনি। অতএব আমাকে গল্পের নাম বলতেই হবে। এ প্রসঙ্গে শুরুতেই তারাশঙ্করের ‘ডাইনি’ মনে পড়ে; বিশেষ করে যখন সে ধূসর শূন্যলোকে মিলিয়ে যাচ্ছে—ডাইনি একবার মানুষ হয় তারপর অন্তর্গত দোলা চলে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, স্বপ্নে কেবলই স্মৃতিমেদুর হয়; আবার পরক্ষণেই জনপদের সার্বক্ষণিক অবুঝ মানুষের বিবেচনাতে সে হয় ডাকিনী ও হন্তাকারক। ‘নিম অন্নপূর্না’য় যুথীর ছোলা চুরি এবং প্রীতিলতার চাল অনুসন্ধান পর্ব—আমাকে এখনো তীব্র আলোকিত করে। রাস্তার তীর্যক গ্যাসের আলোয় ঢলে পড়া বৃদ্ধের মৃত্যু ছবি আঁকছেন কমল কুমার; মৃত মানুষের চাউনি কমল মজুমদারের হাতে অন্য এক ‘খেলার প্রতিভা’ নির্মাণ করে মুহূর্তে–এখনো কি মানুষেরা মৃদুস্বরে কথা হয়, ছোট করে হাসে। এই দৃশ্যময়তার পাশাপাশি আবার গরম ভাত যখন পরিবেশিত হচ্ছে, তখন প্রীতিলতার কোমল বেদনাময় হেঁয়ালি—বুড়োর জন্য মন খারাপ করছে, খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এরকম চমকে ওঠা এক বৃদ্ধের সন্ধান পেয়েছিলাম ‘ফাদার সিয়েরগি’তে; তলস্তয় লিখছেন, কামনাকে দূর করার জন্য হাত পুড়িয়ে ফেলেছেন এবং অনুশোচনায় আঙুল ক্ষত করেছেন ফাদার সিয়েরগি‌। ধীরে ধীরে নতুন উপলব্ধি হয়—বড় যাজক হওয়ার আয়োজন স্তব্ধ করে সাধারণ মানুষের পঙক্তিতে দাঁড়ান জীবনের শেষ প্রান্তে—-এক কৃষকের বাড়িতে কিচেন গার্ডেনার হন, তার শিশুদের পাঠদান করেন, আর অসুস্থ মানুষকে সেবা করেন। তোমার প্রশ্নের উত্তর আবারও বোধ হয় গোলমালে হয়ে গেল।
এক্ষুনি আমাকে পাপ স্বীকার করতেই হবে— কারণ একটিমাত্র গল্প নিয়ে কথা বলার চুক্তিপত্র, আমার কু-অভ্যাসে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারিনি।

শুদ্ধস্বর: আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?

মামুন হুসাইন: ‘আপন ভজন কথা না কহিবে যথা তথা, আপনাতে আপনি সাবধান…—–সাঁইজির এই গান আমাকে সাহস যোগায়। যেহেতু বাংলা সাহিত্যের আনুষ্ঠানিক ছাত্রত্ব আমার নেই, আমি ভাষার কাঠামো, ব্যাকরণ, ফর্ম ইত্যাদি বিষয়ে তীব্র অজ্ঞ। ‘অবচেতন’ যদি থাকে ভাষার মতো তবে অন্তরলোকে কী ঘটে, সব ব্যাখ্যা আমি কি জানি? বহুদিনের ভুল অভ্যাসে অনুমান হয়—যেকোনো শিল্পকর্মই শেষ বিচারে আমাদের ইচ্ছা-স্বপ্ন-বিশ্বাস এবং সংযুক্তির মিথস্ক্রিয়া। ‘লিখনে কি ঘটে’—এই নামে মহান অমিয়ভূষণের বই ভূমিকা হিসেবে পড়া যায়। বুঝতে পারি—বয়স বাড়ছে, আমরা যেমন জগৎকে ভুলে যাব, জগৎও তেমনি আমাকে ভুলে যাবে। আমরা আমাদের বেঁচে থাকার সময় ক্ষণকে বলেছি—-খুব সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে কখনো, অথবা একেবারেই হালকা চালে, যেন তা চেনা যায় এবং বহুত্বের ছায়া আনে দৃষ্টি বলয়ে। যত্নে তৈরি যেকোনো লেখাই, আমার ধারণা, আমাদের মানসলোকে একপ্রকার উদ্বিগ্নতা ছড়ায়। যেহেতু আমার জ্ঞান-গরিমার তীব্র ঘাটতি—আমার চারপাশ, আমার সময় আমাকে যেভাবে নির্দেশ দেয় কথা বলার, তাই আমার ব্যাকরণ, ফর্ম বা ভাষা কাঠামো। ভেবে ভেবে স্থির করি—-কোনো একটি গ্রন্থ যদি বরফ জমে থাকা সমুদ্রের কুঠার হয়,তবে একেবারেই নমনীয় না হওয়া, অন্তর্গত সত্তার কোনো পরিমার্জনা ছাড়াই ক্ষমাহীন ভাবে, লেখা নামক একটি অসুস্থতার দাসত্ব গ্রহণ, আমার-আমাদের ভবিতব্য।

শুদ্ধস্বর: আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটোগল্পের মূল উপাদান কী?

মামুন হুসাইন: এখন পর্যন্ত ছোটোগল্পতেই ঘোরাফেরা করছি আমরা। শেষ ক্লাসের মাস্টারমশাই শেখান—ছোটোগল্পে বাহ্যিক বর্ণনা থাকবে না, চকিত চমক থাকবে, বিষয় হবে ছোট, নাটকীয়তা থাকবে, দ্বন্দ্ব থাকবে এবং অনন্য বাঁক থাকবে। কেউ বলেছেন ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে গল্প শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয় অথবা অর্ধ হতে ১/২ ঘন্টা। দেখেছ– আমি আমার লেখার কালে এইসব শর্তাবলি একটিও মানতে পারিনি। খানিক আগে বলেছি: ‘লেখা নামক অসুস্থতা’ সম্ভবত একপ্রকার ট্রান্স তৈরি করে; তখন আমি বা আমরা নির্দেশিত হই। বাক্য-শব্দ-কাগজ— আমাকে যেভাবে পরিচালিত করে আমি সেই নির্দেশনা কেবল প্রতিপালন করি নিষ্ঠার সঙ্গে। আমার বলার কথাগুলো যথাযথ প্রকাশিত হওয়ার জন্য যা করণীয় আমি তাই করতে বাধ্য হই। ফলে আমাকে নিয়ে ব্যাকরণমনস্ক-রুচিশীল-বিদগ্ধ বিদ্বৎজনের অস্বস্তি কোনোকালেই আর ঘোচে না—-আমার না হয় গল্প, না হয় প্রবন্ধ না হয় উপন্যাস; আমি কারাবাস করি এক অনন্ত নোম্যান্স আইল্যান্ডে। আমি বিশ্বাস করি–যেকোনো লেখার মূল উপাদান, চূড়ান্ত ভাবনায় লেখকের চিন্তা প্রকাশের স্বাধীন-ইচ্ছা বৈ কিছু নয়।

শুদ্ধস্বর: লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

মামুন হুসাইন: এ প্রসঙ্গে খানিকটা কথাবার্তা আমরা ইতোমধ্যে শুরু করেছি। মানুষ যদি ‘রাজনৈতিক জীব’ হয়—- তবে জগত সংসারের সকল মানুষই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের জায়গা থেকে দেখলে অর্থনীতি যখন ভিত্তি, তখন সামাজিক উপরিকাঠামোর অন্যতম উপাদান হলো রাজনীতি। দলের আনুষ্ঠানিক তকমা ছাড়াও একজন মানুষ তার রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে জগৎ সংসার পরিমাপ করে চলেন আমৃত্যু। ‘রাজনীতি’ শব্দের মজা কম নয়: আমরা কখনো বলি রাষ্ট্রনীতি, রাজগতি অথবা রাজবুদ্ধি। কেরি মহাশয় তাঁর অভিধানে রাজনীতির শব্দের অর্থ করেছেন—রাজন্য + নীতি অর্থাৎ ‘রাজার ন্যায় বিচার’। আরিস্ততল বলতেন, রাজনৈতিক হওয়ার অর্থ হলো সবকিছুই কথা ও যুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে; সহিংসতার মাধ্যমে নয়। কিন্তু মানব ইতিহাসে ‘রাজার ন্যায় বিচার’ এর সুযোগ সন্ধানে নামলে তুমিও মানবে আলোচনা ধাবিত হয় এক অতল আঁধার বিশ্বলোকে। একটি বাক্য রচনা না করেও, যেকোনো সংবেদী মানুষ সংক্ষুব্ধ হতে পারে, দ্রোহী হতে পারে এবং রাষ্ট্র কর্তৃত্বের মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে মতান্তর প্রকাশ করতে পারে। একজন লেখক সকল রাজনৈতিক জন্তুর মতো রাজনীতির কলাকৌশল ও মতামত নিয়ে আক্রান্ত হবেন, এটি আমার কাছে খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এখন এই লেখকের সরকার কর্তৃত্ববাদী, সাংবিধানিক, সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী না স্বৈরতান্ত্রিক তার উপর ভিত্তি করে তোমার কথিত ‘বোধ’ নির্মাণ ও বিনির্মাণ হবে—তুমি বলবে কোনো এক বোধ কাজ করে,…হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম নেয়…। ইতিহাসের খেরোখাতায় সংবেদী মানুষের ‘রাজনৈতিক জীব’ হয়ে ওঠার নানান কাহিনি ছড়ানো। এক্ষুনি মনে পড়ছে রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন হচ্ছে অবিভক্ত পাকিস্তানের ঢাকায়; সুফিয়া কামালের বাড়িতে পুলিশ—এটি বন্ধ করে দিন। কিন্তু তাঁর মতো তিনি সোচ্চার হয়েছেন। কবি শামসুর রহমান বলছিলেন যখন নোয়াখালীতে তীব্র দাঙ্গা, তখন রায়পাড়া থানার কৈবর্ত জনগোষ্ঠীর সামনে তাঁর বাবা বন্দুক নিয়ে উন্মত্ত জনতার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। এটি কি তাঁর বাবার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ, না কি মানুষের চিরায়ত শুভবোধ? কবি আহসান হাবিবের যোগ্যতার শেষ নেই; কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যে ৪০ জনের সঙ্গে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন, তারা সবাই রবীন্দ্রবিরোধী।‌ শামসুর রহমান ক্ষোভে তাঁর সঙ্গে বহুদিন কথা বলেননি। স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য বদরুদ্দিন উমরকে ওই ষাটের দশকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খুৎবাতে গালাগালি করা হচ্ছে ধর্মদ্রোহী বলে। রাষ্ট্র বলছে, তিনি ধীরেন দত্তের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত। শেষমেষ চাকরি থেকে পদত্যাগ‌। ৬০ থেকে শুরু হয়ে ৮০-৯০এর উত্তাল দিনে আমাদের বহু অগ্রজ লেখক চিন্তক ভাবুক তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, বলা যায়। রোমান প্রবচন, রাষ্ট্র যখন নিজেই সন্ত্রাসী, তখন ম্যান ইজ আ উল্ফ টু ম্যান— পরিসংখ্যান বলে সারাদেশে ১৯৭১ এর গণহত্যায় এক হাজারের উপর বুদ্ধিজীবী হত্যা হয় তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য। তুমি মানবে প্রত্যেকটি মানুষ যেহেতু আলাদা আলাদা অবলোকনের উপায় খুঁজে পায়, আলাদা হয় তার অভিজ্ঞতার জগৎ, এবং সমাজে তার ভূমিকাও হয়ে পড়ে আলাদা। কাগজ-কলমে রাষ্ট্রীয় অন্যায্যতার কথা লিপিবদ্ধ করা আর রাজপথে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলিকাষ্ঠে জীবন দান নিশ্চয়ই সবাই সমান সাহসে করতে সক্ষম হয় না। এরকম একটি সাহসের কথা বলি: খুব কম আলোচিত হয়‌, কুর্ট আইসনার— তিনি ছিলেন একাধারে বিপ্লবী, সাংবাদিক এবং নাট্য সমালোচক‌। বাভারিয়ান সোভিয়েত রিপাবলিকের রাষ্ট্রপতি হন ১৯১৪ এ। তাঁর সঙ্গে কবি, লেখক ও নাট্যকারের সম্পর্ক ছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের থেকেও বেশি। তিনি ভাবতেন, রাজনীতি হলো শিল্প আর শিল্প হলো রাজনীতি। স্বপ্ন দেখতেন কবি-নাট্যকার, এঁরা বিপ্লবের বীজমন্ত্র দূর গ্রামে ছড়িয়ে দিবে। কিন্তু ১৯১৯, আমাদের সুবিখ্যাত একুশে ফেব্রুয়ারির দিন তাঁকে বিপ্লব বিরোধীরা মিউনিখের রাস্তায় হত্যা করে, হুমায়ন আজাদ, দীপেন বা অভিজিৎ-এর মতো।
আবার একেবারেই উল্টো পিঠে—এই দেশেই অন্য ঘটনা আছে: সামরিক অধিকর্তা যখন নিজেই স্বঘোষিত কবি তখন তার চারপাশে আমাদের কতিপয় লেখকের সম্মিলন ও গুঞ্জনপর্ব, যেন পদোন্নতি, জমির দলিল এবং দরদালানের চটজলদি বন্দোবস্ত হয়; অথবা কৃতজ্ঞতায় তারা সবাই তখন সভাকবি— যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেলের কাব্যগ্রন্থ। এও তো একপ্রকার রাজনীতি—হাক্সলির ভাষায়, এই প্রকার বুদ্ধি ব্যবসায়ীরা ইন্টেলেকচুয়ালি জায়েন্ট, কিন্তু morally dwar। এই আপসকামীতার একেবারে বিপরীত প্রান্তে লেখকদের বৈপ্লবিক লেখালেখি প্রসঙ্গে পৃথিবীতে সাহিত্যের একটি জনরা তৈরি হয়েছে— রেজিস্ট্যান্স লিটারেচার এবং প্রিজন লিটারেচার। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এই মুহূর্তে অব্যাহত পৃথিবীর নানান প্রান্তে; খবরের পাতায় দেখি— ফ্রান্স, আমেরিকা, ইসরাইল, আফগানিস্তান, ভারতসহ সকল দেশেই রাষ্ট্রীয় নিবর্তনের পক্ষে লেখক চিন্তক সোচ্চার।
আমার ভয়কাতুরে চিত্ত সকল দুর্বলতা সত্ত্বেও গভীরভাবে বিশ্বাস করে, সামাজিক মানুষ হিসেবে যেকোনো অন্যায্যতার বিপক্ষেই আমাদের দাঁড়ানো উচিত। নিজেকে শাসন করার জন্য ডেসমন্ড টুটুর কথাটি স্তত্রের মতো বলি: তুমি যদি অন্যায্যতার মুহূর্তে নিরপেক্ষ থাকো তাহলে তুমি স্বৈরাচারের পক্ষে। ধরো একটি হাতি ইঁদুরের লেজে পা দিয়েছে, আর তুমি বলছো আমি নিরপেক্ষ, ইঁদুর তোমার এই নির্দলীয় ভঙ্গি কখনো পছন্দ করবে না। সিমন দ্য ব্যুভেয়ারের একটি লেখা, কোনো উপন্যাস কি? স্মরণে পড়ছে না; একজনকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, এই রেজিস্টেন্স মুভমেন্টে তোমার অবদান কী? সে তখন জবাব দিচ্ছে, একজন ফরাসি হয়েও আমি যে আজও জীবিত, এটাই আমার অবদান। কথাটি আমার স্বপক্ষে জুড়ি : নির্বুদ্ধিতায়, লোভে, ক্রমাগত আপস করতে করতে— এই যে বেঁচে আছি, ভয়ংকর-সহিংস-পশ্চাদপদ-কূপমণ্ডক এক জনপদে এখনো—বলতে পারো, এইটুকুই আমার অবদান ও রাজনীতির জ্ঞানগম্মি। পেছন ফিরে দেখি—-অসম্মানে-অবহেলায়, জনপদের নামহীন গোত্রহীন মানুষের সঙ্গে—–সংযুক্ত হতে হতে, বিযুক্ত হতে হতে ভুলমেধায়, ভুল উচ্চারণে একটি ব্যক্তিগত পথ খুঁজেছি অনন্ত—-‘আত্ম দীপো ভব’—-তুমি নিজে নিজের পথনির্দেশক আলো হয়ে ওঠো….।

শুদ্ধস্বর: আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন।

মামুন হুসাইন: খুব ভেবেচিন্তেই বলি– তোমার মতো আমার কয়েক ঘর আত্মীয় আছে ভূ-ভারতে কেবল মাত্র তাঁরাই ভাবে আমি বোধহয় হিজিবিজি কিছু লিখতে শিখেছি। পৃথিবীতে এত সব মহার্ঘ্য রচিত হয়ে আছে যে তার কিছু মাত্র আস্বাদনের আগেই জীবনের ‘আলো ক্রমশ নিভিয়া আসিতেছে’! সামান্য যা কাগজে ছাপা হয়েছে, তা ঐসব দূর-নমস্য-বাতিঘরের চুইয়ে পড়া আলো মাত্র। আমি তো রবিঠাকুর, দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়ের মতো কোনো মৌলিক লেখক নই—- ফলে ঘাটতি পূরণের জন্য, লেখার চেয়ে পড়াটাই বেশি হয়। বলতে পারো নানান বইপুস্তক গুছিয়ে মিথ্যে-মিথ্যে তীব্র পড়ার আয়োজন করি মাত্র। তারপর কিছু একটা বীজমন্ত্র উড়ে এলে, তা গোছাতে যে এতসব নথিপত্র দেখতে বসি, যে সামান্য একটি অনুচ্ছেদ রচনার আগেই ‌মস্তিষ্কের শক্তি উবে যায়। ফলে আমার আর লেখক-জন্ম উদযাপন হয় না; রচিত হয় একেবারেই সাধারণ এক উন্মুল পাঠকের জীবন। বলতে পারো, কিছু না বুঝেই যত্রতত্র যা পাই তাই পড়তে থাকি।
একা জীবনানন্দ খুব শক্ত ধাতের মানুষ ছিলেন, এই ব্যাখ্যা খোঁজ করতে ইচ্ছে করে কখনো, যখন দেখি লোকালয় ছেড়ে তিনি কেবল হাঁটছেন; একেই কি বলে, দ্যা আর্ট অফ ওয়ার্কিং? কখনো ভেবেছি —-নিৎসের মতো শক্ত গোঁফওয়ালা মানুষ, চাবুকে আহত ঘোড়ার গলা জড়িয়ে হাপুস কান্নারত; এই বিষয়ে কিছু লেখার আছে কি? সংগীত মস্তিষ্কে কি কাজ করে— কখনো ভাবি এ বিষয়ে একটি মলিন পাঠ রচনা করব। সম্প্রতি কোথাও পড়লাম, পাকিস্তানের তমঘা-ই- ইমতিয়াজ পদক বর্জনকারী, তেজস্বিনী সুফিয়া কামাল প্রতি শনিবার মধু আর দারুচিনি মিলিয়ে একটি স্বপ্ন পাওয়া ওষুধ বিতরণ করতেন। ঢাকায় ওঁর বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটার সময় আঁধার আঁধার পরিত্যক্ত ঘরের বারান্দায় উঁকি দিই রাস্তা থেকে, আর মনে মনে প্রজ্ঞাপন লিখি— এখন এই ‘সাঁঝের মায়া’ নামক গৃহ থেকে কোনো দারুচিনি-মধু পাওয়া যাবে না! বলতে পারো বইয়ের সঙ্গে আমার কথাবার্তা এরকম বিচিত্র দুষ্কর্মে লিপ্ত হয় অহরহ।
অতি সম্প্রতি একটি লেখা আলিম আজিজকে দিয়েছি—ফার্মার্স সুইসাইড ভেবে, ‘জলছাপের চিত্রকলা’ নাম। এখন ভবিষ্যৎ জানে–
লেখাজোখার কারখানায় আমার শিক্ষানবিশী কাল আরও খানিকটা বাড়বে, নাকি সামনেই দূর গির্জা ঘরের অন্তিম ঘণ্টাধ্বনি! জীবন যখন ভাবি প্রকৃতির সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, তখন কিয়ের্কেগাদ লিখছেন ১৮৪৩ এ তাঁর আয়েদার / অর গ্রন্থে : কি অন্তঃসারশূন্য আর অর্থহীনই না এ জীবন! আমরা মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার জন্য লাশ নিয়ে গোরস্তানে যাই, তার ওপর তিন কোদাল সমান মাটি ফেলে দিয়ে জুড়িগাড়ি করে ঘরে ফিরে এসে এইভাবে সুখ পেতে থাকি যে, কী দীর্ঘ জীবন-ই না আমাদের জন্য অপেক্ষমান! বলতে কি, জীবনের অনেক মৌল অনুষঙ্গ সন্দেহ করার সাহস এইভাবে হয়তো কখনো অনুবাদ করার প্রণোদনা ছড়ায়; অথবা তর্কে-ঝগড়ায় ক্লান্ত হয়ে আবারও দুর্বল মেধায় স্থির করি —জীবন এক আশ্চর্য-বিপজ্জনক-মনোহর কাহিনিই বটে!

 

 

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শুদ্ধস্বর
error: Content is protected !!